হৃদয়_রেখেছি_জমা,পর্বঃ২১
অরিত্রিকা আহানা
দুদিনের অনুষ্ঠান শেষে পার্মানেন্টলি মাহমুদের ফ্ল্যাটে শিফট হয়ে গেছে মেহরিন। সে চলে আসার পর লায়লা শারাফাত ইরফান আহমেদের সঙ্গেই থাকছেন। এতবছর বাদে পুরনো মান অভিমান ভুলে গিয়ে এক হয়েছেন দুজনে। মাহমুদ ভীষণ খুশি। কিন্তু মেহরিন খানিকটা একটু অসন্তুষ্ট। বাবার সঙ্গে অফিসের বাইরে তাঁর খুব একটা কথা হয় না বললেই চলে। দেখাসাক্ষাৎ তো বহু দূরের কথা।
কিন্তু বিয়ের পর সমস্যা হয়ে গেছে। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে হলে রোজ ঐ বাসাতেই যেতে হবে তাঁকে। রোজ, রোজ ইরফান আহমেদের সম্মুখে পড়ে নিজেকে কোনরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চায় না মেহরিন। চোখাচোখি হলেই ইরফান আহমেদ কেমন করে যেন চেয়ে থাকেন। তখন আর অফিসের সেই রাশভারী, গুরুগম্ভীর ইরফান আহমেদ মনেই হয় না তাঁকে। মনে হয় বহুকালের আত্মগ্লানিতে দগ্ধ, অসহায় এক পিতা নিজের কৃত অপরাধের জন্য অনুনয় করে ক্ষমা ভিক্ষা চাইছে।
বাবার প্রতি এখনো পুরোনো সেই ক্ষোভ রয়ে গেছে মেহরিনের। লায়লা শারাফাতের সঙ্গে করা অন্যায়ের কথা আজও ভুলতে পারে নি সে। মায়ের কষ্ট নিজের চোখে দেখেছে। তাই তো শত চেষ্টা করেও কিছুতেই ইরফান আহমেদের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে নি।
ইরফান আহমেদ সেটা বুঝতে পারেন। বুঝতে পারেন বলেই লজ্জায়, অনুশোচনায় মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই তাঁর চোখে পানি চলে আসে। তাঁরই মেয়ে অথচ কোনদিন বাবা বলে ডাকে না। দুঃখে, কষ্টে নিজেকে শেষ করে দিতে মন চায়। কিন্তু তিনিও মেহরিনের মত। চাইলেও নিজের সবটা সবার কাছে প্রকাশ করতে পারেন না।
★
রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে লায়লা শারাফাতের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলো মেহরিন। হঠাৎ করে নিচতলায় একটা দৃশ্য দেখে চোখ আটকে গেলো। তিনচার বছর বয়সী একটা বাচ্চা গার্ডেন এরিয়াতে বসে তাঁর বাবার সাথে দুষ্টুমি করছে। বাচ্চার বাবা ধৈর্য সহকারে ছেলের সব আবদার পূরণ করছে আর একটু পরপরই সস্নেহে ছেলের নরম তুলতুলে গালে চুমু খাচ্ছে। অপূর্ব এক দৃশ্য! নয়ন জুড়িয়ে যাওয়ার মতন। প্রশান্তিদায়ক!
দৃশ্যটা দেখে হঠাৎ মাহমুদের কথা মনে পড়ে গেলো মেহরিনের। ডুঁকরে কেঁদে উঠলো বুকের ভেতরটা। সে তো চাইলেও মাহমুদকে কখনো এমন সুখ দিতে পারবে না! নিজের সমস্তটা দিয়ে হলেও না!
ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়ে চাচার কাছে মানুষ হয়েছে মাহমুদ। ইরফান সাহেব তাঁর কোন আবদার অপূর্ণ রাখেন নি। কিন্তু পারিবারিক স্নেহ বলতে ঐ অতোটুকুই। চাচার আদর ছাড়া অন্য কাউকে খুব একটা কাছে পায় নি। সেই মানুষটার ছোটবেলা কেটেছে বাবামায়ের আদর ছাড়া তাঁর নিজের কোন সন্তান থাকবে না ভাবতেই যন্ত্রণায় বুকটা ভারী হয়ে এলো মেহরিনের।
ফোন কেটে দুম ধরে মেঝেতে বসে পড়লো।চোখের কোনে জমা হলো বিন্দু বিন্দু নোনা জল।
মাহমুদ এসেছিলো বারান্দায় ভেজা টাওয়েল মেলে দিতে। মেহরিনকে মেঝেতে বসে থাকতে দেখে মুচকি হেসে বললো,’কি ব্যাপার? মেঝেতে বসে আছো যে?’
মেহরিন জবাব দিলো না। ফ্যালফ্যাল করে মাহমুদের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তাঁর নারীসত্তা ব্যর্থ! ব্যর্থ তাঁর গোটা জীবন!
ভালো করে মাহমুদের দিকে চাইলো। সত্যিই কি এই নিয়ে কোন কষ্ট নেই মাহমুদের? কোন আফসোস নেই?
-‘কি হলো তোমার? কথা বলছো না কেন?’
মাহমুদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো মেহরিন। তাঁর শূন্য কোল সারাজীবন শূন্যই থাকবে। কখনো পূর্ণ হবে না। মাতৃহৃদয় সন্তানের আকুতিতে অসহ্য বেদনায় ছটফট করে মরবে কিন্তু এই নিষ্ঠুর সত্য থেকে কখনো মুক্তি মিলবে না।
তাঁর কান্না দেখে মাহমুদ ঘাবড়ে গেলো। হাটুমুড়ে সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে বসে পড়লো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বারবার জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে!
এবারে দুহাতে তাঁর কোমড় জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো মেহরিন। অসহায় আর্তনাদ করে বললো ,’আমি কখনো মা হতে পারবো না মাহমুদ। তুমি কখনো বাবা ডাক শুনতে পারবে না। আমাদের বেবি হবে না কোনদিন।’
মেহরিনের এমন কান্না তীরের মতন বিদ্ধ করলো মাহমুদের হৃদয়টাকে। যাকে সে অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছে, বহুযত্নে বুকের ভেতর আগলে রেখেছে তাঁর এমন কান্না সত্যি বড্ড অসহায় করে দিলো মাহমুদকে। তাঁর হাতে যদি ক্ষমতা থাকতো তবে সমস্ত পৃথিবীর বিনিময় হলেও মেহরিনের শূন্য কোল পূর্ণ করে দিতো সে।
-‘কান্না থামাও মেহরিন! প্লিজ!’
-‘কেন উপরওয়ালা আমাকে এতবড় শাস্তি দিলেন? আমি তাঁর কি ক্ষতি করেছি? কেন আমার সঙ্গেই এমন হলো? কেন তুমি আমাকে নিজের সঙ্গে জড়ালে!’
তাঁকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করলো মাহমুদ। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে স্নেহার্দ্র কন্ঠে বললো,’এসব কথা বলো না মেহরিন। সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধান্তের ওপর কারো হাত নেই। তিনি যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।’
-‘তবে আমার সঙ্গেই কেন এমন হতে হলো? আমি তো নিজের অক্ষমতার দায় একাই বয়ে বেড়াতে চেয়েছিলাম। কেন তিনি তোমাকে আমার সঙ্গে জড়িয়ে আমার ভেতরের যন্ত্রণা আরো বাড়িয়ে দিলো?’
-‘জানো তো, উপরওয়ালা মানুষকে সুখি হওয়ার জন্য দুটো অপশন দিয়েছেন। কিছু পেতে হলে কিছু ত্যাগ করতে হবে। আমার বেলাতেও তাই হয়েছে। আই চোজ ইউ! আমার কাছে মনে হয়েছে তোমাকে ছাড়া বাকি সবকিছু সবকিছু আমার জন্য অর্থহীন। যেকোন কিছুর বিনিময়ে হলেও তোমাকে আমার চাই। নতুবা আমি মরে যাবো। নিঃসন্দেহ আমি সৌভাগ্যবান যে তিনি আমার আকুতি শুনেছেন। এন্ড আই থিংক হি গেইভ মি দ্যা বেস্ট ওয়ান আই ডিজার্ভ। একটা কথা সব সময় মনে রেখো মেহরিন,উপরওয়ালা কখনো কারো ওপর অবিচার করেন না। আনডাউটেডলি, হি ইজ দ্যা বেস্ট অব প্ল্যানার্স!’
