প্রেম_পায়রা ?️?️ ২৪,২৫

0
1689

প্রেম_পায়রা ?️?️
২৪,২৫
লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
চতুর্বিংশ_পর্ব

চারপাশ গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন। কোলাহলহীন নির্জন রাস্তায় মৃদু বাতাস এসে স্নিগ্ধর শার্টের কিছুটা অংশ ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে বারংবার।
শুনশান একটা ব্রীজের পাশ ঘেঁষে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একমনে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে স্নিগ্ধ। এক ফালি চাঁদের হালকা আলোয় ব্রিজের নিচে বহেমিয়ান নদীর পানি চিকচিক করছে।

– ” মিশরাত তুমি কোথায়?
আমি জানি আমি মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছি। তাই বলে এভাবে হুট করে হারিয়ে যাওয়া কী খুব প্রয়োজন ছিল? তুমি তো জানোই রাগের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে নিজের কন্ট্রোলে থাকতে পারি না আমি!
কোথায় তুমি!!”

পানির বহেমিয়ান‌ স্রোতের দিকে তাকিয়ে আনমনে বিড়বিড় করে বলে উঠলো স্নিগ্ধ।

পকেটে ফোনের ভাইব্রেশন টের পেতেই ভাবনার সুতো কাটে তার। পকেট থেকে ফোন বের করতেই সেখানে এসডি নামটা জ্বলজ্বল করছে। ফোন রিসিভ করে কানের কাছে নিতেই অপর প্রান্ত থেকে যে কথাগুলো কানে এসে পৌঁছায় তাতে স্নিগ্ধর চেহারার রং পরিবর্তন হতে থাকে ধীরে ধীরে। যথেষ্ট পরিমাণ গাম্ভীর্য বজায় রেখে প্রত্যুত্তরে বলে উঠলো,

– ” কিপ আইস অন হার! আ’ম কামিং হেয়ার!”

বলেই খট করে কল কেটে দিলো স্নিগ্ধ।
– ” আমি এর শেষ পর্যন্ত দেখে ছাড়বো! তোমাকে তো আমার কাছে ধরা দিতেই হবে মিস অরিন, সেটা যে করেই হোক! এত কিছু করার কারণটা কিভাবে অজানা রাখি বলো!”

আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই নিজে বলে উঠলো স্নিগ্ধ। মুখে রয়েছে স্মিত হাসি।

– ” ফারাহ্‌, এই ফারাহ্!”
কারো ডাক শুনে ঘুমের ঘোরেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে মিশরাত‌। আধো আধো চোখ মেলতেই সামনে সিদ্দিকা বেগমের চেহারা চোখে পড়ে তার।
– ” কি ব্যাপার, তুই এখানে মেঝেতে এভাবে ঘুমাচ্ছিস কেন ফারাহ্‌?”

আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিল‌ মিশরাত‌। তাই তো! সে মেঝেতে বসে এতক্ষণ খাটের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছিল।
– ” কিরে কথা বলছিস না কেন? কোথায় হারিয়ে গেলি?”

– ” আসলে দিদা, কাল রাতে এমনি একটা জিনিস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। কখন যে চোখ লেগে এসেছে তা টের পাইনি।”
সিদ্দিকা বেগমের কথায় আমতা আমতা করে বলে উঠলো মিশরাত‌। কিন্তু তার দৃষ্টি একটা জিনিস ই খুঁজে চলেছে!

– ” এটাই খুঁজছিস না তো?”
সিদ্দিকা বেগমের হাতে একটা হাতঘড়ি দৃশ্যমান। সেটা দেখে হালকা চমকে উঠে মিশরাত‌।
-” সেকি এই ঘড়িটা দিদা পেল কি করে? আমি তো এটা আমি ড্রয়ার টাতে রেখেছিলাম।”

– ” ভালোবাসার মানুষটার থেকে যখন দূরে থাকলেও স্মৃতি গুলো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, যখন চাইলেও দূরে সরে থাকতে পারবি না তাহলে অযথা দূরে থাকার বৃথা চেষ্টা কেন করছিস?
শান্ত গলায় মিশরাতকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন সিদ্দিকা বেগম। মিশরাতের মুখে কোনো শব্দ নেই। সিদ্দিকা বেগম তো ঠিকই বলছে। প্রতিনিয়ত নতুন করে স্নিগ্ধর স্মৃতি গুলো তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। তবুও বহু কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে সে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত না করা অবধি সে যে স্নিগ্ধর মুখোমুখি হতে চায় না।

