তুমিময়_প্রেম?♥ PART_10,11

0
1629

তুমিময়_প্রেম?♥
PART_10,11
FABIYAH_MOMO?

ক্যাম্পাসের গেট পার করে ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো কেউ ভীষন ফলো করছে। পলকে পলকে কদমে কদমে সে আমায় টিপটিপ দেখছে। আমি বিষয়টাতে ঘাবড়ালাম না, শান্ত থাকলাম। ব্যাগের ফিতা আকড়ে ডিপার্টমেন্টের ক্লাসরুমের দিকে যাচ্ছি। সিড়িতে এক পা ফেলবো পেছন থেকে অর্পনা ডেকে দিলো। ওর চিকন গলায় মিনমিন কন্ঠ পেলেই বুঝে যাই ওটা অর্পনা ছাড়া কেউ হবে না। আমার ক্লাসমেট। আবার ব্যাচমেটও বলা চলে। ও বলল-

–মম দাড়াও।। একটু কথা আছে।
আমি ওর কথায় দাড়ালাম। হাতের বাদামী ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিলাম। দশ মিনিট এখনো আছে। ক্লাস শুরু হতে দেরি হবে। আমি শান্ত গলায় বললাম-

–খুব জরুরী কিছু? কি বিষয়ে বলতে চাও?
–তোমায় ক্যাম্পাসে মুগ্ধ ভাইয়ার দলবল খুজঁছে। কি কাজে উনাদের তোমায় লাগবে। জলদি যাও।
–ওদের কাজে আমার কি প্রয়োজন? একেকটা তো একেকটার চেয়ে কম না! আশ্চর্য! কেমন বেহায়া মুখে আবার ডাকলো!
–আমি কি করি বলো? জেনি আপু যেই খাতারনক, পারেনা গলায় হাত ঢুকিয়ে মারে। ভয় পাই গো। তুমি উদ্ধার করো।
–আচ্ছা তুমি টেনশন নিও না আমি ব্যাপারটা দেখছি। ওদের তলবে আমায় কেন ডাকলো তার জন্য মশলার ঝাটা খেতেই হবে। তুমি আমার ব্যাগ নিয়ে ক্লাসে বসো, আমি আসছি।
–সাবধানে থেকো মম। ওরা কিন্তু আগের বার তোমার চুল কেটে দিয়েছিলো। এবার…
–এবার কিছু করতে পারবেনা। আগেরবার নাহয় ভালোমানুষী করেছি। এবার টাটকা দুই থাপ্পর গালে বসিয়ে আসবো।

অর্পনা আমায় বিড়বিড় করে অনেক কিছু বললেও স্পষ্ট কানে কিছুই শুনিনি। অনুমান শক্তিতে বলছি, অর্পনা খুব সম্ভবত এই বলেছে- মম তোমাকেই খুজছে বাংলাদেশ!

গরম পড়েছে খুব। কি সূর্যের প্রখরতা!! তালু ফেটে গড়াগড়ি খেতেই দ্বিধাগ্রস্ত হবেনা, এমন কাঠফাটা গরম। ইচ্ছা করছে হিম শীতল পানির মধ্যে ডুবে থাকি, কি ঠান্ডা! আহ্..পরানটা জুড়িয়ে যায় ঠান্ডায়। কল্পনারাজ্য থেকে গরমের নিস্তার পাওয়া গেলেও বাস্তব দুনিয়ায় গরমে ঘেমে চৌচির। ওরা আমার সামনে। বদমাশ মুগ্ধ শহীদ মিনারের চকচক ফ্লোরে বসে আছে। বাকি গুলা ফ্লোরের নিচের সিড়িতে। মানে দূর থেকেই বোঝা যায় লিডার বসে আছে।।গলার ওড়নাটা নিয়ে কপাল মুছতেই বলে উঠলাম-

–দা না কাস্তে? কোনটা কোনটা? কোনটা দিয়ে কোপাবো?? বল বল দেরি না!!

এক বালতি অবাক নিয়ে মুখ হা করে আছে সবাই। কেবল মুগ্ধ স্বাভাবিক। যেমনটা সর্বদা থাকে। জেনি চিৎকার করে বলল-

–হাউ ডেয়ার ইউ রাস্তার মেয়ে! কাকে ধমকি দিচ্ছো? চোখ নামাও! তোমার বাবার সামনে চোখ উঠাবা! আমাদের সামনে ভুলেও না!

