শেষ গোধূলি পর্ব:০২

0
1266

শেষ গোধূলি
পর্ব:০২
নাহিয়ান

পরদিন নিজের বাড়ির নিচতলায় চেম্বারে বসে মিঃ রহমান রোগী দেখা সবে শেষ করে ভাবছেন, আসলেই ওনার সংসারের উপর তিক্ততা অনেক আগেই এসে গিয়েছে। নিজের পিতা একজন দারোগা ছিলেন। ওনার চতুর্থ স্ত্রীর তৃতীয় সন্তান উনি। মেঝ ভাই পড়াশোনায় ব্রিটিশ আমলে মাধ্যমিক পাশ। কিন্তু অত্যন্ত বিধ্বংসী তার আচরণ। পানিতে ডুবে মারা গিয়েছেন। বড় ভাই পড়াশোনা নিয়ে বেশি ভাবেননি। বাবাকে উনি খুব ছোট থাকতে দেখেছিলেন। আবারও ওনার মাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন ওনার বাবা। খুব কষ্ট করে মানুষ হতে হয়েছে তার। যদিও সম্পদ ছিলো। তবুও তা ব্যবহারের অনুমতি পাননি। বাড়ি বাড়ি লজিং থেকে পড়াশোনা চালিয়েছেন। কোলকাতা মেডিকেল থেকে ডাক্তারি পড়ে ফিরে আসেন জন্মভূমিতে। জন্মস্থান ছেড়ে আরেক জেলায় বসবাস শুরু করেন। শহরের মাত্র দুটো সরকারি হাসপাতালের একটার সরকারি ডাক্তার উনি। দেশ স্বাধীন হয়েছে এক দশকও হয়নি।

ওনার স্ত্রী, রোজিনা রহমানের বড় ভাই ব্রিটিশ আমলে ভারতের ডায়মন্ড হারবার এলাকায় বসবাস করা SDO ছিলেন। বর্তমানে সচিব স্তরের লোক। সেখানেই বসবাস করতেন রোজিনা রহমান। মিঃ রহমান খুব ভালো করে বুঝতে পারেন, ওনার স্ত্রী অত্যন্ত অহংকারী। রোজিনা রহমানকে উনি উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর বিয়ে করেন। কোনোদিনও ঘরের কাজ করতে বলেননি৷ ওনার খেদমতের জন্য কাজের লোকের অভাব ছিলো না। সন্তান জন্ম দিয়ে কিছুকাল কোলে রেখে তুলে দিতেন কাজের লোকের হাতে। সাজগোজের প্রতি ঝোঁক ছিলো। ওনার গহনার শখ পূরণ করতে মিঃ রহমান নিজের চেম্বারে যে রোজগার হতো তার সম্পূর্ণটা নিয়ে ওনার স্ত্রীর সামনে রাখতেন প্রতিরাতে। শর্ত ছিলো, শত টাকা পূর্ণ হলে সেটা মিঃ রহমানের। আর খুচরা যা থাকবে তা ওনার। মিঃ রহমানের ভিজিট ফি ছিলো সবে তিন কি চার টাকা। ওনার স্ত্রী এমন কাজে সন্তুষ্টই ছিলেন। তারপরও চাহিদা ছিলো। রোজিনা রহমানের সব চাওয়াই পূরণ করতেন। কোথাও হয়তো ফাঁক ছিলো। অর্থের পিছনে ছুটতে গিয়ে সংসারে মন দিতে পারেননি খুব ভালো করে।

বড় মেয়ের পর বড় ছেলে ওনার। বড় মেয়ে মাধ্যমিক পাশ করার পরপরই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে যখন বি.এ পরীক্ষা দেবেন। তখন রোজিনা রহমানের শখ জাগে উনিও পরীক্ষা দেবেন। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন নারী উনি। মাত্র কিছুকাল পড়াশোনা করেছেন। মিঃ রহমান, যখন ওনার স্ত্রী পুত্রের পরীক্ষা চলে, তখন বাড়িতে কোনো অতিথি এলেও ওনার স্ত্রীকে বিরক্ত করতেন না। মূল বাড়ির সাথে লাগোয়া ছোট বাড়িটায় গিয়ে পড়তে বলতেন। ওনার স্ত্রী, ওনার মান রেখেছেন। উনি সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছেন, যেখানে ওনার বড় ছেলে থার্ড ক্লাস পেয়ে পাস করেছে।

