মনময়ূরী,১১,১২

0
1155

মনময়ূরী,১১,১২
Anamika

এশার পরীক্ষার শেষ দিন ছিল আজ। এশ যেন অনেক বড় দ্বায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে গেল আজ এমন তার ভাব। মুখে ঝলক খুশির সেই সাথে ঠোঁটে মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে হাঁটছে সে। আজ নাহয় হেঁটেই বাড়ি যাবে সে। খোলা আকাশের নিচে দিয়ে শত ব্যস্ততার এই শহরের পরে কিছু কিছু রাস্তা নিরব পড়ে আছে মাঝখানে। এই গোলমেলে পরিবেশ তো এই সুন্দর মনোমুগ্ধকর শান্ত এক পরিবেশের দেখা মেলে পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে বাড়ি আসার ঘণ্টার এই সফরে। হাঁটার সময় এশার মনে শুধু একটা বিষয়ই চলছিল আর সেটা হলো মাহির। আজ নিশ্চয় মাহির বলবে এবার তো এক্সামও শেষ হলো স্কলারশিপ পেয়ে গেলেই আর একমুহূর্তে যেন তোর পা দেশের মাটিতে স্থায়ী না থাকে। যত দ্রুত পারিস চলে আয়। এশার মন বলছে মাহির এমনটাই বলবে। সে খুশিতে লাফিয়ে ওঠে মাঝ রাস্তায়। লাফানোর পরে দাঁত দিয়ে জিহ্বা কাটে সে। চোখ খিঁচে বাম পাশে ফিরে হালকা চোখ খুলে তাকায় সে, নাহ কেউ নেই। এবার সামনে, পেছনে ডানে তিন দিকেই চোখ বুলিয়ে নেয় সে। যাক কেউ তাকে লাফাতে দেখেনি নয়তো নির্ঘাত পাগল মনে করতো। কিন্তু জায়গাটা তো ফাঁকা। আরও কিছুক্ষণ লাফালে কেউ দেখবেও না। আচ্ছা ও যদি পাগলের মতো নাচে তবে কী খুব খারাপ হয়ে যাবে? উহু…. কেউ নেই মানেই কারো চোখে পড়বে না। যেখানে দেখার কেউ নেই সেখানে লজ্জা পেয়ে খুশিটা দমিয়ে রাখারও কোনো কারণ নেই। এশা লাফায়। আরও লাফায়। বারবার লাফিয়ে নিজের খুশি জাহির করতে থেকে, নিজের সব সুখ ভাগ করে নেই এই পিঁচ ঢালা নিঃসঙ্গ রাস্তার সাথে, এই খোলা আকাশের সাথে। তারপর…. তারপর নিজেই নিজের মাথায় টোকা মেরে বলে, কীরে এশা, পাগল হয়ে গেলি দেখি। পাগলামোতে এতোই মত্ত হয়ে গেলি যে বাড়ি ফিরতে হবে তার খেয়াল নেই তোর। মাহির বলেছে তো আজ অপেক্ষা করবে। প্রতিদিনের মতো রাতে কথা বলবে আজ তবে আজ সে পরীক্ষা শেষে এশা বাড়ি পৌঁছাতেই কথা বলবে বলেছিল। আর আর বলেছিল অপেক্ষা করবে। ইশ, তুইও না। খুশির চক্করে গেলি তো ভুলে! এখন যদি গিয়ে দেখিস মাহির তোর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে চলে গেছে তখন! চল চল তাড়াতাড়ি পা চালা এশা। ইশ আজ নাহয় একটা সিএনজি নিলেই পারতি রে। বড্ড ভুলো মন তোর। নিজেকে খুব করে বকে দেয় এশা।

