নিভৃতে_যতনে Part_13,14

0
1854

নিভৃতে_যতনে
Part_13,14
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_13

আকাশটা আজ ধূসর রাঙা। কালো ও ধূসর মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে উন্মুক্ত আকাশের বুকে। দক্ষিণ দিকে বইছে ঢেউ খেলানো বাতাস। বাতাসের মাঝেই ফুটে উঠেছে ধুলোবালির ঘূর্ণন রেখা। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাখিদের আতঙ্কিত কন্ঠ। সময়টা দুপুর হলেও বাইরে দেখে মনে হচ্ছে যেন গোধূলির লগ্ন ঘনিয়ে এসেছে। আমি দ্রুত বারান্দা থেকে কাপড় নিয়ে আসি অতঃপর বারান্দার থ্যাই গ্লাসটা লাগিয়ে দেই। বিছানা কাপড় রাখতে রাখতে দেখি ইতিমধ্যে হৃদিপু সকল জানালা বন্ধ করে ফেলেছে। আমি কাপড়গুলো বিছানার উপর রাখতে রাখতে হৃদিপুকে জিজ্ঞেস করি,

— পলি আন্টি কি চলে গিয়েছে?

হৃদিপু বিছানায় পা তুলে বসে বলে,

— হ্যাঁ মাত্র গেলো।

— সাথে ছাতা নিয়ে যেতে বলেছিলাম তাকে। নিয়েছিল কি?

— দেখলাম তো নিয়েছে।

আমি এক গাদা কাপড় হৃদিপুর কোলে ছুঁড়ে মেরে বলি,

— বসে আছো কেন? কাজ করো। কাজ ছাড়া কিন্তু এই ঘরে ভাত নাই।

হৃদিপু আমার মুখের উপর একটা জামা গোল করে ছুঁড়ে মেরে তীক্ষ্ণ গলায় বলে,

— ছোট বেলায় তোকে হাতে খায়িয়ে দিয়েছি এইদিন দেখার জন্য? আমার কষ্টের এই প্রতিদান দিলি তুই?

আমি ভ্রু কুঁচকে বলি,

— তো এর চেয়ে বেশি তুমি কি এক্সপেক্ট করো?

হৃদিপু আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে উঠে আসে। তা দেখে আমি দ্রুত সরে যাই। হৃদিপু এইবার রুদ্ধ গলায় বলে,

— ইউ বেয়াদব মেয়ে! দাঁড়া বলছি। আজ তোর একদিন কি আমার চল্লিশ দিন৷

কথাটা বলেই হৃদিপু আমার দিকে তেড়ে আসতে নিলে আমি হৃদিপুকে জড়িয়ে ধরে বলি,

— ওলে ওলে আমার বইনাটা। কত রাগ করে।

হৃদিপু ফোঁসফোঁস করতে করতে বলে,

— ছাড় আমায়। ছাড়। হুহ! হুহ!

আমি হেসে বলি,

— ইশশ! ইশশ! কি রাগ। জ্বলে পুড়ে আইস্ক্রিম হয়ে গেলাম।

কথাটা বলেই ফিক করে হেসে দেই। আমার হাসি দেখে হৃদিপুও হেসে দেয়৷ অতঃপর সেও আমায় জড়িয়ে ধরে।

____________________

বাহিরে আজ ঝড় হচ্ছে। আষাঢ় মাসের ঝড়। চাপা এক হুংকার দিয়ে বাতাস বইছে। চারদিকে হিম শীতল এক ভাব। পরিবেশটা শীতল দেখে আমি আর হৃদিপু ঢুকে পড়লাম রান্নাঘরে। মূল উদ্দেশ্য ভুনা খিচুড়ি আর গরু মাংসের রেজালা রান্না করা। বৃষ্টি-বাদলের দিন আর বাঙ্গালীরা খিচুড়ি খাবে না?তা কি হয়! দুইজনে মিলে রান্না শেষ করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। রাতের খাবার খেতে এখনো দেরি তাই আমি মোবাইল নিয়ে খাটে বসলাম। এফবিতে লগইন করে নিউজফিড স্ক্রোল করতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর হৃদিপু আমার পাশে এসে জিজ্ঞেস করে,

— ভাইয়া কবে আসবে রে?

আমি মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলি,

— পরশু আসবে মনে হয়৷ কেন?