দুপুরের দিকে ছাদে ভেজা কাপড়গুলো মেলে এসে বাচ্চাদের খাবার আয়োজন করায় ব্যস্ত ছিলো মিশরাত‌। কলিং বেলের আওয়াজ কান অবধি পৌঁছাতে পেছন ফিরে তাকায় সে। এখন এই ভরদুপুরে কে আসবে?
দরজায় কড়া নাড়ার পেতেই সামনের দিকে এগিয়ে যায় সে।
কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলতেই চোখে মুখে বিস্ময়ের সীমানা ছড়িয়ে পড়ে তার।

– ” ভ‌,ভ্‌,ভা,ভাইয়া তুমি?”
অবাকের সুরে বলে উঠল মিশরাত‌।

– ” কেন কি মনে করেছিলি? তুই আমাদের থেকে লুকিয়ে থাকবি আর আমরা তোকে খুঁজে বের করতে পারবো না?”
থতমত খেয়ে যায় মিশরাত‌। তার এখানে থাকা সম্পর্কে তার ভাই ইরফান কী করে জানলো? তার তো জানার কথা নয়।

-” ভাইয়া তুমি এখানে কি করে এলে? আর তোমাকে এ জায়গার কথা কে বলেছে?”
উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল মিশরাত‌।

– ” তুই এত বড় হয়ে গিয়েছিস কবে মিশরাত‌ যে নিজের কষ্ট গুলোকে চাপা দিয়ে একা একা সবার থেকে দূরে সরে এসেছিস?”
পাশ থেকে মেহেরের কন্ঠস্বর শুনে আঁতকে উঠলো মিশরাত‌। আরো এক দফা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা দুটো মানুষের দিকে।

– ” বউমনি, তুমিও?”

– ” হ্যাঁ আমি! তোর সাহস হলো কি করে আমাদের না জানিয়ে এখানে এসে বসে আছিস!
ওদিকে যে সবাই তোকে খুঁজতে খুঁজতে বেহাল দশা তার কি কোনো দাম নেই?”
মেহেরের হুংকারে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে মিশরাত‌।

– ” আমি তো চেয়েছিলাম তুমি আর ভাইয়া এই বিষয়ে না জানো! তোমার এই অবস্থায় কি করে এত বড় কথাটা বলতাম বলো? তাই ,,”

– ” আর তাই সবাইকে না জানিয়ে তুই দিদার কাছে চলে এসেছিস?
দিদা যদি আমাদের না বলতো তাহলে তো আমরা টেরও পেতাম না যে তুই এখানে!!”

মেহেরের কথা শুনে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল মিশরাতের‌।

– ” কি!! দিদা তোমাদের আমার ব্যাপারে বলেছে??”

-” হ্যাঁ আমিই বলেছি!!”
পেছন থেকে সিদ্দিকা বেগমের কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে।

– ” সরি স্যার! আমরা তার উপর নজর ই রাখছিলাম‌। কিন্তু হঠাৎ করে একটা গাড়ি আমাদের গাড়ির সামনে দিয়ে ক্রস করতেই ম্যাম কে আমরা হারিয়ে ফেলি! আর গাড়িটার পিছুও বেশিদূর করতে পারিনি!”

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলে নিচু কন্ঠে বলে উঠল স্নিগ্ধ কে।
স্নিগ্ধ তড়িৎ গতিতে দাঁড়িয়ে ছেলেটার সামনে গেল।

– ” হোয়াট! এত টা ইরেসপন্সেবল কি করে হতে পারো তোমরা! তোমাদের একটা মাত্র কাজ দিয়েছিলাম আমি! ঐ মেয়েটার উপর নজর রাখতে বলেছিলাম! সেটাও তোমাদের দ্বারা হয় নি!
আমার অরিনের সম্পর্কে প্রত্যেকটা ইনফরমেশন আমার চাই!
আর সেটাও আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে!”
স্নিগ্ধর হুংকার শুনে সামনে থাকা ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আর সেখান থেকে চলে গেল।
-” ড্যাম ইট!”
বলেই পাশে থাকা চেয়ারটা মেঝেতে ফেলে দিল স্নিগ্ধ!

