৫ম_তলার_মেয়েটা,৩৮,৩৯

0
662

#৫ম_তলার_মেয়েটা,৩৮,৩৯
ফাহমিদা_লাইজু
#পর্ব_৩৮

অবশেষে রজনীর খবর পাওয়া গেলো। একটুও সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লেন পম্পির বাবা পম্পিকে সাথে নিয়ে ।
পম্পির বাবা ভাবছেন রজনী হয়তো কাউকে খুঁজে পেয়েছে কিংবা আগেই কেউ ছিল তার জীবনে যার সম্পর্কে তিনি জানেন না।এই জন্যই রজনী এতটা সাহস পেয়েছে।সে বাসা থেকে কোন গহনা,টাকা কিছুই নিয়ে যায়নি আর তার সামনে দিয়েই তো বেরিয়ে গেলো।তিনি একটা বারও আটকানোর চেষ্টা করেননি।
রজনীর কাবিনের টাকাটা ব্যাংকে রাখা ছিলো রজনীর নামেই। গতকাল ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে সেখান থেকে টাকা উঠিয়েছে রজনী আর এই সূত্র ধরেই পম্পির বাবার লম্বা হাত রজনীর খোঁজ পেয়ে গেলো। তাঁর ইনফর্মার ফলো করে রজনী যেখানে থাকে সেই জায়গাটা পর্যন্ত দেখে এসেছে। তিনি মনে মনে ভাবতে লাগলেন নিশ্চয় কোন হাভাতের সঙ্গে আছে,তা না হলে রজনীর টাকার দরকার পড়লো কেন?

পম্পি তার বাবার মনের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। পম্পি ভাবছে তাঁর বাবা অনুতপ্ত, রজনীর সাথে খারাপ আচরণের জন্য। রজনী অভিমান করেই চলে গেছে। সিরাতকে, রজনী পছন্দ করলে তাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করলে সে নিজেও খুব খুশি হতো। কিন্তু রজনী সিরাতকে ফিরিয়ে দিয়েছে,এখন সে তাহলে কিভাবে কার কাছে আছে?এই সব প্রশ্নের উত্তর ওখানে গেলেই পাওয়া যাবে।

গাড়ি ছুটে চলেছে সব কিছু পেছনে ফেলে। সারি সারি গাছ, কোথাও বা ধান ক্ষেত সবুজে ঢাকা দুই পাশের রাস্তা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। রাজধানী থেকে বের হয়ে যত দূরে যাওয়া যায়, যেদিকেই যাওয়া যায় চোখে পড়বে শুধু সবুজ আর সবুজ, সীমান্ত পর্যন্ত সবুজের খেলা। আস্তে আস্তে এই সবুজ অবশ্য কমে যাচ্ছে।এই জন্যই ঢাকার বাইরে বের হলেই খুব ভালো লাগে। পম্পি নিজের অজান্তেই তার বাবার একেবারে কোল ঘেঁষে বসলো সেই ছোট বেলার মতো।কত দিন এভাবে বাবার কোল ঘেঁষে বসে না। যত কিছুই হোক বাবার উপর অভিমান করে আর কত দিন থাকা যায়? স্ত্রীর কাছে ভালো স্বামী হতে না পারলেও বেশীরভাগ বাবারা সন্তানের অসম্ভব ভালো বাবা হয়ে উঠে।তাই তো কখনো কখনো বাবা আর মায়ের সম্পর্ক নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে নিজেদের মনে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। কখনো মা জিতে যায় কখনো বা বাবা জিতে যায়।

গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তায় আসতেই ড্রাইভার বলে উঠলো-
—এই ফ্লাইওভারের জন্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ মনে হয় ঢাকাই পইরা যাইবো।
এই শুনে পম্পি কোথায় কোথায় বলে দেখতে চাইলো-
ড্রাইভার একটু স্লো করে এগুতে লাগলো-
—ছোট ম্যাডাম এই যে দেখেন।

