#৫ম_তলার_মেয়েটা,২০,২১
ফাহমিদা_লাইজু
#পর্ব_২০
ভাবীর প্রতিটা কথাই নিরার গায়ে কাঁটা ফুটানোর মত অনুভূতি দেয়।ভালো মুখে সে নিরার সাথে কথাই বলতে পারে না।নিরার কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করে যা আয় হতো তা সামান্য হলেও সেটা ছিল তার একটা শক্তি।তাই ভাবী যখন ঐ কাজ ছেড়ে সংসারের কাজ করতে বলে,নিরা রাজি হয় না কাজ ছাড়তে।সে যথেষ্ট কাজ করে সংসারের। সে যদি এই কাঁথা সেলাইয়ের কাজটা ছেড়ে দেয়, তখন দেখা যাবে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তার কাঁধেই চাপবে ।এই নিয়েই চলে ভাবীর কথা,নিরা চুপ করে থাকতে চেষ্টা করে।যখন আর সহ্য হয় না তখন বেরিয়ে যায় বাড়ী থেকে।তখন পেছন থেকে ভাবী বলতে থাকে,’কাউরে খুঁজে নিলেই তো পারস,তাইলে আর আমার গলার কাঁটা হইতে হয় না।’
এই কথা বেশির ভাগ সময় বলে হোসেন বাড়ী না থাকলে।তার পর ও হোসেন অনেক কিছুই জানতে পারে প্রতিবেশীর কাছ থেকে-
‘কি রে হোসেন তোর বৌ কি তোর বইনরে একটু শান্তি দিবো না?কি এমন করছে নিরা যে এমন কইরা কথা শুনায় আর হইছে মাশাআল্লাহ নিরা একটা মানুষ!একটা কথার ও উত্তর দেয় না।কি দিয়া বানাইছে ওরে আল্লায়?
হোসেনের মাথা গরম হয়ে যায়।বৌকে জিজ্ঞেস করলে সব কিছু অস্বীকার করে।বৌ ভাবে নিরা গিয়ে সব কিছু ভাইকে বলেছে। তাই এমনি এমনি কিছুক্ষণ হুমকি ধামকি করে হোসেন শান্ত হয়। নিরা আসলে জিজ্ঞেস করে , নিরা তো উত্তরই দেয় না। প্রতিবার এই ঘটনাই ঘটে।
নওমির খুব অশান্তি লাগে এই সব দেখে। তার খুব খারাপ লাগে তার মাকে আজেবাজে কথা বলে মামি।সে কিছুই করতে পারে না। আবার সহ্য ও করতে পারে না।তার ভেতরটা চুরমার হয়ে যায়।পারা-প্রতিবেশী, শিক্ষকদের সবাই নওমিকে ভালোবাসে তার আচার আচরণ আর ভালো রেজাল্টের কারণে।ক্লাসে তার রোল নং এক অথবা দুই হয়।এই ভালোবাসাই নওমিকে বাড়ীর অশান্তি অনেকটা ভুলিয়ে দেয়।
একদিন নিরার ধৈর্য্যর সমস্ত বাঁধ যেন ভেঙে যায় , সে তার ভাবীর গলা চেপে ধরতে চায় কিন্তু তার রোগা শরীরটাকে এক ধাক্কায় ফেলে দেয় ভাবী। নিরা ছিটকে পরে গিয়ে হাঁপাতে থাকে।ভাবী যেন অগ্নিমূর্তি ধারণ করে।
এবার প্রতিবেশী চাচী এসে দেখে নিরা মাটিতে পরে আছে। তাড়াতাড়ি ওকে উঠিয়ে বসায়।নিরা বসে থাকতেও পারছে না ঠিকমত।ঘরে নিয়ে নিরাকে শুইয়ে দেয় চাচী,পানি খাওয়ায়। ভাবী মনে মনে ভয় পেয়ে যায়।হোসেন এই অবস্থা দেখলে উপায় নেই।চাচী হোসেনের বৌকে কথা শোনাতে থাকে।
নিরার শরীর দিন দিন দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। খাওয়ার সময় খোঁটা শুনতে শুনতে গলা দিয়ে খাবার নামতে চায় না।আস্তে আস্তে শরীর শুকিয়ে, ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে নিরার।
হোসেন বাড়ীতে ঢোকার আগেই প্রতিবেশী চাচীর কাছে সব কিছু শুনলো। নিরার কাছে গিয়ে দেখে নিরা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।ওর চোখের কোনে পানি।
হোসেন চলে যেতে পা বাড়ালেই নিরা ডাকলো,
‘ভাইজান।’
‘কেমন লাগতাছে এহন?’
