হৃদয়_রেখেছি_জমা,পর্বঃ৯,১০
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৯
বছর দুয়েক আগের কথা,
বেশিকিছুদিন ধরে এজেন্সি থেকে ইনফরমেশন লিক হচ্ছিলো। সেই সাথে হঠাৎ একদিন রাতুল মিসিং। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো কিডন্যাপ করা হয়েছে তাঁকে। তোড়জোড় মাহমুদদের মিশনে পাঠালেন ইরফান সাহেব। সঙ্গে মেহরিনও ছিলো। সেই মিশনেই মারা যায় রাতুল।
রাতুলের মৃত্যুর ঘটনাটা জানা জরুরি! মিশন চলাকালীন সময়ের বর্ননা,
মাহমুদের দুইপাশে পক্ষ বিপক্ষ মিলিয়ে মোট তিনজন সদস্য বন্দি ছিলো। রাতুল, মেহরিন এবং শত্রুদের এক সদস্য। শত্রুনেতার দাবি ছিলো মাহমুদ যদি তাদের সদস্যটিকে ছেড়ে দেয় তবে সে-ও মেহরিন কিংবা রাতুলের দুজনের মধ্য থেকে একজনকে ছাড়িয়ে নিতে পারবে। বাট ইট ওয়াজ আ ট্র্যাপ। পরে বুঝতে পারে মাহমুদ!
যাইহোক, মাহমুদ-মেহরিনের প্রেমের বসন্ত তখন বারোমাস! তথাপি সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলো না দুজনের কেউই। রাতুলকে প্রচুর পরিমানে টর্চার করা হয়েছে। আগে তাঁকে উদ্ধার করা প্রয়োজন। তাঁকে ছাড়ানো গেলে মেহরিনকেও ছাড়িয়ে আনা যাবে। সি ক্যান ফাইট! মেয়ে দেখে শত্রুপক্ষ বোধহয় খুব একটা গুরুত্ব দেয় নি। মাত্র দুজন পাহারাদার রেখেছে। তবুও অনুমতির অপেক্ষায় একবার মেহরিনের দিকে চাইলো মাহমুদ, চোখে চোখে কথা হয়ে গেলো দুজনার। রাতুলকে ছেড়ে দিতে বললো দুজনেই।
★
কিন্তু ঝামেলাটা তখনই হলো যখন নিজমুখে অপরাধের কথা স্বীকার করে নিলো রাতুল। এজেন্সি থেকে ইনফরমেশন তাঁর মাধ্যমেই লিক হচ্ছিলো। হি ওয়াজ সোল্ড! বিশাল একটা অ্যামাউন্টের লোভ দেখিয়ে কিনে নেওয়া হয়েছিলো তাঁকে। কিন্তু পরোবর্তীতে তারাই আবার ওর সাথে বেইমানী করে। সত্যি সত্যি আটক করে ফেলে তাঁকে। কারণ শত্রুদের অনেক ইনফরমেশন জেনে গেছে সে। তাঁকে ছেড়ে দেওয়া মানে ওদের ইনফরমেশন লিক হওয়া।
তাই মেহরিনকে আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত হতে দেখে বাধা দিলো রাতুল। আতংকিত ফ্যাকাসে মুখে বারবার করে মাহমুদকে অনুরোধ করলো মেহরিনকে আটকাতে। কিন্তু তার আগেই শত্রুপক্ষের নির্দেশ মোতাবেক তাদের ঘাঁটির দিকে এগোতে শুরু করেছে মেহরিন।
মাহমুদ হতভম্ভ! রাতুলের মতন সৎ বিশ্বাসী এজেন্ট এই ধরনের কাজ করবে সে ভাবতেই পারে নি! দেশের সঙ্গে কি করে এতবড় বেইমানি করলো সে? অথচ তাঁকে রক্ষা করতেই ইরফান সাহেব পুরো ফোর্স পাঠয়েছেন! তাঁকে চুপ থাকতে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো রাতুল। কাঁদতে কাঁদতেই বারবার করে ক্ষমা চাইলো। অনুতপ্ত কন্ঠে বললো,’ওরা আমাকে ছাড়বে না মাহমুদ ভাই। ওদের অনেক ইরফরমেশন আমি জেনে গেছি। যদি বেঁচে থাকি সেগুলো এজেন্সি পাবে। কিন্তু,জানি বাঁচবো না। কালরাতেই ওরা আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিলো। কিন্তু শেষমুহুর্তে আমাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে আপনাদের ফাঁসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওদের মেইন টার্গেট নতুন এজেন্ট। নতুন ইনফরমেশন! তবে এটা নিশ্চিত যে আমাকে ওরা ছাড়বে না। আপনি প্লিজ মেহরিন আপুকে আটকান। প্লিজ মাহমুদ ভাই! আমার জন্য দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আর ক্ষতি করবে না। আমাকে আমার শাস্তি ভোগ করতে দিন।’
হতভম্ভ ভাব কাটিয়ে দ্রুতই নিজেকে সামলে নিলো মাহমুদ। আর একমুহূর্তও দেরী করলো না। সঙ্গে সঙ্গেই শুট করলো মেহরিনের দুপাশের দুজনকে। তবে গুলি শত্রুপক্ষ থেকেও চললো! রাতুলের ওপর!
