৫ম_তলার_মেয়েটা,৩০,৩১

0
594

#৫ম_তলার_মেয়েটা,৩০,৩১
ফাহমিদা_লাইজু
#পর্ব_৩০

একটার পর একটা ছবি দেখছে নওমি কিন্তু বুঝতে পারছে খুব অল্পই।একটা ছবিতে চোখ আটকে গেলো।একটা মেয়ের অবয়ব।অনেকটা রজনীর মতো দেখতে।
পম্পি খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করতে লাগলো ছবি সম্পর্কে। উদ্দেশ্য রজনীকে রাগানো।
—ওরে আল্লাহ,এই লোক তো দেখ খালামনির ফিদা। যাকে বলে প্রকৃত প্রেমিক।
ছবির মেয়েটা অবশ্যই তুমি।নাক,চোখ ,মুখ সব কিছু তোমার মতো।একটা জিনিস ছাড়া, ঠোঁটের নিচের তিলটা শুধু। কিন্তু শিল্পীরা পোর্ট্রেট তৈরি করে, যার পোর্ট্রেট তাকে সামনে বসিয়ে।এই শিল্পী খালামণির এত নিখুঁত পোর্ট্রেট তৈরি করলো কিভাবে?
নওমি বলল-
—শিল্পীর মনে রজনীমণি এমনভাবে বসে আছে যে, সরাসরি তাকে দেখার আর দরকার হয়নি, চোখ বন্ধ করে মন থেকে দেখে নিয়েছে।

রজনী কে একটু চিন্তিত মনে হলো।

তাদের কথায় বাঁধা পড়ল যখন একজন হ্যান্ডসাম লোক কাছে এসে রজনীকে বলল-
—সত্যিই এসেছ?ভেবেছিলাম আসবে না।
—আসবো না ভাবার কি কারণ?
লোকটা একটা ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বলল-
—একদম আগের মতো আছ, তোমার কোন পরিবর্তন হয়নি।
—তোমার কিন্তু বেশ পরিবর্তন হয়েছে।
—কি রকম?
—আগে যেমন ভালো করে কথাই বলতে পারতে না। বেশিরভাগ সময় চুপচাপ থাকতে।এখন তো বেশ কথা বলছ।
—আফসোস, কেন যে তখন কথা বলতে পারতাম না!
রজনী এবার পম্পি আর নওমিকে পরিচয় করিয়ে দিলো-
—সিরাত,এই হলো আমার মেয়ে,আর ও হলো ওর বন্ধু।আর মেয়েরা ও হলো আমার ক্লাসমেট সিরাত।

সিরাতের মুখ হা হয়ে গেলো,পম্পিকে মেয়ে বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। সে শুনেছিল রজনীর বিয়ে হয়েছে একজন বিবাহিত লোকের সাথে। কিন্তু রজনীর স্বামী যে এত বয়স্ক, তার যে এত বড় মেয়ে আছে এটা চিন্তারও বাইরে ছিল।

রজনী খলখলিয়ে হেসে বলল-
—মাছি ঢুকবে তো।মুখটা বন্ধ কর।

পম্পি আর নওমি একে অপরের দিকে তাকিয়ে দুজন দুজনকে বোঝাতে চাইলো ,চল এখান থেকে সরে যাই।
ওরা একটু দূরে গিয়ে ছবি দেখতে লাগলো।

হঠাৎ এখানে পম্পির আব্বুর কণ্ঠ শুনে পম্পি অবাক হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখলো রজনীর সামনেই বড় বড় চোখ করে তার আব্বু দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদের পাশেই সিরাত দাঁড়িয়ে।নওমি প্রশ্ন করলো ,
—এই সময় আঙ্কেল হঠাৎ এখানে?
পম্পি সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেলো, যেন নওমির কথা শুনতেই পায়নি। একেবারে আব্বুর সামনে সে-
—আব্বু তুমি এখানে? হোয়াট এ সারপ্রাইজ!
আমি, খালামনি আর নওমি এলাম এই আর্ট এক্সিবিশন দেখতে। তুমি আসবে জানলে তো সবাই একসঙ্গে চলে আসতাম।নওমি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাইলেও কিছুটা ঘোলাটে হয়েই গেলো।

