“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৩৬

0
2790

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৩৬
(নূর নাফিসা)
.
.
মেহেদী চলে গেলো আর নাহিদা গালে হাত রেখে দাড়িয়েই রইলো! তার মুখে ফুটে উঠেছে হাসির রেখা, মনে জানান দিয়েছে অন্যরকম এক ভালো লাগা! মানুষটা কোন প্রকৃতির, সেটা বুঝা মুশকিল! কখনো মনে হয় পাগল, কখনো বাজে লোক, কখনো জোকার আবার কখনো মনে হয় একজন আদর্শ স্বামী হওয়ার চেষ্টা করছে! তা যদি হয় তাহলে তো জীবনটাকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলার স্বপ্নটা দেখতে শুরু করবে সে। দু’হাতে আঁকড়ে ধরবে নতুন পৃথিবী!
আনন্দে বিমোহিত মনে নাহিদা রুমটা গুছিয়ে নিলো। মেহেদীর জামাকাপড় ধুয়ে সে নাস্তা করতে বসলো মেহেরুনের সাথে। মেহেরুন ইসলাম বললো,
– ভার্সিটি যাস না কেন? ক্লাস চলে না?
– হ্যাঁ, চলে।
– তাহলে?
– এমনি।
– এমনি বললে হবে না! পড়াশোনা চলমান রাখতে হবে। তোর বাবাকে বলে এনেছি আমি, পড়াশোনা যতদূর করতে পারিস সব ব্যবস্থা আমি করে দিব। নিয়মিত ক্লাস কর। আজও তো যেতে পারবি। ক্লাস করে আয়। সংসারের কাজে মন না বসিয়ে পড়াশোনায় মনযোগ দে। আর গাধাটাকে একটু আঁচলে বেধে রাখ। আমি যতদিন বেচে আছি, এছাড়া আর কোনো কাজ নেই তোর।
– আজ যাবো না। শনিবার থেকে দেখি।
– আচ্ছা।
নাস্তা করে দুজনেই মেহতাজের সাথে ভিডিও কলে কথা বললো এবং আয়াশ ও আরিশার সাথেও কথা বললো। দুপুরে জহিরুল ইসলাম বাড়ি ফিরেছেন সাথে নিয়াজ উদ্দিনকে নিয়ে। অফিস যাওয়ার সময় মেহেদী রিকশায় গেলেও আসার সময় গাড়িতে এসেছে নিয়াজ উদ্দিন তাদের বাড়িতে আসছে বলে। এতোদিন পর বাবাকে দেখতে পেয়ে নাহিদা খুব খুশি। দুপুরে খাওয়াদাওয়া হলো একসাথে। নাহিদার খুব ইচ্ছে করছে বাবার সাথে বাড়িতে যেতে। নিয়াজ উদ্দিন জহিরুল ইসলামের সাথে ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলার সময় নাহিদা মেহেরুনের রুমে এলো।
– মা?
– হ্যাঁ, আয়। কিছু বলবি?
– অনেকদিন হলো মায়ের সাথে দেখা হয় না। একদিনের জন্য যাই বাবার সাথে?
মেহেরুন ইসলাম মুচকি হেসে বললেন,
– ছেলের বউ করে এনেছি বলে কি ঘরবন্দী করে রাখবো! যখন ইচ্ছে মায়ের সাথে দেখা করে আসবি। যতদিন ইচ্ছে থেকে আয়। তবে আবার মাস পাড় করে দিস না! আমারও যে একা থাকতে ভালো লাগে না!
– তাহলে আপনিও চলুন।
– আমি গেলে কালকেই তোকে চলে আসতে হবে। তার চেয়ে একাই যা। থেকে আয় দুচারদিন। মেহেদীকে বলে দেখ যায় কি-না।
– আচ্ছা।
নাহিদা তার বাবাকে বলে খুশি মনে রুমে এলো। মেহেদী টিশার্ট জিন্স পড়ে রেডি। কোথাও যাওয়ার জন্য বের হবে মনে হচ্ছে! নাহিদা জিজ্ঞেস করলো,
– কোথাও যাবে?