– ” রবিনের মুখ থেকে আসল সত্যিটা বের না করা পর্যন্ত আমি স্নিগ্ধর সামনে যাবো না!
সত্যিটা তো আমাকে জানতেই হবে কে আমার নামে এত ঘৃন্য ষড়যন্ত্র চালিয়েছে!

আচ্ছা ভাইয়া তোমার ঐ ডিটেক্টিভ বন্ধু আছে না? উনার সাথে কথা বললেই তো পাওয়া যাবে রবিন এখন ঠিক কোথায় রয়েছে!!”

মিশরাতের বলা কথা কর্ণপাত হতেই ইরফানের টনক নড়ে। হ্যাঁ তাই তো। মিশরাত তো‌ ঠিকই বলছে। এই কথাটা তো তার মাথায় আগে আসে নি!!
পকেট থেকে ফোনটা বের করে কললিস্ট ঘেঁটে একসময় নম্বর টা পেয়েও যায় ইরফান। ইশরাক নাম দিয়েই সেভ করা নম্বরটা!
ফোনের রিংটোনের আওয়াজ আসতেই ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে সরু চোখে ফোনের দিকে তাকালো ইশরাক‌। বহু বছর পর চেনা একটা নম্বর চোখে পড়তেই মুচকি হাসলো সে। কানে লাগানো ব্লুটুথ অন করে শান্ত গলায় বলে উঠলো,

– ” ইয়েস মিস্টার ইরফান!”
ইশরাকের কন্ঠস্বর কানে পৌঁছাতেই ইরফান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো,
– ” কেমন আছিস?”
– ” এইতো আলহামদুলিল্লাহ! হঠাৎ এত বছর পর মনে করলি আমায়!
– ” আমি জানি তুই আমার উপর রাগ করে আছিস, কিন্তু দেখা হলে বিশ্বাস কর সব খুলে বলবো!
তুই এখন কোথায়?”

ইরফানের কথা শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ইশরাক‌। সামনে এগিয়ে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ায় সে।
– ” আমি তো চট্টগ্রামে! কেন কিছু কি হয়েছে ওখানে?”
– ” কালকের মধ্যে একটু ঢাকা ব্যাক করতে পারবি?”
– ” ঠিক আছে, এমনিতেও হাতে কোনো কেস নেই আপাতত! তাই কোনো সমস্যা নেই! আমি কাল সন্ধ্যার মধ্যেই ঢাকা ব্যাক করবো। ডোন্ট ওয়ারি!”
– ” ঠিক আছে! তাহলে কালকে দেখা হচ্ছে।”

বলেই খট করে ফোন কেটে দিল ইরফান। মিশরাত ইরফানের দিকে বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

– ” ইশরাক কাল সন্ধ্যায় ঢাকায় চলে আসবে। তুই টেনশন করিস না।”
মিশরাতও বিনিময়ে একটা সৌজন্যমূলক হাসি দেয়।

– ” কি মনে করেছো, স্নিগ্ধ? তোমাদের দুজনের মাঝে আমি প্রাচীর গড়ে দিয়েছি তাতেই আমার প্রতিশোধ নেয়া শেষ? উহু একদমই না! এখনো অনেক কিছু বাকি! আমি এত সহজেই তো সবটা ছেড়ে দিবো না। আমার প্রতিশোধ তো সেদিন পূর্ণ হবে যেদিন আমার সামনে তোমাকে এ কবরে রেখে আসা হবে!
এর আগে তো আমি তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি না।”
কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে দেয়ালে টাঙানো স্নিগ্ধর ছবিটা হাতে নিয়ে সেটাতে লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে দিলো অরিন‌। মুখের কোণে রহস্যময় হাসি।

পরদিন বিকেলে,,

– ” সবকিছু শোনার পর তো মনে হচ্ছে রবিনের একার পক্ষে এটা করা কখনোই সম্ভব না। এর পেছনে অন্য কেউ মাস্টার মাইন্ড রয়েছে। এখন সেটা কে একমাত্র রবিনকে ধরতে পারলেই জানা যাবে!
আচ্ছা মিশরাত ঠিক মনে করার চেষ্টা করে দেখো তো গত দুয়েক মাসের ভেতর কি কোনোভাবে কোথাও তোমার রবিনের সাথে দেখা হয়েছিল?”