সিরাত আর দাঁড়ালো না সেখানে।

পম্পির আব্বু তখনো খুব একটা স্বাভাবিক হলেন না। তার চেহারায় রুষ্টতা এখনও দেখা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে রজনী কে সিরাতের সাথে কথা বলতে দেখেই তার বাবা এমন করছে।পম্পির ধারণা হলো তার আব্বুর স্পাই নিশ্চয়ই খবরটা দিয়েছে।
পম্পি ছোটবেলায় খুব একটা বুঝতো না, তার আম্মু লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতো। বড় হলে বুঝতে পারতো তার আম্মুর সাথে তার আব্বু কি পরিমাণ খারাপ ব্যবহার করে। কখনো কখনো বাচ্চাদের সামনেও তার মাকে অনেক কিছু বলতো তার আব্বু। তখন নিজের অপমান এর চাইতে বাচ্চাদের সামনে এসব বলার জন্য আম্মু লজ্জায় মরে যেতো। পম্পির ভাই সব সময় বলতো,’আম্মু আমি বড় হয়ে গেলে তোমাকে আর পম্পিকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো।’ আম্মু বলতো,’পরেরটা পরে দেখা যাবে, আগে পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াও, তোমার বোনটাকে সব সময় দেখেশুনে রাখবে, এই দুইটা জিনিসই তোমার কাছে চাওয়া আমার।’

ভাইয়ার পড়াশোনা শেষ হতে হতেই আম্মু শেষ হয়ে গেল। সেই দুঃখ ভাইয়ার মনে এখনো আঘাত করে।আব্বু সব সময় সন্দেহ করতো আম্মুকে। একদিন ছোট খালার সঙ্গে ফোনে আলাপ করার সময়, কথা প্রসঙ্গে আম্মু বলে ফেলেছিল,’এই জীবন অসম্ভব যন্ত্রণার, দুরারোগ্য ব্যাধির চেয়েও যন্ত্রণার। কিছু না করেও সব সময় নিজের চরিত্র সম্পর্কে এমন বাজে আর অশ্লীল কথা শোনতে হয়। মানুষ একসময় সবকিছুতে নাকি অভ্যস্ত হয়ে যায় কিন্তু আমি আজও এই কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হতে পারিনি কেন বলতে পারিস?এখনো মেনে নিতে পারিনি যে, আমি খারাপ আমার চরিত্র খারাপ। আমি যা না কেন তা স্বীকার করবো?’
আম্মু এই সংসার ছেড়ে চলে যেতে না পারলেও কখনো আব্বুর কাছে মাথা নত করে থাকেনি। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকেনি। আম্মুর প্রতিবাদ ছিল অন্যরকম।
একসময় আম্মু আলাদা রুমে থাকতে শুরু করলো। আব্বু কিছু বলতে থাকলে নিজের মত নিজে কাজ করতে থাকতো সেই কথাগুলো কানে গেলেও এমন একটা ভাব দেখাতো, তোমার যা ইচ্ছা বলতে পারো আমার কিছু যায় আসে না। একটা অবজ্ঞাভাব দেখাতো। নিজের মত থাকতে নিজেকে কিছুটা ভালোবাসতে শুরু করেছিল আম্মু তখনই একটা স্ট্রোক আম্মুকে কেড়ে নিলো।

সেদিন পম্পি বাসায় ছিলো না। কিভাবে তার আম্মু উত্তেজিত হয়ে গেল, ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেল এবং স্ট্রোক হলো, জানে না , কিছুই জানেনা। বাসার কাজের লোক গুলোও কিছু বলতে পারলো না।
পম্পির ধারণা মোবাইলে তার আব্বু , আম্মুকে এমন কিছু বলেছিল যে, সে সহ্য করতে পারেনি। হয়তো বুকের ভেতর কষ্টের ভার এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে বহন করতে পারেনি।