তাঁকে ছেড়ে দিয়ে ফের দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললো মেহরিন। ফের বাঁধভাঙ্গা ক্রন্দনে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। মাহমুদ সস্নেহে তাঁর মাথাটা কোলে তুলে নিলো। পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,’বিশ্বাস করো, তোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কিচ্ছু বলছি না আমি। কারণ বলার মতন তেমন কিছু নেই। সত্যিটা তুমি নিজেই জানো। তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তাই প্লিজ নিজেকে দোষারোপ করা বন্ধ করো।’
অতঃপর পাঁজাকোলা করে তাঁকে তুলে নিলো মাহমুদ। ভেতরে ঢুকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো,’পানি খাও।’
চোখমুছে অনেকটা স্বাভাবিক হলো মেহরিন। পানির গ্লাসটা রেখে খুবই রিলাক্সভাবে তাঁর পাশে বসলো মাহমুদ। মেহরিনের একটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,’মন খারাপ করে থেকো না প্লিজ। তুমি মন খারাপ করে থাকলে আমি শান্তি পাবো না। কি চাও বলো? বেবি? বেবি লাগবে তো তোমার? ঠিক আছে। আমি আজই ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলবো। স্যারোগ্যাসির মাধ্যমে যদি বেবি নেওয়া যায় তাহলে ভালো আর যদি নাও নেওয়া যায় তাহলে আমরা বেবি অ্যাডপ্ট করবো। কোন সমস্যা নেই।’
মেহরিন নতমুখে বসে রইলো। মাহমুদ দুহাতে তাঁর মুখটা তুলে ধরে বললো,’কিছু বলবে না? আর কতক্ষণ এভাবে মুখ ভার করে থাকবে?’
ধীরে ধীরে নিজের মাথাটা তাঁর বুকের ওপর এলিয়ে দিলো মেহরিন। দুহাতে তাঁর গেঞ্জি আঁকড়ে ধরে বললো,’আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। ইউ আর দ্যা রিজন অফ মাই লাইফ!’
মুখে হাসি ফুটে উঠলো মাহমুদের। মেহরিনের অগোছালো চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো,’আমি জানি সেটা। তোমার চাইতে বেশি ভালো আমাকে কেউ বাসে না। বোধকরি আমি নিজেও নিজেকে ততোটা ভালোবাসি না যতটা তুমি বাসো।’
মেহরিন চুপ করে রইলো। মাহমুদ বেশকিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,’একটা অনুরোধ করবো। রাখবে?’
মুখ তুলে চাইলো মেহরিন। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কি?’
-‘চাচ্চুর সঙ্গে সব মিটমাট করে নিলে হয় না? মানুষটা ভেতরে ভেতরে তোমার জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছেন। তাছাড়া ছোটমা তো উনাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। ভালোও বাসেন। তাহলে তোমার উনাকে বাবা ডাকতে আপত্তি কোথায়?’
মেহরিন চুপ করে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলো। মাহমুদ ফের অনুরোধের সুরে বললো,’সন্তান না থাকার চাইতে বেশি কষ্ট হয় থেকেও না থাকার মতন হয়। সেই কষ্ট মানুষ সহ্য করতে পারে না। চাচ্চুর বয়স হয়েছে। আর কয়দিনই বা বাঁচবে। কি হয় উনাকে একটু বাবা বলে ডাকলে? নাহয় জোর করেই ডাকলে?
মেহরিনের চোখের পানি গাল গড়িয়ে মাহমুদের হাতের ওপর পড়লো। ঠোঁট চেপে কান্না আটকে বললো,’উনি আমার মাকে কষ্ট দিয়েছেন। তাই আমি উনাকে বাবা ডাকি না। মাকে আমি খুব ভালোবাসি।’
-‘আর বাবাকে? বাবাকে একটুও ভালোবাসো না? তাঁর কিছু হলে সহ্য করতে পারবে? কষ্ট হবে না তোমার?’
মেহরিন নিরুত্তর রইলো। মানুষটা যতই অন্যায় করুক না কেন তিনি তাঁর বাবা। বাবা মাকে চাইলেও কেউ অস্বীকার করতে পারে না। তাদের কিছু হলে সন্তানের বুকে একটু হলেও আঘাত লাগবে।
-‘কি হলো কথা বলছো না যে? হবে না তোমার কষ্ট?’
মেহরিন চোখ মুছে মৃদু হাসলো। বললো,’কালকে আমরা বাবার সাথে দেখা করতে যাবো ঐ বাসায়। আসার সময় দুজনকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবো।’ খুশিতে ঝলমল করে উঠলো মাহমুদের চেহারা। তাঁর এতদিনের চেষ্টা সফল হতে চলেছে। মেহরিন রাজি হয়েছে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে। এবার নিশ্চয়ই আর কোন দুঃখ থাকবে না ইরফান আহমেদের! খুব খুশি হবেন তিনি।