“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৩২

0
2724

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩২
(নূর নাফিসা)
.
.
– তাহলে তুমি তোমার বাবার বাড়ি চলে যাও। সেখানে তোমাকে না খায়িয়ে রাখবে না! আমি না হয় অন্য কোনো ব্যবস্থা করে নেই।
– কিহ!
-জ্বি।
– তবুও আপনি শুধরাবেন না!
মেহেদী শার্ট চেঞ্জ করতে করতে বললো,
– যেমন আছি, বেশ আছি!
নাহিদা এবার সিরিয়াস মুডে বললো,
– এমন কেন আপনি! কোনো মানুষ বলে আপনাকে আখ্যায়িত করা যায়! দিনরাত প্রতিটি সময় আপনি বাবা মা কে অবহেলা করে, অমান্য করে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছেন। সেই খেয়াল কি আপনার আছে! কীজন্য দুনিয়াতে জন্ম নিয়েছেন আপনি? পিতামাতাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য? আপনার পিতামাতা বলে তো এখনো আদরে রেখেছে। অন্যান্যদের মতো হলে পুত্রের আসন হতে ত্যাজ্য করে দিতো!
– দ্যাটস গুড, এজন্যই আমি ত্যাজ্য নই!
– সব কথাই তো মজা করে উড়িয়ে দেন! এমনটা কি ভেবেছেন কখনো যে পিতামাতা কি চায় একটু ভেবে দেখি! পিতামাতা আমাকে নিয়ে এতো টেনশন করে আমি একটু তাদের টেনশনমুক্ত করার চেষ্টা করি! তাদের একটু খুশি রাখার চেষ্টা করি! অহংকারের সন্তান হয়ে দেখাই, সকলের কাছে মর্যাদা সমেত পাত্র হয়ে দেখাই! মানুষ তো জন্ম লাভ করে সেই সুত্রেই! আর আপনি কি করছেন!
– বেশি কথা বলো না। মেয়ে মানুষ চুপচাপ থাকাই শ্রেয়।
– রাখেন আপনার শ্রেয়! আপনি কি নিজেকে পুরুষ বলে দাবি করেন নাকি! জন্মগত ভাবেই আল্লাহ তায়ালা পুরুষকে অধিক শক্তি দিয়ে তৈরি করেছেন। আর আপনি, মেয়েদের থেকেও নিকৃষ্ট! আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখুন মেয়েরাও নানান কাজে জড়িয়ে আছে পেটের দায়ে, সংসারের টানে! আপনার মতো ঘরের কোনে বসে নেই। বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা কি জিনিস, পার্টি কাকে বলে তা সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণই অজ্ঞাত! উচিৎ কথা বলতে গেলেই আমি বেশি বলে ফেলি! কেন বলি সেই মর্মটা কি একবার বুঝতে চেষ্টা করেছেন!
– তোমার বুঝ তোমার কাছেই রাখো। আর ইচ্ছে হলে আশেপাশের মতো তুমিই জড়িয়ে পড়ো কাজে।
– আপনার যেই অবস্থা দেখছি এখন আমাকেই জড়াতে হবে কাজে! কি আর করার! আমার হাতে টান পড়লে তো আর এদিক সেদিক থেকে টাকা এসে পড়ে না! আমার পেটের দায়ে তো আর কারো কিছু আসে যায় না! তার ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে। বসে থাকুন আপনি ঘরের কোনে।
নাহিদা কাপড়চোপড় ওয়ারড্রবে রেখে ঠাস করে ড্রয়ার লাগিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে! মেহেদী ফ্রেশ হয়ে কিচেনে এসে দেখলো মেহেরুন ইসলাম রান্না করছে। মেহেদী পাতিলের ঢাকনা সরিয়ে দেখতে দেখতে বললো,
– আজ রান্না এতো দেড়ি কেন, আম্মু!
– ডাকবি না আমাকে আম্মু! আমি তোর কিছু হইনা! তোর মতো ছেলের আম্মু হয়ে থাকতেও চাই না! কতো শখ ছিলো, ছেলেকে সুন্দরভাবে মানুষ করবো। সকলের প্রিয় পাত্র থাকবে আমার ছেলে! সবার মুখে মুখে প্রশংসা থাকবে আমাদের ছেলের জন্য! ছেলে বড় হবে, উপার্জন করে মুখে দু মুঠো ভাত তুলে দিবে! ছেলের উপার্জনে পেট পুরে আহার করবো। ছেলে বিয়ে করবে, সংসার সাজাবে। সজ্জিত সংসার আলোকিত করতে একসময় নাতি নাতনি আসবে। আমি জীবনের বাকিটা সময় তাদের নিয়ে খেলা করে কাটিয়ে দিবো! সেই কপাল কি আমার আছে! ছেলেকে আজ পর্যন্ত যোগ্য মানুষ হিসেবেই গড়ে তুলতে পারলাম না। শুধু শুধু এতো লম্বাটে স্বপ্ন দেখে কি হবে!