মেহরিন হতবাক হয়ে চেয়েছিলো কেবল। তারপর থেকেই রাতুলের মৃত্যুর জন্য মাহমুদকেই দায়ী করলো সে। তাঁর ভাষ্যমতে, দুজনের মধ্যে সম্পর্ক থাকার কারণেই রাতুলকে এত সহজে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে মাহমুদ। হি ইজ সেল্ফিশ!এরকম একটা সেল্ফিশ লোকের সঙ্গে রিলেশন রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব না। সেই থেকেই দুজনের ব্রেক আপ।
এতক্ষণ যাবত সোহাগকে দুজনের ব্রেক আপ কাহিনী বলছিলো মাহমুদ। সোহাগ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’মেহরিন আপনার সাথে ঠিক করে নি মাহমুদ ভাই!’
-‘না সোহাগ। ইমোশোনালি, মে বি সি ওয়াজ রাইট। শেষ মুহূর্তে রাতুলের চোখে আমি বাঁচার আকুতি দেখেছিলাম। বাড়িতে তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী আর অসহায় ছোট বোন ছিলো! বাট প্র্যাক্টিকালি ব্যপারটা অন্যরকম। এই ছাড়া আমার কাছে আর কোন উপায় ছিলো না। ইদার আই হ্যাড টু লেট দ্যা ইনোসেন্ট ডাই অর আই হ্যাড টু লিভ দ্যা গিল্টি টু হিজ ফেইট! আই চোজ দ্যা সেকেন্ড ওয়ান।’
-‘উই নেভার লেট দ্যা ইনোসেন্ট ডাই! বেঁচে ফিরলেও রাতুলের শাস্তি হতো।’
-‘হতো। হয়ত মরতো কিংবা বেঁচে যেতো। একটা সম্ভাবনা ছিলো! বাট থিংক’স হ্যাপেন্ড সাডেনলি!’
-‘তবুও। আমি বলবো হি ওয়াজ আ ট্রেইটর! তাঁর শাস্তি মৃত্যু দন্ডই হওয়া উচিৎ।’
-‘ইয়েস। বাট হি ওয়াজ অলসো আওয়ার কলিগ। আমরা একসাথে অনেকগুলো মিশনে কাজ করেছি। মেহরিন ওকে ছোট ভাইয়ের মতই স্নেহ করতো। শেষমুহুর্তে বোধহয় মেহরিনকে বাঁচাতেই সত্যিটা বলে দিয়েছিলো সে।’
-‘ব্রেক আপের পর আপনি মেহরিনকে আটকানোর চেষ্টা করেন নি?’
-‘সব চেষ্টা ব্যর্থ ছিলো! মেহরিনকে আটকে রাখা যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজে ধরা দিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি তাঁকে আটকে রাখতে পারবে না।’
সোহাগ করুণ মুখে মাহমুদের দিকে চেয়ে রইলো। মাহমুদ খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথাগুলো বলছিলো। অথচ তাঁর চোখ লাল! কন্ঠস্বর নিষ্প্রাণ!
-‘ডাজ শী রিয়েলি হেইট ইউ?’
-‘নো। সি লাভস মি। সে আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমি এ-ও জানি যতই ভালোবাসুক না কেন ও নিজে যখন ঠিক করে নিয়েছে আমার কাছে ফিরবে না। তারমানে ফিরবে না। সি ইজ ভের্যি হার্ড! তোমার ইমাজিনেশন চাইতেও অনেক বেশি হার্ড।’
সোহাগ ব্যপারটা কিছুতেই মানতে পারছে না। মেহরিনের মত বুদ্ধিমান একজন এজেন্ট কি করে এমন বোকার মতন কাজ করতে পারে? রাতুলের প্রতি তাঁর স্নেহ থাকতেই পারে তাই বলে তাঁর অন্যায়কে ছোট করে দেখবে এটা কেমন কথা? একটা নিরপরাধ মানুষকে দোষী বানিয়ে দিয়েছে সে। দিস ইজ আনফেয়ার। ভেরি আনফেয়ার!’
★
এইটুকুই ছিলো মাহমুদের সঙ্গে ব্রেক আপ করার জন্য মেহরিনের সাজানো অযুহাত। বাট দ্যা রিয়েল স্টোরি ইজ কমপ্লিটটি ডিফরেন্ট! ইন দ্যাট স্টোরি মাহমুদ ইজ দ্যা ওয়ান এন্ড অনলি হিরো অফ হার লাইফ হোম সি লাভস দ্যা মোস্ট!
রাতুল মারা যাওয়ার পর মিশন শেষে সেদিনই অন্য একটা মিশনে আফ্রিকা পাঠানো হয় মাহমুদকে। মেহরিনের শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না বিধায় ইরফান সাহেব তাঁকে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেন। মাইন্ড রিফ্রেশমেন্ট এর জন্য পনেরো দিনের ছুটি দিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ পনেরো দিনই ছুটিই ছিলো মেহরিনের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজিডি। ইন দ্যাট টাইম শী লস্ট হার ইউটেরাস অ্যাজ আ রেজাল্ট অফ আ টিউমার অপারেশন! অ্যান্ড হ্যাড টু এক্সেপ্ট স্টেরিলিটি!সারাজীবনের জন্য বন্ধ্যাত্ব বরণ করে নিতে হয়েছিলো তাঁকে। ডাক্তার স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন সি কান্ট বি আ মাদার উইথ হার ওন.! অথচ এতবড় সত্যিটা লায়লা শারাফাতের কাছেও চেপে গেলো মেহরিন। ঢাকার বাইরে অন্য হস্পিটালে অপারেশন করালো। সমস্ত ধকল একা একাই সহ্য করলো। তারপর রাতুলের মৃত্যুর অজুহাতটাকে কাজে লাগিয়ে মাহমুদের সঙ্গে ব্রেক-আপ করার সিদ্ধান্ত নিলো। নিজেকে বোঝালো, শুধুমাত্র ভালোবাসায় অযুহাতে মাহমুদের লাইফটাকে নষ্ট করার কোন অধিকার তাঁর নেই। এটা স্বার্থপরতা! সি হ্যাজ টু স্যাক্রিফাইস হার লাভ!
