নিভৃতে_যতনে Part_02,03

0
2242

নিভৃতে_যতনে
Part_02,03
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_02

রুমের অবস্থা নাজেহাল। সবকিছু এলোমেলো অবস্থায় মেঝেতে পরে আছে। দুই এক জায়গায় কাঁচের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গুমোট অন্ধকার চারদিকে। আমি বিছানার সাথে লাগানো দেওয়ালে পিঠ করে হাটু গুঁজে বসে আছি। গায়ে এখনো হলুদের লেহেঙ্গাটি জড়ানো। হাতে পায়ে হলুদের ছোঁয়া। কাঁচা ফুলের গহনাও দুই একটা এখনো শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। আর বাদ বাকি সব মেঝেতে পরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নয়ন দুটি আমার শুষ্কতা বজায় রেখে রক্তিম লাল হয়ে উঠেছে। বাইরে দরজায় একের পর এক কড়া আঘাত পড়ছে। হৃদিপু ডাকছে। কিন্তু সেইদিকে আমার কোন ধ্যান নেই। আমি এক ধ্যান জানালার বাইরে তাকিয়ে আছি। জানালার বাইরে ঝুলানো মরিচ বাতির রঙ্গিন আলোটা চোখে বিঁধছে খুব। যা ক্ষণে ক্ষণে আমার চোখে জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। মাথার চুল চেপে ধরলাম। সবকিছুই এখন আমার কাছে অসহ্য লাগছে।

কিছুক্ষণ আগেই আমি হলুদের পর্ব চুকিয়ে এসেছি। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও সকলের সামনে সঙ সেজে বসেছিলাম। শুধু মাত্র এই আশায় হয়তো এখন খবর আসবে, “পাত্রপক্ষ বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে। এই বিয়ে আর হবে না।” কিন্তু সে গুড়ের বালি। চারদিকে গান-বাজনা। কোলাহলময় পরিবেশ। আত্নীয়স্বজনরা মেতে উঠেছে গল্পে। বাড়ির ছোকরারা ছুটোছুটি করছে এদিক ওদিক। কাজ বুঝাচ্ছে সকলকে। এত কোলাহল,ধ্বনি ও শব্দের মাঝেও আমায় সেই অতি কাঙ্ক্ষিত ধ্বনিটি কেউ শুনাতে পারি নি, যার জন্য আমি চাতক পাখি হয়েছিলাম। হৃদিপু মিনিট দুয়েক বাদেই আশ্বাস দিয়ে গেছেন, “খবর হয়তো এখনই আসবে। তুই চিন্তা করিস না।” তার কথায় আমি একটু ভরসা খুঁজে পেলেও যখন ছেলেপক্ষের সকলকে হাসি মুখে অনুষ্ঠানে প্রবেশ করতে দেখলাম তখনই সব ভরসা উবে যায়। নীরব দৃষ্টিতে সব দেখতে থাকি। তারা আসলো হলুদ ছোঁয়ালো, মিষ্টি মুখ করালো,আশির্বাদ করলো। বিয়ের ডালা বুঝিয়ে দিলো। আর আমি! নির্বিকার চেয়ে রইলাম। অতঃপর তারা বিদায় নিতেই আমিও উঠে চলে আসলাম নিচে। পিছু নিলো মা আর হৃদিপু। পিছনে শুরু হলো তথাকথিত সেই আত্মীয়স্বজনদের কানাঘুষা। কিন্তু সে সবে কি আদৌ আমার কিছু যায় আসে? দরজা ভিজিয়ে নিজের ক্ষোভ ঝাড়লাম নিরিহ রুমটির উপর। এরপর নিথর হয়ে বিছানায় বসে পড়লাম।

কথাটা ভেবেই বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস। গা-টা বড্ড জ্বালা করছে। একেক জায়গা খিঁচে উঠছে। ফ্রেশ হওয়া দরকার। আমি উঠে দাঁড়াই। দরজার অপাশ থেকে শুনা যায় হৃদিপু, মা, চাচী আর ফুপুর আতঙ্কে কম্পিত কন্ঠ। আমি নিজেকে সামলে চেঁচিয়ে উঠি,

— আমি ঠিক আছি।

কথাটা বলার সাথে সাথেই অপাশটা নীরব হয়ে যায়। হয়তো এতক্ষণ আমার এই “ঠিক আছি” শুনার জন্যই তাদের এত অস্থিরতা। আমি শব্দহীন পায়ে এগিয়ে যাই আলমারিটার দিকে। এক সেট জামা নিয়ে এগিয়ে যাই ওয়াশরুমের দিকে।

___________________

ফ্রেশ হয়ে এসে আমি দরজাটা খুলে দিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে পড়ি। মনে মনে কল্পনা আঁটি কিভাবে এই বিয়েটা বন্ধ করতে পারি। পালানো সম্ভব না। আর আমি পালাতে চাইও না। কিন্তু এর বাদে উপায়টা কি? যখন আমি এই আকাশ-কুসুম ভাবছি তখন হৃদিপু খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে রুমে আসে। আমার পাশে বসে প্লেটটা বিছানার উপর রেখে আমার হাত দুইটি তার কোলে টেনে বলে,

— দেখ জীদ করিস না। এখনো সময় আছে। লাস্ট মোমেন্টে এসেও বিয়ে ভাঙতে পারে।

আমি হৃদিপুর দিকে শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে বলি,

— কিভাবে ভাঙ্গবে শুনি? আর কেই বা ভাঙ্গবে বিয়েটা? ওই আমার সো কোল্ড হবু বর নাকি তোমার শ্রদ্ধেয় চাচাজান?

