টক্সিক_রিলেশনশীপ,৩৪,৩৫
-ঈপ্সিতা শিকদার
৩৪
বাসন্তী সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেতে বসেছে। সাহেরা বেগম তাকে নাস্তা দিয়ে টিভি নাহিবাকে নিয়ে টিভি খবর দেখতে বসেছেন। তাঁর বেশি সাউন্ডে টিভি দেখার স্বভাব। বাসন্তী ডাইনিং টেবিলে বসেও সব শুনতে পাচ্ছে। হুট করেই যা শুনতে পায় তাতে বুক ধ্বক করে উঠে তার।
খাবার রেখেই বড় বড় পা ফেলে বসার ঘরে উপস্থিত হয় সে। টিভিতে তখনো নিউসটি চলমান।
“ব্রেকিং নিউজ! ব্রেকিং নিউজ! সুখী দম্পতি বাসন্তী-নায়িমের সম্পর্কে ফাটল, আলাদা থাকছেন তারা। তবে কি ভাঙতে চলেছে তাদের সম্পর্ক?”
বাসন্তী ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। সাহেরা বানু আড়চোখে বাসন্তীর দিকে তাকান। সান্ত্বনার সুরে বলেন,
“চিন্তা কোরো না বউমা। সব ঠিক হইয়া যাইবো।”
বাসন্তী প্রতিত্যুরে কিছু বলল না। গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখশ্রীতে কী একটা ভেবেই দ্রুতো পদচারণায় নিজ কামরায় চলে গেল।
যাওয়ার আগে সাহেরা বানুর উদ্দেশ্যে বলল,
“মনি, আকরাম কাকুকে বলবেন সবাইকে বলে দিতে আজ আমি আসবো না কোনো কাজে। ঘরেই থাকব। তাই বলে আমার অনুপস্থিতিতে যাতে কাজে কোনো গাফলতি নাহয়। আর আপনি কষ্ট করে নাহিবাকে খায়িয়ে-পড়িয়ে দিবেন।”
ঘরে এসে কোনোদিকে না তাকিয়েই দরজা বন্ধ করে দিল সে। সারা ঘরময় পায়চারি করে ক্লান্ত হয়ে বসলো। রমণী নিশ্চিত আজ তার দরবারে প্রণয়ের আগমন হবে। মানুষটা আসবেই আসবে আজ নিজ স্বার্থ হাসিল করতে। আনমনেই বিড়বিড়ালো,
“তুমি আসবে তোমার দাম্ভিকতা চূর্ণবিচূর্ণ হবে আমার চোখের সম্মুখের। তোমার প্রিয় জিনিসটি যে হারানোর পথে। তুমি হাত পাতবে আমার সামনে, আমি প্রতিশোধ পাবো। তবে তা কী শান্তি দিবে আমায়? পৈশাচিক শান্তি?”
ফোঁস বোধক শব্দ করে তপ্ত বায়ু বের হলো তার দেহ থেকে। সাথে বের হলো কিছুটা আশঙ্কা, হতাশা, কামনা।
“জানি না শান্তি পাব কি না। তবে তোমায় দেখতে হবে আজ এসে, তোমায় ছাড়াও তোমার বসন্তকুমারী অনেকটা ভালো আছে। অনেকটা! আজ আমি সাজবো। মনের মতোন সাজবো! তোমার নয়ন দুটোতে ভাসাতে হবে না আমার ভালো থাকার চিত্র!”
