টক্সিক_রিলেশনশীপ,২৪,২৫

0
1152

টক্সিক_রিলেশনশীপ,২৪,২৫
-ঈপ্সিতা শিকদার
২৪
পাগল প্রায় হয়ে ফ্লাট থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক ছুটতে লাগে নায়িম। বাসন্তী জ্ঞান হারিয়েছে বহু আগেই। হুট করেই নিচতলার সিঁড়ির নিচ থেকে কারো মৃদু আর্তনাদের শব্দ শুনতে পায় সে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সে৷

মাথা ঝুঁকিয়ে উঁকি দিতেই দমবন্ধ অনুভূতি হয় তার। রক্তাক্ত মুখশ্রীর অনিমেষের গায়ে গা এলিয়ে চোখ বুজে আছে চৈতালি। চৈতালির কোলের মাঝে রক্ত লাল দেহ নিয়ে শায়িত আছে ছোট্ট নাহিবা।

“নাহিবা? আমার প্রিন্সেস?” বড় বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে নায়িম।

নায়িমের কণ্ঠ শুনে অদম্য আনন্দ নিয়ে চোখ তুলে তাকায়। বুক চিড়ে তপ্ত এক শ্বাস বেড়িয়ে আসে, কিছুটা দুঃখ সমাপ্তির আনন্দের, কিছুটা বিষাদের। তারপর জ্ঞানহীন চৈতালিকে নিয়ে কোনোরকম বাহিরে আসে সে।

নায়িম তখনো স্তব্ধ। রক্তাক্ত নাহিবার দর্শনে যে তার হৃদয়ে বিষক্রিয়া হচ্ছে। ধীর কণ্ঠে তাকে ডেকে উঠে অনিমেষ,

“নায়িম, নাহিবাকে কোলে নে! চৈতালিকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে।”

“আমার নাহিবা আর নেই তাই না?” কেমন যেন ঘোর লাগা গলায় বলে উঠে নায়িম। দুঃখের ঘোরই হয়তো।

“কী বলছিস এসব? আমাদের নাহিবা একদম ঠিক আছে। এত কথা বাদ দে, হাসপাতালে যেতে হবে।”

হুট করে মরুভূমির উত্তপ্ত রোদ্রে মৃত গোলাপটির মাঝে সতেজতা ফিরে এলে যেমন বোধ হয় তেমনই বোধ হলো নায়িমের। সে যেন সকল সক্ষমতা, বোধশক্তি ফিরে পেল। তাড়াতাড়ি নাহিবাকে কোলে তুলে নেয়। অনিমেষকে ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে যেয়ে বসায়। তার কোলে নাহিবাকে দিয়ে আবার চৈতালিকে নিয়ে আসে। তারপর আবার ফ্ল্যাটে ফিরত যায় বাসন্তীকে নিতে।

একা একটা মানুষকে সামাল দিতে হচ্ছে তিনজনকে। সাহায্য করার কেউ নেই। একেই বলে অসহায়ত্ব।

হাসপাতালে নেওয়ার সাথে সাথেই চৈতালিকে এডমিট করা হয়। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষয়ে তার অবস্থা শোচনীয়। বাসন্তী সুস্থ আছে, তবুও তাকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। অনিমেষের তেমন বড় ক্ষতি নাহলেও মাথায় দুটো সেঁলাই পড়েছে।

নায়িম অনিমেষের পাশে বসে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“এসব কী করে হলো? আর নাহিবার গায়ে যদি কোনো ক্ষতই না হয়, এত রক্ত…?”

“চৈতালির রক্ত। মেয়েটা তোর মেয়েকে বাঁচাতে নিজের জীবনে কুরবানি দিয়ে দিচ্ছিল।

তোরা যাওয়ার পর আমরাও ক্লিনিকে যাই বাবুকে টিকে দিতে। কিন্তু এসে দেখি সদর দরজা খোলা ফ্ল্যাটের। ভাবি হয়তো তোরা এসেছিস। কিন্তু ঢুকতেই দেখতে পাই একঝাঁক অজানা গুন্ডা টাইপের লোক। ভীতিগ্রস্ত হই৷ পালাতে চাই তার আগেই চার জন আমাকে ধরে ফেলে। একজন হকি স্টিক হাতে তোর মেয়ের দিকে এগুতে থাকে। চৈতালি ভয়ে স্থবির হয়ে গিয়েছিল।

