হৃদয়_রেখেছি_জমা,পর্বঃ৭,৮
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৭
সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরী হয়ে গেলো মেহরিনের। গতকাল রাত তিনটার দিকে বাসায় পৌঁছেছে সে। ফ্রেশ হয়ে শুতে শুতে প্রায় সাড়ে তিনটার বেজে গেছিলো। তারপর বিছানায় যেতেই ঘুমে! এক ঘুমে বারোটা!
ব্রেকফাস্ট সেরে তাড়াহুড়ো করে হেড কোয়ার্টারের দিকে ছুটলো সে। আজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হওয়ার কথা ছিলো। ইরফান সাহেব নিশ্চয়ই আজকে কতগুলো শক্ত কথা শুনিয়ে দেবেন তাঁকে। বিরক্তিতে মুখ কালো হয়ে গেলো তাঁর। এই লোক যতক্ষণ অফিসে থাকেন ততক্ষণ একেবারে অন্যরকম। একমাত্র কাজ ছাড়া অন্য সকল সম্পর্কের কথা ভুলে যান তিনি।
কাজের সাথেই তাঁর সমস্ত সম্পর্ক। কাজে গাফলতি হলে মাহমুদ, মেহরিন কাউকেই ছাড় দেন না তিনি। তবে মাহমুদের ব্যপারটা কেবল লোক দেখানো বলেই মেহরিনের ধারণা। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ভাইয়ের ছেলে বলে মাহমুদের প্রতি ইরফান সাহেব একটু বেশিই স্নেহশীল। কিন্তু তার যে একটা কারণ আছে সেটা মেহরিন স্বীকার করতে রাজি নয়। পারতপক্ষে, ইরফান আহমেদের নির্দেশ কখনো অমান্য করে না মাহমুদ। যতই কঠিন কাজই হোক না কেন ইরফান সাহেব যদি একবার আদেশ করেন বিনাবাক্যে রাজি হয়ে যাবে মাহমুদ। বাবা মা মারা যাওয়ার পর চাচার কাছেই মানুষ হয়েছে সে। বাইরের মানুষের কাছে তিনি যতই গম্ভীর হোক না কেন, ছোট বেলা নিজের ছেলের মতন বড় করেছেন মাহমুদকে। মেহরিনের কাছে হয়ত তাঁর পিতার হাজারটা দোষ আছে, থাকাটাই স্বাভাবিক কিন্তু মাহমুদের কাছে তিনি সবার ওপরে।
পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দেড়টা বেজে গেলো মেহরিনের। ভেতরে ঢুকতেই ডেস্কের কাছে প্রথম এনার সঙ্গে দেখা। মিষ্টি হেসে আন্তরিক গলায় বললো,’গুড নুন মেহরিন আপু।’
-‘গুড নুন!’, আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলো মেহরিনও। তারপর গলার স্বরটা খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,’বস কি ইতোমধ্যে আমার খোঁজ করেছেন?’
জবাবে না সূচক মাথা দোলালো এনা। গতকালের ঘটনা সোহাগের কাছে জানতে পেরেছেন ইরফান সাহেব। তাই মেহরিনের দেরী নিয়ে কিছু বললেন না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো মেহরিন। বাঁচা গেছে! আজকে আর কতগুলো বেহুদা কথা শুনতে হবে না তাঁকে। এই ভেবে খানিকটা আনন্দও হচ্ছে।
এনা নীল রংয়ের ফাইল বাড়িয়ে দিলো তাঁর দিকে। ফাইলের ওপর তিনটা স্টার মার্ক করা, তারমানে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল। হাত বাড়িয়ে ফাইলটা নিলো মেহরিন। এনা মুখের হাসি বজায় রেখে বললো,’মাহমুদ আপনাকে দিতে বলেছিলো। ফাইলে এবারের মিশনের পুরো কেইস স্টাডি আর কিছু ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনালদের রিপোর্ট করা আছে। আপনাকে সেটা আরেকটা কপি তৈরী করে মূলকপিটা ফেরত দিতে। প্রয়োজন মনে করলে নতুন করে ইনফরমেশন এ্যাড করতে পারবেন।’
-‘মাহমুদ আসে নি?’, আনমনেই প্রশ্নটা করে ফেললো মেহরিন।
-‘ন’টার দিকে এসেছিলো। শরীর খারাপ তাই ছুটি নিয়ে চলে গেছে। বললো, বাসায় বসেই নাকি বাকি কাজ সারবে।
-‘নতুন কপি কবে নাগাদ লাগবে?’