এলাকার সবচেয়ে শিক্ষিত দম্পতি। এরপরও বোকামি আছে। কোনো সন্তানের পড়াশোনার পিছনে অর্থ খরচ করেননি। মিঃ রহমানের একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিলো, কষ্ট না করলে মানুষ হওয়া যায়না। ছেলেমেয়েদের বলতেন, উনি কষ্ট করে মানুষ হয়েছেন তাদেরও তাই হতে হবে। মেয়েদের খুব বেশি পড়াননি৷ বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। রোজিনা রহমানও ওনার এই ধারণা কোনোদিনও না ভেঙে বরং আরো বিশ্বাস করতে সাহায্য করেছেন। মেঝ ছেলেকে খুব বেশি ভালোবাসতেন রোজিনা রহমান। আর এতেই ছেলে বিগড়ে গিয়েছে। আর সেই বিগড়ে যাওয়াটা বাবার প্রথম অবহেলায় বিধ্বংসী রূপ নিয়েছে। এরপর বাবার অতিরিক্ত শাসন। তাকে একেবারে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছে।

মিঃ রহমান আবিষ্কার করলেন, ওনার নিজেরই রোজিনা রহমানের প্রতি অনীহা আর সংসারের প্রতি তীব্র তিক্ততার পিছনে মূল কারণ ওনার মেঝ ছেলেই।

_______

মিঃ রহমানের সবচেয়ে ছোট ছেলে, ওনার বড় দুই নাতনির থেকে বয়সে ছোট। বড় মেয়ের আর মেজ মেয়ের বিয়ে একসাথে দিয়েছিলেন। মেঝ মেয়ে অনেক বেশি দুষ্টু ছিলো। মেঝ মেয়ের মেয়ের জন্মের পর, বড় মেয়ের মেয়ে পৃথিবীতে আসে। ওনার স্ত্রী যখন আবারও অন্তঃসত্ত্বা হয়, তখন দুই মেয়ে তাদের শ্বশুরবাড়িতে সামান্য লজ্জাবোধ করলেও, এই সমাজে এমন অনেক ঘটনা ঘটে।

তখন এই শহরে গাড়ির দেখাই ছিলো না। মোটরসাইকেল ও নেই। দেশে তার রপ্তানি কম। মিঃ রহমান একটা ইমপোর্ট কোম্পানির মাধ্যমে জাপান থেকে বাইক নিয়ে আসেন। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে হজ্জও করেছেন। সপ্তাহে একদিন রোজিনা রহমানকে নিয়ে সেই বাইকে শহর ঘুরতে বের হতেন। বন্ডিং তো স্ট্রং ছিলো। চির ধরালো মেঝ পুত্র। ওর অন্যায়ে, দুজনের ভিতর প্রথমে বাকবিতন্ডা থেকে এতদূর।

একবার উনি ওনার স্ত্রীকে নিয়ে বের হয়েছেন। বাড়িতে ওনার দুই ছেলে আর তিন মেয়ে আছে। একজন মধ্যবয়সী মহিলা আছেন, ওদের খেয়াল রাখতে। মেঝ মেয়ে খুব জেদি। সন্ধ্যায় সবার জন্য দুধ খেতে দিলেও সে খায়নি। মহিলাটা তাকে জোর না করে উঠানের চৌকিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন পিঠ ফিরিয়ে। মেঝ মেয়ের কিছু সময় পর ইচ্ছা জাগে, সে দুধ খাবে। ওনাকে গিয়ে বলতেই, উনি ঘুম ঘুম চোখে বলেন, চুলায় গরম করা আছে, নিজে যাতে একটু ঢেলে খেয়ে নেয়। মেঝ মেয়ের তা সহ্য হলো না। চুলার পাশে থেকে দিয়াশলাইটা এনে ওনার শাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলো। ঠিক পিছনে। উনি ধড়ফড়িয়ে উঠে চিৎকার করতেই সবাই উপস্থিত হলো। মিঃ রহমানের বড় ছেলে দ্রুত পানি এনে ছুড়ে দিলো ওনার গায়ে। মেঝ মেয়েকে বকেও লাভ হলোনা। মিঃ রহমানকে বলা হয়নি এই সম্পর্কে। বড় ছেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো, ও পুরো ওদের মায়ের মতো হয়েছে।