চৈতালি নাহিবাকে নিজের কোলে আড়াল করে নিজে সেই আঘাত সয়। আবারও মারতে গেলে সেই আঘাতও ওর মাথায় পড়ে। আমাকে মারধর করে। অনেক কষ্টে পালাই ওদের নিয়ে। সুযোগ বুঝে দুজনকে ল্যাং মেরে ফেলে, বাকিদের ধাক্কা দিয়ে পালাই আমরা। কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিল না। কারণ গাড়ির চাবিও ঘরে। সিঁড়ির নিচেই লুকাই আমরা। ভাগ্যের জোরে আজ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলাম মনে হচ্ছে।”

নায়িমের মনে আরেক ভাবনার ঝড়। যেই মেয়েটাকে সে অপবিত্র নর্দমার কীট ভাবে, সেই মেয়ে-ই নিজের জীবনের পরোয়া না করে তার মেয়েকে বাঁচাল! নিজ মনেই এক দ্বন্দের সৃষ্টি হলো তার পবিত্রতা সম্পর্কিত আচ্ছনতা থেকে।

“স্ট্রেঞ্জ! এত কিছু হলো এপার্টমেন্টের একটা মানুষও এগিয়ে এল না।”

কথাটা বলেই কাউকে কল লাগায় নায়িম। কিছুক্ষণের কথোপকথনের পর তার মুখশ্রীতে কঠোর এক ভাব প্রতিফলিত হয়।

“কী হয়েছে?” প্রশ্নবোধক চাহনি অনিমেষের।

“আমাদের এপার্টমেন্ট আর এর দু’পাশের এপার্টমেন্টের প্রতিটি ফ্ল্যাটে না কি আজ কেউ একজন এসে ধানমণ্ডির পাশেই হওয়া চলমান কনসার্টের টিকেট দিয়ে গেছে ফ্রীতে, তাও হিসেব ছাড়া। এই সব সাদিকের কাজ!

সে-ই এগুলো প্ল্যানিং করে করেছে। আজ শুক্রবার, সবারই ছুটি, তার উপর পাশেই কনসার্ট; সুতরাং সবার যাওয়া নিশ্চিত। সব ভেবে-চিন্তেই এই প্ল্যান করেছে সে। ঐ কু** বাচ্চাকে তো আমি ছাড়ব না, এটা আমার ওয়াদা!”

___

নায়িম বাসন্তীর কেবিনে বসে। মাত্রই বাসন্তীর জ্ঞান ফিরেছে। মেয়েকে সুস্থ দেখে তার আনন্দ তো সীমানা ছাড়িয়ে গেল। হাজার খাণেক চুমু খেল কোমল তকে। নায়িমের কেন যেন ঈর্ষা বোধ হল। ভাবল,

– মায়েদের মমতার টান যদি এতটাই হয়৷ তবে গ
তার মা কি মা ছিল না?

ঠিক তখনই একঝাঁক রিপোর্টার নায়িমের লোকদের ঠেলে চেষ্টা করল কেবিনের দরজা খুলে প্রবেশ করার। ডাকাডাকি, চেঁচামেচি তো করেই যাচ্ছে। কিন্তু কথা হলো তারা জানল কীভাবে নায়িম এই হাসপাতালে। ঠিক তখনই মনে পড়ল, সে কোনোরকম ছদ্মবেশ ছাড়াই হাসপাতলে ঢুকেছে।

নায়িম না যাওয়া অবধি এরা শান্ত হবে না, সে তা জানে। বাসন্তীকে ওড়না নিতে ইশারা করে দরজা খুলে সামনে দাঁড়াল সে। কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই নানা সাংবাদিক নানা ধরনের প্রশ্ন করতে লাগল। যদিও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বিষয়বস্তু একটাই।

কিন্তু একটি প্রশ্ন শুনেই তেঁতে উঠল বাসন্তী। তা হলো-

“এত বছর নিজের বিয়েকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখলেন কেন? মেয়েদের মন পেতে ও তাদের পাত্তা পেতেই কি এই ব্যবস্থা?”