নিজের সাথে বোঝা-পড়ার শেষে আলমারিটা খুলে বাসন্তী। সবচেয়ে মনোরম দেখতে শাড়িটি বের করে গায়ে ধরে বড় আয়নাটিতে নিজের প্রতিবিম্বকে পর্যবেক্ষণ করে সে। বাসন্তী রঙের জামদানি শাড়ি সোনালি সুতোর কাজ করা। এই শাড়িটা গায়ে জড়াতেই যেন বাসন্তীর উজ্জ্বল শ্যামা গাটা চাঁদের মতোন চকচক করছে।
বাসন্তী সেই শাড়িই সুন্দর করে আটপৌরে পরে। দু’হাত ভর্তি বাসন্তী রঙা কাচের চুড়ি, কানে স্বর্ণের বড়ো ঝুমকো, গলায় চিকুন একটা চেইন, পায়ে স্বর্ণের পায়েল।। চুলগুলো বেশ কমনীয়তার সাথে আঁচড়িয়ে বাঁকা সিঁথি করে ফেলে রাখে। হৃদয় লোভানো বাঁকা চুলগুলো ছেয়ে রাখে পিঠ।
সাজের সাথে খুব একটা সখ্যতা গড়েনি বাসন্তীর ছোটো থেকেই। সে আশ্রিতা মানুষ একটু সকলের ব্যবহার শেষে পরিত্যাক্ত স্নো-পাউডার তার কপালে জুটলেই ঢেরাসই। তবে আজ রমণী সাজতেও বসেছে। মুখশ্রীতে লাগাচ্ছে বিবি ক্রিম, দামী কম্পেক্ট পাউডার ও ব্লাশ। মৃদু গোলাপি অধর রাঙিয়ে নিয়েছে কালচে লাল লিপস্টিকে। সবকিছু শেষে ভাসা ভাসা চোখজোড়াকে হরিণীর ন্যায় টানাটানা করার প্রচেষ্টায় যত্ন করে কাজল লাগাতে ভুল করে না।
নমনীয়তা, যত্নের সাথে অত্যন্ত পরিশ্রম দিয়ে নিজেকে সাজানোর পর শুধু কয়েকমুহূর্ত নিজের প্রতিবিম্বকে দেখেই যায় রমণী। মুখে আজ সেই কোমল স্নিগ্ধতা নেই, আজে আছে সূর্যের তেজ। কাউকে জ্বালানো-পোড়ানোর আকাঙ্ক্ষা।
___
ফাহিম গতকাল সারাটা রাত্রি ভেবেছে পূর্ণতাকে নিয়ে। নিজের ভাবনা বদলে ফেলেছে সে। তার মনে হয়েছে সে যেমন সীমার যোগ্য ছিল না, তেমন পূর্ণতারও যোগ্য নয়। মেয়েটা সুন্দরী, যুবতী, অবিবাহিত। সে তার চেয়েও আরও ভালো কাউকে পাওয়ার অধিকার রাখে। তার চেয়েও বড় কথা গতকাল রাতে চৈতালির স্মৃতিকথা তাকে পুড়িয়েছে।
গোটা রাত নির্ঘুম কাটানোয় ভোরের দিকে চোখ লেগে গেছে ফাহিমের। হুট করেই সে আভাস পায় তার মুখশ্রীতে বিন্দু বিন্দু পানিরছিটে পড়ছে।
তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ হালকা মেলে দেখতে পায় একজন শাড়ি পরা রমণী তার দিকে ঝুঁকে আছে। শাড়িটি আর কারো নয়, চৈতালির, যা সে কাল সারারাত জড়িয়ে ছিল। রমণীর মুখশ্রীর অনেকটাই ঢেকে আছে অর্ধসিক্ত চুলে, আর চুলের পানিই তার মুখে পড়েছে হয়তো।
তন্দ্রাবেশে ফাহিম ভাবে, চৈতালিই এসেছে। জড়িয়ে ধরে মেয়েটিকে। মেয়েটিও আপন মায়ায় আবদ্ধ করে নেয় তাকে। সাথে সাথেই চমকে উঠে চোখ খুলে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে।
প্রেয়সীর স্পর্শ চিনে না, এমন প্রেমিক হয়তো দুনিয়াতে নেই।
ফাহিমও তার ব্যতিক্রম নয়। ছোঁয়ার সাথেই বুঝতে পেরেই এই দেহ তার অপরিচিত, ভীষণ রকমের অপরিচিত। চোখ ভালোভাবে খুলেই দেখতে পায়। এটা পূর্ণতা, চৈতালি নয়।
“সরি, আমি আসলে বুঝতে পারিনি।”
পূর্ণতার নত দৃষ্টি। চেহারা লজ্জায় আচ্ছন্ন। মুখে মুচকি হাসি। সে বলল,
“না বুঝতে পেরেই বোধহয় ভালো করেছো।”
“সরি?”
“কিছু না। ঐ যে চা এনেছি, পান করো। তোমার পছন্দের লুচি, আলুর দম করেছি। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে চলে আসো।”
উঠে চলে যেতে নেয় পূর্ণতা। ফাহিম ডাক দেয়,
“পূর্ণ?”
“হ্যাঁ, বলো।”
“এই শাড়ি কোথায় পেলে তুমি? এই শাড়ি তো…”
“চৈতালির, তাই তো? সে যেহেতু আগলে রাখেনি তার জিনিসপত্র, অন্যকেউ নিলে ক্ষতি কী? তাছাড়া তোমার বেডে রাখা ছিল আমি পরে নিয়েছি।”
“আর তুমি এত সকাল সকাল আমার ঘরে ঢুকলে কী করে? আজ তো ফজর নামাজ পরতেও আমি উঠিনি, দরজাও খুলিনি।”
“আমি তো প্রতিদিন ফজরের এক-দু ঘণ্টা আগেই তোমার ঘরে আসি। নাহলে তোমার কি মনে হয় কারো অযত্নে ফেলে যাওয়া নেতিয়ে পড়া ফুলগুলো একা একাই প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠেছে?”