—কখনো সরাসরি ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ দেখা হয় নি। অসাধারণ সুন্দর স্বাধীনতার প্রথম স্মারক এই ভাস্কর্য ।
ভাইয়া জানেন তো ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো জয়দেবপুরের অধিবাসীরাই।সেই সময়‌ শহীদ হন হুরমত আলী,কালু মিয়া ও মনু খলিফা। সেই স্মৃতি এবং শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই নির্মাণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রথম এই ভাস্কর্য ১৯৭৩ সালে।এক হাতে রাইফেল অন্যহাতে গ্রেনেড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অতন্দ্র প্রহরীর মতো।

—জ্বী ম্যাডাম জানি এই ইতিহাস।আগে অনেকদূর থাইকাই দেখা যাইতো এই ভাস্কর্য। এইটা দেখলেই মনে হইতো গাজীপুর চৌরাস্তায় আইসা পড়ছি। কিন্তু আফসোস এখন আর দেখা যায় না।

—এই ভাস্কর্য অক্ষত রাখতে নিশ্চয়ই কোন ব্যবস্থা করবে সরকার।এত সুন্দর,তাও আবার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম স্মৃতি এই ভাস্কর্য নিশ্চয়ই অবহেলায় পতিত হবে না।
আব্বু তুমি কি বলো?

—নিশ্চয়ই একটা কিছু ব্যবস্থা করবেই। অবশ্যই করা উচিত। হেলাফেলায় এই ভাস্কর্য নষ্ট হয়ে গেলে আমাদের স্বাধীনতাকেই অপমান করা হবে।

—সুন্দর একটা ভাস্কর্য আগে দেখলাম না। এখন আফসোস লাগছে দূর থেকে দেখলে কেমন দেখা যেত, দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।এই দিকে আমার কখনো আসাই হয় নি। দাদা,নানা সবার বাড়িই সিলেটে।তেমন কোন আত্নীয়ও নেই।
নওমিদের বাড়ি ময়মনসিংহের কোথায় যেন বলেছিল মনে পড়ছে না।

—এত খারাপ রাস্তা আর হয় না। গাড়ির জান থাকে না।
—ভাইয়া গাড়ির কি জান থাকে?

— মাইনষের যে অবস্থা হয় এই প্রাণহীন গাড়ি গুলোর অবস্থা আরো বেহাল । এই রাস্তা দিয়া একমাস চলাচল করলে এই গাড়ি ভাঙ্গারির দোকানেও কিনব না এমনই লক্কর-ঝক্কর হইয়া যাইবো।

পম্পির বাবা ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন আর কতক্ষণ লাগতে পারে।সে বলল-
—রাস্তা ভালো না, কতক্ষণ যে লাগে নির্দিষ্ট করে বলা যাইতেছে না।তবে আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ময়মনসিং শহরে পৌঁছতে পারবো ইনশাল্লাহ।

—ময়মনসিংহ পৌঁছে আমরা লাঞ্চ করে নেব।
আমরা যেখানে যাচ্ছি প্রত্যন্ত গ্রাম। হয়তো তেমন কিছুই পাওয়া যাবে না। প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা ও করতে হবে কি বল মামনি?

—ঠিক আছে আব্বু।

ময়মনসিংহ শহরে ঢোকার আগেই পম্পির বাবা ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন কোথায় লাঞ্চ করলে ভালো হবে কারণ ড্রাইভার ছেলেটা ময়মনসিংহের। স্বাভাবিক ভাবেই ওর সব কিছু চেনাজানা।
সে বলল —
—সারিন্দায় লাঞ্চ করলে ভালো হইবো। এটা গাঙ্গিনাপাড়ে।এই গাঙ্গিনারপাড়ই সবকিছু,বলতে গেলে ময়মনসিংহ শহরের প্রাণ।এর পর কেনাকাটা করা যাবে এখানেই।এছাড়াও এখানে সেখানে রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন শোরুম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শহরের সর্বত্র।

খেয়েদেয়ে, কেনাকাটা করে একটু বেশিই সময় গেলো।পম্পি খাওয়ার জন্য অনেক কিছু কিনলো ফ্রুট,ড্রাই ফ্রুট, মিষ্টি নাস্তার আইটেম,আরো অনেক কিছু কিনলো। পম্পির বাবা মানা করলেন না বা তাড়া দিলেন না,এটা সেটা নিয়ে দেখাচ্ছে আব্বু এটা নিচ্ছি।সেই ছোট বেলায় এভাবে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে যেতেন কেনাকাটা করতে,সেই স্মৃতিগুলো মনে হচ্ছে। আবার যদি যেতে পারতেন জীবনের ঐ সময় টাতে!