মেহেদী কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো কিচেন থেকে। মেহেরুনের বকবকানি চলছেই। নাহিদা তাকে বলছে, “থাক মা। ওসব বলে লাভ নেই। আপনার ছেলের কানের অগ্রভাগেও যায় না সেসব।”
ইশার নামাজ পড়ে জহিরুল ইসলাম বাড়িতে এসেছেন। তার পরপরই মেহেদী এসেছেন। নাহিদা চুপচাপ টেবিলে খাবার সাজাতে লাগলো। মেহেদী এসে চেয়ার টেনে বসলো। মেহেরুনও চুপচাপ খাবার প্লেটে দিতে লাগলো। নাহিদাকে বললো,
– নাহিদা, বসে পর।
– না, মা। আপনারা খেয়ে নিন। আমার পেট ভরা।
– পেট ভরা মানে! দুপুরেও খাওয়া হয়নি তোর। কি খেয়েছিস পেট ভরা যে!
– কখনো কখনো মুখের কথাতেই পেট ভরে যায় মা। আমার ভালো লাগছে না। এখন খাবো না আমি। শুধু শুধু জোর করে ভাত নষ্ট করার প্রয়োজন নেই।
নাহিদা মেহেদীর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে না খেয়ে রুমে চলে গেলো। মেহেদী খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। জহিরুল ইসলাম এসে চেয়ারে বসে বললেন,
– ইশার নামাজ পড়েছো তুমি?
– না।
– তাহলে মুখে খাবার তুলছো কোন সাহসে? নামাজ থাকবে না, কাজকর্ম থাকবে না, অন্নও থাকবে না।
কথাটা বলার পরপরই মেহেদী খাওয়া ছেড়ে প্লেট রেখে চলে গেলো। মেহেরুন বললো,
– এটা কি করলে! এখন যে না খেয়ে চলে গেলো! খাওয়ার মাঝে কথাটা না বললে হতো না!
– না, হতো না। এখনই বলা প্রয়োজন ছিলো। যাওয়ার হলে যাক চলে। যার কাজ নেই তার আহারও নেই।
মেহেদী কিচেনে হাত ধুতে ধুতে তার বাবামায়ের কথা শুনেছে। সে হাত ধুয়ে কিচেন থেকেই পানি পান করে সোজা রুমে চলে গেলো। নাহিদা বিছানা ঠিক করে শুয়ে আছে। মেহেদীকে রুমে ঢুকতে দেখে সে চোখ মুছে চোখের পাতা বন্ধ করে ফেললো। মেহেদী দরজা লাগিয়ে বিছানায় চলে এলো। ফোনে কল আসতেই সে রিসিভ করে বললো, “এখন আসতে পারবো না। তোরা যা। ঘুমাবো আমি।” এটুকু বলেই সে কল কেটে তার চাদরটাও ছড়িয়ে নাহিদার উপর দিলো। তারপর সে নাহিদার সাথে ডবল চাদরের নিচে চলে গেলো। নাহিদার বালিশে শুয়ে সে পেছন থেকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে রাখলো। তার উপর মেহেদীর হাত রাখায় নাহিদা চমকে উঠলো! সে চোখ খুলে দেখলো রুম অন্ধকার! ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরতে গেলে বুঝতে পারলো মেহেদীর মাথাটা তার মাথার সাথে লাগানো। সে এতো তারাতাড়ি চলে এলো কেন! এতো তারাতাড়ি তো খাওয়া শেষ হওয়ার কথা নয়! নিশ্চয়ই খায়নি কোনো কারনে! আবার এখানে এসে গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লো কেন! নাহিদার মনে নানান ভাবনা উঁকি দিচ্ছে! সে কি এখন স্বাভাবিক আছে নাকি মাতাল! সে ড্রিংকস করে আসেনি তো আবার!
ভাবতে ভাবতে নাহিদা হাতটা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই মেহেদী আরও জড়ো হয়ে বললো,
– সমস্যা কি! আমি তোমার হাসব্যান্ড না? ঘুমাও চুপচাপ।
মেহেদীর আচরণ নাহিদার মাথায় ধরছে না! এখন তার সাথে কথা বলারও কোনো ইচ্ছে নেই। তাই চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়েই রইলো সে। আর চোখের পাতার নিচে ঘুরপাক খাচ্ছে নানান ভাবনা!
সকালে এলার্মের শব্দ শুনে ঘুম ভাঙলো নাহিদার! কিন্তু এটা তার ফোনের এলার্ম না! মেহেদীর ফোন বেজে চলেছে। নাহিদা চোখ খুলে অনুভব করতে পারলো সে মেহেদীর বুকের সাথে মিশে আছে! হাত পেছনের দিকে নিয়ে টাইম দেখার জন্য তার ফোন খুজতে লাগলে মেহেদী তার উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলো। সেও জেগে গেছে। লাইট অন করে সে এলার্ম বন্ধ করলো। এবং বাথরুমে চলে গেলো। মাত্রই নাহিদার এলার্ম বাজতে শুরু করলো। সে উঠে বসে এলার্ম বন্ধ করলো। মসজিদের আযান শোনা যাচ্ছে। আর নাহিদা বসে বসে হাই তুলছে! বেশ কিছুক্ষণ পর মেহেদী ওযু করে বেরিয়ে এলো। ওয়ারড্রবের উপর থেকে টুপিটা নিয়ে সে বেরিয়ে গেলো। যদিও মেহেদীর আচরণে সে অবাক তবুও নাহিদার ভালো লাগলো তা দেখে। কিন্তু সে তো সবসময় নামাজ পড়ে না! আনন্দ ও হতাশা মিশ্রিত এক নিশ্বাস ফেলে সে ওযু করতে চলে গেলো। নামাজ পড়ে কুরআন পাঠ করলো। অত:পর বিছানাপত্র গুছিয়ে রুম গুলো ঝাড়ু দিতে লাগলো। ঝাড়ু দেওয়ার শেষ পর্যায়ে মেহেদী বাড়িতে ফিরেছে। তার হাতে একটা প্যাকেট। সে রুমের দিকে যেতে যেতে নাহিদার উদ্দেশ্যে বললো,
“ঝাড়ু দেওয়া শেষ করে রুমে এসো।”
নাহিদা ঝাড়ু দেওয়া রেখে মেহেদীর যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে রইলো! মেহেরুন তখন পানির জগ নেওয়ার জন্য ড্রয়িং রুমেই ছিলো। তিনিও একটু অবাক হয়ে মেহেদীর হাতের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেহেদী চলে যাওয়ার পর নাহিদাকে ইশারা করে জিজ্ঞাসা করলো, “কি?” নাহিদাও ইশারায় মাথা নেড়ে জবাব দিলো, “জানি না!”। ঝাড়ু দেওয়া শেষ করে নাহিদা রুমে এলো। মেহেদী তাকে বললো,
– হাত ধুয়ে এসো।
– কেন?
– কেন আবার! যেতে বলেছি যাবে!
নাহিদা বাথরুমে এসে হাত ধুয়ে রুমে এলো। মেহেদী ছোট টেবিলের উপর প্যাকেট খুলে বসেছে। নাহিদা এগিয়ে এসে দেখলো পরটা ভাজি নিয়ে এসেছে! সে মেহেদীর দিকে তাকাতেই মেহেদী বললো,
– দাড়িয়ে আছো কেন? বসো এখানে। পরটা ভাজি খাও। এটাই সকালের নাস্তা।
– সকাল সকাল পরটা ভাজি! আমি খাবো না। আমার গ্যাস্ট্রিকের প্রব্লেম আছে।
– প্রব্লেম থাকলেও এটাই খেতে হবে। নয়তো খাবার পাবে না। মাস শেষ হবে তারপর ভাত খেতে পাবে।
– মানে!
মেহেদী তার হাত টেনে বসিয়ে বললো,
– মানে পরে বুঝে যাবে। এখন চুপচাপ খাও। খাওয়ার পর বেশি করে পানি খাবে তাহলে আর প্রব্লেম হবে না। ধরো।
নাহিদা একটা পরটা হাতে নিলো। মেহেদী খেতে খেতে বললো,
– আম্মুর কাজে হেল্প করার হলে করবে কিন্তু কিছু খাবে না। মনে থাকবে?
– কেন?
– সব কথার এতো মানে আর কেন খুজো কেন! খাবে না বলেছি, তো খাবে না। আমি উপার্জন করবো, খাবার কিনে আনবো তারপর খাবে। মনে থাকবে তো?
নাহিদা চরম অবাক! সে খাবার মুখে রেখেই জবাব দিলো,
– হু।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here