“হোয়াট! বাট কীভাবে?”
“আন্টির থেকে স্পেয়ার কি নিয়েছি বহু আগেই। আচ্ছা, শুনেন জনাব চুলোয় তেল বসিয়ে এসেছি। বহু কাজ আমার, আপনার ইনভেস্টিগেশন অংশগ্রহণ করার সময় আমার নেই। সংসার সামলাতে হয়।”
বলে সে মৃদু হেসে বেরিয়ে গেল। ফাহিম গোলগোল চোখে রমণীর যাওয়া দেখলো। পূর্ণতার ধাঁধাময় কথাবার্তা, তার চাল-চলন দিনদিন আরও যেন অদ্ভুৎ হয়ে উঠছে।
___
নায়িম আপেলে এক কামড় বসাতেই অনিমেষ এসে ত্রাসিত মুখে বলে,
“দোস্ত তুই নিউস দেখেছিস? কীসব আজগুবি কথাবার্তা লিখছে তোকে আর ভাবীকে নিয়ে!”
“হুম, দেখেছি।” খাপছাড়া ভাব নিয়ে জবাব দেয় নায়িম।
“তো চল ভাবীর কাছে। তোর ইমেজ তো একদম ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে সাংবাদিকরা। এমন হলে তুই তো আর…”
“কী হবে খুব বেশি হলে? আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আর মিউজিক ক্যারিয়ার ধুলোয় মিশে যাবে? ইট’স ওকে। যখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিলাম তখন এগুলোর জন্য বাঁচতে মন চায়নি।
বাঁচতে মন চেয়েছে প্রেয়সীর সাথে বার্ধক্য দেখতে। বসন্তকে আর একবার হলেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরতো। এই সম্পত্তি, ক্ষমতা আমায় টানেনি তখন টেনেছে সম্পর্ক, ভালোবাসার মায়া। এগুলো ধ্বংসে হলে হোক, আমি হলেও হলাম, আমার ধ্বংসেই নাহয় বসন্ত প্রাচুর্য পাক।”
গাম্ভীর্যপূর্ণ গলায় কথাগুলো বলে শব্দ করে এক শ্বাস ফেল নায়িম। সেই উষ্ণ নিঃশ্বাসে কিছু একটা ছিল যা অনিমেষকেও নিশ্চুপ করে দেয়। গভীর আকুতি, অপ্রকাশিত ভালোবাসা ও বেদনা, আরও কী কী যেন।
“এতোই যখন ভালোবাসিস। যাস না কেন ভাবীর দোয়ারে? মানাস না কেন তাকে?”
“জানিস আমি যখন মরবো ভেবে ফেলেছি। তখন আরও একটা বিষয় আমাকে পোড়াচ্ছিল, আমি মরলে আমার বসন্ত আর নাহিবাকে আগলে রাখবে কে? নাহিবা তো ছোট্ট, আর বসন্ত হলো অবুঝ চড়ুই পাখির মতোন।
আমার চারধারে শত্রু। ভদ্র সমাজ, আঁধার সমাজ দুই জায়গাতেই ক্ষমতাধর হওয়ায় আমি সবার চোখের কাটা। কখন মরি ঠিক নেই। এই মুহূর্ত বেঁচে আছি, পরমুহূর্তেই মরে যেতে পারি। আমার মৃত্যু নিশ্চিত হলে বসন্ত-নাহিবাকে থেকে সব ছিনিয়ে নিতে ভুল করবে না তারা।
বসন্তকে তাই আমি ছাড়াই নিজের নাম কামাতে হবে, শক্ত পাহাড়ের ন্যায় হতে হবে। যাকে টক্কর দেওয়ার সাহসও কারো হবে না। এর সূচনা হয়েই গিয়েছে। বসন্ত নিজের এনজিও খুলেছে, কারখানা খুলেছে, শহরে একটা শোরুমও খুলেছে।
আমার বিশ্বাস আমার প্রেয়সীর আলাদা নাম তৈরি হতে দেরি নেই। তারপর মরলেও শান্তি। মনে সাহস থাকবে আমার স্ত্রী-সন্তান ভেসে যাবে না বন্যার জলে।”
কথাগুলো বলার সময় অনুভূতিহীন নায়িমেরও কেন যেন গলা কেঁপে উঠে? প্রিয়জনের মায়া বুঝি এতই ভয়ংকর! কে জানে? নিজের আবেগ লুকাতে গম্ভীর মুখে তাড়াতাড়ি অনিমেষ থেকে দূরে চলে যায় নায়িম। আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ তার কর্ম নয়।
অনিমেষ ম্লান হেসে বন্ধুর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে। বিড়বিড়ায়,
“তুই সত্যিই অদ্ভুৎ নায়িম। বড়োই অদ্ভুৎ। কীসের এত কৃপণতা তোর ভালোবাসা প্রকাশে? একজন নারী যে অধীর অপেক্ষায় থাকে তোর একটু ভালোবাসা বোধ করতে, তা কেন তুই বুঝিস না?”