-‘কালকের মধ্যে। মিনিস্ট্রিতে নাকি জমা দেবেন বস।’
-‘ঠিক আছে। হয়ে যাবে।’
বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো এনা। মেহরিন ফাইল খুলে রিপোর্ট তৈরীর কাজে মনোযোগ দিলো। কাজের মাঝখানে হঠাৎ মনে পড়লো মাহমুদের শরীর খারাপের কথা বলছিলো এনা। কি হয়েছে তাঁর? শরীর কি সত্যিই খারাপ? নাকি অন্যকিছু?
তাই হবে! সেরকম হলে এনা নিশ্চয়ই বলতো। অতএব, অনুমানের ওপর ভিত্তি করে মাহমুদের ছুটে নেওয়ার একটা কারণ দাঁড় করিয়ে ফেললো সে। কারণটা হলো, গতকাল রাতে দেরীতে বাসায় ফিরেছে মাহমুদ। ঠিকমতন ঘুমাতে পারে নি। তাই শরীর খারাপের অযুহাত দিয়ে বাসায় গিয়ে ঘুমানোর প্ল্যান করেছে। মাথা থেকে মাহমুদের চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে পুনরায় কাজে মনোযোগ দিলো মেহরিন।
বাস্তবিকই বাসায় গিয়ে ঘুমানোর প্ল্যান করেছে মাহমুদ কিন্তু তাঁর শরীর সত্যিই খারাপ। সকালে অফিসে ঢোকার সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম দেখে আর দেরী করে নি। দ্রুত কাজ সেরে বেরিয়ে গেছে।
★
সেদিন রাতে ফাইলের জন্য মেহরিনের কাছে ফোন করলো মাহমুদ। রিসিভ করলো সোহাগ। মেহরিনের জন্মদিন উপলক্ষ্যে সারপ্রাইজের অ্যারেঞ্জ করেছে তাঁরা। বাসার ভেতরে হৈ-হুল্লোড় চলছে। সিনিয়র জুনিয়র অনেক কলিগ এসেছে।
ফোন রিসিভ করলেও কথা বললো না সোহাগ। মেহরিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’মাহমুদ ভাই।’
ভিড় থেকে সরে এলো মেহরিন। ঘরভর্তি লোকজনের গমগমিতে অপরপ্রান্তের মানুষটা ঠিক ভাবে শুনতে পাবে কিনা সেই চিন্তা করে খানিকটা চেঁচিয়েই ‘হ্যালো’ বললো সে।
তাঁর গলার আওয়াজ পেয়েই ওপাশ থেকে মাহমুদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,’হ্যাঁ মেহরিন?’
-‘বলো! শুনছি।’
-‘সকালে এনা তোমাকে যেই ডকুমেন্ট পেপারটা রেডি করতে বলেছিলো সেটা কি রেডি?’
-‘হ্যাঁ।’
-কোথায় রেখেছো? খুঁজে পাচ্ছি না তো?’
-‘তুমি অফিসে?’, অবাক হলো মেহরিন।
-‘হ্যাঁ। কিছু জরুরী কাগজপত্র আর ফাইলটা হঠাৎ করেই দরকার পড়লো। সেগুলো নিতে এসেছি।’
-‘ওটা তো আমার ড্রয়ারে। তালাবন্ধ!’