“এই ব্যাডা! কী বললি তুই আমার জামাইকে?” তার বিষাক্ত কণ্ঠ শুনতেই সকল ক্যামেরা নায়িমকে ছেড়ে তার উপর ফোকাসে করল।

“আমার স্বামীর এত মাইয়া লাগে না, হ্যাঁ? বাংলাদেশের কত মেয়ে নায়িমের পাত্তা পেতে চায়। কিন্তু ও কখনো এই আমাকে ছাড়া কোনো মেয়ের দিকে সেই দৃষ্টিতে তাকায় না। সেটা আমি ওর স্ত্রী বাসন্তী কোন কাঠগড়ায় বলবেন, সেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলতে রাজি।

হ্যাঁ, ও আপনাদের থেকে, দর্শকদের থেকে আমাদের কথা লুকিয়েছে। কিন্তু তার কারণ আপনারা নিজের সম্মুখেই দেখতে পাচ্ছেন। এই বিষয়টা জানাজানি হতেই আমার মেয়ের জীবনে কথা এসেছে। আমরা হাসপাতালে। ঐ যে আমার বোন, নায়িমের প্রিয় বন্ধু অনিমেষ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে এসেছে।

না জেনে আমার স্বামীর উপর কোনো কালিমা লাগাবেন না। আপনারা নায়িমকে ভালোবাসা দিয়েছেন, এই জায়গায় পৌঁছিয়েছেন, আপনাদের অধিকার আছে জানার। কিন্তু তাই বলে এসব আমি সহ্য করতে পারব না!”

নায়িম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে বাসন্তীকে। যেই মেয়েটা কারো সামনে কথা বলতে অবধি দ্বিধাবোধ করে, নিজের পক্ষও কোনোদিন ঠিকঠাক রাখতে পারে না, সেই মানুষটি তার জন্য এতগুলো অচেনা লোকের সামনে আওয়াজ তুলল। আবার, মেয়েটা তো চাইলেও পারত তার করা অত্যাচারের কথা ফাঁস করতে। তাও করেনি। এতটা ভালোও বুঝি বাসা যায়?

আজকের ঘটনাগুলো নায়িমকে খুব করে ভাবাচ্ছে। খুব করে! তার চিন্তাধারাকে, মানসিকতা রীতিমত লণ্ডভণ্ড করে ফেলছে।

“স্যার, ম্যাম যে বলছে তা কি সত্য? কে আপনাদের শত্রু যাদের জন্য আপনারা হাসপাতালে?”

“হ-হ্যাঁ?” ভাবনার সুতো কাটে নায়িমের। নিজেকে সামলে শুধায়,

“দেখুন, এখন আমার পরিবারের অবস্থাই শোচনীয়। ইন্টারভিউয়ের মন-মানসিকতা নেই। খুব শিঘ্রই আমি একটা কনফারেন্স ডাকব, সেখানেই বিস্তারিত জানবেন। এখন আপনারা হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট না করে, চলে যাবেন। এর কারণে অন্যান্য রোগীদেরও সমস্যা হচ্ছে।”

সাংবাদিকগণ বিদায় হতেই নায়িমের ফোন বেজে উঠে। সেই খবরের লিংক পাঠানো প্রাইভেট নাম্বারটিই। ক্রূর হেসে কল রিসিভ করে সে।

“কেমন লাগল মামার কামাল ভাগিনা?”

“শিয়াল কূটনা শুধু আড়াল থেকেই একটু-আধটু ক্ষতি করেই ভাবে সে জিতে গেছে। অথচ, সিংহ সামনের থেকে আক্রমণ করে বাঁচার সুযোগ অবধি দেয় না। এটাই রাজা আর হারামির মধ্যে পার্থক্য। ঠিক যেমনটা আমি খান সম্রাজ্যের সম্রাট ও আপনি হারামি চাকরের মধ্যে পার্থক্য।”

তেঁতে উঠেন সাদিক মিয়া।
“ভাগিনা, বেশি বাড় বাইড়ো না। তুমি যেই ইস্কুলে মাত্র ঢুকসো, আমি তার শিক্ষক।”

“আরে শকুনি মামা মাত্র ঢুকলে কী হয়েছে? পুরো স্কুল আর গোদিটাই তো আমার। কাউন্ট করা শুরু করে দেন। আপনার ধ্বংস অতি নিকটে।”

কথাটুকু বলেই কল ডিসকানেক্ট করে দেয় সে। বাসন্তী তখনো বেডে বসে রাগে ফুঁসছে।

বাঙালি নারীর এক অবিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তারা নিজে স্বামীকে ধুঁয়ে ফেলেও অন্যকারো মুখ থেকে তার বিরুদ্ধে একটা কথাও সহ্য করতে পারে না।

বাসন্তীও নিশ্চয়ই এর ব্যতিক্রম নয়। নায়িমের মুখে কেন যেন আলতো হাসি ফুটে ইঠে। কাঁধে স্পর্শ পায় কারো। তাকিয়ে দেখে অনিমেষ।

