#৫ম_তলার_মেয়েটা,০৯,১০
ফাহমিদা_লাইজু
#পর্ব_৯
—আপনার ছেলে নিবিড় নওমির সাথে অশোভন আচরণ করেছে এতটুকু শুনেই তো আপনার বোঝা উচিত।সেটা না করে ছেলের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে চান বা ঢেকে রাখতে চান সেটা যাই হোক,আপনিতো আরো নোংরামি ছড়াতে চাচ্ছেন ব্যপারটায়। নিবিড় যতটা ছোট আপনি তো ততটা ছোট না।ও তো ভুল করতেই পারে।ওর ভুল শুধরে দেয়ার দায়িত্ব তো আপনাদের। ওকে বুঝিয়ে সঠিক শিক্ষাটা দেয়া আপনারই তো উচিত। কিভাবে মেয়ে বা মহিলাদের সাথে ব্যবহার করতে হয় এটা ছোট বেলা থেকেই শেখানো উচিত ছিল আপনার। আপনার নিজেরই তো লজ্জা পাওয়ার কথা।সেটা না করে উল্টো নওমিকে দোষ দিচ্ছেন? কৈফিয়ত চাচ্ছেন আপনার দুধের বাচ্চার উপরে কেন অপবাদ দিচ্ছি?
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে পম্পি ,নওমির হাত ধরে টেনে বের হয়ে এলো রাস্তায়।নিবিড়ের মা আর একটা কথা বলারও সুযোগ পেলো না।
নওমি ফোনেই জানিয়ে দিয়েছিল ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে নিবিড়কে পড়াতে পারবে না।এর পর নিবিড়ের মা কয়েকদিন ফোন করে নওমিকে যেতে অনুরোধ করলো।সে বলেছিলো,’অন্তত একবার দেখা করে টিউশন ফি টা নিয়ে যেও।
এই জন্যই পম্পিকে নিয়ে নওমি গেল আজকে।
ওরা নিবিড়ের মায়ের সামনে বসে ছিল।কয়েক রকম নাস্তা দেয়া হয়েছিল ওদের সামনে।
তাদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়েছিল এইভাবে-
পম্পি:আন্টি নিবিড় নেই?
নিবিড়ের মা :ঐ রুমেই আছে। লজ্জা পাচ্ছে তাই সামনে আসছে না।
পম্পি:লজ্জা পেলে নওমির কাছে পড়ে কিভাবে?
নিবিড়ের মা:শুনেছে নওমির সাথে ওর ফ্রেন্ড এসেছে তাই লজ্জা পাচ্ছে।
নওমি হঠাৎ করে ফোনে বললে নিবিড়কে আর পড়াতে পারবে না। তোমার ঝামেলা থাকতেই পারে তবুও একটু সময় করে তুমিই পড়াও। তোমার ছাত্র তোমার কাছে ছাড়া কিছুতেই পড়বে না। দরকার হলে আমি তোমার বেতন বাড়িয়ে দেব।এত দিন থেকে তোমার কাছে পড়ছে।অংক তুমি এত সুন্দর করে করাও ওর মাথায় ঢুকে যায়। সামনে ওর এস এস সি পরীক্ষা এই সময় টিচার পাল্টানো খুব সমস্যা হয়ে যাবে।বোঝই তো আরেকজন টিচারের সঙ্গে নিবিড়ের এডজাস্ট হওয়ার ও তো ব্যপার আছে।
নওমি বুঝতে পারলো তাকে খবর দিয়ে এনেছে বুঝিয়ে রাজি করার জন্য।
নওমি:আন্টি কোন ভাবেই নিবিড়কে পড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব না।
নিবিড়ের মা:কারণটা কি সেটা বলবে তো।
নওমি:সেটা বললে আপনার ভালো লাগবে না।
নিবিরের মা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে গেল।
নিবিরের মা:এই সব কথার মানে কি?
