তুমিময়_প্রেম ❤
PART_22
FABIYAH_MOMO
মাথা ফাটা, ঠোঁট কাটা, ঠোঁটের রক্ত চোয়াল পযর্ন্ত গড়িয়ে চুয়ে চুয়ে গাড়ির দরজায় পড়ছে। হাত একটা জানালা দিয়ে বের হয়ে গেছে। গাড়ির জানালা ভেঙ্গে কিছু কাচঁ গালে ঢুকে গেছে। কিছু কাচঁ জায়গা করেছে মাথার চুলের কিউটিক্যালে। মাথাটা জানালার সাথে ভয়ঙ্কর ভাবে ধাক্কা লেগেছে বিধায় শেষ নিশ্বাসের মূহুর্ত চলছে। সমস্ত শরীর কেমন নিস্তেজ লাগছে, যেনো দেহ থেকে রূহটা ধীরে ধীরে নিস্তার নিচ্ছে। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আছে। সেই ঝাপসা চোখে বহু কষ্টে নিজেকে আবিস্কার করেছে রাত আড়াইটার হাইওয়ে সড়কে! গাড়ির ফ্রন্টলাইট বারবার ‘অনঅফ’ হয়ে ভেলকি দেখাচ্ছে। ঠিক হরর মুভিতে যেমনটা রুমের লাইটগুলো অন-অফ হতে থাকে, ঠিক সেরকম। কাপা কাপা হাতে অসার শরীরে কোনোমতে পকেট থেকে ভুম ভুম শব্দ করা কম্প বস্তুটা বের করলো। বস্তুটার কম্পনের চেয়ে সহস্রাধিক গুণে হাতটা যেন কাপছে। রক্তেমাখা বুড়ো আঙ্গুলটা স্ক্রিনে হালকা টাচ করেও টাচ হচ্ছিলোনা রক্তের দাপটের কারনে। লাগাতার বুড়ো আঙ্গুলকে সেই কাজে লিপ্ত রাখতেই একটা রাগান্বিত গলার কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,
— জাহান্নামের কোন্ রাস্তায় তুই টিকিট বিক্রি করতে গেছিস হারামজাদা! কল করছি কল ধরছিস না! কত্ত বড়ো সাহস! শালা কথা বলছিস না কেন্? মরে গেছিস!!
অস্ফুট স্বরে ঠোঁট নাড়িয়ে ঠেলেঠুলে বলে উঠলো,
— মরে যাচ্ছি… মরে যাচ্ছি..
গলার স্বর নিচু থেকে নিচু হচ্ছিলো বলে ফিসফিসানির আওয়াজটা ওপাশ থেকে কম শোনা গেল! বকাবকি করা ব্যক্তিটাও পরিস্কার বুঝতে পারলোনা। আগুনের হুল্কার মতো আরো দুদফা চেচিয়ে বললো,
— শালা হারামি! মদ রেখে বসে আছিস!থাবড়া দিয়ে দাতঁ ফেলে দিবো! তুই কথা বলবিনা, না? দেখিস এবার যদি সামনে পাই এমন শিক্ষা দেবো জীবনেও ভুলবিনা!
