রাকা (৩০)
রিমা খালাকে ডেকে আনতে গেলাম।
সে শুয়ে আছে সাড়া-শব্দহীনভাবে।
আমি যেতেই চোখের পলক ফেললো।
পিটপিট করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
তারপর ম্লান হেসে বললো, কিরে মা? আপনের কথা জিজ্ঞেস করেই কই গেছিলি দৌঁড় দিয়ে?
আমি হাসির জবাব না দিয়ে বললাম,
– কোথাও না। তোমাকে আব্বু ডাকে।
– কেন?
– জরুরি কথা আছে নাকি।
– আমার সাথে আবার কিসের জরুরি কথা! আচ্ছা চল। বলে আমার আঙুলে ধরে টান দিতেই আমি ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
– তুমিই যাও। আমি গেলে আব্বু ধমক দিয়ে বলবে,বড়দের কথার মাঝখানে তুমি আসো কেন?
খালা বললো,
– নাহ্। তুই চল তো!
আমি গোঁ ধরে বসে রইলাম।
আব্বু আবার ডাকতেই খালা দৌঁড়ে চলে গেলো।
আমি বসে রইলাম একা একা।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষন ইন্টারনেটে এটা ওটা দেখলাম।
কোনো কাজ না পেয়ে অনেক্ষন চেষ্টা করে একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলে ফেললাম আচমকা।
খুলেই চেনা-অচেনা সবাইকে রিকুয়েস্ট পাঠাতে লাগলাম।
আবার কারো কারো একাউন্ট ও ঘুরে ঘুরে দেখা শুরু করলাম।
জেদ ধরলাম অকারণে,আজকে আর পড়বোই না।
এভাবেই সময় নষ্ট করবো ভেবে,নতুন ক্ষেত্রেই সময় ব্যয় করতে লাগলাম দ্বিধাহীনভাবে।
একজনের একাউন্টে ঢুকে আরেকজনের, ওখান থেকে আবার আরেকজনের এমন করে করে আমি মোটামুটি এলাহীকান্ড করে ফেলছি।
হঠাৎ চোখে পড়লো, আমার অধম দুলাভাইয়ের একটি ছবি।
কুখ্যাত পোজের সেই ছবির মানুষকে দেখে চেনাও যেন দায়।
অনেক কষ্টে, অনেক চেষ্টার পরে একাউন্টে ঢুকে দেখলাম, কারেন্ট সিটি কিশোরগঞ্জ দেওয়া। আইডির ছবিগুলো দেখে নাক মুখ কুঁচকে যাচ্ছিলো আমার। কি রংচঙে, বখাটে একটা ছেলে সে!
কোথাও আমার তানিশা আপুর কোনো ছবি দেখলাম না। কিন্তু তার এই একাউন্ট ভর্তি লাইকস,কমেন্টস। সবগুলা কমেন্ট খুঁটে খুঁটে দেখছি, আপুর আইডির সন্ধান পাওয়া যায় কিনা জানতে।
আপুকে পেলাম না কিন্তু একগাদা নোংরা জিনিস দেখে নিয়েছি।
দুলাভাই লোকটা সুবিধার না আসলেই।
ফেসবুকে দক্ষ এমন একজন বান্ধবীকে ফোন করে, তার থেকে সব জেনেশুনে তবেই সব তথ্য উদ্ধার করতে পারলাম।
দেখলাম,দুলাভাইয়ের নামে অনেকগুলোই আছে একাউন্ট। দুটোর মধ্যে এটাতেই (যেটা প্রথম খুঁজে পেয়েছিলাম) তার সময় দেওয়া হয় বেশি।
ওখানে বা কোনো একাউন্টেই তানিশা আপুর কোনো চিহ্ন নেই।
রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস আপডেট করা আছে অন্য একটা মেয়ের সাথে।
এক জায়গায় একজনকে দেখা যাচ্ছে।
অদ্ভুত! দুলাভাইরা এখন কিশোরগঞ্জে আছে, এই খবর কি এক্ষুনি আব্বুকে দেওয়া উচিত নয়?