–সোজা হয়ে থাকিস! আমার ফ্যামিলি মেম্বার টেনে আনিস না! তোরটা টানলে ইজ্জত থাকবে না!

নাসিফ সবসময়ের মতো সিগারেট টানছে। ছেলেটাকে সিগারেট ছাড়া একদিনও দেখিনি। সে একটা সিগারেটখোর! মুগ্ধ কেমন শোপিসের মতো পুতুল সেজে আছে।বসে বসে তামাশা দেখছে। জেনি মেয়েটা রিমির দিকে সর্তকতায় ইশারা করলো। অঘটন ঘটানোর ইশারা। রিমি ইশারা পেয়ে আমার দিকে তরল কিছু ছুড়ে মারলো। নিমিষেই পুরো জামা নষ্ট হয়ে গেল। আকষ্মিক চোখ বন্ধ করলেও চোখ যখন খুলি তখন সবাই আমার দিকে অট্টহাসিতে হাসছে। জামার দিকে তাকালাম। বুক ফেটে কান্না আসছিলো! কাদঁতে পারছিলাম না! কালো কালির পানি গুলিয়ে আমার দিকে ছুড়ে মেরেছে। গতবছর আব্বু জন্মদিন উপলক্ষে জামাটা গিফট করেছিলো। সেই পছন্দের জামাটা আমার শেষ। কি করে দিলো? দাগটা সাবান দিয়ে ধুলে, লেবু দিয়ে ঘষলেও উঠবে না। কঠিন দাগ টিভির এডর্ভাটাইজের মতো কোনো ডির্টাজেন্টে উঠবেনা। রাগ লাগছিলো। দা এনে একঘন্টা কুপিয়ে জখম করলেও রাগের স্ফুলিঙ্গ কমবেনা। তবুও কাদো মনে ছোট হয়ে চলে আসলাম। আজ কিছু করলাম না। মনটা শক্ত নেই। প্রচণ্ড নরম হয়ে গিয়েছে। যেকোনো সময় চোখ দিয়ে ছলছল হয়ে জল পড়তে পারে। ওদের সামনে কাদতে নেই। দ্রুত পায়ে হাটঁতেও পারছিনা। সবাই ভাববে হেরে গিয়েছি। নিজেকে কঠোর দেখানোর প্রয়াস করছি।

গার্লস হোস্টেলের ওয়াশরুমে আছি। বেসিনের পানি ছেড়ে মুঠো করে জামার উপর থেকে আলতো কালির ছোপটা উঠাচ্ছি। যদিও জানি কালির দাগ উঠবেনা। পছন্দের জিনিসে কটু দেখা দিলে ভেতরটা কেমন হাহা করে বলে বোঝানো যাবেনা। মেয়েদের কাছে ছোটখাটো জিনিসটাই অনেক। অনেক কিছু। আমার কাছে সর্নালংকারের মূল্য নেই। স্বর্ণ কখনো হীরার যোগ্যতা পায়না, বাবার ভালোবাসা মিশ্রিত উপহারটা হীরার মতো। আমার হীরার খনিতে দাগ লাগলো। জামারহাতায় চোখ মুছে বাইরে বের হলাম। হোস্টেলের ব্যাক এরিয়া এটা। ওয়াশরুম গুলো স্বচ্ছ পরিস্কার। বড় একটা হলরুম পেরিয়ে এখানে আসা লাগে। যেহেতু আমি কান্না করেছি তাই জায়গাটা আমার জন্য উত্তম। নিরিবিলি, কোলাহলমুক্ত। কেউ নেই। কেউ নেই। আমি ওয়াশরুমের দরজাটা বাইরে থেকে সিটকিনি লাগিয়ে পেছনে ঘুরতেই ঝড়ের বেগে কেউ ঝুকে আসলো। একহাত ওয়াশরুমের দরজায় পড়লো। আমি চমকে দরজার সাথে ঠেকে গেলাম। চোখ বড় করে অবাকে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। মুগ্ধ ধারালো চাহনি দিয়ে তাকিয়ে আছে। পিছনে দরজা সামনে মুগ্ধ ডানে হাত বামেও অপর হাত দিয়ে দিলো। মাঝে আমি পুরো খাচায় বন্দিশিবির! সে বলল-

–আজকের মেয়েটা কে আমি চিনি না। কে সে? Who is she? Is she Momo?