মেঝ ছেলের অন্যায়, ঘরের বাইরেও শুরু হলো। ১৪ বছর বয়স থেকে নেশা ধরেছে সে। নেশার টাকা না পেয়ে চুরি শুরু করলো। মায়ের সব গহনাই একে একে চুরি করে বেঁচে দিয়েছে। রোজিনা রহমান টের পেয়েও কিছু বলেন না। অন্ধ ভালোবাসা। মিঃ রহমান একদিন জানতে পেরে অনেক মেরেছেন। ইস্ত্রি গরম করে পিঠের চামড়া উঠিয়ে নিয়েছেন। তবু ছেলেকে শোধরাতে পারেননি। বারবার পুলিশকে সামলাতে হয়েছে ওনাকে।

বড় ছেলেকে নিয়ে মাঝে মাঝেই শীতকালে দুজন দুটো এয়ার গান হাতে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়ে পড়েন। পাখি শিকারে দুজনেই দক্ষ। ছোট ছেলেটা অনেক ছোট। সে সবে কিন্ডারগার্টেনে পড়ে। সরকারি প্রাইমারির বাইরে প্রথম শহরে কিন্ডারগার্টেন খুললে, তার প্রথম ছাত্রই তার ছোট ছেলে। কাঠের একটা বাক্স চামড়ায় মোড়া। তাতে করে বই খাতা নিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিতে একজন লোক রাখা আছে। ছোট মেয়ে একবার, তার ছোট ছেলেকে মেরে ফেলতে গিয়েছিলো, তাও হিংসায়। ছোট মেয়ের জন্মের পাঁচ বছর পর ছোট ছেলের জন্ম। এতোদিন ছোট হিসাবে মেয়ের আদর বেশি ছিলো। ছেলেটা জন্মের পর তাকে কেয়ার করতে হয়। বড়রাও ওকে নিয়ে খোঁজ খবর বেশি রাখে। এটাই তার সহ্য হয়নি। উঁচু বিছানায় খুব কষ্ট করে উঠে ছয়মাসের বাচ্চাটার গলা চেপে ধরে আর বলতে থাকে, আমার আদর তুই নিয়ে নিচ্ছিস। বাচ্চাটার চিৎকার শুনে অনেকে চলে আসে। আর ওকে ছাড়িয়ে নেয়।

বড় ছেলে গ্রাম থেকে একটা মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করে আনে। রোজিনা রহমানের কি কারণে মেয়েটাকে পছন্দ হয়নি, তা স্পষ্ট নয়। উনি ওই মেয়েটাকে একদমই সহ্য করতে পারতেননা। তিনদিন আটকে রেখে দিলেন একটা রুমে। খেতেও দেননি। ওয়াশরুমেও যেতে দেননি৷ পিছনের দরজা দিয়ে পাশের বাড়ির লোক সাহায্য করেছিলো। সেই মেয়ে চলে গেলো তার ছেলেকে ছেড়ে।

—————

মিঃ রহমানকে বারংবার বলায় ওনার অনীহাকে তীব্র করে তুলে, অবশেষে মিঃ রহমান বিয়ে করতে রাজি হলেন। পুরুষ মানুষ, স্ত্রী যদি নিজেই অনুমতি দেয়, তারপর বারবারই খোঁচাতে থাকে, কে সুযোগ নেবে না? ঘটক সাহেব এসে, ওনার গ্রামের এক হতদরিদ্র ১৫ বছর বয়সী কিশোরীর প্রস্তাব আনলেন। এতো তার বড় নাতনীর থেকেও দেড় বছরের ছোট। মিঃ রহমান রাজি বিয়ে করতে।