— না এইভাবেই।

আমি আর কিছু না বলে চুপ করে রই। আজ দুইদিন হতে চললো রোয়েন বাসায় নেই৷ অফিসিয়াল কিছু কাজ পড়ায় তাকে ঢাকার বাহিরে যেতে হয়েছে। আমার যেহেতু এক্সাম সেহেতু আমাকে নেওয়া সম্ভব ছিল না। আবার আমাকে একবারে একা রেখেও সে যেতে পারছিল না। তাই তিনি সব দিক বিবেচনা করে হৃদিপুকে এইখানে থাকার জন্য বলেন। হৃদিপুও আমার সাথে থাকতে আপত্তি করে নি।
হঠাৎ হৃদিপু বলে উঠে,

— সিয়া তুই কিন্তু ঠিক মত পড়ছিস না। এডমিশন টেস্টের জন্য কিন্তু হাতে বেশি টাইম নেই। পরের সপ্তাহেই হয়তো ডেট পড়বে। এখন সিরিয়াস না হলে কিন্তু ঢাবিতে চান্স পাবি না।

আমি ভাবলেশহীন গলায় বলি,

— নাই বা পেলাম। সমস্যা কি?,

হৃদিপু বিষ্ময়কর ভরা কন্ঠে বলে উঠে,

— লাইক সিরিয়াসলি? তুই বলছিস এই কথা? তোর না স্বপ্ন ছিল ঢাবিতে পড়ার? ইচ্ছে না ছিল আমার ক্যাম্পাসকে নিজের বলার? আমার সাথে ঢাবির প্রাঙ্গনে উন্মুক্ত পাখির মত ঘুরে বেড়ানোর?

আমি হৃদিপুর দিকে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলি,

— সেসব ইচ্ছে যে অনেক আগেই মৃত ঘষিত হয়েছে। আর মৃত জিনিস কখনো জীবন্ত হয় না। হোক সেটা মানুষ বা ইচ্ছে। ভুলে গেছি আমি আমার সকল ইচ্ছে। এখন আর কোন ইচ্ছে কাজ করে না আমার ভিতর। পড়ালেখাও এখন বিরক্ত লাগে৷

হৃদিপু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

— যা তো একটা কলম আর সাদা কাগজ নিয়ে আয়।

আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করি,

— কেন?

হৃদিপু একটু কঠোর সুরেই বলে,

— আনতে বলেছি আন। বেশি কথা কেন বলিস?

আমি আর কিছু না বলে মুখ ফুলিয়ে স্টাডি টেবিলের উপর থেকে একটা কলম আর কাগজ নিয়ে আসি। দুইটা তার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলি,

— নাও।

হৃদিপু আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— তোর কাছে রাখ আর আমার সামনে বোস।

আমি হৃদিপুর কথা মতই তার সামনে বসি। হৃদিপু আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— এইবার এই সাদা কাগজে একটা সোজা একটা দাগ টানতো।

কথাটা শুনার সাথে সাথে আমার ভ্রু যুগল একত্রিত হয়ে আসে। আমি কৌতূহলপূর্ণ চোখে তার দিকে তাকাই। হৃদিপু আমার দৃষ্টির মর্ম বুঝতে পেরে বলে,

— আহা কর না।

আমি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে কাগজের মাঝে একটা দাগ টানি। এরপর হৃদিপুর দিকে তাকাতেই হৃদিপু আমায় বলে,

— এইবার এইটা মুছে ফেল।

কথাটা শুনে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। বিষ্ময়কর চোখে তাকিয়ে রইলাম হৃদিপুর দিকে। অস্ফুটস্বরে বলে উঠি,

— পাগল হয়েছ? কলমের কালি আবার মুছে কিভাবে?

হৃদিপু ভাবলেশহীন গলায় বলে,

— তাহলে বলছিস এই দাগটা মুছা যাবে না?

আমি অকপটে স্বীকার করি,

— না! এইটা ইম্পসিবল।

হৃদিপু আমার কথা শুনে মুচকি হেসে বলে,

— আমাদের ইচ্ছেগুলো ঠিক এই কলমের কালির মতই হয়। কালো,ঘন ও গভীর এক টান। যা একবার মনের ক্যানভাসে আঁচড়ে পড়লে মুছা বড় দায়। তুই যতই চেষ্টা কর সেই দাগটাকে তুলতে কিন্তু তুই পারবি না৷ সর্বদা এর ছাপ রয়েই যাবে। এর অস্তিত্বও রয়েই যাবে। ঠিক যেমন তুই এই কাগজের পাতা থেকে কলমের দাগ মুছতে পারবি না তেমনই নিজের ইচ্ছেগুলো ভুলতে পারবি না। সেগুলো সর্বদা তোর মনের মাঝেই থাকবে। হোক জীবন্ত অথবা মৃত। অস্তিত্ব কিন্তু রয়েই যাবে আর সেটা তুইও পদে পদে অনুভব করতে পারবি৷

আমি চাপা কন্ঠে বলি,

— কি বুঝাতে চাইছো?

