প্রেম_পায়রা ?️?️
পর্ব-৬,৭
লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
ষষ্ঠ_পর্ব
পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ কানে এসে বিঁধতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় স্নিগ্ধ। সূর্যের হালকা আলোয় পুরো রুম আলোকিত হয়ে গিয়েছে। পাশ ফিরে মিশরাতকে না দেখে ঘড়ির দিকে তাকায় সে। সবেমাত্র সকাল সাতটা বাজে। এতো সকাল বেলা মিশরাত আবার কোথায় যেতে পারে। ভাবতে ভাবতেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো স্নিগ্ধ।
রুমের দরজা খুলে বাহিরে কারো সাথে সজোরে ধাক্কা খেয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল স্নিগ্ধ। বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকাতেই মিশরাত রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
– ” এই আপনি কি চোখে কম দেখেন নাকি!
ইশশ আমার হাতটা মনে হয় ভেঙে গিয়েছে। এতো জোরে কেউ ধাক্কা দেয়। আস্ত হাতি একটা!!”
সাথে সাথে চোখ বিস্মিত হয়ে যায় স্নিগ্ধর। এ মেয়ে বলে কি! মুখের মধ্যে কাঠিন্যের ছাপ এনে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,
– ” হোয়াট!!
কি যা তা বলছো মিশরাত। আমি আর হাতি!! আর ইউ কমেডি উইথ মি??
ইউ নো আ’ম জাস্ট 78 কেজি। ডাফার একটা!!”
স্নিগ্ধর কথা শুনে মিশরাত তেতে উঠে!
– ” এই একদম আমার সামনে ইংলিশ ঝাড়বেন না বলে দিচ্ছি!
একে তো ধাক্কা দিয়ে আমার হাতের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে তার উপর বড় বড় কথা! হুহ!”
বলেই পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে যায় মিশরাত। আর স্নিগ্ধ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
– ” এটা কি মেয়ে না অন্যকিছু!
যখন দেখো তখন বোমা বিস্ফোরণের মতো বিস্ফোরিত হতে থাকে! ইডিয়ট কোথাকার!”
বলেই ফোন নিয়ে রুমের বাইরে চলে আসে স্নিগ্ধ।
চৌধুরী বাড়িতে নানা ধরনের আয়োজন চলছে যার মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো স্নিগ্ধ আর মিশরাত। কেননা আজকে তাদের রিসিপশন। মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী মিশরাতকে ডেকে নিয়ে তার রুমে বসালেন। বিয়ের দ্বিতীয় দিন হঠাৎ এভাবে মিসেস ইয়ামিন চৌধুরীর রুমে আসায় বেশ ঘাবড়ে যায় মিশরাত। হঠাৎ এভাবে তাকে ডেকে পাঠানোর কারণ কি?
মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী উঠে গিয়ে আলমারি খুলে সেখান থেকে একগাদা শাড়ি আর কয়েকটা জুয়েলারি বক্স বের করে নিয়ে আসলেন। মিশরাতের সামনে সেগুলো এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,
– ” মিশরাত এগুলো তোমার আজকের রিসিপশনের জন্য শাড়ি। এখান থেকে তোমার যেটা পছন্দ হবে সেটা পড়ে নিও।
আর এই গহনা গুলো আমাদের খানদানি গহনা। এগুলো স্নিগ্ধর দাদি মানে আমার শ্বাশুড়ি আমাকে বিয়ের পর দিয়েছিলেন। আর আজকে আমি তোমাকে এগুলো দিলাম। আজ থেকে এসবের দায়িত্ব তোমার।”
কথাগুলো বলেই বক্স থেকে দুটো বালা বের করে মিশরাতকে হাত এগিয়ে দিতে বললে মিশরাত ধীরে ধীরে তার হাত দুটো এগিয়ে দেয় না চাইতেও।
মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী বালা দুটো পড়িয়ে দিলেন মিশরাতের হাতে সযত্নে।
– ” এগুলো আজ থেকে তোমার!