___
সন্ধ্যা পেড়িয়ে গভীর রাত নেমেছে, নিঝুম রাত! কী নিথর রাত! না আছে কোনো কোলাহল, না কোনো ভীড়, না কোনো আলো-ছায়ার খেলা।
এত শান্তির মাঝেও বাসন্তী মনে শান্তি নেই। আছে রাশি রাশি উত্তেজনা, অবিরাম অস্থিরতা। কারণ নায়িম যে আসেনি। তবে একজন এসেছে খান বাড়ি থেকে। সে হলো চৈতালি।
বাসন্তী ভেবেছিল চৈতালিকে হয়তো নায়িমই পাঠিয়েছে নিজের কথা মানাতে। কিন্তু পরে জানলো চৈতালি কাউকে না বলেই এসে পড়েছে। এমন কী সে বাসন্তী-নায়িম সম্পর্কিত ছাপানো খবরের বিষয়ও প্রথম জেনেছে বাসন্তীর মুখ থেকেই।
বর্তমানে আশাহত বাসন্তী। ভাবলো,
– নায়িমের জীবনে আগে যা একটু মূল্য ছিল, কিন্তু এখন কি একটুও মূল্য নেই তার? যুবক কেন তার সামনে আসলো না ক্ষমার আবেদন নিয়ে? সে কেন চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পারল না? কেন তাকে জানাতে পারলো না যে সে তাকে ছাড়াই ভালো আছে?
রাতের আঁধার বাড়তেই বাসন্তী সব হিসাব-নিকাশের অবসান ঘটালো। নিজেকে বুঝাতে মনে মনেই বলল,
“আজ সুযোগ আসেনি তো কী হয়েছে? কোনো দিন তো সামনে আসবে। তখন বুঝিয়ে দিব আমি বেশ।আছি তাকে ছাড়াই।”
তখনই কাঁধে হাত রাখলো কেউ। চমকে উঠে পিছনে ঘুরলো বাসন্তী। চৈতালি মুচকি হাসির সহিত দাঁড়িয়ে আছে।
“কেমন আছো?”
“এই তো আছি। দেখতেই তো পাচ্ছে, সাজগজ, অলঙ্কার, কাজ-কারবার সবকিছু নিয়ে খারাপ নেই তো।”
“সত্যিই তো। ভালোবাসা ছাড়া ভালো থাকা যায়?”
বাসন্তী মুখশ্রীতে অমলিন চওড়া এক হাসি এঁকে নিয়ে বলল,
“প্রেম, ভালোবাসার বাহিরেও অনেক কিছু আছে জীবনে, পৃথিবীতে। ভালোবাসাময় জীবন হয়তো একটু কাঁটাময় মাধুর্যপূর্ণ, কিন্তু প্রেমহীন জীবনটা বিরস হলেও মন্দ নয়।”
চলবে…
#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৩৫তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
দেখতে দেখতে আরও এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। নায়িম একবারও আসেনি বাসন্তীর দোয়ারে। তবে এসেছে চৈতালি, অনিমেষ বহুবার।
বাসন্তী প্রায় ভুলেই বসেছে নায়িমের অপেক্ষা। সে তার মতো নিজের কাজে ডুবে থাকে। আজও বাসন্তী নিজের কাজে ব্যস্ত, দোকানের হিসেব নিচ্ছে ম্যানেজার থেকে নিজের শোয়ার ঘরে বসেই।
এমন সময় সাহেরা বানু ছুটে আসেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন,
“এসেছে। তোমার সাথে কথা বলবার চায় বউমা।”
বাসন্তী কপালে বিরক্তির ভাজ পড়ে। আজকাল কাজটাকেই সবকিছুর উর্ধ্বে রাখে বাসন্তী। আইপ্যাডে চোখে রেখেই সে শুধায়,
“এভাবে দৌড়ানোর কী আছে মনি? যে-ই আসুক, বসতে বলো। আমি কাজ শেষ করে আসছি নিচে।”
“দুঃখিত, মিসেস খান। আমি কারো জন্য অপেক্ষা করতে অভ্যস্ত।”
পরিচিত ভার কণ্ঠ শুনে সচকিত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে দাঁড়ায়। নায়িম ফাজ খান দাঁড়িয়ে, অনিমেষনেত্রে তাকে দেখেই যায় বাসন্তী।
“এই ছেলে তুমি কে?”