নওমি মাথা নিচু করে বসে আছে দেখে পম্পি বলল-
পম্পি:খাতায় I love you লিখে নওমিকে দিয়েছে।
নিবিরের মা:এই সব কি বল?আমার দুধের বাচ্চার সম্বন্ধে এই সব বলার সাহস হয় কি করে।বয়সে বড় তাও আবার টিচারের সাথে আমার ছেলে এমন করবে?ও কি এই সবের মানে বুঝে?কত বড় সাহস তোমাদের?
এর পরেই পম্পি উঠে দাঁড়িয়ে ঐ সব কথা বলে নওমিকে নিয়ে বেরিয়ে আসলো।
পম্পি বলল-
—এতটুক শুনেই মহিলা কি রিএ্যাক্ট করলো।তোর সাথে নিবিড়ের প্রত্যেকটা আচরণের কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলার দরকার ছিল।
—একটা কিশোর, বলতে গেলে বাচ্চাই এমন আচরণ করছে প্রথমে ভেবেছি এমনিতেই ওর হাত আমার হাতে লেগে যাচ্ছে কিংবা ওর পা।পা লেগে গেলে সরি বলে আবার সালাম করতো। ছেলেটা আগে এমন ছিল না। হঠাৎ করেই গত দুই মাস থেকেই এমন আচরণ করছে।আমি আমার মনের ভুল ভেবে প্রথমে উড়িয়ে দিয়েছি এর পর খাতায় লিখে আমাকে দেখানোর পর ভাবলাম ব্যপারটা অনেক সিরিয়াস আর সহ্য করা যায় না।
—এখন সবাই মোবাইলে কত কিছু দেখে আর নিবিড় তো একটা কিশোর।এই বয়সেই ভুল পথে পা বাড়ায় কিশোর-কিশোরীরা।এত তাড়াতাড়ি বাচ্চাদের হাতে মোবাইল দিয়ে দেয়া আমার মতে ঠিক না।
—বাদ দে তো।ভালো লাগছে না।বাইশ দিন পড়িয়েছিলাম,বেতন পেলাম না।
—আরে টাকার জন্য চিন্তা করিস না।এখন তো অর্ধেক খরচ আমি দেবো,তোর চাপ কমবে।এখন চল তোর মুড ঠিক করি,ফুচকা খাই।
নওমি “ফুচকা” বলে জিভ দিয়ে মুখে একটা শব্দ করলো।নওমি ভাবতে লাগলো আসলেই পম্পি অন্যরকম একটা মেয়ে।এখন মিশে বুঝতে পারছে চমৎকার মনের মেয়ে পম্মি আর অনেক সাহসী। এই মুহূর্তে সে একা থাকলে মন খারাপ করে বাসায় গিয়ে বসে থাকতো।
—আচ্ছা পম্পি তোদের বাসা ঢাকায় তবুও তুই কেন বাসায় থাকিস না?
—একদিন নিয়ে যাবো তোকে আমাদের বাসায়।
—আমি এই প্রশ্ন করেছি?
—গেলেই এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি। আমার পরিবার সম্পর্কে কেউ কিছুই জানে না আমি বলতে পছন্দ করি না। কিন্তু তোকে বলবো সব কিছু।
নওমি মনে করিস, আমার ফাইটার ফিসের জন্য খাবার নিতে হবে।
—আচ্ছা ঠিক আছে।
নওমি তাকিয়ে দেখলো চটপট মেয়ে পম্পির মুখটায় দুঃখে ছেয়ে গেছে।
—আরে নওমি ,কেমন আছ?
হঠাৎ তাশফিকে দেখে নওমি চমকে গেলো।
—ভালো।আপনি?
—ভালো।
—এখানে কি কর?
পম্পি বলল-
—মিষ্টি খাচ্ছি।
—মিষ্টি?
—দেখছেন ফুচকা খাচ্ছি, তবুও জিজ্ঞেস করেন কি করে, তাই বললাম।
তাশফি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
নওমি সেটা বুঝতে পারলো।
—পরিচয় করিয়ে দেই উনি স্বর্ণার ভাইয়া আর ও আমাদের ফ্রেন্ড পম্পি।
পম্পি বলল-
—ভাইয়া ফুচকা খাবেন?