এগুলো সামলে রেখো!”
শাশুড়ির কথা শুনে মিশরাত একপলক হাতে থাকা বালা দুটোর দিকে তাকালো। মনে মনে ভাবলো,
– এগুলো কি আদৌ আমার পাওনা!
আমি তো শুধুমাত্র কদিনের অতিথি। ছ মাস পর সবকিছু ত্যাগ করে চলে যেতে হবে আমায়! এই স্বল্প সময়ের জন্য কি এত বড় দায়িত্ব পালন করতে পারবো আমি আদৌ?”
মিশরাতকে অন্যমনস্ক থাকতে দেখে মিসেস ইয়ামিন মিশরাতের হাতের উপর হাত রেখে নরম কন্ঠে বলে উঠেন,
– ” কি হয়েছে মিশরাত? কি ভাবছো?
মা বাবার কথা মনে পড়ছে?”
মিশরাত আমতা আমতা করে বলল,
-” না না আন্টি তেমন কিছু না! এমনিতেই!”
– “তা না হয় নাই ভাবলে কিন্তু এই আন্টি ডাক আমার কাছে চলবে না। স্নিগ্ধর মতো তুমি ও আমাকে মা বলে ডাকবে!
মনে থাকবে?”
মিসেস ইয়ামিন হালকা হেসে বললেন।
মিশরাত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই মিসেস ইয়ামিন বলেন,
– ” আচ্ছা ঠিক আছে, এবার তুমি গিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নাও আর দেখো স্নিগ্ধর কিছু লাগবে কিনা?
একটু পরেই তো তোমার বাসার লোকজন ও চলে আসবে!”
মিসেস ইয়ামিনের কথায় মিশরাত উঠে দাঁড়ায়। তারপর মুচকি হেসে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ে রুম থেকে।
দু রুম পেরুতেই একটা রুম চোখে পড়ে মিশরাতের। কারো ফিসফিস করে কান্না করার শব্দ তার কানে আসছে। শুনেছে এ বাড়িতে স্নিগ্ধ, মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী, আর ইফতেখার চৌধুরী ছাড়া আর কেউ নেই। তবে কি এটা স্নিগ্ধর বাবার রুম??
– ” বাবা প্লিজ এবার তো সুস্থ হয়ে যাও!
দেখো আমি প্রমিজ করছি আর কোনোদিন তোমার অবাধ্য হবো না। তোমার জন্য আমি বিয়েও করে নিয়েছি! বাবা প্লিজ তারাতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠো তোমার বউমার সাথেও তো তোমার দেখা করতে হবে তাই না!!”
বলেই নিঃশব্দে কান্না জুড়ে দিল স্নিগ্ধ। আর সেটা দূর থেকে মিশরাতের চোখে পড়তেই তার ও খারাপ লাগা কাজ করলো। মনে মনে ভাবতে থাকলো,
– ” ইশ লোকটা সবসময় রাগী আর ইগো মুড নিয়ে থাকলেও এখন বাচ্চাদের মতো কিভাবে কান্না জুড়ে দিয়েছে।
দেখতে কঠিন হলেও ভেতরটা অনেক নরম!”
পেছন থেকে কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে মিশরাত। ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকাতেই দেখে মিসেস ইয়ামিন দাঁড়িয়ে আছেন। তা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে।
– ” তোমার শ্বশুরের স্ট্রোক করার পর থেকেই ছেলেটা এমন হয়ে গিয়েছে।
সারাদিন মনমরা হয়ে থাকে আর তার সামনে যেয়ে প্রলাপ বকতে থাকে। না জানি কবে তোমার শ্বশুর সুস্থ হবেন!!”
হতাশার সুরে বলে উঠলেন মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী। মিশরাত মিসেস ইয়ামিনের হাতের উপর হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করতে বলে উঠল,
– ” চিন্তা করবেন না মা!