-‘হায় হায়! বলো কি? আমার যে এক্ষুনি লাগবে।’
-‘জরুরি ফাইল তাই ড্রয়ারে তালা মেরে এসেছিলাম।’
-‘তোমার কাছে কি ফাইলের সফট কপি আছে?’
-‘সফট কপি তো পুরোটা রেডি করতে পারি নি। ভেবেছিলাম কালকে সকালে গিয়ে করবো।’
-‘তাহলে এখন?’ হতাশ শোনালো মাহমুদের কণ্ঠস্বর!
ফাইলের আবশ্যকতা বুঝতে পেরে মেহরিন একমুহূর্তও ভাবলো। তারপর নিজে থেকেই প্রস্তাব করলো,’আমি কি সোহাগকে দিয়ে চাবি পাঠাবো?’
হাসি ফুটে উঠলো মাহমুদের ঠোঁটে। ডকুমেন্টটা এক্ষুনি লাগবে তাঁর। কিন্তু এতরাতে সোহাগকে পাবে কোথায় মেহরিন? নাকি সোহাগের কথা বলে মেহরিন নিজে আসবে?
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে উচ্চস্বরে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কৌতূহল বশতই প্রশ্ন করলো সে,’এত শোরগোল কিসের? তোমার বাসায় কি মেহমান?’
-‘আজকে আমার জন্মদিন। সোহাগরা কেক নিয়ে এসেছে সেলিব্রেট করার জন্য।’
-‘তাই নাকি? হ্যাপি বার্থডে।’
-‘থ্যাংক ইউ।’
-‘কত হলো এবার? পঁচিশ না ছাব্বিশ?’
-‘ছাব্বিশ।’
-‘সেকি? গতবার না চব্বিশ ছিলো?’
-‘উহুঁ। গতবার পঁচিশতম জন্মদিন সেলিব্রেট করেছিলাম।’
মাহমুদ ঠাট্টার সুরে বললো,’তাহলে তো বুড়ো হয়ে গেলে। এবার অন্তত বিয়েটা করো!’
বিয়ের প্রসঙ্গটা উঠতেই বিব্রত হলো মেহরিন। দ্রুত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললো,’আমি কি চাবি পাঠাবো?’,
-‘এক্ষুনি পাঠানোর দরকার নেই। তোমাদের পার্টি শেষ হলে পাঠাও।’
-‘কিসের পার্টি? আজকে কোন পার্টি হচ্ছে না।’
-‘তুমি না বললে সবাই এসেছে?’
-‘ওরা সারপ্রাইজ দিতে এসেছে। পার্টি হবে আগামীকাল।’
বস্তুত জন্মদিন নিয়ে মেহরিনের বিশেষ কোন খেয়াল ছিলো না। আগ্রহ কিংবা উচ্ছ্বাস তো নেই বললেই চলে। কিন্তু কলিগদের অনুরোধে পার্টিটা রাখতে হচ্ছে তাঁকে। সবাই এত করে অনুরোধ করেছে যে না করতে পারে নি।
মাহমুদ তাঁর কথার জবাবে বাধ্য ছেলেদের মতন করে বললো,’আচ্ছা। তাহলে এক্ষুনি পাঠিয়ে দাও।’ ফোন রেখে দিচ্ছিলো সে। কিন্তু মেহরিনের প্রশ্নটা শুনে থমকে গেলো।
-‘তুমি আসবে কাল?’, হঠাৎ করেই প্রশ্নটা করে বসলো মেহরিন। কেন করলো সে নিজেও জানে না। কালকে অফিসে দেখা হলে বাকি সবার মত মাহমুদকেও ইনভাইট করতে পারতো সে। আলাদা করে জিজ্ঞেস করার কোন প্রয়োজনই ছিলো না। বিশেষ করে এইমুহূর্তে! এমনভাবে! নিজের ওপর রাগ হলো। সবসময় বোকার মতন কাজ করে সে।
প্রতিউত্তরে মাহমুদ হাসলো। অনেকটা কথা আদায় করে নেওয়ার মতন করেই বললো,’ইনভাইট করছো?’