যদি আপুকেও খুঁজে বের করা যায়!
ভেবে দৌঁড়ে চলে গেলাম আব্বুর রুমে।
গিয়েই থমকে গেলাম।
আব্বু আর খালার মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে।
তাও আবার তাদের কথা কাটাকাটির পিছনে মূল দায়ী ব্যক্তিটি আমিই।
এমতাবস্থায় এই খবর আর কিভাবে দিবো, তাই পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে চুপচাপ তাদের কথা শুনতে লাগলাম।
কথাগুলো এতটাই মারাত্বক যে আমার হাঁটু কাঁপছিলো। বুক ধড়ফড় করছিলো।
আমার আব্বু এই সব বলছে?
★
রিমা খালা আব্বুর কাছে যেতেই আব্বু উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,
– রিমা! খুব চিন্তায় আছি, একটা বিহিত করতে চাই তোর সাথে পরামর্শ করে!
খালা কৌতূহলপরবশ হয়ে বললো, কী? বলেন।
আব্বুর উত্তেজনা যেন বেড়েই যাচ্ছে ক্রমশ।
সে গলা পরিষ্কার করে বললো,
– আমি আর এইসব ঝামেলা, দুশ্চিন্তা নিতে পারবো না। বল তো কী করলে ভালো হয়?
– কেন? কিসের চিন্তা আপনার?
– এইযে আমার জীবনটা এভাবে তছনছ হয়ে যাচ্ছে…
– গেছে বলেন। সব ঠিক হয়ে যাবে। ওগুলো ছিলো দুর্ভাগ্য! এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করলে কি ভালো কিছু হয়ে যাবে? এসব দুশ্চিন্তা প্রশমন করার জন্য আপনার শুভ চিন্তা করা উচিত ভাই।
– আমার পক্ষে আর শুভ চিন্তা করা সম্ভব না। আমার জন্য এখন আগে একটা সিদ্ধান্তে যাওয়া জরুরি। সিদ্ধান্তে গেলেই শুভ চিন্তার সময় হবে।
– মানে? বুঝিনি কিছু।
আব্বু খানিক হতাশাগ্রস্থ হয়েই বললো,
– দেখ, অনু তো এরকম করলোই, সব ছেড়ে চলে গেলো, একটা বার ও ভাবলো না আমাদের তিনটা মানুষের কথা… তারপর বড় মেয়েটা… সেও সেইম কাজ করলো। শুধু তাই নয়। প্ল্যান করে এসে আমাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, মেয়ে আমাকে ধোঁকা দিতে পর্যন্ত দ্বিধাবোধ করেনি।
– তো? এগুলা নিয়ে পড়ে থাকলে কি জীবন চলবে? এগুলো ভুলে যান না।
– হ্যাঁ। ভুলতে চাই। তাইজন্যই তোর সাথে পরামর্শ করতে আসছি।
– হুম। কিন্তু আপন থাকলে ভালো হতো। তিনজন মিলে একটা সিদ্ধান্তে যাওয়া যেত।
– আপন নাই দেখেই কথাটা তুলছি। ও থাকলে এই কথা তোলা যেত না। কারণ আমি জানি ও আমার কথায় কিছুতেই সায় দিবেনা। ভীষণ একঘেয়ে ছেলে।
খালা এবার কিছুটা নড়েচড়ে বসে প্রশ্ন নিক্ষেপ করলো ,
– কী এমন কথা??
আব্বু গম্ভীর গলায় বললো, রাকাকে নিয়ে।
খালা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
– রাকাকে নিয়ে! কী করছে রাকা?
– নাহ্। কিছুই করেনাই। তবে করবে না যে, তার গ্যারান্টি কে দিবে?