পম্পির আব্বু বলল,
—তোমাদের দেখা শেষ হলে, এবার যাওয়া যাক।
পম্পি বলল-
—আব্বু আমরা বাইরে কোন ভালো রেস্টুরেন্ট এখন খাবো। এর পরে বাসায় যাবো।আজ আমাদের ভার্সিটি বন্ধ তাই সারাদিনের জন্য আমরা প্ল্যান করে বের হয়েছি। তুমিও কি আমাদের সঙ্গে খাবে?
পম্পির কথাগুলো অনেক জোরালো ছিল। পম্পির আব্বু ভাবলেন এখন মেয়েকে রাগানো ঠিক হবে না।
—ঠিক আছে আমি বাসায় যাচ্ছি , তোমরা খাওয়া শেষ করে আসো।

রজনী এতক্ষণ একটা কথা বলেনি। তার ভয়ের চেয়েও লজ্জা লাগছিল অসম্ভব। সিরাত যা বোঝার বুঝে গেছেছিল।ও আল্লাহ কি লজ্জার ব্যাপার! লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। তার চোখের পানি আর বাঁধা মানতে চাইছে না। পম্পি আরেকটু কাছে এসে রজনীর হাতটা চেপে ধরলো।
—চল খালামনি যাওয়া যাক।
নওমির বাসায় চলে যেতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু পম্পিকে বলার সাহস হলো না। পম্পি এখন খুব রেগে আছে।ওর বাবার উপরে রাগ যেন আর কমছেই না।

রজনীর গলায় যেন খাবার আটকে যাচ্ছে। কিছুতেই খেতে পারছে না।এই ব্যপারটা ওরা দুজনেই খেয়াল করলো।
নওমি কথা বলা শুরু করলো-
—রজনীমণি তুমি আমাকে কত কথা বল,মন ভালো রাখার কথা বল।এখন তুমি এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকবে?
পম্পি বলল-
—কোন কিছু ভাবার দরকার নেই,তুমি আমার আব্বুকে ডিভোর্স দিয়ে দাও।এভাবে আর কয় দিন সহ্য করবে? আমার আব্বু তো, খুব ভালো করেই চিনি,কোন দিন ও শোধরাবে না।তুমি মরার আগ পর্যন্ত এ সব করতেই থাকবে। আমার আম্মুকে দেখেছি না।এখন মনে হয় আম্মু মরে গিয়ে বেঁচে গেছে।
—ডিভোর্স দিয়ে কোথায় যাবো,কার কাছে যাবো?
—কেন?সিরাতের কাছে।
রজনী এই কথা শুনে চমকে গেলো।
—কি বলছো এসব?এটা হতেই পারে না। সিরাত আর আমি – এটা কিছুতেই হতে পারে না। আরেকজনের জন্য আমি সিরাতকে নিজে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম একসময়। সেদিন আমি দেখেছিলাম ওর চোখে কি গভীর বিষন্নতা। কিন্তু তখন শুধু দেখেছিলাম, হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে চাইনি কারণ তখন আমি আরেকজনের জন্য এতটাই পাগল, তার জন্য দুনিয়ার সব কিছুই তুচ্ছ।
কিছুদিন আগে আমার বান্ধবীর কাছ থেকে আমার নাম্বার নিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করে সিরাতে।
এখন আমরা নিজেদের ফ্রেন্ড ও ভাবি না জাস্ট পরিচিত হিসেবেই যোগাযোগ।