-‘এসো, এনাকে নিয়ে। আমি চাবি পাঠাচ্ছি।’ দ্রুত ফোন রেখে দিলো মেহরিন। তাঁর শেষের কথাগুলো অনেক বেশি ভারী শোনালো। ফোন হাতে নিয়ে স্থিরভাবে কিছুক্ষণ বসে রইলো মাহমুদ। আবার শরীর খারাপ লাগছে তাঁর। মাথা ঝিমঝিম করছে। তথাপি সোহাগ আসার অপেক্ষা করে বসে রইলো। সোহাগ এলে ফাইল নিয়ে তারপর বেরোবে। কাজটা যেভাবেই হোক শেষ করতে হবে তাঁকে।
.
.
.
চলবে
#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৮
ডাক্তারের পরামর্শে তিনদিনের ছুটি দেওয়া হয়েছে মাহমুদকে। এই তিনদিন সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে বলা হয়েছে তাঁকে। প্রেশার ডাউন। এই মুহূর্তে বেডরেস্ট খুবই জরুরী।
আপাতত ডাক্তারের কথা মেনে চলার চেষ্টা করছে সে সকাল থেকেই শুয়ে আছে। কিন্তু টানা তিনদিন এভাবে ধৈর্য ধরে থাকতে পারবে কিনা সন্দেহ! কর্মজীবী মানুষরা কাজ ছাড়া বেশি দিন থাকতে পারে না। হাঁপিয়ে উঠে।
দুপুরের দিকে এনা এলো দেখার করার জন্য। বেশ সেজেগুজে এসেছে। একা একা বাসায় বোর হচ্ছিলো বিধায় খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে বই পড়ছিলো মাহমুদ। এনাকে দেখে আন্তরিকভাবে হাসলো। জবাবে এনাও মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলো,’শরীর কেমন তোমার?’
মাহমুদ হাতদুটো সামনে ছড়িয়ে বললো,’এই, যেমন দেখছো।… তোমার কি খবর? খুব খুশি মনে হচ্ছে!’
-‘এনি গেস?’
-‘পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে?’ সকৌতুকে হাসলো মাহমুদ।
-‘ধুর! ইউ.কে. থেকে আমার বড় মামা এসেছেন। গ্রামের বাড়ির নানার জন্য দো’য়ার আয়োজন করা হবে। তাই আমরা সবাই মিলে নানুর বাড়ি যাচ্ছি। ভাবলাম যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে দেখা করে যাই।’
-‘ভালো করেছো। সকাল থেকে খুবই বোর হচ্ছিলাম।’
-‘কিন্তু আমি তো বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না। বাসার সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’, দুঃখ প্রকাশ পেলো এনার কন্ঠে।
-‘ইট’স ওকে। এঞ্জয় ইউরসেল্ফ!’
এনা ব্যাগ থেকে একটা টিফিন বক্স বের তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আন্তরিক কন্ঠে বললো,’মা দিয়েছেন তোমার জন্য। রান্না করা কিছু খাবার আছে।’
হাসি ফুটে উঠলো মাহমুদের ঠোঁটে। দারুণ রান্না করেন এনার মা। বাড়িতে মহিলা না থাকায় এসব খাবার সচরাচর কপালে জোটে না তাঁর। এনা অবশ্য মাঝে মধ্যেই খাবার নিয়ে আসে। তবুও তৃপ্তি মেটে না। বক্স খুলে খাবারের গন্ধ নিলো সে। তাঁর উৎসাহ দেখে এনা মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,’খাবে এখন? প্লেট নিয়ে আসি?’