‘ভাল।’
হোসেন ,নিরার পাশে গিয়ে বসলো।
‘তোমারে কিছু কথা কইতে চাইছিলাম।’
‘তোর ভাবীর কথা কইবি?’
‘কখনো ভাবীর নামে তোমার কাছে নালিশ করছি?’
‘সেইটাই তো সমস্যা।সব কিছু তোর মনের মধ্যে চাপা দিয়া রাখস?’
‘নওমির ব্যপারে কথা ছিল।’
‘এত আমতা আমতা করতাছস কেন?যা কইতে চাস কইয়া ফ্যালা।’
‘নওমির বাবা সম্পর্কে।’
‘ঐ অসভ্যের কথা কি আর কইবি?’
‘হায়াত মৌতের তো ঠিক নাই। মরনের আগে তোমারে একটা কথা জানাইয়া যাইতে চাই। কিন্তু কথা দেও এই কথা তুমি ছাড়া আর কেউ যেন জানতে না পারে।আমারে আগে কথা দেও।’
‘কি এমন কথা? আচ্ছা ঠিক আছে কথা দিলাম।’
‘যেই সত্য এত দিন শুধু একমাত্র আমি জানতাম এখন তোমারে কইতেছি,সব কিছু শোনার পর আমারে যেই শাস্তি দিতে চাও তুমি দিও কিন্তু আমার নওমিরে পর কইরা দিও না। আমার জন্য নওমি ক্যান শাস্তি পাইবো?’
‘কি ব্যপার, কি এমন কথা আমারে বল?’
নিরা , হোসেনের হাত ধরে কেঁদে ফেলল,
‘তোফাজ্জল স্যারের কথা মনে আছে?’
‘থাকবোনা আবার? তার টাকা দিয়াই তো আমার দোকান।’
‘নওমি উনার সন্তান।’
‘কি?’
হোসেন উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
‘মানে কি?আমি তো কিছুই বুঝতে পারতাসি না।’
এর পরে নিরা সব কিছুই বলল হোসেনকে। হোসেন কি বলবে বুঝতে পারছে না।
নিরা আবার বলল,
‘কোন দিন বিশেষ দরকার না পড়লে স্যারের কাছে এই কথা জানাইবা না।উনি তো জানেনই না নওমির কথা।’
এই কথা হজম করার মতো শক্তি হোসেনের ছিল না।সে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো কেমন যেন টলতে টলতে। বারান্দায় বসে পড়লো মাথা নিচু করে।
হোসেনের বৌ এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল,
‘এতক্ষণ বইনের কাছে আমার বদনাম শুনলা?তো এখন কি শাস্তি দিবা আমারে?
এমনিতেই মাথাটা ভোঁতা হয়ে আছে নিরার কথা শুনে এখন বৌয়ের কথা শুনে মেজাজ সপ্তমে পৌঁছে গেল। বারান্দায় রাখা মাটির কলসটা তুলে একটা আছাড় মারলো হোসেন।সেই শব্দে ভেতর থেকে নিরাও কেঁপে উঠলো আর বৌ একেবারে থ হয়ে গেল।এমন রাগ তো হোসেন কখনো দেখায় না।
হোসেন কোন কথা বলল না,বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলো।ফিরলো অনেক রাতে।বৌ এসে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,
‘আমার তো কোন দোষ ছিল না ,নিরাই তো আমারে মারতে নিছে আগে।’
‘তোমার কথা শুনলে মরা মানুষ ও উইঠা পরবো আর আমার বইন তো একটা জ্যান্ত মানুষ! আমার কপালপোড়া বইন ,ও তোমার চোখের কাঁটা?