★
এবার আসি বর্তমানে,
পুরো অফিস ফাঁকা। থার্ড ফ্লোরে দুটো রুমে বাতি জ্বলছে কেবল। মাহমুদ আর মেহরিন আলাদা আলাদা ভাবে নিজেদের ডেস্কে বসে কাজ করছে। ইরফান একগাদা ফাইল ধরিয়ে দিয়েছেন দুজনকে। সেগুলো দেখে নতুন করে প্রত্যেকটা ফাইলের রিপোর্ট করতে হবে। বাধ্য হয়ে রাত জেগে কাজ করতে হচ্ছে দুজনকে।
মাহমুদের কাজ শেষ। মেহরিনের রুমে উঁকি দিলো সে। ভেতরে বসে একমনে কাজ করছে ডাকুরানী! দরজায় টোকা দিলো মাহমুদ।
-‘কাজ শেষ?’ টেবিল থেকে মুখ না তুলে জিজ্ঞেস করলো মেহরিন।
-‘হ্যাঁ। তোমার বাকি থাকলে আমাকে দিতে পারো।’
-‘লাগবে না। আরেক সামান্য।’
মাহমুদ ভেতরে ঢুকে টেবিলের ওপর উঠে বসলো। টেবিলের ওপর সকালের এনার দেওয়া গিফট বক্স আর একটা ছোট টিফিন বক্স রাখা। টিফিন বক্স খুলে দেখলো সে, খালি! বন্ধ করে এনার দেওয়া বক্সটা খুললো।
মেহরিন একঝলক সেদিকে তাকিয়ে ফের কাজে মনোযোগ দিলো। চকলেট দিয়েছে এনা। সাথে একটা চিরকুট। মাহমুদ প্রথমে প্যাকেট খুলে চকলেটে কামড় বসালো। তারপর আধখাওয়া চকলেটের বাকি অংশ মেহরিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’খাবে?’
-‘উহু।’ তাঁর হাতটা সরিয়ে দিলো মেহরিন।
আরো একটা বাইট বসালো মাহমুদ। তারপর একহাতেই চিরকুটটা খুলে জোরে জোরে পড়তে শুরু করলো।
‘প্রিয় মেহরিন আপু,
আপনি কি জানেন আপনি ঠিক চকলেটের মতনই মিষ্টি? বোধহয় জানেন না। সেজন্যই সবসময় মন খারাপ করে থাকেন। আপনাকে যে আমি কত পছন্দ করি আপনি সেটাও জানেন না। ছেলে হলে নিঃসন্দেহে আমি আপনাকে প্রপোজ করতাম…’ বাকিটা আর পড়লো না মাহমুদ। ঠাট্টাসুরে বললো,’মনে হচ্ছে প্রেমপত্র লিখেছে। আজকাল মেয়েরাও একে অপরের তারিফ করে দেখছি! ইম্প্রেসিভ! মেহরিন তাঁর কাছ থেকে চিরকুটটা নিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিলো।
ঠোঁট উল্টালো মাহমুদ। কিছু চুপচাপ বসে থেকে আরেকটা চকলেট খুলে খাওয়া শুরু করলো। তাঁর যে খিদে পেয়েছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না মেহরিনের। নিশ্চয়ই রাতে খাওয়া হয় নি! কাজ করতে করতে কখন যে সময় চলে গেছে মাহমুদ টেরই পায়নি। ব্যাগ থেকে ছোট একটা বক্স বের করে তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলো মেহরিন। ভুনাখিচুড়ি! সাথে শসা আর গাজর খেটে আনা হয়েছে। মাহমুদ একবার বক্সটার দিকে একবার মেহরিনের হাতের দিয়ে চেয়ে থেকে হেসে ফেললো।
-‘ডিনার করো নি কেন?’
-‘খেয়াল ছিলো না। কিন্তু তোমার কাছে দুটো বক্স? এত খাও তুমি?’
-‘বক্স নিয়ে নেবো কিন্তু।’
-‘আচ্ছা সরি!’
মেহরিন নিজে থেকেই বললো,’লাঞ্চে রুটি আর সবজি নিয়ে এসেছিলাম। খাওয়ার সময় পাই নি। সেগুলো দিয়ে ডিনার করেছি। তাই বক্সটা রয়ে গেছে।
মাহমুদ খেতে খেতে বললো,’ও আচ্ছা। ঠিক আছে এবার তোমার কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করো। পৌনে একটার মতন বাজে।’
★
কাজ শেষ। টেবিল গুছিয়ে নিলো মেহরিন। বেরোনোর সময় মাহমুদ এনার দেওয়া চকলেটের বক্সটা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’তোমার গিফট ফেলে যাচ্ছো।’
ভুলবশত ফেলে যাচ্ছিলো মেহরিন। মুচকি হেসে বললো,’নিয়ে আর কি হবে? তুমি তো খেয়ে অর্ধেক শেষ করে ফেলেছো।’
-‘বাকি অর্ধেক?’