পম্পির মা ঘরকোনো মহিলা ছিলেন,ঘরটাই তার সব কিছু। ঘর কুনো হয়েছিলেন পম্পির বাবার জন্যই। একবার শপিং এ গিয়ে দেরি হচ্ছিল দেখে পম্পির বাবা পম্পির মাকে রেখেই চলে আসেন। সেদিন পম্পির মা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি ঢাকার কিছুই চিনেন না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন।এক রিকশাওয়ালা এটা দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? শুধু জায়গার নাম আর বাসার নাম্বার বলতে পেরেছিলেন।সেই রিকশাওয়ালা তাঁকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলো। রিকশা থেকে নেমে পার্শে যত টাকা ছিল সব দিয়ে দিয়েছিলেন রিকশাওয়ালাকে।
এটা শুনে পম্পির বাবা নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হবেন তা না উল্টো এত টাকা রিকশা ওয়ালা কে দিয়েছেন দেখে রাগে গজ গজ করছিলেন।
সেই দিনই পম্পির মা নিজেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন
নিজের কাছে,আর কোন দিন শপিং এ যাবেন না, আর তাঁর প্রতিজ্ঞা তিনি রক্ষা করেছিলেন আমৃত্যু।
পম্পির মাকে আবার ফিরে পেলে জীবনে করে আসা ভুলগুলো শুধরে নিতেন। আফসোস সেটা সম্ভব না।সময় চলে গেলে আফসোস করেই বা কি হয়? আবার রজনীর কথা মনে হতেই তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। বিশ্বাস ঘাতক ।

পম্পি সবুজ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেল তার বাবার কাঁধে মাথা দিয়ে। পাম্পির বাবার খুব শান্তি লাগছে মেয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। তাঁর ও মনে হয় তন্দ্রার মতো এসেছিল, ড্রাইভার এর কথায় ঘুম ভাঙলো।
—স্যার একজন লোক হাত ইশারা করতেছে। গাড়ি কি থামাবো?
পাম্পির বাবা চিনতে পারলেন।ফুলপুর চলে এসেছেন।এখানে থাকার কথাই ছিল ওর। এটাই তাঁর ইনফর্মারদের একজন। গাড়ি থামিয়ে তুলে নেওয়া হল তাকে।সেই বাকি রাস্তাটা সেই চিনিয়ে নিয়ে যাবে।

—আর কত দূর?
—স্যার আরো সাত কিলোমিটার ভিতরে।আধা কিলো আগেই গাড়ি রেখে যেতে হবে। ওখান থেকে রাস্তা এত সরু যে, সহজে গাড়ি যেতে পারবে না। রিক্সা ভ্যান চলে সেটাও খুব কম। হয়তো হেঁটেই যেতে হবে।

অবশেষে পৌঁছানো গেলো পদ্মপুর গ্রামে।এত দিন পর এতটা রাস্তা হেঁটে এসে পম্পির বাবার ক্লান্তি একমুহূর্তেই উবে গেল রজনীকে দোলনায় বসে দোল খেতে দেখে। একটা বড় গাছের ডালে পাটের মোটা রশি ঝুলিয়ে দোলনা বানানো হয়েছে। এটাতে বসেই রজনী মনের সুখে দোল খাচ্ছে। পায়ের আওয়াজ হতেই পেছন ফিরে ওদেরকে দেখে রজনীর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হলো।
সকালের সূর্য টা তখন হেলে পড়েছে পশ্চিম দিকে, লাল আভা ছড়িয়ে সে আজকের মতো বিদায় নিচ্ছে । পম্পি দৌড়ে গিয়ে রজনীকে জড়িয়ে ধরল। রজনী যেন একেবারে জমে গেছে। বাস্তবে এমন হচ্ছে এটা বুঝতে তার অনেকক্ষণ সময় লাগলো।
বাড়িটার খুব কাছাকাছি অন্য লাগোয়া বাড়িঘর নেই। দূরে দূরে আছে তিন পাশে বাড়ি। এই বাড়িটাতে ঘর সংখ্যা মোটে দুইটা, শূন্য গোয়াল ঘর, বিভিন্ন গাছ দিয়ে বাড়িটা ঘেরাও করা। ঘরের চাল, বেড়া সবকিছুই খড় দিয়ে তৈরি,চালের উপরে লাতানো গাছ,লাউ বা সিমের মাচা ছোট্ট উঠানের একপাশে, একটা পাশে একটা টিউব ওয়েল – দারিদ্র্য যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা যুগ যুগ ধরে।
পম্পির বাবার হঠাৎ করে মনে এলো, ঘরে নিশ্চয় ঐ শয়তান ঘরে শুয়ে আছে। তিনি জোরে ডাকতে লাগলেন-
—ঘরে কে আছ বের হও?