— এইটা যে ইচ্ছাগুলো কখনো ভুলা যায় না। সেগুলো সর্বদাই আমার মনের মাঝে থাকে। শুধু একটা সুযোগ খুঁজে বেরিয়ে আসার। নিজেকে তুলে ধরার। আর তুই এখন সে সুযোগটা পাচ্ছিস। কিন্তু তা কাজে লাগাচ্ছিস না। লাইফ তোকে একটা সুযোগ দিচ্ছে ঘুরে দাঁড়ানোর। সুযোগটা কাজে লাগা। নিজেই একবার ভাব, আমাদের দেশে কতজন নারী পারে বিয়ের পর নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যেতে? কয়টা শ্বশুরবাড়ি বা জামাই হয় এমন যারা কিনা তাদের বউদের পড়ালেখা করায়? ভাব!

আমি কিছু না বলে চুপ করে রই। মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করতে থাকে হৃদিপুর কথাগুলো। কথাগুলো বার বার আমাকে নতুন এক ভাবনা ভাবতে বাধ্য করছে। এইদিকে আমায় চুপ থাকতে দেখে হৃদিপু আবার বলে,

— ভাইয়া তোকে নিজ থেকে পড়াচ্ছে, তোকে সাপোর্ট করছে, তোকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছে কিন্তু তাও তুই সেটা হেলায় নিচ্ছিস? নিজের ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস কর। যেমন আগে করতি। নতুন দমে, নতুন রুপে, নতুন উদ্যোগে নিজের ইচ্ছাগুলো জীবিত কর। তোর মনোবল কিন্তু অনেক স্ট্রোং। সেটা আপাতত এখন ঢাবির দিকে স্থির কর। আই নো ইউ ক্যান ডু ইট। গিভ এ চান্স টু ইউর সেল্ফ৷ প্লিজ! ভুলে যাস না তোকে নিজেকে প্রুভ করতে হবে আর এর শুরু কিন্তু এখন থেকেই।

হৃদিপুর কথাগুলো শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। নির্মল চোখে তাকিয়ে রই হৃদিপুর দিকে। মস্তিষ্কে চলতে থাকে হাজারো ভাবনা, হাজারো চিন্তা। মনে পড়ে অতীতগুলো। সেই ইচ্ছে, সেই মনোভাব গুলো। সকলের ব্যবহার গুলো। হঠাৎই আমার বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস। আমি কিছু না বলে শুধু আপুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। ঠিক তখনই তপ্ত এক নোনাজলের ফোটা গড়িয়ে পড়ে চোখের কার্নিশ বেয়ে।

চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_14
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

শ্রাবণের শেষভাগ। তপ্ত গরমে যখন মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে, প্রকৃতি ঢাকা পরে ধুলোর স্তুপে তখনই এক পলশা বৃষ্টি নেমে আসে প্রকৃতির বুকে। ম্লানে ধুয়ে নিয়ে যায় সকল গ্লানি, সকল ক্লান্তি। উপহার দিয়ে যায় এক নির্মল প্রকৃতি। আজও এক পলশা বৃষ্টি নেমে এসেছে প্রকৃতির বুকে।বাতাস বইছে শনশন… শনশন। বাহিরের পরিবেশটার মতই আজ আমার অন্তরটাও অগোছালো হয়ে উঠেছে। বুকের মাঝে উথাল-পাথাল ঢেউয়ের বইছে। মন-মস্তিষ্ক জুড়ে অপ্রীতিকর চিন্তা-ভাবনার আসর জমেছে৷ এই প্রথম ভয় যেন আমাকে কাবু করে বসে আছে৷ বিছানায় বইপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে বসে আছি। কোথাও শিট পড়ে আছে তো কোথাও বই-খাতা। তাদের মাঝেই লুকোচুরি খেলছে কলম-রাবার-পেন্সিল। কালবাদে পরশুই আমার এডমিশন এক্সাম। সবকিছু পড়া আগেই শেষ করে ফেললেও এখন মনে হচ্ছে আমার কিছুই পড়া হয়নি। আমি কিছুই পারি না। এমন এক অনুভূতি হচ্ছে যে, পরীক্ষার হলে গিয়ে হয়তো আমি আমার নামই ভুলে যাব৷ উফফ কি এক যন্ত্রণা। হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু চোখ দিয়ে পানিই পড়ছে না। বার বার হাঁসফাঁস করছি। একবার বাংলা দেখছি তো একবার হিসাববিজ্ঞান, আরেকবার ফিন্যান্স দেখছি তো আবার ম্যানেজমেন্ট।
আমার এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কারবার রোয়েন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শীতল চোখে সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বেশ কিছুক্ষণ আমায় সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর রোয়েন গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,

— তোমার জামাই ভেগে যায়নি যে এমন পাগলের মত আচরণ করছো।

কথাটা কর্ণপাত হতেই আমি রোয়েনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাই। রুদ্ধদ্বার গলায় বলি,

— কি বললেন? আমি পাগলের মত আচরণ করছি?