নায়িমের পুনরায় মুখ খুলায় ঘোর ভাঙে বাসন্তীর। জেদ চেপে যায় মাথায়। এতদিন খোঁজ-খবর নেই, এখন এসেই তার উপর তদারকি কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না সে।
“ও আমার শো-রুমের ম্যানেজার নাহিদ। তাই না নাহিদ?”
“জ-জী ম্যাম।”
নায়িমের বাজপাখির ন্যায় তীক্ষ্ম চাহনিতেই কেঁপে উঠছে সদ্য বাইশের গণ্ডি পেড়ানো ছেলেটি। নায়িম খুবই ক্রোধান্বিত আজ। দাঁতে দাঁত চেপে আদেশ করলো,
“মি. নাহিদ, আপনি আজ বাড়িতে যান। আজ আর কোনো কাজ নেই আপনার।”
যুবক কোনো শব্দ ছাড়াই ঘর ত্যাগ করে।
নায়িম ইশারায় সাহেরা বানুকে চলে যেতে বলে। তিনিও নৈশব্দে দরজা চাপিয়ে চলে যান।
“কাজ হবে অফিসে, ড্রইংরুমে। বেডরুমে কীসের কাজ? ফার্দার যেন এমন না দেখি।”
বাসন্তী ক্ষুব্ধ চোখে তাকায় নায়িমের কথা শুনে। বলে,
“আপনি বলার কে? নিশ্চয়ই আপনার সাথে মিডিয়ার লোকদের কাছে ইন্টারভিউ দেওয়ার আবেদন নিয়ে এসেছেন। আপনার কাছে তো তা-ই সব নিজের জীবনের পর। বাকি সবাই মরুক তাতে কী?”
এই বাক্য যেন অগ্নিবাণ হয় নায়িমের জন্য। দপ করে নিভে তার রাগ।
“মোটেও না। আমি আমার মেয়ে আর স্ত্রীকে দেখতে এসেছি। কোনো ইন্টারভিউ-ফিন্টারভিউয়ের জন্য আসিনি।”
“হাহ্! নায়িম ফাজ খান যে সবকিছুই করে নিজের স্বার্থে বা নিজের ইমেজ আর সম্মানের জন্য, সে না কি কোনো কারণ ছাড়া দেখতে এসেছে! এটাও বিশ্বাস করতে হবে এখন?”
“বিশ্বাস-অবিশ্বাস তোমার বিষয়। আমার অন্তরের কথা একমাত্র আমার আল্লাহ, আর আমিই জানি। যাকগে এখন নাহিবাকে তৈরি করে দাও, নিজেও একটা ভালো সুতি শাড়ি পড়ে তার উপর একটা খিমার পরে নেও ভালো দেখে।”
“কেন?” ভ্রু কুঁচকায় বাসন্তীর।
“আমরা এক জায়গায় যাচ্ছি তাই।”
“না, আমি কোথাও যাবো না। নাহিবা আপনার মেয়ে, মন চাইলে তাকে নিয়ে যান।”
বাসন্তী মুখের উপর না করে দেয় ইচ্ছেকৃত ভাবেই। যুবককে উত্তেজিত করার প্রচেষ্টা আর কী। কিন্তু তাকে অবাক করে নায়িম চেহারাতেও রাগের ভাব আসে না।
বরং, বেশ শান্ত কণ্ঠে বলে,
“নাহিবা আমার মেয়ে, তুমি বুঝি কিছু নও? আমার স্ত্রী তুমি। তুমি নিজে তৈরি হবে না কি তুমি তৈরি করব? অনেকদিন প্র্যাকটিস না থাকলেও, আমি পটু বড়ো এ কাজে। আজও পারব।”
বুক মোচড়ে উঠে বাসন্তীর। গলা শুকিয়েও আসছে বড়ো। প্রেমিকের রাগের উপর প্রতিবাদ করার শক্তি থাকে, তবে অসভ্যতায়…?
