#৫ম_তলার_মেয়েটা,পর্ব-০২,০৩
ফাহমিদা_লাইজু
#পর্ব_২
সিমি তার বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনি কোন দিন,আজ সে কত সহজেই মোবাইলে নিজের বিয়ের কথা বলে ফেলল।ফোনে এই এক সুবিধা যে কোনো কিছু বলে ফেলা যায়। সরাসরি অনেক কথাই অনেক সময় বলা যায় না।
—বাবা আমি বিয়ে করে ফেলেছি,আমাকে ক্ষমা করে দিও।
এতটুকু বলেই সিমি লাইন কেটে দিল।
শফিক যেন স্বপ্ন দেখছেন,তাঁর মনে হচ্ছে স্বপ্নের ভিতরেই এই সব কথাগুলো শুনলেন।একটা কথাও না বলে চেয়ারে বসে পড়লেন ধপ করে।
পারু বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন ,কে ফোন করেছিলো। উত্তর না পেয়ে হাত থেকে মোবাইল নিয়ে দেখলেন সিমির নাম্বার থেকেই কল এসেছিলো।তিনি আবার কল করলেন কিন্তু বন্ধ পেলেন।
এক অজানা আশঙ্কায় তার হৃদয় কেঁপে উঠলো।
ভয়ে ভয়েই শফিকের হাতে ঝাঁকি দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন –
—কি বলল সিমি?বল কি বলল? আমার মেয়ের কোন বিপদ হয়নি তো?
শফিক ,পারুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ।এখন মনে হলো এটা স্বপ্ন না,একেবারে বাস্তব।সিমি তাদের না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে।কত বড় স্পর্ধা?
খুব শান্ত ভাবে বললেন শফিক-
—তোমার মেয়ে, সিমি বিয়ে করেছে।
—কি ? কি বলছ এই সব?
এইবার শফিক কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেন-
—আমি কি তোমার সাথে তামাশা করছি? মশকরা করছি?বুঝতে পারছ না কথা?
কথাটা বুঝতে পারুর কিছুটা সময় লাগলো। কিন্তু হজম করতে পারলেন না , কোন কথা না বলে ঢলে পরে গেলেন তিনি।
এই সংবাদটা হজম করার মত মানসিক শক্তি পারুর নেই।তাই যা হবার তাই হলো।
পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা ঝিমি দৌড়ে এলো মায়ের কাছে।সাথে সাথে মর্জিনা ও এলো।শফিক রাগে কাঁপতে লাগলেন। সবকিছুর জন্যই তিনি পারুকে দোষী ভাবতে লাগলেন।জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে পরে থাকতে দেখেও তার মনে কোন দাগ কাটলো না। তিনি এই জায়গা থেকে চলে গেলেন। তিনি একটু বুঝতে পারলেন না তার রাগ তাকে মনুষ্যত্বহীন করে তুলেছে।একটা অপরিচিত মানুষের এমন অবস্থায় ও মানুষ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে আর তাঁর মনে এত বছরের সঙ্গীর জন্য এক ফোঁটা মমতাও উঁকি দিল না।
ঝিমি দিশা পাচ্ছে না এখন সে কি করবে।এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। মর্জিনা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো।শাওন এসেছে।ঝিমি তার ভাইকে পেয়ে এতক্ষণে যেন একটু প্রাণ পেলো।সে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল-
—ভাইয়া দেখ মায়ের কি হয়েছে।এখন কি করবো?
মায়ের এই অবস্থা দেখে শাওন অবাক হলেও মনে মনে ভাবলো তার বাবার জন্যই হয়তো এমন হয়েছে।রুমি যে বাসায় নেই সেই খেয়াল তার মনেই এলো না।
ওরা তিনজন মিলে পারুকে বিছানায় তুলে, শুইয়ে দিল।ঝিমি মাথায় পানি ঢালতেই কিছুক্ষণের মধ্যেই পারুল জ্ঞান ফিরলো।আর তিনি শুরু করলেন বিলাপ।এই শুনে শফিক আবার অগ্নিমূর্তি ধারণ করে এলেন-
—ঢং পেয়েছ,মরা কান্না জুড়ে দিয়েছে? আচ্ছা ঠিক আছে আজকেই ইচ্ছে মতো কেঁদে নাও,মেয়ে মরে গেছে একটু তো কাঁদতেই হয়।তবে আস্তে কাঁদ। তোমার মরা কান্না শুনে আশেপাশের লোকজন এসে জিজ্ঞেস করতে শুরু করবে।
আর একটা কথা আজ এই মুহুর্ত থেকে এই বাসায় সিমির নাম কেউ উচ্চারণ করবে না।সবাইকে ভাবতে হবে সিমি মরে গেছে।
এই বলে শফিক বারান্দায় চলে গেলেন।
শাওন এই সব শুনে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তার বড় বোন বাবার ভয়কে উপেক্ষা করে এত বড় একটা কাজ কিভাবে করলো সেই চিন্তা তার মাথায় ঘুরতে লাগলো।
সিমি আর পরশ ভেবে পাচ্ছিল না,এখন কি করা উচিত। কোথায় যাবে তারা?সিমির বাসার দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল সেটা তাদের কাছে পরিষ্কার।এখন বাকি রইল পরশদের বাসা। সেখানে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় ও নেই। মেরে,কেটে যাই করুক না কেন ওখানেই যেতে হবে।পরশ বলল-
—সিমি আমরা কি ভুল করলাম?