বিয়েরদিন সকালে,

মিঃ রহমান পাঞ্জাবি, পায়জামা পড়ে রেডি হয়ে যাচ্ছেন। রোজিনা রহমান ওনার হাতের একজোড়া চুড়ি খুলে দিলেন ওনার সতীনের জন্য।

বড় ছেলে উঠানে বসে সাইকেল পরিষ্কার করছিলো। পিছন থেকে কাউকে যেতে দেখে বুঝতে পারেনি কে গিয়েছে। রোজিনা রহমানও বেরিয়ে এসেছেন। ততক্ষণে মিঃ রহমান চলে গিয়েছেন। বড় ছেলে পিছনে ফিরে বললো,

-কে যায়?

-জামাই যায়।

রোজিনা রহমান বেশ হাসি মুখেই কথাটা বললেন। বড় ছেলে বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রোজিনা রহমান বললেন,

-তোদের বাবা বিয়ে করতে যাচ্ছেন। তোদের নতুন মা আসবে।

বড় ছেলে কথাটা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো। জিজ্ঞাসা করায় লাভ হলোনা।

বাড়িতে বোনেরাও উপস্হিত। বড় মেয়ে ভাবলেশহীন। মেঝ মেয়ে জিজ্ঞাসা করায় রোজিনা রহমান বললেন,

-ওই খিটখিটে মেজাজের বুড়োকে সহ্য করবে কে? বয়স বেড়েছে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। এরপর বিছানায় পোড়ো হয়ে পড়লে সেবা কে করবে?

মেঝ মেয়ে হতাশ স্বরে বললো,

-আম্মা, আমাদের কথা তো ভাববেন।

-তোদের কথা কি ভাববো? তোদের তো আর ওই বুড়োকে সহ্য করতে হয়না।

সবাই বুঝলো, তাদের মা বৃদ্ধ বয়সের সেবা করতে পারবেন না বিধায় আবারও বিয়ে দিলেন। ওনার অহংকার থেকে উনি স্বামী সেবা বিমুখ। বাবা এতো কিছু দেওয়া সত্ত্বেও, একজন বৃদ্ধ মানুষকে উনি দেখতে পারবেন না। বড় ছেলে বেশ অভিমানেই বললো,

-আপনার মেঝ ছেলের জন্য যে অন্যায় করলেন আপনি, আপনাকে না ভবিষ্যতে পস্তাতে হয়। অহংকার পতনের মূল, এটা মনে রাখবেন।

বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

দুইদিন পর মিঃ রহমান নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। কিশোরী মেয়েটাকে দেখে তার ছোট ছেলে, তার সেঝ মেয়েকে বলেই বসলো, ‘আপু, এতো শাঁকচুন্নি। ‘

সেঝ মেয়ে চোখ রাঙিয়ে থামিয়ে দিলো। আসলেই মেয়েটা সেরকমই। গায়ের শ্যামবর্ণের পাশাপাশি চেহারাটাও খারাপ। সে খাটো। মোটা হয়ে গেলে পুরো একটা বল মনে হবে। মেয়েটার নূন্যতম অক্ষরজ্ঞান নেই। কথাগুলোও খুবই নিম্নস্তরের। রোজিনা রহমান খুব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন। মাঝে মাঝে ঘটি টান আসে। ছেলেমেয়েগুলোকেও তাই শিখিয়েছেন। সবার ভাষাই শুদ্ধ। বাড়ির কাজের লোকগুলোও ওদের সাথে থেকে থেকে তেমনভাবেই কথা বলে। এদের মধ্যে নতুন বউয়ের ভাষাটাই কটু শোনাচ্ছে। তারসাথে উনি সব শব্দ ঠিক করে উচ্চারণও করতে পারেননা।