সে দেয়ালের সাথে গায়ের ভর ছেড়ে দিয়ে দুই হাত বুকে গুঁজে বলে,

— তা নয়তো কি? কোন স্বাভাবিক মানুষ কি এইভাবে আচরণ করে নাকি?

কথাটা শুনে হয়তো এখন আমার ক্রোধে ফেটে যাওয়ার কথা ছিল। কোমড় বেঁধে রোয়েনের সাথে ঝগড়ায় মশগুল হওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু হলো এর বিপরীতটা। আমি একদম চুপসে গেলাম। মুখ ছোট হয়ে এলো আমার৷ কেন না আমি জানি রোয়েন যা বলছে তা ঠিক। পরীক্ষা সামনে আসলেই আমি হাইপার হয়ে যাই৷ কেমন উগ্র উগ্র ভাব চলে আসে আমার মাঝে। আর এইখানে তো জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। পাগলামো করবো আমি করবো না তো কে করবে শুনি? আমি চুপচাপ হাতের উপর হাত ঘেষে চলেছি। অস্বস্তি লাগছে বেশ। আমাকে এইভাবে চুপ থাকতে দেখে রোয়েন বলে উঠে,

— এইভাবে করতে থাকলে যা পড়েছ তাও ভুলে যাবে। ডাফার!

আমি থমথমে গলায় বলি,

— তো কি করবো?

রোয়েন স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে,

— নিজের মনকে শান্ত করো আর টেনশন কম করো। টেনশনই তোমার অর্ধেক পড়া খেয়ে ফেলবে।

— হু। কিন্তু করবোটা কি?

উনি বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করার মত শব্দ করে উঠেন এবং আমার দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— নিজেকে আপাতত শান্ত করো আর নিজেকে ও মন-মস্তিষ্ককে শান্ত রাখতে যা মন চায় তাই করো। লাইক মুভি দেখো বা ঘুমাও। প্রেশার না নিয়ে রিলেক্স করো একটু। এতে মাইন্ড ফ্রেশ হবে।

আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই আমার মুঠোফোন বেজে উঠে। আমি কিঞ্চিৎ ফোনের দিকে দৃষ্টি নিহিত করতেই দেখি হৃদিপু কল করেছে। আমি কলটা রিসিভ করে কানেই দিতেই অতি চিন্তিত এক কন্ঠ কানে ভেসে এলো,

— তুই ঠিক আছিস তো?

আমি মিনমিনে গলায় বলি,

— আমি ঠিক আছি।

— দেখ একদম হাইপার হবি না। এইটা জাস্ট নরমাল এক পরীক্ষা আর কিছু না।

— হু।

— পরীক্ষা আসলেই তো তুই আর নিজের মধ্যে থাকিস না। এই এক জ্বালা। দেখ একদন প্রেশার নিবি না। মাথা ঠান্ডা রাখ।

— চেষ্টা করছি।

— তোর তো পরীক্ষা আসলেই এইটা সেটা খেতে ইচ্ছে করে। এইবার করছে না?

আমি নিচু স্বরে বলি,

— করছে।

হৃদিপু দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

— ভাইয়াকে বল নাহলে। সে এনে দিবে নে। এইবার তো আমি নেই যে তোর আবদার পূরণ করবো।

আমি একটু কঠোর সুরেই বলি,

— তুমি বাদে সেটা পূরণের জন্য তো কেউ কোনকালেই ছিল না। তো তুমিও নেই আবদার করার কোন মানুষও নেই।

— বলে দেখনাই একবার।

— ইচ্ছে নেই।

হৃদিপু আর কথা না বাড়িয়ে অন্য কথা বলতে শুরু করে। হৃদিপুর সাথে আরও মিনিট পাঁচেক কথা বলার পর সে রেখে দেয়। একবার রোয়েনের দিকে তাকিয়ে, সে ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে মোবাইল গোঁতাচ্ছে। আমি চোখ নামিয়ে ফেলি। হঠাৎই মনের মাঝে বিষন্নতা নামক কালো মেঘ ছেয়ে যায়। মলিন হয়ে আসে মুখ। আমি নখ নিয়ে বিছানার চাদর খুঁটতে থাকি।রোয়েন কিছুক্ষণ মোবাইল নিয়ে গুতাগুতি করে আমার দিকে তাকায়। আমাকে চুপটি মেরে বসে থাকতে দেখে উনি আমার দিকে ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয়ে আসে। অতঃপর স্বগতোক্তি গলায় বলেন,

— আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।

আমি মুখ তুলে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে বলি,

— বৃষ্টি হচ্ছে তো বাইরে৷

রোয়েন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

— আমার চোখ আছে৷

কথাটা বলেই সে কাবার্ড থেকে একটা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে যায়। এইদিকে তার শেষ উক্তিটি শুনে আমি বেশ অপমানিতবোধই করলাম। সেই সাথে কেমন এক চাপা অনুভূতি জাগ্রত হলো মনের মাঝে। আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। মনে মনে নিজেকে বললাম,” গোল্লায় যাক সে। তোর এত কি হ্যাঁ? অন্যের ভালো তোর বুঝতে হবে না। যার ভালো সেই নিজেই বুঝবে।”

আধাঘন্টার মাঝে রোয়েন ফিরে আসে। কলিংবেলের টুংটাং শব্দ কর্ণধার পর্যন্ত পৌঁছাতেই আমি ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাই। দরজা খুলতেই দেখি রোয়েন প্রায় খানিকটা ভিজে গিয়েছেন। চুলগুলোও ভিজে কপালের সাথে খানিকটা লেপ্টে এসেছে। বুঝাই যাচ্ছে বাইরে বৃষ্টির প্রকট খুব বেশি। যার জন্য ছাতাতেও মানাচ্ছে না। আমি কিছু না বলে আসতে নিবো তখন চোখ যায় উনার বাম হাতের দিকে। হাতে তার একটি পলিথিনের প্যাকেট। সেটা দেখার সাথে সাথে আমার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে। আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই সে আমার হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে গটগট করে ভিতরে ঢুকে পড়েন। এক হাত নিয়ে নিজের চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ড্রয়িংরুমের একপাশে ছাতাটা রেখে রুমে চলে যান তিনি আর আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রই। অতঃপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে পলিথিনের প্যাকেটটা নিয়ে ডায়নিং টেবিলের সামনে চলে যাই। প্যাকেটটা টেবিলে রেখে খুলে দেখি তাতে একটি আলাদা পলিথিনে কতগুলো ফুচকা, সেই সাথে পাশে আরেকটা পলিথিনে কিছু চকলেট আর এক বাটি চকলেট আইস্ক্রিম। এইসব দেখে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। গোলগোল চোখে তাকিয়ে রই জিনিসগুলোর দিকে। বুঝা উঠার চেষ্টা করি জিনিসগুলো আসলে কার জন্য? আদৌ কি এইসব আমার জন্য? সব কিছু কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। আর হবেই না কেন? আবদার পূরণ করার মানুষ বলতে ছিলই মা আর হৃদিপু। তাদের বাদে এমনটা তো কেউ কখনো আমার জন্য করেনি। না বাবা আর না চাচ্চু। আমার যখন যা লেগেছে তা সর্বদা মুখ ফুটে বলতে হয়েছে বা নিজেরটা নিজেরই করতে হয়েছে। সেখানে রোয়েনের কাছ থেকে এমন কিছু পাওয়াটা সত্যি অবিশ্বাস্য।

আমি স্থির চোখে তাকিয়ে আছি জিনিসগুলোর দিকে। কথাটা সত্য যে, এইগুলো আমার খুব প্রিয় এবং এইগুলো আমার খেতে ইচ্ছে করছিল। তাহলে সে কিভাবে জানলো? আমি তো আমার ইচ্ছেটা প্রকাশ করি নি তাহলে? রোয়েন নিরব জানতাম। কিন্তু সে যে এক অপ্রকাশিত রহস্য তা আজ জানলাম। হঠাৎই মনের মাঝে খিলে যায় এক রাশ মুগ্ধতা। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে কিঞ্চিৎ এক হাসি। এই হাসি কিসের তা আমার জানা নেই। শুধু এতটুকু জানি আমার মন এখন বিষন্ন নয়। একদম নয়।

_________________________

আমি এক কাপ কফি বানিয়ে বেডরুমের দিকে এগুলাম। ইতিমধ্যে রোয়েন শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল মুছছে সে। আমি তার সামনে এগিয়ে গিয়ে কফির কাপটা এগিয়ে দিলাম। সে একবার আমার দিকে তাকিয়ে গলায় টাওয়ালটা ঝুলিয়ে নিয়ে কাপটা নিয়ে নেয়। ছোট করে বলে উঠে,

— থেংক ইউ।

কেন যেন আজ তার এই ছোট বাক্যটি শুনে আমার বুক ধক করে উঠে। অস্বস্তিতে ফালিয়ে দেয় আমায়। অথচ উনাকে দেখো! কতটা না ভাবলেশহীন লাগছে তাকে। হুহ! আমি নিজেকে সামলে মিনমিনে গলায় বলি,

— আপনি কি ফুচকা খাবেন?