কথা শুনে একজন বয়স্ক বৃদ্ধ মহিলা বেরিয়ে এলেন-তিনি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এর পরে প্রায় চিৎকার করে বললেন-
—কেডা তুমি,বাড়ির ভিতরে ঢুইক্কা চিল্লাচিল্লি করতাছ?কত বড় সাহস?

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

#৫ম_তলার_মেয়েটা

#পর্ব_৩৯

গাড়িটাকে ঘিরে ছোট বড় বাচ্চাদের জটলা,এদের মধ্যে কয়েকজন অতি উৎসাহী লোকও আছে, তারা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করছে কার বাড়িতে গাড়িওয়ালা লোক এসেছে। বিভিন্ন প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছে ড্রাইভারকে।
ড্রাইভার নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না কার বাড়িতে এসেছে পম্পিরা, শুধু এতটুকু জানে রজনী ঐ বাড়িতে আছে। রজনীর নাম বলার পরেও তেমন কেউ চিনতে পারলো না।

পদ্মপুর গ্রামটা ছবির মতো সুন্দর।এখানে কালো বিএমডব্লিউ গাড়িটাকে খুব বেশি বেমানান লাগছে।এখানে হঠাৎ কোন গাড়ির হর্নে ভীত হয়ে পাখিদের উড়ে চলে যেতে হয় না কারণ খুব একটা গাড়ি ঢুকে না এখানে। তালুকদার বাড়ির গাড়ি আসলেও সেটা ছয় মাসে কিংবা বছরে একবার।রজনীর নানির বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে গাড়িটা রাখতে হয়েছে। এর পর থেকে রাস্তা এত সরু যে কোন ভাবেই সামনে এগিয়ে যাওয়া যাবে না।

এত কিছুর মধ্যেও ড্রাইভারের চোখ গেলো দূরে, যেখানে টুপ করে সূর্যটা‌ ডুবলো।
এই দৃশ্যটা অসম্ভব সুন্দর হলেও কেন জানি মনটা বিস্বাদে ভরিয়ে দেয়।একটি দিনের সমাপ্তি দিয়ে শুরু হয় আরেকটি দিনের জন্য অপেক্ষা। রাতের আঁধারে সব কিছু ডুবে গেলেও রাত হাজির হয় তার আলাদা সৌন্দর্য নিয়ে। সেই সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে থাকে আকাশের চাঁদ আর তারার মেলা,মেঘেদের লুকোচুরি। শুরু হয় আঁধারের প্রতিক্ষায় থাকা প্রাণিদের বিচরণ।প্রতিটা জিনিসের প্রয়োজন ব্যক্তিভেদে আলাদা। কোন ফুল হয়তো রাতের আঁধারে সুরভী ছড়ায় আবার কোন ফুল হয়তো দিনের আলোয় নিষ্প্রাণ হয়ে যায়।কারো কাছে যেটা প্রয়োজন কারো কাছে হয়তো সেটা মৃত্যুসম। যেটা কারো কাছে হয়তো অপছন্দের সেটারই তীব্র প্রতিক্ষায় থাকে হয়তো কেউ।তবে প্রকৃতিতো চলে তার নিজস্ব নিয়মেই।