– হ্যাঁ। কেন?
– বাড়িতে যাবো।
– এখন কি রাস্তায় দাড়িয়ে আছো?
– বাবার বাড়িতে যাবো। মাকে বলেছি। মা বলেছে যেতে। যাবে না?
– মাথা খারাপ তোমার! সকালে মাত্র কন্ট্রাক্ট পেপার সাইন করিয়েছি আর তুমি এখনই চলে যাবে! মাস শেষে পুরো পাচ হাজার টাকা দিতে হবে! তুমি চলে গেলে কিভাবে! খেয়ে খেয়ে টাকার উশুল তুলতে হবে না!
– কি আযব কথাবার্তা বলছো! বাবার খরচ বাচবে এতেও হিংসে করতে হবে! আমি কতদিন হলো এসেছি, মায়ের সাথে দেখা হয় না! যাই একটু? চারদিন থেকে চলে আসবো।
– চারদিন! বারো বেলার খাবার লস!
মেহেদীর এই তামাশা মোটেও ভালো লাগছে না। নাহিদা গোমড়া মুখু হয়ে তাকিয়ে রইলো! মেহেদী তাকে আয়না দেখে বডি স্প্রে করতে করতে বললো,
– বাবার সাথে তুমি যাও। আমার কারো বাড়িতে যেতে ভালো লাগে না।
– প্রথম বার বেড়াতে যাবো, তা-ও একা?
– তো কি হয়েছে! গেলে যাও, না গেলে নেই!
– গেলে কি হয়!
– আমি বেইলি রোড যাবো এখন।
নাহিদা মুখটা মলিন করে তার ব্যাগ গুছাতে লাগলো। মেহেদী তৈরি হয়ে বসে আছে। নাহিদাকে এতো ধীরে ধীরে গোছগাছ করতে দেখে বললো,
– এতোক্ষন লাগে ব্যাগ গুছাতে! ঝটপট করো।
– আপনার এতো তাড়া কেন! আপনি কি যাবেন সাথে!
– ক্ষনে তুমি আবার ক্ষনে আপনি! এটা কেমন ভাষা! বারবার এমন ভাষা চেঞ্জ করো না তো! আপনি করে বললে নিজেকে বুড়ো বুড়ো লাগে! আর মনে হয় সত্যিই আমি তোমার নানা! কেননা সবাইকে তুমি করে বললেও নানাকে আপনি করে বলতাম! এনিওয়ে, তোমরা বের হলে আমি বাসা থেকে বের হবো। তাই তাড়া দিচ্ছি। তারাতাড়ি করো, নয়তো বলো আমি গুছিয়ে দেই।
নাহিদা কোনো প্রতিক্রিয়া জানালো না। সে তার কাজ করেই যাচ্ছে। বাথরুমে জামা পাল্টে এসে বোরকা হাতে নিয়েছে। মেহেদী পেছনের দিকে দুহাত রেখে খাটে ভর দিয়ে হেলে বসে আছে আর পা নাড়াচ্ছে! দৃষ্টি নাহিদার দিকেই। তাই নাহিদা বোরকা পড়তেও যেন লজ্জা পাচ্ছে। সে বাথরুমে গিয়েই বোরকা পড়ে এলো। যতক্ষণ পর্যন্ত হিজাব পড়লো ততক্ষণ পর্যন্ত আয়নায় তাকে দেখছিলো মেহেদী। নাহিদার তখনও খুব অসস্তি লাগছিলো! কি দেখছে সে এমন করে! এভাবে কারো দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়! এতক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকলে একটা মানুষের ভেতর কতোটা অসস্তির সৃষ্টি হতে পারে তার কি জানা নেই! জানবে কি করে, তার মাঝে তো কোনোরকম অনুভূতিই নেই!