নওমি নিশ্চিত ছিল তাশফি খাবে না।তাকে অবাক করে দিয়ে তাশফি বলল –
—খাবো।
আর তাশফি নিজেই ফুচকা ওয়ালাকে বলল-
—মামা আর একটা ফুচকা আমাকে দিয়েন।
পম্পি বলল-
—একটা সেলফি হয়ে যাক।
এই কথা শুনে তাশফি নিজের মোবাইল নিয়ে প্রস্তুত হলো। সে খুব খুশি হয়েছে।
নওমি আস্তে খোঁচা দিয়ে পম্পিকে বলল-
—এই সব কি?
তাশফি ফুচকা খুব একটা খায় না, তবুও সে খাচ্ছে,কারণ তাহলে আরো কিছুটা সময় নওমির সাথে থাকা যাবে। পম্পি সেলফি তুলল,তাশফিও।
পম্পির সামনে নওমি মানা করতে পারলো না তাশফিকে।
তাশফি কিছুতেই ওদের বিল দিতে দিলো না।গাড়ি দিয়ে তাশফি ওদেরকে পৌঁছে দিতে চাইলে নওমি জোর আপত্তি করলো।সে বলল-
—আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
রিকশায় উঠে নওমি চুপ করে রইলো। পম্পি জিজ্ঞেস করলো-
—মন খারাপ নাকি তোর?কি হলো আবার?
—না মন খারাপ না।এখন আমার মেজাজ খারাপ তোর উপর।
—কেন?আমি কি করলাম?
—ভাইয়া খাবেন?সেলফি তুলি ..এই সব কি?
—তোর আর তাশফি ভাইয়ার ব্যপারটা আমি শুনেছিলাম।আর তোর কি মনের ভাব বুঝতে চেষ্টা করলাম।
—তো কি বুঝলি?
—ডাল মে কুছ কালা হ্যয়।
নওমি কেন জানি পম্পির উপর রাগ করতে পারলো না। তবুও রাগের অভিনয় করে তাকিয়ে রইল।
নওমি আর পম্পি বাসায় আসার কিছুক্ষণ পরেই দরজায় নক হলো।
নওমি দরজা খুলে দেখলো পারু একটা ট্রে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
—আরে আন্টি কেমন আছেন?
—ভালো।দুপুরেও খুঁজে গেছি তোমাকে।দুপুরে রান্না করেছিলাম।একা থাক , কি না কি খাও।
—আমার সাথে আমার ফ্রেন্ড পম্পিও থাকে এখন।আপনি ভেতরে আসেন আন্টি।
পারুকে, পম্পির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল নওমি। জিন্স,টপস পরা পম্পিকে দেখে ভালো লাগলো না পারুর কিন্তু তিনি সেটা প্রকাশ করলেন না।পারু বাসাটা ঘুরে দেখলেন। পম্পির একটু আড়ালে গিয়ে পারু নওমির হাতটা মুঠোয় ভরে বললেন-
—অনেক সময় তোমাকে অনেক কটু কথা বলেছি কিছু মনে রেখো না মা।
—এটা কি বলেন আন্টি,এ সব মনে রাখার মত বিষয়?
—আরেকটা অনুরোধ রাখবে আমার?
—বলেন আন্টি রখার মত হলে অবশ্যই রাখবো।
—আমার ছোট মেয়ে ঝিমি।এবার এস এস সি দিবে।একদম পড়াশোনা করে না।শুনেছি তুমি টিউশনি কর?
—আমি ম্যাথ পড়াই সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত।
—অন্য সাবজেক্ট গুলো ও একটু দেখবে। তোমার যখন সময় হবে তখন পড়াবে,কোন সমস্যা নেই।
—কিন্তু আঙ্কেল জানেন?