এই একটু আগে পম্পির বাবা গলা চড়িয়ে যখন বলছিলেন ঘরের ভেতরে কে আছে। বৃদ্ধা একচোট ধমক দিলেও পম্পির বাবার ধারণা ছিল আরো কেউ আছে, ইনফর্মারকে ইশারা করলেন দেখতে।দুইটা ছোট ঘর ,বাড়ির এই কোনা থেকে ঐ কোনা সহজেই দেখা যায়।সে বলল,কেউ নেই। পম্পির বাবা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন রজনীর দিকে।এই বৃদ্ধা তার নানি হয়।নানির বয়স হলেও তিনি অত্যন্ত চালাক মহিলা। বিশেষ করে তাঁর সামনেই রজনীর খুব লজ্জা লাগছে কারণ তার স্বামী তাকে নিয়ে যে বাজে ধারণা করছে সেটা আবার নানি বুঝে না ফেলেন।

পম্পি সামনে এসে বলল-
—আব্বু তুমি কাকে খুঁজছ?
পম্পির বাবা চুপ করে রইলেন।
নানি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন রজনীর দিকে।
—যার সাথে আমার বিয়ে হইছে উনি সেই।আর ও হলো উনার মেয়ে।
পম্পির অদ্ভুত লাগলো পরিচয় পর্বটা।তবে এর চাইতে ভালো পরিচয় আর দেওয়ার ছিল না।
রজনী খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারছে পম্পির বাবা মনে করেছে কোন পুরুষের সাথেই রজনী এখানে এসেছে।রাগে তার গা জ্বলা করতে লাগলো।এই অমানুষটা পুরুষহীন নারীর জীবন কল্পনাই করতে পারে না!!

নানি তাড়া দিলেন-
—এইটা আগে কইলেই তো অইতো।নাতজামাই আইছে কি দিয়া আমি যে সমাদর করমু?তয় জামাই আপনে কারে খুঁজেন?আর তো কেউ এই বাড়িতে থাহে না।
—পম্পির বাবা নিজেকে সামলে নিয়ে, নানিকে সালাম দিলেন।
বৃদ্ধা একেবারে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নাতজামাইয়ের আদর আপ্যায়নে।

বাড়িতে কোন চেয়ার নেই।উঠানের এক কোনায় বসার জন্য মাঁচা আছে,যেটা অনেকদিন আগে নানির প্রতিবেশী ছেলে জমিরকে দিয়ে বানিয়েছিলেন। তিনি এখানে আগে মাঝে মাঝে বসতেন , এখন আর কেউ বসে না।এখন অনেক দিন পর এটা কাজে লাগলো।তিনি রজনিকে দিয়ে একটা কাপড় বিছিয়ে তাতে বসতে বললেন পম্পির বাবাকে।পম্পি হাঁটাহাঁটি করছে,সে সব কিছু দেখেই মুগ্ধ হচ্ছে,তার চোখ সে কথাই বলছে।

নানি রজনীকে বললেন-
—শরবত কর।লেবু গাছ থন একটা লেবু ছিইরা ল।

নানি নামায পড়তে ঘরের ভেতরে গেলেন। কারেন্ট নেই এখন । এখানে বলা যায় না কখন কারেন্ট আসবে, একবার গেলো তো গেলোই। একটু বৃষ্টি বা ঝড় হলে তো কথাই নেই সেটা কয়েক ঘণ্টা বা একদিন বা দুইদিন ও লেগে যেতে পারে। একমাত্র হেরিকেনটা উঠানে রাখা হলো।
শরবত খেয়ে পম্পির বাবার মাথা মনে হয় কিছুটা ঠান্ডা হলো।
পম্পি শরবত খেয়ে একেবারে অভিভূত। লেবুর এত সুন্দর ঘ্রানে মন জুড়িয়ে গেলো!