তিনি খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবেন! আপনি ধৈর্য ধরুন!”
মিশরাতের কথা শুনে মিসেস ইয়ামিন আলতো হেসে মাথা উপরনিচ করে সম্মতি জানালো।
ব্লু কালারের শাড়ি, সাথে ম্যাচিং করে স্টোনের অর্নামেন্টস্, লম্বা চুল গুলো সুন্দর করে সাইড থেকে বিনুনি করা আর মুখে হালকা মেকআপের আবরণ। সব মিলিয়ে অসাধারণ দেখাচ্ছে মিশরাতকে। স্নিগ্ধকেও পুরো ব্লু রঙের ফর্মাল লুকে অসাধারণ লাগছে। দুজনকে দেখে একটাই কথা মনে হবে,
মেড ফর ইচ আদার!
রিসিপশনের আয়োজনে মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী সবাইকে মিশরাতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই কারো পরিচিত কন্ঠে ফারাহ্ নামটা শুনতেই পেছন ফিরে তাকায় মিশরাত। মিসেস ইবনাত তার দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে রয়েছেন। মাকে দেখে মিশরাত অশ্রুসিক্ত নয়নে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যায় মিসেস ইবনাতের কাছে। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে চোখ থেকে দু ফোঁটা জল বিসর্জন দেয় মিশরাত। মেহেরকে দেখে মেহেরকেও জড়িয়ে ধরে সে। এদিকে মিস্টার আজীজ আর ইরফানকে দেখে স্নিগ্ধও এগিয়ে যায়। কুশলাদি বিনিময়ের পর স্নিগ্ধ আর মিশরাতকে নিয়ে একত্রে স্টেজে বসানো হয়।
রিসিপশনের আয়োজন উপলক্ষে কাপল ডান্স এর জন্য ঘোষণা করা হয়। এদিকে এটা শুনে মিশরাত পড়ে যায় মুসিবতে।
– ” এইরে এখন কি করবো!
এই লোকটার সাথে এখন কাপল ডান্স করা লাগবে। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব। এতো ক্লোজলি? আর আমি তো ডান্স ও পারি না!
কোথায় যে ফেসে গেলি তুই মিশরাত!”
মনে মনে বিড়বিড় করে উঠে মিশরাত। স্নিগ্ধ ও পড়েছে অস্বস্তিতে। কিন্তু এখন তো আর সরাসরি মানাও করা যাচ্ছে না। পাশ থেকে মিশরাত ফিসফিস করে বলে উঠে,
– ” এই যে শুনুন! এটা কি করা খুব জরুরি? আমি তো ডান্স এর ড ও পারিনা। আর সেখানে কাপল ডান্স!”
স্নিগ্ধর দৃষ্টি সামনে রেখে হাসি মুখে বলে উঠে,
– ” কিছু করার নেই। এখন তো এটা করতেই হবে!
না হলে আমাদের আচরণ দেখে মায়ের সন্দেহ হয়ে যেতে পারে! সো দেয়ার ইজ নো ওয়ে!
আর ডোন্ট ওয়ারি! আমি যেভাবে যেভাবে স্টেপ করবো তুমিও জাস্ট স্টেপ এ তাল মিলাবে! তাহলেই হয়ে যাবে!”
স্নিগ্ধর কথা শুনে মুখটা কাচুমাচু করে ফেলল মিশরাত। সব এরেন্জমেন্ট করা শেষ হলে হলরুমের ডেকোরেশনের লাইট বন্ধ হয়ে জ্বলে উঠলো হালকা সাদা আর নীলের মিশ্রণের আলো। যেখানে মিশরাত আর স্নিগ্ধর চেহারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর ই বেজে উঠে কোনো গানের চেনা সুর!
” জানাম জানাম জানাম সাথ চালনা ইউহি!
কাসাম তুমহে কাসাম
আকে মিলনা ইউহি!