ঠিক আছে আইজ থাইকা আলাদা সংসার নিয়া থাক তুমি। আমি আর আমার বইন আলাদা। অন্য কেউ হইলে ঘাড় ধাক্কা দিয়া বাইর কইরা দিত কিন্তু তুমি আমার সন্তানের মা তাই তোমারে সম্মান দেই।’
কয়েকদিন এভাবে চলার পর বৌ হোসেনের কাছে ক্ষমা চাইলো। আবার সবাই একসাথে হলো।নিরা, হোসেনের চোখের দিকে তাকিয়ে আর কথা বলতে পারে না।কি এক অপরাধবোধে ভুগে সে।তবে নিরা খেয়াল করছে হোসেন কি আগের মতো নওমিকে ভালোবাসে নাকি ঘৃণার চোখে দেখছে। কিন্তু সে জানে না, ‘পালার বড় জ্বালা’ । হোসেন, নওমিকে নিজ সন্তানের ভালোবাসা দিয়ে লালনপালন করেছে। জন্মপরিচয় সেই ভালোবাসার উপর চেপে বসতে পারবে না। হোসেনের পিতৃস্নেহ মন নওমির জন্য কানায় কানায় পূর্ণ।কোন কিছুই সেখানে ফাটল সৃষ্টি করতে পারবে না কখনো।
এখন ভাবী নিরাকে আরো গোপনে অত্যাচার করতে লাগল।নিরার শরীর আরো দুর্বল হচ্ছে।সে তেমন কিছুই খেতে পারে না।আসলে খেতেই ইচ্ছে করে না। সারাক্ষণ বমি বমি লাগে,চোখে অন্ধকার দেখে।
নিরার নিজের মৃত্যুর ভয় না করলেও নওমির জন্য ভয় হতে লাগলো।তার অবর্তমানে নওমির কি হবে এই ভয়ে মন আৎকে উঠে।ডাক্তার দেখাবে সেই কথা বলতেও লজ্জা লাগে ভাইকে। এমনিতেই ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাচ্ছে।সে নিজেই বুঝতে পারছে তার শরীরের শক্তি যেন শেষ হয়ে আসছে। একদিন রাতে হোসেন যখন বাইরে বসে ছিল তখন তার আশপাশে কেউ নেই দেখে নিরা এগিয়ে যায় ভাইয়ের কাছে।
‘ভাইজান ঘুমাও নাই যে এখনো?’
‘তুই ও তো ঘুমাস নাই।’
‘ভাইজান আমার নওমিরে তুমি দেইখো। কোনদিন পর কইরো না।আমারে যদি কথা দেও তাইলে মইরা শান্তি পামু।’
‘এত খালি মরণ মরণ করস ক্যান?কিছুই হইবো না তর।’
‘আমারে কথা দেও।’
‘আচ্ছা কথা দিলাম।তুই কি ভাবস?ওরে কোন সময় আলাদা চোখে দেখি?নওমি তো আমারই মেয়ে।’
একদিন নিরাকে তার শ্বশুর বাড়ি থেকে খবর পাঠানো হলো একবার গিয়ে যেন দেখা করে । নিরার স্বামী খুব অসুস্থ।নিজের শরীর এত খারাপ নিয়েও নিরা তার মেয়েকে নিয়ে গেলো।নিরাকে দেখলে খুব একটা বোঝা যায় না তার শারীরিক অবস্থা।গিয়ে দেখলো আসলেই তার স্বামী অসুস্থ , বিছানা থেকে উঠতে পারে না। কিন্তু কি হয়েছে এটা কেউ বলল না।
সবাইকে বাইরে যেতে বলে নিরার স্বামী শুধু নিরার সাথে কথা বলতে চাইলো।
‘তোমারে এক মুহুর্ত ও শান্তি দেই নাই যত দিন আমার কাছে ছিলা।আসলে কাউরেই শান্তি দেই নাই।আরো দুইবার বিয়া করছিলাম কেউ আমার লগে নাই। আমার কোন সন্তান ও নাই। আমারে ক্ষমা কইরো।’
‘ক্ষমা করলাম।’
‘নিরা আর একটা কথা,তুমি সত্যি কইরা কউ তো তোমার মেয়ের বাপ কি আমি?তাইলে আমার ঐ দুই বৌয়ের সন্তান কেন হইলো না?’
নিরা একটা কথাও বলল না।লোকটা আসলেই খুব অসুস্থ যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে,কথা বলছে খুব কষ্টে। এত টুকু বলেই হাঁপিয়ে গেছে।
‘বল আমারে সত্যিটা বল।’
‘কি হইবো জাইনা?’