—এখনো বলিনি,রাতে বলবো।
—আচ্ছা ঠিক আছে।
পারু চলে যেতেই পম্পি বলল-
—এখন দরকার পরেছে তাই এসেছে।দুনিয়াটাই স্বার্থপরের আড্ডাখানা। আচ্ছা দেখি তো কি দিয়ে গেল?নওমি দেখ বিড়িয়ানি দিয়েছে আজ রাতে আর রান্না করতে হবে না।
—হু বলে নওমি কি চিন্তা করছে দেখে পম্পি জিজ্ঞেস করলো –
—কি রে কি চিন্তা করিস?
—কিছু না।
পরশের দাদুর রিপোর্ট সব নরমাল এসেছে।তাই সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।এই কয় দিনে সিমির উপর মহা বিরক্ত হলেন দাদু।সিমি কে ডেকে এনে বললেন-
— দরজাটা লগাও। গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তোমার সাথে।
দরজা লাগিয়ে সিমি নির্বিকার ভাবে বসে আছে।
—তোমার বাবার বাড়িতে কাজের লোক কতজন?
—একটা।
—বাবুর্চি,মালি,ড্রাইভার নাই?
সিমি একটু রেগে তাকালো।মনে মনে বলল’ আমার সঙ্গে তামাশা করছে’
—নেই।
—ভাড়া বাসায় থাকো?
—জী
—তোমার যে শাশুড়ি তাঁর বাবার বাড়ির অবস্থা জান?
—না।
—সে ফুটানি করতে পছন্দ করে না,তাই কিছুই বলে না।তিন ভাইয়ের এক বোন রোকেয়া।যখন নাঈম বিয়া কইরা নিয়া গেল আমাগো গ্রামে, রোকেয়ার কাছে তখন আশপাশের সব কিছু নতুন।আমাগোর তুলনায় সে একজন রাজকন্যা। তাগোর বাড়ি রাজপ্রাসাদের মত। কাজের লোকে ভরা।প্রথম প্রথম আমি খুব রাগ করতাম এইটা পারে না এটা পারে না,ধরতে গেলে কিছুই পারে না। তবুও কি চেষ্টা,সব কিছু করার কত চেষ্টা। কোন সময় বলে নাই,বাপের বাড়ি হেন করছি, তেন করছি।এর পরে ঢাকায় বাসা নিল দুই রুমের।কত কষ্ট করছে!এর পরে আস্তে আস্তে ওর বাপ মা মাইনা নিসে। খুব শান্তি লাগতো ওদের দুইজনের ভালোবাসা দেইখা।
অনেকদিন পর আমি রোকেয়ারে জিজ্ঞেস করছিলাম-
‘আমরা বাড়ির সবাই কত কথা বলছি কোন উত্তর দেও নাই কখনো। তোমার রাগ উঠতো না? নাঈমরেও কক্খোনো কিছু বল নাই।”
রোকেয়া বলছিলো,’নিজেরা বিয়ে করে এমনিই একটা অন্যায় করেছি তাই নিজেকে সব সময় অপরাধী ভাবতাম,আর ভাবতাম আপনার ছেলে আপনাদের কত ভালোবাসে, আমার জন্য আপনাদের সাথে তার যেন সম্পর্ক খারাপ না হয়। যদি তাকে বলতাম,সে আপনাদের কিছুই বলতে পারতো না কিন্তু মনে মনে কষ্ট পেতো।’
এর পরে রোকেয়া পড়ালেখা শেষ করলো।রুমির জন্ম হইলো এর পিছে পিছেই আবার পরশ হইলো। চাকরি করার খুব ইচ্ছা ছিল এই বাচ্চাদের জন্য করতে পারলো না।
তোমারে আলাদা কইরা দিতে আমরা রাজি আছি।কোন জায়গায় বাসা নিবা?
—সত্যি!তাহলে ভর্সিটির কাছেই নিবো।
দাদু সিমির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এতক্ষণ এত কথা বলে কোন লাভ হলো না।এই মেয়ে অন্য ধাতু দিয়ে গড়া।
—কিন্তু তুমি একলা থাকতে পারবা তো?
—মানে?