ছ’মাস আগের সেই দিনটি আজও চোখের সামনে ভাসতে থাকে। সেইদিন মাহির চলে যায় আর রেখে যায় এশা’কে। এশা বড্ড মিস করে তাকে। রোজ নিয়ম করে কথা হলেও কোথায় যেন একটা খালি জায়গা থেকেই যায়। এই ক’মাসে রোজ নিয়ম করে মাহিরের আওয়াজ শোনা এশার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এইভাবেই হয়তো একদিন আওয়াজ এর সাথে সাথে মাহিরের সবকিছু সহ মাহিরও এশার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে। এশা যখন এসব ভাবতে থাকে তখন মাঝেমাঝে মনে ভয় জাগে। এশা যেমন মাহিরকে নিজের অভ্যেসে পরিণত করে ফেলছে ধীরেধীরে তেমনই কী মাহিরও এশা’কে নিজের অভ্যেস বানিয়েছে? না-কি শুধু এশার প্রতি দ্বায়িত্বটুকু পালন করতে এমন করছে। এশা নিজের মনকে বোঝায়, মাহিরও নিশ্চয় তার মতো করেই এশা’কে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে। নয়তো এশার জন্য এতোকিছু কেন করবে সে। এশা রেগে গেলে মান ভাঙায় মাহির। এমনটা তো তখনই সম্ভব যখন দ্বায়িত্বের সাথে ভালোবাসাটাও থাকে কারো মনে। মাহিরেরও হয়তো তাই। আর যদি না হয়? ভাবতেই ভেতরটা চিনচিন করে ওঠে আবার নিজেকে সামলে বলে, না হলে হয়ে যাবে। এতোদিন দূরে থেকে শুধু কয়েক মিনিটের কথায় যদি এশা এমন নিজ জগতটা হারিয়ে ফেলতে পারে তবে ১০-১২ ঘণ্টা সামনে থাকলে তো মাহির এমনিতেই এশার মাঝে হারিয়ে যাবেই। তার উপর ছুটির দিন মানে তো পুরো ২৪ ঘণ্টা একসাথে কাটানো। সম্ভব না হলেও এশা সম্ভব করেই ছাড়বে।

-সেটা কিছুতেই সম্ভব নয় এশা।
-কেনো সম্ভব নয় বলবে আমায়?
মাহির কিছুক্ষণ নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। মাথায় হাত দিয়ে চুল পেছনের দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয় আবার কপাল চেপে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নেয় কয়েকবার। আবার সোজা হয়ে বসে সে। হাত দু’টো সারেন্ডারের ভঙ্গিতে নিয়ে ঠোঁট দুটো ছোট্ট করে ফু দেয় সে। এতে কিছুটা স্বাভাবিক হয় সে। পাশে রাখা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক ঢোক পানি দিয়ে গলা ভেজানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে কাজ হয় না দেখে পুরো গ্লাসের পানিটা শেষ করে হালকা শব্দ করে গ্লাসটা রাখে সে।
-এশা আমাদের কিন্তু কথা হয়েছিল তুই আগে পড়াশোনা কমপ্লিট করবি। স্কলারশিপের জন্য চেষ্টা করবি তবে আজ এমনভাবে জেদ করছিস কেনো?
-আমি জানি না। আমি ওসব স্কলারশিপের চেষ্টা করতে পারবো না, তুমি দেশে ফিরে এসো। এসে থাকো, যদি মনে হয় আমার সাথে থাকতে পারবে তুমি তবে থাকলে নয়তো চলে যাবে। কিন্তু আমি আসছি না ব্যস।
-এশা, আমি অনেক কষ্টে নিজের রাগটা দমিয়ে রেখেছি সেটা বাইরে আনতে বাধ্য করবি না বলে দিচ্ছি।
মাহিরের মুখভঙ্গি শক্ত হয়ে আসে দেখে এশা ভয় পায় তবুও নিজেকে সামলে কঠোর গলায় বলে,
-তবে যেমন আছি তেমনই থাকি আমরা। আমি এখানে একা যেমন ছিলাম, যেমন থেকেছি, যেমন আছি তেমনই নাহয় থাকবো। তুমি আর আমার কথা ভেবোনা বুঝলে।
-এশা এবার কিন্তু বেয়াদবি হয়ে যাচ্ছে।
মাহির রেগে যেতে এশা কলটা কেটে দিয়ে মোবাইল সুইচড অফ করে রেখে দেয়। রাগছে রাগুক কিন্তু সেও যা চায় তা মানিয়েই ছাড়বে নয়তো দু’জন দু প্রান্তে রয়ে যাবে।

