হৃদয়_রেখেছি_জমা,পর্বঃ১৫,১৬
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৫
রাতের খাবারের জন্য মেহরিনকে ডাকতে এসেছিলো মাহমুদ। মেহরিন ওয়াশরুমে। অপেক্ষা করতে করতে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো সে। শরীর ভীষণ টায়ার্ড। সারাদিন বড্ড ধকল গেছে। আচমকাই খাটের ওপর মেহরিনের ফোনে মেসেজ টোন বেজে উঠলো। পাশ ফিরতেই মেসেজের লিখাটা চোখে পড়লো তাঁর। ভিসা সংক্রান্ত কোন একটা মেসেজ। খানিকটা অবাক হলো সে। ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ ওপেন করলো ভেতরে কি লিখা আছে সেটা পড়ার জন্য।
কিন্তু পড়ার আগেই মেহরিন ছোঁ মেরে তাঁর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো। নাকমুখ কুঁচকে বিরক্ত মুখে বললো,’এসব কি ধরনের অসভ্যতা! তুমি আবার আমার ফোনে হাত দিয়েছো?’
-‘কিসের ভিসা করাতে দিয়েছো তুমি?’
ফ্যাকাসে হয়ে গেলো মেহরিনের চেহারা। মাহমুদের অজান্তেই দেশ ছেড়ে পালানোর প্ল্যান করছে সে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। সব কিছু জানার পর, মাহমুদ তাঁকে ছাড়বে না এটা সে ভালো করেই জানে।
কিন্তু সেও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। তাঁর এতদিনের ত্যাগ, পরিশ্রম, সংযম কিছুতেই বিফলে যেতে দেবে না। দরকার হলে সবকিছু ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবে। তবুও সারাজীবন ব্যর্থতার কষ্ট বয়ে নিয়ে বেড়াতে পারবে না। আতংকিত চেহারা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বললো,’আমার নয়।’
-‘কার?’, ভ্রু কুঁচকালো মাহমুদ।
-‘আছে একজন।’
-‘সে কে?’
-‘তা জেনে তুমি কি করবে? তাছাড়া বললেও তুমি চিনবে না।’
চট করে তাঁর হাত থেকে আবার ফোনটা নিয়ে নিলো মাহমুদ। হাত মুড়িয়ে পেছনে লুকিয়ে বললো,’সত্যি করে বলো। তোমার মাথায় কি চলছে?’
-‘আমার ফোন দাও!’, আচমকাই রাগে জ্বলে উঠলো মেহরিন।
-‘আগে আমার প্রশ্নের জবাব।’
-‘তোমার কোন প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই।’
-‘আমি চাইলেই তোমাকে বাধ্য করতে পারি?’
তাচ্ছিল্যভরে হাসলো মেহরিন। যদিও ভেতরে ভেতরে নার্ভাস সে। কিন্তু বুঝতে দিলো না। স্বভাবসুলভ গম্ভীর কন্ঠে বললো,’মেহরিন শারাফাতকে বাধ্য করবে এমন এজেন্ট এখনো এনএস আই তে তৈরীই হয় নি। ইউ নো দ্যাট? অ্যাম আই রাইট?’
-‘ইউ হ্যাভ টু আন্সার মি!’ অধৈর্য শোনালো মাহমুদের কন্ঠস্বর।
-‘আই ও’ন্ট!’
-‘প্লিজ!’, বাধ্য হয়ে গলা নরম করলো মাহমুদ। সে বুঝে গেছে মেহরিনকে খেপিয়ে লাভ নেই। উল্টো হিতে বিপরীত হবে। আজকে রাতে মেহরিনের সঙ্গে কোনরকম ঝগড়া করতে চায় না সে।
মেহরিন চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো,’আমার মামাতো ভাইয়ের। হায়ার স্টাডিজ এর জন্য দেশের বাইরে যাবে সে। সেইজন্য ভিসা করাতে দিয়েছিলাম।’ কথাগুলো বলার সময় কোনরকম উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেলো না তাঁর কণ্ঠে কিংবা চেহারায়।
ফোনটা আলতো করে তাঁর দিকে ছুঁড়ে মারলো মাহমুদ। ঠোঁট উলটে বললো,’ সামান্য একটা কথা নিয়ে এমন রহস্য করার কি আছে? প্রথমে বললেই তো হতো।’
-‘ও আমাকে পছন্দ করে। মাঝেমাঝে উল্টোপাল্টা মেসেজ পাঠায় তাই তোমাকে দেখাতে চাই নি।’, এবারেও খুব দ্রুত মিথ্যে বানিয়ে ফেললো মেহরিন।
মাহমুদ হাসলো। বলা বাহুল্য, মেহরিনের কথাগুলো বিশ্বাস করেছে সে। তাই ভেতরের লেখাগুলো পড়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করলো না। মুচকি হেসে বললো,’ইউ থিংক, আই উইল বি জেলাস? এখনো আমার ওপর এত ভরসা?’
মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো মেহরিন।মাহমুদ তাঁর কথা বিশ্বাস করেছে। এটাই অনেক! সোজাসুজি কোন জবাব না দিয়ে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। তারপর খানিকটা নির্দেশের সুরেই বললো,’তুমি বেরোও রুম থেকে আমি ঘুমাবো।’
-‘ডিনার করবে না?’
-‘না।’
-‘কেন?’
-‘আমার খিদে নেই।’
-‘সারাদিন তো কিছু খাও নি। চলো খাবে চলো।’
-‘বললাম তো আমার খিদে নেই।’
কথা না বাড়িয়ে তাঁকে পাঁজকোলা করে তুলে নিলো মাহমুদ। একেবারে ডাইনিং টেবিলের সামনে বসিয়ে দিয়ে বললো,’আমার রাগ খাবারের ওপর দেখানোর প্রয়োজন নেই। আমি তোমার সামনেই আছি। ইচ্ছে হলে মেরে হাতপা ভেঙ্গে দিতে পারো।’
-‘তোমার ওপর রাগ করতে যাবো কেন? আমি তো বলেছি আমার খিদে নেই।’
-‘খামোখা কথা বাড়িয়ো না মেহরিন। আমি জানি তোমার খিদে পেয়েছে।’
আর কথা বাড়ালো না মেহরিন। বাস্তবিকই তাঁর খিদে পেয়েছে। মাহমুদ যাওয়ার পর থেকে একফোঁটা পানিও খায় নি। পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। খাওয়া শেষ করে চুপচাপ রুমে চলে গেলো। মাহমুদও পেছন পেছন গেলো।
ভেতরে ঢোকার আগেই মেহরিন সতর্ক করে দিয়ে বললো,’আমি তোমার কথা রেখেছি। এবার তুমি বেরোও। আমি ঘুমাবো।’
-‘তো ঘুমাও না। আমি কি ধরে রেখেছি?’
-‘ঘুমাবো। আগে তুমি বেরোও!’, এবারে কড়া গলায় ধমক দিলো মেহরিন।
-‘আমার জামাকাপড় সব এই ঘরে। আমি চেইঞ্জ করবো।’, মুচকি হেসে জবাব দিলো মাহমুদ।
ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো মেহরিন। অতঃপর দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। বিরক্তিতে কপালখানা কুঁচকে গেছে তাঁর। মাহমুদ সেদিকে তাকিয়ে আরেকবার হাসলো। লোকে প্রিয়তমার হাসিমুখ দেখে প্রেমে পড়ে। আর সে ডুবেছে প্রিয়তমার রাগ, অভিমান আর কঠোরমূর্তি দেখে। হায়রে কপাল! সত্যিই আশ্চর্য রকমের রাগ মেহরিনের! কি অদ্ভুত মায়া!
-‘হাসছো কেন?’
-‘মন চেয়েছে তাই হাসছি! তোমার সমস্যা?’
-‘হ্যাঁ সমস্যা। আমার অসহ্য লাগছে।’
-‘কিচ্ছু করার নেই। আমার বাসা, আমার ঘর, আমার মুখ! আমি হাসবো। কারো অসুবিধে হলে সে চোখ কান বন্ধ করে রাখতে পারে।’
-‘বাসার খোঁটা দিচ্ছো? আমি ইচ্ছে করে তোমার বাসায় এসেছি? তুমি জোর করে আমাকে নিয়ে এসেছো।’
-‘ইউ শুড থ্যাংক মি! আমি নিয়ে না এলে এতক্ষনে জেলে থাকতে।’
রাগে চুপ করে গেলো মেহরিন। চুপচাপ খাটের ওপর গিয়ে বসলো। আলমারি থেকে টিশার্ট আর ট্রাউজার বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো মাহমুদ।
সে ভেতরে ঢোকার পরই ব্যাগ থেকে ফোন বের করে চুপিচুপি সোহাগের নাম্বারে ডায়াল করলো মেহরিন। উদ্দেশ্য সায়েদের কোন খবর আছে কিনা সেটা জানা। দুবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ করলো সোহাগ। মেহরিনের প্রশ্ন শুনে বিস্মিত কন্ঠে বললো,’সায়েদ তো ধরা পড়েছে মেহরিন! মাহমুদ ভাই তোমাকে বলে নি?’
অবাক হলো মেহরিন! সায়েদ ধরা পড়েছে? মাহমুদ তাঁকে বললো না কেন?
ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই অসহ্য রাগে দাঁত কিড়মিড় করলো মেহরিন। ফোন রেখে চুপচাপ মাহমুদের বেরোনোর পর্যন্ত অপেক্ষা করলো।
★
ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই মাহমুদের নাক বরাবর প্রচণ্ড জোরে ঘুষি পড়লো। নাকে হাত দিয়ে মেহরিনের রণচণ্ডী মূর্তির দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো সে।
-‘মিথ্যে কেন বলেছো শয়তান! সায়েদ ধরা পড়েছে। কি ভেবেছিলে আমি খবর পাবো না? মিথ্যেবাদী! অসভ্য, জংলি!’, বলতে বলতেই আবার ঘুষি মারলো মেহরিন।
নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে! তথাপি নাক ডলতে ডলতে শব্দ করে হাসলো মাহমুদ। পাশ কাটিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দেখলো নাক ফুলে গেছে কিনা। ভয়ানক লাল হয়ে গেছে! হাতে রক্ত! এরপরেও মুখের হাসি বজায় রেখে বললো,’এত জোরে ঘুষি দিলে মরে যাবো মেহরিন।’
মেহরিন তাঁর কথায় পাত্তা না দিয়ে কাঠকাঠ গলায় বললো,’আমি এক্ষুনি বাসায় ফিরে যাবো।’
-‘আমার গাড়ি নষ্ট!’, রুমাল দিয়ে নাক মুছলো মাহমুদ।
-‘মিথ্যে কথা। চাবি দাও আমি পরীক্ষা করবো।’
-‘সত্যি বলছি। এই দেখো, আমার ভাঙ্গা নাক ছুঁয়ে বলছি!’
ফের ঘুষি মারতে চাইলো মেহরিন। তড়িৎগতিতে সামনে থেকে সরে গেলো মাহমুদ। চোখ বড়বভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,’সত্যি সত্যি মেরে ফেলবে নাকি?’
-‘গাড়ির চাবি দাও।’
-‘বললাম তো গাড়ি নষ্ট।’
তীক্ষ্ণ শিকারির ন্যায় জ্বলজ্বল দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে রইলো মেহরিন। তাঁর কথাটা সে বিশ্বাস করতে পারছে না। মাহমুদ ফের হেসে ফেললো। বললো,’ভয় পাচ্ছো? কদিন বাদে তো আমার সঙ্গেই থাকতে হবে। এক বাসায়, এক কামরায় , একই খাটে। দুজনে পাশাপাশি!’
-‘ভয়? কিসের ভয়?’
-‘একসঙ্গে থাকার ভয়?’
-‘কনফিডেন্স থাকা ভালো মি.মাহমুদ সিদ্দিকি কিন্তু ওভারকনফিডেন্স নয়।’
-‘তাই নাকি?’
-‘ইয়েস। মেহরিন শারাফাত যখন একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে তোমার কাছে থাকবে না তারমানে থাকবে না।’
-‘আচ্ছা?’, মাহমুদ সকৌতুকে হাসলো।
-‘হ্যাঁ। এখনো সময় আছে নিজের ইমোশনকে কন্ট্রোল করে নাও।’
জবাবে মাহমুদ ধীরস্থির ঠান্ডা, শীতল কন্ঠে বললো,’তুমি একবার নয় একহাজারবার সিদ্ধান্ত নিলেও আমার কথাই শেষ কথা হবে। এই কথাটা আজকের তারিখ সহ খাতায় লিখে রাখো। আই প্রমিস ইউ দ্যাট!’
মুখ ভেংচি কাটলো মেহরিন। সেই সাথে ঠোঁট উল্টালো। তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,’ফোর্স করার কথা ভাবছো নাকি?’
-‘ডিপেন্ডস অন সিচ্যুয়েশন!’
-‘সিচ্যুয়েশন?’
-‘ইয়েস! সিচ্যুয়েশন। তুমি যদি সেরকম কোন সিচ্যুয়েশন ক্রিয়েট করো তাহলে আমি বাধ্য হবো তোমাকে জোর করতে।’
মুখে হাসি বজায় রাখলেও মনে মনে মেহরিন ঠিকই বুঝলো এত সহজে তাঁকে যেতে দেবে না মাহমুদ। আপাতত এই নিয়ে তর্ক করতে মন চাইছে না। হাল ছেড়ে দিয়ে বললো,’ঠিক আছে এসব আলোচনা পরে হবে। এখন তুমি ঘর থেকে বেরোও।
-‘কেন থাকলে কি হয়?’
-‘মানে?’
