মাধবীলতা,পর্ব-১

0
2475

মাধবীলতা,পর্ব-১
-ঈপ্সিতা শিকদার

মাধবী নির্নিমেষ দৃষ্টিতে দেখল সায়েমের অতি তাড়ার সহিত তালাকনামাতে সাক্ষর করাটা। যেন সাইন করলেই বাঁচে। আনমনেই হেসে উঠে মাধবী, ছয় বছর আগে বিয়ের সময়ও ঠিক এতটাই তাড়া দেখিয়ে ছিল এই পুরুষটি। সায়েম তার দিকে কাগজটি এগিয়ে দিয়ে সাইন করতে ইশারা করলে সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় কলমটা হাতে নেয়।

সায়েম অবাক। সে তো জানত মেয়েটা আজ ভেঙে গুড়িয়ে যাবে, মাটিতে লুটিকে কাঁদবে সে বিরহের যন্ত্রণায়। কিন্তু সেখানে মাধবি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

হুট করে মাধবী তার চোখে চোখ রেখে বলে উঠে,
“এভাবে তো হবে না শিক্ষক মশাই। কাবিনের সাত লাখ টাকা তো পরিশোধ করুন, তারপর ডিভোর্স নিয়েন।”

অবিশ্বাস্য চাহনি সায়েমের। বিস্ময়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। কম্পিত গলায় বলে উঠে,
“মানে? কী বলতে চাচ্ছো তুমি?”

“ওলেলে এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন প্রিয়তম? আমার আড়ালে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তালাক দিবেন ভেবে রেখেছেন, আর দেনমোহর, কাবিনের টাকা শোধ করার কথা ভাবেননি?” হাস্যোজ্জ্বল মুখে জবাব দেয় মাধবী।

সায়েমের মাথায় যেন বজ্রপাত হয়। ধপ করে বসে পড়ে চেয়ারে। সে ভাবতেই পারেনি সরলমনা মাধবি, এত ধাক্কার মাঝে এসব নিয়ে ভাববে বা নিজের হক বুঝে নেওয়ার মতোন সচেতন হবে। সাত লাখ টাকা একত্রে বিয়ে ভাঙতে জোগাড় করা, এ তো বড়োই কষ্টসাধ্য। তাকে তার আজ পর্যন্ত পুঞ্জিত সকল অর্থই তবে তুলে দিতে হবে মাধবির হাতে।

স্বামীর অবস্থা দেখে বাঁকা হাসে মাধবী। হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে তাড়ার ভঙ্গিমায় শুধায়,
“টাকার ব্যবস্থা হলে কল কোরো আমায়। আমি আজ যাই, হ্যাঁ? দেরি হচ্ছে।”

সায়েমের করুণ দশা। কী জবাব দিবে এখন বাসায় যেয়ে সে দুশ্চিন্তায় ব্যথিত হৃদয় তার। সাথে তো মাধবীর আশ্চর্যদায়ক আচারণ আছেই।

মাধবী বেরিয়ে আসে উকিলের কক্ষ থেকে। তার হাসিমাখা মুখটা এখন অদৃশ্য যন্ত্রণায় কাতর। আপন মনেই বিড়বিড়ায় সে,
“না, এই কষ্টকে আমি আচ্ছন্ন হতে দিব না আমার উপর। দেবদাসী হব না আমি, হব না বিরহে পাগল। আমি যে মা, দিনশেষে আমার ছোট্ট সন্তান আমার উপর নির্ভর করে। আমি ভেঙে পড়লে আমার ছেলে-মেয়েকে সামলাবে কে? জন্মদাতা যখন হাত ছেড়ে দিয়েছে, আমার সন্তান আর আমার ভালো ভবিষ্যতের চিন্তা আমাকেই করতে হবে।”

শক্ত মুখে সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক থাকার অদম্য প্রয়াস তার। তবুও তার অলক্ষ্যে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার চোখ হতে।

বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা একটা। ছেলে-মেয়ে তার বড়োই শান্তশিষ্ট, কী তাকে ছাড়াই সুন্দর একা এক খেলছে! মাধবী ভেবে নিল আজ আর স্কুলে যাবে না সে। যার মনে আনন্দ নাই, ইতিবাচকতা নেই, সে এবার অন্যকে শিক্ষা দান করবে কী করে? বলা বাহুল্য, মাধবী একটি ছোটোখাটো প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োজিত।

“আজ দিন কেমন কাটল আমার প্রিন্স আর প্রিন্সেসের?”

