নিভৃতে_যতনে Part_25,26

0
1745

নিভৃতে_যতনে
Part_25,26
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_25

চারদিকে হট্টগোল। মেয়েপক্ষের সকলে ব্যস্ত বরযাত্রীদের আপ্যায়ন করতে। ছুটাছুটি চলছে এইদিক সেদিক। আমরা শুভ ভাইয়ার বাসায় যেতেই সকলে ক্ষণেকের মাঝে রওনা দিয়ে দেয়। যার জন্য কেউ তখন ভালো মত আমায় পরোক্ষ করতে পারেনি। অতঃপর কমিউনিটি সেন্টারে এসে যখন সবকিছু একটু স্থির হলো তখন সবাই হামলে পড়লো আমার উপর। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম বিধায় মা নিজ থেকেই আমায় সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমিও হাসি মুখে তাদের বরণ করলাম। আমাকে নিয়ে একেকজনের একেক কথা। কেউ ভালো বলছে তো কেউ খুঁত ধরছে। কেউ বা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করছে। বলতে গেলে, বাঙ্গালী আত্মীয়দের আসল কাজ যা আরকি। প্রথমে এতটা বিরক্ত না লাগলেও আমি এখন চরম বিরক্তি। কখন না জানি মুখ ফোসকে কিছু একটা বলে বসি আর তা বোমা বিস্ফোরণ মত বিস্ফোরিত হয়ে উঠে। একান্ত ব্যাপারটা ব্যক্তিগত হলে এতক্ষণে হয়তো কথা শুনিয়ে দিতাম কিন্তু বিষয়টা যে ব্যক্তিগত না৷ আমি কিছু একটা বললেই তা এখন তিল থেকে তাল হবে, সেই সাথে অপদস্ত হবে মা ও বাবা। যা কিছুতেই আমি চাই না। যারা আমায় এত ভালোবাসে তাদের অসম্মান কি আর মানা যায়? আমি কোনভাবে জায়গাটা থেকে কেটে পড়তে চাইছি কিন্তু এই আত্মীয়রা আমরা পিছে কাঁঠালের আঠার মত লেগে আছে। ছাড়ছেই না আমায়। অসহ্য! বেশ কিছুক্ষণ পর কোথ থেকে জেরিন আর ফাহিম এসে হাজির হলো। জেরিন জানালো যে, নুরি আর নীলা আপু আমায় খুঁজছে। আমার সাথে কি যেন কাজ আছে তাদের। কথাটা শুনে মাও আর নাকচ করলেন না। পাঠিয়ে দিলেন ওদের সাথে। আত্মীয় নামক বিচ্ছু বাহিনীর দল থেকে মুক্তি পেয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচি আমি ৷ ক্ষণেই একবার চোখ বুলিয়ে জেরিন আর ফাহিমকে দেখে নিলাম। দুইজনই সমবয়সী। তাই চঞ্চল ভাবটা একটু বেশি। বেশ কিছু দূর যেতেই দেখি রোয়েন সটান হয়ে দাঁড়িয়ে এক হাতে মোবাইল টিপছে আর অন্য এক হাতে গাড় নীল পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছে। জেরিন আর ফাহিম গিয়ে রোয়েনের সামনে দাঁড়াতেই আমিও দাঁড়িয়ে পড়ি। জেরিন আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,

— ভাবী তুমি থাকো আমরা আসছি।

আমি জেরিনের মুখের দিকে কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— কিন্তু নুরি আর নীলা আপু কোথায়? তারা না আমার খোঁজ করছিল?

জেরিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফাহিম বলে উঠে,

— ভাবী যে তোমার খোঁজ করছিল আমরা ঠিক তার কাছেই তোমাকে নিয়ে এসেছি।

কথাটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র বিস্ময়ে আমার নয়ন দুইটি বৃহত্তম আকার ধারণ করে। ঠোঁট দু’টির মাঝে বিরাজমান হয় কিঞ্চিৎ ফাঁক। জেরিন কনুই দিয়ে ফাহিমের পেটে গুতা দিয়ে বলে,

— বেশি কথা বলিস তুই। চুপ থাকতে পারিস না।

ফাহিম পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

— রোয়েন ভাইয়া দেখো এইখানে পুরুষ নির্যাতন হচ্ছে। তুমি কিছু বলো।

রোয়েন এইবার তাঁর মুঠোফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলেন,

— বেশি কথা বলার শাস্তি এমনই হয়। জেরিন এই গর্দভকে নিয়ে বিদাই হো তো।

জেরিন কিছু না বলে ফাহিমকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। ওরা যেতেই আমি চট জলদি জিজ্ঞেস করে বসি,

— আপনি মিথ্যে বলে আমায় কেন আনালেন?