মুগ্ধকে জবাব দেওয়াটা প্রয়োজন মনে করিনা। ওর বুকের উপর হাতজোড়া দিয়ে ধাক্কা দেই। ও জমের মতো লেগে আছে। কেউ ওর হাত দুটোকে আঠা মেরে দরজায় লাগিয়ে দিয়েছে। আমি চরম বিরক্ত। ও আবারো বলল-

–তুমি জবাব দিচ্ছো না কেন!এ্যান্সার মি!কে তুমি! কেন তুমি চুপ আছো!

ওর ফালতু কথা শুনে মাথা গিজগিজ করছে। এমনেই জামা নষ্ট করে দিয়েছে! এখন আমাকে আহ্লাদ দেখাতে চলে এসেছে! ফালতু! গালে একটা থাপ্পর দিলাম। মুগ্ধ রেগে গেল। রাগলো… রাগলো চরম রেগে গেলো। আমার বাহু চেপে ঝাকিয়ে বললো-

–তুমি চুপ থাকবে কেন! চুপ তোমার জন্য চুজেবেল না! তুমি ওদের সামনে কেন চুপ ছিলে ব্লাডি ফুল! হোয়াট দ্যা হ্যাল ইজ উইথ ইউ!আমি তোমার সিচুয়েশন দেখলাম! তুমি ফাউ ফাউ ওদের শেমফুল কাজে চেহারা দেখছিলে! কেন কিছু করলেনা!আমায় চড় মারলেই ওদের কাজে রিভেন্জ পাবে? Why have you slapped me?হোয়াই?

-চলবে

#তুমিময়_প্রেম?♥
#PART_11
#FABIYAH_MOMO?

–তুমি চুপ থাকবে কেন! চুপ তোমার জন্য চুজেব্যাল না!তুমি ওদের সামনে কেন চুপ ছিলে ব্লাডি ফুল!হোয়াট দ্যা হ্যাল ইজ উইথ ইউ!আমি তোমার সিচুয়েশন দেখলাম!তুমি ফাউ ফাউ ওদের শেমফুল কাজে চেহারা দেখছিলে!কেন কিছু করলেনা! আমায় চড় মারলেই ওদের কাজে রিভেন্জ পাবে? Why have you slapped me? হোয়াই?

সজোরে ধাক্কা দিয়ে আমার বাহু ছেড়ে হনহন করে চলে গেল মুগ্ধ। হাতের তালু দিয়ে আমি বাহু বুলাতে ব্যস্ত। মুগ্ধ হলরুম থেকে চলে যাচ্ছে, বারবার চুলগুলোকে ব্যাকব্রাশ করছে।। রাগের চোটে তার পায়ের গতি বেড়েছে, আমি বাহুতে হাত ডলতে ডলতে বুঝতে পেরেছি। এতো কি রাগ তার আমার উপর? কোন্ অধিকারের ভাগ ফলাচ্ছে আবার? আমি স্থান ত্যাগ করে ক্লাসে গেলাম। সিড়ি দিয়ে উপরে উঠছি বারবার মুগ্ধের রাগী চেহারাটা ভেসে উঠছে। রাগ যে যেমন তেমন তা না, মনে হয় পুরো এক সাগর আগুনের গোলা পুষে রাখে।। ক্লাসে গিয়ে সেখানেও খেলাম বিরাট ঝটকা! আজ নিউকামারদের ক্লাস হবেনা… ডিসমিস! ক্লাস পুরো খালি!সবাই ব্যাগ গুছিয়ে নিচে চলে গেছে। কেন ডিসমিস কেউ জানে না। একজন বললো, সিনিয়র দলের নির্দেশ ! দশমিনিটে ক্লাশ খালির আদেশ! বোঝা গেল, ক্লাসের ডিসমিসটা মুগ্ধদের কাজ। খেয়েদেয়ে কিছু জানে না ক্লাসে ঘটালো ব্যাঘাত!