প্রেমের অসভ্যতা হেমলকের মতোন, বিষাক্ত হলেও তা আপন মায়ায় বিমোহিত করতে কখনোই যেন ব্যর্থ নয়।
তবুও আজ বাসন্তী বিন্দু পরিমাণও দুর্বল হতে চায় না এই যুবকের সম্মুখে। নিজের অনুভূতির প্রতিটি বিন্দু বিন্দুকে গুটিয়ে নিল সে।
“বাহ্! আজ আপনার মনে পড়লো আমি আপনার স্ত্রী! ক’টা মাস হয়েছে আমি আপনার বাড়ি ত্যাগ করেছি? একবারও তো খোঁজ নিতে আসেননি। যেহেতু ছেড়ে দিয়েছিলেনই, এখনও তেমনেই থাকুন না!”
ভ্রুক্ষেপহীন নায়িম। একটুও বিচলিত হলো না সে। বরং, আগের মতোই গম্ভীর মুখশ্রী এবং শীতল ভঙ্গি তার।
“ছাড় দিয়েছিলাম, ছেড়ে দেইনি। খেয়াল করে দেখো দূরে, তবে আমার সীমানার মাঝেই উড়েছো এতকাল। তোমাকে বলেছি না একদিন, আমার মৃত্যুতেও তুমি আমার ছায়াতল মুক্ত হবে না?
তোমার ভালোর জন্যই তো আসিনি, যাতে নিজের এন.জি.ও, শো-রুম আর কাজে মনযোগ দিতে পারো ঠিক-ঠাক ভাবে। আর দিয়েছোও তো, এক মাসেই তো বেশ ভালো পর্যায়েই তোমার স্টোর।
যাকগে এখন তাড়াতাড়ি তৈরি হও। মাদ্রাসার সবাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আজ নানিমার মৃত্যুবার্ষিকী, বহু কাজ আমার।”
বাসন্তী নানিমায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর বিষয়ে জেনে আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ আলমারি থেকে কাপড়-চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।
___
পূর্ণতাকে বেলে মাছের ঝুড়ি রান্না শিখাচ্ছা ফাহিমের খালা সামিরা। যুবতী নিজ উদ্যোগে শিখছে।
রান্না শেষে পূর্ণতার হাত ধরে বিনীত ভঙ্গিমায় তিনি বলেন,
“মা, তুমিই আমার শেষ বিশ্বাস। আমার ছেলেটা…! আমি নিঃসন্তান, বাবাহারা ফাহিমকে বুকে আগলে পেলেছি আমি আর আমার স্বামী। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর ফাহিমদের সাথেই থাকতাম। কিন্তু চৈতালিকে বিয়ে করে আনার পর খেয়াল করলাম মেয়েটা প্রায়শয়ই ফাহিমের সাথে তর্ক জুড়ে দেয় আমার থাকা নিয়ে। তাই ছেলের মায়া ছেড়ে স্বামীর ভিটেতেই চলে যাই। তাও যদি সুখ হয় ছেলের।
ফাহিম কত আসতে বলেছে, আসিনি আর একবারও। শেষে ফাহিম অনেক কাকুতি-মিনতি করে তার প্রয়োজন বলে। জানায় চৈতালি আর তার না কি ডিভোর্স হচ্ছে, সেও সদ্য সুস্থ হয়েছে এক্সিডেন্ট থেকে। আমি ছুটে আসি। জানি তো আমার ছেলেটা কত ভালোবাসে মেয়েটাকে। ফাহিমের বোন মানে আমার ভাগ্নি থেকে জানতে পারি চৈতালির কুকর্ম। এরপর প্রতিদিন আমার ছেলেটাকে ভাঙতে দেখেছি।
ভাবলাম বিয়ে দিলে ঠিক হবে। কত যে মেয়ে দেখালাম, সে মানলো না। আমার মনে হলো চৈতালিই পারে তাকে সুখ দিতে। ভাবলাম বুবুকে নিয়ে নাহয় আমি আমার বাড়িতে রাখবো। তবুও মেয়েটা ফিরুক, আমার ছেলের সংসার করুক এবার। চৈতালিকে কত বার কল করেছি, নির্দয়া আমার পরিচয় দেওয়া মাত্রই কেটে ব্লক করে দিয়েছে। তুমিই এখন একমাত্র আশ্রয় মা।”