‘আমার আত্নার শান্তি পাইবো ও যদি আমার সন্তান হয়।’
‘তাইলে জাইনা রাখ তোমার আত্নার শান্তি পাওনের মত খবর আমার কাছে নাই। আমি কিছু শুনাইতে পারবো না।আমি আসি।’
এই বলে নিরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো নিরা।মেয়ের হাত ধরে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।কি কারণে তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরতে লাগলো বুঝতে পারলো না। তোফাজ্জলকে সে আজও ভুলতে পারেনি।সে দিন নিরা পালিয়ে এসেছিল আসলে নিজের কাছ থেকে নিজেই। তোফাজ্জলের স্ত্রী, সন্তান আছে।তাদের সাথে অন্যায় হোক এটা কখনো চায়নি সে।সে যদি ওখানেই থেকে যেতো তাহলে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়ে যেতো।সব কিছু ভেবে সেদিন নিজেই দুঃখের সাগরে ভেসে গিয়েছিল তোফাজ্জলের এক চিমটি ভালোবাসা নিয়ে।নওমি যদি কখনো জানতে পারে ওর জন্ম পরিচয় তখন কি তাকে খুব ঘৃণা করবে? তার আদরের নারীছেড়া ধন যদি তাকে ঘৃণা করে তখন কিভাবে বাঁচবে সে এই চিন্তা তাকে গ্রাস করে রেখেছে সবসময়।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু
#৫ম_তলার_মেয়েটা
#পর্ব_২১
নওমি হাত বাড়িয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলে তার হাতটা শূন্যতা অনুভব করলো। মূহুর্তেই উঠে বসলো নওমি।এখন রাত কত কে জানে।তার ছোট্ট হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো তার পাশের বিছানার জায়গাটা খালি দেখে,যেখানে নিরা ঘুমাতো।
নওমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।মাথাটা তার মায়ের জায়গাটায় ঠেকিয়ে বলতে লাগল,
‘আমারে একা ফেলে কেন চইলা গেলা।আমি এখন কি করমু।কি একটা প্রাণির ডাক শোনা যাচ্ছে।টিনের চালে কেমন যেন খসখস শব্দ হচ্ছে।ভয়ে নওমির বুক কেঁপে উঠলো। গতকাল রাতেও তার মা পাশে ছিল।কখনো খারাপ স্বপ্ন দেখে কিংবা শব্দ শুনে ভয় লাগলে মাকে জড়িয়ে ধরতো।আজ কাকে ধরবে সে।সে বলতে লাগলো,
‘মাগো,ও মাগো কই গেলা তুমি?আল্লার কাছে গেছ আমারে নিয়া যাও নাই ক্যান?’
সে কাঁদতেই থাকলো।সে জানে মৃত ব্যক্তির সাথে যাওয়া যায় না। কিন্তু এখন তার মন কোন কিছুইতেই মানছে না।সব যুক্তি তার কাছে এখন তুচ্ছ। নওমির বুকের ভেতরটা যেন একেবারে চুরমার হয়ে গেছে।
রুমের বাইরে থেকেই ডাকলো হোসেন’
‘নওমি ঘুমাস নাই?’
রুমে ঢুকে টিমটিমে বাল্বটা জ্বালালো হোসেন। বিছানায় তাকিয়ে দেখে,নওমি মাথা বিছানায় লাগিয়ে শরীরটা ধনুকের মতো করে কাঁদছে।
হোসেন কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘কারো মা কি চিরকাল থাকে রে পাগলী।তুই যদি এমন করস তাইলে তো আমার মনডা ভাইঙা যায়।মা আর কান্দিস না।
এই বলতে বলতে হোসেনের ও কান্না চলে এলো।
এবার নওমি মাথা তুলে তাকালো মামার দিকে।
‘মামা আমার মন মানে না যে,কি করবো আমি?’
‘তুই কত বড় হইছস , এইবার ক্লাস সেভেনে উঠছস।তুই তো সবই বুঝস,যার হায়াত যখন শেষ হয় তারে তখনই চইলা যাইতে হয়।বুদ্ধিমতি মা আমার আর কান্দিস না।’
‘মারে ছাড়া বাঁচবো কেমনে মামা?’
‘ বাঁচন তো লাগবোই, বাঁচন লাগে।তোরে অনেক বড় হইতে হইবো।সময়ে সব কিছু ঠিক হইয়া যাইবো।এখন ঘুমাইয়া পর।’
নওমি শুয়ে পড়লো। নওমির গায়ে কাঁথাটা ঠিক করে দিল হোসেন।চলে যাওয়ার সময় লাইট অফ করে দিতে চাইলে, নওমি বলল-
‘অন্ধকারে ভয় লাগে মামা।লাইট বন্ধ কইরো না।’
‘আইচ্ছা ঠিক আছে।’
হোসেন নিজের রুমে গিয়ে শোয়ার পর তার বৌ বলে উঠলো-
‘ভাগনির জন্য দরদ একবারে উপচাইয়া পরে।’
‘তুমি কি মানুষ? মেয়েটার মা মইরা গেছে।এই বারো বছর মেয়েডা তার মায়ের সাথে ঘুমাইছে, একটা দিনের জন্যেও চোখের আড়াল হয় নাই।আজ তার মা নাই,একলা ঘরে কাঁনতাছে। যদি মানুষ হইতা ওর লগে গিয়া ঘুমাইতা। সান্তনা দিতা,দুইডা ভালো কথা কইতা।’
‘আমার এই সব ঢং ভালো লাগে না।’
‘মানুষের কষ্ট তো তোমার কাছে ঢং ই মনে হইবো, কারণ তুমি পাথর হৃদয়ের অমানুষ।মেয়েডা দুঃখে, কষ্টে,ভয়ে ঘুমাইতে পারতাছে না। আমার কেমন যে লাগতাসে।’
‘আমারে অমানুষ কও? ঠিক আছে তোমরাই শুধু মানুষ।আমি অমানুষ এইডাই ভাল।এত বড় মেয়ের আবার ভয় কিয়ের? বুঝি না কিছুই বুঝি না।’
গজগজ করতে করতে ঘুমিয়ে গেল হোসেনের বৌ।
তাদের ঘরের বেড়া আর চাল টিনের আর মেঝে মাটির। লম্বা একটা ঘর।তিনটা রুম।মাঝখানের রুমে হোসেনরা, ডানপাশের রুমে নওমি আর বাম পাশের রুমে হোসেনের ছেলেমেয়ের।হোসেনের চোখে ঘুম নেই।কান খাড়া করে রেখেছে কিছু শোনা যায় কিনা নওমির রুম থেকে।
ঠিক হয় নি কিছুই।প্রতিটা পদে পদে নওমির মায়ের কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে যায় মামির ব্যবহারে। এইজন্য স্কুলে গেলে আর আসতে মন চাইতো না। ছুটির পর আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়িতে আসে, যেন সময় বেশি লাগে।
তবে হোসেন এখন তার বউয়ের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখে।সব সময় নওমিকে জিজ্ঞেস করে তার মামি কিছু বলেছে কিনা?নওমি সব সময় মানা করে। হোসেন জানে মেয়ের স্বভাব হয়েছে তার মায়ের মত। কখনো কারো বিরুদ্ধে নালিশ করে না। তাই হোসেন প্রতিবেশী চাচীকে বলে রেখেছে একটু খোঁজখবর রাখতে।চাচী সেটা খুশি মনে করছে। তবুও সব সময় তো আর পাহারায় রাখা যায় না।
এভাবেই কাটতে লাগল নাওমির জীবন।
হোসেনের সংসার বড় হয়েছে খরচ বেড়েছে সে তুলনায় আয় বাড়েনি। স্কুল কলেজের শিক্ষকদের সহায়তায় নওমির তেমন কোন সমস্যা হয়নি।আর হোসেন ভাবতো, তোফাজ্জল যেই টাকা তাকে দিয়েছিলেন সেটা নীরার জন্য। এইজন্য তার আয়ের উপর নওমির হক সবচেয়ে বেশি তাই ওর লেখাপড়ার খরচ যতটুকু দরকার পড়েছে, করেছেন।
সমস্যার সূত্রপাত হয় যখন নওমি পাবলিক মেডিকেলে, ভার্সিটি কোথাও চান্স পায়নি। প্রাইভেটে পড়তে অনেক খরচের ব্যাপার এটা চালানো হোসেনের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়।
অনেক ভেবেচিন্তে হোসেন সিদ্ধান্ত নিলো তোফাজ্জলের সাথে দেখা করবে।অনেক কষ্টে তোফাজ্জলের ঠিকানা জোগাড় হলো।
তোফাজ্জল তাকে চিনতেই পারেন নি।নওমি তাঁর মেয়ে এই কথা শুনে চিৎকার করে উঠলো তোফাজ্জল।
হোসেন যখন বলল,
‘এই দাবি নিয়া আমি আসি নাই।নওমি নিজেও এই কথা জানে না।আমি আইছি নওমির পড়ালেখা যেন বন্ধ না হয় তাই আপনি একটা ব্যবস্থা কইরা দিবেন।
নওমি আপনের মেয়ে এই কথা বিশ্বাস না হইলে পরীক্ষা করান।কি জানি পরীক্ষা আছে না সেইটা করান।’
তোফাজ্জল মাথা নিচু করে বসেই ছিলেন।এই কথা শুনে তিনিও ভাবলেন হোসেন ঠিকই বলছে। আর হোসেন তো আর নওমির পিতৃত্বের অধিকার আদায় করতে আসেনি। এসেছে মেয়েটার জন্য সাহায্য চাইতে।
তার মনটা খচখচ করতে লাগলো।এটা তো সত্যি নিরার সাথে তার সম্পর্ক হয়েছিল।ওর মায়াবী মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মেয়েটার মনে কোন পাপ ছিল না।না হলে অনেক সুবিধা আদায় করতে চাইতো নিরা।
তোফাজ্জল জিজ্ঞেস করলেন,নিরা কেমন আছে?
হোসেন যখন বলল,নিরা মারা গেছে, তোফাজ্জল সত্যিই কষ্ট পেলো।কেন নিরার জন্য কষ্ট অনুভব করলেন জানেন না।তবে আস্তে আস্তে নিরার প্রতি একটা দূর্বলতা জন্মেছিল এই কথা অস্বীকার করতে পারেন না আর এই জন্যই সেই খামার বাড়ীতে আর মন টেকেনি তার। তাড়াতাড়ি খামার বিক্রি করে পালিয়েছিলেন সেখান থেকে , নিরার থেকে।
তোফাজ্জল ভাবলেন হোসেনকে তিনি সাহায্য করবেন।মেয়েটা তার নিজের হলেও সাহায্য করবেন,নিজের না হলেও করবেন।কারণ মেয়েটা তো নিরার।একটা ডি এখন এ টেস্ট করবেন ঠিক করলেন।
যেইদিন টেস্টের রিপোর্টটা তোফাজ্জলের হাতে আসলো তিনি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলছিলেন। অসম্ভব গোপনে টেস্টটা করতে দিয়েছিলেন। এইজন্য হোসেনকে বলেছিলেন নওমির চুল এনে দিতে।
তোফাজ্জল,হোসেনের সাথে দেখা করে , জানালেন তিনিই নওমির জন্মদাতা। ইচ্ছে করলে এই সত্য লুকিয়ে ফেলতে পারতেন, হোসেনের সাধ্য ছিল না সত্য উদঘাটন করার। হোসেনকে একটা অনুরোধ করলেন এই ব্যাপারটা যেন অন্য কেউ জানতে না পারে। তাদের দুজনের মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ থাকে। তা না হলে অনেক বড় সমস্যার সম্মুখীন হবেন। নওমির জন্য তিনি সবকিছু করবেন।নওমির ভবিষ্যত কিভাবে সুন্দর হয় সব ব্যবস্থা তোফাজ্জল করবেন। তাইতো নিজের বিল্ডিংয়ের একটা ছোট ফ্ল্যাটে নওমিকে থাকতে দিলেন আর হোসেনের একাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেন। হোসেন আবার নওমিকে পাঠায়। নওমি প্রতিমাসে তোফাজ্জলের স্ত্রীর কাছে গিয়ে বাসা ভাড়া দিয়ে আসে।এভাবেই নওমির খরচ চলে আসছে।এর মধ্যে নওমি টিউশনি করিয়ে কিছু টাকা নিজের কাছে রেখে বাকিটা তার মামা হোসেনকে পাঠিয়ে দেয়।হোসেন বার বার মানা করে টিউশনি করার দরকার নেই শুধু মনোযোগ দিয়ে পড়তে বলে।
হোসেন যেন এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত । তবে মনের গভীরে একটা দুঃখ রয়ে গেছে সেটা হলো তার বোন নিরা জীবনে কোনদিন একটু শান্তি পেলো না। কিছু কিছু মানুষের কি জন্মই হয় আজীবন কষ্টে কাটানোর জন্য?সেটা হোসেন জানেন না।নিরার মৃত্যুর কিছুদিন পরেই নিরার স্বামী মারা যায়। বেঁচে থাকতে দুই চোখে দেখতে না পারলেও
হোসেন সেদিন গিয়েছিলেন শেষ দেখা দেখতে। সেদিন শুনেছিলেন নিরার স্বামীর ক্যান্সার হয়েছিলো।
অ-নে-কটা সময় চলে গেছে, কিছুই তো ঠিক হয়নি।
মামা বলেছিলেন সময়ে সব কিছু ঠিক হয়ে যায়। মা মরে যাওয়ার পরে রাতের পর রাত কাঁদেছে। এখনো তার কান্না পায়।মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভাসে।
তবে,এখন তাশফিকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। তাশফিকে এত এভোয়েট করেও, এত দূরে সরাতে চেয়েও পারলো না।মনকে আর বেঁধে রাখতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত কি হয় এই সব ভাবনায় ডুবে যায় নওমি।মনটা খুব অস্থির লাগছে। রজনীর সাথে কথা বললে ভালো লাগবে। মোবাইল নিয়ে কল দিলো রজনীকে।
আছে তোফাজ্জলের স্ত্রী হাজেরা ঘুমিয়ে গেলে তোফাজ্জল তাঁর মায়ের রুমে গেলেন-
—আম্মা কি ঘুমিয়ে গেছ?
