“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৪০

0
2703

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪০
(নূর নাফিসা)
.
.
বডি স্প্রে দেখে সেদিনের কথা মনে হতেই নাহিদা বডি স্প্রে করার পর মেহেদীর মুখেও স্প্রে করে হাসতে হাসতে এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নাহিদাকে দৌড়ে বের হতে দেখে মেহেরুন বললো,
– আরে, কি হয়েছে!
নাহিদা স্প্রে হাতের মুঠোয় লুকিয়ে বললো,
– কিছু না, মা।
নাহিদা রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো মুখ মুছতে মুছতে মেহেদী বেরিয়ে এসেছে। নাহিদার দিকে তাকিয়েই হাটছে কিন্তু কিছু বললো না। সে সোজা বেসিনে এসে কুলি করতে লাগলো। জহিরুল ইসলাম রুম থেকে বেরিয়ে বললেন,
– নাহিদা, ভার্সিটিতে যাবে?
– হ্যাঁ, বাবা।
– বই কিনেছো?
– না।
– বিকেলে মেহেদীর সাথে গিয়ে বই কিনে এনো। আর নিয়মিত ক্লাস করো। কেমন?
– আচ্ছা, বাবা।
– মেহেরুন, মেহেদীর কাছে টাকা দিয়ে নাহিদাকেসহ বিকেলে পাঠিয়ে দিও।
নাহিদা মনে মনে ভাবলো, ভালোই হয়েছে। তার শেষ সম্বলটুকু বেচে যাবে!
মেহেদী কুলি করে ফ্রিজ থেকে আপেল নিয়েও আবার রেখে দিলো। কাটা কমলালেবু থেকে এক টুকরো নিয়ে খেতে খেতে বেরিয়ে আসছিলো কিচেন থেকে। নাহিদাকে বলা বাবার কথা শুনে মেহেদী বললো,
– বই কিনতে চৌদ্দ জন যেতে হয়! বুক লিস্ট দিলে একাই আনা যায়!
জহিরুল ইসলাম বললেন,
– নিজের জিনিস দেখেশুনে নিজে আনা-ই ভালো। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে যাও। তবে একা গেলে বই ঠিকঠাক মতো এনে দিও। চলো অফিস যাবো। নাহিদাও চলো, ভার্সিটির সামনে নামিয়ে যাই।
– আচ্ছা।
নাহিদা যেতে রাজি হলেও মেহেদী বললো,
– আমি যাবো না কারো গাড়িতে! নিজের পা আছে। পকেটে রিকশা ভাড়াও আছে। নিজে নিজেই চলতে সক্ষম! কারো উপর নির্ভর করি না।
– তাই নাকি! পরশু যে আমার গাড়ি নিয়ে বের হলে?
– সেটা তো তোমার প্রয়োজনেই গিয়েছি! আমার কোনো প্রয়োজন ছিলো নাকি!
– রাত দশটা পর্যন্ত আমার প্রয়োজন ছিলো?
– পথ ভুলে গেলে এমনই!
– শেখাও আমাকে! শ্বশুর বাড়ি যেতে যেতে এইটুকু সময়ে তুমি বাবার বাড়ির পথ ভুলে গেছো! নাহিদা, ও না যাক। তুমি এসো গাড়িতে।
– পার্স নিয়ে আসছি, বাবা।
– এসো।
জহিরুল ইসলাম বেরিয়ে গেলেন। নাহিদা রুমের দিকে পা বাড়ালে মেহেরুন তার হাতে পাচশো টাকার নোট দিলে নাহিদা বললো,
– মা, এটা কিসের টাকা?
– ভার্সিটি যাবি, আসার সময় ভাড়া লাগবে না!
– আছে তো আমার কাছে।
– রাখ এটা। আর যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে ছোট একটা সংকেত দিবি। চুপচাপ বসে থাকলে তো আর প্রয়োজন মিটবে না। মনে থাকে যেন।
নাহিদা মুচকি একটা হাসি দিয়ে রুমে চলে গেলো। হাত থেকে স্প্রেটা রেখে পার্স নিয়ে বের হতে যাবে, এমন সময় মেহেদী দ্রুত পায়ে রুমে প্রবেশ করলো। নাহিদার কাছে এসে বললো,
– খুব চতুর সেজে গেছো না? রাতে শোধ নেবো মিসেস!