তার ছেলে ছোট্ট মাহিন জবাব দেয় না, শুধু ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আর মেয়ে মিহিরিমা সে পরিপক্ব নারীর ন্যায় মিহিরিমা মুখ বেঁকিয়ে বলে,

“এট্টুও ভালো যায়নি। বাড়িতে তোমার আর বাবাইয়ের ঝগড়া শুনতে হয়। এখানে এসে মামা-মামীর। তোমরা ম্যারিড কাপেলরা এমন ঝগড়ুটে কেন বলো তো? আমাদের মতো গুড গুড হয়ে থাকতে পারো না? মনে হয় বিয়ে করাটাই মন্দ। আমি আর মাহিন ভেবে নিয়েছি আমরা কোনোদিন বিয়ে করব না।”

মেয়ের বাচ্চামো কথাতেও ভাবুক হয় মাধবী।
– তার ভাই আর ভাবী অরোনির মধ্যে ঝামেলা তাদের নিয়ে নয়তো? কিন্তু অরোনি তো তাকে তার ভাইয়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসে, বেস্টি বলে কথা।

মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“মা, মামা-মামী মধ্যে কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল তা জানো?”

“ঐ যে মামী আইসক্রিম খাচ্ছিল তা দেখে মাহিন চায়। তখন মাহিনকে মামী বকা দেয়, আর মামা মামীকে। তারপর তারা চেঁচামেচি করে।” গোছালো-অগোছালো ভাবে ঘটনা ব্যক্ত করে সাড়ে তিন বছরের মিহিরিমা।

আরেকদফা মন ভেঙে যায় মাধবীর। প্রিয় বান্ধুবীর থেকে এমন আচারণ আশা করেনি। আর সে মোটেও ভাইয়ের সংসারে পড়ে থাকতে আসেনি। বাসা ঠিক করেছে সে। শুধু সব ঠিক-ঠাক করা অবধি মানে দুই দিন থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু না, এখন মনে হচ্ছে আজই ভাড়া নেওয়া বাসায় উঠতে হবে।

ব্যাগপত্র গোছানোই ছিল। সে শুধু নিয়ে বেরিয়ে যায়। তার ভাই রায়িম উদ্বিগ্ন হয়ে এগিয়ে আসে। অরোনিও আসে, তবে তার চেহারা বিরক্তি।

“কী রে? এমন ভরা দুপুরে তুই বাচ্চা দুটো আর ব্যাগপত্র নিয়ে কই যাচ্ছিস?”

“আমি আগেই বাসা ঠিক করে নিয়েছিলাম নিজের জন্য ভাই। আর অরো মনে আছে তোর হৃদয় নামক ছেলেটির সাথে সম্পর্কের কথা জেনে পাত্রপক্ষ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর আত্মহত্যা করতে যাস। তখন আমি আটকাই, ভাইয়াকে নিজের কসম দিয়ে তোকে বিয়ে করতে বাধ্য করি।
অথচ, দেখ আমার এমন বিপদে আমার বাচ্চা সামান্য আইসক্রিম চাওয়ায় লঙ্কাকাণ্ড বাধালি তুই! জানিস, বিপদের দিন আসা খুব জরুরি নাহলে কে আঙিনার সাপ, কে আপন বুঝা যায় না।”

মাধবীর সূক্ষ্ম খোঁচায় মুখশ্রী ম্লান হয়ে যায় অরোনির। মাধবী কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রিকশায় চড়ে বসে। তার টাকায় কেনা আলমারি আর খাটটা খাণিকক্ষণ আগেই ভ্যানওয়ালা নিয়ে গেছে।

___

ষাটোর্ধ্ব লতা বেগমের লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। ছেলের বউ যে এভাবে ছেলের সম্মুখে ছোট করবে ভাবতেও পারেননি তিনি। শেষে কি না তাঁর অসুখ নিয়ে খোঁটা দিল হাঁটুর বয়সী মেয়েটা!