ইশরাকের‌ প্রশ্ন শুনে মিশরাত খুব গভীর ভাবে চিন্তা করতে থাকলো! কিছুক্ষণ পর আপনাআপনি ই তার চোখ মুখে বিস্ময়ের আভা ফুটে উঠল।

– ” হ্যাঁ গত মাসের প্রথম দিকে একবার আমার রবিনের সাথে শপিং মলে দেখা হয়েছিল!”

উত্তর শুনতেই ইশরাকের‌ মুখে আচমকাই হাসি ফুটলো!

– ” সেসময় আমার আর স্নিগ্ধের মাঝে কিছুটা সমস্যা চলছিল। হঠাৎ একদিন শপিং মলে রবিনের সাথে দেখা হয়ে যায় আমার। আর আশ্চর্য জনক ভাবে সে আমার সামনে হাত জোর করে ক্ষমা চাইতে থাকে আর কিসব জানি উল্টোপাল্টা প্রলাপ বকছিলো!
কিন্তু এটার সাথে এই কেস কি কোনোভাবে রিলেটেড?”

– ” ইয়েস মিসেস মিশরাত‌ ফারাহ্‌। আপনার সাথে রবিনের দেখা কোয়েন্সিডেন্সলি ভাবে হয় নি। এটা কারো প্ল্যানের একটা পার্ট ছিল মাত্র। আর এটাকে ইউজ করেই ওসব ছবি, ভিডিও বানানো হয়েছে। আই এম শিওর যেই বা এটা করছে না কেন তার উদ্দেশ্য শুধু আপনাদের মাঝে ডিসটেন্স তৈরি করা না! এর পেছনে আরো কোনো রহস্য আছে!………..

চলবে ?

#প্রেম_পায়রা ?️?️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#পঞ্চবিংশ_পর্ব

ইশরাকের বলা কথাগুলো কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় মিশরাত। কার ই বা তার আর স্নিগ্ধের সাথে শত্রুতা যে তাদের দুজনকে আলাদা করে দেয়ার জন্য এতো প্রচেষ্টা।
– ” আপনি এসব কি বলছেন ভাইয়া? এগুলো কি করে সম্ভব!”
মিশরাতের প্রশ্নের জবাবে ইশরাক আলতো হাসলো।

– ” ইয়েস মিসেস মিশরাত‌। আমি যা বলছি তা ঠিকই বলছি। তাই এখন সেই মাস্টার মাইন্ড কে ধরতে হলে আগে রবিনকে ধরতে হবে!
আর সেটার জন্য আমার কিছু ইনফরমেশন প্রয়োজন। কারো কাছে রবিনের পার্সোনাল নাম্বার রয়েছে?”
ইশরাকের‌ প্রশ্নে ইরফান কললিস্ট থেকে তড়িঘড়ি করে রবিনের ফোন নম্বর ঘেঁটে ঘেঁটে বের করে ইশরাকের‌ দিকে এগিয়ে দিতেই ইশরাক নম্বরটা নিয়ে নেয়।
ইশরাক নাম্বার টা নিতেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বিকেলের দিকে ঢাকায় পৌঁছে সর্বপ্রথম মিশরাত আর ইরফানের সাথে একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করে সে।

– ” আচ্ছা ঠিক আছে, আমি এখন উঠি! খুব সম্ভবত রাতের দিকেই রবিনের লোকেশন ট্রাক করা হয়ে যাবে!
আর রবিনকে একবার হাতের মুঠোয় পেলে ও নিজেই ‌সব কিছু গড়গড় করে বলে দিবে! ডোন্ট ওয়ারি!”

মিশরাত আর ইরফানের দিকে তাকিয়ে বলে গটগট করে বাইরের দিকে হাঁটা শুরু করলো ইশরাক‌। আর মিশরাতও ইশরাকের যাওয়ার পানে এক ফালি আশা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। কে জানে জীবনের কোন মোড়ে গিয়ে থামবে এই ঝড়‌!