কথাটা বলার পরপরই মেহেদী তার খাওয়া কমলালেবুর খোসাটা নাহিদার ঠোঁটে ঠেসে দিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো। নাহিদা ঠোঁট মুছে থু থু ফেলতে লাগলো! তার মুখ এখন তেতো লাগছে! তার মতে এই মেহেদী একটা জঘন্য খাটাশ লোক! ডেঞ্জারাস পিশাচও বটে! মনে মনে বকতে বকতে নাহিদা ঠোঁট ঘষে মুছে পানি খেয়ে ভ্যাজলিন লাগিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। মেহেদী আগে চলে গেছে। জহিরুল ইসলাম ড্রাইভারের সাথে গাড়িতে বসে আছে। নাহিদা গাড়িতে উঠে বসলো। তাকে ভার্সিটির সামনে নামিয়ে জহিরুল ইসলাম অফিসে চলে গেলো।
প্রায় অনেক দিন পর বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা হলো। কিন্তু আশিকের সাথে দেখা হয়নি। ক্লাস করেছে মাত্র দুইটা, বাকি সময় নোট সংগ্রহ ও আড্ডায়ই কাটলো। নাফিসার সাথে দেখা হয়েছে ভার্সিটিতে। দুইবোন কথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসার সময় নাহিদা বললো,
– কি খাবি?
নাফিসা ঘনঘন চোখের পলক ফেলে বললো,
– তুমি বলেছো এই কথা! বিশ্বাস হচ্ছে না আমার! যার কাছ থেকে পাচ টাকা নেয়ার জন্য পঞ্চাশ মিনিট যুদ্ধ করতে হয়, আজ সে নিজ থেকে বলছে কি খাবো আমি!
– কি করবো বল! অনেক দিন ধরে ছ্যাচড়াটা পাচ টাকার জন্য পঞ্চাশ মিনিট যুদ্ধ করে না। তাই ভাবলাম, ভদ্রানীটাকে নিজ থেকেই অফার করি!
– কি! আমি ছ্যাচড়া!
– আরে না, তুই তো আমার ভদ্রানী কিউটিপাই। হিহিহি… ক্যান্টিনে চল। সকাল সকাল এতো দৌড়াদৌড়ি করে এখন আমারও ক্ষুধা লেগে গেছে!
– ক্যান্টিনে খাবো না। ফুচকা খাবো।
– ওকে।
দুজনেই গেইটের ধারে লোকের কাছে ফুচকা অর্ডার করলো। প্রতিযোগিতা চলছে তাদের মাঝে। বরাবরই নাফিসার মুখ নড়েচড়ে বেশি! আজও তার ব্যাতিক্রম না। ফুচকা খেয়ে জ্বিভে ঝাল আটকে গেছে! ঝালের প্রখরতা আরও বাড়িয়ে দিতে নাফিসা অফার করলো ঝালমুড়ি। নাহিদাও উৎফুল্ল হয়ে অফার এক্সেপ্ট করলো। ঝালমুড়ি খাওয়ার সময় নাহিদার একজন বান্ধবী যুক্ত হয়েছে তাদের সাথে। সম্পূর্ণ বিল নাহিদা ই পরিশোধ করেছে। ঝালমুড়ি খেতে খেতে তিনজন গেইটের বাইরে দাড়িয়ে কথা বলছে। হঠাৎ তাদের থেকে একটু সামনে একটা রিকশা থেমে পরিচিত কন্ঠে ভেসে এলো, “এখানে দাড়িয়ে আছো কেন? বাসায় যাবে?”
সবাই তাকিয়ে দেখতে পেল রিকশায় বসে আছে মেহেদী। নাহিদা বললো,
– হ্যাঁ, বাসায়ই যাবো।
– তাহলে চলে এসো। বাসায়ই যাচ্ছি।
নাফিসা বললো,
– ভাইয়া, ঝালমুড়ি খেলে নেমে আসুন?
– না, কাজ আছে আমার। তুমি খাও।
নাফিসাকে জবাব দিয়ে আবার নাহিদাকে বললো,
– যাবে নাকি তুমি?
– হ্যাঁ, আসছি।
নাহিদা নাফিসার হাতে তার ঝালমুড়ির প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– নে, তুই খা। আমি চলি। সাবধানে বাসায় যাবি। আল্লাহ হাফেজ।
– আল্লাহ হাফেজ।
নাহিদা রিকশায় উঠে পড়লো। রিকশা আবার চলতে শুরু করলো। প্রচুর ঝাল লাগছে জ্বিভে! একটু পানি পানেরও সময় হলো না। ঝাল কমাতে মুখে শ্বাস কাটছে নাহিদা। মেহেদী বললো,
– ঝাল খেতে পারো না তবে খেতে যাও কেন?