“তোর মেয়ের গায়ে আঘাত লেগেছে ভেবে তোর দমবন্ধ হয়ে আসছিল, তাই না রে? তাহলে এটা কী করে ভুলে যাস তোর স্ত্রী বাসন্তীও কারো মেয়ে? এমন কী পৃথিবীর প্রতিটি মেয়েই কারো না কারো রাজকন্যা! মেয়েটা কিন্তু কত কিছুই করতে পারত তোর বিরুদ্ধে এখন। কিন্তু দেখ তোকে ভালোবেসে দিব্যি তোর দোষ লুকিয়ে গুন গেয়ে গেছে।”

পরদিন, চৈতালি অনেকটাই সুস্থ। জ্ঞান ফিরেছে ঘণ্টা খাণেক আগে। খবর তাকে দেখতে ছুটে এসেছে সবাই। বাসন্তী তার হাত জোড়া ধরে দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে কেঁদে ফেলে।

“তোমাকে কোন ভাষায় যে ধন্যবাদ দিব জানা নেই। আমার মেয়ের জীবন তুমি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁচিয়েছো। এতটা পরের জন্য কে করে আজকাল!”

“পর বোলো না বাসন্তী। নাহিবা তোমায় মাতৃত্বের স্বাদ দিলে, আমায় আভাস দিয়েছে৷ সেই শিশুকে আমি বাঁচাব না। ধন্যবাদ দিয়ে আমার অনুভূতিগুলোকে ছোট করবে না প্লিজ।”

বেশ কষ্ট হলেও এতগুলো কথা বলেই দম ফেলল চৈতালি। নায়িমের কাছে এই কথাগুলো শুনা বিস্ময় বৈকি কিছুই নয়।

এদিকে চৈতালির মনে চলছে অন্য পরিকল্পনা। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগ মুহূর্তে সে যাকে স্মরণ করেছে, সে হলো তার জীবনের প্রথম পুরুষ ফাহিম। সে বোধ করেছে প্রিয় মানুষকে আর কোনোদিন দেখতে পারবে না, এই ভাবনাটি কত ভয়ংকর। তার ছুটে চলে যাতে মন হচ্ছে ঐ অতি সামান্য পয়সার অধিকারী পুরুষটির। অথচ, একসময় এই পুরুষটিকেই দূর দূর করে জীবন থেকে বের করে দিয়েছিল সে।

এই নিষিদ্ধ আবেদনটি করেই ফেলল সে সকলের সামনে। নায়িম পূরণ না করে পারল না। জার্নি করা চৈতালির জন্য একটু কষ্টসাধ্য বা অনুচিত হলেও তাকে গাড়ি করে নিয়ে গেল ফাহিমের ভর্তি হওয়া হাসপাতাল।

ফাহিমকে দেখে কম্পিত দেহ নিয়েই তাকে দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরল চৈতালি।

“আমাকে ক্ষমা করো প্রিয়। আবারো জায়গা দাও না তোমার বুকের নিরাপদ স্থানে?”

এতটা কষ্ট পাওয়ার পর কী ক্ষমা সম্ভব! ফাহিম করবে তো তাকে ক্ষমা? ক্ষমা আর ভালোবাসা উভয়ই যে মুখে বললেই হয় না। মনকে মানতে হয়।

নায়িমের চিন্তাধারাও কি পরিবর্তন হবে এবার? কারণ ডিজঅর্ডারের তো চিকিৎসা হয়, কিন্তু চিন্তাধারা ও মানসিকতায় ত্রুটি এর সংশোধন হয় শুধু নিজ বোধ থেকেই।

চলবে…

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||২৫তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নিজেকে চৈতালির থেকে ছাড়িয়ে নেয় ফাহিম। তার চোখে-মুখে ক্ষোভের আবরণ, সাথে কিছুটা অস্পষ্ট বেদনা। ব্যাঙ্গাত্মক সুরে হেসে বলে,

“এখন কেন এসেছো আমার কাছে ফিরে? নিশ্চয়ই কারো থেকে খবর পেয়েছো আমার প্রমোশন হয়েছে। এখন আর আমি সামান্য ব্যাংক কর্মচারী নই, বরং ব্যাংকের জিএম। আমার মাইনে এখন সত্তর হাজার, কোম্পানির গাড়ি, ফ্ল্যাট সবই আমার আছে।

তোমার লোভটা আর গেল না, তাই না? একদিন মৌমাছির মতো অর্থ নামক মধুর খোঁজে একদিন এই পুরুষের কাছে, তো একদিন ঐ পুরুষের কাছে যাও। মানুষ হয়েও সাপের চেয়েও বেইমান তুমি চৈতালি!”