সে কফির কাপে এক চুমুক দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠেন,

— আমি ওইসব খাই না।

— অহ আচ্ছা৷

সে কিছু না বলে বিছানায় গিয়ে বসে। আমিও আর কিছু না বলে চলে আসি ডায়নিং এ।

____________________________

ভর্তি পরীক্ষার পর্ব চুকিয়েছি আজ এক সপ্তাহ হতে চললো। আমার পছন্দের সকল জায়গায়তেই পরীক্ষা দেওয়া শেষ আমার। পরীক্ষা একবারে অনেক ভালো দিয়েছি তা না। আমার মতে মোটামুটি। কিঞ্চিৎ আশা আছে যে, পাবলিকে চান্স আমার হয়ে যাবে। কিন্তু এখন শেষ পর্যন্ত কি হয় তা আল্লাহ মালুম। এইখানে একটা কথা না বললেই নয়, রোয়েন কিন্তু আমার পিছনে কম খাটনি করে নি। আমাকে পরীক্ষার আগে অনেক বুঝিয়েছেন। কিভাবে কি করতে হবে, না হবে। নিজ হাতে নোটসও করিয়ে দিয়েছেন তিনি। হোক না একটু স্ট্রিক। যা করেছেন তাতে আমার ভালোই হয়েছে। সেই সাথে হৃদিপুর সেদিনের কথাগুলো যেন ম্যাজিকের মত কাজ করেছিল আমার জন্য। পড়ালেখার প্রতি হারিয়ে যাওয়া আগ্রহটা যেন নতুন দমে পেয়েছিলাম। যার ফলে পরীক্ষাটা নিয়ে আমি এত সিরিয়াস হতে পেরেছিলাম। এখন শুধু আরাম আর রেজাল্টের অপেক্ষা।

শ্বাশুড়ি মা এসেছেন চার-পাঁচদিন হয়েছে। এসেই আমার সাথে দুনিয়ার কথা জুড়ে দিয়েছেন। কোচিং আর পড়ার প্যারা এখন না থাকায় আমার একাকিত্ব সময়টা এখন তার সাথেই কেটে যায়। আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলে রোয়েন আজই বাসায়। কিছুক্ষণ আগেই মসজিদ থেকে জুম্মার নামাজ পড়ে ফিরেছে। আপাতত নিজের রুমেই বসে ল্যাপটপে কি যেন কাজ করছে। উনার তো আবার কাজের শেষ নাই। আমি ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে মায়ের সাথে কথা বলছি। রোয়েনের বিষয় উঠতেই তিনি বলেন,

— কিছু মনে করো না মা। একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

আমি হাসি মুখেই জবাব দেই,

— হ্যাঁ মা করুন।

— রোয়েন কি তোমার সাথে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে? ছেলেটা তো আবার আমার একটু চাপা স্বভাবের। সহজে কারো সাথে মিশতে পারে না। বেশি কথাও বলে না। তা তোমার সাথেও কি এখন ওমনই আছে?

কথাটা শুনে আমি কিছুক্ষণ চুপ হয়ে যাই। বুঝে উঠার চেষ্টা করি আমার এখন কি বলা উচিৎ। তার সাথে কথা বলতে গেলেই তো আমার ঝগড়া লেগে যায়। আর বাদ বাকি সময় টুকটাক কথা। স্বাভাবিকই আমরা কিন্তু তাও কোথাও এক ‘কিন্তু’ রয়েই যায়। আমি না জানি নিজের কথা, আর না জানি তার মনের কথা। মাঝে মধ্যে মনে কিছু একটা আমাদের মধ্যে আছে। কোন এক টান, কোন এক অনুভূতি। আবার মাঝে মধ্যে মনে কোন কিছুই নেই। কিন্তু তা কি আর বলা যায়? আমি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলি,

— না মা তেমন কিছু না। তিনি স্বাভাবিকই।

— যাক তাহলে তো ভালো। তা তোমার কোন অসুবিধা হয় না তো?

— না মা।

— তা এই কয়েকমাসে কোথাও ঘুরতে গিয়েছে তোমরা?

আমি এইবার বিপাকে পরে যাই। সত্যি বলতে আমাদের একান্তভাবে কখনো ঘুরতে যাওয়া হয়নি। সেরকম ইচ্ছাই জাগেনি। আমি মাথা নিচু করে বলি,