—যা হবার তা তো হয়েই গেছে।এখন এই সব ভেবে কাজ নেই।চল তোমাদের বাসাতেই চলে যাই।
পরশের মন কেমন কেমন করছে। বাসায় যাওয়ার পরে কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় আল্লাহ ই জানেন।
সিমির ভালো লাগছিল। ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে হাঁটা সেটা তো আছেই, তার নিজেকে খুব স্বাধীন মনে হচ্ছিল।মনে হচ্ছিল খাঁচার আবদ্ধ পাখি মুক্ত হয়েছে।
দরজা খুলল পরশের ছোট বোন দুলি।সে তার ভাইয়ের পেছনে একটা মেয়েকে দেখে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল।এই সংবাদ খুব সহজেই পৌঁছে গেল ভেতরে।পরশের বাবা নাঈম, মা রোকেয়া,বড় বোন রুমি চলে এলো।দুলি বার বার প্রশ্ন করেও কোন উত্তর পেলো না পরশের কাছ থেকে।
এবার নাঈম সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন –
—মেয়েটা কে?
—মানে বাবা,হলো কি..
শেষ করতে পারছে না কথা ,পরশের গলায় কথা যেন আটকে আসছে।
রোকেয়া ধমকে উঠলেন-
—কি হয়েছে,গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না কেন? এত রাতে একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছ।আর এই মেয়েটাই বা কেমন ,এত রাতে একটা ছেলের সাথে বাসায় এলে এসেছে?
নাঈম বললেন-
—একটু চুপ কর না,আগে শুনি পরশ কি বলতে চায়।বল পরশ ।
পরশ চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বলল-
—বাবা আমরা বিয়ে করেছি।
রোকেয়া একেবারে গর্জে উঠলেন।
—কি বল,তুমি বিয়ে করেছ?বিয়ে কি ছেলে খেলা বললাম আর হয়ে গেল? ফাজলামো করার আর জায়গা পাস না।
সিমির দিকে তাকিয়ে বললেন-
—এই মেয়ে তোমার কি আক্কেল বল তো ,একটা ক্লাসমেট বেকার ছেলেকে বিয়ে করে চলে এসেছ।
ও আল্লাহ আমাকেই উঠিয়ে নিয়ে যাও।বড় বোনের বিয়ে হয়নি আর ছোট ভাই বিয়ে করে চলে এসেছে।
রোকেয়া থামছেন না কিছুতেই ,পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে তাই নাঈম তাকে এক প্রকার জোর করেই তাদের বেড রুমে নিয়ে গেলেন। গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন রোকেয়াকে। এবার রোকেয়ার রাগ কান্নায় রুপ নিল।এভাবেই জড়িয়ে রাখলেন অনেকক্ষণ কান্নার গতি কমে এলে , রোকেয়া কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললেন-
—ছাড় তো,এখনি দুলি চলে আসবে।
—আসলে আসুক না।ওরা তো বড় হয়েছে,সব কিছুই বুঝতে পারে।দেখ গিয়ে ও দুর থেকে দেখে চলে গেছে।
হঠাৎ মনে পরে যাওয়ার ভঙ্গীতে রোকেয়া বললেন-
—কি কাজটা করলো বল তো ছেলেটা?
—আমরা কি করেছিলাম মনে নেই?
—মোটেও এমন না, আমাদের ব্যপারটা অন্যরকম ছিল।তুমি বেকার ছিলে না।
সেই সব মনে করতে চাই না।কি কষ্টের দিন পার করেছি!