মিঃ রহমান অত্যন্ত লম্বা আর খুবই ফর্সা। আর রোজিনা রহমানও অত্যন্ত সুন্দরী। সেই রোজিনা রহমানকে দেখার পর নতুন বউকে এবাড়িতে বেমানান৷ রোজিনা রহমানের সন্তানেরাও খুবই সুদর্শন। মেঝ ছেলের ছবি পাকিস্তান আমলে একটা বাচ্চাদের গুঁড়া দুধের কোম্পানি নিয়ে গিয়েছিলো কৌটায় দেবে বলে। তখন মেঝ ছেলে খুব সুন্দর ছিলো। এখনো আছে। বিয়ের বয়স হয়েছে। কথাবার্তাও পাকা। তার আগেই ওদের বাবা বিয়ে করে আনলেন।

মিঃ রহমান বদলে গিয়েছেন। এতোদিন অনীহা সত্ত্বেও মানিয়ে নেওয়ার নাটকটা আর করতে পারছেন না। ছেলেমেয়েদের প্রতি আচরণও রুড হয়ে যাচ্ছে।

সেঝ মেয়ের জামাই তার শ্বশুরের বিয়ের কথা জানতে পেরে মারাত্মক রেগে যান। উনি দ্বিতীয় বিবাহ অপছন্দ করেন। সেঝ মেয়েকে বাবার বাড়ি থেকে নিতেও আসেননি। সে একা গিয়েছে শ্বশুরবাড়ি। স্বামীর সামনে দাঁড়াতেই সে বলে,

-তোমার বাবার এই বয়সে ভীমরতিতে ধরেছে? নাতনির থেকে ছোট একটা মেয়েকে উনি বিয়ে করলেন কি করে?

-আম্মাই তো অনুমতি দিয়েছেন। উনি বিয়ে করেছেন সেটা ওনার ব্যাক্তিগত বিষয়। আমারও বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাদের সংসারে কি হলো সেটা ভাবার আমার সময় নেই।

-তুমিও শুনে রাখো, তোমার নতুন মা আর তোমার বাবা ওই বাড়িতে থাকলে আমি আর কখনো ওখানে যাবো না। তোমার মাকে আমাকে দাওয়াত দিতে নিষেধ করবে।উনি যতোদিন থাকবে, আমি যাবোনা।

-প্রফেসর সাহেব, কথা তো শুনুন…

বের হয়ে যান রুম থেকে। উনি সত্যিই কখনো ওনার শ্বশুর সেবাড়িতে থাকা অবস্থায় আসেননি। ওনার স্ত্রী, অর্থাৎ মিঃ রহমানের সেঝ মেয়ে এসেছে। কিন্তু উনি আসেননি

___

নতুন বউ বাড়িতে তিনদিন হলো এসেছে। রোজিনা রহমান খেয়াল করেছেন, ওনার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মিঃ রহমানের আচরণ ওনার সন্তানদের প্রতিই রুড হয়ে যাচ্ছে। তিনদিন পর, নতুন বউ তার বাবার বাড়িতে যাবে। মিঃ রহমান ওনার ছেলেমেয়েদের নির্দেশ দিয়েছেন একসাথে যেতে। যে মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি, তাদের যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু যারা আছে, তারা সবাই যাবে। ছোট ছেলে যেতে চায়নি। তবে ছোট মানুষের কথার মূল্য কতোটুকু? বড় ছেলে বাড়ি থেকে সেদিনের জন্য বের হয়ে যায়। সে যাবে না। মেঝ ছেলে খুব স্বাচ্ছন্দ্যেই সেজেগুজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ছোট মেয়েটাও বাধ্য হয়ে যাচ্ছে। ছোট মেয়েটা তার নতুন মায়ের থেকে মাত্র দুবছরের বড়।

ছোট বউ দোতলায় থাকে। বের হওয়ার সময় ভারী ব্যাগ সে সিঁড়ি বেয়ে নামাতে পারছে না। মিঃ রহমান তার ছোট মেয়েকে নির্দেশ দিলেন সেটা নামাতে। সেই মুহূর্তে ওখানে আর কেউ উপস্থিত ছিলো না। ছোট মেয়ের তার নতুন মাকে একদমই পছন্দ হয়নি। এখন আবার তার কাজ করে দিতে হবে। সে মানা করতে চাইলো। কিন্তু মিঃ রহমানের নির্দেশ অমান্য করার ক্ষমতা তার নেই। সে রাগেই ব্যাগটাতে একটা ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেললো। ব্যাগটা একদম নিচে না পড়ে কয়েক সিঁড়ি নিচে গিয়ে বেঁধে আছে। সে সেখানে নেমে ব্যাগে আবারও ধাক্কা দেয়। এরপর লাথিও দেয়। মিঃ রহমান মেয়ের এই উচ্ছৃঙ্খলতায় মারাত্মক রেগে গিয়ে, ওর মুখে থাপ্পড় বসিয়ে দেন। এরপর লাঠি দিয়েও মারেন।

রোজিনা রহমানের এই প্রথম মনে হচ্ছে, সে ভুল করেছে। কিন্তু এখন সেটা শুধরে নেওয়ার কোনো উপায় নেই।

____

নতুন বউয়ের গ্রামে যখন সবাই একসাথে ঢুকলো। তখন মিঃ রহমান সবাইকে এগিয়ে যেতে বলে, ভ্যান ভাড়া মিটিয়ে দিচ্ছেন। এমন জায়গায়, তার ছেলেমেয়েদের অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। নতুন বউ আগেই চলে গিয়েছে ভিতরে। ওরা আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে। মেঝ ছেলে বেশ হাসি মুখে আগে আগে হাঁটছে। খেয়াল করেছে, অনেকেই ওকে দেখছে। আশেপাশের বস্তি সদৃশ বাড়ি থেকে মেয়েরা উঁকি দিচ্ছে। অনেক মহিলাও ওকে দেখছে। সে মনে মনে ভাবছে, দেখতে তো সে খুবই হ্যান্ডসাম। তাকানোটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিছুদূর হাঁটতেই এক মহিলা পথ আটকে ওর দিকে তাকিয়ে, তার পাশের আরেকজন মহিলাকে বললো,

-দেখিসো কি মিথ্যা মানুষ রটাতি পারে! আমাগো শিরিনের (নতুন বউ) বরডা কি সুন্দর! আর ওর বাপ কইলো কোন বুড়োর সাথে নাকি ওর নিকে দিছে। ওর কপাল আছে বলতি হবে। নাইলে ওই রূপে কেউ এমন সুন্দর জামোই পায়?

-হ হ। ঠিক কইছো।

এতোক্ষণে মেঝ ছেলে বুঝতে পারলো ওকে এভাবে দেখার কারণ কি? পিছনে তাকিয়ে দেখে ছোট ভাই মুখ টিপে হাসছে। ছোট বোনটা ভাবলেশহীন। যে মার ও খেয়েছে, তাতে ওর হাসি কেন, মুখ থেকে কথাও বের হচ্ছে না। মেঝ ছেলের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ওদের কথায়। ও বেশ জোরে চিৎকার করে বললো,

-ওই মহিলার বর আমি না। আমি না। পিছনের ওই বুড়োটা।

সবাই এবার একটু অবাক হয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখতে পায়, মিঃ রহমান ধীরে ধীরে হেঁটে আসছেন। ওনারা লজ্জা পেয়েছেন এই ভুলে। সরে গেলেন ওদের রাস্তার উপর থেকে।

শিরিনের বিয়ে হয়েছিলো মামার বাড়িতে। তাই বাবার বাড়ির এলাকার কেউ চিনতো না ওর বরকে।

সবাই শিরিনের বাড়ি পৌঁছে দেখতে পায়, মাটির ভগ্ন একটা বাড়ি। ঘরের ভিতর দমবন্ধ পরিবেশ। শিরিনের মা মেয়ের ছোট দুই ছেলেমেয়ের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেন। ওরা সেদিনই আবার ফিরে আসে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here