মৃত্যুযন্ত্রনা থেকে কঠিন কোনো যন্ত্রনা দুনিয়ায় হয়না। ‘সুইসাইড’ করতে চাওয়া মানুষ যদি ইচ্ছার আশা ফিরে পায় তারা আর সুইসাইডের চিন্তাও করেনা! আজ গাড়িতে এক্সিডেন্ট হওয়া রামিম চাচ্ছিলো মুগ্ধ ওকে বকুক! ইচ্ছেমতো বকুক! তবুও ওর মৃত্যুযন্ত্রনার মতো ভয়ঙ্কর যন্ত্রণাটা বিনা শব্দে বুঝুক! হঠাৎ ওপাশ থেকে চমকিত কন্ঠে মুগ্ধ বলে উঠলো,
— প্লিজ রিসপন্স মি, ড্যাম! রামিম প্লিজ কিছু বল? তোর কিছু… আমি এক্ষুনি আসছি! আমি এক্ষুনি আসছি! চোখ খোলা রাখ্ রামিম! পুশ ইউরসেল্ফ! আ’ম কামিং…
পান্জাবী পড়া বাদ দিয়ে আলমারি খুলে হাতের কাছের কাছে যা পেল তাই সে ঝটপট গতিতে গায়ে জড়িয়ে লিফটের ভেতরে ঢুকে গেল! কানের কাছে ফোন লাগিয়ে চিৎকার করে রামিমকে সজাগ রাখায় ব্যস্ত ছিলো মুগ্ধ! লিফটের দরজাটা আপনাআপনি বন্ধ হতে গিয়েও যেনো বন্ধ আর হলো না, কিছু একটার সাথে বাধা লেগে দরজাটা খুলে গেলো! মুগ্ধ ভ্রুকুচকে লক্ষ করতেই দেখলো লিফটের মধ্যবর্তী জায়গায় কারো পা বসানো! তাকে দেখে মুগ্ধের হাত লিফটের সুইচ থেকে ধীরগতিতে নামতে লাগলো। কঠিন চাহনি ছুড়ে একজোড়া নয়ন তার দিকে লক্ষ করতেই মুগ্ধ আটকা গলায় বলে উঠলো,
— রারামিম.. রারামিম.. রারামিমিম ওওর…
একজোড়া নয়নের অবয়বটা তার কাছে চলে আসলো! লিফটের দরজাটাও অফ হয়ে গেলো। লিফট নিচে যাচ্ছে। মুগ্ধের গলা ধরে আসছিলো। কিচ্ছু উচ্চারন করতে পারছিলো না সে মমর কাছে।
— কি মশাই? বিয়ের পিড়িতে বসার জন্য লাফালাফি করে এখন নিজেই পালাচ্ছেন রামিমের অজুহাতে? জোশ তো!
মুগ্ধ নিজেকে কোনোরকমে সামলে মানুষটার দুইগালে দুইহাত রেখে অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,
— আমি বিয়ে করবোই! আমি মিথ্যে বলছিনা! আমি বিয়ের আসর থেকে পালাচ্ছি না! আমি আসবো! বিশ্বাস করো আমি আসবো! রামিম…রামিমের সত্যি কিছু হয়েছে পাকনি। ফোনের ওওপাশে ও গোঙাচ্ছে..
লিফট খুলতেই মমকে উপেক্ষা করে পার্কিং লটে ছুটেগেলো মুগ্ধ! ড্রাইভারটা দারোয়ানের সাথে গল্প করছিলো। মুগ্ধকে হুলস্থুল অবস্থায় দেখে পিছে পিছে দৌড়ে এসে ড্রাইভার বললো,
— স্যার? আপনি কোথায় যাবেন বলুন। আমি ড্রাইভ করছি।
মুগ্ধ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে সিটবেল্ট বাধতেই বললো,
— দরকার নেই। আপনি থাকুন!
আচমকা গাড়ির অপর দরজাটা খুলতেই মুগ্ধ হকচকিয়ে ওখানে তাকালো! মম গাড়িতে বসে সিটবেল্ট বাধতে লাগলো। মুগ্ধ ভ্রুকুচকে স্থির হয়ে ওকে দেখতেই মম মুগ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
— আমাকে দেখা বাদ দিয়ে রামিমের জিপিএস ট্র্যাক করো মুগ্ধ! কোথায় আছে চেক করো! কুইক!
মুগ্ধ সর্বোচ্চ স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে। পাশ থেকে রাস্তার খবরটা কানে পৌঁছাচ্ছে মম। মুগ্ধ ওকে বললো-
— আর কতদূর?
— সিগন্যাল আশপাশেই দেখাচ্ছে!! রামিম এখানেই কোথাও আছে! তুমি আরেকটু সামনে যাও!
