টক্সিক রিলেশনশীপ,শেষ পর্ব

0
2366

টক্সিক রিলেশনশীপ,শেষ পর্ব
-ঈপ্সিতা শিকদার

দেখতে দেখতে দশটা বসন্ত কেটে গিয়েছে, নাহিবা আজ পূর্ণাঙ্গ কিশোরী। এয়ারপোর্টে অপেক্ষারত নায়িম, বাসন্তী, নাহিবা, বিহান ও নীতি অনিমেষের উদ্দেশ্যে।

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দেখা মিলে অনিমেষের। সাথে ত্রিশ উর্ধ্ব বছরের একজন ভিনদেশী নারী ও জাম্পার পরনে এক চার-পাঁচ বছরের শিশু। কৃষ্ণাঙ্গ তার গায়ের রঙ, পরনে ডাস্কি পিংক জাম্পস্যুট। এই নারীটির নাম জানে সকলেই। অনিমেষের স্ত্রী ভিয়োনা ও একমাত্র ছেলে অর্নব।

অনিমেষকে দেখেই দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরে নায়িম। বিহান ও নীতি “চাচ্চু”, “চাচ্চু” বলে জড়িয়ে ধরে। ভিয়োনিকা বাসন্তীকে অবাক করে সুদীর্ঘ সালাম দেয়।

“আসসালামু আলাইকুম আপু। হাউ আ’ইউ?”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি ঠিক আছি।”

“আপনারা কেমন আছেন? আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?”

“নো, নো, খোনো অহসুভিদাহ্ হয়নি।”

বাসন্তী আরেকদফা ধাক্কা খায় ভিয়োনিকার বাংলা বলা শুনে। যদিও বাংলা বলার ধরনটা খুবই হাস্যকর ছিল। তবে বলেছে যে এ-ই বা কম কীসের? আরও কিছু কথাবার্তা চলে বাসন্তী ও ভিয়োনিকার মাঝে।

এদিকে অনিমেষ নায়িমকে খোঁচা দিয়ে বলে,
“‘আমাকে তো সারাজীবন বলে আসলি, দুটি সন্তানের বেশি নয় একটি হলে ভালো হয়’। আর নিজে তো তিন তিনটে নিয়ে বসে আছিস।”

“আল্লাহর দান বন্ধু সব। আমি তো ভেবেছিলাম বসন্তের মান বুঝি কখনোই ভাঙাতে পারবো না। এভাবেই জীবন যাবে।”

“এজন্যই তো আমি আইডিয়া দিয়েছিলাম। নাহিবাকে দিয়ে ওসব বলা তাহলেই তোকে ভাবী নিজেই ডাকবে। তুমি তো নাহলে সাধু সেজে বসে থাকতে চেয়েছিলে। আরে চোখের সামনে থাকলে আবার রাগ ধরে রাখা যায়। এজন্যই তো জ্ঞানীগুণীরা বলে গেছে, কায়া দেখলে মায়া বাড়ে।”

“হ্যাঁ, ভাই তুই-ই মহান বুদ্ধিজীবী। ঠিকই তো বিয়ে করে নিলে তলে তলে ভিয়োনা ভাবীকে।”

“ভিনদেশে নিঃসঙ্গ রাতে কাঁধে মাথা রাখতেও তো কাউকে চাই। মেয়েটাও আমার মতো বাপ-মা হারা ইমিগ্রেন্ট। একদম নিঃসঙ্গ, ডিপ্রেশনে ক্লাবে ক্লাবে মদের নেশায় ধুত হয়ে থাকতো। তাই ভাবলাম চার হাত এক করে নেই। আর আলহামদুলিল্লাহ্, সুখেই আছি।”

“পূর্ণতার কী অবস্থা?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিমেষ।
“দুই বছর হলো স্বামী মারা গেছে কার এক্সিডেন্টে। নিজের মেয়ে-ছেলে, চাকরি নিয়েই এখন তার জীবন।”

বাসন্তী খেঁকিয়ে উঠে তাদের কথার মাঝে,
“তোমার কি এখানেই সব কথা শেষ করবে না কি? বাড়ি যাবে না?”

নায়িম ভীতু দাসের ন্যায় মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায়। অনিমেষের মুখে দুষ্টু হাসি খেলা করে।

___

আজ নাহিবার জন্মদিন। বিশাল আয়োজন হয়েছে মোস্তফা বাড়িতে। হ্যাঁ, নায়িম আজও মোস্তফা বাড়িতেই থাকে। বাসন্তীর কাজ ও সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েই।

বাসন্তী মেয়ের বার্থডে উপলক্ষে বাসন্তী রঙের কাতান শাড়ি পরেছে। আঁচল গোছাতেই নায়িম বাথরুম একটা তোয়ালে পরে থেকে বের হয়।

স্ত্রীকে দেখেই বিমোহিত হয়ে যায় সে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এগিয়ে যায় বাসন্তীর দিকে। অর্ধভেজা গায়ে জড়িয়ে নেয় নিজের বসন্তকুমারীকে নিজের সাথে। কেঁপে উঠে বাসন্তী। সে কী এক আবেশ প্রেমের!