প্রতিবেশী দুইজন মহিলা এলো।এর মধ্যে একজন জমিরের মা।যে সব সময় নানিকে সাহায্য করে। সব সময় খোঁজ খবর রাখে।নানির যা লাগে জমির বাজার থেকে কিনে এনে দেয়। নানি এদেরকে ডেকে একটু দূরে নিয়ে বললেন-
—তোরা একটু আত(হাত) লাগা। চৌকির নিচে মুরগি আছে দুইডা।জবাই দে।আর ভাত বওইয়া দে,চাইরডা ডিম আছে হিদ্দ দে (সেদ্ধ)।
—চাচি জামাইরে ভাত দিতাইন ক্যায়া।পোলাউ দিবাইন।চাউল আমার বাড়িতে আছে আমি লইয়া আই।আর কি কি লাগবো?
—আর তেমুন কিছু লাগতো না।কাইল রজনী শহরে গিয়া কিইন্না আনছে ম্যালা(অনেক) কিছু।
— একটা হারিকেন মনে অয় লাগবো?
—হু,হারিকেন আর একটা বাত্তি আনিছ।

পম্পির মনে পড়লো আসার সময় যা কেনা হয়েছে সব গাড়িতেই রয়ে গেছে।সে তার বাবাকে বলল –
—আঙ্কেল গিয়ে কেনা জিনিস গুলো নিয়ে আসুক।
পম্পির বাবা সায় দিলেন আর গাড়িতে থাকা এরোসল স্প্রে টা নিয়ে আসতে বললেন।মশার জন্য এখানে বসাই যাচ্ছে না।

এবার একটু ফাঁকা পেয়ে পম্পির বাবা পম্পিকে বললেন রজনী কে ডেকে আনতে। রজনীর সাথে কথা বলা দরকার।
পম্পি গিয়ে দেখলো রজনী রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। শোবার ঘরের দরজা দুইটা, সামনে এবং পেছনে। পেছনের দরজার সাথে রান্নার জায়গাটা লাগোয়া।উপরে একটু ছাউনি, তিনপাশ খোলা, মাটির চুলা দুইটা।অন্য সময় নানির সন্ধ্যার পরে এই রান্না ঘরের দরকার পড়ে না। দিনে একবারই তিনি রান্না করেন।কোন মতে একটু খেয়ে বেঁচে থাকা।এই জীবন এখন অসম্ভব ভারী মনে হয়। অনেক তো বাঁচলেন আর কেন বেঁচে থাকা। গ্রামের সবাই তাঁকে খুব কর্কস মহিলা ভাবে। কারণ নিজেকে সেভাবেই তৈরি করেছেন। যৌবন থাকতে থাকতে স্বামী হারা নিঃসন্তান নানি ,তা না হলে এখনো টিকে থাকতে পারতেন না। শিয়াল, কুকুর খুবলে খুবলে খেয়ে ফেলতো অনেক আগেই।একটা এতিম ছেলেকে বড় করেছিলেন, সেটাও এত বড় বেইমানি করলো,যা জমি জমা ছিল সব ধোঁকা দিয়ে সই করিয়ে নিয়ে গেলো।

—খালামনি আব্বু তোমাকে ডাকছে।

জমিরের মা কাছেই ছিল তাকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে রজনী গেলো উঠানে।

—তো, মনে হচ্ছে ভালোই আছ?
—আশা করেছিলেন খুব খারাপ থাকবো?
—তুমি তো বলেছিলে তোমার নানি মারা গেছেন,এখন আবার নানি আসলো কোত্থেকে?
—উনি আমার নানির আপন ছোট বোন।ছোট বেলায় খুব আসা হতো, খুব আদর করতেন আমাদের।
—উনি একাই থাকেন?
রজনীর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, তবুও বলতে হবে।সব কিছু একবারে বলাই ভালো।
— নানি নিঃসন্তান।নানা অনেক বছর আগে মারা গেছেন।অনেক জমিজমার মালিক ছিলেন। অনেক বড় বাড়ি ছিলো।একটা এতিম ছেলেকে বড় করে বিয়ে দিয়েছিলেন।সেই ছেলে নানিকে ধোঁকা দিয়ে সাইন করিয়ে সব জমিজমা নিয়ে নিলো,সবতবাড়িটা পর্যন্ত।সব বিক্রি করে এক সময় নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো।
এই টুকরো জমিটা কিভাবে যেন রয়ে গেলো। এখানেই সবাই সহযোগিতা করে ঘর তুলে দিলো নানিকে। এখন ভাতা দিয়ে নানি কোনমতে চলেন। আগে নানি যাদেরকে সাহায্য সহযোগীতা করতেন তারা এখন নানিকে দেখেন।আমি এই সব কিছুই জানতাম না। ভেবেছিলাম নানি তার পালিত ছেলেকে নিয়ে সুখেই আছে। নানির ব্যবহার কিছুটা রুক্ষ হলেও মনটা খুব ভালো।