মম ফোনের দিকে মগ্ন থাকতেই হঠাৎ ব্রেক কষলো মুগ্ধ! ক্রুদ্ধভাবে মুগ্ধের দিকে দৃষ্টি ছুড়তেই স্ট্যাচুর মতো আবিষ্কার করলো মুগ্ধকে। মম অবাক দৃষ্টিতে মুগ্ধের অবস্থা বুঝার জন্য সামনে তাকাতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো তার! মম চোয়াল ঝুলিয়ে মুখে হাত দিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধের ঠোঁটজোড়া ওই দৃশ্য দেখে অনবরত কাপঁছে। সামনের দিকে দৃষ্টিস্থির করে স্টিয়ারিংয়ে বসানো হাতদুটো দ্বারা সিল্টবেল্ট খুললো মুগ্ধ। আস্তেধীরে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে পা ফেলতেই মম আড়ালে চোখ মুছলো।
গাড়ির বামপাশটা থেবড়ে গেছে! ডানপাশটা অক্ষত হিসেবে একাংশ জীবিত আছে! কোনো মানুষ ভয়াবহ এই এক্সিডেন্টে বাচঁবে বলে তার কোনো আশঙ্কা নেই! মোটকথা কেউ বেচে থাকলেও বেশিক্ষন বাচঁবে বলে মনে হয়না! মুগ্ধ রোবটের মতো একপা একপা ফেলে গাড়ির ডানপাশটা দেখতে যাচ্ছিলো যেখানটার এখনো কিছু অংশ অক্ষতাবস্থায় ছিলো! মুগ্ধ গাড়ির ঠিক সামনে দাড়াতেই হুট করে বজ্রাঘাতের মতো কয়েকপা পিছিয়ে গেলো! মম সচকিত চোখে মুগ্ধকে ধরে বলে উঠলো,
— পপিছালে ককেনো?
মুগ্ধ বড় ঢোক গিলে কপালের ঘাম মুছে মমর দিকে তাকালো। চোখদুটো বুজে আধো আধো গলায় বললো,
— রারামিম নেনেই…
— মানে! রামিম নেই মানে? রামিম কই গেলো?
মম গাড়ির ড্রাইভিং সিটে ঝুকে দেখলো আসলোই কেউ নেই, সিট খালি। হঠাৎ একটা মানুষ কিভাবে উধাও হলো? মম গাড়ির দরজা ও জানালার অবশিষ্ট কাচেঁর উপর রক্তের অবস্থান পেলো! মম দুইআঙ্গুলে রক্ত নিয়ে ঘষে দেখলো, নাকে শুকে বুঝতে পারলো — এগুলো রক্তই! মম আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সিচুয়েশনটা দেখলো এবং পরক্ষনে ‘মুগ্ধ!! মুগ্ধ!!’ বলে চিৎকার চেচামেচি করতে লাগলো! মুগ্ধ বন্ধ চোখজোড়া খুলে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে মমর কাছে দ্রুত গেলো! মম সম্পূর্ণ একটা ব্যাখ্যা সাজিয়ে মুগ্ধের কাছে পেশ করলো,
— “মুগ্ধ লুক! এটা দুইরাস্তার মোড়! রামিমের গাড়িটা হাইওয়ের এমন ট্র্যাকে এক্সিডেন্ট হয়েছে যেটা দুই রাস্তার মোড় পার করে বেশ খানিকটা দূরে! গাড়িটা নিখুঁতভাবে দেখো মুগ্ধ! গাড়ির দরজায় লাল রক্ত! আ’ম ভেরি সিউর এবাউট ইট, এটা রামিমের রক্ত! ওর বাজেভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে মুগ্ধ ! ওকে ডেফিনেটলি কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে! বিকজ ওর রক্ত ছাড়া গাড়িতে কিছুই নেই!”
.
মুগ্ধ হাইস্পিডে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে! বাতাসের ‘শো শো’ শব্দ এখন ‘হো হো’ ব্যগ্রধ্বনিতে শোনা যাচ্ছে! তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে গাড়ির গতি! আধাঘন্টার রাস্তা সেখানে কভার করলো এগারো মিনিটের মধ্যে! হাসপাতালের সামনে থামিয়ে রিসেপশন থেকে খবর নিয়ে দুজন চললো রামিমের কাছে! ‘অপারেশন থিয়েটার’ — শব্দটা চোখে পড়লো সবার আগে! মুগ্ধ শব্দটার কাছে গিয়ে দাড়ালো না! মূলত সেই সাহস বুকে জুটলো না! মুগ্ধ যাকে ডানহাত-বাহাত সবকিছু ভাবতো, আজই তারই এমন লোমহর্ষক হৃদয়নিংড়ানো অবস্থা দেখতে হলো! মুগ্ধ হাতে থাকা ফোনটা নিয়ে থমথম গলায় কাউকে কল করলো! বিপরীত দিক থেকে কলটা রিসিভ হতে বেশি দেরি হলো না! চট করা ধরে ফেললো,
— জেনি…
— মুগ্ধ? তোমার কি হয়েছে? তোমাকে এমন শোনাচ্ছে কেনো?