মাহির মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে। এখন বাংলাদেশ সময় নিশ্চয়ই রাত ১২টা। এশার এতক্ষণ ঘুমে গলে পড়ে থাকার কথা। এদিকে হোয়াটসঅ্যাপ কল যাচ্ছে না দেখে একবার সরাসরি কল দেয় সে। কিন্তু ফোন বন্ধ পায়। চার্জ শেষ হওয়ার কোনো কারণ দেখছে না, শেষ হলেও এশা চার্জ করতে লেট করে না কখনো। নির্ঘাত ইচ্ছে করেই এমনটা করেছে সে। আজ মাহির এশার অপেক্ষায় ছিল। বলেও রেখেছিল তাকে। মাহিরের ধারণা ছিল পরীক্ষা শেষেই ছুঁটে বাড়িতে আসবে এশা কিন্তু সে আসেনি। এসে কলও দেয়নি। রাতে মাহির যখন নিজে থেকে কল দেয় তখন জেদ ধরে বসে থাকে সে। বলে স্কলারশিপ চাই না ওর। পড়ালেখা ভীষণ প্যারা। দেশে থেকেই করবে, সহজ হবে। বাইরে গিয়ে এডজাস্ট করতে গিয়ে ওইটুকুও পড়ালেখা হয়ে উঠবে না তার দ্বারা। মাহির বার বার ইন্সিস্টস করে যেন এশা নিজের এই উদ্ভট ডিসিশন বদলে আবার আগের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। কিন্তু না কিছুতেই তা হলো না। গতকাল অবধিও সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। সে খুশি ছিল আর ভয়েও। বারবার উপরে তাকিয়ে চোখ বুঁজে চাইতেই ছিল সে, যেন স্কলারশিপটা পেয়ে যায় সে। আর তাকে যেন সেইখানে পাঠানো হয় যেইখানে মাহির আছে বর্তমানে। কিন্তু হঠাৎই হাওয়া পরিবর্তন হলো। এশা’কে কারণ জিজ্ঞেস করলে খুবই লেইম একটা কারণ দেখায় সে। পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে নাকি ব্রেইন পঁচে গেছে এসব বড় কোনো পরীক্ষা দিলে নাকি শুধু শুধু লোক হাসানো হবে; উল্টো কাজের কাজ কিছুই হবে না। মাহির যখন এশার কাছে এমনটা শোনে তখন বেশ অবাক হয়েই চেয়ে ছিল সে। এশা’কে চিনতে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে বলে মনে হচ্ছিলো। একবার তো ভেবেছিলো এশা হয়তো মজা করছে তার সাথে। কিন্তু না এশা একনাগাড়ে কথাটা বলতেই থাকলো। যেন সে তোতা পাখি আর এই একটা বাক্যই তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে তাই সেটাই আওড়ে যাচ্ছে সে।

এশা তখনও জেগে। তার মন চায়, একবার… একবার মাহিরের সাথে কথা বলতে। এখনই বলতে ইচ্ছে করে ‘আমি আসতে চাই, তুমি যেমনটা চাও আমিও তেমনটাই চাই। হোক সেটা পড়াশোনার খাতিরে নয়তো শুধু তোমার কাছে যাওয়ার বাহানায়, আমি যেতে চাই তোমার বর্তমান ঠিকানায়। সেই শরহে যেই শহরে পা রাখলেই তুমি তুমি গন্ধ পাওয়া যায়। তুমি কী নিয়ে যাবে আমায়?’ কিন্তু সে চেয়েও বলতে পারে না। চুপ করে রয়। মুখ বুঁজে সহ্য করে পড়ে রয়। ঘুমটাও যেন ছুটি নিয়েছে। কষ্টেরা সেন ঘুম তাড়িয়েছে। বলেছে যা ঘুম যা, তুই চলে যা। পালিয়ে যা। এশার মনে এখন আমার বাস আর চোখে কাজল ছড়িয়ে দিতে আমি করিয়েছি স্রোতের সাথে সাক্ষাত। তুই এসে আমার কাজে ঘটাস না ব্যাঘাত। যা ঘুম যা আজ এশা’র চোখে রবে অশ্রুর বাস।

Continued……

Anamika

#মনময়ূরী
১২.