—বেরানো তো অনেক হলো ,কখন রওনা দিতে চাও?
এই কথা শুনে রজনী মুচকি হাসলো।মনে হচ্ছে এখানে খুব শখ করে রজনী বেড়াতে এসেছিল, এক সুখী ফ্যামেলীর মতো একসাথে বিদায় নিয়ে ভালোবাসার নীড়ে ফিরে যাবে তারা।ব্যপারটা এতটাই সহজ আর আনন্দময়!!!

—এত দূর থেকে এত কষ্ট করে আমার অবস্থান জেনে আসছেন,এত ধকল সহ্য হবে একটু রেস্ট না নিয়ে গেলে? গরীবের বাড়িতে যখন এসেই পড়েছেন , রান্না হচ্ছে খাবেন , এর পরে শক্ত চৌকিতে ঘুমাবেন। ঘুম হয়তো আসতে চাইবে না নরম বালিশ আর নরম বিছানা ছাড়া। তখন না হয় এই প্রকৃতির সুর শুনবেন মনোযোগ দিয়ে। বুঝতে চেষ্টা করবেন দূর থেকে দেখা বা শোনার মধ্যে বাস্তবের কতটা তফাৎ।

রজনীর কথায় এতটা দৃঢ়তা ছিল পম্পির বাবা কোন উত্তর দিতে পারলেন না। পম্পিও শুনছিলো রজনীর কথা। তার বাবা এই বাড়িতে ঢুকেই যেই আচরণ করলো সেটার মানে নিতান্ত নির্বোধ ব্যক্তিও বুঝতে পারবে ।সে যা ভেবেছিল সেটা ছিল ভুল, কিছু মানুষ কোনদিনও বদলায় না কিংবা বদলাতে চায় না।একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো পম্পির বুকের গভীর থেকে।

একজন গাড়িওয়ালা লোক এই বাড়িতে এসেছে এই খবর ছড়িয়ে পড়লো গ্রামে। বিভিন্ন মানুষ জন আসতেই লাগলো দেখা করতে।গ্রামের মেম্বারও এলেন।এর মধ্যে জমির অনেকগুলো চেয়ার জোগাড় করে এনেছে, বাজার থেকে একটা চার্জার লাইট ও ভাড়া করে এনেছে। এখন সাত থেকে আট জন লোক দিয়েই উঠান ভরা মনে হচ্ছে। পম্পির আনা মিষ্টি আর নাস্তা এখন কাজে দিচ্ছে। পম্পির বাবা অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে সবার সাথে কথা বলছেন।মেম্বার সাহেব দাওয়াত দিলেন তার বাড়িতে খাওয়ার জন্য আগামীকাল দুপুরের।সেই উপলক্ষে গ্রামের সব মানুষের দাওয়াত। পম্পির বাবা যতই বলেন আগামীকাল চলে যাবেন, তাঁর কাজ আছে ততই মেম্বার নাছোড়বান্দা।

আস্তে আস্তে রাত বাড়তে লাগলো, মানুষ জন চলে গেলো একে একে।
পম্পির বাবা ভেবেছিলেন খাবেন না,এটা তাঁর নিরব প্রতিবাদ।কি জন্য, কিসের প্রতিবাদ তিনিই জানেন। কিন্তু সামনে খাবার রাখার পর এর সুঘ্রাণে পেট মোচড় দিলো,টের পেলেন আসলেই ক্ষুধা লেগেছে। মুরগি,ডিম,ভাজি,ডাল যেন অমৃত লাগলো মুখে। রজনীর নানি বলে বলে দিচ্ছেন রজনী কে একা সেটা পাতে দেয়ার জন্য। বহুদিন পর নিজের নানুর কথা মনে পড়লো। তাঁর নানু ও এমনই হয়ে গিয়েছিলেন দেখতে । বৃদ্ধ হয়ে গেলে মনে হয় সবাই একই রকম হয়ে যায়!আহ কি যত্ন করে সামনে বসিয়ে খাওয়াতেন নানু,খাবারের স্বাদ যেন ঠিক এমন ছিলো।
সময়ের সাথে সাথে সবাই এক সময় হারিয়ে যায়।নানা-নানু,দাদা-দাদু কেউ নেই,এমন কি নিজের মা বাবাও নেই।এক সময় তিনিও থাকবেন না। ইচ্ছে হোক বা না হোক সবাইকেই একদিন এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে যেতে হবে।কেন তাহলে এত কিছু?এই সব ভাবনা আসছে কেন মনে-তাহলে কি এই বিশুদ্ধ প্রকৃতির মাঝে মনটাও বিশুদ্ধ হতে চাইছে?

পম্পির একটু ঝাল লাগছে কিন্তু তবুও সে খুব মজা করে খাচ্ছে।কে রান্না করেছ জানতে চাইলো সে। রজনী জমিরের বৌকে এনে দাঁড় করালো,
—এই যে এই ছোট্ট বৌটা রান্না করেছে। এই মামির ছেলের বৌ। অসম্ভব মিষ্টি চেহারার মেয়েটার বয়স খুব বেশি হলে পনেরো ষোল।এই বয়সেই বিয়ে, কিছু দিন পর দেখা যাবে দুই তিন টা বাচ্চাকাচ্চার মা। পম্পির মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
মেয়েটা কিছু শোনার জন্য তাকিয়ে আছে পম্পির দিকে।
—খুব মজা হয়েছে রান্না। তোমার হাতে জাদু আছে।

কিশোরী বৌয়ের চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো।আর কিছু না এতটুকু শোনার জন্যই হয়তো সে খুব মনোযোগ দিয়ে যত্ন করে রেঁধেছে।
কত মানুষের কত অল্প চাওয়া।কত অল্পতে তারা খুশি হয়।

যার দেখার পরিধি, জানার পরিধি যত কম তার জীবনে চাওয়াও তত কম।অল্পতেই তারা তুষ্ট হতে পারে,সব সময় না পাওয়ার হাহাকার তাকে তাড়া করে ফেরে না, তার কখনো বিনিদ্র রাত কাটে না।

রান্নার সময় জমিলের মা বলেছিলো, ‘রজনী আম্মা জমিরের বৌ খুব ভালা রান্দে,ওরে ডাইক্কা আনি?’ রজনী কে সে আম্মা বলে।গ্রামে দেখা যায় রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও যারা পাড়াতো ভাসুর, দেবর, ননাস ,ননদ তাদের ছেলেমেয়েদের শুধু নাম ধরে বলে না । নামের সাথে আব্বা ,আম্মা যোগ করে।

জমির একটা ভ্যান দিয়ে তোশক বালিশ নিয়ে এলো। রজনী বলল-
—এই সব কই পাইলি?
—আরে আফা বড় বাজারে সব কিছু ভাড়ায় পাওয়া যায়।ভাড়ায় আনছি।
—বড় বাজার তো অনেক দূরে।এত কষ্ট করার কি দরকার ছিল?
—কি যে কন না আফা,ওত বড়লোক মানুষ আইছে এই কাঠ বিছনায় থাকতে পারবো?আর আমরার গেরামের জামাই,ভালা কইরা সমাদর করন লাগবো না? দোহান বন্ধ অইয়া গেছিলো, দোহানদারের বাড়িত গিয়া তারে আইন্না দোহান খুলাইছি।
রজনী অভিভূত হয়ে গেলো সবার এত সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দেখে। সবাই সবার সাধ্য মতো চেষ্টা করছে নিজেদের বাড়িতে থাকা ভালো জিনিসটা দিয়ে সহযোগিতা করতে। জামাই বলে কথা, তাঁর আপ্যায়নে যেন ত্রুটি না থাকে। তবুও কি পম্পির বাবার মন ভরবে?তাতে অবশ্য কিছুই যায় আসে না,রজনী তো তাঁকে দাওয়াত করে আনেনি।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here