—পরশ নিজের পায়ে দাঁড়ানের আগ পর্যন্ত আলাদা বাসায় যাইবো না,আমারে তাই কইছে।
—তাহলে আমি থাকবো কি করে?
—দেখ সিমি তোমার না হয় লজ্জা শরম নাই কিন্তু পরশের আছে।বেশরমের মত বাপের টাকা দিয়া সংসার সে পাতবো না।
প্রতিটা মানুষই আলাদা।সবার চিন্তা আলাদা।এর মধ্যে কারো কারো চিন্তা শুধু নিজেরে নিয়া।তুমি যদি এই পরিবাররে আপন কইরা নিতে পারতা ওরা কতটা ভালোবাসা যে তোমারে দিতো, তোমারে মাথায় তুইলা রাখতো।নিজের কপালে নিজেই লাথি দিলা। ভাল মানুষ চিনতে পারলা না ,চখের পর্দা সরাইয়া দেখ এখনও সময় আছে।
আমার প্রত্যেকটা কথা চিন্তা কইরা দেইখো।
আর একটা কথা শোন, আগামীকাইল কিছু মেহমান আসবো।
—আমি কি করবো?আমি তো রান্না পারি না।
—তোমারে কিছুই করতে হইবো না,শুধু বাসায় থাইকো।বাইরে বাইরে হইয়া যাইয়ো না।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু
#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_১০
সিমি মেহমানদের সামনে এসে একেবারে স্ট্যাচু হয়ে গেলো।শফিক বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন, আর পারু একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন সিমিকে এই বাড়িতে দেখে।
শফিক আর পারুকে আনতে গাড়ি পাঠানো হয়েছিলো। সুন্দর,মনোরম সাজানো গোছানো ফ্ল্যাটে ঢুকে তাঁরা অবাক হয়ে গেলেন।অনেক বড় লিভিং রুমে তাঁদের বসানো হলো।
পরশের বড় মামা হায়দার, হায়দার গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান। সিমির বাবা এতদিন এই ইন্ডাস্ট্রিতে সেকেন্ড একাউন্টেন্ট পদে চাকরি করলেও হায়দাররের সাথে সরাসরি পরিচয় ছিল না।এত এত এম্প্লয়ির ভেতরে শফিককে আলাদা ভাবে চেনার প্রয়োজন পড়ে নি।তাই যখন হায়দার সব কিছু শুনলেন রোকেয়ার কাছে, তিনি খুব আশাহত হলেন।ভাগ্নেকে নিয়ে তাঁর অন্যরকম স্বপ্ন ছিল। তার কোম্পানির একজন সামান্য কর্মচারীর মেয়ের সাথে পরশের বিয়ের কথা শুনে খুবই দুঃখ পেলেন।
বোন রোকেয়ার অনুরোধ উপেক্ষা করার সাধ্য হায়দারের ছিল না তাই অফিসে শফিককে তলব করলেন তাঁর রুমে।শফিক এই সংবাদে অসম্ভব ভয় পেয়ে গেলেন,ভাবতে বসলেন নিজের অজান্তেই কোন ভুল হয়ে গেলো না তো।তা না হলে এত দিনের চাকরি জীবনে কখনো যার সঙ্গে সরাসরি কথা হয়নি সেই চেয়ারম্যান স্যার তাঁকে কেন ডাকবেন?
ভয় আর সঙ্কা নিয়ে উপস্থিত হলেন হায়দারের সামনে। হায়দার তাঁকে খুব ভালো করে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন।আগেই সব খবর নিয়েছেন শফিক সম্পর্কে। চাকরি জীবনে সৎ একজন মানুষ এই ব্যপারে কোন সন্দেহ নেই।শফিকের পরিবারে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ কেউ নেই। একমাত্র শফিক সবার মধ্যে একটু ভালো অবস্থানে আছেন।মাথার চুল অনেক কমে এসেছে গায়ের শার্ট-প্যান্ট পুরনো হলেও পরিপাটি, জুতাজোড়া ও অনেক পুরনো ,এর উপরেই জুতার কালি মেখে চকচকে করা হয়েছে। মোটামুটি নিম্ন মধ্যবিত্ত ব্যক্তির বাস্তব চিত্র।
হায়দার অভয় দিয়ে শফিককে বসতে বললেন। শফিক কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বসলেন।
—শফিক সাহেব কেমন আছেন?