ভাবতে ভাবতে নাহিদা তার হিজাব গাথা শেষ করলো। মেহেদীর এমন দৃষ্টান্ত দেখে সে তারাতাড়ি করতে গিয়ে উল্টাপাল্টা লাগিয়ে আরও দেড়ি করে ফেলেছে। জুতা পড়ে সে লাগেজ হাতে নিলে মেহেদী উঠে এসে লাগেজ হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নাহিদা তার পিছু পিছু বেরিয়ে মেহেরুনের কাছে বিদায় নিয়ে বের হলো। জহিরুল ইসলামের কাছ থেকে মেহেদী গাড়ির চাবি নিয়ে নিয়াজ উদ্দিন ও নাহিদাকে গাড়িতে উঠতে বললো। মেহেদীর হাবভাব দেখে নাহিদার মনে হচ্ছে মেহেদী যাচ্ছে তাদের সাথে। আবারও মনে হচ্ছে যদি সে যায় তাহলে ড্রাইভারকে নিলো না কেন!
বাড়িতে এসে মেহেদী নাহিদার লাগেজ ঘরে দিয়ে নাফিসা ও রুমানা বেগমের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করলো। তখনই নাহিদা জানতে পারলো মেহেদী চলে যাবে! তাদের পৌছে দেওয়ার জন্য এসেছে সে! রুমানা থাকতে বললো কিন্তু সে কাজের তাড়া দিলো। বেরিয়ে আসার সময় নাহিদাকে বললো,
– চলে যাচ্ছি আমি।
নাহিদা মালিন মুখে বললো,
– শুধু শুধু আসার কি দরকার ছিল! অন্য গাড়ি করে বাবা আর আমি আসতে পারতাম!
মেহেদী ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– না এলে যে গাড়িটা নিতে পারতাম না আব্বুর কাছ থেকে! এসেছি আর রাত পর্যন্ত লং ড্রাইভের একটা সুযোগ পেয়েছি! আল্লাহ হাফেজ।
– সাবধানে যেও, আর রাতে বাইরে থাকার প্রয়োজন নেই। কাল ছুটির দিন। সারাদিন গাড়ি ও মানুষ দুজনেই ফ্রী।
– তোমার শ্বশুর মশাই ফ্রী না।
বলতে বলতে মেহেদী বেরিয়ে গেলো। নাফিসা লাফিয়ে এসে নাহিদার দুকাধ ঝাপটে ধরে বললো,
– ভাইয়া কি বলেছে কানে কানে?
– তোর জানার কি প্রয়োজন!
– হুহ্! ঢং! আমি কিন্তু শুনে ফেলেছি!
– তাহলে তো শুনেছিস ই! জিজ্ঞেস করার কি আছে! সর!
– হিহিহি… শুনিনি! যাইহোক কিউটিপাই, ভাইয়া কিন্তু ওভার স্মার্ট! চলাফেরা, হেয়ার স্টাইল, ড্রেস আপ, হ্যান্ড ওয়াচ প্লাস ব্রেসলেট! ওফ্ফ! জাস্ট পারফেক্ট!
নাহিদা হিজাব খুলতে খুলতে বললো,
– ব্রেসলেট! অন্যের হাতে দেখলে বলেন রিকশার টায়ার পড়ছে! আর নিজ ভাইয়ার হাতে দেখে এখন সেটা ব্রেসলেট হয়ে গেছে!
নাফিসা খিলখিল করে হেসে উঠলো এবং বললো,
– সেজন্যই তো বললাম ওভার স্মার্ট! তবে আরাফ ভাইয়ার স্মার্টনেস কিন্তু সবদিক থেকেই পারফেক্ট!
– হুম।
– মেহেদী ভাইয়াকেও মানায়! দেখতে একেবারে হলিউড হিরো! আজ শুধু সানগ্লাসটার অভাব ছিলো!
– সানগ্লাসটা পকেটে ছিল! বাবাকে দেখে পড়েনি তখন!
– অহ! আমি তো ভাবলাম সানগ্লাস আনেইনি! ইশ! নাজিয়া আপু এলেও খুব ভালো হতো!
– আপু কি এখন আসবে! মাত্র ক’দিন হলো গিয়েছে।
– সেটাই তো! ক’দিন থাকবে তুমি?
– দু-চার দিনের মতো।
– ভার্সিটি যাও না কেন? যাবে না আর?