রোয়েন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

— স্বাদে কি তোমায় ডাফার বলি? আত্মীয়দের সামনে যদি ওরা গিয়ে বলতো আমি খোঁজ করছি তাহলে বিষয়টা কেমন হতো? খোঁচাচ্ছিল তো এইভাবেই এরপর তা মাত্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যেত।

রোয়েনের কথার মর্ম বুঝতে পেরে মিইয়ে যাই আমি। তার মানে রোয়েন এতক্ষণ সবই দেখছিল আর আমার বিরক্তিটা বুঝতে পেরেই সেখান থেকে বের করে নিয়ে এসেছে আমায়। কিন্তু তাও কথাটা না বুঝার ভাণ করে মিনমিনে গলায় বলি,

— খোঁজ করছিলেন কেন?

রোয়েন পাঞ্জাবীর পকেটে মোবাইল পুড়তে পুড়তে বলে,

— নিজের দিকে একবার তাকাও তো।

আমার এইবার ভ্রু কুঁচকে আসে। আমি রোয়েনের দিকে একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। কিন্তু বিষয়টা ধরতে না পেরে রোয়েনের দিকে তাকাতেই উনি স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠেন,

— কোমরের পাশ দিয়ে শাড়ি নেমে গিয়েছে। বলেছিলাম না ভালো মত পিন করতে? করো নি কেন?

ঘটনাক্রমে বুঝতে আমি দ্রুত পিছন দিয়ে আঁচল টেনে সামনে নিয়ে আসি।

— না মানে..

রোয়েন আমার কথা অনাগ্রহ করে বলেন,

— শাড়ি যদি সামলাতে না পারো তাহলে পড়ো কেন?

আমি মিনমিনে গলায় বলি,

— আপনি সামলাবেন বলে।

কথাটা মুখ ফোসকে বলে ফেলি আমি। যার ফলে এখন আড়ষ্টে পড়ে যাই। তিনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

— সামলানোর মানুষ আজ আছে তো কাল নেই। তাই নিজেই নিজের উপর নির্ভরশীল হওয়া শেখো।

কথাটা শোনা মাত্র আমার মন বিষিয়ে যায়। ভিতরটা কেমন হাহাকার করে উঠে। চুপ হয়ে যাই আমি। আমাকে এইভাবে চুপ থাকতে দেখে রোয়েন তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন,

— যাও! ওয়াশরুমে গিয়ে ঠিক করে নাও। আর আমি তোমার আশেপাশেই আছি৷ বিব্রতবোধ করার দরকার নেই।

_____________________

শুভ ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় সপ্তাহখানেক হলো। সকল অনুষ্ঠান শেষে পুনরায় যে যার মত জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বাবার স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে শীতের ছুটি চলছে বলে আপাতত বাবা-মা দুইজনই আরও সপ্তাহখানেক থাকবেন৷ এতে অবশ্য আমি অনেক খুশি। এখন আর একা সময় পার করতে হবে না। কথা সঙ্গী হিসাবে তারা আছে। সেই সাথে তাদের অতুল ভালোবাসাও আছেই। নিজের আপন মেয়ের চাইতে কম ভালোবাসেন না তারা আমায়। অনেক সময় আমি নিজেই দ্বিধায় পড়ে যাই এরা আসলে আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি নাকি আসল বাবা-মা। বাহিরের মানুষের কথা না হয় বাদই দিলাম।

গোধুলির লগ্ন। শীতে আছন্ন পরিবেশ। কনকনে শীত না হলেও মোটামুটি ভালোই শীত পড়েছে এইবার। গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে ড্রয়িং রুমে বসে মা-বাবার সাথে বসে বাদাম চিবুচ্ছি আর গল্পগুজব করছি। বাবা তার ছোট বেলার কাহিনী শুনাচ্ছেন। সেই সাথে তিনি যুদ্ধের সময় কি দেখেছিলেন, করেছিলেন, তার পরিবার কিভাবে বেঁচে ছিল, কিভাবে তারা বাঙালী যোদ্ধাদের সাহায্য করেছিলেন তাও বলছেন। আমি অবশ্য বেশ মনোযোগ দিয়েই এইসব শুনছি। আমার এত আগ্রহ দেখে বাবা যেন দ্বিগুণ উৎসাহের সাথে গল্পগুলো বলা শুরু করলেন। গল্প গুজব করতেই করতে কখন যে সন্ধ্যা ছয়টা অতিক্রম করে রাত নয়টা বেজে যায় তা টেরই পাইনি আমরা। হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর যেতেই টনক নাড়ে। রোয়েন কোথায়? সে তো সবসময় ছয়টা কি সাড়ে ছয়টার মাঝে বাসায় এসে পড়ে। আর দেরি হলে তো উনি ফোন করে জানিয়ে দেন। কিন্তু আজ তো উনি আমায় কোন ফোন করেন নি। মাকে করেছিলেন নাকি? তাৎক্ষণিক আমি মাকে জিজ্ঞেস করি,

— মা! উনি কি আজ আপনাকে ফোন করে বলেছিলেন যে তার দেরি হবে বা এমন কিছু?

মা নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দেন,

— না এমন কিছু তো বলেনি মা। কেন?