“আন্টি, আপনি যে কী বলেন না! আমার এত বড় কলঙ্কিত অতীত, সত্য জানা মাত্রও আপনি আশ্রয় দিয়েছেন। এ-ই ঋণই তো আমি কোনো কালেই শোধ করতে পারবো না। যেখানে আমার আপন বাবা-মাই আমাকে আমার দ্বিগুণ বয়সী লোকের কাছে টাকার বিনিময়ে… তাদেরও কী দোষ আমার তো বিয়েও হচ্ছিলো না।”
হুহু করে কেঁদে দেয় পূর্ণতা। মধ্যবয়স্ক নারীটি আদরের ছলে চোখজোড়া মুছে দেন।
“কাঁদিস না, যা হয়েছে তাতে তোর দোষ ছিল না। কত মেয়ে-ছেলে যৌবন সামলাতে না পেরে কিংবা টাকার বিপরীতে সতীত্ব বিলিয়ে দেয়। তোকে তো কিছু জানোয়াররা… তুই পবিত্র, তোর কেন হবে পীড়া? অপবিত্র তো ঐ জানোয়ারগুলো। আল্লাহর কাছে চা, নিজে পরিশ্রম দে সব ঠিক থাকলে তোরও ভরা সংসার হবে আমার ফাহিমের সাথে।”
“তা-ই তো চাই। সাক্ষী আমার প্রতিটি ইবাদত। ফাহিম আর আপনারা আমার শেষ আশ্রয়, নাহলে মৃত্যু ছাড়া উপায় নেই। আপনি না বললেও আমি আমার সর্বোচ্চ দিব। কিন্তু আমার সত্য জেনে গেলে উনি যদি ঘৃণা করে আমায়…? উনার ঘৃণা আমি নিতে পারবো না।”
“আমরা সুশিক্ষিত পরিবার পূর্ণ। আমার ছেলেও আমার শিক্ষায় শিক্ষিত। এতোটা ছোটো মন ওর হবে না যে তুমি যেই ভুলে সামান্যতম দোষীই নয়, তার জন্য তোমাকে শাস্তি দিবে। শুধু একবার ওর মনে একটু জায়গা করো তোমাকে রাণীর মতোন রাখবে, যেমনটা রাখতো চৈতালিকে। আফসোস মেয়েটা বুঝলো না।”
ফাহিমের খালা সামিরা রহমানের মুখে তৃপ্তির হাসি। তিনি জানেন এই মেয়ে সুখী করবে ফাহিমকে। কারণ যে নিজে অতোটা যন্ত্রণা পেড়িয়েছে, এতটা অপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে গিয়েছে, সে আর যাই হোক আগত সুযোগ আগলে রাখতে ভুল করবে না না।
সামিহা রহমানের পূর্ণতাকে দেখার পর থেকেই কেমন চেনা চেনা লাগছিল। পরিচিত এক মেয়ের সাথে যেন সাদৃশ্য পাচ্ছিলো। পরে মনের ভুল ভেবে নেয়। কিন্তু তিনদিনের মাথায় রাতে পানি পান করতে উঠলে পূর্ণতার তাহাজ্জুদের নামাজে করা আকুতি শুনে জানতে পারেন তাঁর ভ্রান্তিই সঠিক।
তিনি শুনতে পান পূর্ণতা মোনাজাতে আল্লাহর কাছে আবেদন করছে,
“আল্লাহ আমার উপয় সদয় হও। কী এমন গুনাহ করেছি আমি আল্লাহ, যার জন্য আমার সাথেই এমন হলো! ঐ পশুটা আমাকে সারাটা রাত ঘুবলে খেয়েছে, অথচ মানুষের চোখে দোষী আমি। জীবনে কোনোদিন পর্দা ছাড়া বের হইনি। গায়রে মারহামের সাথে কথা অবধি বলিনি, তবুও আমি চরিত্রহীন। আমার পরিবারের কাছেও। কেন? কেন?
পৃথিবী ঘৃণ্য চোখ থেকে বাঁচতে চার দেওয়ালের মাঝে বন্দী হয়েছে আজ থেকে দুই বছর আগেই। কিন্তু তাতে কী আর আপন মানুষদের কটাক্ষ থেকে বাঁচা যায়? পরের দেওয়া কষ্ট, লাঞ্ছনা মানা যায়, তবে আপন মানুষের…! আমারও তো স্বামী-সংসারের আকাঙ্ক্ষা আল্লাহ, তবে আমাকে কেন এত অযোগ্য করা হলো এসবের। কেন আজ আমি আমার পরিবারের কাছে খদ্দরের কাছে বিক্রি করার এক পণ্য হয়ে গিয়েছি?”