— না মা যাওয়া হয়নি। আসলে আমার পরীক্ষা ছিল তার উপর পড়ার চাপ। তাই সময় মেলে নি।

— তাহলে আজ ঘুরে এসো কেমন? আমি রোয়েনকে বলে রাখছি।

আমি অকপটে বলে উঠি,

— না মা এর দরকার নেই।

কিন্তু কে শুনে কার কথা? মা আমায় এক ধমক দিয়ে চুপ করে দেন এবং চলে যান উনার কাছে।

_____________________

আকাশ আজ আবছা মেঘলা। রৌদ্দুরের দেখা নেই। স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। টিএসসির প্রাঙ্গণে নির্মল এক পরিবেশের মাঝে হেটে চলেছি আমরা। অন্যপাশে বেশ জমজমাটই আছে বটে। এইপাশটা একটু নীরব। আমি কোন মতে শাড়ি সামলে নিয়ে এগিয়ে চলেছি। শাড়িটা সামলাতে আমার বেশ হিমসিম খেতে হচ্ছে। তার উপর পিঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এক গুচ্ছ চুলের মেলা। সব মিলিয়ে আমি মহা বিরক্ত আর সেই বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছে মুখে চোখেও। এক মা না বললে এই চৌদ্দ প্যাঁচ আলা ত্যানা আমি মরলেও পড়তাম না। আমি মনে মনে সমান তালে শাড়ি আবিষ্কারককে বকে চলেছি আর হেটে চলেছি। পাশেই রোয়েন কোন ভাবান্তর ছাড়া হেটে চলেছে। এমন সময় শাড়িতে আমার পা বেজে যায় আর আমি পড়ে যেতে নেই। ঠিক সেই সময় এক জোড়া পুরুষালী শক্ত হাত আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে সামলে নেয়। আমি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি রোয়েন। আমাদের দুইজনের চোখাচোখি হতেই সে আমাকে ঠিক মত দাঁড় করিয়ে দিয়ে সরে দাঁড়ান। এরপর গম্ভীর কন্ঠে বলেন,

— যেটা পড়ে সাচ্ছন্দ্যবোধ করো না সেটা পড়ো কেন?

আমি ঠোঁট উল্টিয়ে বলি,

— মাকে না করার সাধ্য আমার ছিল না। তার কথা উপেক্ষা করা আমার দ্বারা সম্ভব না।

সে নিরদ্বিধায় বলে উঠে,

— তো এখন ভুগতো।

আমি গাল ফুলিয়ে হাটতে নিলে পুনরায় শাড়ির সাথে আমার পা বেজে যায়। আমি হোচট খেতে নিলেই রোয়েন আমায় দ্বিতীয়বারের মত আগলে নেয়। অতঃপর আমাকে ঠিক মত দাঁড় করিয়ে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে নিজের হাত এগিয়ে দিয়ে বলে,

— আমার হাত ধরে হাটো।

কথাটা শুনে আমি চিটকে সরে দাঁড়াই। অকপটও স্বরে বলি,

— না লাগবে না। আমি এইভাবেই হাটতে পারবো।

সে গম্ভীর মুখে বলেন,

— যা বলেছি তা করো।

আমি এর প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাব কিন্তু রোয়েনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চোখে পড়তেই তা পরক্ষনে হজম করে নিলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে এগিয়ে দিলাম নিজের হাত। সে আমার হাতটি ধরতে আমার শরীর শিহরণ দিয়ে উঠে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় কয়েকশো গুন। মনের মাঝে কাজ করছে কিছুটা সঞ্চয়, কিছুটা লজ্জা, কিছুটা মুগ্ধতা। কেন না রোয়েনই আমার জীবনের প্রথম পুরুষ যে কি-না আমার হাতটি ধরার সুযোগ পেয়েছে। আমাকে আগলে নেওয়ার অনুমতি পেয়েছে। তাই তো তার সাথে থাকাকালীন হওয়া সকল ঘটনা, অনুভূতি সবই আমার কাছে নতুন। ঠিক অন্যরকম।
রোয়েন আমার হাতটি শক্ত করে ধরে এগুতো থাকে আর আমিও তার পিছু পিছু যেতে থাকি। হঠাৎই মনে হলো যেন আমার সকল বিরক্তি দৌড়ে পালিয়েছে। এখন আর আমার বিরক্ত লাগছে না বেশ ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে এই মানুষটা যদি এইভাবেই আমার হাতটি ধরে চলতে থাকে তাহলে আমি অনন্তকাল এইভাবেই চলতে রাজি। হঠাৎ আমার কেন এমন লাগছে জানি না আর জানতেও চাই না। সব অনুভূতি যে জানতে নেই। থাকুক না কিছু অনুভূতি আড়ালে, নিরবে। নিভৃতের চাদর মুড়ি দিয়ে।