—আসার আগে কিন্তু বলেছিলেন তোমার ফ্রেন্ডের আর্ট এক্সিবিশন।
—ওটাতো শুধু বলার জন্য বলা। ওরকম বয়সে অনেকেরই একজনের আরেকজনের জন্য ফিলিংস থাকে। সময়ের সাথে সাথে সেগুলো মন থেকে দূর হয়ে যায়।
—তোমার প্রতি সিরাতের কোন সাধারণ ফিলিংস ছিল না। সেটা ছিল সত্যিকারের ভালোবাসা। যেটা এখনো তার মনে বিদ্যমান।
—কি যে বল না যত্তসব ফালতু কথা।
—তুমি নিজের চোখেই তো দেখলে কতটা সুন্দর করে তোমার পোর্ট্রেট করেছে। দেখে মনে হচ্ছিল সত্তিকারের তুমি, শুধু ওই তিলটা ছাড়া।
—এখন আমার মনে পড়লো,ঐ তিলের কাহিনীটা। আমাদের কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময় ছোট্ট একটা নাটকের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে আমার ছোট্ট একটা চরিত্র ছিল। তখন শাড়ি পড়েছিলাম সাজগোজ করার সময় একটা ফলস তিল দিয়েছিলাম।ওটাই হয়তো ওর মনে আছে।
—তো আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে তোমাকে। নিজেই তো প্রমান পেয়ে গেলে।
—কিন্তু আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব না, তোমার বাবাকে ধোঁকা দেয়া।
—ধোঁকা দেয়ার প্রশ্ন আসছে কেন?
—এসব প্রশ্ন এখন একদম বাদ। খেতে এসেছি ভালো করে সবাই খাও।একদম চুপ।

এ সব কথা শুনে নওমি শুধু তাশফির কথাই ভাবছিলো।তাশফিও কি তাকে এতোটা ভালোবাসে? ওর মা-বাবা কখনোই মেনে নেবেন না তাদের এই সম্পর্ক। তখন কি হবে? তাশফি কি করবে?সে কি করবে?তাশফিকে ছাড়া তার জীবন কিভাবে এগিয়ে যাবে?কিছুই জানে না।এখনই এ সব ভাবার দরকার ও নেই।অহেতুক মাথায় চাপ নেয়ার কোন দরকার নেই।
এখন এই সময়টা ওদের সাথে আনন্দে কাটুক, যদিও একটু আগেই একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেছে।
তবুও যার যার সমস্যাগুলো কে দূরে রেখে একটু সুখের খোঁজ তো চলতেই থাকবে।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

#৫ম_তলার_মেয়েটা

#পর্ব_৩১

নওমি দোতলায় ঢুকতেই তোফাজ্জলকে সোফায় বসা দেখে তার পা আটকে গেল।জালেরা বেগমের সাথে দেখা করতেই এসেছিল নওমি। তিনিও ছেলের সামনেই বসে আছেন।তোফাজ্জলের নিজের বাসায় তিনি থাকতেই পারেন কিন্তু নওমির মনে হতে লাগলো তিনি এখানে কেন?
জালেরা বেগম অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলেন ‘নওমি’ ।
নওমিকে দেখে তোফাজ্জল যেন কাঠ হয়ে গেলেন। নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ফাঁসির আসামি মনে হতে লাগলো।জীবনে কোন দিন এতটা অপরাধ বোধে ভোগেননি তিনি।চোখ নিচের দিকে নামিয়ে বসে রইলেন।শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতেই হলো তাকে।পালিয়ে যাবনই বা কোথায়? পালিয়ে গেলে মানুষের চেহারার আড়াল টুকুই শুধু হওয়া যায় কিন্তু মনের দিক থেকে তো আড়াল হওয়া যায়না। সব সময় দুঃখগুলো নড়াচড়া করে মনের ভেতর। তোফাজ্জল শেষ পর্যন্ত মায়ের কাছেই ফেরত এলেন। দুনিয়ার সবাই তাকে ঘৃণার চোখে দেখলেও তার মা তাকে সেই পরম মমতায় আগলে রাখবেন।মা হলেন পরম শান্তির আশ্রয়স্থল।

যন্ত্রচালিত মেশিনের মত এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসলো নওমি।কি বলবে বা কি করবে বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ সময় যেন মনে হতে লাগলো কয়েক ঘণ্টা। কখনো তোফাজ্জলের মুখোমুখি হলে যেসব প্রশ্ন করবে ভেবেছিল নওমি, সেগুলো তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে কিন্তু এখন কিছুই মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। তোফাজ্জলকে দেখে তার রাগ বা ঘৃণা কিছুই হচ্ছে না বরং অজানা ভালোবাসার অনুভূতি হচ্ছে মনে।বাবাদের প্রতি কি মেয়েরা এমনই ভালোবাসার টান অনুভব করে? তোফাজ্জলের দিকে তাকিয়ে তার খুব কষ্ট লাগছে। কি অসহায় ভঙ্গিতে বসে আছেন। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।আর বসে থাকতে পারলো না খুব ধীরগতিতে উঠে নওমি বের হয়ে গেলো।
জালেরা বেগমও কিছু বললেন না।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নওমি ভাবতে লাগলো। কোন নির্দৃষ্ট ভাবনা না,এলোমেলো ভাবনা সব। দরজার সামনে এসে আশ্চর্য হয়ে গেলো সে,স্বর্ণা তার মা তাবাসসুমকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নওমির মনে হচ্ছে এই সব কিছুই সে স্বপ্নে দেখছে।একটু আগে তোফাজ্জল কে দেখা এখন আবার ওরা।এই সব নিশ্চয়ই স্বপ্ন। আজ এইসব কি হচ্ছে তার সাথে?
স্বর্ণা বলল-
—এই মাত্রই এসেছি।নক করে দেখলাম খুলছিস না। ভাবলাম ঘুমাচ্ছিস।
স্বর্ণার মুখে হাসি নেই।সে কথা বলছে মুখ গম্ভীর করে।ভেতরে ওর একটা গুমোট ভাব,একটা কষ্ট যেন ওকে খোঁচা দিচ্ছে।
নওমি যেন বাস্তবতায় ফিরে এলো।এসব কিছু স্বপ্ন ভাবার তো কোন কারণ নেই।সে এমনই এক জন, তার সাথে সব কিছু ঘটাই স্বাভাবিক। খুব ভালো করে বুঝতে পারলো আন্টি খুব জরুরি কিছু বলতে এসেছে।

দরজার লক খুলে ভেতরে ঢুকলো তারা। কোন ভনিতা না করেই তাবাসসুম বললেন-
—নওমি বসো। খুব জরুরি কিছু কথা বলতে এসেছি তোমাকে।
নওমি বসলো।সে বুঝতে পারছে কি বলবেন তিনি।নিশ্চয়ই বলবেন, তাশফির সাথে সম্পর্ক না রাখতে।তাকে দেখে অন্তত তাই মনে হচ্ছে। ছেলের ভবিষ্যত সম্মানিত করতে এসেছেন ।

—আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমার আর তাশফির বিয়ে দিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিবো।এতে করে মানুষের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না। দেশের বাইরে এইসব নিয়ে মানুষ প্রশ্ন করেনা। তোমার আঙ্কেল রাজি ছিলেন না,অনেক বুঝানোর পর রাজি হয়েছে। আর তাশফিকে আমরা কষ্ট দিতে চাই না। মূলত তাশফির কথা চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া। সমাজে আমাদের একটা মান সম্মান আছে। তোমার ব্যাপারে সবকিছু জানাজানি হয়ে গেলে আমরা আর মুখ দেখাতে পারবো না।তাই বিয়েতে কোন আত্মীয়-স্বজনদের কাউকে আসতে বলা হবে না। এইজন্য তাড়াতাড়ি তোমাদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

নওমি ভাবতেও পারেনি তাবাসসুম তাকে এই সব কথা বলবে। তাঁর কথায় এমন মনে হচ্ছে, নওমিকে বিরাট দয়া করছেন তাঁরা। তাঁরা যদি মেনে না নেন রাস্তার কুকুর নওমিকে কামড়ে কামড়ে খেয়ে ফেলবে।নওমি অবৈধ সন্তান বলে এই সমাজে তার থাকার অধিকার নেই, তার জন্য অন্যদের মাথা নিচু হয়ে যাবে। এত শিক্ষিত , এত জ্ঞানী, মানবতার সেবায় নিয়োজিত একটা পেশায় থাকা,সমাজের উপরের তলার মানুষদের মনোভাব দেখে নওমি দুঃখ পাচ্ছে না। শুধু অবাক হয়ে যাচ্ছে আগের চেনা জানা মানুষগুলো এভাবে হঠাৎ করে কিভাবে অচেনা হয়ে গেল! দূর থেকে সান্তনা দেওয়া যায় কিন্তু যখন নিজেদের স্বার্থ সামনে আসে তখনই মানুষের মুখোশ খুলে আসল চেহারা বেরিয়ে আসে।আসলে মানুষের মন মানসিকতা শিক্ষা,অশিক্ষা, সমাজের উঁচু নিচু দেখে যাচাই করা যায়না।