আজ হঠাৎ এতো ট্রাফিক! মাহিরের মেজাজ খারাপ করে দেয় এতোটা অপেক্ষা, এতোটা পরিশ্রম তার পরে গিয়ে সে সফল হয়েছে। আর কিছুটা পথ তারপরেই সে গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। কিন্তু বাধ সাধছে এই ট্রাফিক। আজ এতোটা গ্যাঞ্জাম কী কারণে হতে পারে? তার অপেক্ষা দীর্ঘ করতে? হতেই পারে। ট্যাক্সির ব্যাক সীটে বসে আছে মাহির। একেকবার মাথা বের করে সামনের দিকে আবার পেছনের দিকে দেখে নিচ্ছে সে। না জ্যাম অনেকটা লম্বা রাস্তা ব্লক করে রেখেছে। সে চোখের গ্লাসটা খুলে হাতে নিয়ে এক কোণা ঠোঁটে চেপে ধরে অপেক্ষা করতে থাকে। অপেক্ষা জ্যাম ক্লিয়ার হওয়ার, অপেক্ষা এই পথের দূরত্ব শেষ করার। হঠাৎ রেড লাইট থেকে ইয়োলো জ্বলে ওঠে। মাহির একটু নড়েচড়ে বসে। আর একটু অপেক্ষা তারপরই গ্রীণ সিগনাল দেখা যাবে আর সমস্ত জ্যাম ছেড়ে যাবে। সে এই মুহুর্তে যে স্থির ট্যাক্সির ব্যাক সীটে বসে আছে সেটিও গতিশীল হবে। ব্যস আর একটু। আর একটুখানি অপেক্ষা।

অপেক্ষার অবসান ঘটলো। ট্যাক্সি আবারও গতিপ্রাপ্ত হলো। চলছে নিজ গতিতে তবুও মাহিরের যেন তর সইছে না। সে বলে,
-ড্রাইভ ফাস্টার।
-আ’ম ট্রাইং।
ড্রাইভারের উত্তর। সে তার মতো যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তবুও মাহিরের তাড়াহুড়ো করায় সে কিছুটা বিরক্ত হচ্ছে। কিছুই করার নেই, তার তো কাজই এমন। দেখে মনে হচ্ছে পেছনে বসে থাকা মানুষটির খুব জরুরি কোনো কাজ আছে। হতে পারে বড় কোনো ক্ষতি হতে পারে তাই এমন তাড়া দিচ্ছে। মাহির আবারও তাড়া দেয়। সে বলে,
-আরে ভাই জলদি চলো অলরেডি দেরি হয়ে গেছে।
ড্রাইভার সম্ভবত তার কথার মানে বুঝলো না। মাহির বিরক্ত হয় উত্তর না পেয়ে। একবার তাকায়, বোঝে তার ভাষা ড্রাইভারের বোধগম্য হয়নি। সে এতো টেনশনের মাঝেও নিচের ঠোঁট উপরের দাঁতে কামড়ে ধরে হাসে। এতোটা ডেস্পারেট হয়ে গেছে সে! ড্রাইভার যে বাঙালী নয় সেটাও তার খেয়াল নেই। সে বাইরের দিকে তাকায় কিছুক্ষণ। আকাশটা দেখা যাচ্ছে না। এতো উঁচু উঁচু বিল্ডিং সবকটিতে মিলে বেশ ষড়যন্ত্র করেই আকাশটা আড়াল করেছে। মাথার উপরেরটুকু দেখা সম্ভব কিন্তু অবশ্যই তাকে ট্যাক্সি থেকে নামতে হবে, সেটা এই মুহুর্তে এসে সম্ভব নয়। মোটেও নয়। আজকের আকাশটা নিশ্চয়ই একসাথে হাতে হাত রেখেই দেখা হবে। বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে আসার সময়ও তো মাথায় অন্য চিন্তা থাকায় আকাশটাকে দেখা হয়নি। আজ আকাশের রংটা কেমন হতে পারে? প্রেমময় কোনো রঙে রাঙিয়ে আছে নিশ্চয়ই। ভাবনার মাঝে একটা প্রশ্ন কানে ভেসে আসে তার। সে সামনে তাকায়, ট্যাক্সি চালকই করেছে প্রশ্নটি। প্রশ্নের অর্থ এমন,
-কেউ আসছে বুঝি, সামওয়ান স্পেশাল। কে স্যার?
মাহিরের সোজা উত্তর,
-মাই ওয়াইফ।
এরপরে আরও একটি প্রশ্ন তার কানে এসে বাজে। মুহুর্তেই মনের মাঝে অন্যরকম অনুভূতি জাগায়।
-খুব ভালোবাসেন স্ত্রীকে?
মাহির উত্তর দিতে পারে না। কী বলবে? ভালোবাসে সে? সত্যিই ভালোবাসে? আর এশা সে কি ভালোবাসে?
মাহির কিছুটা নড়েচড়ে বসে। তারপর… তারপর নিরবতার মাঝে দিয়ে চলে যায় সময়টা। গন্তব্যে এসে পৌঁছে যায় ট্যাক্সি। ট্যাক্সি থামলেই সামনের দিকে হেলে যায় মাহির তখনই তার ধ্যান আসে। বাইরে তাকায় সে। হ্যাঁ, এইতো সে এখন এয়ারপোর্টের সামনেই আছে। নামে সে আর বলে যায় আবারও ফিরবে যেন ওয়েট করে।

