মনময়ূরী,২৩,২৪

0
992

মনময়ূরী,২৩,২৪
Anamika

-আজকাল আমি তোমায় পড়তে পারি, তোমার মন বুঝতে পারি।
এশা ঢোক গেলে, এমন হলে তো আজ শেষ। মাহির হেসে এশার গালে চুমু দেয়। এশা মাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাহিরের দৃষ্টিতে কিছু একটা আছে, কিছু একটা যার গভীরতা মাপতে পারা অসম্ভব। হয়তো সেই চেষ্টাও বোকামি হবে। মাহির বলে,
-হয়েছে আর খেতে হবে না, কেকটাও তো খেতে হবে।
এশা শুধু মাথা নাড়ায়। মাহির তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। এশা পানি খেয়ে উঠে পড়ে।

অনেকটা সময় যাচ্ছে এশা দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। মাহির তখন খেতে ব্যস্ত। এই নিয়ে দুইবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছে সে এশা’কে। চোখে চোখ পড়ছে দুইবারই বিনিময়ে এশা মিষ্টি করে হাসি উপহার দিয়েছে। মাহিরের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে সেই সময় আবারও দেখে সে। এশা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। মাহির বলে,
-রুমে যাও আমি আসছি।
মাহিরের বলতে দেরি হয়েছে এশার পালাতে দেরি হয়নি। মাহিরের কথাটা কানে আসতেই সে ছুঁটেছে রুমের দিকে। এতটাই দ্রুত গতিতে গিয়েছে যে মাহির যে ওকে কেকটা সাথে নিয়ে যেতে বলেছে পরে সেটা ওর কান অবধি পৌঁছোতেই পারেনি।

মাহির যখন রুমে প্রবেশ করে তখন দেখে এশা বিছানার মাথার সাইডে নিজের সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দিয়ে বসে আছে। চোখদুটো তার বন্ধ রয়েছে হাত দু’টো দিয়ে নিজেকেই আবদ্ধ করে রেখেছে যেন মনে হচ্ছে কাউকে খুব শক্ত করে আকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। মাহির এগিয়ে যায় এশার দিকে। বেড সাইড টেবিলের উপর একটা প্লেট রাখে প্লেটে কয়েক টুকরো কেক রাখা, বাকিটা রেখে এসেছে ফ্রিজে। সবকিছু গুছিয়ে আসতে অনেকটা সময় চলে গেছিল যার কারণে একবার ভেবেও ছিল যে কেক সাথে নিয়ে আসবে কিনা। কেনো না এতোটা সময় এশার পক্ষে জেগে অপেক্ষা করা সম্ভব বলে মনে হয়নি তার কাছে। পরেই আবার ভাবলো নিয়ে গেলে ক্ষতি তো নেই আবার না-হয় এসে রেখে যাওয়া যাবে।

-জায়গা দে আমায়।
এশা চোখ মেলে তাকায়। মুখভঙ্গি তার এমন যেনো কেউ তাকে বিরক্ত করে ফেলেছে। যেমন কোনো কিছু নিয়ে ভাবনায় বিভোর থাকলে তখন কেউ এসে ডাক দিলে মনে হয় ঠিক তেমন। এশার এমন চেহারা দেখে মাহির আবার বলে,
-একটুখানি সর না বাবা।
এশা সরে গিয়ে পাশে জায়গা করে দেয় কিন্তু বিরক্তি নিয়ে এও বলে যে,
-ওই পাশটা তো পুরোটা ফাঁকা ছিল তোমার এখানেই বসতে হবে!
-হ্যা হবে। তাতে তোর কী?
-তোমায় তো আমিইই…
এশা হাত দু’টো মেলে গলা চেপে ধরার জন্য এগিয়ে আসে। মাহির মাথা সরিয়ে নিয়ে চোখ বড় করে বলে,
-অওওও… খুনি বউ, এইভাবে আমাকে মেরে ফেলবি তুই! আমার তো এখনও বাচ্চাকাচ্চাও হলো না।
এশা বিরক্তি নিয়ে বলে,
-এই যাও তো এখান থেকে..
-আমি একটুখানি রোমান্টিক ফিল আনার চেষ্টা করছি আর তুই কিনা… রোমান্স কিলার কোথাকার।
মাহিরের মুখখানা দেখে এশার হাসি পায়। হাসিটা চেয়েও আটকে রাখতে না পেরে শব্দ করে হেসে দেয় সে। মাহির এবার কেক সহ প্লেট এগিয়ে বলে,
-নে এটা ধর।
-ধরে কি করবো?
-তুই ধরে রাখবি দেখবি আর আমি খাবো।
-এটা কিন্তু অন্যায়।
-তোর মাথা।
মাহির বিরক্তি নিয়ে এশার মাথায় টোকা মেরে বলে,
-গাধী এটা তোর জন্য। আগে তো দেখলেই ঝাপিয়ে পড়তিস আজ কী হলো?
এশা একটু লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গি করে বলে,
-ও মা, আমি বড় হয়েছি না। একটু তো মেইনটেইন করতে হবে।
-আমরা আমরাই তো এতো শতো ভাবতে হবে না, খা।
এশা খেতে শুরু করে, এক পর্যায়ে এসে মাহির প্রশ্ন করে,
-বসে বসে কী ভাবছিলি?
প্রশ্নটা শুনেই এশার গলায় আটকে যায় খাবার। সে কাশতে শুরু করে। মাহির কী তবে বুঝে গেল! ভাবনার মাঝে মাহির পানির গ্লাস এগিয়ে দিলে সেই ভাবনা সাইডে রেখে এশা পানি পান করে। গ্লাসটা নিয়ে সাইডে রেখে মাহির বলে,
-এতে ঘাবড়ে যাওয়ার কী আছে বুঝি না! পর পুরুষের স্বপ্নে তো মশগুল ছিলিস না। সেই তো আমাকে নিয়েই ভাবছিলি।
এশা তাকায়, মাহির তার চোখে চোখ রেখে বলে,
-আমি, মানে তোর বর। মানে একান্ত তোরই।
এশা মাহিরকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-আর আমি?
-সে তুই জানিস, আমি বলি কী করে?
-ধ্যাত!
এশা বিরক্তি নিয়ে মাহির কে ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে অন্যপাশ ফিরে। মাহির হেসে চাদরটা টেনে দেয় এশার গায়ের উপর তারপর সেই একই চাদরের ভেতর সেও ঢুকে শুয়ে পড়ে। এশাকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
-আমি বিশ্বাস করি তুমি একান্তই আমার, তবে শুনতে চাই তোমার থেকে। কী বলবে না?
এশা মাহিরের দিকে ফিরে বলে,
-তুমি না আমার মন পড়তে পারো!
-হু নিজে উপলব্ধি করার সাথে সাথে সেই ব্যক্তির কাছে থেকে জানার মাঝে অন্যরকম তৃপ্তি লুকিয়ে থাকে। সেইটা আমি অনুভব করতে চাই। এখন তুই…
মাহিরের কথার মাঝেই এশা বলে ওঠে,
-ভালোবাসি।
মাহির যেন ভুল শুনলো সেই ভাবেই শুয়ে রইলো। কিছুক্ষণ বাদে সবটা বোধগম্য হতেই সে এশাকে দেখার জন্য ঘাড় ঘোরালো। এশা তখন চাদর দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেলেছে। একটা হাতের তিনটে আঙুল আর চুলগুলো ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। মাহির এশা’কে চাদরের ভেতরেই থাকতে দিলো শুধু সে নিজে বাইরে না থেকে চাদরের ভেতরে ঠিক এশার মতো করে ঢুকে পড়লো। ঘরের মাঝে এখন কোনো শব্দ নেই তারা দুজনেই যেন চুপচাপ। মাহির এশার হাত ধরে তাকে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। ওইভাবেই ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলো,
-এ আমি কী শুনলাম!
এশাও ঠিক একইভাবে উত্তর দিলো,
-যা সত্যি তাই শুনেছ।
চলতে থাকে কথপোকথন। ফিসফিসিয়ে কথা বলে দু’জন। রাতের গভীরতা বাড়ে আবার সেই রাত কেটে গিয়ে সকাল নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে প্রস্তুত হয়ে পড়ে। সেই সময়টাতে ওদের চোখে ঘুম এসে ভীড় জমায়। ওরা হারিয়ে যায়, ঘুমের শহরে। একে অপরের বুকে আবদ্ধ হয়ে এক সাথে পাড়ি জমায় এক সুখময় স্বপ্নের জগতে।

সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে যায়। ঘুমিয়েছেই তো রাত পার করে তো হবে না দেরি। এশা চোখ মেলে আবারও বন্ধ করে ফেলে। রাতের কথা মনে হয় তার। এসব সত্যি ছিল! সত্যিই এসব সত্যি ছিল! এক সময়ের স্বপ্ন এইভাবে সত্যি রূপ নিলে এমনই প্রশ্ন জাগে। এশা চোখ বুঁজেই নিজের একটা আঙুল মুখে নিয়ে দাঁত বসিয়ে দেয়। ব্যথা পায় সে তবুও হাসে। সত্যিই সে আর মাহির একসাথে আছে। আগেও ছিল তবে ভালোবেসে নয়। হয়তো ভালোবাসা ছিল প্রকাশ করতে করতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে এইতো। তবে দেরি হলেও সময়টা ভালোবাসাময়, ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে তাকে। সমস্ত তিক্ত স্মৃতি ভুলে গিয়ে এইটুকুনই মনে রাখতে ইচ্ছে করে।

এশা চোখ মেলে একবার দেখে নেয় মাহিরকে। মাহির অপর দিকে মুখ করে উবু হয়ে শুয়ে আছে। মনটা খারাপ হয়ে যায়। মুখটা দেখতে চেয়েই তো চোখ খুলেছিল সে আর এই মাহির কি-না অন্যপাশে ফিরে আছে। এশার মাথায় আইডিয়া আসে। সে পা তুলে। পরেই কী যেন ভেবে আবার নামিয়ে দেয়। ইচ্ছে ছিল ফুটবলের মতো কিক করে ফেলে দেবে মাহিরকে, এটাই তার শাস্তি হবে অন্যপাশে ফিরে শুয়ে থাকার। কিন্তু ইচ্ছেটা দমিয়ে নেয় সে। মাথাটা তুলে হাতের ভরে একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে মাহিরের পিঠের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। মাহির ভার অনুভব করে কিন্তু ওঠে না। সে দেখতে চায় এশা কী কী করে!

হঠাৎ চোখ মেলে তাকায় এশা। হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসে ডাকতে থাকে মাহির’কে। মাহির উঠতেই চায় না।

continued….

Anamika

#মনময়ূরী
২৪.

হঠাৎ এশার খেয়াল হয় অনেকটা বেলা হয়ে গেছে আর মাহির তখনও ঘুমিয়ে রয়েছে। অফিস মিস করে গেল মাহির! উফফফ, এই মাহিরটাও না। সে মাহিরকে ধাক্কা দিয়ে উঠাতে চায় কিন্তু মাহির তো উঠবে না বলে পন করেছে মনে হচ্ছে। এখন কী করা যায়! এশা দাঁত দিয়ে নখ কাঁটতে কাঁটতে ভাবতেই থাকে। তারপর নিজের চুল খুলে কয়েকটা চুল একসাথে গুচ্ছ করে নিয়ে মাহিরের কানে ঢুকিয়ে দেয়। বেচারা মাহির ওর এই অত্যাচার নিতে পারছে না কিন্তু উঠে বসাও তো যাবে না। এশার আইডিয়া ফেইল হয়ে গেল। সে নিজেই নিজেকে বললো,
-এ আবার কেমন ঘুম ঘুমোচ্ছেরে এশা। এই আইডিয়াও কাজে দিলো না। এখন উপায় কী?
নিজের কাছে প্রশ্ন করে আবারও মাহিরকে ধাক্কা দেয়। ডাকতে গিয়ে ভাবে কী বলে সম্বোধন করবে? আগে মাঝে মধ্যে প্রয়োজনে ডাকতে হলে মাহির ভাইয়া ডাকতো এখন তো সেটাও করা যাবে না। অবশ্য আরও একটা উপায় তার জানা আছে তবে সেটা তো আজ আর কাজে দেবে না। তার জন্য মাহিরকে চোখ মেলে তাকাতে হবে। সেইটাই তো করার চেষ্টা করছে সেই কবের থেকে। হচ্ছেই না। এশা শুয়ে যায় আবারও। তারপর আড়চোখে মাহিরকে দেখে আবার উঠে বসে আরেকটুখানি এগিয়ে গিয়ে একটা হাত মাহিরের মাথার কাছে বালিশের উপর রাখে আর অন্য হাত রাখে মাহিরের কাঁধে। এরপর নিজের মাথাটা নিচু করে মুখটা মাহিরের কানের কাছে নিয়ে গিয়ে বলে,
-ওঠো না প্লিজ। অনেক বেলা হয়ে গেছে তো, অফিসে যাবে না।
মাহির ওঠে না দেখে আবার বলে,
-শুনছো? এইই… উঠতে বলছি কবে থেকে তোমায়, কানে শোনো না তুমি?
এশা না পেরে সোজা হয়ে বসে রয়। মাহিরের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
-এবার আমার রীতিমতো চিন্তা হচ্ছে, আমার ভবিষ্যৎ পোলাপাইন যদি এমন হয় তবে তো আমি শেষ।
কথাটা বলেই ঢোক গেলে এশা। মাহিরের কানে ঠিক পৌঁছেছে কথা খানা তাই তো হাতটা বাড়িয়ে এক টানে এশাকে শুইয়ে দিয়ে তার দিকে ফিরে শোয় নিজেও। এশা বুঝতে পারে ঠিক কি হচ্ছে আর তা বুঝেই চোখ বুঁজে নেয়। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই অনুভব করে তার পেটের উপর কিছু একটার ওজন। চোখ মেলে দেখে মাহির তার পেটের উপর মাথা রেখে তার দিকেই চেয়ে আছে।