নিচে যেয়ে দেখি ক্যাম্পাসের দক্ষিণ দিকটায় নতুন স্টেজ বানানো জায়গায় সব শিক্ষার্থী জমায়েত হয়ে দাড়িয়ে আছে। স্টেজে লম্বা মাইক বসানো হয়েছে। সেই সাথে মুগ্ধদের টিম স্টেজ দখলে উপস্থিত হয়েছে।। মাইক হাতে সাউন্ড টেস্টে ‘হ্যালো হ্যালো’ করছে রামিম। রিমি জেনির সাথে হাত নাড়িয়ে নানা অঙ্গিভঙ্গিতে কথা বলতে ব্যস্ত। অন্যদিকে তন্ময়, নাসিফ, আহাদ এবং মুগ্ধ মিলে বিশেষ কিছু ব্যাপারে আলোচনা করছে। আমি কৌতুহলে বশবর্তী হয়ে স্টেজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সামনে এক মস্ত ভীড়ের ঠেলাঠেলি। প্রচুর হৈ হুল্লোড় হচ্ছে।। মুগ্ধদের আলোচনার প্রেক্ষাপট কি? তা জানার জন্য আমার মতো বহু স্টুডেন্ট দাড়িয়ে আছে।। তন্ময় কথা বলতে বলতে ভীড়ের দিকে তাকালো। স্টেজ থেকে সবার মুখখানা দেখা গেলেও আমি কিছুটা দূরত্ব রেখে দূরে দাড়িয়ে আছি। একবার মনে হলো তন্ময় স্টেজ থেকে আমাকে দেখছে, আর মুগ্ধের জরুরী ডিসকাসে হু হা করে ‘হুদাই টাইপ’ মাথা ঝুলাচ্ছে।। মুগ্ধের কথায় তার বিন্দুমাত্র ধ্যান নেই। মুগ্ধ সবাইকে তার কথা বোঝাতেই খেয়াল করলো তন্ময়ের দিকে। মুগ্ধ চুপ হয়ে গেল, পাশ থেকে নাসিফ মুগ্ধের চুপ হওয়ার কারন লক্ষ্য করে বুঝে গেল তন্ময়ের ব্যাপারটা। তন্ময় তাদের ইর্ম্পট্যান্ট ডিসকাশন ছেড়ে ফাউল দিকে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ শার্টের হাতা ভাজ করতেই চট করে গালে দিলো চড়টা! আচমকা চড় খেয়ে তন্ময় গেল চমকে। ভিড়ের চিল্লাচিল্লি সব গেল থমকে। মুগ্ধের মাথায় রাগের ভূত চেপে বসেছে। উনিশ থেকে বিশ হলেই একুশে ফেব্রুয়ারি বানিয়ে ছাড়বে। তন্ময় চড় খাওয়া গালে হাত বুলাতে থাকলে মুগ্ধ প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে কানে নেয়। কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘামের কণাগুলো বুড়ো আঙ্গুলে আড় ভাবে মুছে নেয়। তন্ময় এখনো ক্যাবলা হয়ে আছে কোন্ অপরাধের শাস্তি পেলো চড় খেয়ে? মুগ্ধ কেন হঠাৎ রাগারাগী করছে। মুগ্ধ কানে ফোন লাগিয়ে কথা বলতে বলতে অন্যদিকে চলে গেলে আহাদ এসে তন্ময়কে সমবেদনা জানায়। বেচারা তন্ময় মুগ্ধের হাতে ক্রোধের থাপ্পর খেয়েছে!! ডিসট্রাক্ট হওয়ার কারন যে এক তরুণী! সেটা আড়াল করতে চাইছে।। কে সেই তরুনী? কাকে দেখার প্রয়াসে থাপ্পর খেলো তন্ময়?

মাইক টেস্টের পর হাতে নিলো মুগ্ধ। সব স্টুডেন্টের চিল্লাহুল্লা অফ করতে বলে মূল বক্তব্যে প্রবেশ করলো। আজ তার মধ্যে নেতা নেতা ভাব প্রকাশ পাচ্ছে। ঠোটের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে ডানহাতে মাইক, অপরহাত মুঠোকরে পিছনে গুটিয়ে দম্ভভরে দাড়িয়ে আছে মুগ্ধ।। রোদ্রের রোদময় ঝিলিক গাঢ় নীলের শার্টকে অদ্ভুত ভাবে স্নিগ্ধ করছে। শার্টের হাতা গুটানো জায়গায় কালো রঙটি দেখা যাচ্ছে। ফোল্ড করাতে ভেতরের কালো রঙটি উঠে এসেছে, সেই হাত দিয়ে বারবার চুল বেয়ে ঘামে ঝরা কনাগুলো অদ্ভুত মোহনীয়!! মুগ্ধের এ অবস্থা দেখে মেয়েগুলো তো লাটে ক্রাশট্রাশ খেয়ে মরে যাবে! দায়ভার কি মুগ্ধ নেবে?? মুগ্ধ স্টেজে পায়চারী ভঙ্গিতে হাটতে হাটতে ঠোটে হাসির রেশ ফুটিয়ে বলে উঠলো,

