পরী পর্বঃ৯ম
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা
.
এক দৌড়ে সায়েম বাড়ি চলে এলো। বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে সায়েমের মা রাগ চোখে সায়েমের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, সারারাত কি বাড়িতে নাটক চলবে! কোথায় গিয়েছিলি তুই? এক দিকে জ্বীন ভূত আসছে আরেকদিকে বৌমা অসুস্থ!
মায়ের কথায় সায়েম প্রত্যাশার দিকে তাকালো। প্রত্যাশা ডাইনিং টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে কপালে এক হাত দিয়ে রয়েছে। সায়েম এগিয়ে গিয়ে প্রত্যাশাকে কোলে নিয়ে ঘরে চলে গেল। সবাইকে সেদিকে হা হয়ে চেয়ে থাকে।
.
প্রত্যাশা বিছানায় বসে আছে। সায়েমের দিকে তাকিয়ে বললো, কোথায় গিয়েছিলে তুমি?
সায়েম প্রত্যাশার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে, আমি কি বাবা হচ্ছি!
সায়েমের কথা শুনে প্রত্যাশা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। ছোট দুটো ছানাবড়া হয়ে গেছে প্রত্যাশার। সায়েম আবার ফিসফিসিয়ে বললো, কি গো কিছু বলছো না কেন!
লজ্জা পেয়ে প্রত্যাশা সায়েমের বুকে মুখ লুকায়। সায়েম প্রত্যাশাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর কপালে ভালোবাসার চুমু এঁকে দেয়।
.
সকাল হতে না হতেই প্রত্যাশার মা হওয়ার বিষয়টা নিশ্চিত করে বাড়িতে মিষ্টির বন্যা বইতে লাগলো। আশপাশের লোকজন এবং আত্মীয় স্বজনেরা এসে প্রত্যাশাকে দেখে যাচ্ছে। সায়েম অনেক খুশি। গত কয়েকদিনের ঘটনায় সায়েমের চেহারাটা মলিন ছিল। বাবা হওয়ার আনন্দে আজ সায়েম সব কিছু ভূলে গেল।
.
কাল রাতের ঘটনার জন্য বাড়ির সদস্যরা চিন্তিত এবং ভীত হয়ে আছে। সবাই সচোখে রুমের মধ্য জিনিসপত্র ভাংচুর হতে দেখেছে৷ সায়েমের ওপর জ্বীন পরীর আছরটা ছাড়াতে হবে। তাহলে এই খুশির পরিবেশটা আরও ভালো ভাবে উপভোগ করা যাবে। বাড়িতে একজন নতুন সদস্য আসতে চলেছে। তাই সায়েমের বাবা লোকজনের পরামর্শে একজন ওঝাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এলেন। মাথার চুল গুলো তার বড় বড় এবং জট পাকানো। গায়ে বিশাল জোড়াতালি দেওয়া একটা ডিলাডালা কাপড় পরা। কাধে একটা পুটলীও আছে। বাড়ির ভিতরে এসে আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে দেখিতে উনি একা একাই ফুঁ…. ফুঁ…. ফুসসস..ট্রো..ট্রো… ফুঁ ফুঁ উচ্চারণ করছেন। সবাই উনাকে ফুঁ বাবা বলেই ডাকে।
.
ওঝাকে দেখে সায়েম একটু ক্ষেপে গেল।
– একে কেন বাড়ির ভিতর নিয়ে এসেছো!
বাড়িতে থাকা সায়েমের চাচি বলে উঠলেন, তোর ভালোর জন্যই এসেছে বাবা। জ্বীন পরীর আছরটা ছাড়াতে হবে তো।
ফুঁ বাবা এখানো একা একাই তার হাতে থাকা লাঠিটা ধরে, ফুঁ…..ফুঁ…. ফুসসসস…..ট্রোওও…. উচ্চারণ করেই যাচ্ছেন।
সায়েমের মা বললেন, হ্যাঁ বাবা, এখন একটু বস তো উনার সামনে।
বাড়িতে থাকা সকলেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুঁ বাবার অদ্ভুত সব আচরণ গুলো দেখছে। প্রত্যাশা সায়েমের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সায়েমের বাবা সায়েমকে বেলকুনির মেঝেতে বসতে বললেন।
.
ফুঁ বাবা তার পুটলী থেকে মাটির একটা পাত্র বের করে সেটাতে আগুন দিয়ে ধোঁয়ার সৃষ্টি করলেন আর মুখ থেকে অদ্ভুত সব উচ্চারণ বের করছেন। আশেপাশের মানুষ জন এসেও উনাকে দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছে। তার থেকেও সবার এখন কৌতুহল এখানে এখন কি ঘটতে চলেছে। সায়েমের বাবা উনাকে ডেকে এনেছেন বলে প্রত্যাশা উনাকে মুখের ওপর কিছু বলতেও পারছে না।
.