এক জান হ্যায় ভালে
দো বাদান হো জুদা!
মেরি হোকে হামেশাই রেহনা, কেহনা কাভি আলবিদা!”
স্টেপের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে মিশরাত আর স্নিগ্ধ। স্নিগ্ধর দৃষ্টি মিশরাতের চোখেই আবদ্ধ।
“মেরি সূবহা হো তুমহি
অর তুমহি সাম হো
তুম দার্দ হো
তুমহি আরাম হো
মেরি দুয়ায়ো সে আতি হে ইয়ে সাদা,
মেরি হোকে হামেশাই রেহনা
কাভি না কেহনা আলবিদা!(২)
তেরি বাহোমে হ্যায় মেরে দোনো জাহা,
তু রাহে জিদহার
মেরি জান্নাত ওয়াহি!
জ্বাল রেহি আগান হ্যায় এ যো দো তারফা
না বুঝে কাভি মেরি মান্নাত ওয়াহি!
তু মেরি আরজু
মেয় তেরি আশিকী
তু মেরি শায়েরী
মেই তেরি মসিকি!”
মিশরাত ও তাকিয়ে তাল মেলাচ্ছে স্নিগ্ধর চোখে। স্নিগ্ধ না চাইতেও সে তার কন্ট্রোল হারাচ্ছে বারংবার! যেন ঐ চোখ দুটিতে এক অদৃশ্য মায়া শক্তি রয়েছে যা তাকে ক্রমশ তার দিকে আকর্ষণ করছে। স্নিগ্ধর হাত মিশরাতের কোমরে যেতেই হালকা শিউরে উঠে সে। এ কেমন অনুভূতি??
“তালাব তালাব তালাব
বাস তেরি হ্যায় মুঝে
নাসো মে তু নাশা বানকে ঘুলনা ইউহি
মেরি মোহাব্বাত কা কারনা তু হাক ইয়ে আদা
মেরি হোকে হামেশাই রেহনা
কাভি না কেহনা আলবিদা!
মেরি সুবহা হো তুমহি
অর তুমহি সাম হো
তুম দার্দ হো
তুমহি আরাম হো
মেরি দুয়ায়ো সে হে আতি হে ইয়ে সাদা,
মেরি হোকে হামেশাই রেহনা
কাভি না কেহনা আলবিদা!!”
সবার হাতের করতালির ধ্বনিতে ধ্যান ফিরে আসে স্নিগ্ধ আর মিশরাতের। স্নিগ্ধ ও সরে আসে মিশরাতের কাছ থেকে। এতক্ষণ যেন দম আটকে আসছিল তার। স্নিগ্ধ সরে আসতেই জোরেশোরে দম ফেলে মিশরাত। হঠাৎ করেই একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরে তাকে। কিন্তু পরক্ষণেই তার টনক নড়ে ওঠে।
– ” মিশরাত এসব কি উল্টো পাল্টা ভাবছিস তুই?
এগুলো অন্যায়! তোর এসব চিন্তা করাও পাপ! আমি বারবার কেন ভুলে যাই আমাদের বিয়ে আর বাকি পাঁচটা বিয়ের মতো না!
এটা জাস্ট ছয় মাসের একটা চুক্তি!”
মনে মনে বিড়বিড় করে বলে উঠে মিশরাত।………
চলবে ?
#প্রেম_পায়রা ?️?️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#সপ্তম_পর্ব
সারাদিনের ধকল কাটিয়ে অনুষ্ঠান শেষে যে যার যার ঘরে চলে আসে। মিশরাত ফ্রেশ হয়ে শাড়ি ছেড়ে একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে নেয়। বের হয়ে ভালো করে মাথায় ওড়না জরিয়ে কিছু না বলেই রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে মিশরাত। সেটা খেয়াল করতেই ভ্রু কুঁচকে ফেলে স্নিগ্ধ।
– ” এই মেয়ের আবার কি হলো? কিছু না বলেই হুট করে এতো রাতে রুম থেকে বের হয়ে গেল!