–হ্যালো এভ্রিবডি! সবাইকে তপ্ত রোদের নিচে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানিয়ে আমি রাদিফ মুগ্ধ আপনাদের সামনে কিছু জরুরী ব্যাপারে কথাসমূহ পেশ করতে যাচ্ছি। সবাই জানেন প্রতিবছর আমাদের সামারফিল্ড ক্যাম্পাস আমোদ-ফূর্তিতে এডভান্স! এবারও আমরা পিছিয়ে থাকবো না, পিছিয়ে থাকার কথাই আসেনা।। এ্যাট ফাস্ট! আমরা নিউ স্টুডেন্টদের ‘নবীন বরন’ উদযাপন করবো। দ্যান আমাদের ‘শিক্ষাসফর’। শিক্ষাসফর শেষে ট্রেডিশনাল ফেস্টিব্যাল ‘বাংলা নববর্ষ’, ‘ক্লাস পার্টি’, ‘রিসার্চ-ট্যুর এসাইনমেন্ট’, লাস্টলি আমাদের সিনিয়র ব্যাচের ‘র‍্যাগ ডে’। আপনারা জানেন ক্যাম্পাসে আমরাই সিনিয়র। আমাদের এটা লাস্ট ইয়ার।। কাজেই প্রত্যেকটা সেলিব্রেশন আমরা আমাদের মতানুসারে করবো। প্রত্যেকটা কাজে আমাদের এক্সট্রা হেল্পের হাত লাগবে।। তাই ইউ নিড হেল্প গাইজ! কাল আমাদের ক্যাম্পাসে ‘নবীন বরন’ আই হোপ এভ্রিওয়ান নোস এবাউট ইট! আগেই নোটিশ বোর্ডে নোটিশ দেওয়া হয়েছিলো। সো কাল আমাদের নবীন বরন উৎসবে সবাইকে সকাল দশ ঘটিকার সময় উপস্থিত থাকতে আমন্ত্রণ করা হলো।। থ্যাংকিউ।।

.
.

ক্যাম্পাস থেকে সবার আগে আমি বের হলাম। উদ্দেশ্য একটাই মুগ্ধের সাথে আমি গাড়িতে করে যাবো না। নিজেই একটা রিকশা ধরে তার আগে বাসায় যেয়ে ফাইজাকে পড়িয়ে আসবো।। যেই ভাবা সেই কাজ, আমি রিকশা করে রাস্তা চিনে চিনে ওদের বাসায় পৌছাই। মেইন বড় গেটের কাছে রিকশা থামালে আমি রিকশা থেকে নেমে ভাড়া চুকিয়ে গেটে নক করতেই দারোয়ান কাচুমাচু করে গেট খুলে দিলো। তার মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কেউ তাকে ঠাটিয়ে দুটো চড়ের হুমকি দিয়েছে। ভয়ে পুরোপুরি ভিজাবিড়াল হয়ে গেছে। দারোয়ান দরজা খুলে দিয়ে মাথা নিচু করে আছে, আমি অবাকের দৃষ্টিতে ভেতরে ঢুকে যেতে নিলে পেছন থেকে দারোয়ান কাপা কাপা গলায় বলে উঠে-

–আফা,

আমি ‘আফা’ ডাক শুনে পিছনে তাকাই। দারোয়ান চোখে তাকিয়ে কথা বলতেই ঢোকের পর ঢোক গিলছে। আমি কপালকুচকে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

–কি মামা? আপনি মিনমিন করে কাহিনি করা বন্ধ করবেন? গলা ঝেড়ে বলুন তো, ব্যাপার কি!
দারোয়ান মামা মাথার টুপিটা বগলের নিচে গুজে থমথম গলায় বলে উঠলো-
–আফা আফনে এট্টু ওইহানে যাইবেন? নাইলে এই গরীবের চাকরি নট হইয়া যাইবো..
–আশ্চর্য তো! শুধু শুধু চাকরি নট হবে কেন?
–আফা এই গরীবের ইট্টু উপ্কার করেন আফা, ইট্টুখানি ওইহানে যান।।