-‘আনো।’
কিচেন থেকে একটা প্লেট আর হাতধোয়ার পানি নিয়ে এলো এনা। হাত ধুয়ে খেতে বশে গেলো মাহমুদ। সবই দেশীয় রান্না। সেই সাথে কিছু মিষ্টান্ন। তাঁর খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো এনা। তারপর ময়লা বাসনগুলো নিয়ে সিংকে ভিজিয়ে রাখলো। বুয়া এসে পরে ধুয়ে নেবে। মাহমুদ তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললো,’আন্টিকে আমাকে পক্ষ থেকে একটা স্পেশাল থ্যাংকস দেবে।’
এনা হাসলো। মাহমুদ হঠাৎ করেই জানতে চাইলো আজকে সন্ধ্যার পার্টিতে এনা যাচ্ছো কি না।
-‘কিসের পার্টি?’, অবাক হলো এনা।
-‘কেন? মেহরিনের জন্মদিনের পার্টি?’
-‘তাই নাকি?’ ফের অবাক হলো এনা। ইরফান সাহেবের কাছ থেকেছুটি নেওয়ার জন্য আজকে সকালে অফিসে গিয়েছিলো সে। মেহরিনের সঙ্গে দেখাও হয়েছে। কই মেহরিন তো তাঁকে কিছুই বলে নি! তথাপি হালকা হেসে বললো,’আমাকে বোধহয় বলতে ভুলে গেছেন।’
থমকে গেলো মাহমুদ। ভুলে গেছে? হতেই পারে না। সে নিজে সোহাগকে বলতে শুনেছে অফিসের সবাইকেই ইনভাইট করেছে মেহরিন। হঠাৎ করে কালরাতের কথাটা মনে পড়তেই মুচকি হেসে বললো,’আমি বলি নি তোমাকে?ভুলে গেছিলাম বোধহয়।’
-‘কি?’
-‘মেহরিন গতকাল আমাকে ইনভাইট করার সময় বারবার বলেছে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তখন তো শরীর ভালো ছিলো তাই বলেছিলাম যাবো। তাই হয়ত আর আলাদা করে বলে নি।’
এনা বোধহয় খুশি হলো কথাটা শুনে। মনে মনে মেহরিনকে খুবই পছন্দ করে সে। কেন করে সে নিজেও জানে না। কিন্তু করে। ঐ যে আছে না, কোন কারণ ছাড়াই কাউকে ভালো লাগা। অনেকটা সেরকম। কিন্তু ভয়ে কখনো বলার সাহস পায় নি। তাছাড়া মেহরিন কখনো আগ বাড়িয়ে তাদের মধ্যেকার দূরত্ব কমানোর প্রতি কোনরকম আগ্রহ প্রকাশ করে নি। অবশ্য কেবল এনা নয়, অফিসের প্রায় সবার সঙ্গেই নির্দিষ্ট একটা ডিসটেন্স মেইনটেইন করে চলে সে। তবুও সহকর্মীদের কাছে কেমন করে যেন ভীষণ কো-অপারেটিভ সে। সবাই তাঁকে পছন্দ করে।
-‘কিন্তু আমি তো তিনচারদিনের আগে ফিরতে পারবো না। তুমি কি আমার হয়ে মেহরিন আপুকে বুঝিয়ে বলতে পারবে?’
-‘বলতে পারি। কিন্তু সে আমার কথা কতটুকু বিশ্বাস করবে তার গ্যারান্টি দিতে পারছি না।’
হেসে ফেললো এনা। চাকরীতে জয়েন করেছে অবধি মেহরিনের সঙ্গে মাহমুদের খোঁচাখুঁচি চলছে। ঝগড়ার জন্য রিজন খুঁজে পেতে সময় লাগে না তাদের। বললো,’দিতে হবে না। তুমি জাস্ট জানিয়ে রাখলেই হবে। পরে আমি নিজে উনার সঙ্গে কথা বলে নেবো।’
কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো সে। পুনরায় মিষ্টি হেসে বললো,’এবার আমি আসি?’