—নওমি কিছু বলছ না যে! তোমার মামাকে জানাও। কথা বার্তা বলে সবকিছু ঠিক করতে হবে। বিয়ে হয়ে গেলে সব ডকুমেন্টস জমা দিতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবকিছু রেডি করে ফেলতে হবে।

নওমি হাসলো।নিজের মনকে বলল,কিছুতেই উত্তেজিত হওয়া যাবে না।প্লিজ শান্ত থাকো।

তাবাসসুম ভাবলেন ,নওমি খুশিতে আটখানা হয়ে হাসছে। এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করবে নাকি। নওমি খুব চালাক মেয়ে। বেছে বেছে তার বোকা ছেলেটাকে ফাঁসিয়েছে।

খুব মোলায়েম ভাবে নওমি বলল-
—আন্টি আপনারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঠিক আছে কিন্তু আমি তো কোন সিদ্ধান্ত নেইনি ।
—মানে কি?তুমি তাশফিকে ভালোবাস না,বিয়ে করতে চাও না?
—ভালোবাসি। কিন্তু এভাবে বিয়ে করতে চাই না।
—কিভাবে?
—আসলে বলতে চাইছি আমি আপনাদের ফ্যামিলির জন্য কোনোভাবেই যোগ্য না। চোরের মতো বিয়ে আবার দেশের বাইরেও চলে যেতে হবে, আমার জন্মের বৈধতা নেই বলে শুধু মাত্র এই জন্য! আমার জন্ম হওয়ার পেছনে আমার তো কোন অন্যায় ছিল না তাহলে আমি কেন মুখ লুকাবো,চোরের মতো থাকবো। তাশফির সঙ্গে আমার বিয়ে হলে আপনাদের মান সম্মান ধুলায় মিশে যাবে এটা তো আমি হতে দিতে পারি না।এত দিন আপনাদের মেয়ের বান্ধবী হিসেবে আমাকে অনেক আদর করেছেন এর বিনিময়ে এত টুকু তো করতে পারি?

তাবাসসুম খুব আশ্চর্য হলেন নওমির কথা শুনে। তাঁর ধারণার বাইরে এই মেয়ে,ওকে দেখে পড়ে ফেলা সহজ না।মনে মনে একটু খুশিও হলেন, এখন তাশফিকে বলা যাবে নওমি নিজেই রাজি না।
স্বর্ণা টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,মাথা নিচু করে।নওমির দিকে তাকাতে পারছে না। এখানে তার মায়ের সাথে কিছুতেই আসতে চায়নি।তার বাবা-মা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে এই বিয়ে না হোক।
সে এত দিন যেই নওমিকে দেখেছে আজ তাকে সম্পূর্ণ অচেনা লাগছে। পরিস্থিতি মানুষকে কত কিছু শেখায়।তবে খুব খুশি লাগছে নওমির কথা শুনে।ওর আত্মসম্মানবোধ আছে, শুধু আছেই না প্রখর আত্মসম্মানবোধ ওর।

স্বর্ণা তার ভাই তাশফিকে বলেছিল, তোমারা লুকিয়ে বিয়ে করে ফেল। কিন্তু তাশফি রাজি হয়নি।’যা কিছু করবো আব্বু আম্মুর সম্মতি নিয়েই করবো’ এই বলেছিল তাশফি।

—তুমি তাহলে এই বিয়েতে রাজি না?
—না।
—তাহলে এই কথা তাশফিককে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিও।
—ঠিক আছে আন্টি জানিয়ে দেবো।
—তাহলে আমরা আসি এখন।