– হ্যাঁ যাবো আগামী সপ্তাহ থেকে। চল, মায়ের কাছে যাই।
কিচেনে এসে নাহিদা বললো,
– মা, তুমি কি সারাদিন রান্নাঘরেই পড়ে থাকো!
– রাতের জন্য রান্না বসাবো না!
– দাও, আমি কেটেকুটে দেই।
– তোর শ্বশুর শ্বাশুড়িকে নিয়ে এলি না!
– বাড়ি ফাকা রেখে কি উনারা আসবে! তাছাড়া আমি দুচারদিন এখানে থাকবো, উনারা কি থাকবে! যাওয়ার সময় বললে আসবে।
– মেহেদীও তো তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো! কিছু একটা খেতেও দিতে পারলাম না!
– সুযোগ দিলে তো খাওয়াবে! তাছাড়া মাত্র খেয়ে এসেছে। কি যেন কাজে বেইলি রোড যাবে।
– রাতে আসবে?
– না।
মা ও বোনের সাথে গল্প করে কিছুক্ষণ মেহেদীকে ভুলে থাকলেও সন্ধ্যার সাথে সাথে নাহিদার মনেও ভয়ের অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে! মেহেদীকে নিয়ে তার যতসব ভয়! সে যে লং ড্রাইভের কথা বলে গেলো, সে কি কোনো পার্টিতে জয়েন করবে! তাদের তো অভ্যাস খারাপ! বন্ধুবান্ধব একসাথে হলেই পার্টি করে আর মাদক দ্রব্য সেবন চলে! এমন যেন না হয়, সেই প্রার্থনাই করে যাচ্ছে মনে মনে! মাগরিবের নামাজ আদায় করে সে মেহেদীর ফোনে কল করলো,
– আসসালামু আলাইকুম?
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।
– কে?
– নাহিদা বলছি।
– অহ! বলো…
– কোথায় আছো?
– বেইলি রোড।
– এখনো সেখানে!
– এলামই মাত্র!
– নামাজ পড়নি?
মেহেদী দুষ্টুমি মাখা কন্ঠে বললো,
– ইশারের আযান দেয়নি তো এখনো!
– মাগরিবেরটার কথা জিজ্ঞেস করেছি।
– মাগরিব উল্লেখ্য ছিল না!
– ওফ্ফ! এতো প্যাচাতে পারে কথা!
– হাহাহা… পড়েছি।
– বাসায় ফিরবে কখন?
– জানিনা।
– একটা কথা রাখবে?
– সম্ভব হলে।
– চাইলেই সম্ভব হবে।
– বলো।
– ফ্রেন্ডরা আছে সাথে?
– তাদের নামে বদনাম বলবে নাকি!
– ধুর!
মেহেদী আরও একবার হাহা.. করে হেসে বললো,
– কি যেন বলবে, বলো।
– তুমি কি আজও…
– কি আজও?
– মেসেজ করি, দেখে কেটে দিবে।
– ঠিকানা দেই, কানে কানে এসে বলে যাও।
– আমি মেসেজ দিচ্ছি কিন্তু…
কল কেটে নাহিদা দ্রুত মেসেজ করলো, “ড্রিংকস করো না প্লিজ! হারাম এসব! বাবা-মা জানতে পারলেও খুব কষ্ট পাবে। প্লিজ, রাখো এই কথাটা। ওসব বাজে অভ্যাস ছেড়ে দাও প্লিজ!”
মেসেজ সেন্ট করে তা ডিলিট করে নাহিদা রিপ্লাইয়ের আশায় বসে রইলো ফোন হাতে নিয়ে। কলেই বলতো কিন্তু নাফিসা অথবা তার মা যাতে শুনতে বা আন্দাজ করতে না পারে সেজন্য মেসেজ করে দিলো। কিন্তু মেহেদীর যে কোনো রিপ্লাই আসছে না! সে কি মেসেজ দেখেনি! নাকি দেখে তার অনুরোধ মানতে পারছে না বলে রিপ্লাই করছে না!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here