________________________

বেশ কিছুক্ষণ হাটার পর রোয়েন আমায় নিয়ে একটা ফুচকার স্টোলের সামনে আসে৷ আমাকে স্বগোতক্তি কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— খাবে?
আমি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাই। সে এক প্লেট ফুচকার অর্ডার দিয়ে আমাকে নিয়ে একটা চেয়ারে বসে। বেশ কিছুক্ষণ পেরুতেই পাশ থেকে দুই-একটা ছেলে আমাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করা শুরু করে দেয়। তারা জোরে জোরে কথা বলায় তাদের সকল কথা আমার আর রোয়েনের কানে এসে স্পষ্টভাবে বারি খাচ্ছিল। সব শুনে ক্রোধে আমি ফেটে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছু বলতে পারছিলাম না। আমি রোয়েনের মনোভাব বুঝার জন্য তার দিকে তাকাতেই দেখি সে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে ফেসবুক স্ক্রোল করছেন। দেখে মনে হচ্ছে তার মধ্যে এইসব কথার কোন ভাবান্তরই সৃষ্টি করছে না। যা দেখার সাথে সাথে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। মনের মধ্যে থাকা সকল অনুভূতি ও মুগ্ধতা উবে যায়। আমি রাগান্বিত গলায় রোয়েনকে বলে উঠি,

— ওরা আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলছে আর আপনি চুপচাপ বসে আছেন?

রোয়েন মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

— তা না হলে আমি কি করবো?

আমি অবাক হয়ে বলি,

— কি করবেন মানে? তারা আপনার এই সামনে আপনার স্ত্রীকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করছে আর আপনি চুপচাপ বসে তা কাপুরুষের মত শুনে যাবেন? কিছু করবেন না?

সে আমার দিকে একবার তাকিয়ে মোবাইল অফ নিজের পাঞ্জাবির পকেটে তা পুরতে পুরতে বলে,

— কথাগুলো কি আমাকে বলেছে নাকি যে আমার গায়ে লাগবে? যাকে বলেছে তার গায়ে লাগার কথা এবং তারই প্রতিবাদ করার কথা। সেই যদি চুপ থাকে তাহলে আমি কেন ঝামেলা করবো?

— কি বলতে চাইছেন আপনি?

সে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

— এইটা যে, কথাগুলো যেহেতু তোমায় বলেছে সেহেতু প্রতিবাদও তুমি করবে। অন্যের আশায় কেন থাকো যে, সে তোমার হয়ে প্রতিবাদ করবে? নিজের জন্য নিজেরই লড়তে হয়। আর
আমি কি সবসময় তোমার সাথে সাথে ঘুরে বেড়াবো নাকি? আজ না হয় আমি প্রতিবাদ করলাম কিন্তু এরপরে? আমি কোন গল্প বা সিনেমার নায়ক নই যে তুমি বিপদে পড়বে আর আমিও সেখানেই উপস্থিত হয়ে যাব তোমাকে বাঁচানোর জন্য। বাস্তবতা বুঝো। অন্যের প্রতি আশা না রেখে নিজের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ নিজেই করতে শিখো।

আমি শীতল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলি,

— তো কি করতে বলছেন আপনি?

— নিজে গিয়ে প্রতিবাদ করো। এরপরে তারা ঝামেলা করলে বাকিটা আমি দেখবো।

কথাটা শুনে আমার কি হলো জানি না। কোন এক দৃঢ় শক্তি এসে হানা দিলো মনে। আমি কিছু না বলে উঠে দাঁড়াই, চলে যাই সেই দুটো ছেলের সামনে। যে ছেলে আমায় নিয়ে বাজে বলছিল তার গালে কষিয়ে এক থাপ্পড় লাগিয়ে দেই। উঁচু গলায় বলি,

— ঘরে মা-বোন নেই? বাসায়ও বুঝি নিজের মা-বোনদের এইসবই বলে বেড়ান? রাস্তা-ঘাটে মেয়ে দেখলেই টিজ করতে ইচ্ছে করে? লজ্জা করে না এইসব করতে?

মূহুর্তেই ছেলে দুইটা হৈ হৈ করে উঠতেই পাবলিক জমা হয়ে যায়। তা দেখে পিছন থেকে রোয়েন এসে জোর গলায় বলে,

— টিজ করার এতই যখন শখ তাহলে পুলিশের বারিটাও না হয় ফ্রিতে খাও।

কথাটা বলে ফোন হাতে নিতেই দুইটা ছেলে ভয়ে কেটে পড়ে। দুইজনের কেটে পড়া দেখে আমি কিছু বলতে যাবো তার আগের রোয়েন আমার হাত চেপে ধরে বলে,

— যাচ্ছে যেতে দাও। সব জায়গায় অতিরিক্ত কথা বলতে হয় না। পরিমাণ মত বললেই হয়। আর মেয়ে যেহেতু হয়েছে সেটার সৎ ব্যবহার করো। পাবলিক প্লেসে কিন্তু মেয়েদের দাপট বেশি মনে রেখো।

কথাটা বলেই তিনি আমার হাত ধরে ফের ওই জায়গায় নিয়ে আসেন আর আমি মুগ্ধ চোখে তার পানে তাকিয়ে রই। মন থেকে বেরিয়ে আসে তার জন্য সম্মানবোধটা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here