মেহরিন বক্স থেকে একটা চকলেট তুলে নিয়ে বললো,’গিফট দিয়েছে তাই একটা রাখলাম। বাকি গুলো তোমার।’
-‘চকলেট দিয়ে আমি কি করবো?’
-‘এতক্ষন কি করেছো?’
-‘তখন তো ক্ষিধে ছিলো।’
-‘ঠিক আছে, নিতে হবে না তোমার। দাও, আমার গিফট আমাকেই ফেরত দাও।’ বক্সটা মাহমুদের হাত থেকে নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললো সে।
-‘টাকলু তোমাকে কিছু দেয় নি?’
-‘দিয়েছে। ঘড়ি!’
দুজনে লিফটের কাছে এসে দাঁড়ালো। হঠাৎ করেই প্রশ্ন করলো মেহরিন,’সবাই তো যা দেওয়ার দিয়েছে। তুমি আমাকে কোন গিফট দিলে না?’
নিতান্ত রসিকতা করে প্রশ্নটা করেছিলো সে। কিন্তু মাহমুদ হাসলো না। চট দুপা এগিয়ে এলো মেহরিনের কাছাকাছি! দুহাতে তাঁর বাহু চেপে ধরে আচ্ছন্ন গলায় বললো,’কি চাও বলো? যা চাও তাই দেবো! আই প্রমিস!’
তাকে সরিয়ে দিয়ে আচমকাই হেসে ফেললো মেহরিন। ঠাট্টাসুরে বললো,’বেশি কিছু না। আপাতত তোমার গাড়িতে একটা লিফট দিলেই হবে। আমার গাড়িটা আবার গেছে।’
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মাহমুদ। কৃত্রিম আফসোসে মাথা দুলিয়ে বললো,’কতবড় সুযোগ! চাইলে গোটা আমি টাকেই পেয়ে যেতে মিস মেহরিন শারাফাত! আর তুমি কি না চাইলে সামান্য একটা লিফট? দুঃখজনক! খুবই দুঃখজনক!’ অথচ তাঁর সত্যিই কষ্ট হচ্ছে!
-‘এই মুহূর্তে তোমার চাইতে তোমার গাড়িটাই আমার বেশি প্রয়োজন মি.মাহমুদ সিদ্দিকি। বাসায় ফিরতে হবে।’, ফের ঠাট্টারসুরে জবাব দিলো মেহরিন।
তাঁর ঠাট্টায় যোগ দিলো না মাহমুদ। যতই শক্ত থাকার চেষ্টা করুক না কেন ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড অসহায় বোধ করছে সে। গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করে বললো,’এসো।’
চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো মেহরিন। শুনশান রাস্তা ধরে এগোতে শুরু করলো গাড়ি। দুজনেই নিরব। ঝাপিয়ে কান্না আসছে মেহরিনের কিন্তু সে কাঁদতে পারছে না। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের ভেতর!
.
.
.
চলবে
#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১০
সাপ্তাহিক ছুটি। কলিগরা সবাই মিলে মাহমুদের বাসায় পার্টি দিয়েছে। মেহরিনও এসেছে এবং যথারীতি সবার শেষেই এসেছে।নিরিবিলিতে সোফায় বসে ফোন স্ক্রল করছে। হাতে জুসের গ্লাস। তাতে অল্প অল্প করে সিপ দিচ্ছে আর মাঝেমাঝে আড়চোখে মাহমুদকে দেখছে। কালো একটা জার্সি ট্রাউজারের সাথে ছাই রঙা টি-শার্ট পরেছে মাহমুদ। অ্যাজ ইউজুয়্যাল লুকিং হ্যান্ডসাম! পা দুটো ছড়িয়ে মেঝেতে লেপ্টে বসে আছে। চোখাচোখি হতেই চোখ ফিরিয়ে নিলো মেহরিন।
হৈ-হুল্লোড় অবশ্য খুব একটা হচ্ছে না। মেঝেতেই গল্পের আসর জমিয়ে গোল হয়ে বসেছে সবাই। মেহরিন উঠে কিচেনে চলে গেলো। খুব খিদে পেয়েছে তাঁর। দুপুরে খাওয়া হয় নি। পার্টি উপলক্ষ্যে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার অর্ডার করেছে মাহমুদ। প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে ঝটপট ডিনারে বসে গেলো সে। গল্পের আসর ছেড়ে উঠে এলো মাহমুদ। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে তাঁর সামনে রেখে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। এদিকে মেহরিনের দেখাদেখি বাকিরা খিদে পেয়েছে, খিদে পেয়েছে বলে টেবিলে বসে পড়লো। বাদ গেলো শুধু মাহমুদ। তাঁর শরীর খারাপ। খাবারে রুচি নেই।
ঘরভর্তি মানুষজন। সোহাগ গিয়ে মেহরিনের পাশে বসলো। মেহরিনের খাওয়া প্রায় শেষ। চামচ দিয়ে খাবার নাড়াতে নাড়াতে বললো,’হোস্ট কোথায় সোহাগ? সে খাবে না?’
-‘পরে খাবে।’ এককথায় উত্তর দিলো সোহাগ। ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলো মেহরিন। রোজ সোহাগ এত কথা বলে, আজকে তাঁর দরকার অথচ আজকেই সে চুপ করে বসে আছে। অসহ্যকর! এদিকে সোহাগ নিজে থেকে কিছু না বললে তো সে জিজ্ঞেসও করতে পারবে না।
★
বেশকিছুক্ষণ নিরবে কেটে গেলো। ডিনার শেষে সোহাগ গ্লাসে ড্রিংক্স ঢেলে নিতে নিতে বললো,’ভাবছি যাবার সময় সবাই মিলে বাসাটা পরিষ্কার করে দিয়ে যাবো। মাহমুদ ভাইয়ের শরীর খারাপ। উনাকে কষ্ট দেওয়াটা ঠিক হবে না।’
-‘শরীর খারাপ?’
-‘হ্যাঁ। জ্বর!’
-‘তো শরীর খারাপ যখন পার্টি ক্যান্সেল করে দিলো না কেন?’
-‘অ্যারেঞ্জমেন্ট সব আগে করা হয়েছিলো। আমরা না এলে খাবার সব নষ্ট হতো। সে যাই হোক, হলে নাহয় হতো কিন্তু আমরা তো জানতামই না উনার শরীর খারাপ। এখানে আসার পরই শুনেছি।’
এতক্ষণে সবার শান্ত থাকার কারণ বুঝতে পারলো মেহরিন। আজকে সবাই অন্যদিনের তুলনায় অনেক বেশি শান্ত। মাহমুদের অসুস্থতার কারণেই শোরগোল করছে না কেউ। সাবধানে কথাবার্তা বলছে। খাবার শেষ করে খালি প্যাকেটগুলো বিনে ফেলে হাত ধুয়ে নিলো সে। উঁকি দিলো মাহমুদের রুমে। নাহ! খালি নেই। খাটের ওপর তাকে ঘিরে তিনচার জন বসে আছে। লম্বা হয়ে শুয়ে আছে মাহমুদ। ডান হাতটা ভাঁজ করে কপালের ওপর রাখা। অগত্যা সরে যেতে মেহরিনকে। সোহাগ মাহমুদের রুমের ঢুকতে যাবে, মেহরিন উঁকি দিতে দেখে বললো,’কি ব্যপার মেহরিন? কিছু খুঁজছো?’
আচমকা তাঁর গলার স্বর শুনে চমকে উঠলো মেহরিন। বিব্রত মুখে তাড়াহুড়ো করে জবাব দিলো ,’না মানে ওয়াশরুমে যাবো।’
-‘ভেতরে কেউ আছে?’
-‘সেটাই দেখছিলাম।’
-‘দাঁড়াও আমি দেখছি।’
সোহাগ ভেতরে ঢুকতেই মাহমুদ ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,’কি?’
-‘ওয়াশরুমে কেউ আছে?’
-‘এনা গেছে।’
বেরিয়ে এলো সোহাগ। তাঁর পেছন পেছন মাহমুদও উঠে এলো। দরজার কাছে মেহরিনকে দাঁড়ানো দেখে বেরিয়ে গেলো। ডাইনিং এর পেছনে কমন ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দিয়ে বললো,’যাও।’
বিব্রত বোধ করলো মেহরিন। সোহাগের কাছে থেকে অস্বস্তি লুকাতে মিথ্যে বলেছিলো সে। এইমুহূর্তে মাহমুদের উপস্থিতি সেটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এর আগে অনেকবার এই বাসায় এসেছে মেহরিন। সুতরাং, ওয়াশরুম, বারান্দা, স্টোরুম সবই তাঁর চেনা। মাহমুদকে নিরবদৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে উশখুশ করলো। এইমুহূর্তে এই দৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে হলে ওয়াশরুমে ঢুকাটাই বেস্ট অপশন। তাই দেরী না করে ঝটপট ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
ফ্রেশ হয়ে মাথায় পানি দিয়ে বের হলো। মাহমুদ নেই। আরো একবার তাঁর রুমের দিকে উঁকি দিলো মেহরিন। নেই! এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে শেষে কিচেনে দেখা মিললো। ভেতরে মাহমুদ একা নয় এনাও আছে। মাহমুদকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। চুপচাপ ডাইনিং এ গিয়ে বসলো মেহরিন। হঠাৎ করেই বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া করছে। অসহ্য লাগছে সবকিছু। মিনিট দুয়েক বাদে বেরিয়ে এলো মাহমুদ। হাতে প্লেটভর্তি খাবার। তাঁর অপজিটে চেয়ার টেনে বসলো। টিভি তে ভারত পাকিস্তানের খেলা চলছে। লাইভ টেলিকাস্ট। সবার মনোযোগ টিভির দিকে। মাহমুদ খেতে খেতে টিভি দেখছিলো। মেহরিন গম্ভীরমুখে ফোনের দিকে চেয়ে রইলো।
★
ডিনার শেষে গ্লাসে ড্রিংক্স ঢেলে নিলো মাহমুদ। আয়েশি ভঙ্গিতে গ্লাসে চুমুক দিতে যাচ্ছিলো, মেহরিনের চোখে চোখ পড়তেই জিজ্ঞেস করলো,’ইউ ওয়া’না ড্রিংক?’ নিতান্ত ঠাট্টার সুরেই প্রশ্নটা করেছিলো সে। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে তড়িৎগতিতে গ্লাসটা নিয়ে নিলো মেহরিন। কোনরকম কথাবার্তা ছাড়াই গলাধঃকরণ করে নিলো পুরো গ্লাস। মাহমুদ হতভম্ভ! পুনরায় বোতল থেকে ড্রিংক্স ঢেলে নিলো মেহরিন। মাহমুদ কিছু বুঝে উঠার আগেই আবারো পুরো গ্লাস গলায় ঢেলে দিলো। এদিকে ওদিক চাইলো মাহমুদ। সবার দৃষ্টি টিভির দিকে। তিন নাম্বার গ্লাস মুখে দেওয়ার আগেই ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো সে। অবাক হয়ে বললো,’কি করছো কি? নেশা ধরে যাবে তো!’