-‘এসো।’
সে বেরিয়ে গেলে পুনরায় বইয়ে মনোযোগ দিলো মাহমুদ। কিন্তু বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারলো না। মাথা ব্যথা করছে গেছে। বই রেখে চুপচাপ ঘুমানোর শুয়ে পড়লো। দুপুরের খাওয়া তো হয়ে গেছে। অতএব নিশ্চিন্তে একটা ঘুম দেওয়া যায়!
★
পার্টিতে মোটামুটি কলিগরা সবাই এসেছে কেবল মাহমুদ আর এনা ছাড়া। মেহরিনকে অবশ্য খুব একটা বিচলিত দেখালো না এই নিয়ে। নিজের মত করে এঞ্জয় করলো সবার সঙ্গে।
অথচ সবাই চলে গেলে ঠিকই আবার চুপিচুপি সোহাগকে জিজ্ঞেস করলো কেন মাহমুদ পার্টিতে আসে নি। তাঁর সঙ্গে কি কথা হয়েছে সোহাগের?
ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞার কথা খুলে বললো সোহাগ। তারপর আর বিশেষ কথাবার্তা হলো না। বিদায় নিয়ে চলে গেলো সে।
হাতের কাজকর্ম সেরে মেহরিন ফোন নিয়ে বসলো। মাহমুদকে ফোন করবে নাকি করবে এই নিয়ে বেশকিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্ব করে শেষমেশ ফোনটা করেই বসলো।
দুপুরের অনেকক্ষণ ঘুমানোর ফলে রাতে ঘুম আসছে না মাহমুদের। সকালের বইটা নিয়ে বসলো সে। পড়া প্রায় শেষের দিকে। ফোনের আওয়াজ পেয়ে বই রেখে ফোন রিসিভ করলো। কিন্তু ওপাশ থেকে জবাব দিলো না মেহরিন। নাম্বারটা নতুন! মাহমুদের চেনার কথা নয়। ফোন রেখে দেবে কিনা ভাবছিলো।
-‘মেহরিন?’
ধক করে উঠলো বুকের ভেতরটা। উত্তজনা কাটিয়ে দ্রুত সাড়া দিলো মেহরিন। খানিকটা কৈফিয়ত দেওয়ার মতন করেই বললো,’সোহাগের কাছে শুনলাম তুমি নাকি অসুস্থ। কেমন আছো এখন?’
-‘ভালো।’
-‘এলে না যে?’
-‘হাঁটাচলা নিষেধ। ডাক্তার রেস্টে নিতে বলে গেছেন।’
-‘ও আচ্ছা। খাওয়াদাওয়া ঠিকমত করছো?’
-‘করছি।’
-‘এনা? এনাও তো এলো না? সে তো আসতে পারতো?’
-‘তুমি তাঁকে ইনভাইট করেছো?’
-‘করি নি?’
-‘আমি কি করে বলবো? আমি তো জানার জন্যই প্রশ্ন করলাম।’
-‘তুমি ওকে বলো নি?’
-‘আমি কেন বলবো মেহরিন?’
-‘মানে?’