হৃদিপু আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— আচ্ছা সে সব কথা পরে হবে আগে খেয়ে..

আমি হৃদিপুর কথার মাঝে ফোঁড়ন দিয়ে বলি,

— কথা ঘুরাচ্ছ কেন তুমি?

হৃদিপু স্থির হয়ে বলে,

— কথা ঘুরাচ্ছি না। জাস্ট বলছি আগে খেয়ে নে। এইভাবেই তুই দুপুর থেকে কিছু খাস নি। তার উপর তুই তখন ওইভাবে উঠে চলে আসায় মেহমানদের মাঝে কানাকানি শুরু হয়ে গিয়েছে। চাচী কোনমতে বিষয়টা সামলিয়েছে।

আমি মুখ ঘুরিয়ে বলি,

— এদের তো কাজই অনুষ্ঠানে এসে খুঁত ধরা আর কানাঘুষা করা। এ বাদে তাদের কাজ কি? আজ পর্যন্ত তারা কখনো উপকারে এসেছে? সবসময় তো মানুষের অপকারই করতে জানে এরা। দাওয়াত কেন দেয় এদের? অসহ্য!

হৃদিপু প্লেট হাতে নিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বলে,

— পরে এদের গোষ্ঠী উদ্ধার করিস আগে হা কর!

কথা বলে এক লোকমা ভাত আমার মুখের সামনে ধরে। আমি কিছু না বলে খাবারটা মুখে তুলে নেই। হৃদিপু খায়িয়ে দিতে দিতে বলে,

— বিয়েটা করে ফেললে হয় না সিয়া? এই জেলখানা থেকে যখন মুক্তি পাচ্ছিস তো মুক্ত হয়ে যা না। একটা কারণের জন্য..

আমি আপুর কথার মাঝে ফোঁড়ন দিয়ে বলি,

— একটা কারণ না আপু। অনেক কারণ আছে। শুনবে? মাস খানেক আগেই তো উনিশে পা দিয়েছি। বয়সের দিকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হলেও আমি মানসিক দিক দিয়ে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত নই। এই সংসার নামক বেড়াজালে নিজেকে আবদ্ধ হওয়ার মনোবল নেই আমার। তার উপর মাস খানেক পরেই আমার এডমিশন এক্সাম। কোন কোচিং ভর্তি হওয়ার আগেই তোমার সো কোল্ড শ্রদ্ধেয় চাচু আমার জন্য ছেলে ধরে বেঁধে নিয়ে আসলো। তাও কি তার কোন বন্ধুর ছেলে। কথা নাই, বার্তা নাই সোজা এসে আংটি পড়িয়ে চলে গেল। আমি নিজেই ঘটনাক্রমে স্তব্ধ ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না কি থেকে কি হচ্ছে। এরপরই মধ্যে বিয়ের ডেট ফাইনাল করে দিল। আর দিবেই বা না কেন? কোন ডিমান্ড ছাড়াই ঘাড়ের বোঝা সরাতে পারছে, এমন সুযোগ কি কেউ হাত ছাড়া করে? আর এইদিকে আমি এখনো পর্যন্ত ছেলের নাম আর পেশা বাদে কিছু জানি না। ইজ দিস নট গ্রেট?

শেষের কথাটা একটু ক্রোধেই বললাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলি,।

— এইসব না হয় বাদই দিলাম কিন্তু আমার যে এখনো আসল কাজটাই রয়ে গেসে। আমাকে যে নিজেকে প্রুফ করতে হবে। আর এর জন্য হলেও আমাকে এই বাসায় থাকতে হবে। এট লিস্ট পড়ালেখা শেষ করার আগপর্যন্ত।

হৃদিপু আমার কথা শুনে বলে,

— সেটা তুই অন্য জায়গায় থেকেও করতে পারবি। দ্যাট ইজ নট এ বিগ ইস্যু। কিন্তু আমার মতে চাচ্চু হয়তো তোর বিয়ে আরেকটু পরে দিত কিন্তু তোর বেপরোয়া ভাবটার জন্যই..

আমি হৃদিপুকে বলতে না দিয়ে বলি,

— যেই ঘড়ির সুতোর টান ছেড়েই দেওয়া হয়েছে তা কি আর নিয়ন্ত্রণে থাকে?