-‘মানে এক বিছানায় তুমি আর আমি একটু ঘুমাতাম আরকি! কতদিন তোমাকে জড়িয়ে ধরি নি!’, মুখে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠলো মাহমুদের।
-‘ফালতু কথা বাদ দাও।’
-‘ফালতু কথা কোথায় বললাম? যেটা সত্যি সেটাই তো বললাম।’
-‘আবার?’, চোখ পাকালো মেহরিন।
-‘ঠিক আছে আমি আর কিছু বলবো না। কিন্তু তুমি একটা ভালোবাসার কথা বলো।’
মেহরিন তাঁর ভাঙ্গা নাকের দিকে ইশারা করে বললো,’এখনো শিক্ষা হয় নি দেখছি।’
-‘এইজন্যই তো বলছি একটু ভালোবাসার কথা বলো। নইলে, এই যে আমার নাক ভেঙ্গে দিয়েছো এই ভেবে পরে তোমারই আফসোস হবে।’
-‘তুমি কি যাবে নাকি আমি বেরিয়ে যাবো?’
মেহরিন রেগে যাচ্ছে বুঝতে পেরে বিছানায় বালিশ নিয়ে বেরিয়ে গেলো মাহমুদ। যাওয়ার সময় মেহরিনকে চমকে দিয়ে ওর একেবারে কাছে এগিয়ে গিয়ে মুখে একটা ফুঁ দিয়ে বললো,’এক খাটে কেন? এক বিছানায়ও যদি তুমি আমাকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেও ঘুমাও তবুও তোমার কোন অসম্মান আমি করবো না মেহরিন। এইটুকু ভরসা আমার ওপর তুমি রাখতে পারো।’
সে চলে গেলে মেহরিন মূর্তি মতন সেখানে কিছুক্ষন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাঁর বুকের ভেতরটা হু হু করছে। ডান হাতের মুঠোয় দিকে চোখ পড়তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। হাতে রক্ত লেগে আছে! রাগে তখন বুঝতে না পারলে এখন বুঝতে পারছে ঘুষিটা বেশ জোরেই লেগেছে মাহমুদের।
রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো সে। পাশের রুমে উঁকি দিতেই দেখলো ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাকে ওষুধ লাগাচ্ছে মাহমুদ।
ধীর পায়ে কাছে এগিয়ে গেলো। আয়নার ভেতর দিয়ে তাঁকে দেখতে পেয়ে হাসলো মাহমুদ। মুচকি হেসে বললো,’বলেছিলাম না পরে কষ্ট হবে? এখন হলো তো?’
মেহরিন জবাব দিলো না। অনুশোচনা হচ্ছে তাঁর। রাগটা মাহমুদের সঙ্গে একটু বেশিই করে সে। নিজের অজান্তেই মুখটা করুণ হয়ে গেলো তাঁর।
মাহমুদ ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে খুব স্বাভাবিকভাবেই বললো,’যাও, যাও শুয়ে পড়ো। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুঃখ পাওয়ার মতন কোন ঘটনা ঘটে নি। তোমার সিমপ্যাথি পাওয়ার জন্য ইচ্ছে করে কথাগুলো বলেছিলাম।এখন তো দেখছি সত্যি সত্যি ইমোশোনাল হয়ে পড়েছো।’
মেহরিন অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মাহমুদের শান্ত সুন্দর মুখটার দিকে। এত ভালোবাসার পরেও একটা মানুষকে কেবল কষ্টই দিয়ে যাচ্ছে সে। ভাবতেই নিজের রাগ হলো। ক্ষণকালের জন্য আত্মবিস্মৃত হলো সে। এগিয়ে গিয়ে মাহমুদের পায়ের পাতার ওপর ভর করে দাঁড়ালো। দুহাতে মাহমুদের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,’আমি তোমার ভালোবাসা চাই!’
মাহমুদ হাতের ওষুধের ক্রিমটা বেসিনের ওপর রেখে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো মেহরিনকে। কপালে আলতো চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিলো তাঁকে। মেহরিন আচ্ছন্নের মত তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে চুপচাপ বুকের সঙ্গে মিশে রইলো।
মেহরিনকে নিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে পাশে রুমে ঢুকলো মাহমুদ। বিছানায় ওকে শুইয়ে দিলে গায়ের ওপর কাথা টেনে দিলো। তারপর মিষ্টি হেসে বললো,’গুড নাইট!’
বাতি নিভিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। মেহরিন বালিশে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললো। নিজের দুর্বলতা মাহমুদের কাছে প্রকাশ করে ফেলেছে সে। একবারও ভাবে নি এর পরিনতি কি হতে পারে! রাগে দুঃখে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো আজকের পর থেকে আর মাহমুদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখবে না সে।
.
.