তিনি নিশ্চিত হন এই মেয়ে আসলে তাদের এলাকার হামিদ ব্যাপারীর মেয়ে। যাকে প্রায় দু থেকে তিন বছর আগে এলাকারই এক কুখ্যাত গুণ্ডা মাদ্রাসা থেকে আসার পথে অপহরণ করে ধর্ষণ করে তার বাসার সামনে ফেলে রেখে যায়। এই ঘটনার পর মেয়েটিকে আর কোনোদিন বাড়ি থেকে বের হতে দেখতে পাওয়া যায়নি। বহুদিন না দেখাতেই চিনতে একটু সন্দেহ হচ্ছিলো সামিরা রহমানের।
পরে সামনে এসেই পূর্ণতাকে তিনি জিজ্ঞেসাবাদ করেন। জানতে পারেন কেন পূর্ণতা বাড়ি থেকে পালিয়েছে। আর কতটা প্রয়োজন তার এই আশ্রয়। সব শুনে আর ঘাটেন না বিষয়টা তিনি। হুট করেই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফাহিম ও পূর্ণতার বন্ধুসুলভ সম্পর্ক। আশার প্রদীপ জ্বলে তাঁর হৃদয়ে, যদি এবার একটা গতি হয় একমাত্র পুত্রের। তারপর থেকেই তার প্রতিটি কর্ম, দোয়ার অন্তরালে শুধু পূর্ণতা ও ফাহিমের মিলনের আকাঙ্ক্ষা।
এদিকে পূর্ণতার আগে থেকেই কিছুটা সম্মানজনক অনুভূতি জন্মে ছিল ফাহিমের প্রতি। চৈতালির ব্যাপারে শুনে সহানুভূতি ও নিজের চাওয়া পূরণের তীব্র ইচ্ছে জন্ম নেয়। এ যেন উভয়পক্ষের কাছে স্বর্ণসুযোগ, যা কেউই হাত ছাড়া করতে ইচ্ছুক নয়।
___
বাসন্তী বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শীতল বায়ু অনুভব করছে। আপন ধ্যানে মগ্ন রমণী। নায়িম তার বেডরুমে মেয়ের সাথে খেলছে। বাসন্তী ভেবেছিল তাদের মাদ্রাসা থেকে মোস্তফা বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে নায়িম নিজ বাড়ি ফিরবে, কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। বরং, সে নিজেও ঢুকেছে এই বাড়িতে। সেই যে ঢুকেছে আর বের হয়নি।
“কেমন আছো?”
“যেমন রেখেছিলেন তার চেয়ে অনেক ভালোই। তবে ভালোতে আদৌ ভালো আছি কি না তা জানা নেই।”
“অভিমান প্রচুর আমার উপর?”
“অভিমান তো ভালোবাসার মানুষের উপর থাকে।”
“তবে ভালোবাসা বুঝি ফুঁড়িয়ে গেছে তিক্ততায়, বিষে? ভুলে গেছো?”
“ভালোবাসা কখনোই ফুঁড়িয়ে যায় না। তবে ভালোবাসায় যখন অতিরিক্ত তিক্ততায় প্রলেপযুক্ত হয়ে পড়ে, তখন তা আর বয়ে বেড়ানো যায় না।
তাছাড়া যে আমাকে ভালোবাসেইনি কখনো, যাকে সর্বক্ষণই আমি ভুল ভেবেছি, ভুল চিনেছি; তাকে আবার কী করে ভুলবো?”
“যদি আজ বলি ভালোবাসি?
“গায়ক সাহেব অভিনয়টা এবারও বড্ড অকৃত্রিম। তবুও আজ মন গলেনি।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল নায়িম। গম্ভীর গলা কেঁপে কেঁপে উঠলো যেন।
“ক্ষমা চাইবো না, আমার চোখেই আমি তা পাওয়ার যোগ্যতা রাখি না। শুধু এটুকু বলবো অসুস্থতা আর বিরহ আমাকে তোমায় ভালোবাসতে শিখিয়েছে বসন্ত।”
বেরিয়ে গেল সে। বাসন্তীর ধ্যানভঙ্গ হলো। তার কাছে মনে হলো পুরো ঘটনাটিই এক স্বপ্ন মাত্র। তবুও মন আনচান করছে তার। দ্রুতো বাহিরে যেয়ে সারা ঘর দেখলো। নাহিবা ঘুমিয়ে আছে, তবে নায়িমের অস্তিত্ব যেন বিলীন হয়ে গিয়েছে।
নিচে নামে সে। সায়রা বানুকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানান নায়িম বেরিয়ে গিয়েছে কয়েক মিনিট আগেই। হনহন করে নিজের ঘরে চলে আসে সে। অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে বাসন্তীর চোখজোড়া।
পরক্ষণেই রিনরিনে গলায় বলল,
“যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। নাহলে কি আর মনটাকে এত খুলে রাখতে পারতাম তার সামনে? নাহলে রাগে, নাহলে আবেগে অনুভূতিগুলো চাপা পড়তোই।”
চলবে…