-‘জন্মদিন তোমার, তুমি অফিসের সবাইকে আলাদাভাবে ইনভাইট করেছো কেবল এনাকে ছাড়া। তোমার কি মনে হয় না একটা মানুষের সেল্ফ রেস্পেক্টকে আঘাত করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট? এনা হয়ত কিছু মনে করে নি কিংবা করলেও বলবে না। বাট জিনিসটা কিন্তু খুবই খারাপ হয়েছে।’
খট করে ফোন রেখে দিলো মেহরিন। ইচ্ছে করেই মাহমুদের কথার জবাব দিলো না সে। যা বলার এনাকেই বলবে।
বস্তুত মেহরিন ভেবেছিলো মাহমুদকে বলা আর এনাকে বলা একই কথা। গতকাল রাতে মাহমুদকে এনার কথা বলেছিলো সে। খুব জোর দিয়ে অবশ্য বলে নি কারণ সে জানে মাহমুদকে বলা মানেই এনা আসবে। আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু মাহমুদ যে ব্যপারটাকে এমনভাবে দেখবে একথা তাঁর মাথাতেই আসে নি।
তবে যাইহোক না কেন, ব্যপারটা সত্যি খুবই খারাপ হয়েছে। একদমই উচিৎ হয় নি! মাহমুদের সঙ্গে যাই হয়ে থাক না কেন এনার সঙ্গে মেহরিনের কোন বিরোধ নেই। এতদিন মনেপ্রাণে এইকথা বিশ্বাস করে এসেছে সে। কিন্তু আজ? আজ সব গোলমেলে লাগছে। সে যতই নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করুক না কেন তাঁর অবচেতন মন যে খানিকটা হলেও এনার প্রতি সত্যিই ঈর্ষান্বিত এই ভেবে কষ্ট আরো বাড়ছে। অনুশোচনা হচ্ছে।
★
দুদিন পরের ঘটনা,
অফিসে জয়েন করেছে মাহমুদ। এনাও ফিরে এসেছে। ডেস্কে বসে কাজ করছিলো মেহরিন। হঠাৎ মনে হলো, এনা অফিসে এসেছে কিনা একবার চেক করে আসলে হয়। ডেস্ক ছেড়ে উঠে গেলো সে।
সেদিনের ঘটনার পর থেকে এই দুদিন মনে মনে খুবই দুঃখ বোধ করেছে মেহরিন। এনা নিশ্চয়ই ভেবেছে ইচ্ছে করেই কাজটা করেছে সে। কিন্তু না,তাঁকে ছোট করার কোন উদ্দেশ্য মেহরিনের ছিলো না। এনাকে সব বুঝিয়ে বলতে হবে। সব শুনলে নিশ্চয়ই এনা বুঝবে।
যাত্রাপথেই এনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। এনা তাঁর দিকে সুন্দর একটা গিফট বক্স বের করে দিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,’হ্যাপি বার্থডে মেহরিন আপু। সরি ফর লেইট। এটা আপনার জন্য। সেদিন আসতে পারি নি বলে আমি খুবই দুঃখিত।’ তারপর মেহরিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললো,’আসলে আগে থেকেই ফ্যামিলি ট্রিপ প্ল্যানিং করা ছিলো। না গেলে খারাপ দেখাতো। এমনিতে কাজের অযুহাতে ফ্যামিলি প্রোগ্রামগুলো ঠিকমত এটেন্ড করতে পারি না। তারওপর নানার মৃত্যুবার্ষিকী। ‘
মেহরিন অবাক! এনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে না সে বিন্দুমাত্রেও মেহরিনের প্রতি অসন্তুষ্ট। উল্টো পার্টিতে এটেন্ড করতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করছে। ব্যপারটা কি? যাইহোক, আপাতত হজম করে নিলো মেহরিন। জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বললো,’ইট’স ওকে আমি কিছু মনে করি নি। তবে তুমি এলে আমি সত্যিই খুব খুশি হতাম।’
এনা সোৎসাহে মাথা দুলিয়ে বললো,’পরের বার থেকে ডিল ডান।’
সোহাগকে সাথে নিয়ে কোথায় বেরোচ্ছিলো মাহমুদ। যাত্রাপথে মেহরিনকে হতভম্ভ হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে থাকতে দেখে হাঁটার ওপর দিয়ে চোখ মেরে বসলো। বিস্ময়ে, অস্বস্তিতে হতবাক মেহরিন! অসভ্যটা শুরু করেছে টা কি? তাকে এভাবে কনফিউশনে রেখে কি আনন্দ পায় সে? তৎক্ষণাৎ রাগে মুখ ফিরিয়ে নিলো। চট করে এনাকে উদ্দেশ্য করে বললো,’চলো। আমার ডেস্কে গিয়ে বসি।’ তারপর এনার জবাবের অপেক্ষা না করে সে নিজেই এনার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলো।
.
.
.
চলবে