—আমরাও তো আমাদের বাবা-মাকে এক সময় কষ্ট দিয়েছিলাম।
—এই জন্যই তো আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে।
এই বলে রোকেয়া কান্নায় ভেঙে পড়লেন। নাঈম তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন-
—এমন করে না রুক্কু,এমন করে কেঁদো না রুক্কু।
দুলি মায়ের রুমে ঢুকতে গিয়ে দুর থেকেই মাকে কাঁদতে দেখে চলে গেল।
লিভিং রুমে বসে আছে পরশ আর সিমি পাশাপাশি।রুমি ওদের উল্টো দিকে বসে আছে।কি বলবে ,কি করবে বুঝতে পারছে না।
দুলি সোজা পরশের সামনে এসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল-
—ভাইয়া তুই যা করছিস একদম ঠিক করিস নি।সবাই ক্ষমা করলেও আমি তোকে কখনো ক্ষমা করবো না।মাকে কোনদিন কাঁদতে দেখিনি আজ মা কিভাবে কাঁদছে!!তুই অনেক কষ্ট দিয়েছিস মাকে।
এই কথা শুনে পরশের ও বুক ফেটে কান্না আসছিল।সিমি মনে মনে বলছিলো,’ছোট বোন এভাবে কথা বলে ,থাপ্পর দিয়ে দাঁত ফেলে দেয়া উচিত। তার প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে।আর তার মনে হলো মা ভাত টেবিলে দিয়ে বার বার ডাকতেন,
‘তোরা খেতে আয়,এখনো আসিস না কেন?সব তো ঠান্ডা হয়ে গেল।তবে বাসার কারো জন্য সিমির একটুও খারাপ লাগছে না।এখন তার মাথায় শুধু খাবারের চিন্তা ঘুরছে।
বারোটা বেজে যাচ্ছে আর নওমির হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ আগেই সব লাইট অফ করে সে শুয়ে পরেছে। দরজায় যেন নক না হয় , মনে মনে বলতে লাগল। অপেক্ষা করছে সারে বারোটা বেজে যাওয়ার জন্য। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে বারোটা পার করলেই শান্তি,তার মানে আর নক হবে না।
দরজা প্রতিদিন নক হয় না,হয় মাঝে মাঝে। দুই মাস ধরে এমন হচ্ছে।
প্রথম যেদিন নক হলো ,সে ঘুম থেকে উঠে কিছু না বুঝেই ঘুমের ঘোরে দরজা খুলে দিয়েছিল।
একটা অপরিচিত লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুহূর্তেই ঘুম ছুটে গেল নওমির।দরজা খোলাটা ভীষণ বোকামি হয়েছে ভেবে মনে মনে চিন্তা করে ফেলল ,কোন বিপদ বুঝলে চিৎকার করবে সে। তখন বিল্ডিংয়ের সবাই অবশ্যই আসবে।
নওমি যখন জিজ্ঞেস করল,’কাকে চাই?’
বিশ্রীভাবে হেসে লোকটা বলল,’তোমাকে।’
—মানে?আপনাকে আমি চিনি না তো।আপনি কয় তলায় এসেছেন?
—এটা ছয় তলা না?
—না , পাঁচ তলা।
‘সরি’ বলে লোকটা চলে গেল।
নওমি ভেবেছিল আসলেই ভুল করে এসেছে। তার ভুল ভাঙল এর দুই দিন পর,যখন একইভাবে দরজায় নক হলো।নওমি এবার আর ভুল করলো না।দরজা না খুলেই জিজ্ঞেস করল-‘কে?’