তাঁরা চলে যাওয়ার পর নওমি ঐ জায়গাতেই বসে রইলো,উঠে দরজাও লাগালো না।উঠে যাওয়ার শক্তি টাও যেন পাচ্ছে না। মনটা যেন একেবারে চুরমার হয়ে শরীরটাকে নিস্তেজ করে দিয়েছে। কতখানি শক্ত হয়ে এই কথাগুলো তাকে বলতে হয়েছে এটা শুধু সেই জানে। তাশফিকে সে কিভাবে ভুলে থাকবে এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। তবে তাকে ভুলে থাকতে হবে যে কোন উপায়েই হোক। তার নিজের যেটা অভাব ছিল সারা জীবন সেটা হলো একটা পরিবার। এই পরিবারের অভাব কারো যেন না হয় জীবনে। তার কারণে তাশফি যেন কখনো তার পরিবার থেকে আলাদা না হয় সেই চেষ্টা সব সময় করে যাবে সে।

মোবাইল স্ক্রিনে তাশফির নাম ভেসে উঠলো। আগে থেকেই সাইলেন্ট করা মোবাইলটা উল্টে রাখল নওমি। কি কথা বলবে সে তাশফির সাথে? সে বলল-
“তাশফি তুমি ভালো থেকো।”
তার কথার যেন প্রতিধ্বনি হলো ফাঁকা ঘরে।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে তাশফিকে মেসেজ পাঠালো,”তোমাকে কিছুতেই বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তুমি ভালো থেকো।”এর পরে তাশফির নাম্বার ব্লক করে দিলো।

স্বর্ণা রাগ হয়ে বলল-
—আম্মু আমরা এসেছিলাম সবকিছু ঠিক করার জন্য। কিন্তু এখন সম্পূর্ণ উল্টো পরিস্থিতি নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। ভাইয়াকে কি বলবে?
—কি বলবো মানে? তুমি তো নিজেই শুনলে নওমি নিজেই তাশফিকে বিয়ে করতে চাইছে না।
—তুমি যেভাবে কথা বললে, এরকম ভাবে কথা শুনলে নওমি রাজি হবে ভাবলে কী করে তুমি?
—এই ব্যাপারে তুমি কিছুই আলাপ করবে না তাশফির সাথে।
—বাহ্ তোমাদের মন মানসিকতা দেখে আমি অবাক হচ্ছি। স্ট্যাটাসের চিন্তা করতে করতে লাইফটাই শেষ হয়ে গেল। কি হবে এই সব করে? শুধু শুধু দুইটা মানুষকে কষ্ট দেয়া।
—অনেক বেশি কথা বলছো স্বর্ণা। আমি কখনোই তোমাদের কোন কিছুতে জোর করিনি। কখনো তোমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে বলিনি। তোমার বাবার সঙ্গে আমার মতের কখনো মিল ছিল না কিন্তু এই ব্যাপারটাতে আমি একমত। সমাজ নিয়ে আমাদের চলতে হয়।
—কি তোমাদের শুধু সমাজ সমাজ সমাজ! ভাইয়া ঠিকই এক সময় নওমিকে নিয়ে দূর-দূরান্তে পালিয়ে যাবে তখন কি করবে? এখন তো সে ভালো মনে চাচ্ছে তোমাদের মতে, তোমাদের রাজি করিয়ে সবকিছু করতে। যখন তোমাদের এই নোংরা মানসিকতা সম্পর্কে জানতে পারবে তখন দেখো কি হয়!
—যা বোঝনা তা নিয়ে কথা বলতে এসো না।

স্বর্ণার কথায় তাবাসসুমের ভাবনার উদয় হল মনে। আসলেই তো সবকিছু যদি ওলটপালট হয়ে যায়। ছেলে যদি তাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে যায়। তাহলে কিভাবে থাকবেন? নিজের ছেলে নিজের সন্তান দুনিয়াতে এত এত মেয়ে থাকতে এমন একটা মেয়েকে পছন্দ করলো কেন?

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here