দারোয়ান মামা গাড়ির পার্কিং লটের ওখানে যেতে ইশারা করছে। পার্কিং লটে কয়েকটা গাড়ি থামানো। পিছনে আরো গাড়ি আছে কিনা জানি না, থাকতেও পারে। বিশাল বড় এরিয়া জুড়ে ছিমছাম অবস্থাযুক্ত পার্কিং লট। এই লটে ঢোকার এন্ট্রিপথই তিনটা। আর এই গেটসহ টোটাল চারটা। আমি একপ্রকার বাধ্য হয়েই পার্কিং লটের ওখানে গেলাম। দুপুরের কড়া কাঠফাটা রোদ, তার উপর সকাল থেকে প্রায় না খাওয়া আমি। সব মিলিয়ে শরীরে কি পরিমাণ যন্ত্রণা কাজ করছে একমাত্র আমি জানি।। প্রথম দুইটা বি.এম.ডব্লিউ গাড়ি পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেলাম। তব্দা টাইপ নিরিবিলি, একটা কাক-পঙ্খিও নেই, এখানে কেন যেতে বললো মামা? কিছু ধরতে পারছিনা। পা ঘুরিয়ে চলে আসতে লাগলাম।। হঠাৎ হাতে হেচকা টান অনুভব করলাম! ছিটকে গিয়ে তিন নাম্বার গাড়ির উপর পড়লাম। হাতে জোরেসোরে ব্যাথা পেলাম, মাথা তুলে হাতে হাত দিয়ে ডলতে ডলতে ঘুরে তাকাতেই দেখি পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে দুই নাম্বার গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে মুগ্ধ দাড়িয়ে আছে। বা-ভ্রু খুব উচুতে তোলা, ঠোট কামড়ে কটমট করছে। মুগ্ধকে দেখেই আমার মাথায় রাগের ঝাপটা বাজ ফাটিয়ে দিলো! মনে মনে ভয়াবহ একটা গালি ছুড়ে মারলেও মুগ্ধ আমার আগেই ধমকের সুরে বলে উঠলো-

–থাপ্পর চিনো? লাইফে থাপ্পর খেয়েছো! গুণে গুণে দশটা থাপ্পর বসালে টেস্ট কেমন হয়! ইউ নো? চামড়া লাল করে দেবো বেয়াদ্দব মেয়ে!

আমি কপালকুচকে মুখ অল্পবিস্তর হা করে আছি। কি বলছে না বলছে, সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে!! মুগ্ধ দু’কদম এগিয়ে আসলো। আমি পা পিছিয়ে গাড়ির সাথে সেটে গেলাম। ভয়ে ধকধক করছে, মুগ্ধ সামনে দাড়িয়ে দু’পকেটে দাত ঢুকিয়ে রাগে ফুসফুস করছে।।সত্যি সত্যি যদি ধরাম করে চার-পাচটা চড় মারে ! তাহলে তো গালের চামড়া খুলে রাস্তায় গড়াগড়ি খাবে! কি সর্বনাশ!! মুগ্ধ গলার স্বর আরো তীক্ষ্ম করে রাগান্বিত সুরে উঠলো-
–এটিটিউট কাকে দেখাও? মুগ্ধকে! আমাকে রেখে চলে আসছো কেন? সাহস দেখাতে? কত্ত বড়ো সাহস তোমার! একদম পা ভেঙ্গে হাতে ধরিয়ে দিবো ব্রেনলেস ডাফার কোথাকার !

মুগ্ধ রাগ ঝেড়ে একদফা মুখের বুলি শোনালো। ওর মুখের করুণ অবস্থা দেখে আমার পক্ষে পাল্টা কথার জবাব দেওয়া হলো না! আমি মম চুপচাপ শান্তশিষ্ট ভদ্রবিশিষ্ট মেয়ের মতো কুজে গেলাম। আমার সাথে কিসের রাগারাগী? মুগ্ধের সাথে গাড়িতে করে আসতেই হবে এমন কোনো পেপার সাইন আছে নাকি! কি নিয়ে আমার সাথে ক্যাচক্যাচানি! মুগ্ধ ‘ফলো মি! কুইক!’ বলে নাক ফুলিয়ে চলে যেতে লাগলো। আমিও নির্বিকার ভঙ্গিতে যেতে লাগলাম।

ফাইজা আমাকে পেয়ে পূর্বের মতো হাসিখুশিতে পরিপূর্ণ হলো। আমি চেয়ার টেনে ওকে বসিয়ে পাশে আরেকটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। ফাইজা খুব মিস্টি মিস্টি কথার প্রহর আনতে পারে। মেয়েটা খুবই মায়াবী।। আমি পড়ানো শুরু করলে মুগ্ধ রুমে গটগট করে প্রবেশ করে। ফাইজার নরম তুলতুল ফোমের বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে। মাথা উচু তুলে মাথার নিচে দুহাত রেখে দেয়। একদম ডোন্ট কেয়ার মুডে সিলিংয়ে লাগানো তিনপাখার ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকে। আড়চোখে আমি সব পর্যবেক্ষণ করছি। মুগ্ধ কি কি করছে সবই বুঝতে পারছি।