-‘দ্যাট’স নান অফ ইউর বিজনেস!’ রাগে চোখ লাল করে চাইলো মেহরিন। মাহমুদের হাতের বোতলটা ফিরিয়ে নিতে চাইলো।
অবস্থা বুঝে প্রতিউত্তর করলো না মাহমুদ। ঘরভর্তি লোকজন! এদের সামনে ঝামেলা করার কোন মানে হয় না। তবে বোতল ফেরত দিলো না। কোলে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। মেহরিন তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ তাঁর মুখের দিকে চেয়ে থেকে সোহাগকে উদ্দেশ্য করে বললো,’খেলা শেষ হতে আর কতক্ষণ লাগবে সোহাগ। বেশি দেরী হলে আমি একাই চলে যেতে পারবো।’
সোহাগের মনোযোগ খেলার দিকে। অনুরোধের সুরে বললো,’আর দশটা মিনিট বসো মেহরিন। সবাই একসাথে বেরোবো।’
-‘আমার দেরী হয়ে যাবে।’, ঘোরতর অনিচ্ছা প্রকাশ করলো মেহরিন।
বাধ্য হয়ে খেলার আসর থেকে উঠে আসতে হলো তাঁকে। কিন্তু মাহমুদের ইশারায় পুনরায় ফিরে যেতে হলো। মাহমুদকে বারণ করতে দেখে খেপে গেলো মেহরিন। একাই বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো কিন্তু তৎক্ষণাৎ মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। গা গুলিয়ে বমি আসছে। অ্যালকোহলের তেজ গলায় বিষাক্ত জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে। ছুটে বেসিনের দিকে চলে গেলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পেছন পেছন গেলো মাহমুদ। মেহরিনের হঠাৎ রাগের কারণ তাঁর অজানা! ভয়ে জিজ্ঞেস করার সাহসও পেলো না। কি থেকে কি বলে ফেলবে, শেষে দেখা যাবে ঝগড়া লেগে গেছে দুজনে। তার চেয়ে চুপ করে থাকাই শ্রেয়। মেহরিন শান্ত হলে পরে জিজ্ঞেস করা যাবে।
★
কলিগরা সবাই চলে গেছে। মাথার ওপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে নিরব দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মেহরিন। মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ড্রয়িংরুমে সোহাগ অপেক্ষা করছে। মিনিট দশেক বাদে মাহমুদ ভেতরে ঢুকে মেহরিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,’দেখি ওঠো। বিছানা ঝাড়বো।’
দ্বিধান্বিত চেহারা নিয়ে মেহরিন উঠে বসলো। ক্লান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,’সোহাগ? সোহাগ নেই? চলে গেছে?’
-‘হ্যাঁ।’
অবাক হলো মেহরিন! তাঁর কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই চলে গেছে সোহাগ? মাহমুদকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না। গায়ে একফোঁটাও জোর নেই। দুবার বমি করায় ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। তাঁর শরীর খারাপ দেখেই সোহাগ চলে গেছে।
মাহমুদ বিছানা রেডি করে এসির টেম্পারেচার বাড়িয়ে দিলো। রিমোটটা মেহরিনের মাথার কাছে রেখে আলমারি থেকে কম্বল বের করে দিয়ে বললো,’শুয়ে পড়ো। আমি বাতি নিভিয়ে দিচ্ছি।’
চুপচাপ শুয়ে পড়লো মেহরিন। বাতি নিভিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো মাহমুদ। ড্রয়িংরুমে বসে টিভি অন করলো। টিভি দেখার ফাঁকে হঠাৎ ফোন বের করে এনার নাম্বারে ডায়াল করলো। এনা মাত্র বাসায় গিয়ে পৌঁছেছে এনা। মাহমুদের ফোন পেয়ে হাসিমুখে রিসিভ করে বললো,’মাত্রই বাসায় ঢুকেছি। তুমি ফোন দিলে।’
-‘ও আচ্ছা। এইজন্যই ফোন দিয়েছিলাম। ঠিক আছে রাখি তাহলে। কাল দেখা হচ্ছে।’, সংক্ষেপে কথা শেষ করতে চাইলো মাহমুদ।
আজকে মাহমুদের সম্পর্কে নতুন করে অনেক কিছু জেনেছে এনা। বেশিকিছু প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু সংকোচের জন্য জিজ্ঞেস করতে পারলো না। আপাতত কৌতূহল চেপে পুনরায় হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,’মেহরিন আপুর কি অবস্থা? ঘুমিয়ে গেছে?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি রাখছি। সকালে কথা হবে!’
ফোন রেখে টিভির দিকে মনোযোগ দিলো মাহমুদ। ড্রয়িংরুমে কথার আওয়াজ শুনে উঠে এলো মেহরিন। তাকে দেখে মাহমুদ অবাক হয়ে বললো,’এখনো ঘুমাও নি?’
-‘খেলার কি অবস্থা?’