একটু একটু করে এগোতে থাকে মাহির। ভীড় ছাড়িয়ে এদিক থেকে ওদিক যায় সে। খোঁজে এক চেনা মুখ। পেয়েও যায় সে। ওই তো সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। বার বার ঘড়ি দেখছে। অপেক্ষা করতে করতে বিরক্তও হয়ে পড়েছে এতক্ষণে সাথে ভয়ও দেখা যাচ্ছে তার চোখে। ভয়ের কারণ কী হতে পারে? সে কী ভাবছে মাহির তাকে নিতে আসবে না। সে কী ভাবছে, মাহির ভুলে গেছে তার আসার কথা। ‘ওরে পাগল মেয়ে আমি কখনো ভুলতে পারি নাকি।’ মনের কথা মনেই বলে সে। মুচকি হেসে এগিয়ে যায়। ভাবলো পেছন থেকে এশা’কে ‘ভাউউউ’ বলে চমকে দেবে। ভয় পেয়ে মেয়েটা নিশ্চয়ই কাঁদো কাঁদো চোখে তাকাবে। আর সে আছে দেখে সেই ভয়টা খুশির রূপ নেবে। কিন্তু তা আর হলো না। এশা আগেই দেখে ফেলে মাহিরকে। মাহিরকে দেখে এশার চোখদুটোতে জল আসে ঠিকই কিন্তু ভয়ে বা কষ্টে নয়। খুশিতে। এশা তো ভেবেই নিয়েছিলো সে আসতে পারবে না। পরীক্ষায় সফলতা আসলেও হয়তো তাকে অন্য কোথাও পাঠানো হবে। কিন্তু না সে এই মুহুর্তে মাহিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