কি জানি!”
বিড়বিড় করে সোফায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লো স্নিগ্ধ।
প্রায় আধঘন্টা পর দরজা খুলে পা টিপে টিপে রুমে প্রবেশ করে মিশরাত। স্নিগ্ধ তখনও ল্যাপটপে একদৃষ্টে চেয়ে কাজ করছে। অফিসের কিছু ইম্পর্ট্যান্ট ডকুমেন্ট ঘাঁটাঘাঁটি করছে স্নিগ্ধ। এই বিয়ে রিসিপশনের চক্করে অফিসে বেশি মনোযোগ দেয়া হয় নি।
হঠাৎ সামনে কেউ খাবারের প্লেট ধরায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় স্নিগ্ধ। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে মিশরাত হাতে করে খাবারের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর চোখের ইশারায় সেটা তাকে নিতে বলছে।
– ” কি ব্যাপার এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছেন কেন?
নিন খাবারটা নিন তারাতাড়ি! না হলে ঠান্ডা হয়ে যাবে!”
চোখ দুটো ছোট ছোট করে বলে উঠে মিশরাত। স্নিগ্ধ ও কোনো কথা না বলে গটগট করে খাবারের প্লেট টা নিয়ে নেয়।
খাবার খাওয়ার এক পর্যায়ে মিশরাত আচমকা জিজ্ঞেস করে উঠে,
– ” আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, আপনার বাবার স্ট্রোক করার জন্য আপনি দায়ী এটা কেন মনে হয় আপনার? আপনি কি করেছিলেন এমন?
আর হ্যাঁ আপনার বাবা তো চাইতেন যে আপনার বিয়েটা হয়ে যাক। তাহলে আপনি তখন বিয়ে করেন নি কেন?”
শেষ দু লোকমা বাকি। এই সময় কথা কর্ণপাত হতেই গলায় খাবার আটকে গেল স্নিগ্ধর। টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু পানি খেয়ে নিলো সে। এসির বাতাসের মাঝেও কপাল বেয়ে ঘাম পরছে। মনের ভিতরেও একপ্রকার অস্থিরতা শুরু হয়ে গিয়েছে।
মিশরাতের করা প্রশ্নের একটা উত্তর ও দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় এখন। তাই কোনোমতে বলে উঠল,
– ” এখন এসব কথা বলার সময় না মিশরাত। আর তোমার আমার সম্পর্ক এতোটাও ক্লোজ না যে সব কথা অনায়াসে তোমাকে বলে দেয়া যাবে!
যদি কোনোদিন সঠিক সময় আসে তাহলে তোমাকে নিশ্চয়ই বলবো। আপাতত সেটা না হয় অজান্তেই থাকুক!!”
বলেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো স্নিগ্ধ। তারপর বাইরের দিকে হাঁটা দিল। আর এদিকে মিশরাত কয়েক পলক স্নিগ্ধর যাওয়ার পানে তাকিয়ে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো!!
পরেরদিন সকালে,,
মিশরাত খুব ভোরে উঠে পড়ে ঘুম থেকে। যত যাই হোক মিথ্যে হলেও তাকে এ বাড়ির বউয়ের মতো আচরণ করতে হবে। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে রান্নাঘরের দিকটায় চলে যায় সে। কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তার পর সকালের নাস্তা বানানোর কাজে লেগে পড়ে সে।
নাস্তার টেবিলে স্নিগ্ধ এসে বসতেই মিসেস ইয়ামিন ভ্রু কুঁচকে তাকালেন স্নিগ্ধর দিকে।
– ” কি ব্যাপার স্নিগ্ধ? তুমি এই পোশাকে? তুমি কি আজকে অফিস জয়েন করছো নাকি?”
মায়ের কথা শুনে রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে স্নিগ্ধ বলে উঠে,
– ” হ্যাঁ মা। আমি আজকে থেকেই অফিস জয়েন করছি!