উত্তর এলো আস্তে,’আমি, খোল।’
নওমি বলল,এটা পাঁচ তলা।’তখন বিশ্রীভাবে হেসে চলে গেল।
এর পর লোকটাকে দারোয়ানের সাথে কথা বলতে দেখলো একদিন নওমি।লোকটা চলে যেতেই দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলো, লোকটার পরিচয়।
জানতে পারলো লোকটা বাড়িওয়ালার বোন জামাই।দুই মাস আগে তারা ছয় তলায় এসেছে।
নওমি ভাবে আর কেউ শুনতে না পারলেও পাশের বাসায় তো টের পাওয়ার কথা। দরজায় নক করার সময় ওরা একটু দরজাটা খুলেও তো দেখতে পারে,জানেই তো এখানে একা একটা মেয়ে থাকে।আসলে কেউই ঝামেলায় জড়াতে চায় না।সবাই নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত।
নওমি কয়েকজনকে বলে রেখেছে।কোন মেয়ে ওর সাথে শেয়ারে থাকতে চাইলে রাখবে।তাহলে একা থাকা লাগবে না আর এই সব উটকো ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে পারবে।
এক সময় ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যেতে লাগল,সাড়ে বারোটা বেজে গেলে নিশ্চিন্ত মনে চোখ বন্ধ করলো। ঠিক ঐ সময় দরজায় নক পড়লো। একটা কথাও বলল না নওমি। ।শ্বাস – প্রশ্বাসের শব্দ ও যেন অসভ্য লোকটা না শুনতে পায়।এই কিছুক্ষণ মনে হলো সময় থেমে গেছে , আর কাটতে চাইছে না।
লোকটার পায়ের আওয়াজ সিঁড়ির শেষ ধাপে গেলে নওমি চোখ খোলে।
অথচ অসভ্যটা নিচ থেকে এই পর্যন্ত আসার সময় সিঁড়িতে বিড়ালের মতো হাঁটে,কোন শব্দ হয় না।
অন্ধকারে খুব ভয় লাগে নওমির।উঠে গিয়ে ওয়াসরুমের লাইট অন করে দিলো। হঠাৎ মনে হলো প্রতিদিন পাশের বাসা থেকে বিভিন্ন শব্দ আসে,আজ কি ওরা বাসায় নেই নাকি?
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু
#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_৩
পরশের রুমের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তার সিঙ্গেল খাটটা।এই খাটে দুইজন কিভাবে ঘুমাবে ভাবতে লাগল সিমি। তবুও তো এতক্ষণে থাকার একটা ব্যবস্থা হলো,বাসা থেকে বের যে করে দেয় নি এটাই তো অনেক।পরশ দরজা লাগিয়ে দেয়ার পরে এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে সিমির।পরশ বিভিন্ন বাহানায় যতই কাছে আসতে চাইছে সিমি ততই দুরে সরে যাচ্ছে।এক সময় সিমির পিঠ দেয়ালের সাথে গিয়ে ঠেকলো।পরশের দুই হাত সিমিকে মাঝে রেখে দেয়ালে গিয়ে ধরলো।
সিমির চোখে জড়তা এবং উচ্ছাস আর পরশের চোখে দুষ্টুমি খেলা করছে।
এমন সময় দরজায় নক হলো।
দুলি দাঁড়িয়ে আছে।
—এই যে আপুর ড্রেস। তোমার বৌ তো কোন কাপড় নিয়ে আসেনি, তাকে আপুর ড্রেস পরতে দিল।
কাপড়গুলো পরশের হাতে দিয়েই চলে গেলো দুলি।
এর মধ্যে সিমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।আজকের আকাশ কালো মেঘে ঢাকা।বাতাসটাও অনেক ভারি,থমথমে। চারিদিক যেন একটু বেশিই নীরব।একটা অস্থির আর মন খারাপ করা পরিবেশ। হঠাৎ কেন জানি সিমি খুব কান্না পাচ্ছে।
এমনিভাবে বিয়ে সে তো কখনো চায়নি, কখনো ভাবনাতেও আসেনি। সুন্দর করে বৌ সেজে ফুলে সজ্জিত বিছানায় বসে থাকবে আর ,ফুলের মিষ্টি সুবাসে মন পাগল হয়ে উঠবে এমনটাই বার বার কল্পনায় ভাসতো। হঠাৎ কি থেকে যে কি হয়ে গেল!
পরশ এসে কখন পাশে টের পেলো না সিমি।দুই হাত দিয়ে সিমির কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে আনতেই দেখলো সিমির চোখে পানি।
—আরে কাঁদছ কেন?
পরশের মুখে তুমি শুনে কান্নার মাঝেও হাসি পেলো সিমির।সে ফিক করে হেসে উঠলো।
পরশ সিমিকে ছেড়ে দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
—কি ব্যপার হাসছ কেন?এই কান্নার মাঝে হাসি।পাগল হয়ে গেলে নাকি?
—তোর মুখে তুমি শুনে খুব হাসি পাচ্ছে।
—আরে আমরা এখন হাসব্যান্ড-ওয়াইফ না?আগের মতো তুই তুই বললে হবে?
—আমার কিন্তু সময় লাগবে। হঠাৎ করে তুমিতে আসতে পারবো না।
— পরেরটা পরে দেখা যাবে। এবার বল কাঁদছিলে কেন?