– ভাই! কি বলতেছেন এসব! আচ্ছা, আপনি কী বলতে চাইতেছেন আসলে? খোলাখুলি বলেন তো!
– রিমা, তুই তো সম্পর্কে ওর ফুফি হস, যদিও অনুর মন গলানোর জন্য ওদের ছোট থেকেই খালামণি বলা শিখিয়েছিস। তুই তোর ভাইঝিটাকে একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে দিস তো…
খালা স্তম্ভিত গলায় বললো,
– হ্যাঁ, অনু আপা তো আমাকে সহ্যই করতে পারে নি কোনোদিন। কখনোই সে আমাকে ভালো চোখে দেখতে পারেনি। তবে আমি তাকে বোনের আসনেই বসিয়েছিলাম,আপনারা সবাই তো জানতেন? আমার তো আর একটাও বোন নেই। তাই আপনার মেয়ে দুইটাকে খালামণি বলা শিখায়েছিলাম। যাতে আপা একটু হলেও বোঝে, আমার মনে সে যেমন ভাবে তেমন কোনো ময়লা নাই। ভাই আপনি তো জানেন, তানিশা আর রাকা যে আমার কলিজার টুকরা? কথায় আছে,মায়ের চেয়ে মাসির আদর বেশি। তাই ওদের খালা ডাক শিখিয়েছিলাম। এ নিয়েও তো আপা কত কান্ড করলো,আহা,মনে নাই ভাই? তানিশার জন্মদিনে,আমার আনা চারা গাছে সে গরম পানি ঢেলে দিয়ে পর্যন্ত রাগ মিটাইছিলো।
একটু থেমে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
– আমাকে সরাসরি একবার ফোন করে বলেও দিয়েছিলো, “রিমা, তুমি যে কত বাজে বেহায়া একটা মেয়ে তা আমার জানা আছে, এখন আবার আমার বোন সাজছো ঢং করে? আমার মেয়েদের খালা বলা শিখাও তুমি, হ্যাঁ? ভাবছো বুঝিনা কিছু? পরে একদিন সুযোগ বুঝে আমার সব নিজের করে নেওয়ার ধান্ধা?”
সেদিনের পরে আর আসিনাই আপনার বাসায়। আপনিও যোগাযোগ করেন নি, একবার জানতেও চান নি যে কেন রিমা হঠাৎ করে বাসায় আসা বন্ধ করে দিলো…
আব্বু সামান্য হেসে বললো,
– ছাড়্ তো এসব। এগুলা সব আমার ভুল। আর মনে করাইস না এসব। অনু তো সবসময়ই এমন। প্রতিহিংসাপরায়ণ, ঈর্ষায় ভরপুর। এটাতো সবাই ই জানিস তোরা। ও এরকম করতো বলেই তো ভাবতাম, ও বুঝি শুধু আমাকেই ভালোবাসে, সেজন্যই হয়তো আমার পাশে অন্য কাউকেই সে সহ্য করতে পারেনা। আমিও এজন্য সবাইকে এড়িয়ে চলতাম,চলার সর্বাত্মক চেষ্টা করতাম,, যাতে অনু কষ্ট না পায়! আর দেখ! ফলাফল কি হলো! হাহ্ হা! সেই অনু এখন অন্য সংসারে,অন্যের বউ,অন্যের বাচ্চার মা!!