অনেকদিন ধরে অফিসের বেশ কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কাজ বাকি। সেগুলো দেখতে হবে।আর আজকে একটা মিটিং ও রয়েছে।”
– ” এটা আবার কোন ধরনের কথা, স্নিগ্ধ? তোমার বিয়ে হয়েছে সবেমাত্র একদিন হয়েছে! আর আজকেই তুমি অফিসে জয়েন করার কথা বলছো!
সেটা হয় নাকি?
না তুমি অফিসে যাবে না! তুমি মিশরাতকে টাইম দাও। মেয়েটা নতুন জায়গায় এসেছে।
এক কাজ করো তোমরা দুজন কয়েকদিন সময় কাটিয়ে এসো। আমি বরং তোমাদের হানিমুনের টিকেট কেটে রাখছি!
মিশরাত তোমার কোন জায়গা পছন্দ সেটার নাম আমাকে বলে দিও মা!”
সবে মাত্র পানির গ্লাসে চুমুক বসিয়েছিল মিল্লাত। মিসেস ইয়ামিন চৌধুরীর কথা শুনে বিষম উঠে যায় তার। কাশতে কাশতে চোখ নাক লাল হয়ে গিয়েছে। চোখেও হালকা পানি জমে গিয়েছে। মিসেস ইয়ামিন দৌড়ে উঠে গিয়ে মিশরাতের মাথায় আর পিঠে কয়েকবার হাত বুলিয়ে দিলেন। এতে কিছুটা শান্ত হয় সে। স্নিগ্ধ মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
– ” মা এখন না হয় এসব থাক!
বাবাও অসুস্থ। পরে না হয় বাবা সুস্থ হয়ে গেলে আমরা যাবো!”
– ” তোমাকে এতো বেশি বুঝতে হবে না স্নিগ্ধ। যেটা বলা হয়েছে সেটাই করো। পরে না হয় তোমার বাবা সুস্থ হলে আবারও সবাই মিলে একসাথে ফ্যামিলি ট্যুরে যাওয়া যাবে!
এখন আপাতত তোমরা দুজন গিয়ে কয়েকদিন ঘুরে এসো!”
মিসেস ইয়ামিন চৌধুরীর কথা শুনে মিশরাত একবার অসহায় দৃষ্টিতে স্নিগ্ধর দিকে তাকায় আর শুকনো ঢোক গিলে নেয়।
রুমের মধ্যে একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে অস্থির ভাবে পায়চারি করে যাচ্ছে মিশরাত। আর স্নিগ্ধ সোফায় বসে মুখ দু হাতে গুজে গম্ভীর ভাবে বসে রয়েছে।
– “আরে আপনি এভাবে বসে আছেন কেন? আপনার মা তো আমাদের দুজনকে হানিমুনে পাঠানোর আয়োজন ও করে ফেলেছে!
এখন কি হবে? কিছু একটা তো করুন!”
মিশরাতের বকবকানি শুনে মাথা তুলে তাকায় স্নিগ্ধ। মুখে একরাশ বিরক্তি স্পষ্ট!
– ” আরে এভাবে হাইপার হচ্ছো কেন?
এখনি তো মা আমাদের পাঠিয়ে দিচ্ছে না!
আর গেলেও তো কোনো সমস্যা নেই!”
চোখ দুটো বড় বড় করে ফেলে মিশরাত। মানে কি? এতো বড় একটা ব্যাপার অথচ স্নিগ্ধর মাঝে যেন কোন চিন্তাই নেই। এমন ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখে রাগে ফুঁসতে থাকে মিশরাত। এদিকে মিশরাতের উপর চোখ পড়তেই হালকা ঘাবড়ে যায় স্নিগ্ধ!
– ” আরে তুমি রেগে যাচ্ছো কেন? আগে আমার পুরো কথাটা তো শোনো!