—এমনিই হঠাৎ মন খারাপ লাগছিলো।
পরশ চুপ হয়ে গেলো।সে ভাবলো সিমি তার বাসার সবার জন্য মন খারাপ করছে।তার নিজের ও অনেক খারাপ লাগছে,মা এখনো তার সাথে কথা বলে নি।একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
এবার সিমি আর একটু কাছে এসে বলল-
—এখন আবার তোর কি হলো?সরি সরি পতি দেব, আপনার কি হলো?বলতে বলতে হাসতে লাগলো সিমি।
—আপনি ভেতরে চলেন । আমি পতিদেব, না? আচ্ছা বোঝচ্ছি পতিদেব কাকে বলে।
সিমির ঘুম ভেঙে গেল।কয়টা বাজে বুঝতে পারলো না। গায়ের উপর থেকে পরশের হাত সরিয়ে দিল।ঝিমি আর সিমি এক বিছানায় ঘুমাতো।মাঝে মাঝে ঝিমির হাত,পা সিমির গায়ের উপর উঠিয়ে দিত আর তখনই সিমির ঘুম ভেঙে যেতো।সিমি উঠে বসে ঝিমিকে ঠিক করে শুইয়ে আবার ঘুমাতো।আজ তার বিয়ে হয়েছে জীবনের একটা অধ্যায় থেকে সম্পূর্ণ নতুন অচেনা একটা অধ্যায় শুরু হলো।
পরশের খাট ছোট তাই পরশ নীচে বড় করে বিছানা করেছে তোশক আর কাঁথা বিছিয়ে।এই যে এত দিনের চেনা মানুষকে পাওয়ার যে এত আকুলতা ছিল এখন সে তার পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছে।
তার সমস্ত মন,প্রাণ, শরীরে ছড়িয়ে দিয়েছে এক অদ্ভুত অনুভূতির শিহরণ।
এই সব কিছু এভাবে হোক এটা সিমি চায়নি।
আজ সকাল এবং রাতের মাঝে কতটা পার্থক্য জীবনে।
সকালে যখন রিকশা ভাড়া নিতে মায়ের রুমে যাচ্ছিল তখন , ভেতরে না ঢুকে দাঁড়িয়ে গেলো সিমি,আসলে তার পা আর সামনে এগুতে পারছিল না।শফিক বলছেন-
—আমি যা বলছি তাই হবে।টাকা কি গাছে ধরে? এই সব আলতু ফালতু খরচ করার জন্য আমি টাকা দিতে পারবো না।
মেয়েদের খোঁজ খবর রাখ।ওদের দিকে নজর দাও। উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গেলেই সিমিকে বিয়ে দিয়ে দেব।
পারু কি বললেন,বোঝতে পারলো না সিমি। কিন্তু ঠাস করে একটা থাপ্পরের শব্দ ঠিকই শুনতে পেলো।এই সব নতুন কিছু না। তার মাকে কি পরিমাণ অত্যাচার সহ্য করতে হয় এটা তিন ভাইবোনই জানে।
আজ যেন আর সহ্য হচ্ছিল না। সোজা রুমে ঢুকে যায় সে।পারু বিছানায় বসে কাঁদছেন।শফিক , সিমিকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন-
—কি চাই?
