মনময়ূরী,১৫,১৬
Anamika
-আমি বাধা সৃষ্টি করছি বলতে!
মাহিরের বাবা স্ত্রীর হাত নিজের হাতের মাঝে আবদ্ধ করে বলতে শুরু করলেন,
-আমাদের ছেলে এখন যেই বয়স পার করছে সেই বয়সটা আমরা অনেক আগেই পার করে এসেছি সেইদিক দিয়ে তোমার বোঝা উচিৎ ছিল বিষয়টা। এই বয়সে জেদটা বেশি কাজ করে। এখন তুমি যদি এশা’কে আটকে রাখো তবে জেদ কমে আসার বদলে বেড়ে যাবে।
এইটুকু বলে নড়েচড়ে বসলেন তিনি। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বুঝলেন দৃষ্টিতে কৌতুহল মেশানো। তিনি আবারও বলতে শুরু করেন,
-এশা’কে যে আমরা পাঠাবো…
-পাঠাবো মানে!
স্ত্রীর হুংকার। উনি যেনো এই কথাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। মাহিরের বাবা তাকে শান্ত করিয়ে বলেন,
-আহ! আগে পুরো কথাটুকু শোনো তারপর কথা বলো।
উনি চুপ করে রইলেন দেখে প্রশ্ন করা হলো,
-কী হলো চুপ রইলে যে?
-ওমা, এই মাত্র না বললে পুরো কথা শুনে কথা বলতে।
হাসলেন স্ত্রীর কথা শুনে এরপর শুরু করলেন,
-শোনো ধরো এশা স্কলারশিপ পেয়ে গেল তবে কি তুমি খুশি হবে না?
-কেনো হবো না?
-সেটাই তো বলতে চাইছি, তুমি এশা’কে মাহিরের থেকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে এসেছ আমি জানি, দেখে আসছি সেই যখন থেকে এশা জন্ম নিয়েছে ঠিক তখন থেকেই। এর আরেকটা কারণ ছিল, মাহির হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতো বলেই এশার দিকে তোমার নজর একটু বেশি যেতো। যার ফলস্বরূপ এশা’র হোস্টেলে যাওয়ার কথা উঠলে তুমি নাকোচ করে দিয়েছিলে। কিন্তু তখন যা মনে হতো এখন সেটা সবার কাছে মিথ্যে প্রমাণ করবে তুমি?
-মিথ্যে! কেমন মিথ্যে?
-অবশ্যই লোকে তো বলবে তুমি নিজের ছেলেটাকে কাছে পেতে একটা মেয়ের স্বপ্ন ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছ। যাকে কিনা তুমি নিজের মেয়ে বলেই মানো, এমনটা যদি করো তখন তো যে কেও এশার প্রতি তোমার ভালোবাসাকে নাটক বলেই ধরে নেবে।
স্ত্রীর চেহারার রঙ পাল্টাতে দেখে তিনি বলেন,
-এখন প্রতিক্রিয়া দেখালে তো হবে না। যা বাস্তব আমি সেটাই তুলে ধরছি। আবার নিজের মাঝে একটা কিছু নিয়ে ঘুরছি যা আমাকে তিলে তিলে খাচ্ছে। জানো তো এশার জন্য একজন ভালো সঙ্গী খুঁজতে গিয়ে খারাপটা এনেছিলাম এরপরে ফলাফল না ভেবে নিজের ছেলের সাথে জুড়ে দিলাম মেয়েটাকে। কী পেলো মেয়েটা বলতে পারো? আমাদের ছেলে তো সেই পড়ে আছে ভীনদেশে।
কথাটুকু বলে উনি থামলেন। খুব গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস নিজের মাঝ থেকে হাওয়ায় মিশিয়ে দিলেন কিন্তু স্ত্রীর থেকে আড়াল করতে পারলেন না। কাধে স্ত্রীর স্পর্শ পেতেই বললেন,
-আমি ঠিক আছি।
বলেই হাসলেন। হেসেই আবার বলতে শুরু করলেন,
-শোনো এশার কাছে যাবে গিয়ে বলবে ভালোভাবে পড়ায় মন দিতে। স্কলারশিপ পেতেই হবে। হবে মানে হবেই। ও একবার ওই দেশে পৌঁছে গেলে দু’টো পথ তৈরি হবে তোমার ছেলের এ দেশে ফিরে আসার।
এবার মাহিরের মায়ের চোখে আনন্দ জ্বলজ্বল করে উঠলো। উনি উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলেন কেমন পথ? স্ত্রীর এমন অবস্থা দেখে বলেই দিলেন।
-এক. এশা কাছাকাছি থাকলে যদি তোমার ছেলের পাথরের মতো মন গলাতে পারে তবে তো কথাই নেই। কিন্তু সেটা মনে হয় না সম্ভব হবে। হলে এতোদিনে একটু আকটু আঁচ পেয়ে যেতে। সে যাই হোক আমি দ্বিতীয়টা বলি বুঝলে।
শোনো কোনোভাবে যদি এশা’কে পাঠানো যায় মেয়েটা কিন্তু টিকতে পারবে না ওখানে। অফ পেলেই আসার জন্য ছটফট করবে আর তোমার ছেলের মাঝে এতোটুকু দ্বায়িত্ববোধ তো আছেই যে এশা’কে সেফলি না পৌঁছে দেওয়া অবধি শান্তি পাবে না সে।
-কী বলতে চাইছো বলো তো?