– খেতে পারি। তবে আজ একটু বেশি হয়ে গেছে! ঝাল ফুচকা খাওয়ার পর আবার ঝালমুড়ি।
– ফুচকা আবার ঝালমুড়িও! একসাথে এতোকিছু খেয়েছো! বাসায় তো এমন ভাব দেখাও যেন খেতেই জানো না!
নাহিদা তার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে আবার সামনে তাকিয়ে রইলো। আর মনে মনে বললো, “আমি এইটুকু খাওয়াতে এতো কিছু খেয়ে ফেলেছি আর উনি যে পুরো রেস্টুরেন্ট খেয়ে ফেললেও বলে খাওয়া হয়নি তার, সেটা কিছু না!”
মাথায় কিছু নাড়া দিতেই সে বললো,
– এতো তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাচ্ছো যে?
– চব্বিশ ঘন্টার কাজ মেহেদী এক ঘন্টায় সম্পাদন করতে পারে। ট্যালেন্টেড লোকদের সারাদিন কাজে পড়ে থাকতে হয় না। বুঝতে পেরেছো?
নাহিদা মনে মনে বললো, “হুহ্, যাকে ঠেলে ঠেলে কাজে পাঠাতে হয়, সে নাকি আবার ট্যালেন্টেড! ফাকিবাজের নানা একটা! ফাকিবাজের কাজই তো ফুটানি করা!”
মেহেদী একটা দোকানের সামনে রিকশা থামিয়ে একটা পানির বোতল নিয়ে এলো এবং বোতলের মুখ খুলে নাহিদার হাতে দিলো। নাহিদা মনে মনে খুশি হলেও বাইরে প্রকাশ করলো না। চুপচাপ পানি পান করে নিলো। মেহেদী এবার তার পেছন দিকে এক হাত রেখে বসেছে। মুহুর্তেই নাহিদার মনে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে! সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার পর দুজন এই প্রথম রিকশায় একসাথে বসেছে। তার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে তারা সদ্য প্রেমিক-প্রেমিকা! ভাবতেই নাহিদার চেহারার ভঙ্গিতে চমৎকার উজ্জ্বলতা ছাড়িয়েছে! বিরতিহীন ছুটে চলেছে রিকশা। বাতাসের গতিতেও মিশে আছে তীব্রতা! পরিবেশের মাধুর্যে মুখরিত হয়ে উঠেছে দুটি প্রান আর পাশাপাশি বসে আছে দুটি দেহ।
“পাচশো টাকা কি ঝালমুড়ি আর ফুচকা খেয়েই শেষ করে দিয়েছো নাকি রিকশা ভাড়ার জন্য কিছু রেখেছো?”
নাহিদা এতোক্ষণ কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলো তার জানা নেই। মেহেদীর কথায় এতোক্ষণে তার ধ্যান ভাঙলো! তাকিয়ে দেখলো মেহেদী তার পার্স খুলছে। কখন যে তার পার্স মেহেদীর কাছে চলে গেছে সে খেয়ালই করেনি! মেহেদী টাকা বের করে দেখলো পাচশো টাকার নোটের সাথে আরও কিছু খুচরা আছে। সেখান থেকে পঞ্চাশ টাকা নিয়ে তার কাছে পার্স ফিরিয়ে দিয়ে বললো,
– এতো টাকা তোমার কাছে! এতো টাকা নিয়ে ভার্সিটি যেতে হয়! আসা যাওয়ায় রিকশাভাড়া মাত্র চল্লিশ টাকা!
– আমার টাকা..
– তো কি হয়েছে? রিকশায় কি আমি একা এসেছি! তুমিও তো এসেছো সাথে! ভাড়া দিবে না! এতো ঠেকা পড়েছে নাকি তোমাকে ফ্রীতে ভার্সিটি থেকে নিয়ে আসার!
নাহিদার এখন অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে করছে! কিন্তু কিছুই করলো না। কোনো একটা শব্দ পর্যন্ত করলো না রিকশাওয়ালা সামনে থাকায়। বাড়ির সামনে রিকশা থামতেই চুপচাপ রিকশা থেকে নেমে সে বাড়ির ভেতর চলে গেলো। মেহেদী তার মুখভঙ্গি দেখে নিশব্দে হাসলো। ভাড়া প্রদান করে সেও বাড়িতে প্রবেশ করলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here