সিমি শুধু কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল একটা কথাও বলল না।মায়ের পাশে গিয়ে বসল সে।
পারু নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে বললেন-
—তোর দেরি হয়ে যাবে তো। সকালে হাঁটতে গিয়ে একটু দেরি হলো তো, মর্জিনা নাস্তা বানাতে দেরি করেছে তাই তোর বাবা একটু রাগ করেছে।তেমন কিছু না।
এর পর শফিককে বললেন-
—সিমির ভাড়াটা দাও তো।
শফিক টাকাটা দিতে হাত বাড়ালে সিমি অন্যদিকে তাকিয়ে হাতে নিল।
তিন ভাইবোনের প্রতিদিনের খরচ শফিক সকালেই গুনে গুনে ভাঁজ করে রাখেন।এক টাকাও যেন বেশি না রায় তাই বার বার গুনেন।তেই টাকা তাদের দেয়া হয় তা দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে খুব অল্পই থাকে,যা দেয়া হয় কিছু খাবার জন্য। কিন্তু প্রতিদিন তো সমান না,মাঝে মাঝে ভাড়ায় বেশি চলে যায়।এটা শফিক বুঝেন না।টাকা না থাকলে বা টানাটানি থাকলে একটা কথা ছিল।এই ব্যপারটাতে ওদের তিনজনই আপত্তি ছিল। কিন্তু কিছুই করার ছিল না।একটা টিউশনি করবে সেটাও অনুমতি নেই।
তবে শাওন বাবাকে না জানিয়ে একটা টিউশনি করে।ও ছেলে বলেই না পারে। সন্ধ্যার পরে আসলেও সমস্যা নেই।
টাকাটা নিয়ে নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেল সিমি।মনে মনে ভাবলো আর এই বাসায় ফিরবো না।আর যেখানেই থাকা হোক না কেন,এখানে আর না।
পরশকে বিয়ের কথা বলাতে খুব অবাক হলো।এই অবস্থায় বিয়ে সেটা তো অসম্ভব।সিমি বলল,তাহলে আর যেন ওর সাথে সম্পর্ক না রাখে পরশ।
পরশ অনেকভাবে বুঝিয়েও লাভ হলো না।সাক্ষী হিসাবে আহনাফ আর নুরিকে নিয়ে গেল ওরা কাজী অফিসে।
আহনাফ হাসতে হাসতে বলেছিল,’কয়েকদিন পরে আমাদের বিয়ের সময় তোদের সাক্ষী হিসেবে আনবো,রেডি থাকিস।’
সিমি ভাবতে লাগল যা হবার তা তো হয়েই গেছে। ঠিক হলো কিনা চিন্তা করে লাভ কি? নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দিলেও তার মন কেমন করছে।শত যুক্তি দিয়েও মনটা শান্ত হচ্ছিল না।
দোতলার সিঁড়িতে নওমির সাথে দেখা হয়ে গেল বাড়িওয়ালা তোফাজ্জল হোসেনের সাথে।নওমি সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
—আঙ্কেল কেমন আছেন?
তোফাজ্জল হোসেন যেন একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন।
—ভালো আছি।তুমি কেমন আছ মা?
—জ্বী ভালো আছি।
—তোমার কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?কোন সমস্যা হলে নিঃসংকোচে বলবে।আমি না থাকলে তোমার আন্টিকে বলবে।
উনাকে দেখলেই নওমির মনে হয় দরজায় নক করার ব্যপারটা বলে কিন্তু আবার মনে হয় নিজের বোন জামাইয়ের কথা কি বিশ্বাস করবে? উল্টো তাকেই হয়তো খারাপ মনে করে বাসা ছেড়ে দিতে বলবে।
তোফাজ্জল কে দেখলে নওমির খুব ভালো মানুষ মনে হয়।
উনি বারবার নওমিকে বাসায় যেতে বললেন।
মাসে একবার শুধু ভাড়া দেওয়ার সময় বাড়িওয়ালার বাসায় যায় নওমি।বিল্ডিংয়ের সব ভাড়া বাড়িওয়ালার স্ত্রী হাজেরার কাছে দিতে হয়।হাজেরা সবার সাথেই ভালো ব্যবহার করেন কিন্তু অহংকার তাঁকে ঘিরে থাকে।সেটা ভেদ করে কেউ কাছে যেতে পারে না। প্রত্যেককে বসিয়ে বসিয়ে দীর্ঘ আলাপ জুড়ে দেন। তার বেশীর ভাগই থাকে তাঁদের নিজেদের,আত্নীয়দের কার কি আছে,কার কত টাকা আছে।একই কথা বার বার বলেন।শ্রোতা যে অসহ্য হয়ে যাচ্ছে সেই খেয়াল নেই।
নওমির কাছে খুব অদ্ভুত মনে হয় হাজেরাকে।
দেখা হলে নওমিকে জিজ্ঞেস করেন নাম যেন কি তোমার?কয় তলায় যেন থাক?
প্রতিবার তিনি নওমির নাম ভুলে যান।
তোফাজ্জল আর হাজেরাকে দুই ভুবনের বাসিন্দা মনে হয় নওমির কাছে।তাই উনাদের বাসায় যেতেই ইচ্ছে করে না।ভাড়া দিতে যেতে হয় বাধ্য হয়ে।
একটা রিকশায় চেপে বসলো নওমি। রিংটোন শুনতেই খুব বিরক্ত লাগলো,কে আবার কল দিল এই সময়ে?
মোবাইল স্ক্রিনে দেখলো অপরিচিত নাম্বার।
রিসিভ করতেই-চিনতে পারলো-
—আপনাকে না বলেছি আমাকে কল দিবেন না, এখন আননোন নাম্বার থেকে কল শুরু করেছেন?
—কি করবো বল,তুমি যে কল রিসিভ কর না।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু