মনময়ূরী,৩৩
Anamika
মাহির জুস নিয়ে এসে আগে নিহার হাতে একটা গ্লাস দিলো তারপর আরেকটা গ্লাস এশার সামনে এগিয়ে দিয়ে এশা যখন হাত বাড়ালো তখন আবারও টেনে নিয়ে বললো,
-এখন দিচ্ছি তবে মনে রাখিস পরে এর শোধ তুলবো।
কথাটা শেষ করে এশার হাতে গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে বসলো সে। অবাক হলো এশা রাগলো না একটুও। ওর মুখের বর্ণ অন্যরকম হয়ে যাবে। তবে এই রকম মুখভঙ্গিকে কী নাম দেওয়া যায় জানা নেই মাহিরের। নিহা জুসটা অল্প খেয়ে গ্লাস রেখে দেয় সামনের টেবিলে। সে ইতস্তত করছে এর মাঝে আবার এশাও ইশারা করছে না বলতে। মাহির দু’জনকেই লক্ষ্য করে যাচ্ছে। আর না পেরে সেই বলে,
-কী যেনো বলতে চাইছিলি, এসা তো এসেও গেছে এবার বল।
নিহা বলবে তার আগে এশা বলে,
-বলা হয়ে গেছে তো।
-তাই নাকি! তো কী কথা হলো শুনি?
-আমাদের মাঝের কথা তুমি জেনে কী করবে?
নিহা এশা’কে আটকে দিয়ে বলে,
-আমায় বলতে দাও।
এশা ‘না’ সূচক মাথা নাড়ায়। নিহা বলতে শুরু করে,
-মাহির আমাদের বন্ধুত্বের শুরুটা তোর মনে আছে?
-হ্যা, থাকবে না কেনো?
-বন্ধুত্ব হয়েছিল যখন তার আগে থেকেই আমি তোর পিছু নিতাম। বলতে পারিস শুরু থেকেই তোর প্রতি একটা অন্যরকম জায়গা তৈরি হয়েছিল মনে। ওই যে বলে না ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’ ঠিক ওইটা। প্রথম প্রথম দূর থেকে দেখে চলে যেতাম আর তখন খেয়াল করি তুই একাই থাকিস সব জায়গায় না কোনো বন্ধু না কারো সাথে কোনো কথা। নিজে থেকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। সাহসটা যেনো বেড়ে গিয়েছিল ওইদিন। তারপর শুরু হয় আমাদের বন্ধুত্বের জার্নি। কতো ভালোই না যাচ্ছিলো দিনগুলো। ভেবেছিলাম একসাথে চলতে চলতে তোর মনেও একদিন আমার জন্য একটা জায়গা তৈরি হবে। হ্যা, একটা জায়গা তো আগে থেকেই ছিল। বন্ধুত্বের জায়গা তবে আমার চাওয়াটা সেই জায়গার থেকেও আরও গভীরে স্থান পাওয়া ছিল। তুই একদিন বললি তোদের বাড়ি থেকে আমরা সকলে যেনো ঘুরে আসি ছুটিতে। সেই সুযোগ আর ছাড়তাম কী কর! ভাবলাম এদিকটা তো প্রচেষ্টা চলছে এবার না-হয় তোর পরিবারের মনেও জায়গাটা তৈরি করা যাক। পরে যাতে কোনো সমস্যা না হয় তাই ভেবেছিলাম কেউ না গেলেও আমি যাব। এই সুযোগ নিচে চলে এসেছে আমার কাছে, ছাড়া তো আর যায় না।
নিহা থামে, সে এশার দিকে দেখে তারপর তার গালে হাত বুলিয়ে দেয়। মাহিরের দিকে দেখার সাহস তার নেই এই মুহুর্তে সে ঠিক করেই এসেছে সবটা বলা শেষ হলেই উঠে পালাবে। মাহিরকে ফেস করার সাহস তখন আর তার মনে থাকবে না। ঠিকই তাই হলো সাহসটা এখনই চলে যেতে চাইলো। নিজের মনকে বোঝালো ‘এখনই হার মানলে হবে না, কথার মাঝখানে আমি পালিয়ে যেতে পারি না। তোকে শক্ত হতেই হবে।’ মনটা তার কথা শুনলো। সাহসটা বাড়লো মনে হয় তবুও মাহিরের দিকে দেখলো না সে। মাহিরের চেহারার অবস্থা যে কেমন হতে পারে তা কল্পনা করতে পারছে সে। সে আবারও বলতে শুরু করে। তাকে যে শেষ করতে হবে কথাগুলো।
-আমরা যেইদিন তোদের বাড়িতে গেলাম সেইদিন যেতে যেতে যেতে দুপুর পেরিয়েছিল। সকলের সাথে আলাপ হয়েছিল ভেবেছিলাম সেই বাড়িতে বুঝি আর কেউ থাকে না। কিন্তু তার ঠিক দু’ঘন্টা পরে একটি মেয়েকে ঢুকতে দেখি বাড়ির ভেতরে। সেই সময় তোর মা আর চাচির সাথে কথা বলছিলাম আমরা। তুই তোর বাবার সাথে বাইরে গিয়েছিলি মনে আছে? রাতে আমাদের জন্য কী কী রান্না হবে সেই লিস্ট অনুযায়ী জিনিসপত্র আনতে। মেয়েটি যখন ভেতরে ঢোকে ভেবেছিলাম আশেপাশে কোথাও থাকে হয়তো কিন্তু যখন তোর চাচি বললেন ‘ও আমার মেয়ে, নাম এশা।’ আমি অবাক হই। কেনো না তুই তো কখনো আমাদের কাছে ওর কথা বলিসনি। এশা তখন প্রশ্ন চোখে তাকিয়ে ছিল। ও বোঝার চেষ্টা করছিল আমরা কে।
সেই বিকেলে আমদের ভাবটাও জমেছিল বেশ কিন্তু এরপর কথা হয়নি কখনো ওর সাথে। মাঝখানে রেখা আমিই টেনেছিলাম। সেদিন রাতে খাবার সময় আমি তোকে দেখছিলাম একটু পর পর। এই অবধি সবকিছু ঠিক ছিল কিন্তু যখনই আমার নজর এশার উপর পড়লো আমি থমকে গেলাম। সেও তোকেই দেখছিল তবে আড়চোখে নয়, ও দৃষ্টি ছিল স্থির। হয়তো অনেকদিন পরে তোকে দেখছিল বলে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল। জানি না আমি। ওই বলতে পারবে ভালো। তবে আমি এইটুকু জানি ওর চোখের তোর প্রতি টান দেখেছিলাম আমি যেমনটা আমি নিজের মাঝে দেখি ঠিক তেমনটাই, সেটা আমার থেকে বেশিই ছিল তবে কম নয়। সেদিন প্রথমবারের মতো ভয় পেয়েছিলাম আমি। কিন্তু তোর দিকে যখন আবার দেখি তখন বুঝতে পারি যে যা আছে ওর দিক থেকেই আছে। তোর মনে ওর তেমন কোনো জায়গা ছিল না সেই সময়টা। আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমাকে আমার অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে হবে নয়তো যার প্রতি তোর কোনো টান নেই তার চোখের তোর প্রতি টান দেখে আমার এই অবস্থা তবে তুই যদি অন্যকারো প্রতি আকৃষ্ট হোস তখন আমার কী অবস্থা হবে! ভাবতেই… আমি তোর বাবা-মায়ের দিকে দেখি। ওনারা খেয়াল করেননি এশাকে, করলে হয়তো ওইদিনই তোর আর এশার হাত এক করে ফেলতেন। কথাটা এমনি এমনি বলছি না আমি, আমি উপলব্ধি করেছিলাম এশার প্রতি তাদের ভালোবাসাটা। তো সেইখান থেকে তো এইটুকু সিওর ছিলাম এশার অনুভূতির এক অংশও যদি তারা টের পান তাহলে তোর মনে কী আছে সেইটা আর দেখতে চাইবেন না।
মাহির এশার দিকে তাকায়। এশা মাথা নিচু করে বসে আছে। এখন কী হবে! নিহা এশাকে দেখে বুঝলো মাহির ওর দিকে দেখছে বলেই ওর মাথা নিচু করে রাখা। এইটুকু বলা বেশি প্রয়োজনীয় ছিল। আর মাহিরও বুঝেছিল এশার মনে তার জায়গা আরও আগে তৈরি হয়েছিল যা সে টেরই পায়নি। তবে এখনও প্রশ্ন বাকি। তবে নিজের মনে সেই প্রশ্নের আবছায়া একটা উত্তর তৈরি করে ফেলেছে মাহির। এবার শুধু উত্তরের সাথে মিলিয়ে দেখার পালা। মাহিরকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। নিহা বললো,
-আমি তো চেষ্টা করেই যাচ্ছিলাম যথা সম্ভব কিন্তু সফল হচ্ছিলামই না। দিনগুলো শুধু নিজের মতো করে পাল্টে যাচ্ছিলো। ক্যালেন্ডারের পাতা গুলোর সাথে মাস পাল্টাতে থাকলো এরপর একসময় বছরটাও পাল্টে গেল। তারপর আরও কয়েক মাস পেরলো। তারপর আসলো এমন একটা সময় যখন তোর মাঝে পরিবর্তন লক্ষ্য করতে থাকলাম। এই পরিবর্তনের কারণটা আমার বুঝতে অসুবিধে হয়নি কারণ আমিও যে সেই পরিস্থিতি পার করে এসেছি এবং তখনও সেই পথেই হাঁটছিলাম। খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম নিজেকে তোর সেই সময়ের সেই সকল অনুভূতির মাঝে। পাইনি আমি। নিজেকে খুঁজে পাইনি। সিদ্ধান্ত নিলাম আশা আর রাখবো না তবে ভালোবেসে যাব আমি। সেখানে তো কোনো বাধা নেই। ইভেন তুই যখন সকলের জোরাজুরিতে সবকিছু খুলে বললি তখন আমি সেই উপায়টাই বলেছিলাম না আমি নিজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলাম। তোকে ‘বেস্ট অফ লাক’ উইশ করাটা যেনো আমার নিজের নিজেকে ছুরি আমার মতো ছিল তারপরেও করেছিলাম।
তোর হয়তো মনে আছে আমি ওই ভেন্যুতে যাইনি যেখানে তুই এশাকে প্রপোজ করবি বলে প্ল্যান করেছিলি। আসলে আমি যাইনি এমন নয়। হ্যা তুই এখন বলবি যে ‘তুই তো এসেছিলি পরে’। হ্যা, ঠিক যে আমি পরে তোর সামনে গিয়েছিলাম কিন্তু শুরু থেকেই ছিলাম আমি আড়ালে লুকিয়ে। আমি যখন লুকিয়ে ছিলাম তখন স্পৃহা আপু ফোন দেয় আমায়। খুলে বলতেই ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘নিজেরটা নিজের করে নিতে শেখ, কেউ এসে তোকে ধরিয়ে দেবে না। পেতে হলে ছিনিয়ে নেওয়া শিখতে হয়।’ আমার যে কী হলো আমি অমনি তোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তোকে শান্তনা দিলাম। তখনই তোর ফোনে একটা মেসেজ আসে। তুই নিজের মাঝে এতোটাই বুদ ছিলি যে শব্দটা তোর কানে পৌঁছোয়নি। মেসেসটা এশা’র ছিল। ও বলেছিল ওর আসতে আরও কিছু সময় লাগবে। আমার মনে হলো ওকে সারপ্রাইজ হিসেবে তো প্রপোজ দেওয়ার কথা আছে তবে সেই প্রপোজটা আমার জন্য হলে ওকে আরো বড় সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে। ও এমনিতেই সরে যাবে। তাই আমি তোকে বুঝিয়েছিলাম যে ও হয়তো কোথাও আটকে গেছে চলে আসবে। তারপর বলেছিলাম, ‘ওর আসার আগে একবার প্র্যাকটিস করে নে। পরে যদি ঘাবড়ে গিয়ে প্রপোজ করতে না পারিস।’ তুই আমার কথার পরিবর্তে প্রশ্ন করেছিলি কী করে করবি আর আমি বলেছিলাম ‘আমায় প্রপোজ কর।’ তুই ভেবেছিলি তোকে সহজ করতে আমি অমন বলেছিলাম কিন্তু আমার মনে ছিল অন্যকিছু।
এশা যখন সেখানে পৌঁছোয় তখন আমি দেখেছিলাম আর সেই সময়ই তোকে বলি প্রপোজ টা করতে। তুই আমার সামনি ছিলি, প্রপোজ করছিলি তবে তোর কণ্ঠে ছিল এশার নাম। তোর অনুভূতিগুলোর প্রকাশ ছিল এশার প্রতি। কিন্তু ও দূর থেকে দেখে কিছুই বোঝেনি। ওর কানে পৌঁছোয়নি তোর মুখে ওরই নাম ছিল। ও সহ্য করতে পারবে না জানতাম আমি। সেটাই হয়েছিল। পালিয়েছিল ও। কিন্তু তখনও আমার একটা ভয় ছিল। একই বাড়িতে তোরা দু’জনে। দু’জনেই কষ্টে ডুবে থাকবি এই অবস্থায় যদি একে অপরের সামনে এসে যাস তবে তো সবটা ভেস্তে যাবে। আমি ভাবলাম, ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম।
continued…..