-এশা’কে নিয়ে ফিরতে তো হবেই তখন নাহয় ছেলেকে জাপটে ধরো প্রয়োজনে পাসপোর্ট লুকিয়ে ফেলবে।
-আইডিয়া তো ভালোই জানো। এতোদিন দাওনি কেনো?
-কেমন করে দিতাম বলো প্রথম প্রথম ছেলের পড়াশোনা শেষই হয়নি আর এইবার যখন এলো তখন বিয়ের ঝামেলার মাঝে মাথাতেই আসেনি। সে যাই হোক এখন বলো তুমি কী সিদ্ধান্ত নিলে?
-আমি এক্ষুণি এশার সাথে কথা সেরে আসছি।
-শোনো।
-এসে কথা বলছি।
-আরে শুনবে তো!
-বলো।
-এশা’কে এইসব নিয়ে কিছু বলতে হবে না। মাহিরের সাথে তোমার কথা হয়েছে যে, সেই বিষয়েও না।
-তবে কী বলবো?
-যা ইচ্ছে হবে বলে মেনেজ করবে, সেটা তোমার উপর। তবে এইসব বলা যাবে না মানে যাবে না ব্যস।
-আচ্ছা তবে আমি যাই।
স্ত্রীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে হেসে দিলেন। তবে উনিও মনে মনে চান মাহির ফিরে আসুক সাথে এশা’কেও নিজের জীবনের বিশেষ অংশ বলে স্বীকৃতি দিক। এমন না হলে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবেন না উনি। সারাজীবন এশার অপরাধী হয়ে বাঁচতে হবে তাকে। ভাবতে ভাবতে ফোনটা বেজে ওঠে। রিসিভ করেন উনি ওপাশ থেকে একটা প্রশ্ন ভেসে আসে,
-মা রাজি হয়েছে বাবা?
-হ্যা, রাজি করিয়েছি।
-কীভাবে বলো তো? আমি এতোকিছু বলার পরেও তো মনে হয়নি রাজি হবে।
-সে তোর জেনে লাভ নেই। শুধু জেনে রাখ এশা স্কলারশিপের জন্য এপ্লাই করবে।
-থ্যাংক ইউ বাবা।
-চড় থাপ্পড় কতদিন খাসনি বল তো?
বাবার কথায় মাহির হেসে দেয়। এপাশ থেকে তার বাবাও হাসেন। হাসি থামিয়ে ছেলেকে বলন,
-এখন রাখছি বুঝলি। কিছু পুরোনো কাগজপত্র লাগবে সেগুলোই নিতে এসেছিলাম। এসেই তোর মা’কে বোঝাতে শুরু করেছি বুঝলি। এদিকে যে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে খেয়াল ছিল না, আমি বরং কাজ সেরে এসে তোর সাথে কথা বলবো।
-ঠিকআছে বাবা।
-নিজের খেয়াল রাখিস।
কথা শেষ হলো বাবা ছেলের ওদিকে মাহিরের মা এশা’কে যখন বলেন তার কোনো আপত্তি নেই তখন এশার হাসিমাখা চেহারাটা দেখার মতো ছিল। এ ক’দিনে কেঁদে কেঁদে ভাসিয়েছিল সে আর এখন খুশিতে আত্মহারা। ফলাফল পরোয়া নেই তার, বড় মা রাজি এই তো অনেক। এর চেয়ে আর কিছু চায় না সে। এখন যদি স্কলারশিপ নাও পায় তার চিন্তা নেই।
এই সেদিনের কথা আর আজকের কথা, এশা মাহিরের সামনে। ঘুমন্ত এশা’কে দেখে হেসে তার পাশে বসে মাহির। কিছুক্ষণ চুপ করে পর্যবেক্ষণ করে তাকে এরপর কপালে ছোট্ট করে চুমু এঁকে দিয়ে আবারও কাজে মন দেয়। ভাবে কিছুক্ষণ বাদে এশা’কে জাগিয়ে দেবে তারপর নাহয় দু’জনে একসাথে ডিনার সেরে নেবে। একটা দিন অনিয়ম হলে কোনো সমস্যা হবে না। ঘুমোচ্ছে যখন ঘুমোক। ঘুমন্ত এশা’কে দেখে তাকে ডেকে তুলতে একেবারেই মন সায় দিচ্ছে না।
এশার ঘুম ভেঙে যায়। উঠে বসে আড়মোড়া ভেঙে বেড সাইড টেবিলে তাকায়। টেবিল ঘড়িতে ছয়’টা বাজে। একটু নড়েচড়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখে চমকে যায় সে, সকাল হয়ে গেছে! মাহির কোথায়? আসেনি এখনো! আসলে তো তাকে জাগাবে নাকি। এবার নিজের পাশের সাইডে বিছানার উপরে তাকায় সে। যেটুকু ঘুম ভাব ছিল সবটা কেটে গেছে। মাহির জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। ওপাশের টেবিলে ল্যাপটপটা খোলা পড়ে আছে। বুঝতে আর বাকি রইলো না মাহির কাজ করতে করতে ঘুমিয়েছে। সে একটা হাত বাড়িয়ে মাহিরের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে উঠানোর চেষ্টা করে। মাহির একবার চোখ মেলে আবার বন্ধ করে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড পরে লাফিয়ে উঠে বসে।
-আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!
-হ্যা, তাই তো দেখছি। তুমি মনে হয় কাজ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলে।
মাহিরের রাতের কথা মনে হতেই মনে মনে হাসে আর বলে ‘ওরে পাগল আমি কাজ করা বাদ দিয়ে যে তোকে দেখছিলাম। তোকে দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।’
এশার ডাকে মনরাজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলো মাহির। সে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এশার দিকে যা দেখে এশা বলে,
-বলছি তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।
-কয়টা বাজে?
-৬টা বেজে ১৫ মিনিট হলো।
-আচ্ছা তুই যা তবে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি আর আধা ঘণ্টা ঘুমোই।
-আচ্ছা।
বলে এশা উঠে চলে যায়। মাহির ভাবে আধা ঘণ্টাতে কী আর হবে, প্রায় সারাটা রাতই জেগেছে সে। নাহ, এখন আর ঘুমিয়ে হবে না। ভেবে এমনিতে চোখ বুজে শুয়ে থাকে সে।
এশা ফ্রেশ আসে, ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকায় মাহির। এশা দাঁড়িয়ে সামনে। মাহিরকে চোখ খুলতে দেখে এশা বলে,
-তুমি না ঘুমোবে বললে!
-পরে ভাবলাম ঘুমিয়ে লাভ নেই। উঠে পরি বুঝলি।
-আচ্ছা যাও তবে ফ্রেশ হয়ে নাও আমি নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছি।
-তুই নাস্তা বানাবি!
-হ্যা, এতে অবাক হওয়ার কী আছে?
-তুই পারিস এসব? কখন শিখলি?
-তুমি চলে আসার পরে প্রতিদিন মা-বড় মা ট্রেনিং দিয়েছে।
-বাব্বাহ!
-উত্তর পেয়েছ তো, এখন যাও।
মাহির যেতে গিয়ে ফিরে এসে বলে,
-এখন তোর ছুটি। কাল রাতে ডিনারের জন্য খাবার এনেছিলাম খাওয়া তো হয়নি এখন নাহয় ওগুলো দিয়েই কাজ চলে যাবে। তুই বরং গরম করে দে আমি খেয়ে নেবো।
-তোমার অসুবিধা হবে না?
-না। সমস্যা আবার কীসের?
-বাড়িতে তো দেখতাম তুমি সদ্য তৈরি খাবার না পেলে হাঙ্গামা করতে।
-সেই সময় পেরিয়েছে। একা থাকতে হলে সব এডজাস্ট করতে হয়। এখন যা দেখি।
মাহির আবারও যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় কিন্তু কয়েক কদম যেতেই থমকে দাঁড়ায় সে। এশা বলে,
-সে এতদিন একা ছিলে বলে খেতে। এখন তো আমি আছি।
মাহির একবার এশার দিকে তাকায়। এশা বলে,
-কালকেরটা আমি খেয়ে নেব। তোমার জন্য কিছু বানিয়ে দেই?
মাহির মনে মনে খুশি হলেও প্রকাশ না করে বলে,
-থাক এখন তুমি ঢঙ করে আমার খাবার বানিয়ে দেবে পরে একশো বার সেটা নিয়ে কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করবে। এরচেয়ে ভালো যা আছে সেটাই খাবো। এখন যা দেখি।
এশা রেগে যায় বলে,
-তো ঠিক আছে আমি নিজেরটাই গরম করে খেয়ে নিই। তুমি তোমারটা দেখে নিও।
এইটুকু বলেই বেরিয়ে যায় সে। মাহির কিছু বলতে চায় কিন্তু সে শোনে না। মাহির অবাক হয়ে বলে ‘কী মেয়েরে বাবা!’ তারপর হেসে দেয়।
continued…..
Anamika
#মনময়ূরী
১৬.
চারিদিকের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, এশার বেশ ভালোই লাগছে। এখন থেকে প্রতিনিয়ত সে এখানে আসবে। নিজের ক্যারিয়ার গড়বে। খুশি তার চেহারার মাঝে ফুটে উঠছে তা দেখে মাহির আপনমনে হাসে। এশা তখনও চারিদিকটা মুগ্ধ নয়নে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত যখন মাহির এগিয়ে এসে তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
-লাফাতে ইচ্ছে করছে?
এশা মাথা নাড়িয়ে ঠিক মাহিরের মতোই ফিসফিসিয়ে বলে,
-খুব।
শুনে হাসে মাহির। হাসির কোনো আওয়াজ হয় না নয়তো এশা ঠিক টের পেয়ে যেতো। হাসি থামিয়ে মাহির বলে,
-এখানে লাফালাফি করলে ওরা সকলে তোকে পাগল ভাববে।
চারিপাশে থাকা শত শত স্টুডেন্টদের দেখিয়ে তারপর আবার বলে,
-বাসায় গিয়ে লাফালাফি ঝাপাঝাপি যা খুশি করিস আমি বারন করবো না। আর যদি তোর মনে হয় আমার সামনে লাফঝাপ দিতে লজ্জা লজ্জা ফিল আসবে তবে বলে দিস আমি বেরিয়ে যাব। কতক্ষণের জন্য বেরোরে সুবিধা হবে সেটাও জানাস কেমন?
মাহিরের কথা শুনে এশা বেশ রাগী একটা লুক নিয়ে তাকায়। ওর বুঝতে বাকি নেই মাহির ওর সাথে মজা করছে। সে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
-এখন না আমার তোমাকে ঘুষি মারতে ইচ্ছে করছে। তোমার যদি মনে হয় এখানে সকলের সামনে আমার হাতের ঘুষি খেতে লজ্জা পাবে তবে জানিও বাসায় গিয়ে মারবো। আর হ্যাঁ যদি আমার সামনে ঘুষি খেতে লজ্জা পাও তবে লাইট অফ করে মারবো। আর প্লিজ বলে দিও ক’খান ঘুষি অবধি তোমার শরীরে সহ্য করার ক্ষমতা আছে, সেই অনুযায়ী মারবো।
এশার কথা শুনে মাহির ওর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে দেখে এশা বলে,
-ওভাবে দেখো না প্লিজ, প্রেমে পড়ে যাবে।
তারপর নিজের গলায় ঝুলে থাকা স্কার্ফের একটা কোনা দুই হাতের আঙ্গুল দিয়ে পেঁচাতে পেঁচাতে চেহারায় লজ্জা আভা এনে বলে,
-তখন প্রেমিকার হাতে মার খেতে আরও খারাপ লাগবে তোমার। বুঝেছ?
‘বুঝেছ?’ এথাটা ঝাঁঝালো গলায় বলে এশা এগিয়ে যায়। মাহিরও এগিয়ে গিয়ে বলে,
-তোর সাথে প্রেম করতে আমার বয়েই গেছে। একে তো এমন একটা বউ নিয়ে পারি না আবার প্রেমিকা। না থাক তোর একটা অবতারই ঠিক আছে।
এশা মাহিরের মুখপানে চেয়ে রয়। মাহির খুব কমবার ওকে বউ বলে সম্বোধন করেছে কিন্তু যতবারই করেছে এশার মনে অন্যরকম অনুভূতি খেলে গেছে। এশা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-ওসব নিয়ে পরে কথা বলবো আগে সব ফর্মালিটি কমপ্লিট করে নিই চলো।
মাহিরের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় এশা।
ফেরার সময় এশা খেয়াল করে ওদের ট্যাক্সি অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। সে মাহিরের দিকে খেয়াল করে, মাহির চোখ বুঁজে বসে আছে৷ একটুখানি ঝাকুনি দিয়ে ডাকে,
-ঘুমিয়ে পড়লে?
মাহির চোখ খুলে দেখে এশার দিকে। এশা বেশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে দেখে মাহির সোজা হয়ে বসে প্রশ্ন করে,
-কী হয়েছে?
-কী হয়েছে মানে! রাস্তাটা দেখো একবার…
মাহির বাহিরে দেখে আবার এশার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে,
-কী সমস্যা?
-এই রাস্তা তো অন্যদিকের, তোমার এপার্টমেন্টের রাস্তা তো পেরিয়ে এসেছি।
-জানি।
-জানো, তো কিছু বলছো না যে! তোমার না আমায় পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাওয়ার কথা।
-আজ অফিসে যাচ্ছি না।
এশা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে দেখে মাহির বলে,
-একবার পড়া শুরু করলে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পাবি না বুঝলি; তাই ভাবলাম আজ হাফ ডে না করে ফুল ডে লিভ নিই তার উপর আবার তোর কীসব কেনাকাটা করার আছে বলছিলি।
মাহির এশার দিকে তাকিয়ে ওকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
-আমরা কিছুসময় এই শহরটা ঘুরবো তারপর লাঞ্চ করবো তারপর আবার কিছুসময় ঘোরাঘুরি করে শপিং শেষ করে সন্ধ্যের পরে ফিরবো।
এশার চেহারায় খুশিটা স্পষ্ট। তবুও মাহিরের মন চাইলো ওর থেকে শুনতে তাই প্রশ্ন করে বসলো,
-কী খুশি তো?
এশা মাহির হাত নিজের কাধ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের দুই হাতের একটা দিয়ে মাহিরের সেই হাতে আঙুল ডুবিয়ে দিলো। এরপর আরেক হাত বাহুতে রেখে কাঁধে মাথা রেখে বললো,
-খুব খুশি। থ্যাংক ইউ সো মাচ।
এশার এমন কান্ডে মাহির অবাক না হয়ে পারলো না। কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো এশার মনে একটু হলেও তার জন্য জায়গা তৈরি হয়েছে। জায়গা তো আগে থেকেই ছিল তবে এখন যেটার কথা হচ্ছে সেটা হলো ভালোবেসে জায়গা দেওয়া। মাহির একবার ভাবে এ নিয়ে সরাসরি কথা বলতে হবে আবার ভাবে আজ এশা এতটা খুশি আছে তাকে এমন প্রশ্ন করে কোনো দোটানায় ফেলে দেওয়াটা ঠিক হবে না। পরে কখনো প্রশ্ন করবে। মন বলছে পজিটিভ কিছু আছে। এশার চোখে ডুব দিলেই বোঝা যায় ওখানে নেগেটিভ কিছু নেই। মাহির হাতের বন্ধনটা আরেকটু দৃঢ় করে বসে। এশা তখন গ্লাস নামিয়ে দিয়ে বাইরের ব্যস্ত শহরটা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ তার চোখ ওই শহরে আবদ্ধ এই মুহুর্তে নইলে বুঝতে পারবো দু’টো চোখ যে শুধু তারই মাঝে আবদ্ধ রয়েছে৷
সম্পর্কগুলো কখন যে গভীর হয়ে ওঠে আবার কখন ফাটল ধরে তা বুঝে ওঠা মুশকিল। এই যেমন মাহির-এশা দু’জনের মাঝে এতো সুন্দর একটা বন্ডিং তৈরি হয়েছে তবুও তারা একে অপরের থেকে মনের খবর আড়াল করে বাঁচে। ভয়, যদি ভাবনার বিপরীত কিছু শুনতে হয়। ভয়, যদি অপরজন রেগে গিয়ে দূরত্ব তৈরি করে নেয়। ভয়, এই ভয়েই তো মনের সাহসটা মেরে দেয়। ভয় থেকেই আসে দুঃশ্চিন্তা, ভয় থেকেই হয় সবকিছুর সর্বনাশ। এই সময় প্রয়োজন শুধু এক টুকরো সাহসের। একজনের এক কদম এগিয়ে আসার। ব্যস আর কিছুর প্রয়োজন হয় না। তখন নিজে নিজেই সম্পর্কগুলো গভীর হয়ে যায়। যখন একজন খেয়াল করে অপরজনের একটু এগিয়ে আসা তখন সে শতবার এগিয়ে যায়। এশা-মাহিরের ক্ষেত্রেও তাই। দু’জনেই আছে অপেক্ষায়, একজন তো এগিয়ে আসুক তারপর আর কে আটকায়।
-কীরে তোর পড়াশোনার কী পাখনা গজিয়েছে?
সরে রত্রী নেমেছে, শহরটা কৃত্রিম আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। এশা জানালার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রাতের শহরটা দেখছিল। সমস্যা সেখানে নয়, সমস্যা তো ওর চেহারার ফ্যাকাসে ভাবটা। ওর এমন মনমরা মুখটা দেখে মাহিরের মনে চিন্তারা বাসা বেঁধে ফেলে তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে কথা বলে সে। প্রশ্ন শুনে এশা ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ওর চোখদুটো ছোট ছোট হয়ে আছে যেন আরও ভেতরে ঢুকে গেছে। মাহির এগিয়ে এসে গালে হাত রাখে। প্রশ্ন করে,
-তোকে অমন দেখাচ্ছে কেনো?
এশা কোনোরকম নড়াচড়া ছাড়া প্রশ্ন করে,
-কেমন?
কণ্ঠস্বর শুনে দূর্বল মনে হয় মাহিরের কাছে, সে এবার ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করে,
-তোর কী শরীর খারাপ লাগছে এশা?
এশা কোনো উত্তর দেয় না। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মাহিরের দিকে। ওর দৃষ্টিতে কিছু একটা আছে। কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ লুকিয়ে রেখেছে নিজের মাঝে। মাহির ভাবে প্রশ্ন করবে? আবার ভাবে আগে ও স্বাভাবিক হোক তখনই জানতে চাইবে। কিন্তু ওর মনে থাকা প্রশ্নের উত্তর এশা দিয়ে দিলো। কোনো রকম প্রশ্ন করা ছাড়ায় উত্তর পেয়ে গেল সে। এশা বললো,
-কখনো কখনো প্রশ্ন করে উত্তর পাওয়ার আশা রাখতে নেই, কেনো জানো?
এইটুকু বলে এশা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। হয়তো অপেক্ষা করে মাহির কিছু বলবে, কিন্তু মাহির বলে না দেখে নিজেই আবার বলে,
-কিছু প্রশ্নের উত্তর আমাদের নিজেদের মাঝেই লুকিয়ে থাকে অথচ আমরা আশা করে বসে থাকি অন্যকেউ এসে সেই উত্তর দিয়ে যাবে। এখানেই তো ভুল করি।
এইটুকু বলে নিজের গালে থাকা মাহিরের হাতে হাত রেখে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকে তারপর হাতটা সরিয়ে দেয়। ধীর পায়ে হেঁটে যায় রুমের দিকে। বিছানায় শুয়ে পড়ে একপাশে। বিড়বিড় করে বলে,
-এশা জানিস তো তুই আস্ত একটা বোকা। হ্যা, বোকাই তো। কখনো কখনো আশা রাখাটা বোকামির পরিচয়।
তার ঠোঁটে হাসি চোখে জল। মাহির তখনও বাহিরে সেই জানালার পাশেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।
continued……