—জি স্যার ভালো।
এসির মধ্যে বসেও শফিকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগলো।রুমাল বের করে ঘাম মুছতে ও ভয় লাগছে।
—আপনাকে একটা অ্যাড্রেস দিচ্ছি,আপনি আগামীকাল লাঞ্চ আওয়ারে আপনার স্ত্রীকে নিয়ে ওখানে যাবেন। আমিও জুম্মার নামাজ আদায় করে ওখানে উপস্থিত হবো।এই সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন করবেন না, ওখানে গেলেই সব কিছু জানতে পারবেন।তবে আশ্বস্ত করছি ভয়ের কোনো কারণ নেই। ঠিক আছে এবার আপনি আসুন তাহলে।
এই ব্যাপারে অফিসে কারো সঙ্গে আলোচনা করার দরকার নেই সেটাও জানিয়ে দিলেন।
শফিক কোনমতে চেয়ারে এসে বসলে।অন্য কলিগরা এসে জড়ো হলো। কি কারনে চেয়ারম্যান স্যার হঠাৎ ডেকেছেন সেই কৌতূহলে। শফিক জানালেন তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি।
গত রাতে ভালো করে ঘুম হয়নি।একটাই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে।কি কারণ হতে পারে।
সিমিকে এখানে দেখে তাই শফিক আর পারু বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। হায়দার আসতেই শফিক যেন চেতনায় ফিরলেন।
হায়দার ,শফিককে বসতে বললেন।
শফিক বললেন-
—স্যার আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না।
—আমার ভাগ্নে পরশ আর আপনার মেয়ে সিমি বিয়ে করেছে।
এর পর সব কিছু খুলে বললেন। সবার পরিচয়, যোগ্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেন।
সব শেষে বললেন-এটা ওরা খুব অন্যায় একটা কাজ করেছে।
—জি স্যার একশবার,এটা খুবই জঘন্য কাজ করেছে।আমি সিমিকে কখনো ক্ষমা করবো না।
সিমি দাঁড়িয়ে সবই দেখছে,সে বুঝতে পারছে না,পরশের মামাকে তার বাবা স্যার স্যার করছে কেন?এটাও বোঝা যাচ্ছে উনাকে তার বাবা খুব ভয়ও পাচ্ছে।তার মানে তার বাবা কাউকে অন্তত ভয় পায়!
কথা নেই বার্তা নেই পারু নিরবে কাঁদতে শুরু করলেন।
হায়দার ,সবাইকে আসতে বললেন।সবার সাথে পরিচয় হয়ে যাওয়ার পরে হায়দার বললেন-
আমার বোনের পরিবারের সবাই অনেক চেষ্টা করেছে সিমিকে আপন করে নিতে। কিন্তু সিমি আলাদা বাসায় থাকতে চায়,পরশের পড়াশোনা এখনও শেষ হয়নি তাই ওর পক্ষে সংসারের দায়িত্ব নেয়া কোন ভাবেই সম্ভব না।অনেক বুঝিয়ে ও কোন লাভ হয়নি আপনার মেয়েকে।আর ও যথেষ্ট বেয়াদব একটা মেয়ে। এখন আপনি বলেন আমাদের কি করা উচিৎ।উভয় পরিবারের মতামতের ভিত্তিতে এর একটা ফয়সালা দরকার।
—স্যার থাপ্পর দিয়ে দাঁত ফেলে দেন।মাইর পরলেই ঠিক হয়ে যাবে।
এবার নাঈম হেসে বললেন-
—সব কিছু মেরে ঠিক করা সম্ভব না।আর এটা কোন সমাধান না।
দাদু বললেন-
—সিমিরে আপনেরা সাথে কইরা নিয়া যান।ওর সমস্ত খরচপাতি আমরাই দিমু।পরশের পড়া শেষ হইলে তখন আলাদা সংসার পাতবোনে দুইজন। এখন এই মাইয়া এই সংসারে থাকলে এই সংসারে প্রতিদিন অশান্তি হইবো।
শফিক কটমট করে তাকালেন সিমির দিকে।সিমি বুঝতে পারছে না এই সব কি হচ্ছে।
শফিক বললেন-
—আমাকে ক্ষমা করবেন আপনারা,সিমিকে আমি নিয়ে যেতে পারবো না।ওর জন্য আত্নীয় স্বজন , প্রতিবেশী সবার কাছে ছোট হয়েছি।এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে ,ওকে নিয়ে গেলে আর আবার নতুন করে ঝামেলার সৃষ্টি হবে আর মুখ দেখাতে পারবো না। আমি আবারো ক্ষমা চাইছি।