চলবে
#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৬
‘মাহমুদকে তুমি ভালোবাসো?’, কোনরকম ভনিতা ছাড়াই সোজাসুজি প্রশ্নটা করলো মেহরিন। এইমুহূর্তে তাঁর কেবিনে মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসে আছে সে এবং এনা। দুজনেই ভেতরে ভেতরে নার্ভাস। লাঞ্চ আওয়ার। সবাই যার যার মত করে ব্যস্ত। তাই নিরিবিলিতে বসে এনার সঙ্গে বিষয়টা আলাপ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো মেহরিন। তাঁর প্রশ্নের জবাবে এনা নিরস ভঙ্গিতে হাত ঘড়ি চেক করলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়েই শান্ত কন্ঠে বললো,’সে আমাকে ভালোবাসে না।’
যদিও একবাক্যেই জবাবটা দিয়েছে এনা, তথাপি ভাবপূর্ণ এই বাক্যটির সামগ্রিক অর্থ বুঝতে কোন অসুবিধে হলো না মেহরিনের। পাল্টা কোন প্রশ্ন করলো না সে। মুচকি হেসে বললো,’করবে, করবে! দরকার হলে আমি তোমাকে হেল্প করবো।’
এনা সামান্য হাসলো। তাতে বিশেষ কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেলো না। বললো,’হেল্প? সেটা কেমন?’
-‘মাহমুদের পছন্দ অপছন্দ গুলো নিয়ে একটু আলোচনা করবো তোমার সঙ্গে। তুমি জাস্ট আমাকে এফোর্ট দেবে। বাকিটা আমি দেখবো।’
-‘বিশেষ কোন লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না।’
-‘ঠিক হবে। তোমাকে পছন্দ না করে সে যাবে কোথায়?’
-‘পছন্দ তো সে আমাকে এখনো করে। কিন্তু ভালোবাসা? সেটা কি আদৌ সম্ভব?’
-‘কেন সম্ভব নয়? পছন্দ যখন করে তখন ভালোও বাসবে।’ তারপর একটুখানি থেমে বললো,’বাই দ্যা ওয়ে? তুমি কি আমার কথা ভাবছো?’
এনা জবাব দিলো না। কারণটা তাই। মেহরিন ফের মুচকি হেসে বললো,’এটা ঠিক। ও হয়ত আমাকে সহজে ভুলতে পারবে না। কিন্তু চাইলে তোমাকে ভালোবাসা সম্ভব!’
-‘আমি মাহমুদকে চিনি। ও সেটা কখনোই চাইবে না।’
-‘এত সিউর হয়ে কিভাবে বলছো? হতেও তো পারে?’
এনা এবার খানিকটা শব্দ করে হাসলো। বললো,’আপনি কখনো মা হতে পারবেন না জেনেও যে মানুষটা আপনি বলতে দিশেহারা তাঁকে আপনি কেন এতটা দুর্বল ভাবছেন মেহরিন আপু? ইনফ্যাক্ট আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না আপনি হঠাৎ এসবের মধ্যে আমাকে কেন জড়াচ্ছেন?’
-‘কারণ তুমি মাহমুদকে ভালোবাসো। আমি চাই ও তোমাকে নিয়ে সুখি হোক।’
-‘সেটা কোনদিন সম্ভব না। মাহমুদের সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে শুধু আপনিই আছেন। আপনার জায়গা আমি কোনদিন নিতে পারবো না।’
-‘বেশ। তবে তোমার জন্যে নাহয় একটুখানি জায়গা তৈরী করে নাও?’
-‘চাইলেই কি সব সম্ভব? মাহমুদ আপনাকে পাগলের মত ভালোবাসে।’
মেহরিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’আমি এখন ওর অতীত।’
-‘মোটেও না। এখনো আপনার কোন বিপদের কথা শুনলে ও পাগল হয়ে যায়। নিজের জীবনের পরোয়া পর্যন্ত করে না। আপনার অজান্তে সব সময় সেইফগার্ড হয়ে হয়ে আপনাকে রক্ষা করেছে। সেই মানুষটাকে আপনি আমাতে আকৃষ্ট করার কথা ভাবছেন শুনলে সে কতটা কষ্ট পাবে বুঝতে পারছেন?’
বহু কষ্টে নিজের চোখের পানি সামনে নিলো মেহরিন। চাপা কন্ঠে বললো,’বাস্তবতা কত কঠিন তুমি জানো না এনা। একটা সন্তানের জন্য আমার বাবা আমার মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। অথচ তারাও ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন!’
কথা শেষ করে কান্না আর চেপে রাখতে পারলো না মেহরিন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো। অবাক হলো এনা। এই প্রথম মেহরিনকে এমন অসহায় দেখছে সে। সদাগম্ভীর, বদমেজাজি, রাগী এই মেয়েটার এমন রূপ ক্ষণকালের জন্য বাক্যহারা করে দিলো তাঁকে। তারপর ধীরে ধীরে একটা হাত মেহরিনের মাথায় রেখে বললো,’আপনি কাঁদবেন না প্লিজ। সবাই এক রকম হয় না। তবুও আপনি যদি চান আমি আপনার কথা শুনবো।’
চোখ মুছে সোজা হয়ে বসলো মেহরিন। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বললো,’সরি। একটু ইমোশনাল হয়ে গেছিলাম। কিছু মনে করো না।’
এনাও আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলো না প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললো,’লাঞ্চের সময় আর বেশিক্ষণ নেই। যাবেন না?’
-‘তুমি যাও। আমি আসছি।’
এনা বেরিয়ে গেলে চুপিচুপি পুনরায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো মেহরিন। এই দুর্বিষহ জীবনটার প্রতি বিতৃষ্ণা ধরে গেছে তাঁর। কোন কিছুতেই এখন আর মন টেকে না। মাঝেমাঝে মরে যেতে মন চায়। কি লাভ বেঁচে থেকে? আবার মাঝেমাঝে মনে হয় সবছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে পারলে ভালো হতো। অন্তত মাহমুদের চোখের সামনে থেকে অনেক দূরে।
★
দুদিন পরের ঘটনা। সকাল বেলা নিজের চেম্বারে বসে আয়েশ করে নিউজপেপার পড়ছিলো মাহমুদ। আজকে হাতে বিশেষ কাজ নেই। অল্প কিছুক্ষন থেকে বাসায় ফিরে যাবে।
হঠাৎ দরজায় নক শুনে খবরের কাজ থেকে মুখ না তুলেই বললো,’কাম ইন।’
ফুলহাতা ব্লাউজের সঙ্গে গাঢ় সবুজ রংয়ের একটা কাতান শাড়ি পড়ে এসেছে এনা। সেই সাথে হালকা সাজ। চোখে কাজল, গাড় লাল লিপস্টিক। চুলগুলো খোঁপা বাধা। কানে সিলভার কালারের ইয়ারিংস। বেশ আকর্ষণীয় লাগছে দেখতে। ভেতরে ঢুকে মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিলো। কিন্তু মাহমুদের দৃষ্টি তখনো খবরের কাগজে। এনার উপস্থিতি তখনো টের পায় নি সে।
অবশেষে পারফিউমের মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে লাগতেই খবরের কাগজ থেকে মুখ ফেরালো। সামনে দণ্ডায়মান নারীমূর্তিটির সাজসজ্জার বহর দেখে ক্ষণকালের জন্য নির্বাক হয়ে গেলো। তারপর, বিস্ময় ভাব কাটিয়ে মিষ্টি হেসে প্রশ্ন করলো,’হঠাৎ শাড়ি?’
-‘মেহরিন আপু পরিয়ে দিয়েছে। তোমাকে ইমপ্রেস করার জন্য।’, বলেই হেসে কুটিকুটি হলো এনা।
এমন অপ্রত্যাশিত জবাবে মাহমুদের হতবাক। চোখমুখে সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো এনার দিকে! তারপর আচমকাই হেসে দিয়ে বললো,’তোমার মেহরিন আপুকে বলে দিও তাঁর চেষ্টা সফল। আই অ্যাম ইম্প্রেসড! সত্যিই ভীষণ সুন্দর লাগছে তোমাকে।’
-‘থ্যাংকস ফর ইউর কমপ্লিমেন্ট!’
-‘তারপর? শাড়ি পরেই কাজ করবে সারাদিন?’
-‘উঁহু। ছুটি নিয়েছি। বাসায় ফিরে যাবো।’
-‘ও আচ্ছা।’
-‘তার আগে একটু শপিংয়ে যাবো ভাবছি। তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে? তোমার সময় হবে?’, দ্বিধান্বিত কন্ঠস্বর এনার।
হাতে কাজ নেই। রাজি হয়ে গেলো মাহমুদ।সহাস্যে মাথা নাড়িয়ে বললো,’তোমার জন্য আমি সবসময়ই ফ্রি সুইটহার্ট!’ এনার সঙ্গে মজা করে প্রায়শই এই ধরনের কথাবার্তা বলে সে। অতএব সিরিয়াসলি নিলো না এনা। কিন্তু মনে মনে বেশ খুশি হলো।
-‘ঠিক আছে। আমি ব্যাগ নিয়ে আসছি।’
দরজার আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে সবই শুনছিলো মেহরিন। আপনমনেই হেসে ফেললো। তাঁর চেষ্টা সফল! অথচ বিরহের বেদনায় চোখভর্তি পানি টলমল! এনা বেরোবে বুঝতে পেরে দ্রুত দরজার পাশ থেকে সরে নিজের কেবিনের দিকে চলে গেলো।
★
সারাদিন আর শত চেষ্টা করেও আর কাজে মন বসাতে পারলো না। রাত নটার দিকে নিজের চেম্বার থেকে যখন বেরোলো তখন অফিস মোটামুটি নিরব। সবাই বেরিয়ে গেছে। পকেট থেকে চাবি বের করলো রুমের তালা বন্ধ করার জন্য। তার আগেই কেউ একজন হেঁচকা টানা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো তাঁকে। টাল সামলাতে না পেরে মানুষটার জ্যাকেটের হাতা শক্ত করে খিঁচে ধরলো সে। ভয়ে ভয়ে মাথা তুলে অবিশ্বাস্য কন্ঠে প্রশ্ন করলো,’তুমি?’