ইফতেখার চৌধুরীর রিলিজের সব পেপারে সাইন করে ডক্টরের কাছে বুঝিয়ে দেয় স্নিগ্ধ। ইফতেখার চৌধুরী আর মিসেস ইয়ামিন চৌধুরীর সাথে কোনোভাবে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা দুজন মুখ ফুটে কিছু বলেন নি। তাতেই স্নিগ্ধর বোঝা হয়ে গিয়েছে যে এবারে তাকে সবকিছু ঠিকঠাক করার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে!!
দীর্ঘ এক উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ইফতেখার চৌধুরীকে নিয়ে বাইরের দিকে পা বাড়ায় স্নিগ্ধ।
গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী কাঠকাঠ গলায় বলে উঠেন,
– ” বাকি রাস্তা টুকু আমরা একাই যেতে পারবো! তোমার আর প্রয়োজন মনে করছি না স্নিগ্ধ। আর তোমাকে আমি যেটুকু বলেছিলাম আশা করি নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে?”
মিসেস ইয়ামিন চৌধুরীর কথায় স্নিগ্ধ শুধু সম্মতি জানালো।

– ” ইটস টু লেট মিশরাত এন্ড ইরফান! আমাদের যা করতে হবে খুব শীঘ্রই করতে হবে! রবিনের লোকেশন ট্রাক করে জানা গিয়েছে সে আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগেই সিটি হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়েছে আর লোকেশন অনুযায়ী তার গাড়ি এয়ার পোর্টের দিকেই যাচ্ছে। আমি যদি ভুল না হই, তাহলে খুব সম্ভবত রবিন আজ রাতের মধ্যেই দেশ ছাড়ার প্ল্যান করছে!”

ইশরাকের বলা কথা শুনতে পেয়ে মিশরাতের‌ বিস্ময়ের সীমানা রইলো না। সবকিছু যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

– ” হ্যালো মিশরা‌ত! তুমি কি আমাকে শুনতে পারছো? আমি আমার টিম নিয়ে এক্ষুনি বের হচ্ছি রবিনকে ধরার জন্য!”

– ” আমরাও যাবো আপনার সাথে!”

– ” আর ইউ শিওর? ওখানে কিন্তু রিস্ক ও থাকতে পারে!!”

– ” ইয়েস আ’ম শিওর। আমি আর ভাইয়া এখনি আশ্রম থেকে বের হচ্ছি!”

ইশরাককে উদ্দেশ্য করে বলার পর কল কেটে দিলো মিশরাত‌। চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

– ” ইশরাক কি বলেছে মিশরাত? রবিনের কোনো ক্লু পাওয়া গিয়েছে!”

– ” হ্যাঁ ভাইয়া, এখনি আমাদের বের হতে হবে! বউমনি কি ঘুমিয়ে পড়েছে?”
ইরফান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই মিশরাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

– ” স্যার, মিশরাত ম্যামের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। সে বর্তমানে ঢাকাতেই রয়েছেন। তবে এটা দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে তাকে কেউ কিডন্যাপ করে রেখেছে! তবে আমরা জায়গাটা ট্রেকিং করে জানতে পেরেছি!”

হঠাৎ ফোনের অপর পাশ থেকে সৌরভের বলা কথা শুনে চমকে উঠলো স্নিগ্ধ। এ কদিনে কম চেষ্টা করে নি সে মিশরাতকে‌ খোঁজার। কিন্তু আজকে হঠাৎ এভাবে তাকে ফিরে পেতে হবে কল্পনাও করে নি সে।

– ” ওকে আমি আসছি! তুমি আমাকে লোকেশন টা সেন্ড করে দাও!”