—আপনার মেয়েরে স্বাভাবিক মনে হয় না। আমার মনে হয় ও নিজেই জানে না কি চায়। সবার সাথে মিইলা মিইশা থাকলে তো কোন সমস্যাই ছিল না।
সিমির নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছে।কেউ তাকে রাখতে চায় না।তাহলে কি তার নিজের মধ্যেই সমস্যা?আগে পান থেকে চুন খসলেই বাবা মারতো, তাঁর কথা শোনানোর মাধ্যমই ছিল মাইর দেয়া।কখনো নরম করে কথা বলেছে বাবা?রাগে দুঃখে তার গা কাঁপতে লাগলো। নিজের চুল নিজের ছিড়তে ইচ্ছে করলো। তার বাবা, দাদি, ফুফুরা,চাচারা সবাই মিলে কি অমানবিক আচরণ করেছে তার মায়ের সাথে সেই সব কিছু তো সিমি চোখের সামনে দেখেছে।মাঝে মাঝে তার মা নাখেয়ে থেকেছে কারণ ভাত শেষ।পরের বেলা পেট ভরতো কিনা সেটা মাই ভালো জানে।পরশের পরিবারের সব উল্টো চিত্র দেখে সিমির বিশ্বাস হলো না।সে ভাবলো এদের উপরে উপরে ভালো রুপ, কিছুদিন গেলেই তার ভাগ্যও তার মায়ের মত হবে।
তবে এর মাঝেও একটা ভালো চিন্তা এলো সিমির মনে তা হলো, এই মুহূর্তে তাকে চুপ করে থাকতে হবে।দেখা যাক কি হয়।সে কিছুতেই আবার বাবার বাসায় ফিরে যেতে চায় না।
শফিক বললেন-
—স্যার আশা করি ব্যক্তিগত বিষয় আমার চাকরির ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলবে না।এই বয়সে চাকরি হারালে ছেলে,মেয়ে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে, রাস্তায় নামতে হবে আমাকে।
শফিকের কথায় অনুনয় নিবেদন ঝরে পড়ছে।
হায়দার বললেন-
—এই ব্যপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
—আরেকটা অনুরোধ, সিমিকে তাড়িয়ে দিবেন না দয়া করে।একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে আপনারা ওকে আপন করে নিন।
যেই বাবার উপর এতটা রাগ আর ক্ষোভ জমা ছিল সিমির মনে আজ সেই বাবাকে ওদের সামনে এতটা ছোট হতে দেখে খুব খারাপ লাগছে। দৌড়ে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, এভাবে বলো না বাবা, তোমাকে এত অনুনয় করতে হবে না,আমি ওদের কথা শুনে চলবো।সিমি যেন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল,দ্রুত পায়ে তার বাবার কাছে গিয়ে, বাবাকে জড়িয়ে ধরলো।আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
পারুর চোখে যে পাথর হৃদয় মানুষ শফিক, তার চোখে ও পানি দেখে পারু বর্তমান পরিস্থিতি ভুলে গিয়ে শফিকের চোখে থেকে কিভাবে পানি ঝরে তা দেখতে লাগলেন।
একটা আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হলো।
হায়দারের কথায় সবাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিরে এলেন।
—রোকেয়া আমার একটা মিটিং আছে , কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হতে হবে।
—আচ্ছা তাহলে খাবারের পর্বটা সেরে ফেলি?সবাই চলুন প্লিজ।
টেবিলে বিরাট আয়োজন।সিমি সকাল থেকে একবার ও রান্না ঘরে উঁকি দেয়নি। তার খুব খারাপ লাগতে লাগলো। তার বাবা-মায়ের জন্য এত আয়োজন করেছে তার শাশুড়ি খুব অবাক লাগছে।ওরা মানুষ হিসেবে ভালো ও হতে পারে!