এশা’কে চোখ মেলতে দেখে মাহির বলে,
-একবার পরিবারের চিন্তা তো আরেকবার নিজের চিন্তা। আবার এখন দেখা যাচ্ছে ভবিষ্যৎ বাচ্চাকাচ্চাদের চিন্তায় ডুব দিয়েছিস। তুই এতোটা নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিবি ভাবিনি আমি।
এশা বললো,
-আমি আবার কী করলাম!
-একবারও আমার চিন্তা করেছিস তুই?
-সে তো সবসময় করি।
মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে যাওয়ায় এশা আবারও চোখ বুঁজে নেয়। মাহির তখন সমস্ত কথা হারিয়ে এশার মাঝে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে। এশা যে এইভাবে অকপটে বলে দেবে সে কল্পনাও করেনি।

কিছু সময়ের নিরবতা অতঃপর মাহিরের কণ্ঠস্বর,
-এশা।
এশা মাহিরের মাথায় হাত রেখে তার চুলে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে কিছু সময় ধরেই তবে চোখ তার এখনও বন্ধ। মাহির এশা’কে ডাক দিলে সে শুনেও না শোনার ভান করে থাকে। মাহির আবারও বলে,
-দেখো আমার দিকে।
আবারও সেই তুমিতে আসা। এশার ভালো লাগে খুব। সে দেখে মাহিরকে। মাহির এবার পাশ ফিরে শোয় মাথাটা এখনও এশার পেটের উপর।
-একটা প্রশ্ন করবো?
-হুম।
-ইউ লাভ মি রাইট?
-হুম।
-কবে থেকে?
এশা এবার আর উত্তর দেয় না। মাহির অপেক্ষা করে, আশায় থাকে এই বুঝি এশা উত্তর দেবে তার প্রশ্নের। এশা কথা তো বলে তবে একটা প্রশ্ন করার জন্য।
-তুমি অফিসে যাবে না আজ?
-আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি এখনো।
এশা বুঝে যায় মাহির আর ছাড়বে না ওকে। এশার ভয় হয়, যদি এখন এইসব প্রশ্নের সাথে ইভানের বিষয়েও প্রশ্ন করে বসে তখন কী উত্তর দেবে সে! উত্তর দিতে হলে তো অতীতের পাতা মেলে ধরতে হবে। যা এশা চায় না। সেই তিক্ততা পূর্ণ স্মৃতিগুলো আর মনে করতে চায় না। এশার ভাবনা সত্যি হলো, মাহির ঠিকই ইভানের কথা জানতে চাইলো। এশা তখনও চুপ। মাহির উঠে বসে তারপর বলে,
-আমি তোমার লাইফ পার্টনার রাইট?
এশাও উঠে বসে, মাথা নাড়িয়ে মাহিরের কথায় সম্মতি প্রদান করে। মাহির আবার বলে,
-আমি জানি সে তোমার অতীত। আমাদের বর্তমান বা ভবিষ্যতে তার কোনো অস্তিত্ব থাকবে সেটা তুমি চাও না; আমি এটাও জানি। ইভেন আমিও চাই না। তাই জানতে চাইছি। সবকিছু ফ্রেশ স্টার্ট হবে, কখনো কখনো অতীত এসে সেই ফ্রেশ স্টার্টে বাধা দেয়। এমন অনেক হয়েছে এর আগেও। আমার চোখের সামনে ঘটেছে কিছু কিছু সম্পর্ক ছেদ নিয়ে আজও বেঁচে আছে তবে বাঁচার মতো নয়। আবার কিছু সম্পর্ক একটু টোকা দিতেই ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। এর কারণ কী জানো? এর কারণ হলো এক তৃতীয় ব্যক্তি। সেই সকল সম্পর্কের মিথ্যে দিয়ে ফাটল সৃষ্টি করা হয়েছিল নাকি সত্য দিয়ে আমি এও জানি না। তবে আমি চাই আমাদের সম্পর্কে কখনো এমন দিন যেনো না আসে। আমি সমস্ত কিছু জানতে চাই৷ ইচ এন এভ্রিথিং। পরবর্তীতে যেনো কোনো তৃতীয় ব্যক্তি এসে আমার অজানা বিষয় নিয়ে কোনো সুযোগ না নিতে পারে। আমার মনে হয় তুমি বুঝতে পেরেছো আমি কী বলতে চাইছি।
এশা মাথা নাড়ায়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয় তার। কী বলবে সে এখন! মাহির তার অস্বস্তি বুঝতে পেরে তাকে টেনে বুকের মাঝে নিয়ে বলে,
-আমি দূর্বল নই যে কোনো কিছু আমায় ভেঙে দেবে। তবে তুই চাইলে সময় নিতে পারিস। যতো খুশি সময় নে।
এশা স্বস্তিবোধ করে আবার সেই স্বস্তি যেনো কোথাও হারিয়ে যায়। মাহির এতোক্ষণে আবার সেই ‘তুই’এ ফিরে গেছে। তবে কী মাহির রেগে আছে?

মাহির ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে খেয়াল করে এশা তখনও মূর্তির মতো বসে আছে। প্রশ্ন করে কী কিছু ভুল করে ফেলেছে সে! নাহ, তা তো মনে হয় না। জানতে চাওয়া তো ভুল নয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে কিছু গোপন থাকলে সেই সুযোগ অনেকেই কাজে লাগিয়ে সম্পর্কে বিষ ঢালার কাজ করে যদিও তাদের সম্পর্কের মাঝে তেমন ভিলেইন টাইপ লোক নেই তারপরেও মাহিরের জানতে ইচ্ছে করে। এর আরও একটা কারণ আছে আর তা হলো বিয়ের আগে যখন মাহির ইভান সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল এশা খুব সূক্ষ্মভাবে বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে একটা রহস্য রহস্য গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে এশা কিছু লুকোতে চাইছে তার থেকে। সেটা নিয়ে এশার চোখে ভয়ও দেখেছে সে৷ ভয়টা কাটানোর জন্য হলেও কারণটা জানতেই হবে। এই ভেবে একবার এশা’কে দেখে নেয় মাহির। এশা তখনও বসেই আছে। কিছু একটা ভাবছে সে। মাহির এগিয়ে গিয়ে এশার কাঁধে হাত রাখতেই চমকে যায় সে। আশ্চর্য! এশার নজর যেইদিকে ছিল সেই দিক থেকেই হেঁটে এসেছে মাহির অথচ কাঁধে হাত রাখতেই এমন রিয়েকশন দিলো যেনো দেখেইনি!
-তোর শরীর ঠিক আছে?
-হুহ! হু। ঠিক আছে শরীর। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসেছ? এ মা আমি খেয়ালই করিনি দেখেছ। বসো আমি যাই পনেরো মিনিট সময় দাও নাস্তা তৈরি হয়ে যাবে।
এশা বিছানা থেকে নেমে চলে যেতে নিলে মাহির তাকে আটকায়। নিজের দিকে ফিরিয়ে প্রশ্ন করে,
-কী হয়েছে তোর? আমি প্রশ্ন করেছি বলে ঘাবড়ে আছিস? আমি বাঘ যে তোকে খেয়ে ফেলবো!
এশা মাথা নাড়ায় যার অর্থ হলো ‘না’। মাহির প্রশ্ন করে,
-তবে?
-তুমি আমার উপর রেগে আছো?
-এমন কেনো মনে হচ্ছে তোর?
-তুমি বিশ্বাস করো ইভানের সাথে আমার সম্পর্ক তেমন গভীর ছিল না যাতে আমাদের ফিউচারে ইফেক্ট করতে পারবে। কিন্তু সবটা আমি তোমায় খুলে বলতে পারবো না। প্লিজ জোর করো না।
মাহির অবাক হয়। লুকোনোর কিছু নেই যেখানে সেখানে কিসের এই লুকোচুরি খেলা! এশা’র কথাগুলো অস্বাভাবিক মনে হলো তার কাছে। সে সেইদিকে না গিয়ে বললো,
-আমি তোকে জোর করছি না এশা। আচ্ছা ঠিক আছে, আর কখনো এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবো না।
এশা কান্না করে দেয়। বলে,
-তুমি আমার মন রাখতে এমন বলছো তাই তো। প্লিজ রাগ করে থেকো না আমার উপর।
মাহির অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
-কেনো এমন মনে হচ্ছে আমি রেগে আছি?
-কী সুন্দর তুমি আমায় তুমি করে বলছিলে, জানো আমার না অন্নেক ভালো লাগছিল সেটা। কিন্তু আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিলাম না দেখে তুমি আবার….
মাহির বুঝতে পারলো আর বুঝতে পেরেই এশা’কে কথা শেষ করতে না দিয়ে নিজে বললো,
-পাগল।
এশার মাথায় একটা গাট্টা মেরে সে অন্যদিকে ফিরে হেসে আবার এশার দিকে তাকালো। এশার দৃষ্টিতে অবাক হওয়ার ছাপ স্পষ্ট। মাহির বললো,
-‘তুই’ করে বলাটা আমার অভ্যেস সে তো তুই জানিসই। এখন একদিনে এতটা পেরেছি সেটাতে তো তোর খুশি হওয়া উচিত। তা না করে ম্যাডাম কী সব চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছেন।
-মানে তুমি রেগে নেই?
-না নেই। প্রপারলি ‘তুমি’তে ট্রান্সফর্ম হতে সময় তো লাগবেই বল। আই মিন বলো।
এশার মাথা থেকে যেনো বোঝা নেমে গেল। সে খুশিতে মাহিরকে ঝাপটে ধরলো। মাহিরও বেশ শক্ত করে ধরলো তাকে। তবে বেশি সময় ওইভাবে থাকার সৌভাগ্য হলো না দু’জনের। হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে। মাহির এশা’কে ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে ফোনের দিকে দেখে হেসে দেয়। রিসিভ করে কথা বলতে শুরু করে,
-কেমন আছো ছোট মা?
এশা মাহিরের প্রশ্ন শুনেই লাফিয়ে কাছে এসে খপ করে ফোন কেড়ে নেয় তার থেকে। মায়ের ফোন, মেয়ে কথা বলবে না তা কী করে হয়। সে মাহির কথা বলার সুযোগ পাক বা না পাক তাতে তার কী! সে তো মায়ের সাথে অনেকটা সময় ধরে কথা বলবে। বলবে মানে বলবে ব্যস।

মাহির এশা’কে ভার্সিটির বাইরে ড্রপ করে দিয়ে আবারও উল্টো দিকে গাড়ি ঘোরাতে বলে চালককে। আজ তার কাজ অপজিট সাইডে। দুইদিন ছুটি কাটানোর পরে, পুরো ৪৮ ঘণ্টা এশার সাথে প্রতিটি সেকেন্ড কাটানোর পরেও সে এইটুকু পথ একসাথে চলার লোভ সামলে রাখতে পারেনি। এশা জানে না যে মাহিরকে আবারও পুরো রাস্তা ব্যাক করে অন্য সাইডে যেতে হবে নয়তো ও একসাথে আসতে রাজিই হতো না। এই দুই দিনে দু’জনের সম্পর্ক অনেকটা গভীর হয়ে গিয়েছে। পারলে একে অপরকে ছেড়ে এক মুহুর্তও দূরে থাকবে না তারা। কিন্তু কী করার, জীবনে চলতে হলে কাজ তো করতেই হবে নাকি!

-ওয়েট আ মিনিট।
মাহির তাড়াহুড়ো করেই গাড়ি থামাতে বলে চালককে। সে বেশ যাচ্ছিলো নিজ গন্তব্যের পথে মাঝ রাস্তায় একটা চার্চ পড়ে আর সেইখানে গেইটের ভেতরে চোখ যেতেই এইভাবে গাড়ি থামাতে বলে সে। এতোগুলো বছর পরে এইভাবে তার সাথে দেখা হবে মাহির স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি।

continued….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here