-‘শেষ। ভারত তিন উইকেটে জিতেছে।’
-‘ওহ!’ উশখুশ করলো মেহরিন।
-‘কিছু বলবে?’
-‘আমি বাসায় যাবো।’
আসলে এইমুহূর্তে মেহরিনের পক্ষে এই কথা বলা অসম্ভব কিছু নয়। তাঁর অস্বস্তি হওয়াটাই স্বাভাবিক। মাহমুদের বাসায় এর আগে অনেকবার এসেছে। কিন্তু তখনকার হিসেবটা ছিলো অন্যরকম। এখন সব বদলে গেছে। মাহমুদ হাতঘড়ি চেক করলো। ঘড়িতে এখন সাড়ে বারোটার মতন বাজে। যেতে হলে কমপক্ষে একঘন্টা। শান্তভাবেই বললো,’এখন বেরোলেও দেড়টার আগে পৌঁছাতে পারবে না। আরো বেশিও লাগতে পারে।’
হতাশভাবে সোফায় বসে পড়লো মেহরিন। এতরাতে গাড়িঘোড়া কিচ্ছু পাওয়া যাবে না। তাছাড়া তাঁর গাড়িও নষ্ট। ঠিক করতে দিয়েছে সেই কবে। এখনো ঠিক হয় নি। অতএব আজকে রাতটা তাঁকে এখানেই কাটাতে হবে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,’তোমার নাকি শরীর খারাপ। শুয়ে পড়ছো না কেন?’
-‘আমার ঘুম আসতে দেরী হয়। একটু বাদে রিয়েল মাদ্রিদ এর খেলা আছে। ম্যাচ দেখে তারপর ঘুমাবো।’
-‘ওহ। আমারও ঘুম আসছে না। মাথা ধরে আছে।’
-‘কফি খাবে?’
-‘কে বানাবে তুমি?’
-‘হ্যাঁ। ভালোই বানাই। টেস্ট করে দেখতে পারো।’
মেহরিন সম্মতিসূচক হাসলো। মাহমুদও সলজ্জ হেসে বললো,’ ক্রেডিটটা অবশ্য এনার। ওর কাছ থেকেই শিখেছি।’
-‘শুধু কফি বানানোই শিখেছো আর কিছু শেখো নি?’
-‘ফ্রেঞ্চফ্রাই করতে পারি। ম্যাগি বানাতে পারি।’
তাঁর সরল স্বীকারোক্তিতে ফের হেসে ফেললো মেহরিন। মাহমুদ উঠে কফি বানাতে চলে গেলো। পেছন পেছন সে-ও ঢুকলো। কিচেন পরিষ্কার ঝকঝকে। এনা যাবার আগে সব গুছিয়ে দিয়ে গেছে। মেয়েটা ভীষণ কাজের। দেখলে বোঝাই যায় না এতটা সংসারী ধরণের! আনমনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মেহরিন। এদিকে ওদিক চোখ বুলিয়ে বললো,’আমার বাসাটা বদলাবো ভাবছি।’
-‘হঠাৎ?’
-‘আগের মালিক বাসা বেচে দিয়েছে। নতুন মালিক বেশি সুবিধার না। রাতে ফেরা নিয়ে মায়ের সঙ্গে ঝামেলা করে।’
-‘আমি তো সেই কবেই বদলাতে বলেছিলাম।’
রিলেশনে থাকাকালীন মেহরিনের বাসা নিয়ে খুব আপত্তি ছিলো মাহমুদের। অফিস থেকে অনেক দূরে। ভাড়াও বেশি। তবুও মেহরিন চেঞ্জ করবে না। বলে বলে হয়রান হয়ে ত্যক্ত হয়ে শেষে বলা বাদ দিয়েছে।
-‘বাসা বদলালেই তো আর হয় না। নতুন বাসা গুছাবার মত সময় কই?’
মাহমুদ ঠাট্টার সুরে বললো,’বিয়ে করে নিলেই তো পারো। স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে গোছাবে!’ মেহরিনও পাল্টা হেসে বললো,’আগে তোমার বিয়ে দিয়ে নেই তারপর আমি বিয়ে করবো!’
-‘পাত্রী দেখেছো?’
-‘পাত্রী তো রেডিই আছে।’
-‘পাত্রী রেডি আছে?’,অবাক হলো মাহমুদ।
-‘হ্যাঁ।’
-‘কে শুনি?’
এনা নামটা বলতে গিয়েও চেপে গেলো মেহরিন। মাহমুদ বুঝেও না বোঝার ভান করতে দেখে মুচকি হেসে কৃত্রিম রহস্যের ভঙ্গিতে বললো,’বলা যাবে না।’
মাহমুদ ফের ঠাট্টার সুরে বললো,’বলা যাবে না, এটা আবার কেমন নাম!’
-‘ভালোবেসে দিলাম নাহয় তোমার বউকে একটা নাম। ক্ষতি কি?’
কফি বানানো শেষ। গ্যাস বন্ধ করে দিলো মাহমুদ। মেহরিনের হাতে একটা মগ ধরিয়ে দিয়ে বললো,’চলো বাইরে চলো।’
একসঙ্গে কিচেন থেকে বেরোলো দুজন। সোফার ওপর পা তুলে বসলো মাহমুদ। মেহরিনকে বসতে ইশারা করে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো সে। ঘুরে ঘুরে পুরো বাসাটা দেখলো। এখনো সব আগের মতনই আছে। শুধু বেডরুমে তাঁর আর মাহমুদের ছবি গুলো নেই। দেখা শেষ হলে নিরিবিলিতে পুনরায় মাহমুদের ঘরের বারান্দায় গিয়ে বসলো। মনে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। রিলেশনে থাকাকালীন এই বারান্দায় বসে একসঙ্গে কত গল্প করেছে দুজনে। বিয়ে, সংসার, বাবু কতরকম গল্প!