সময় দেড় ঘন্টা পেরুলো। ঘড়িতে আড়াইটা বাজলো। মুগ্ধ এখন ম্যাগাজিন হাতে আধশোয়া স্টাইলে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। ফাইজা অংক কষছে। মুগ্ধ কি নিয়ে যেন ছটফট ছটফট করছে। খুচখুচানি বিহেব দেখাচ্ছে।। বেডের পাশে টেবিলে রাখা জগ থেকে একনাগাড়ে এক চুমুকে দুই তিন গ্লাস পানি গিলছে। আবারো বিছানায় শুয়ে ম্যাগাজিন হাতাচ্ছে।। ফাইজার কমিক বুক খুলে নেড়েচেড়ে দেখছে।। জগ থেকে পানি ঢেলে ঢকঢক করে পানি গিলছে।। অস্থির হয়ে উঠছে।। আমি ফাইজার দিকে তাকিয়ে থাকতেই মুগ্ধ ফট করে বলে উঠলো-

–এই শোনো তো!

ফাইজা চেয়ার থেকে মাথা বাকা করে পিছনে ঘুরে বলে উঠলো-
–চাচ্চু তুমি ফাইজার মিসকে ডাকছো কেন? ফাইজা এখন পড়ছে,
মুগ্ধ চেহারায় অস্থিরতার গম্ভীরভাব কেটে দিয়ে ফাইজার জন্য হাসিমুখে বলে উঠলো,

–আম্মাজান!!! আপনার টিচারের সাথে প্রাইভেট টক আছে আম্মাজান!বেশি না… একটুখানি বলবো!! একটুখানি, প্লিজ??
ফাইজা মুখে হাত চেপে খিলখিল করে হেসে বলে উঠলো-
–ঠিক আছে বাচ্চাজান!! ফাইফার মিসকে নিয়ে টক – টক করেন!!
–আম্মাজান! আপনি একটু বাইরে যাবেন? নিচে আপনার জন্য র্সাপ্রাইজ আছে দেখবেন প্লিজ??
–সাপ্রাইজ!!! আমি যাবো আমি যাবো!!

ফাইজা চেয়ার ছেড়ে দৌড়ে চলে গেলো।। মাঝখানে আমি চাচা-ভাতিজির কান্ড কারখানাতে জোকার বল্টু হয়ে গেছি।। একদল বলছে আম্মা! অন্যদল বাচ্চা! মাঝে আমি খাই কারেন্টের ঝটকা! ফাইজা যেতেই ধপ করে বিছানা থেকে নেমে দাড়ালো মুগ্ধ। দ্রুত রুমের দরজা ঠেলে দিয়ে আমার সামনে ফাইজার চেয়ার টেনে বসলো।। হোহো করে শ্বাস ছাড়ছে মুগ্ধ। হাপানি রোগীর এনহেলার নষ্ট হলে যেরূপ থেরাপি দেওয়া লাগে মুগ্ধ এখন রোগী সেজে আমার সামনে তেমনভাবে শ্বাস নিচ্ছে।। আমি ভ্রু কুচকে খোচা মেরে জিজ্ঞেস করি-

–মরে যাবেন নাকি? কাফনের কাপড় আনবো? শেষ ইচ্ছা কি, রিপোর্টে বলুন ! আমি নিউজপেপারে ছাপিয়ে দিচ্ছি, একটা রোগী শ্বাসকষ্টে রোগী কুতুকুতু করছে।।।

মুগ্ধ কঠিন চোখে তাকালো! চোখ দিয়ে ছুড়ি মারার ব্যবস্থা থাকলে এতোক্ষনে মুগ্ধ আমায় খুন করে কুটিকুটি করে ফেলতো! কি ভয়ংকর চাহনি!! মুগ্ধ চোখের অগ্নিদৃষ্টি পাল্টে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে অসহায় ভাবে মাথা নুয়ে আছে।। আমার কোলে থাকা ব্যাগ থেকে ফোনটি হঠাৎ ভাইব্রেট হয়ে বাজতে লাগলো। আমি ফোন বের করে কল রিসিভ করে ইসুর সাথে কথা বলতে নিলে পাশ থেকে মাথা নুয়ে মুগ্ধ কি বলে শুনতে পাইনা।। মুগ্ধ সুরের ভলিউম একটু বারিয়ে কি কি যেন বলতে শুরু করলো।।