দুদিন ধরে প্রেশারের ঔষধ নেই তাঁর। অথচ, ডাক্তার সাহেব তাঁকে প্রতিদিনই খেয়ে যেতে বলেছেন। তবে ছেলের বউ কল্যাণী মুখের উপর যা তা বলে দেয় সবসময়। তাই মেয়েটার মুখোমুখি না হতেই ঔষধের কথা বলতে যাননি লজ্জায়। তবে আজ অসুস্থতায় না টিকতে পেরে ছেলের ঘরে যান।

“কল্যাণী, জয় একটা কথা ছিল তোর সাথে। একটু আমার ঘরে আসবি?”

ছেলে জয় উঠতে নিবে তখনই কল্যাণী খেঁকিয়ে বলে,
“কী এমন কথা ছেলের সাথে যে আমার সামনে বলা যাবে না! আমি বুঝি না ভেবেছেন? সবই বুঝি আমি, আপনি নিশ্চয়ই আমার নামে বিষ ভরবেন জয়ের কানে।”

“না, না, বউমা। এ কী বলছো! আমি শুধু বলতে চাচ্ছিলাম যে, দুদিন হয়েছে আমার প্রেশারের ঔষধ শেষ। যদি ও একটু এনে দিত বা টাকাটা দিত, তবে…” নত চোখে শুধান তিনি।

তাঁর কথা শুনে যেন আরও তেলে-বেগুণে জ্বলে উঠে কল্যাণী।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, পাইসেন তো একটাই টাকা খোয়ানো! এছাড়া খালি খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া কাজ কী আপনার? একটু লজ্জা-সরমও নাই আপনার, তাই না? দেখছেন নাতিটার পিছনে কত টাকা যায়, তবুও মুখ উঠিয়ে চলে আসেন টাকা চাইতে। কী এত অসুখ আপনার বুঝি না আমি! সব টাকা নেওয়ার ধান্ধা। যত্তসব!”

লতা বেগমের ক্ষীণ আশা ছিল যে ছেলেটা কিছু বলবে। কিন্তু না, সে চুপ বিরক্তমাখা মুখশ্রী নিয়ে চুপ করে থাকে। তারপর বউকে শান্ত করার উদ্দেশ্যেই হয়তো মুখ খুলে জয়।

“কী এমন হবে আম্মা তোমার কয়দিন ঔষধ না খেলে! এখন মাসের প্রথম দিক, হাতে টাকা নাই। পরে কিনে দিব নে।”

ছেলের কথা শুনে তিনি মুখে আঁচল চেপে তাঁর ঘরে চলে যান। ছোট্ট বেডরুম তাঁর, অবশ্য এটা শোয়ার ঘর না, স্টোররুম। চাকরি থেকে রিটায়ার্ড হওয়ার এক বছরের মাথায় ছেলে আর ছেলের বউয়ের কথার যন্ত্রণায় নিজ রুম ছেড়ে এখানে থাকতে শুরু করে।

বস্তুত, জাহানারা বেগম একজন রিটায়ার্ড প্রিন্সিপাল। যে পর্যন্ত চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন সেই পর্যন্ত বাড়িতে সবাই খুব সম্মান করত। সত্যটা এখন বুঝতে পারেন তিনি। সম্মানটা তাঁকে নয়, বরং, মাস শেষে যে মোটা অংকের টাকা পেতেন, সেই টাকাকে সমীহা করতেন।

____

বিকেলবেলা, নাতনি নিয়ে বাসার সম্মুখের রোডে অন্যান্য তাঁর বয়সী নারীদের সাথে হাঁটাহাঁটি করছেন লতা বেগম। চলছে কিছুটা গল্পগুজব আর আড্ডাও। হুট করেই মিসেস রোমিলা বলে উঠেন,

“জানেন আপা, আপনাদের বিল্ডিংয়ের পাশে যে নতুন বিল্ডিংটা হইসে না? সেটাতে একজন তালাকপ্রাপ্ত মেয়ে এসেছে, দুই বাচ্চা সুদ্ধ। এখনকার বিয়েও না চায়না জিনিসের মতোন হয়ে গেছে, নষ্ট হতে সময় লাগে না।”

লতা বেগম ভেঙচি কাটেন। আনমনেই ভাবেন,
-এই মেয়েটাও মনে হয় কল্যাণীর মতোন অশুভ, রূঢ়, শয়তান। এখনকার মেয়েগুলোই এমন। তবে জামাইটা মনে হয় আমার ছেলের মতো বউয়ের গোলাম না। তাই মায়ের কষ্ট সহ্য না করতে পেরে তালাক দিয়ে দিয়েছে। একদম ঠিক হয়েছে!