হৃদিপু দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে আমায় খায়িয়ে দিতে থাকে। খাওয়া শেষে আমি পানির বোতলটা নিতে যাব তখনই বাবা এসে আমার রুমে হাজির হয়। আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কর্কশ কন্ঠে গর্জে উঠে,

— নতুন কি তামাশা লাগিয়ে দিয়েছ তুমি?

আমি বাবার দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলি,

— কিসের কথা বলছেন আপনি?

কথাটা শেষ না করতেই পিছনে বড় বাবা,রেহানা চাচী,মা, ফুপু আর নাসরিন বেগম এসে হাজির হয়। বাবা কর্কশ কন্ঠে বলে উঠে,

— অনুষ্ঠানের মাঝ থেকে উঠে আসার মানে কি? মেহমানেরা কিসব বলছে তার কোন খবর আছে তোমার?

আমি নিজের দৃষ্টি বাবার উপর থেকে সরিয়ে নিয়ে বলি,

— খারাপ লাগছিল তাই চলে এসেছি।

আমার কথাটা শুনে নাসরিন বেগম বলে উঠে,

— খারাপ লাগতাসিল নাকি আমগো অপনাম করবার লিজ্ঞা তুই ওমনেই উইঠ্যা আইসোস? আমাগো কি তুই শান্তি মত বাঁচবার দিবি না? আর কত ধ্বংস করবি আমগো? অপয়া জানি কোনহানকার। আর কত জীবন খাবি তুই?

আমি নাসরিন বেগমের কথা শুনে তেতে উঠি। তীক্ষ্ণ গলায় কিছু বলতে নিব তার আগেই বড় বাবা বলে উঠে,

— আহা মা চুপ করো তো। বাসা এখনো মেহমানের আনাগোনা আছে। সেদিকে একটু খেয়াল রাখো।

কথাটা শুনে বাবা হেসে বলে,

— মাকে চুপ করিয়ে কি লাভ ভাইজান। ভুল তো কিছু বলে নি। এই মেয়ে তো সবকিছুর মূলই। আমাকে মাটির সাথে না মিশানো পর্যন্ত ও হাল ছাড়বে না। মুখ তো আমার এইভাবেই রাখেনি। এখন বাদ বাকি যা একটু সম্মান ছিল তাও ডুবিয়ে মারবে এই মেয়েটা৷ সত্যি আজ বলতেও গা ঘিনঘিন করছে এইটা আমার মেয়ে। আসলেই মেয়ে নামে ও কলঙ্ক।

বাবা কথা শেষ করতে মা চেঁচিয়ে উঠে,

— এইসব কি বলছ তুমি? মাথা ঠিক আছে?

বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

— যা বলছি ঠিকই বলছি। আমার এই কথাগুলো আরও আগে বলা উচিৎ ছিল কিন্তু বলতে দেরি করে ফেলেছি।

— বেশি বারাবাড়ি করছো কিন্তু তুমি।

নাসরিন বেগম মায়ের উদ্দেশ্যে চড়া গলায় বলে উঠে,

— মাইয়ার ভালবাসায় অন্ধ হইয়া গেসো নি তুমি? মাইয়ার দোষ আসে জানবার পরও তুমি ওর হইয়া কথা বলার সাহচ দেখাও কেমনে?

বাবা আমার দিকে চেয়ে হাত জোর করে বলে,

— তোমার সামনে হাত জোর করে বলছি সব সুন্দর মত হতে দাও আর মানহানি করো না আমার। আর মাত্র আজকের দিনটা। বিয়ের পর আমরা আমাদের রাস্তায় আর তুমি তোমার রাস্তায়। এরপর তুমি মরো নাকি বাঁচো সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। কিন্তু আমাদের শান্তি মত বাঁচতে দাও। আর কোন ঝামেলা করো না। এত অপমান, অপবাদ শুনতে ভালো লাগছে না। নিত্যনতুন তোমার জন্য একেক ঝামেলায় জড়াতে হয় আমাদের। এইবার তো রেহাই দাও।

কথাটা বলে তিনি ক্ষান্ত হোন। আর আমি নিষ্পলক দৃষ্টিতে সকলের মুখে পানে তাকিয়ে আছি। একমাত্র মা ব্যতীত কাউরো চোখে আমার জন্য কোন ভালবাসা নেই। যা আছে তা হচ্ছেএক রাশ বিরক্তি আর ঘৃণা। আমার কানে এখনো বাবার বলা একেকটা কথা প্রতিধ্বনি হচ্ছে। নিজের বিবেক এই বার বার আমাকে ধিক্কার জানাচ্ছে এইখানে পরে থাকার জন্য। নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা সৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ মন-মস্তিষ্ক বলে উঠে, “দরকার নেই কাউকে কিচ্ছু প্রুফ করার। এদের কিছুই যায় আসে না সিয়াশা। কিছুই না। তুই চলে যা এইখান থেকে। নিজের জীবন নিজেই গড়ে নে।”
কথাটা মস্তিষ্কে আসতেই মূহুর্তেই তা আমায় নাড়িয়ে দেয়। নিজের ভ্রম ভাঙিয়ে দেয়। সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই আমি। নিষ্পলক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলি,

— আমার বাবা হওয়া সুবাদে আপনার এই ইচ্ছা আমি রাখব। আপনি যা চান তাই হবে। বিয়ে হওয়ার আগপর্যন্ত কোন ঝামেলা হবে না। কিন্তু মনে রাখবেন এইটাই হচ্ছে আমার কাছে আপবার শেষ চাওয়া-পাওয়া। শেষ দেনা-পাওনা। এরপর থেকে আপনার সাথে আমার আর কোন সম্পর্কই থাকবে না। আমার কবুল বলার সাথে সাথেই আপনার সাথে আমার সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাব। তাও চিরতরের জন্য।

কথাটা বলে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। আর কারো মুখ দেখার বা কথা শুনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। আমি এখন নিতান্তই একা থাকতে চাই। একটু শান্তি চাই। তাই কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলাম,

— সকলের মহান বক্তৃতা শেষ হলে আসতে পারেন। আমি এখন ঘুমাবো। আফটার অল আমি ব্রাইড। কালকে সবচেয়ে সুন্দর আমাকেই লাগতে হবে তাই না? আপনাদের মত মানুষদের জন্য কি আমি এখন না ঘুমিয়ে চোখের নিচে গর্ত করবো নাকি?

আমার কর্কশ কন্ঠে বলা কথাগুলো শুনে সবাই একেক করে চলে যায়। নাসরিন বেগম যাওয়ার আগে আমায় কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে চলে যায়। কিন্তু তার কথা আমলে নেয় কে? সবাই চলে যাওয়ার পর রয়ে যায় শুধু মা আর হৃদিপু। হৃদিপু এতক্ষণ নির্বিকার ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে সাধারণত বড়দের মুখের উপর কথা বলে না। বলতে গেলে সে হচ্ছে এই বাড়ির অতি ভদ্র মেয়ে। আর আমি? আমি তো এই বাড়ির সবচেয়ে অভ্রদ,বেয়াদব,নির্লজ্জ আর ওই যে বুড়ির কথা অনুযায়ী অপয়া মেয়ে। এইতো আর কি?

মা আমায় কিছু বলতে নিবে তার আগেই আমি বলে উঠি,

— মা তুমি যাও। তোমার সাথে সকালে কথা হবে। আর হৃদিপু তুমিও চলে যাও। সকালে কথা হবে।

কথা বলেই আমি ধীরে সুস্থে দুইজনকে বের করে দিলাম। অতঃপর দরজা ভিজিয়ে দিয়ে লাইট অফ করে দিলাম। চোখ প্রচন্ড জ্বালা করছে। মাথাও কেমন ভনভন করছে। ক্লান্ত লাগছে খুব। ঘুমালে হয়তো ভালো লাগবে। অবশ্য আজ আমি শান্তির ঘুম ঘুমাবো। এই রুমে,এই বাসায়,এইখানে আজ আমার শেষ রাত বলে কথা। না ঘুমালে হয় নাকি? আমি ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।হঠাৎ ঘুমে ধরেছে খুব। গভীর ঘুম।

চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_03
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

বিয়ে-শাদির ঘর বলে সকাল হতে না হতেই বাড়ির বড়রা জেগে উঠে। নামাজের পর্ব চুকিয়ে যে যার মত কাজে লেগে যায়। এরপর আরেকটু বেলা হতেই রিলেটিভরা, বড় ভাই-বোনেরা আর পিচ্চি-বাচ্চারা উঠে পড়ে। কালকে হলুদের অনুষ্ঠান শেষে তারা এইখানেই থেকে গিয়েছিল। তারা উঠেই পরিবেশ গরম করে ফেলে। হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠে আর ছোট বাচ্চা-কাচ্চারা মেতে উঠে নিজের মধ্যে। সকলে নাস্তার পর্ব চুকিয়ে উঠতেই আমার ঘুম ভাঙে। আমিও আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ি আর রুম থেকে বেরিয়ে আসি। নিজের মত নাস্তা পানি খেয়ে রুমে বসে মোবাইলে গেমস খেলতে থাকি। বেশ কিছুক্ষণ পর হৃদিপু আর কিছু কাজিন হাতে বিয়ের সাজসজ্জা নিয়ে রুমের ভিতর আসে। অতঃপর একেক করে সব আমাকে দেখিয়ে ব্যাগে ভরতে থাকে। একটু পরই নাকি সকলে আমাকে নিয়ে পার্লারের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। আমিও তাদের কথা অনুযায়ী হা হু মিলাতে থাকি। আর তা দেখে হৃদিপু বার বার আমার দিকে আড়চোখে তাকাতে থাকে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না। হয়তো কালকে রাতে বেরিয়ে যেতে বলায় অভিমান করেছে। বোনটাও না আমার আবার মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে অভিমানী।

ঘন্টা খানিকের মধ্যেই সবকিছু গুছিয়ে সবাই আমাকে নিয়ে রওনা দেয় পার্লারে উদ্দেশ্যে। মোট ৪ টা রিকশা ভাড়া করা হয় পার্লারে যাওয়ার জন্য। সকল রিকশা ২ জন করে।তো আমার সাথে হৃদিপু এই উঠলো। রিকশা চলছে আপন গতিতে। আমি চুপচাপ বসে আছি। হৃদিপুও আজ নিরব। কোন কথা নেই তার মুখে। তা দেখে আমি এক হাত দিয়ে আপুকে জড়িয়ে ধরে বলি,

— আমার বইনাটা কি আমার সাথে রাগ করেছে?

হৃদিপু আমার হাত সরাতে সরাতে বলে,

— যা সর তো। আর আহ্লাদ দেখাতে হবে না।

আমি আপুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলি,

— সরি তো। ভালো লাগছিল না বিধায় চলে যেতে বলেছিলাম তোমায়। আচ্ছা যাও এত গুলা সরি। এইবার মাফ করে দাও।

— হুহ! হুহ! সর সর!

আমি আপুকে ছেড়ে দিয়ে নাক ফুলিয়ে বলি,

— আর কিছু ঘন্টাই তো আছি। জ্বালিয়ে নাও। এরপর আর পাবা না আমায়। হুহ!

— এই মেয়ে! এই! কি বললি তুই? মাইর দিব এক। তোকে পাবো না মানে কি? তোকে না পেলে তুই যেখানেই থাকস না কেন একবারে উঠিয়ে নিয়ে আসবো। হুহ!

আমি হালকা হেসে বলি,

— আমাকে উঠাতে পারবা তো?

হৃদিপু আমার বাহুতে চাপড় মেরে বলে,

— সবসময় ফাজলামো।

আমি আর কিছু না বলে আপুকে জড়িয়ে ধরি। আপু আমায় এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,

— জীদ বা রাগ বিয়েটা করিস না সিয়া। নিজের মন থেকে বিয়েটা না করতে চাইলে পালিয়ে যা।

আমি অবাক চোখে হৃদিপুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলি,

— বাহ রে! এই তুমি না কালকে বললা বিয়েটা করতে। এখন তুমিই বলছো বিয়েটা না করতে?

— হ্যাঁ বলছি। কারণ আমি চাই না তুই রাগের মাথায় কোন সিদ্ধান্ত নিস আর নিজের জীবন নষ্ট করিস। তোর নিজের জীবন নিয়ে অনেক এমবিশন আছে আমি জানি। আমি চাই তুই সেগুলো পূরণ কর। কেউ তোর পাশে থাকুক আর নাই থাকুক আমি আছি।

আমি হালকা হেসে বলি,

— তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই না আপু। আমি কোন কিছু এইভাবেই হুট করে বলি না জানোই তো। সিদ্ধান্তটা আমি অনেক ভেবে চিন্তেই নিয়েছি। বিয়েটা হচ্ছে হতে দাও। এতেই হয়তো সবার ভালো হবে। আর রইলো আমার কথা? আমি তো নরকেও ভালো থাকার উপায় জানি। তো আমাকে নিয়ে চিন্তা করার তো প্রশ্নই আসে না। এন্ড ইউ নো আমি কখনো আমার নেওয়া সিদ্ধান্তের উপর আফসোস করি না। যদি সেটা আমার মৃত্যুও বয়ে আনে তাও না।

— জানি কিন্তু তোর ইচ্ছা,স্বপ্ন ওইগুলো?

— যেখানে জীবনের মূল লক্ষ্যটাই ছেড়ে দিয়েছি সেখানে আর আমার এই ক্ষুদ্র ইচ্ছা বা স্বপ্ন তো অতি তুচ্ছ। আর মোট কথা আমি এখন সব আল্লাহ এর হাতে ছেড়ে দিয়েছি। আমাকে নিয়ে তার যা করার সে করবে। আমি শুধু এখন নিজের মত থাকতে চাই। যেভাবে আমি চাই।

হৃদিপু কিছু না বলে আমার মুখপানে তাকিয়ে থাকে।

______________________

ভেনুতে এসেছি ঘন্টা খানিক আগেই। আমাকে স্টেজে সঙ সাজিয়ে বসিয়ে দিয়ে সবাই এখন পরাগপার। আমিও মূর্তির মত বসে নিবিড় দৃষ্টিতে চারদিকটা দেখছি। সকলের মনে কত উচ্ছাস, কত আনন্দ। অথচ যাকে ঘিরে এই অনুষ্ঠান সেই নির্জীব। ক্ষণে ক্ষণে মানুষ এসে দেখে যাচ্ছে। হালচাল জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে। আমিও ঠোঁটে কোনে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে জবাব দিচ্ছি৷ মাঝে দুইবার ফটোগ্রাফার এসে ছবি তুলার প্রস্তাব দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি প্রতিবারই নাকচ করে দিয়েছি৷ এত ঢঙ ভাঙ করে ছবি তুলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা হচ্ছে না আমার।
বেশ কিছুক্ষণ হৃদিপু আর বাদবাকী কাজিনরা স্টেজে উঠে আসে। সাথে তারা ফটোগ্রাফারকেও নিয়ে আসে ছবি তুলার জন্য। সকলেই একেক করে আমার সাথে ছবি তুলতে থাকে। ছবি তুলা শেষে অনেকে নেমে যায় অনেকে আবার স্টেজে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে থাকে। তখন হৃদিপু এসে আমার পাশে বসে। হাল্কা গলায় ঝেড়ে বলে,

— কে যেন আমায় বলেছিল সে তার নেওয়ার সিদ্ধান্তের উপর কখনো আফসোস করে না।

আমি হৃদিপুর কথা শুনে সুরু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলি,

— আফসোস কে করছে?

— তুই যে রকম ফেস করে বসে আছিস তাতেই তো তাই মনে হচ্ছে তুই আফসোস করছিস। মনমরা হয়ে আছিস কেন তুই?

আমি থমথমে গলায় বলি,

— ভাল্লাগছে না কিছু।

হৃদিপু আমার হাতের উপর হাত রেখে বলে,

— সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই নিয়েছিস সেহেতু নিজের মত করেই সেটা এক্সেপ্ট কর। নিজেকে কেন পরিবর্তন করছিস?

আমি অবাক সুরে বলি,

— পরিবর্তন দেখলে কোথায়?

— নিজেকে নিজেই এই প্রশ্নটা কর উত্তর পেয়ে যাবি। দেখ যত যাই হোক না কেন নিজেকে চেঞ্জ করিস না প্লিজ। তুই আগে যেমন ছিলি তেমনই থাক।

কথাটা শুনে আমি হৃদিপুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। হৃদিপু একটু থেমে আবার বলে,

— তুই কথাটা এডমিট কর আর নাই কর। কালকের ঘটনাটা তোর উপর ইফেক্ট করেছে। আর তুই সেটাই ধরে বসে আছিস। কিন্তু কেন? আমি যে সিয়াশাকে চিনি সে তো এইসব কথা ধরে রাখার মানুষ নয়। সে তো জীবনকে উপভোগ করতে যানে। হাজার কষ্টের মাঝেও হাসতে জানে। তাহলে সে কেন আজ নিজের মুখে হাসি ফুটাতে পারছে না। কেন? তোর ডেমন কেয়ার ভাবটা আজ কই?

আমি হৃদিপুর কথা শুনে আনমনে ভাবি, “আসলেই তো আমি কেন মনমরা হয়ে আছি? কাকে দেখানোর জন্য? এইখানে তো মা আর আপু বাদে কেউ আমার আপন নয়। আমি মরি নাকি বাঁচি তাতে কারো কিছু যায় আসে না। তাহলে? আমি কেন নরমাল হতে পারছি না। সিয়াশা ইউ হ্যাভ টু বি ফাইন। আজ তোর বিয়ে, ইঞ্জয় কর। ফিল ফ্রি। সবাইকে দেখিয়ে দে তোর উপর কোন কথার ইফেক্ট পরে না। ইউ ডোন্ট কেয়ার এবাউট এনিওয়ান”

কথাটা নিজেই নিজেকে বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললাম। তারপর হৃদিপুর দিকে তাকিয়ে বলি,

— আ’ম ফাইন। এত টেনশন কেন করো আমাকে নিয়ে বলতো? জানো না বেশি টেনশন করলে মুখে ভাঁজ পরে যায়? অল্প বয়সে বুড়ি হতে চাও নাকি? দেইখো কিন্তু, বুড়ি হয়ে গেলে কিন্তু তোমার ডট ডট পালিয়ে যাবে।

হৃদিপু আমার বাহুতে চাপড় মেরে বলে,

— আস্তাগফিরুল্লাহ! বইন হইয়া বোনের জন্য বদদোয়া করোস। খাটাশ মাইয়া।

আমি দুষ্টুমির সুরে বলি,

— বাতাসে প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছি। আহা কি প্রেম!

হৃদিপু সুরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— চুপ কর বইনা। আশেপাশে বহুত মানুষ। কেউ শুনলে কেলেঙ্কারি লেগে যাবে।

— জানো! আমার না মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় তুমি আদৌ প্রেম করো কি না। প্রেম করতে ভাই সাহস লাগে আর তোমার মধ্যে সাহসের ‘স’ ও নাই। কেমনে কি ভাই? কাঁঠালের সাথে বাঙ্গী।

কথাটা শুনে হৃদিপু রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। তারপর বলে,

— আপনা টাইম ভি আয়গা। বিয়ে তো করছিস। এরপর বুঝাবো নে আমি, কত ধানে কর চাল।

আপুর কথা শুনে হঠাৎ আমার গুণধর বরের কথা মস্তিষ্কে টনক নাড়ে। আমি চটজলদি বলে উঠি,

— বাই দ্যা রাস্তা ওই ব্যাটার আজ খবর আছে। এখন যা হচ্ছে সব টারই মেহেরবানী। দুই নাম্বারি করার অনেক শখ তাই না। বোঝাচ্ছি আমি। এর জীবন যদি আমি ত্যানাত্যানা না করেছি আমার নামও সিয়াশা না।

আমার কথা শুনে আপু হু হু করে হেসে উঠে। তারপর বলে,

— আহা! বেচারা আমার দুলাভাই।

— দুলাভাই না কঁচু। হুহ!

হৃদিপু হঠাৎ আমার হাতে হাত রেখে বলে,

— এই সিয়াকেই তো আমি এতক্ষণ খুঁজছিলাম। সবসময় এইভাবেই থাক বোন। আচ্ছা এখন চল ছবি তুলবি।

কথাটা বলেই আপু ফটোগ্রাফারকে ডেকে এনে আমায় টেনে নিয়ে যায় ছবি তুলার জন্য। এর ঘন্টা খানিক বাদেই বরযাত্রী এসে হাজির হয়। চারদিকে কোলাহল বেড়ে যায়। চারদিকে থেকে সকলে বলে উঠে, “বর এসেছে! বর এসেছে।” সকলে ব্যস্ত হয়ে তাদের আপ্যায়নের জন্য আর ছোটরা হামলে পরে গেটের উপর। উদ্দেশ্য সালামি আদায়। এই সালামির এমাউন্ট নিয়েই দুইপক্ষের মধ্যে একপ্রকার দ্বন্দ্ব লেগে যায়। অতঃপর একটা জায়গায় এসে দুইপক্ষ মিলে বোঝাপড়া করে নেয়। গেট ছাড়া হয়। বরকে নিয়ে এসে আমার পাশে বসানো হয়। আমার পাশে বর এসে বসতেই আমি তার দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকাই। পরক্ষণেই নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে নিচের দিকে তাকাই। নিজের রাগ সংযত করি। এইভাবে ইচ্ছে তো করছে একে এইখানেই ধুয়ে দেই। কিন্তু কথায় আছে না, “সবসময় মনের জোর চলে না।” আমার বেলায়ও তাই হচ্ছে আজ।

কিছুক্ষণের মাঝেই কাজী এসে হাজির হয়। আমাদের পাশের সোফায় তাকে বসানো হয়। সে মিনিট পাঁচেক এর মধ্যেই বিয়ে পড়াতে শুরু করে। সকলেই আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আর আমি! কোন এক ঘোরের মধ্যে যেন ঢুবে গিয়েছি। খানিকক্ষণ বাদেই কাজীর কথা কানে এসে বারি খায়।

— জনাব ওসমান আলী ও জনাবা আয়েশা বেগমের কনিষ্ঠ কন্যা ‘সিয়াশা ইয়াসমিন’ এর সাথে জনাব শাহরিয়ার তৌসিফ ও জনাবা সালমা বেগমের একমাত্র ছেলে ‘আদনাফ জুহায়র রোয়েন’ এর সাথে এত টাকা দেনমহরে দুইজনের বিবাহ ধার্য করিয়া হইলো। বাবা তুমি কি এই বিয়েতে রাজি? রাজি থাকলে বলো কবুল।

বরকে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই সে কবুল বলে দেয়। অতঃপর আমাকে কবুল বলতে বললে আমিও ঝামেলা ছাড়া কবুল বলেই। দেখতেই দেখতে আমার বিয়ে হয়ে যায়। হয়ে যাই আমি কারো অর্ধাঙ্গিনী। জড়িয়ে যাই এক নতুন সম্পর্কে আর ভেঙ্গে দেই পুরনো সকল সম্পর্ক। শুরু হয় জীবনের নতুন এক অধ্যায়।

______________________

মিনিট দশেক আগেই সকলে মিলে আমায় একটি রুমে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। যাওয়ার আগে বলে দিয়ে গিয়েছে, এখন থেকে এইটাই নাকি আমার রুম। তার রুম থেকে যেতেই আমি চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেই। চারদিকটা ফুলের ঘ্রাণে মো মো করছে। খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে রুমটি। রুমে তেমন আসবাবপত্র না থাকলেও যা আছে তা পরিপাটিভাবেই রাখা। দেয়ালে তেমন কোন ফটোফ্রেম নেই। শুধু বেড সাইড টেবিলে একটি ফটোফ্রেম রাখা। তাতে ভাসছে এক শ্যাম বর্ণ ছেলের প্রতিচ্ছবি। ছেলেটা আর কেউ নয় বরং ঘন্টাখানিক আগে হওয়া আমার জামাই। হুহ! আমি চারদিকে চোখ বুলিয়ে উঠে দাঁড়াই। কাবার্ডের কাছে রাখা আমার লাগেজটার দিকে এগিয়ে যাই। প্রচন্ড অস্থির লাগছে। ফ্রেশ হওয়ার দরকার। তাই লাগেজটা খুলে এক সেট কামিজ আর টাওয়াল বের করে নিলাম। রুমের সাথে ওয়াশরুম থাকায় আমার অসুবিধা হলো না। ঢুকে পড়লাম ওয়াশরুমে। ওয়াশরুমে ঢুকেই আগে মুখে কতক্ষণ পানির ঝাপটা দিলাম। অতঃপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। ক্লান্তিতে মুখটা একদম শুকিয়ে এসেছে। হঠাৎ মনের দুয়ারে আমার বিদায়ের ঘটনাটা কড়া নারে। চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই দৃশ্যটি।

বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসতেই আমাকে ধরে সবাই বাইরে নিয়ে আসে। তুলে দেওয়া হয়ে আমাকে। মা আর হৃদিপু বাদে কাউরো চোখে পানি ছিল না। শুধুমাত্র হাতে গনা কয়েক কাজিনদের চোখ নরম হয়ে এসেছিল। এর বাদে সকলেই মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিল। অনেকে নিজেদের মধ্যে মত্তো ছিল। বাবা উরফ ওসমান সাহেব শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। নাসরিন বেগম তো ছিলেন দৃষ্টির বাইরে। আমি সবকিছুই নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আমার ছিল না তখন পানি। ছিল এক রাশ হতাশা আর ধিক্কার। শুধুমাত্র আসার আগে আমি মা আর হৃদিপুকে বলে আসি। অতঃপর ওসমান সাহেবের সামনে গিয়ে শুধু বলি,

— অন্যায় করে কেউ কখনো পার পায় না। কথাটা মনে রাখবেন আর ভালো থাকবেন!

কথাটা বলেই আমি গাড়িতে উঠে বসেছিলাম। তখন চোখ দিয়ে দুই ফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লেও কেউ দেখার আগেই মুছে ফেলি। নিজেকে শক্ত করে ফেলি। একবারের জন্যও পিছনে ফিরে তাকাইনি আর। চুপচাপ চলে আসি অন্যের নীড়ে।

ঘটনাটা মনে পড়তেই আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেই। মনে মনে ভেবে নেই, “অতীত ভুলে যা সিয়াশা। ভবিষ্যতে ফোকাস কর।” অতঃপর সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসি। বেরিয়ে এসে দেখি রুম এখনো ফাঁকা। বুঝতে আর দেরি নেই সে এখনো রুমে আসে নি। আমি কিছু না বলে চলে যাই বেলকনিতে। টাওয়ালটা মেলে দিয়ে রুমে এসে পায়চারী করতে থাকি। মূলত সেই মহান ব্যক্তিটির অপেক্ষা করতে থাকি। যে নাকি এখন আমার বর। আমি হাটছি আর মনে মনে ভাবছি, “একবার রুমে আসুক ওই ব্যাটা। দেখাচ্ছি মজা। আমাকে বিয়ের করার স্বাদ মিটাচ্ছি”
কথাটা ভেবেই রাগে ফুঁসতে থাকি। বেশ কিছুক্ষণ পর দরজা খোলার আওয়াজ কানে আসে। আমি দরজার দিকে তাকাতেই দেখি মহাশয় এসে হাজির হয়েছেন। তাকে দেখা মাত্র আমি দাঁড়িয়ে যাই। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রই তার দিকে। সে রুমে এসে দরজা ভিজিয়ে দেয়। অতঃপর আমার দিকে চোখ পড়তে সে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই সে বলে উঠে,

— লেট্ মে বি ফ্রেশ ফার্স্ট।

কথাটা বলেই সে গটগট করে কাবার্ডের দিকে চলে যায় আর নিজের এক সেট কাপড় বের করে ঢুকে পরে ওয়াশরুমে। আর আমি সেইদিকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকি। ঘটনাটা ক্রমে আমার বুঝতে সময় লেগে যায়। অতঃপর যখন বুঝতে পারি তখন ক্রোধে ফেটে যাই আমি। প্রায় মিনিট দশেকের উপরে কেটে যায় কিন্তু ব্যাটার বের হওয়ার কোন নামই নেই। আমি পুনরায় পায়চারী করতে থাকি। পাক্কা আধাঘন্টা পর সে বেরিয়ে আসে৷ সে বেরিয়ে আসতেই আমি তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারি,

— এই বিয়ে কেন করেছেন আপনি? হুয়াই? আপনাকে সব জানানোর পরেও কিভাবে করলেন আপনি এই বিয়েটা?

আমার কথা শুনে সে পুনরায় ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অতঃপর ভাবলেশহীন গলায় বলে,

— কি জানিয়েছিলে তুমি আমায়?

কথাটা শুনে আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বলি,

— এইটাই যে আমি অন্য কাউকে ভালবাসি।
তারই ভালবাসার চিহ্ন এখন আমার গর্ভে বেড়ে উঠছে।

কথাটা শুনে সে ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে। কিন্তু তাতে আমার মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। আমি এখনো নিজের স্থানে ঠাই দাঁড়িয়ে আছি। সে আমার কাছে এসে আমার মুখের সামনে এক ঝুঁকে বলে,

— সবই বুঝলাম বাট বাচ্চাটা কার? ভূতের নাকি জ্বীনের? নাকি কোন ভ্যাম্পায়ারের?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here