— জেনি.. রারামিম..
— হ্যাঁ, রামিম এরপর? মুগ্ধ কিছু বলো? রামিম গাধাটা কি করেছে আবার?
— জেনি রামিম হসপিটালে…
ওপাশ থেকে চিৎকার দেওয়া কন্ঠস্বর পাওয়া গেলো! জেনি খুব সম্ভবত চিৎকার দিয়ে দাড়িয়ে পড়েছে! দুজনের কলের মধ্যে এমন নিবরতা চললো, মুগ্ধ ফোন কেটে দিলো। মম পাশ থেকে সব অবলোকন করছিলো। এই প্রথম মুগ্ধকে চুড়মার অবস্থায় দেখতে পেলো!! ইচ্ছে করছিলো মুগ্ধকে শান্ত করার, কিন্তু কিছুতেই করবেনা মম নিজের পরাজয় স্বীকার!
ফোন কলটা করার বোধহয় মিনিট বিশেক পেরুলো, ওমনেই হৈচৈ করে জেনি, রিমি, আহাদ, নাসিফ ও তন্ময় চলে এলো। মুগ্ধ ওদের দেখে সিট ছেড়ে গিয়ে দৌড়ে কাছে গেলো! তন্ময়, আহাদ, নাসিফ, মুগ্ধ – চারজনই গলা জড়িয়ে রামিমের জন্য কাদঁছে! সবচেয়ে বেশি কাদঁছে জেনি ও রিমি!বাচ্চাগুলোর খেলনা নিলে ঠোট উল্টে যেভাবে কাঁদে, জেনি সেই বাচ্চার ন্যায় ডুকরে ডুকরে কাদঁছে। রিমি জেনিকে আগলে ধরে নিশব্দে কাদঁছে। ছেলেরা বেশিরভাগ দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে। শুধু তন্ময় ও আহাদ রিমি, জেনির সাথে সিটে বসে আছে। আমি চুপচাপ জানালা দিয়ে আকাশে তাকিয়ে আছি। যদিও রামিম আমার কেউ না, তবুও মনুষ্যত্বের খাতিরে ওর জন্য বুকফাটা কষ্ট হচ্ছে। হুর হুর করে সময়ের পাল্লা আরো কেটে গেলো। এখনো কোনো খবর আসছেনা! এক নার্সকে ধরে জানা গেলো, রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক! রক্ত লাগবে, ‘ও-পজেটিভ’ এখন সেটাই জোগাড় করতে হবে তিনব্যাগ! মুগ্ধ নার্সের কথা শুনেই পরিচিত কিছু ব্লাডব্যাংক ও ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করলো! ব্লাডব্যাংকে একব্যাগ পাওয়া গেছে! আরো দুই ব্যাগ লাগবে। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো ব্লাডব্যাংকটা এখান থেকে দুইঘন্টার দূরে! ওদের ছয়জনের মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট! হঠাৎ মুগ্ধ প্রশ্ন ছুড়ে বললো,
— জেনি? তোর ব্লাড গ্রুপ না ‘ও-পজেটিভ’?
— হ্যাঁ মুগ্ধ! বাট আমার খুব এর্লাজী! আই কান্ট ডোনেট, মাই ব্লাড টু রামিম!
আরো কিছুক্ষন ভাবলো! এর মধ্যে চোখ তুলে জেনি আহাদের দিকে তাকালো!
— আহাদ? এজ ফার আই রিমেম্বার! তোমার ব্লাড গ্রুপটাও ও-পজেটিভ! ব্লাডটা তুমি কেনো দিচ্ছো না?
আহাদের মুখ শুকিয়ে গেলো। শুকনো মুখে একটু রস এনে ইচ্ছাবিরোধী হাসিতে বললো,
— আর ইউ কিডিং, জেনি? লাস্ট মান্থ আমি ব্লাড ডোনেট করেছি, আর এখন আবার কাউকে ব্লাড দিবো? আমার এই শরীরটা কি জানে কুলাবে?
জেনি চেচিয়ে উঠলো,
— হোয়াট? তুমি কি বললে, আবার বলো তো! তুমি এই ”কাউকে” দ্বারা কাকে মিন করছো? এখানে রামিমকে তুমি কাউকে বলেছো, আহাদ? রামিমকে? আর লাস্ট মান্থে তুমি কোথাও ডোনেট করতে যাওনি! গিয়েছো, ফোর মান্থস বিভোর!