স্নিগ্ধর কথানুযায়ী সৌরভ একটা লোকেশন সেন্ড করে দিলো স্নিগ্ধকে‌।
– ” আমি আসছি মিশরাত! আমি আসছি!”
কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে পাশ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো স্নিগ্ধ।

গাড়ির ব্যাক সিটে বসে আছে মিশরাত‌। চোখে মুখে আতংকের ছাপ। পাশেই ইরফান বসে রয়েছে। আর ফ্রন্ট সিটে বসে ইশরাক রবিনের লোকেশন অনুযায়ী ড্রাইভার কে বিভিন্ন ইনফরমেশন দিচ্ছে।
মিশরাতকে চিন্তিত থাকতে দেখে পাশ থেকে ইরফান বলে উঠলো,
– ” চিন্তা করিস না! সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে! ধৈর্য ধর।”

ভাইয়ের কথা শুনে অসহায় দৃষ্টিতে একবার ইরফানের দিকে তাকায় মিশরাত‌। ইরফান ও চোখের ইশারায় তাকে আশ্বাস দেয়।

– ” ইয়েস! ইয়েস, রবিনের গাড়িটা পাওয়া গিয়েছে ! আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রবিনের গাড়িকে ক্রস করতে পারবো!”
সামনের সিট থেকে হঠাৎ করে ইশরাকের বলা কথা শুনতে পেয়ে আশার আলো দেখতে পেল ইরফান আর মিশরাতের‌।
প্রায় মিনিট বিশেক পর গাড়িতে হঠাৎ ব্রেক কষাতে হালকা সামনে ঝুঁকে পড়লো মিশরাত‌ আর ইরফান।
গাড়ির ফ্রন্ট লাইটের আলোয় রাস্তা হালকা আলোকিত হয়ে রয়েছে। একটা গাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাড়াতেই দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো ইশরাক‌। পিছু পিছু মিশরাত আর ইরফান ও বেরিয়ে আসল। এভাবে হুট করে গাড়ির সামনে কেউ আসার কারণে বিগড়ে যাওয়া মেজাজ নিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে রবিন। কিন্তু পরক্ষণেই মিশরাত আর ইরফানকে দেখতে পেয়ে ভড়কে উঠলো রবিন।
– ” ফারাহ্ ত,ত্, তুই এখানে?”

– ” হ্যাঁ মিস্টার রবিন সাহেব। ফারাহ্ এখানে!
তা কোথায় পালানোর প্ল্যান করছিলেন রবিন সাহেব!”

ইশরাকের কথায় সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
– ” তুই কে? আর তোমরা এখানে কী করছো? আমারে যাইতে দাও! নাইলে ভালো হইবো না বলে দিলাম!”

– ” হ্যাঁ, হ্যাঁ বলছি তো! এত তাড়া কিসের? আমি ইশরাক ফাহিম! দ্যা ডিটেকটিভ অফিসার! আর এখানে এসেছি তোমার কিছু বিশেষ খাতির যত্ন করতে!”

পুলিশের কথা শুনে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল রবিনের‌। কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। আশপাশ কয়েকবার তাকিয়ে পালানোর পথ খুঁজে সেখানে পা বাড়াতে নিলেই ইশরাক সেটা বুঝতে পেরে তড়িৎ গতিতে রবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
– ” আরে কোথায় পালাচ্ছেন রবিন সাহেব। পালালে হবে নাকি! এখনো প্রশ্নোত্তর করা বাকি!”

– ” আমার রাস্তা ছাড় ইশরাক, নাইলে কিন্তু আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হইবো না। আমারে যাইতে দে!”

– ” যদি জেলে না যেতে চাও তাহলে সবটা বলে দাও রবিন। নাহলে কিন্তু তোমাকে জেলে যাওয়ার চাইতে কেউ বাঁচাতে পারবে না! সো যদি জেলে যাইতে না চাও যা যা জিজ্ঞেস করবো সোজাসুজি সেগুলোর উত্তর দিবে!

রবিন হাশপাশ করছে। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। এভাবে যে তাকে ধরা পড়তে হবে তা কল্পনাও করতে পারে নি সে।
– ” আচ্ছা ঠিক আছে! আমি বলতাছি! আমি সব বলতাছি! কিন্তু আমি জেলে যাইতে চাইনা!”

রবিনের কথায় বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো ইশরাকের মুখের কোণে।

– ” মিশরাতের সাথে এসব ছবি কার কথায় বানিয়েছো তুমি? কার প্ল্যান অনুযায়ী এখন পর্যন্ত এত সব ড্রামা চালিয়েছো? এসবের পেছনের মাস্টার মাইন্ড কে?
আর কেনই বা তুমি তার সাথে হাত মিলিয়েছো!”