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে রইলো। মাহমুদ যে কখন এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করে নি। উঠে দাঁড়াতেই তাঁকে দেখে থমকে গেলো। তাঁকে মাঝখানে বন্দি করে হাতদুটো বারান্দার গ্রিলে রাখলো মাহমুদ। ফিসফিস করে বললো,’কিছু মনে পড়ে মেহরিন? পুরোনো কথা?’
বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো মেহরিনের। অস্থির রকমের জ্বালাপোড়া! তথাপি নিজেকে সামলে নিলো। ম্লান হেসে বললো,’পড়বে না কেন? অপ্রয়োজনীয় কথাগুলোই মানুষের সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে।’
মাহমুদ প্রতিউত্তর করলো না। কথাটা মিথ্যে! কিন্তু প্রতিবাদ করতে হলে ভালোবাসার জোর দেখানোর মতন অধিকার থাকা চাই! সেই অধিকার তাঁর নেই। আলতো করে মেহরিনের গালে হাত ছোঁয়াতে গিয়েও সসংকোচে ফিরিয়ে নিলো। হেলান দিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ক্লান্ত গলায় বললো,’তা না হলে তো মানুষ রোবট হয়ে যেতো! শুধুমাত্র প্রয়োজন দিয়ে তো আর জীবন চলতে পারে না। প্রয়োজন,অপ্রয়োজন দুটো মিলেই মানুষের জীবন।’
মেহরিন জবাব দিলো না। অন্ধকারে বাইরের দিকে চেয়ে রইলো। এভাবে কয়েকমুহূর্ত কেটে যাবার পর মাহমুদ আবারো তাঁকে দুহাতের মাঝখানে বন্দি করে ফেললো। খানিকটা ঝুঁকে বিষণ্ণ গলায় বললো,’একটা অনুরোধ করি?’
-‘কি?’
-‘একবার তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরবো? জাস্ট একবার!’
আতঙ্কে চোখ চোখ বড়বড় করে ফেললো মেহরিন। হাতের মুঠো শক্ত করে ফেললো। নিচের ঠোঁটটা এত জোরালোভাবে কামড়ে ধরলো রক্ত আসার জো। তাঁর এই আতঙ্ক মাহমুদকে জড়িয়ে ধরার অনিচ্ছা প্রকাশে নয় বরং আত্মসংবরণে ব্যর্থ হবার ভয়ে! নিজেকে শক্ত খোলসটা ভেঙ্গে যাওয়ার ভয়ে! দ্রুত বাধা দিয়ে বললো,’নো। উই হেভ বিন সেপারেটেড ফর মোর দ্যান টু ইয়ার্স! সো প্লিজ কিপ ডিস্টেন্স!’
-‘জাস্ট একবার!’ ফের অনুরোধ করলো মাহমুদ।
মেহরিন তাঁকে সামনে থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললো,’দেখি সরো, অনেক রাত হয়েছে। আমি ঘুমাবো!’
তাঁর উদাসীনতা ভীষণভাবে আঘাত করলো মাহমুদকে। রবীঠাকুর বলেছিলেন,’আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান। প্রাণেরও আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ!’ মাহমুদের অবস্থাও অনেকটা সেরকম! সে জানে তাঁর প্রিয়তমা নারীটি নিষ্ঠুর! বড়ই নিষ্ঠুর! তবুও তাঁর একেই চাই! অতঃপর আত্মবিস্মৃত হয়ে হেঁচকা টানে মেহরিনকে বুকের কাছে নিয়ে এলো সে! এবং মেহরিন কিছু বুঝে উঠার আগেই হি স্মেশড্ হার লিপ্স বাই হিজ..!
একসেকেন্ড, দুইসেকেন্ড,তিনসেকেন্ড…দশসেকেন্ড! ঘটনার আকস্মিকতায় মেহরিন হতভম্ভ! গোলগাল চোখে মাহমুদের দিকে চেয়ে থেকে বললো,’ইউ কিসড মি?’
-‘ইয়েস! আই কিসড ইউ!’, মাহমুদের চোখেমুখে বিজয়ীর হাসি!
কিন্তু মুহূর্তেই তাঁর হাসি গায়েব হয়ে গেলো। তাঁর পরিবর্তে দেখা দিলো অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকার! সপাটে তাঁর গালে চড় বসিয়েছে মেহরিন। কয়েকমুহূর্তের জন্য কোন কথা বলতে পারলো না সে। অপমানে, লজ্জায় তাঁর সুন্দর মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেলো। একটা প্রশ্নই মাথায় উদয় হলো, ডাজ হি রিয়েলি ডিজার্ভ দিজ?
নো! নেভার! সি ইজ সাচ আ স্টোন হার্টেড পার্সন! সি নেভার কেয়ারড ফর হিম! চুপচাপ রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো সে। মেহরিন বজ্রাহতের মতন জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো! ভয়ানক ভাবে মাথা ঘুরছে তাঁর! চোখের পানি নিঃশব্দে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে! অথচ বুকের ভেতরটা ফাঁকা, শূন্য, অনুভূতিহীন!
চলবে