মুহূর্তে মাধবীর সম্পর্কে এটুকু তথ্য জেনেই তাকে বিচার করে ফেলেন তিনি। একটা দৃঢ় ধারণা জন্ম নেয়।

“তালাক কী আর এমনি এমনি হইসে! জামাই আর শ্বাশুড়িযে মনে হয় জ্বালাতো, নাহয় চরিত্রে সমসা। এজন্যই লাথি দিয়ে বের করে দিসে।”

শুরু হয় মাধবীকে নিয়ে নানারকম আলোচনা-সমালোচনা তার আড়ালেই। অথচ, তারা জানেই না মাধবীর গল্প, অভিজ্ঞতা।

মানুষ সর্বদা নিজ অভিজ্ঞতা দিয়েই অন্যকে বিচার করে। অথচ, হতে পারে যাকে বিচার করছে তার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

যেমন কোনো পুরুষ কোনো নারীর দ্বারা প্রতারিত হলে সে সব নারীকে মন্দ বলে প্রকাশ করে। অথচ, তার মা-বোনও নারী। আবার কয়েকজন কুলাঙ্গার, পশুর জন্য পুরো পুরুষজাতিকেই সেই ঘরে ফেলে নারী। অথচ, তার জন্মদাতা-ভাইও পুরুষ। ঠিক তেমনই লতা বেগম নিজের ছেলের বউ মন্দ হওয়ায় সব ছেলের বউদেরই সেই ঘরে এনে ফেলেছেন। অথচ, তিনি নিজেও একসময় ঘরের বউ ছিলেন, শাশুড়ি নন।

____

ভাড়া বাসায় উঠে তো পড়েছে মাধবী, তবুও স্বস্তি নেই। ঘরে শুধু একটা আলমারি আর খাট। বাজার করতে হবে, ঘরের জিনিসপত্র, রান্নার জিনিসপত্র কিনতে হবে, ছেলে-মেয়েকে ভর্তি করার সময়ও এসেছে, এছাড়াও আরও কত খরচ লাগবে! যেখানে তার ব্যাংকে পড়ে আছে খুব অল্প সংখ্যক টাকা। তার উপর একা হাতে সে এত কাজ কী করে করবে?

আজ মায়ের কথা একটু বেশিই মনে পড়ছে মাধবীর। মা থাকলে এতটা একাকিত্ব ভোগ করতে হত না তাকে। এতটা অনিশ্চয়তার মাঝে নিশ্চয়ই মা তার নিরাপত্তা বেষ্টনীতে আগলে রাখতেন মাধবীকে।

তার ভাবনার মধ্যেই মিহিরিমা এসে বলল,
“মা, ক্ষুধা লেগেছে। দুধ খাব।”

মাধবী বেদনা নিমজ্জিত চোখে মেয়ের দিকে তাকায়। বাসায় দুটো পানির বোতল ছাড়া কিছুই নেই। তার হাতের টাকা শেষ রাতের খাবার যোগাড় করতে যেয়েই। এখন এই অজানা জায়গাতে কোথায় যাবে সে দুধ চাইতে?

অতঃপর মেয়েকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ক্ষুধার্ত পেটেই ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা। আর নিজে কাটায় এক নির্ঘুম অশ্রুসিক্ত রাত্রি। তার আরও চিন্তা। রাত পোহালে ছেলে-মেয়েদের কার ভরসায় রেখে টাকা জোগাড় করতে যাবে?
মাধবী ও লতার জীবন কি এভাবেই চলবে? এমন অনিশ্চিত? অশান্তির মাঝে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here