তাঁরা তো তার বাবা-মাকে ইচ্ছা করলে অনেক অপমান ও করতে পারতো।মামা তার বাবার মতো একজন সামান্য কর্মচারীকে চাকুরীচুত্য করলে কিছুই করার ছিল না।অবস্থার দিকে থেকে তাদের আর পরশদের মধ্যে এত পার্থক্য তার পরেও তারা কোন অহংকার দেখাচ্ছে না।
সবাই সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে আর খাচ্ছে।মনে হচ্ছে বহুদিনের চেনা তারা। শফিক সবাইকে দাওয়াত করলেন।
আলোচনা করে ঠিক হলো কিছু দিন পর রিসেপশনের ব্যবস্থা করা হবে।আর সব কিছু নির্ভর করছে সিমির উপর।
অনেক দিন পর টেক্সট করলো তাশফি। নওমি ভাবলো সিন করবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনের কাছে যুক্তি হার মানলো।ফুচকা খাওয়ার সময় তোলা সেলফিগুলো পাঠালো।তাশফি লিখেছে,”ছবিগুলো খুব সুন্দর হয়েছে।
এখনো ঘুমাওনি কেন?”
“ঘুম আসছে না।আপনি কেন ঘুমাননি?”
“কি কর?”
“জানালার পাশে বসে আছি, চাঁদের আলো এসে পড়েছে রুমের ভেতর।আপনি কি করছেন?”
“ছাদে দোলনায় বসে আছি আর তোমার ছবি দেখছি।আমরা দুজনেই চাঁদের আলো উপভোগ করছি, দারুন না ব্যপারটা? তোমার আর আমার পছন্দ মিলে গেলো।”
“চাঁদের আলো কে না পছন্দ করে?তবে এই মুহূর্তে আমি শুধু চাঁদের আলোর রুপ দেখছি আর আপনি সেটা গায়ে মাখছেন।”
“দারুন বললে তো।”
“হু,এটাই তো আপনার আর আমার মাঝে পার্থক্য।যোজন যোজন দূরত্ব।”
“তুমি চাইলে সেই দূরত্ব ঘুচে যেতে পারে এক মুহূর্তে।”
“এই পৃথিবীতে সব কিছু চাইলেই সম্ভব হয় না।”
“শুধু একবার চেয়ে দেখ।”
“এবার ঘুমান, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”
“আমার উত্তর পেলাম না তো।”
“সব কিছুর উত্তর সবাই কি দিতে পারে?”
“পারে, ইচ্ছে করলেই পারে?”
“ভালো থেকবেন।”
“তুমিও।”
ঘর অন্ধকার হলেও মোবাইলের আলো জ্বলছে তাই পম্পি বুঝতে পারলো নওমি ঘুমায়নি।কাছে আসতেই নওমি ভয় পেয়ে গেলো।
—কি রে কিসের মধ্যে এত ডুবে আছিস?আমাকে দেখে ভয় পাস?
—এভাবে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে আসলে ভয় পাবো না?
—মোটেও নিঃশব্দে আসিনি।আমি ওয়াসরুমে গেলাম,পানি খেলাম তবুও বলিস নিঃশব্দে এসেছি? কি রে আসলেই কি প্রেমে মজেছিস?
—ফালতু কথা বলবি না তো।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু