শেষ গোধূলি
পর্ব:০৩(অন্তিম পর্ব)
নাহিয়ান
ছোট বউয়ের দুই ছেলেমেয়ে। যখন ছেলের জন্ম হলো, তখন বড় বউ নিজে হসপিটালে রান্না করে নিয়ে গেলেন।ছোট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন অনেক সময়। হসপিটালটায় মিঃ রহমান ডাক্তার। বড় বউকে অনেকেই চেনে। ছোট বউয়ের ছেলে মেয়ে উভয়ই ছোট বউয়ের মতো হয়েছে।
একজন নার্স এসে রোজিনা রহমানের কোলে বাচ্চাটাকে দেখে নাক শিঁটকে বললো,
-ম্যাডাম আপনি আপনার কাজের মহিলার ছেলেকে ওভাবে কোলে নিয়ে বসে আছেন কেন?
নার্সটা রোজিনা রহমানের ব্যবহার সম্পর্কে অবগত। তাই ওনার এই আচরণ তার কাছে খুব অদ্ভুত। রোজিনা রহমান কড়া গলায় বললেন,
-বেয়াদব মেয়ে, ও আমার বংশধর। তোমাদের ডাক্তার সাহেবের ছেলে।
নার্সটা বেশ অবাক হয়েছে। এই মহিলাকে কবে বিয়ে করলেন ডাক্তার সাহেব। নার্সটা আর কিছু না বলে চলে গেলো।
কথামতো আরও কিছুদিন পর, মিঃ রহমান ছোট বউকে শহরের আরেক প্রান্তে বাড়ি কিনে সেখানে নিয়ে যান। উনিও ছোট বউয়ের সাথে থাকা শুরু করেন। ছোট বউকে নিজে লেখাপড়া শেখাতে শুরু করেন মিঃ রহমান। কিন্তু সে শেখার কোনো আগ্রহই দেখায় না। নিজের নামটুকু লিখতে শিখেছে। এটুকু করতেই হতো। সে তো আর এমনি এমনি বুড়ো বিয়ে করেনি।
গ্রামের বাড়ির সবকিছুই এখন ছোট বউয়ের। আর শহরের আরো কিছু তার। বড় বউয়ের খরচ আর চলে না।
মিঃ রহমান অ্যাক্সিডেন্ট করেন এরপর। তারপর থেকেই উনি প্রায় বিছানা ধরা। ছোট বউই তার দেখাশোনা করেছে। এর বদলে পেয়েছেও অনেক।
বড় বউয়ের বড় ছেলে অন্য জেলায় সেটেল্ড হয়েছে। ছোট মেয়েটারও বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এখন মেঝ ছেলে, তার বউ ছেলেমেয়ে আর ছোট ছেলে নিয়ে সংসার তার। ছোট ছেলের পড়াশোনা শেষ হয়নি। আর মেঝ ছেলে কিছু করে না। সংসার খরচও আর চলে না। যেখান থেকে রোজগার আসতো, সেসবই ছোট বউয়ের দখলে। মিঃ রহমান আর ডাক্তারি করতে পারেন না। গ্রামের সম্পত্তি থেকে ধান, মাছ সবই আসতো, যা ছোট বউয়ের হাতে। বড় বউ বাড়ির একটা অংশ ভাড়া দিয়ে কোনোমতে সংসার চালায়। এখন রান্নাও বেশিরভাগ সময় তার করতে হয়। মেয়েরা দেখে না। বড় ছেলেও খোঁজ নেয় না, খুব একটা। মায়ের পরে যেন সবারই অভিমান।
ছোট ছেলে চাকরি করে সংসারের হাল ধরে। বিয়ে করেছে। অফিসের অনেক টাকা তার আলমারিতে রাখতে হয়। এখন প্রায়ই টাকা কম পায়। এই নিয়ে বেশ কিছুদিন ভাবার পর প্রমাণ পায়, এটা মেঝ ছেলের কাজ। সে সংসার আলাদা করে ফেলে।
ছোট ছেলের বিয়ের কিছুদিন আগে, মিঃ রহমান মারা যান। শেষ পর্যন্ত তার খেদমতে, তার ছোট বউই নিয়োজিত ছিলেন। বেশ কিছু বছর উনি বিছানায় পোড়ো ছিলেন।
ছোট ছেলের সংসার আলাদা হওয়ার পর রোজিনা রহমান দুই ছেলের কাছে ভাগাভাগি হয়ে থাকেন। উনি স্বামীর কাছে থেকে অনেক সম্পত্তি পেয়েছিলেন। তার সিংহভাগ তিনি লিখে দেন মেঝ ছেলে আর তার স্ত্রীকে। মেয়েদের কানাকড়িও দেননি। যার কারণে মেয়েরা তাকে সহ্য করতে পারেনা। এক ছেলের জন্য, উনি সবই হারালেন। ছোট ছেলে আর বড় ছেলেকেও অল্প দিয়েছেন। এদিকে মেঝ বউকে দেওয়ায় অন্য বউরাও ওনাকে সহ্য করতে পারেনা। ওনার ধারণা ছিলো, ওনার মেঝ বউই ওনাকে বয়সকালে দেখবে। ওনার স্বামীকে যেমন উনি অগ্রাহ্য করেছেন, তেমনটা হবে না।
রোজিনা রহমানের বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওনাকেও ধীরে ধীরে সবাই অগ্রাহ্য করা শুরু করে। বড় ছেলে তো আসেও নি। ছোট ছেলে ওনাকে রাখতে চাইলে, তার বউ তেতে ওঠে। বলে, যাকে সম্পত্তি দিয়েছে, সেই দেখুক না। কাজের লোকের বেতন কোটি টাকা তো দিয়েই রেখেছেন। সম্পদের বেলায় মেঝ বউ আর যখন বয়সকালে দেখার সময় তখন এই ছোট বউ। আর ছোট ছেলে আর বড় ছেলেকেও উনি ঠকিয়েছেন। সবই ওনার মেঝ ছেলে।