– ” অরিন! অরিন সারাহ্‌র কথায়!
অরিনের কথা মাফিক আমি সেইদিন ফারাহ্‌র লগে শপিং মলে দেখা করি আর প্ল্যান অনুযায়ী মিশরাতের লগে একটু জোরাজুরি করার চেষ্টা করি আর সেটাই পেছন থেকে ক্যামেরা বন্দি করে অরিন‌। সেইগুলারে ইডিট কইরা তার প্রায় এক মাস পর পেনড্রাইভ আকারে আমি স্নিগ্ধর কাছে পাঠায় দেই‌। আর অরিন ও তার প্ল্যান অনুযায়ী স্নিগ্ধরে ঘুমের ওষুধ খাওয়াইয়া সেদিন নেশাক্ত বানাইয়া ফারাহ্‌র সামনে হাজির করে যাতে দুইজনের মধ্যেই ঝগড়া শুরু হয়। আর দুজনেই যাতে দুই প্রান্তে চইলা যায়।”

ছোট একটা দম নিয়ে গড়গড় করে বলে দিল রবিন। আর রবিনের বলা কথা কর্ণপাত হতেই মিশরাতের চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।
– ” অরিনের সাথে তোমার পরিচয় হলো কি করে? আর তুমি ই বা অরিনের কথা শুনে এগুলো করতে গেলে?”

– ” অরিনের সাথে আমার যোগাযোগ হয় প্রথমবার ফোনে‌। সে আমারে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়া তার প্ল্যান সম্পর্কে আমারে জানায়‌। আমি ও হ্যাঁ বলছি কারণ আমি ফারাহ্‌র কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে চাইছিলাম! আমারে প্রত্যাখ্যান কইরা ঐ স্নিগ্ধর লগে বিয়েতে রাজী হওয়ার জন্য আর সবচেয়ে বড় কথা সেইদিন সবার সামনে আমারে থাপ্পড় মাইরা অপমান করার জন্য আমি অরিনের সাথে হাত মিলাইছি!”

সবটা শুনে যেন মিশরাতের মাথা ঝিমঝিম করছে। গোলক ধাঁধায় পড়ে জীবনের সবচেয়ে বড় কঠিন রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে সে।

চারপাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। জঙ্গলের মতো একটা রাস্তার মাঝ বরাবর একটা পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরি বা গোডাউনের মতো রয়েছে। আশেপাশে কোনো মানুষের হদিস পাওয়াও বড় মুশকিল।
ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে ধীর পায়ে গোডাউনের দিকে এগোতে থাকে স্নিগ্ধ। সৌরভের কথা অনুযায়ী মিশরাতকে এখানেই কিডন্যাপ করে রাখা হয়েছে।
গোডাউনের ভিতরে প্রবেশ করতেই সারি সারি কার্টুন চোখে পড়ে স্নিগ্ধর। গলা শুকিয়ে আসছে তার। খানিকটা ভেতরে যেতেই কয়েকবার মৃদু গলায় মিশরাতের নাম উচ্চারণ করে সে। কিন্তু কোনো রেসপন্স না আসায় আরো কয়েক পা সামনে এগোতে থাকে সে। একদম শেষের দিকে পৌঁছাতেই একটা ছায়ামূর্তি দৃশ্যমান হয় তার চোখে। কোনো মেয়েলি ছায়ামূর্তি। চোখে মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল স্নিগ্ধর। অবশেষে মিশরাতের দেখা পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে।
– ” ম,ম্,মি,মিশরাত‌!”
আলতো স্বরে পেছন থেকে ডাক দিয়ে উঠলো স্নিগ্ধ‌।

– ” ওয়েলকাম‌ মিস্টার আশফিন চৌধুরী স্নিগ্ধ! ওয়েলকাম‌ টু দ্যা হেল!!”
কিন্তু প্রত্যুত্তরে অন্য কারো কন্ঠস্বর শুনে আঁতকে উঠল স্নিগ্ধ। এটা তো মিশরাতের গলার আওয়াজ না। তাহলে এই ছায়ামূর্তি টাই বা কার?…………

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here