-খুশি?
-অনেক খুশি।
-তবে যে আগেই হার মেনে বসেছিলি সেটা?
এশা দমে যায় কিছুটা। কী বলবে সে?
-কীরে উত্তর দে।
এশা ইতস্তত করে বলে,
-ওই আমার ভয় করছিলো।
-কেনো?
এশা করুণ দৃষ্টিতে দেখে মাহিরের দিকে। এতো এতো প্রশ্ন কেন করতে হচ্ছে তার? এই তো লম্বা একটা জার্নি শেষ করে এলো এশা তবে এখন মাহিরের তো বোঝা উচিত তার রেস্টের প্রয়োজন। সে কোথায় এশা’কে তার সাথে নিয়ে যাবে তা না করে এয়ারপোর্টের বাইরেই একের পর এক প্রশ্ন করতে হচ্ছে তাকে! এখন তো রীতিমতো ভয় হচ্ছে এশার; কোথায় মাহির বলে বসবে চল এখানেই সংসার শুরু করি। এয়ারপোর্টের বাইরে, রোজ নিত্যনতুন মানুষকে আসতে যেতে দেখে বেশ কাটবে সময়টা।
-আবার সাইলেন্ট মোডে চলে গেলি যে!
-উফফফ! তুমি কী বলো তো? চলো না বাসায় যাই। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না আর।
মাহির আর ঘাটালো না। মেয়েটা ভাঙবে তবু মচকাবে না। এখনও কী সুন্দর কথা আড়াল করে যাচ্ছে অথচ সে জানেই না মাহির সবটা জানে। ভয় তার পরীক্ষা অথবা সিলেকশন বা রিজেকশন নিয়ে ছিল না। কখনোই ছিল না। ভয়টা তো তার মাঝে তৈরি করে দেওয়া হয়েছিলো তাও আবার খুব কাছের কেউ এমনটা করেছিল। মাহির লাগেজ নিয়ে হাঁটতে শুরু করে বলে,
-ফলো মি।
এশাও শান্ত মেয়ের মতো মাহিরের পেছনে হাঁটা শুরু করে। ট্যাক্সিতে লাগেজ গুলো রেখে বসে পড়ে দু’জনে। এশা’কে বেশ চিন্তিত দেখা যাচ্ছে। হয়তো ভাবছে এখন তো এড়িয়ে গেল, আবার না শুরু হয়ে যায় মাহির। চিন্তিত চেহারায় কপাল কুঁচকে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে সে। মাহির কিছু না জানার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে,
-মাথা ব্যথা?
এশা তাকায়। মাহিরকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। সে বলে,
-একটুখানি, চিন্তিত হইও না। রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
-আচ্ছা।
এশা বাইরের দিকে দেখে। শহরটা ব্যস্ত। মাহির বলে,
-ছুটির দিনে ফাঁকা থাকে অনেকটা, তোকে একদিন নিয়ে বেরোবো কেমন। তখন দেখবি অন্যরকম এক শহর৷
-ওহ।
-তুই কী কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত?
-না তো।
-তোর কথা বিশ্বাস করতে মন চাইছে না।
-আসলেই আমি চিন্তিত। তবে একটুখানি।
-কেনো?
-হাতে বেশি সময় নেই তো। এখনও কত কত ফর্মালিটি বাকি আছে জানো?
-তুইও না। নিশ্চিন্তে থাক। আমি আছি তো।
-এমা, না না। তুমি নিজের কাজ বাদ দিয়ে আমার পেছনে সময় ব্যয় করলে দু’দিনেই চাকরি খোয়াবে বুঝলে?
-হু।
-কী বুঝলে?
-এই যে তুই একটা আস্ত গাধী।
-বিরক্তিকর।
-সত্য কথা সবসময় বিরক্তিকর মনে হয়।
-ধ্যাত!
এশা এবার রেগে যাবে মনে হচ্ছে। মাহির এশার হাতটা ধরে রাখে বলে,
-ওসব নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। আমার কাজ কাজের জায়গাতেই থাকবে। মাঝখান থেকে কিছু সময় বের করলে তোর কাজও হয়ে যাবে।
-ওহ।
-জি।
-আর কতক্ষণ?
-কীসের?
-দূরত্ব।
-আর কিছু মিনিট।
-আচ্ছা।
আর কথা হয় না দু’জনের মাঝে। পৌঁছোনোর পরে এশা চলে যায় ফ্রেশ হতে। সেই ফাঁকে মাহির বাড়িতে ফোন করে জানাতে যে এশা ঠিকমতো পৌঁছেছে। ফোন রিসিভ করেন মাহিরের বাবা। কথার মাঝেই মাহির এক সময় বলে ওঠে,
-মায়ের কী অবস্থা?
তিনি হেঁসে উত্তর দেন,
-হা হা হা, তোর মা। খুব রেগে আছে বুঝলি। ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোদের। তোরা তোদের মতো করে সবটা গুছিয়ে নে তারপরে না-হয়…
-বাবা আজ রাখছি, পরে আবারও কথা হবে।
এশা চলে আসাতে মাহির ফোন রেখে দেয়। এশা প্রশ্ন করে,
-কী বলছিল বড় বাবা?
-তেমন কিছু না। আসলে আমিই কল করেছিলাম। তুই পৌঁছেছিস জানাতে হবে না! আচ্ছা ওসব ছাড় আমি যাই কিছু নিয়ে আসি খাবি তো নাকি?
-না, এখন ইচ্ছে করছে না। আমি কিছুক্ষণ ঘুমোই?
-আচ্ছা ঘুমো। তা আবার আমায় জিজ্ঞাসা করে করতে হবে নাকি!
এশা কথা বাড়ায় না। মাহির বলে,
-আচ্ছা শোন আমার অফিসে যেতে হবে। হাফ ডে ছুটি নিয়েছিলাম এখন যেতেই হবে। রাতে জলদিই ফিরবো। আরেকটা কথা রুম থেকে বেরিয়ে কিছুটা যেতেই ডান পাশে কিচেন, কিছু খেয়ে নিস ঘুম ভাঙলে।
এশা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। মাহির বেরিয়ে যায়। আর একটু হলেই ধরা খাচ্ছিলো। সেদিন দুই প্রান্তে দু’টো মানুষ পুরো একটা নির্ঘুম রাত কাটায় তারপর শুরু হয় মাহিরের অভিযান। ফলস্বরূপ আজ সে সফল। কিন্তু………

continued….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here