রোজিনা রহমান বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। এখন ওনাকে রাখা দ্বায়। মেয়েরা মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যায়। মেঝ ছেলে বাধ্য হয়ে রাখে। সবার চাপে পড়ে। মা তাকে সবচেয়ে বেশি দিয়েছেন, তাকে দেখার জন্য। এখন সে বাধ্য। এরপরও রোজিনা রহমানকে রাখা ওদের জন্য লাভজনক। সব সন্তানেরাই টাকা পাঠায় মায়ের জন্য। এতোটাকা লাগে না ওনাকে দেখতে। এটা মেঝ ছেলের থেকে যায়। কিন্তু কেউ এই জীবন্ত লাশ রাখার দ্বায়িত্ব নেয় না। যেটা রোজিনা রহমান করেছিলেন, ওনার স্বামীর সাথে।
মেঝ বউ অতিষ্ট ওনার জন্য। উনি একটা রুমে একা শুয়ে থাকেন। কথা বলতে পারেন না। শুধু তাকিয়ে দেখেন। মশা কামড়ায় সেদিকে মেঝ বউয়ের খেয়াল নেই। এই মেঝ বউই যখন সন্তানসম্ভবা ছিলো, তখন উনি নিজে তার মাথায় পানি ঢেলে দিতেন। তার জন্য সরবত বানাতেন। আর সেই মেঝ বউ খেয়ালই করেনা। খাওয়ার সময় কোনোরকমে খাওয়ায়। দুদিন ওনার গায়ে হাতও তুলেছে মেঝ বউ। ওনার বলার কিছু নেই। Bedsore হয়ে ওনার যন্ত্রণা হয়। মেঝ বউ তা খেয়াল করেও কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ছোট ছেলে মাকে দেখতে এসে এটা লক্ষ্য করলো। ডাক্তার দেখিয়ে ব্যবস্থাও নিলো। ওনার খেতে সময় লাগে বলে, কোনোমতে খাওয়ায় ওনাকে। বাধ্য হয়ে দেখে যেতে হচ্ছে।
একদিন গুরুতর অসুস্থ হলে ওনাকে হসপিটালে শিফট করা হয়৷ দুদিন পর সিসিইউতে উনি ওনার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
হসপিটালে থাকা অবস্থায় জানা যায়, ওনার কিডনি ড্যামেজড ছিলো, ওনার হার্টে ব্লক ছিলো। ওনার লিভার নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এতো কিছু হয়ে গিয়েছে কেউ টেরও পায়নি। ওনার কবরটা, ওনার স্বামীর পাশেই দেওয়া হয়। যতো ঘৃণাই থাকুক। এই নিয়তি কেউ খন্ডাতে পারে না।
ছোট বউ এখনো তার ছেলের সাথে আছে। সে এখনো যথেষ্ট সুস্থ। ছেলেমেয়েরাও নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। মেঝ মেয়ে মারা গিয়েছে। বাকিরা এখনো আছে।
রোজিনা রহমানের অহংকারই ওনাকে এমন করুণ মৃত্যু এনে দিয়েছে। যা করা হয়, প্রকৃতি তাই ফিরিয়ে দেয়। উনি স্বামীকে বৃদ্ধ বয়সে দেখতে পারবেন না বিধায় বিয়ে দিয়েছিলেন আবারও৷ উনি সেবা পেয়েই মারা গিয়েছেন। কিন্তু তার বিপরীতে, রোজিনা রহমান সেবার বদলে অবহেলাই পেয়েছেন। স্বামীর দেওয়া সম্পদও ওনাকে একমুহূর্তের জন্যও ভালো রাখতে পারেনি শেষ বয়সে। মিঃ রহমান ওনাকে যথেষ্ট দিয়েই, ছোট বউয়ের কাছে গিয়েছিলেন। বড় বউয়ের অবহেলা উনি বুঝতে পেরেও, তার কষ্ট লাঘবে তাকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য রোজিনা রহমানকে ওনাকে দিতে চাওয়া কষ্টের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করেনি। সবই হারিয়ে শেষে নিঃস্ব হয়ে, অবহেলায় চলে গেলেন। ওনার রূপের অহংকার, মাটিতে মিশে গিয়েছে। ওনার যোগ্যতার অহংকারের কোনো অস্তিত্ব নেই। তার অস্তিত্ব তখনই হারিয়ে গিয়েছে, যখন উনি পোড়ো হয়ে গেলেন। সম্পদ তাকে রক্ষা করতে পারেনি। ডাক্তার সাহেবের বউ এক অর্থে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। ওনার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিরও ফাঁক ছিলো একটা। যা ওনাকে ডুবিয়ে দিতেই যথেষ্ট ছিলো।
সমাপ্ত