-‘হ্যাঁ আমি।’
-‘ছাড়ো আমাকে।’, ধাক্কা দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো মেহরিন।
-‘এনার মাথায় এসব উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা কেন ঢোকাতে চাইছো?’
-‘আমি কিছু ঢোকাতে চাইনি। ও নিজেই তোমাকে ভালোবাসে।’
-‘এই কথা তোমাকে বলেছে ও?’
-‘হ্যাঁ।’
রাগে কথা বলতে পারলো না মাহমুদ। বেশকিছুক্ষণ সময় নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,’তাহলে এখন আমার কি করণীয়?’
-‘ওকে বিয়ে করে সুখে সংসার করো।’
-‘তাই নাকি?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘ঠিক আছে করবো। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।’
-‘কি শর্ত?’
-‘আমি এনাকে বিয়ে করবো। তুমি আমাকে বিয়ে করবে। সোহাগ তোমাকে বিয়ে করবে। এভাবে বিয়ে করতে করতে পুরো একটা সার্কেল তৈরী করে ফেলবো আমরা। কারণ এখানে আমরা চারজনই একে অপরকে ভালোবাসি।’
-‘এসবের মধ্যে সোহাগকে টানছো কেন?’
-‘কারণ সোহাগও তোমাকে ভালোবাসে।’
-‘সোহাগ সেটা একবারও বলেছে তোমাকে?’
-‘না বললেও বোঝা যায়।’
-‘হ্যাঁ। তুমিতো সব বুঝে বসে আছো।’
-‘সবই তোমার কৃপা। তুমিই তো আমার গুরু।’
-‘তাহলে বিয়েটা কেন করছো না?’
-‘আগে গুরু, তারপর শিষ্য!’
-‘আমি সোহাগকে বিয়ে করলে তুমি এনাকে বিয়ে করবে?’
-‘বিয়ে আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে করবো না।’, সরাসরি নাকচ করে দিলো মাহমুদ।
-‘লজ্জা করে না তোমার?’
-‘কিসের লজ্জা?’
-‘এই যে বারণ করার পরেও বেহায়ার মত আমার পেছনে পড়ে আছো?’
মাহমুদের মুখটা হঠাৎ করুণ হয়ে গেলো। অসহায়, মলিন মুখে বললো,’আমি বেহায়া? আমার ভালোবাসার এই মূল্য তোমার কাছে? শুধুমাত্র ভালোবাসি বলে এভাবে অপমান করতে পারলে আমাকে? একবারও আমার কষ্টটা বোঝার চেষ্টা করলে না? কেন মেহরিন?’
মেহরিন জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই রইলো। ইচ্ছে করে মাহমুদকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কথাগুলো বলেছে সে। কিন্তু তাঁকে অবাক করে আচকমকাই দিয়ে হো!হো! করে হেসে উঠলো মাহমুদ। হাসতে হাসতেই বললো,’কি ভেবেছিলে? সত্যি সত্যি বলছিলাম? হাহ্! নো! নেভার মিস মেহরিন শারাফাত! এই কথাগুলো আমি জীবনেও বলবো না তোমাকে। আমি তোমার মতন বেকুব আর মাথামোটা নই যে কেউ আমাকে খেপাতে চাইলেই খেপে যাবো। আই অ্যাম মাহমুদ সিদ্দিকি। আই নো মাই জব বেটার দ্যান এনি আদার!’
মনে মনে নিজের ওপর হতাশ হলো মেহরিন! সবাই তাঁকে একরোখো বলে অথচ তাঁর চাইতে অনেক বেশি একরোখা এবং জেদী মাহমুদ ! এতদিন এই কথাটা বুঝতে না পারলেও আজকে বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র মাহমুদ নয়। অতএব ঠান্ডা মাথায় কার্য সমাধানের চিন্তা করলো। কিন্তু ধ্যান ভঙ্গ হলো আচমকা কোমরে চাপ পড়ায়। ঠেলে তাঁকে দেওয়ালের সঙ্গে চেপে ধরেছে মাহমুদ। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে বললো,’মুখে বলো, ভালোবাসো না। অথচ আমার পছন্দ অপছন্দ তো সবই মনে রেখেছো? কিন্তু শাড়ি সঙ্গে সঙ্গে যে আমার তোমাকেও পছন্দ সেটা জানো না?’