“তোমাকে আমি আদর করতে চাই! তুমি দূরে থাকলে ধুকেধুকে মরি! শ্বাসকষ্ট হয় প্রচুর! রাতে ঘুমাতে পারি না! ক্যাম্পাসে তোমার পাত্তা মিলে না! আশ্চর্য হই আমি! আমি কেমন হয়ে গিয়েছি। আমার মাথা ফাটিয়ে ইনসাল্ট করেছো তুমি! আমি তোমার পেছনেই মাথা হেট করে পাগলের মতো চলছি! ক্যাম্পাসে সব জুনিয়ররা, বিপক্ষ দলের শত্রুরা সবাই ফায়দা উসুলে আমার সেল্ফ রিসপেক্টের পানি বানাচ্ছে! ইজ্জতের নস্টালজিক এক্সকিউজ করছে! আমি শ্বাস নিতে গেলেও কষ্ট পাই! তুমি ফাইজাকে পড়াও আমি চুপিচুপি তোমাকে দেখি! মাত্র দুটা ঘন্টা! মাত্র দুটা ঘন্টা কাটায় কাটায় পড়িয়ে তুমি চলে যাও! একটা নিরীহ প্রাণী বোবা সেজে তোমার আশায় পথ চেয়ে থাকে একটাবারো জানার চেষ্টা করেছো? তোমার এই ডেভিল লুকটা দেখার জন্য ইচ্ছে করে বলে তোমার ড্রেসে কালি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি! আমি সরি! সরি আমি! নিজের উপর ছিঃ ছিঃ করেছি, কেন তোমার প্রতি জটিল কায়দায় আসক্ত হয়ে গেছি! আসক্ত হয়ে কতবার যে কন্ট্রোল হারিয়েছি! মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে হাতটা টেনে বুকের সাথে জাপটে ধরি! ইচ্ছে করে…তোমার হাতে হাত রেখে রাতের নিশিপথ হাটি। কত যে ইচ্ছা আমার ! কত যে বাসনা! এ কদিন তোমায় নিয়ে আমি করেছি বহু কল্পনা! কল্পনার জগতে তুমি আমার জন্য বিদ্যমান! হাতে হাত রাখলে হাতটি থাকবে আমার! পাশাপাশি হাটলে মানুষটি হবো তোমার! আকাশ চিড়ে বজ্রপাতের শব্দ হলে চিৎকার দিয়ে জাপটে ধরবে তুমি! কোনো ভুল-ত্রুটি করলে কান ছিড়ে অভিমান দেখাবে খুবই ! ঝগড়া-ঝামেলা শেষে দূরে যাওয়ার ভয় দেখাবে! আমি আরো রাগ দেখিয়ে তোমায় দূরে যেতে বলবো, তুমিও প্রচণ্ড রেগে গিয়ে দূরে চলে যাবে! দিনশেষে পাগলের মতো এলোমেলো হয়ে গেলে, তুমি ফিরবে আমাকে গুছাতে! কিছুদিন তুমি কথা বলবেনা, কিছুদিন তুমি আদর করবেনা, কিছুদিন তুমি চুপটি করে থাকবে, কিছুদিন পর আবারো স্বাভাবিক হয়ে এই রাদিফ মুগ্ধকে ডাকবে!! অপেক্ষায় আছি প্রিয়….নিরবতার কারাগার ভেঙ্গে জবাব একদিন দিও….♥

মুগ্ধ চোখ বন্ধ করে বুকের উপর চাপা পাথর সরিয়ে ঝটপট করে কথাগুলো বলে দিলো। কি পরিমাণ সাহস করে কথাগুলো বলেছে!! এই সাহস যদি রণক্ষেত্রে দেখানো যায় জিত ছিনিয়ে গোটা রাজ্যে রাজ্যত্ব করা যাবে!! মুগ্ধ ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ছে। জোরে জোরে শ্বাস ছাড়তেই চোখ খুলে যা দেখলো পায়ের নিচ থেকে মাটি খসে যেতে লাগলো। তার প্রেমপূর্ণ কথাগুলোর একটিও তার প্রিয়তমা প্রিয়া কানে তুলেনি! সে ফোনের ওপাশে বান্ধুবী নামক জীবের সাথে কথা বলতে পুরোই ব্যস্তময়ী!

-চলবে

-Fabiyah_Momo

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here