বিরতিহীন ভাবে অসুস্থ শরীরে এতগুলো কথা বলে হাঁপিয়ে উঠেছে ফাহিম। সেদিনের মেয়েটিও কেবিনে উপস্থিত সাহস দেওয়ার ভঙ্গিমায় কাঁধে হাত রাখে তার। কিছুটা শান্ত হয় ফাহিম।

চৈতালি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় ফাহিমের দিকে। ছেলেটা যে এতগুলো মানুষের সম্মুখে তাকে এসব বলতে পারে এমনটা চিন্তাও করেনি সে। শব্দ করে কেঁদে উঠে সে। তার ভাবনা হলো

– সে ভুল করেছে সত্যিই। কিন্তু অনুতপ্তও তো হয়েছে আজ, ভুল স্বীকার করছে। তবুও কেন ফাহিম মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বা মিথ্যে অভিযোগে অভিযুক্ত করছে তাকে? ফাহিম না তাকে ভালোবাসে, তবে কেন বাহু মেলে আবদ্ধ করে নিচ্ছে না তাকে? কেন-ই বা এই মেয়েটা তার সাথে এতটা অধিকার বোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে?

তার নিজের ভাবনার বোঝাপড়া শেষ হতেই উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“বিশ্বাস করো ফাহিম আমি কোনো লোভে পড়ে আসিনি। এমন কী আমি জানতামও না তুমি প্রমোশন পেয়েছো। আমি তো ক্ষমা চাচ্ছি, তবুও কেন ক্ষমা করছো না আমায়? আর এই মেয়েটা কে? ও এখানে কেন?”

“হাউ সিলি! তোমাকে বিশ্বাস করতে বলছো? তোমাকে? যে মানুষটা আমাকে ছেড়ে হুট করেই নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল, এতটা সময়ে আমি কোথায় বা কেমন আছি যার বিন্দুমাত্র আগ্রহ হয়নি, আমার অসহায় চেহারা আর বিধ্বস্ত কণ্ঠে যার মায়া জাগেনি, আমার মান-সম্মানের যেয়ে পরোয়া করেনি তাকে আমি বিশ্বাস করব? এও এখন সম্ভব। বাহ্!

আর কী বললে এই মেয়েটা কে? এই মেয়েটা সীমা। সেই স্টুডেন্ট লাইফ থেকে আমাকে ভালোবাসে। অথচ, কখনো ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা তো চায়-ই নাই, আজ অবধি বিয়েও করেনি। আমার দুঃসময়ে এই মেয়েটা নিজের চাকরি হারিয়েও আমার পাশে থেকেছে। প্রতিমুহূর্ত আমাকে অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে।

আমার মা বিছানায়, তার খেয়াল রাখা লাগে আমার অফিস আছে। আপুও রোজ রোজ আসতে পারে না। কখনো ভেবেছো বা ভেবেছিলে আমি এত সবকিছু কী করে একা হাতে সামলাই? না, তা ভাবোনি। তোমার তো টাকা জোগাড়ের চিন্তা করে, আরেকজনের স্বামীর টাকায় আরাম করেই সময় পাও না। এখন তুমিই বলো, আমার কাকে জীবনে রাখা উচিত? তোমাকে না কি এই মেয়েটিকে?”

“প্লিজ ফাহিম…” মাঝপথেই ফাহিমের হাতের ইশারায় থেমে যায় তার কথা।

“তোমাকে বিশ্বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব না। বিশ্বাস হলো আয়নার মতো একবার ভাঙলে জোড়া লাগানো যায় না।”

চৈতালি চাপা কান্নার সাথে অসুস্থ দেহ নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিয়ে পড়ে যেতে নেয়। বাসন্তী যেয়ে তাকে ধরে সামলে নেয়। নায়িম ও অনিমেষও বিরস মুখে সেখান থেকে প্রস্থান করতে অগ্রসর হয়।

মানুষ কখনো অন্যকে অন্যের অবস্থান থেকে বিচার করে না। বরং, নিজের অবস্থান থেকে অন্যের অবস্থান যতটুকু দেখা যায়, ততটুকুতেই বিচার করে।