রিনরিনে কণ্ঠে কপট রাগ নিয়ে বলে,
“তৈরি হবে না? তোমার মেয়ে বিয়ের বয়সের হয়ে গিয়েছে। এসব ভীমরতি তোমাকে মানায় না জনাব?”

“দিল তো বাচ্চা হ্যা জি। তোমায় নিয়ে আমার অনুভূতির তো একটুও বয়স হয়নি বসন্ত। বরং, আগের ন্যায়ই নবজাতক, সতেজ ও মোহনীয়। তোমাকে দেখলে আজও উন্মাদ হয়ে যায় হৃদয়।”

বাসন্তী মৃদু হাসে। তখনই দরজায় লাথি মেরে প্রবেশ করে বিহান ও নীতি। বাসন্তী চমকিত হয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় নায়িমকে।

“মাম্মা, মাম্মা, মাগফিরাত ভাইয়া না আমাদের চকলেট নিয়ে গেছে।”

“মাম্মা, এত্ত করে বকে দিব নে।”

তোমরা এখন পাপার কাছে বসো। পাপা তোমাদের তৈরি করে দেক। আমি ওদিকটা দেখে আসি। নায়িমকে ইশারা করে চলে যায় বাসন্তী।

নায়িম কপাল চাপড়ে শুধায়,
“এক ছিল আমার নাহিবা যে আমাদের এক করেছিল, আর হলি তোরা যারা আমাদের একসঙ্গে দেখতেই পারিস না।”

___

চৈতালি বারবার নিজের শাড়ি ঠিক করছে। ফাহিমকে জিজ্ঞেস করছে ঠিক লাগছে কি না। ফাহিম বেচারা সম্মতি জানাতে জানাতে বিরক্ত। মাগফিরাতও বিরক্ত মায়ের এই আচারণে।

অনিমেষের সাথে সাক্ষাৎ পার্টিতে। চোখাচোখি হতেই লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে অনিমেষ ও চৈতালি উভয়েই।

ফাহিমই নীরবতা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছেন অনিমেষ সাহেব?”

“আলহামদুলিল্লাহ, বেশ। ঐ যে আমার স্ত্রী-সন্তান।” দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ভিয়োনিকা ও অর্নবকে দেখায় সে।

“পূর্ণতার কী অবস্থা?”

“এই তো দুইটা বছর হলো ওর স্বামী মারা গেছে। এমনে চাকরি-বাকরি সবমিলিয়ে ভালোই আছে মেয়েটা বাচ্চা নিয়ে।”

“আহারে মেয়েটা সারাজীবন কষ্টই পেয়ে গেল।” দুঃখপ্রকাশ করলো ফাহিম।

অনিমেষকে কেউ ডাক দেওয়ায়। সে “এক্সকিউজ মি” বলে চলে গেল।

ফাহিম পাশে ঘুরে দেখে চৈতালি রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে। শুকনো ঢোক গিলে সে।

“কী হয়েছে?” হাসার ভঙ্গিমায়।

“বেশ তো মায়া লাগছে ঐ মেয়েটার জন্য। আবার মাঝেমাঝেই বলে উঠে তোমাকে বিয়ে না করে ওকে বিয়ে করলেই ভালো থাকতাম। তো যাও না, বিয়ে করো না যেয়ে মেয়েটাকে?”

ফাহিম আলতো জড়িয়ে ধরে চৈতালিকে।
“আমি কখনো তোমায় ছাড়তে পারি বলো বা তোমায় ছেড়ে থাকতে পারি?”

“কেন আমি তো কত খিটখিট করি, তোমাকে খোঁটা দেই বারবার, তবে?”

“হ্যাঁ, দুঃখবোধ হয় আমার প্রায়শয়ই তোমার আচারণে। তবে রাত্রিতে যখন ঘুমন্ত তোমার মুখশ্রী দেখি না বুকে, আর পাশে দেখি মাগফিরাতকে সব ব্যথার উপশম হয়। আর সবাই তো ভালো নিয়ে সংসার করে আমি নাহয় খারাপ নিয়েই থাকি। আমার কাছে তাই-ই অনেক।”

চৈতালি ফাহিমের বুকে মাথা রাখে। সে ইচ্ছে করে তেমন আচারণ করে না। এত অভাব-অনাটন এবং অনিশ্চয়তা দেখে অশান্ত ও ফ্রাস্টেটেড হয়ে পড়ে তার মন। তখন নিজের নিয়ন্ত্রণে আর থাকতে পারে না সে। যা তা বলে ফেলে। তবে এই মানুষটা বিপরীতে একটা কথাও উচ্চারণ করে না সব সহ্য করে নেয়।

একটু বাদেই নাহিবা তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলো। সবাই মিলে কেক কেটে নিলো। আনন্দে, উৎসবে কেটে গেল দিনটা। এখন সবার নিজ নিজ ঠিকানায় ফিরার পালা। দিনশেষে কেউ পেরেছে নিজের টক্সিক রিলেশনকে শুধরাতে, কেউ বা ব্যর্থ সৈনিক।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here