মুগ্ধ কপালকুচকে আহাদের দিকে এগুলো! তপ্ত শ্বাস ছেড়ে মুগ্ধ বলে উঠলো,
— তুই ব্লাড দিবি নাকি দিবিনা? পরিস্কার করে বল।
— দোস্ত? প্লিজ বুঝার চেষ্টা কর! আমার এমনেই গত ক’মাস ধরে রক্ত স্বল্পতা চলছে…
জেনি গর্জে উঠে কথা ছিনিয়ে বলে উঠে,
— তোমার কি পিরিয়ড চলে? হ্যাঁ? কিসব ভাওতাবাজি করছো আহাদ! লাইনে আসো সময় থাকতে!ব্লাড দাও।
মুগ্ধ বিরক্ত গলায় বলে উঠে,
— ইশশ জেনি চুপ করো! কি থেকে কি বানিয়ে ফেলছো?
— না না, ওর কি মাসে মাসে পিরিয়ড চলে নাকি জিজ্ঞেস করো! খামোখা আমাদের একটা বুঝাবে, আর আমরাও ওর তালে তালে নাচবো, এসব তো চলবে না! এখানে রামিমের জীবন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে মুগ্ধ!
মুগ্ধ আহাদের দুই কাধে হাত রেখে বললো,
— আচ্ছা তোর মেইন সমস্যাটা কোথায় খুলে বল তো? তুই ব্লাড কেনো দিতে চাচ্ছিসনা, ভ্যালিড আন্সার দে!
— আআরে বললামতো ব্লাড শর্টেজ..
কথাটুকু শেষ হতেই ঠাস করে থাপ্পর বসালো মুগ্ধ! গালে হাত থিয়ে অপরাধী ভঙ্গিতে চোখ নিচু করে আছে আহাদ। পাশ থেকে জেনি বলে উঠলো,
— ওয়েল ডান মুগ্ধ! কাজটা আগেই করা উচিত ছিলো!
— হুঁশ ফিরছে তো? যা! ব্লাড দেওয়ার মতো মহান কাজটাও করে ফেল এখন!
মুগ্ধ আহাদের ঘাড়টা ধরে তন্ময়, নাসিফ ও রিমির সাথে ব্লাড দিতে পাঠালো। জেনি ও মুগ্ধ চুপচাপ বসে আছে। জেনির অক্ষিকোটরটা মমর দিকে ঘুরতেই মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করে বসলো,
— মুগ্ধ? এই মেয়ে এখানে কেনো?
মুগ্ধ একপলক মমর দিকে তাকিয়ে জেনির দিকে মুখ ফিরালো। জেনি মুগ্ধের দিকে উত্তর পাবার আশায় উশখুশ করছে,
— বিয়ে করবো। হবু বউ।
জেনি সপ্ত আকাশ বাদ দিয়ে অষ্টাকাশে আশ্চর্যের সীমা ছুড়ে মেরেছে। মুগ্ধ এতো বড় কথা শান্ত গলায় বললো কীভাবে?
— এই মেয়েকে বিয়ে করবা? পাগল হইছো?এই থার্ড ক্লাসকে বিয়ে করে বউ বানাতে চাও! মাই গড!
— উফ জেনি, বাড়াবাড়ি করবিনা কিন্তু! চুপচাপ বস এমনেই রামিমের সিচুয়েশন আহামরি ভালো না।
অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এলো। মুখের মাস্কটা খুলে নার্সের সাথে কথা বলতেই মুগ্ধ, জেনি দুজন এগিয়ে গেলো।
— রামিম কেমন আছে ডক্টর!! ইজ হি ফাইন? আউট অফ ডেন্জার??
ডাক্তার হালকা কেশে গলা ঝেড়ে বলে উঠলো,
— ডেন্জার সিচুয়েশন ওভারকাম হয়েছে। বডির অনেক জায়গায় স্টিচ লেগেছে। বাট পেশেন্টের জ্ঞান ফিরার উপর ডিপেন্ড করছে। আপনারা ওনার কি হন?
— রামিম আমাদের বন্ধু ডক্টর!
— ওকে। তো একটা ইর্ম্পট্যান্ট কথা আপনাদের বলা দরকার।
— কি কথা ? গুরুতর কিছু?