বাকি সবার কাছে আমাদের বিয়ে আর বাকি সব নরমাল বিয়ের মতোই। কিন্তু আমাদের বিয়ে যে একটা চুক্তি সেটা আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ জানে?
না জানে না! আর মায়ের সামনে এটা কখনো বুঝতেও দেয়া যাবে না যে আমরা আসলে ওরকম সম্পর্কে নেই।
আর সেই নাটক চালিয়ে যেতে হলে আমাদের মায়ের কথা শুনতে হবে।
আর তাই আপাতত আমাদের যেতেই হবে। তবে সেখানে গিয়ে কিছু হবে না। আমরা জাস্ট নরমালি কিছুদিন ঘুরে চলে আসবো।
আর চিন্তা করো না আমি তোমাকে ছুঁয়েও অবধি দেখবো না। কারণ আমি এই বিয়েটা কোনো বিয়ে না, জাস্ট একটা চুক্তি!
যেখানে আমরা নামমাত্র স্বামী স্ত্রী। আর আমি তোমাকে আগেই বলে দিয়েছি আমি কোনোদিন আর কাউকে ভালোবাসতে পারবো না।
শুধু মায়ের মন রক্ষার্থে কিছুদিনের জন্য যেতে হবে!”
বলেই সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো স্নিগ্ধ। টেবিল থেকে মোবাইল টা নিয়ে রুমের দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। আর এদিকে মিশরাত একমনে মেঝের উপর তাকিয়ে রয়েছে।
মাঝ থেকে আরো একটি দিন কেটে গিয়েছে। ভোর ৫:৩০ টায় উঠে ঘুমু ঘুমু চোখে ঢুলতে ঢুলতে প্যাকিং করছে মিশরাত। আজ তার আর স্নিগ্ধর সাজেক যাওয়ার ডেট। শ্বাশুড়ি মায়ের কথা মনে হানিমুনের প্লেস হিসেবে সাজেক সিলেক্ট করা হয়েছে। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে তাই এখন থেকেই প্যাকিং শুরু করে দিয়েছে সে। প্যাকিং শেষে ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই খেয়াল করে ৬:০০ টা বেজে গিয়েছে। তাই পাশ থেকে একটা শাড়ি তুলে চলে যায় ওয়াশরুমের দিকে।
চোখের উপর পানির ছিটে ফোটা অনুভব করতেই বিরক্তি নিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা করে স্নিগ্ধ। এই এতো ভোরে ঘুমটা নষ্ট হওয়ার কোনো মানে হয়?
কিন্তু চোখ খোলার পর বাদবাকি বিরক্তি আর রাগটুকুও উবে যায় স্নিগ্ধর। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শাড়ি পরিহিতা একটা মেয়ের অস্পষ্ট চেহারা চোখে ভাসছে। লম্বা চুলগুলো থেকে টুপ টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ফর্সা শরীরে গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি ফুটে উঠেছে। আর শাড়ির পাশ থেকে কোমরের উন্মুক্ত অংশে একটা কালো কুচকুচে তিল জ্বলজ্বল করছে। যেটাতে চোখ আটকে যায় স্নিগ্ধর। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই এমন অস্বস্তিকর অবস্থায় তাকে পড়তে হবে তা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি সে।
নিজের দৃষ্টিকে যথাসম্ভব সংযত করে দ্রুত বিছানা থেকে উঠে পড়ে সে। এখন এখানে থাকা তার কাছে মোটেও সম্ভব নয়। তাই টাওয়াল নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে ওয়াশরুমে চলে যায় স্নিগ্ধ।
মিসেস ইয়ামিন চৌধুরীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লাগেজ গুলো গাড়ির ডিকিতে রেখে সিটে বসে পড়ে স্নিগ্ধ আর মিশরাত। অতঃপর গাড়ি চলা শুরু করে তার গন্তব্যের দিকে আপন গতিতে!…………..
চলবে ?