সায়েম ফুঁ বাবার সামনে বসে আছে। ফুঁ বাবা বিভিন্ন অদ্ভুত সব উচ্চারণ করেই যাচ্ছেন। সায়েমের চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তের ছাপ।
ফুঁ বাবা এবার মেঝেতে একটা ঝাটার বারি দিয়ে বলে উঠলেন, ফুঁ…. ফুঁ…. ফুসসস……!
তারপর সায়েমের গায়ের ওপর একটা ফুঁ দিয়ে আবার বললেন,বল এমন চান্দের লাগান পোলারে ক্যান ধরসস! বল!!
এটা বলেই উনি সায়েমের গায়ের ওপর আরেকটা ফুঁ দিলেন।
আশেপাশের সবাই কৌতুহল নিয়ে উনার কান্ডকারখানা দেখছে। এক পর্যায়ে উনি মাটির পাত্রটা হাতে নিয়ে সায়েমের দিকে ধোঁয়া দেওয়া শুরু করলে সায়েম কাশতে শুরু করে। উনি মাটির পাত্রে ফুঁ দিয়ে দিয়ে ধোঁয়ার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করছেন৷ সায়েম কাশতে কাশতে বলে উঠল, উফফ..কি হচ্ছে!
সায়েমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যাশারও চোখে মুখে ধোঁয়া এসে লাগছে। সায়েম হাত দিয়ে মুখের সামনে থেকে ধোঁয়াগুলো সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কেউ বুঝতে পারছে না উনি আসলে কি করতে চাচ্ছেন। মাটির পাত্রে ফুঁ দিয়ে দিয়ে উনি পুরো জায়গাটাই ধোঁয়াময় করে ফেললেন। অতিরিক্ত ধোঁয়ায় ওখানে উপস্থিত সবারই কাশি উঠে গেছে।
ধোঁয়ায় সায়েমের বাবা অসুস্থ হয়ে গেছেন। উনাকে ধরে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফুঁ বাবা মাটির পাত্রে ফুঁ দিয়ে দিয়ে ধোঁয়ার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করছেন। হঠাৎ করেই সেখানে পুলিশের আগমন ঘটলো। ধোঁয়ার মধ্যে থেকেই ওরা ফুঁ বাবাকে ধরে বাহিরে নিয়ে গেলো। কোথা থেকে কি হলো ঘটনা জানার জন্য সকলেই পিছে পিছে বাহিরে চলে আসলো। পুলিশদের একজন বলে উঠল, এই ভন্ডটাকে আমরা হাতেনাতে ধরতে চেয়েছিলাম। ধন্যবাদ আপনাদের। ফোন করে আমাদের জানানোর জন্য।
সায়েম মাথা ঝারা দিয়ে তারপর বললো, আপনাদের কাছে আবার কে ফোন করলো!
– অরি নামের একজন ফোন করে জানিয়েছেন আর এই ঠিকানা দেয়েছেন।
এই কথা শুনে সায়েম আর প্রত্যাশা দুইজনই আটকে গেল। পুলিশ ফুঁ বাবার ঘারে হাত দিয়ে বলতে থাকে, হাট চল! তোর লোক ঠকানো ভন্ডামি আজ বের করছি! চল!
বলেই লাঠি দিয়ে পিছনে বারি দিতে দিতে ফুঁ বাবাকে ধরে নিয়ে গেল।
.
সময়ের সাথে সাথে বেড়ে উঠছে প্রত্যাশার ভিতরে থাকা নতুন প্রাণটি। সায়েম বাড়িতে থেকেই প্রত্যাশার অনেক যত্ন নেয়। এক মুহুর্তও চোখের আড়াল করে না। কিন্তু আজ সায়েমকে বাহিরে যেতে হচ্ছে। এই শহর ছেড়ে অন্য একটি শহরে। একটি চিঠি এসেছে ওই ঠিকানাতেই যেতে হবে। সেখানে সায়েমের নতুন চাকুরী হবার কথা৷ যাবার সময় সায়েম বার বার প্রত্যাশার দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলো। প্রত্যাশা মায়াবি দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থেকে সায়েমের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থেকে হাত নাড়িয়ে বিদায় দিচ্ছে। কেন যেন প্রত্যাশাকে ছেড়ে যেতে একদমই মন চাইছে না সায়েমের।
.
চলবে…..