—না, ঘুমাই নাই।ভিতরে আস।
তোফাজ্জল ভেতরে এলে , আম্মা বললেন-
—লাইটটা জ্বালাইয়া দেও।
—না আম্মা লাইট জ্বালানোর দরকার নাই। ডিম লাইটের আলোতে দেখা যাইতেছে।
—আমার আব্বা তুমি কি গোপন কিছু বলবা আমারে?
—আম্মা আমি কিছুতেই শান্তি পাইতেছিনা আপনারে কিছু কথা জানতে চাই।এর পরে আপনিই বলেন আমার ভুল, আমার অন্যায় সম্পর্কে। একমাত্র আপনি পারেন এর সমাধান দিতে।
—তুমি কি নওমির সম্পর্কে কিছু বলবা?
—হু।
—বল।আমি শুনতেছি।
তোফাজ্জল সব কিছুই বললেন- নিরা,নওমি, হোসেনকে ঘিরে খামার বাড়ী আর বর্তমানের সব ঘটনা।
—আমি নওমিরে প্রথম যেদিন দেখছি সেদিনই বুঝতে পারছি নওমি তোমার সন্তান। তোমার কোন অবৈধ সম্পর্কের ফসল।
—কিন্তু কিভাবে আম্মা?
—তুমি যখন ছোট তখন তোমার দাদু মারা যান। তাই তোমার হয়তো উনার চেহারা খুব একটা মনে নাই। উনার কোন ফটো ও নাই। নওমি হইছে হুবুহু তোমার দাদুর মতো। আমি প্রথমে একেবারে চমকাইয়া গেছি নওমিরে সিঁড়িতে দেইখা।এত মিল কেমনে হয়?বয়সকালে তোমার দাদু মোটাসোটা হইয়া গেছিলো।আমি তো উনার যৌবন কাল থাইকাই দেখছি।নওমি উনার যৌবন কালের রুপ।এত দিন তোমারে বলতে চাইয়াও পারি নাই।তবে জানতাম তুমি নিজে থাইকাই বলবা।
—আম্মা এখন আমি কি করবো?
—কিছুই করবা না,যেমন চলতাছে তেমনটাই চলবো।
—আম্মা আপনের কোলে মাথা রাইখা একটু শুই। ছোটবেলার মতো আমারে একটু আদর করে দেন।
জালেরা বেগম তাঁর ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। তিনি বুঝতে পারলেন ছেলের চোখ থেকে পানি পড়ছে।পরুক।জালেরা বেগমের কাছে মনে হচ্ছে তোফাজ্জলের মস্তবড় ভুল হয়েছে।এক মুহূর্তের ভুলের মাসুল কিভাবে দিতে হবে আল্লাহই ভালো জানেন। হাজেরা যদি জানতে পারে সর্বনাশ হয়ে যাবে!তবে হাজেরা, তোফাজ্জলের স্ত্রী তার জানার অধিকার অবশ্যই আছে।কোন স্ত্রী তার স্বামীর এমন ঘটনা মেনে নিতে পারবে না। তবে সব সমস্যারই সমাধান আছে।দেখা যাক কি হয়।জালেরা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সেই দীর্ঘশ্বাস তোফাজ্জলের বুকে গিয়ে বিঁধলো।
তাঁরা দু’জন কল্পনাও করতে পারেননি আরেকজন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনে ফেলেছে।
চলবে…
#ফাহমিদা_লাইজু