চৈতালির সাথেও তেমনটাই হয়েছে। তার অবস্থান থেকে সে অনুতপ্ত, ক্ষমার যোগ্যও হয়তো। তবে ফাহিমের অবস্থান থেকে সে চৈতালিকে যা দেখে তা হলো সে সুযোগসন্ধানী ও অর্থলোভী।

___

বাসন্তী, নায়িম ও চৈতালি বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। ধানমন্ডির এপার্টমেন্টে নয়, গুলশানের ডুপ্লেক্স বাসাতেই এখন থেকে থাকবে তারা। নায়িম পেশাদার বডিগার্ড সহ নিজের লোকদের আনিয়েছে নিরাপত্তার জন্য। অনিমেষও অনিমেষের মা-বাবাকে নিয়ে এখানেই আসছে থাকতে সাদিল মিয়াকে ধরা অবধি।

প্রায় রাত,
সবাই যার যার ঘরে। নায়িম ডিভানে আদশোয়া হয়ে ল্যাপটপে কী যেন করছো, কানে তার এয়ার বার্ডস্, কারো সাথে কথাতেও ব্যস্ত। বাসন্তী ভেজা কাপড় দিয়ে নাহিবার গা মুছিয়ে দিচ্ছে।

হুট করেই বাসন্তী খেয়াল করে নায়িম এয়ার বার্ডস্ খুলে রেখে মাথায় হাত দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিমায় বসে আছে। বাসন্তী নাহিবাকে বিছানার মাঝ বরাবর বালিশ দিয়ে ঘেরাও করে শুয়িয়ে স্বামীর কাছে যায়।

আলতো হাতে জড়িয়ে কপোলে চুমু খেয়ে চোখে চোখ রেখে বলে,

“ভালোবাসি প্রিয়তম। আমার ভালোবাসায় সিক্ত করে দুশ্চিন্তাগুলো দূর করতে চাই তোমার। সেই সুযোগ দিবে কি একবার?”

নায়িম নির্নিমেষ দৃষ্টিতে নিজের বসন্তকুমারীকে দেখে। ধীর গতিতে মুখশ্রীটা এগিয়ে নেয় রমণীর দিকে। তাদের রোমান্টিকতায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে একজন কান্নার অদম্য আওয়াজে পরিবেশ ভারী করতে শুরু করে।

ছুটে যেয়ে নায়িম কোলে তুলে নেয় মেয়েকে। এমন একটা ভাব মেয়ে তার ব্যথা পেয়েছে। আর বাবা কোলে নিতেই মেয়েও একদম শান্ত শিশু। একটু ঈর্ষাই অনুভব করে বাসন্তী, তবে এ ঈর্ষা বহু সুখের ঈর্ষা। যা একজন স্ত্রী বনাম মা-ই অনুভব করতে পারবে।

“আলালের দুলালি যেন একদম!” হেসে বিদ্রূপাত্মক সুরে বিড়বিড়ায় বাসন্তী।

নাহিবাকে পায়ে শুয়িয়ে দোল দিতে দিতে ফোনে ফেসবুকে স্ক্রল করতে শুরু করে। আর যা দেখতে পায় তাতে মাথায় দরদর করে আগুন জ্বলে উঠে।

অধিকাংশ তরুণ ও উঠতি বয়সই ছেলেরা বাসন্তীর নায়িমকে সাপোর্ট করার ক্লিপটি পোস্ট করছে আর হৃদয় জ্বালানো সব ক্যাপশন লিখেছে, লিখছে। এই যেমন একজন লিখেছে আমার ক্রাশ, তো আরেকজন লিখেছে এমন বউ চাই, আবার কেউ লিখেছে আমার হবু বউ।

নায়িম রাগান্বিত হয়ে আপন মনেই বিড়বিড়াচ্ছে,

“এই মেয়েটাকে কে বলেছিল এতসব কথা বলতে ক্যামেরার সামনে? যত্তসব আজাইরা এটেনশন পাওয়ার ফন্দী!”

___

কেটে গেছে প্রায় কয়েকদিন। আজ নায়িম প্রেস কনফারেন্স ডাকিয়েছে। বাসন্তী, নায়িম ও অনিমেষ সেখানে বসে। কালো বোরখা পরা বাসন্তীকে দেখে সবার চোখ জুড়িয়ে যায় সম্মানে৷ সকল সাংবাদিক তাকে একে একে প্রশ্নবিদ্ধ করতে শুরু করে তাকে।

“আমি আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। একটু অপেক্ষা করুন।”

তার কথা শেষ হতেই অজানা একজন প্রবেশ করে সভাই। যাকে দেখে থমকে যায় সকলে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here