— না। আগে এক্সিডেন্ট রিলেটেড কিছু তথ্য আমায় বলতে হবে। কিছু জিনিস কনর্ফাম হওয়া জরুরী।
মুগ্ধ ও জেনি ডাক্তারের কথা শুনে একে অপরের মুখ চাওয়া চাইয়ি করলো। ডাক্তার আবার বলে উঠলো,
— দেখুন ভয়ের কারন নেই। আপনারা প্লিজ বলুন, এক্সিডেন্টটা কোথায় ও কিভাবে হয়েছে।
মুগ্ধ ও জেনি এখনো চুপ! ডাক্তার তার কাঙ্ক্ষিত উত্তর পাওয়ার আশায় অপেক্ষা করছে। মম সবটা আন্দাজ করে ডাক্তারের কাছে এসে বললো,
— ঘটনাটা আমি বলছি। মুগ্ধের ফোনে রামিমের কল আসে। রামিম গোঙানি ছাড়া ক্লিয়ার কোনো কথা বলতে পারছিলো না। মুগ্ধের সন্দেহ হয় এবং রামিমের জিপিএস ট্র্যাক করে স্পটে পৌছাই। সেখানে গিয়ে দেখি গাড়ির ফ্রন্টলাইট ও ড্রাইভিং পার্টটা বাদে অলরেডি গাড়ির সেভেনটি পার্সেন্ট চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। গাড়ির বামপাশটা থেবড়ে ছিলো। রামিম সেখানে ছিলো না। ওকে ওখানকার লোকজন তুলে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। এই হচ্ছে ঘটনা ডাক্তার…
ডাক্তারের মুখে চিন্তার রেশ ফুটে উঠলো। দুমিনিটের মতো চশমার আড়ালে চোখদুটোকে স্থির রেখে ভাবলো। তারপর গম্ভীরভাবে বললো,
— পেশেন্টের ইনজুরি দেখে মনে হচ্ছেনা এটা কোনো নরমাল এক্সিডেন্ট! আপনি বললেন গাড়ির বামপাশটা বেশি থেবড়ে ছিলো। আই থিংক এটা কোনো রোড এক্সিডেন্ট না!
সবার ভ্রুযুগল একসাথে কুন্ঞ্চিত হলো! বিষ্ময়সূচকে বলে উঠলো,
— মানে!
— মানেটা খুব সিম্প্যাল! পেশেন্টকে মার্ডার করার চেষ্টা করা হয়েছে। কোনো গাড়ি এভাবে এক্সিডেন্ট হলে সেখানে ট্রাক বা বাসের যাত্রীরাও আহত থাকতো, কিন্তু আপনারা এসেছেন কেবল একজন পেশেন্ট নিয়ে। তাও গাড়িটার! ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন তো?
ডাক্তার প্রস্থান করলেন। জেনি বিড়বিড় করে কিছু বলছিলো যা কানে পৌছানোর মতো না। মম সিটে বসতেই পাশের সিটে মুগ্ধ ধপ করে বসলো। মুগ্ধ শান্ত গলায় বলতে লাগলো,
— রামিমের এক্সিডেন্ট হয়নি। ফ্লোলেস মার্ডার হয়েছে! ফ্লোলেস মার্ডার! কে করবে এটা? কার এতো সাহস?
মম বলে উঠলো,
— আমার মনেহয় তোমার কাছের লোক। আচ্ছা আমি তাহলে উঠি। এখানে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি হাসপাতাল একদম পছন্দ করিনা। আসি।
— আজব! কোথায় যাবা তুমি? আমার সাথে এসেছো আমার সাথেই যাবা! বসে থাকো এখানে! সকাল হলেই বিয়েটা করবো!
— আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইনা মুগ্ধ। প্লিজ বাচ্চামো না করে ব্যাপারটা বুঝো। আমাকে যেতে দাও। আর যদি হেল্প করতেই পারো তাহলে আমার পরিবারকে ছেড়ে দাও।
মুগ্ধ মমর হাতটা ধরলো! যাকে বলে ‘বজ্র আটুনি’! হাতের ‘রেডিও’ ও ‘আলনা’ যেনো মটমট করে ভেঙ্গে যাবে এখনই! মুগ্ধ শান্ত থেকে ক্ষান্ত গলায় কনভার্ট করে বলে উঠলো,
-চলবে
-ফাবিয়াহ্ মম