নিজের এত কাছাকাছি মাহমুদকে দেখে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে মেহরিনের। হৃদকম্পন অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে বাড়ছে। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,’ছাড়ো আমাকে! আমার অস্বস্তি লাগছে।’
-‘লাগুক।’ তারপর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত কোমল চুম্বনে তাঁর সমস্ত শরীরে ঘূর্ণিঝড় তুলে দিয়ে মিষ্টি করে হাসলো মাহমুদ।কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে বললো ,’আই সয়্যার আই উইল কিল ইউ ইফ ইউ ট্রাই টু হার্ট মি নেক্সট টাইম।’
জবাবে ঠেলে তাঁকে সামনে থেকে সরিয়ে দিলো মেহরিন। প্রচণ্ড রাগে ক্ষোভে চড় মারতে উদ্যত হলো সে। কিন্তু তার আগেই ধরে ফেললো নিকৃষ্টটা। ধরে রাখা হাতের তালুতে জোরপূর্বক চুমু খেয়ে বললো,’কথায় কথায় রাগ দেখানোর স্বভাবটা এবার একটু কমাও ডার্লিং। বয়সে আমি তোমার বড়। তারওপর হবু বর! গায়ে হাত তোলাটা কি ঠিক?’
-‘ছাড়ো, হাত ছাড়ো। অসভ্য, ইতর।’, ধমকে উঠলো মেহরিন।
-‘আদর করে বলো। নইলে ছাড়বো না।’
-‘একা পেয়ে সুযোগ নিচ্ছো?’
-‘যদি বলি নিচ্ছি? কি করবে? পারবে আমার সঙ্গে?’
-‘কি মনে হয় তোমার?’, রাগের চোটে মুখ লাল হয়ে গেলো মেহরিনের। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে বুঝতে পেরে হাত ছেড়ে দিলো মাহমুদ। আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত উপরে তোলে বললো,’আচ্ছা ঠিক আছে। বাদ দাও। চলো, তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিই।’
-‘কোন দরকার নেই। তোমাকে মত অসভ্য, ইতরকে আমি একফোঁটাও বিশ্বাস করি না।’
-‘তাই নাকি?’, চট করে আবার কাছে এগিয়ে গেলো মাহমুদ।
কিন্তু এবার আর পূর্বের ন্যায় সুযোগ দিলো না মেহরিন। তৎক্ষণাৎ জোরেসোরে একটা ধাক্কা মারলো মাহমুদকে। ধাক্কা খেয়ে ছিটকে দুহাত পিছনে গিয়ে পড়লো সে। চোখজোড়া বিস্মিত, হতবাক! মেহরিন এমন কাজ করবে সে ভাবতেই পারে নি। লোহার দরজার বন্ধ পাট্টার সাথে গিয়ে কনুইয়ে বাড়ি লাগলো! ব্যথায় চোখবন্ধ করে ব্যথায় অস্ফুটস্বরে কঁকিয়ে উঠলো সে। তথাপি হাত সোজা করে মালিশ করতে করতে বললো ,’ইউ নিড লাভ! দিনদিন ভায়োলেন্ট হয়ে যাচ্ছো তুমি!’
একফোঁটা রাগ যদি তাঁর কন্ঠে থাকতো! অসহ্য রাগে দাঁতেদাঁত ঘষলো মেহরিন। এমন বেহায়া, নির্লজ্জ মানুষ সে জীবনেও দেখে নি। মার খেয়েও ভালোবাসার কথা বলছে। হাতের ব্যাগটা মাটিতে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বললো,’তুমি আমাকে পিছু ছেড়ে দিলেই তো আমি নরমাল হয়ে যাই। আমার লাইফটাকে হেল করে দিচ্ছো তুমি! কতবার বলেছি, দরকার নেই আমার কারো ভালোবাসার। তবুও কেন পেছনে পড়ে আছো? একা আছি বেশ আছি।’
-‘আচ্ছা ঠিক আছে চলো তোমাকে পৌঁছে দেই।’
-‘খবরদার একপা ও এগোবে না তুমি। আমি একাই যেতে পারবো।’
অতঃপর মাহমুদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গটগট করে একাই বেরিয়ে গেলো সে। মাহমুদ আঘাতপ্রাপ্ত জায়গাটা মালিশ করতে করতে পিছু নিলো। কিন্তু তাঁর পৌঁছানোর আগেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিলো মেহরিন। বাধ্য হয়ে নিজের গাড়ির কাছে ফিরে আসতে হলো মাহমুদকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করে বললো,’একেই বোধহয় চোরের মায়ের বড় গলা বলে।’
.
.
চলবে