খালা ঠোঁট কামড়ে বললেন,
– আচ্ছা বাদ দিন আপার কথা। যার যা মতি সে তেমন গতিই করবে। মন খারাপ করে লাভ নাই। এখন বলেন, রাকাকে কি বুঝিয়ে বলতে হবে? আপনিই তো বলতে পারেন! আর আমি তো সবই বুঝিয়ে বলি ওকে। বলা শেষ_ই বলতে গেলে। আপনার এই মেয়ে তো লক্ষী। সব বলার আগেই বুঝে ফেলে।
আবু ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,
– নাহ্। আমি মনে হয়না কিছু বলতে বা বোঝাতে পারবো ওকে। আমার বুক ফেঁটে যাবে, সম্ভবত হার্ট এট্যাক করবো, এই মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেলে।
রিমা খালা বিষম খেয়ে বললেন,
– মানে! রাকা আপনাকে ছেড়ে যাবে কেন? ও আচ্ছা! ধুর! রাকা আপনাকে ছেড়ে যাইতে যাইতে এখনো অনেক দেরী আছে! কি যে বলেন! মেয়ে কি এখনি বিয়ে দিয়ে দিবেন নাকি?? বাচ্চা মেয়ে। ক্লাস সেভেনে উঠছে সবেমাত্র। এখনি বিয়ে দিয়ে দিলে তো পুলিশে ধরবে।
আব্বু ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করে বললো,
– না। বিয়ে তো এখন আমি দিবো না। তাছাড়া আমার তো বিয়ে দেওয়া লাগেনা। তারা নিজেরা নিজেরাই করে নেয়। দেখলিই তো,ওর মাও করছে, ওর বোন ও করছে। কেউ আমারে জিজ্ঞেস করছে? করেনাই!
– আপনি এইসব কথা বার বার তুলতেছেন কেন?
আব্বু অশান্ত গলায় বললো,
– রাকার ভালোর জন্য। ওর বড় বোন, তানিশা নষ্ট করে ফেলছে নিজের জীবন। শুধুমাত্র আমার গাফিলতির জন্য। আমিও তো মহিলা মানুষ না যে সারাদিন বাসায় বসে থাকবো, মেয়েদের এটা ওটা শেখাবো বা ওদের দেখাশোনা করবো। যদি আমি সময় দিতে পারতাম তাহলে হয়তো এতটা বিপথে যেতে পারতো না মেয়েটা। ও তো পুরাই বখে গেছে। বাপকে সে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে গেছে। ধোঁকা দিয়েছে নিজের বাপকে। ওদের জন্য তো আমি এখন সারাদিন বাসায় ও বসে থাকতে পারি না। আবার বিয়েও করা সম্ভব না।
খালা শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
– তা,আপনি রাকার ভালোর জন্য কি করতে চান ওর সাথে? ওকে বিদেশ পাঠায়ে দিবেন নাকি হোস্টেলে?
আব্বু খালার দিকে দৃষ্টি নিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ওকে ওর মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিবো।
খালা এই কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো।
আর আমার মাথায় যেন ভেঙে পড়লো বাজ।
খালা জিজ্ঞেস করলো,
– কেন?? আপনি কি মরে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন নাকি? মেয়েকে ওখানে পাঠাতে চান কেন?
আব্বু নিচের দিকে তাকিয়ে করুন হাসি হেসে বললো,
– মরে যেতে পারলে তো দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি খুশি আমিই হতাম, রিমা। আমি মরবো কিনা জানিনা,তবে অনেক দূরে চলে যাওয়ার চিন্তাভাবনা আছে। এখানে এভাবে পড়ে থাকলে এমনিতেও আমি বাঁঁচবো না।
খালা কম্পমান গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– অনেক দূর বলতে? কোথায়? কোথায় যাবেন আপনি?
আব্বু নিরুত্তর। খালার ইচ্ছা করছে গলা ফাটিয়ে বলতে, ” আপনি একাই শান্তির খোঁজে চলে যাবেন? আমাকে সাথে নিবেন না? আমিও তো মরে যাবো,এখানে পড়ে থাকলে। আমার মাথার উপরের ছাদটুকুও যে আজ আর নেই! ”
এদিকে আব্বুর ভাষ্য শুনে আমার সারা শরীর থর থর করে কাঁপতে আরম্ভ করলো।
আমাকে অনু চৌধুরীর কাছে পাঠিয়ে দিবে আব্বু? মানে ওই আজমল উদ্দীনের বাসায়?
(চলবে)
Farzana Trina.