— তিনি তো সাধারণ এত দেরি করে না আর দেরি করলেও জানিয়ে দেন।

মাঝ দিয়ে বাবা বলে উঠেন,

— ফোন দিয়ে না-হয় দেখো।

আমি আর সময় অবচয় না করে দ্রুত রোয়েনকে ফোন লাগাই। কিন্তু একি তাঁর ফোন বন্ধ। আমি আরও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করি কিংবা না ফোন বন্ধই। এইবার আমরা সকলে চিন্তায় পড়ে যাই৷ রোয়েনের অফিসের নাম্বার বা কোন কলিগের নাম্বার আমার কাছে নেই। কখনো দরকার পড়ে নি বিধায় আগ বাড়িয়ে আর রাখাও হয়নি। যার ফলে এখন চেয়ে আমি তার অফিসে ফোন করে তাঁর খোঁজ নিতে পারছি না। বাবা আর আমি মিলে অগণিত বার রোয়েনের নাম্বারে ফোন দিতে থাকি কিন্তু প্রতিবারই সেই একই তিক্ত ধ্বনি কম্পিত হচ্ছে, “নাম্বারটি এখন বন্ধ আছে। অনুগ্রহ করে আবার চেষ্টা করুন।”
ধীরে ধীরে মায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে আসে। চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েন তিনি। হাঁসফাঁস করতে থাকেন তিনি। মলিন হয়ে আসে মুখ৷ বাবাও কেমন চিন্তিত হয়ে পড়েন।এইদিকে আমার মনও খচখচ করতে শুরু করে দেয়। চঞ্চল ভঙ্গিতে আমি বার বার রোয়েনের মোবাইল ফোন মিলাচ্ছি। কিন্তু ফল প্রতিবারই শূন্য। সময় যত যেতে থাকলো ততো আমাদের দুশ্চিন্তার পরিমাণ বাড়তে থাকলো। কখন যে ঘড়ির কাটা নয়ের ঘর থেকে গড়িয়ে দশের ঘরে গিয়ে ঠেকে বুঝাই গেল না। বেশখানিকটা সময় পেরানোর পর বাবার ফোনে একটা কল আসলো। জানা গেলো রোয়েন বাইক এক্সিডেন্ট করেছেন। তাকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে আমরাও যাতে সেখানে পৌঁছে যাই। কথাটা শোনা মাত্র আমি স্থির হয়ে গেলাম। পা দুটো যেন অসাড় হয়ে পড়লো। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু যেন আমি হারিয়ে ফেলি। হৃদস্পন্দন প্রায় থেমে যায়। বার বার কর্ণধারে বাজতে থাকে রোয়েনের এক্সিডেন্টের কথা। পাশে মা কাঁদছেন এবং পাগল প্রায় আচরণ করছেন হসপিটালে যাওয়ার জন্য। বাবাও যাওয়ার জন্য তোড়জোড় লাগিয়ে দিয়েছেন। সকলের এত উত্তেজনা ভাব-ভঙ্গির মাঝেও আমি নীরব। স্থির। প্রতিক্রিয়া দিতে ভুলে গিয়েছি আমি৷

চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_26
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

আমি দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে স্থির দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। সামনেই হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে রোয়েন। ডান হাতে তার প্লাস্টার ঝুলছে, ডান পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত সাদা মোটা ব্যান্ডেজ। অভ্যন্তরীণ আরও চোট পেয়েছে কিন্তু তা এতটা গভীর না। মাথার উপর স্যালাইন ঝুলছে। ঘন্টা খানিকের মধ্যে হয়তো স্যালাইন দেওয়া শেষ হয়ে যাবে এরপর বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে তাঁকে। পাশেই মা বসে অঝোরে কেঁদে চলেছেন। বাবা গিয়েছেন ঔষধগুলো আনতে। রোয়েন ঘুমে হওয়ায় মায়ের পরিস্থিতিটা তাঁর দেখা হলো না। আমি এগিয়ে গিয়ে মায়ের কাঁধ হাত রাখলাম কিন্তু সান্ত্বনা দেওয়ার মত কিছু খুঁজে পেলাম না। দৃষ্টি গেল রোয়েনের পানে। আমি যতবারই তাঁর মলিন মুখ পানে তাকাচ্ছি ততবারই ভিতরটা হাহাকার করে উঠছে। মন অস্থিরতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। গুমোট এক চাপা অনুভূতি কামড়ে ধরছে আমায়। কেন জানি না, সামনে শুয়ে থাকা মানুষটির এই অবস্থা আমি মেনে নিতে পারছি না। তার ক্ষতবিক্ষত হওয়া হাত পা দেখে আমি বার বার দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছি। কষ্টরা দলা পাকিয়ে আসছে। আমি জানি না, এই কষ্ট কিসের? তাঁর প্রতি আমার এত প্রগাঢ় অনুভূতি কেন? শুধু জানি, মানুষকে এই অবস্থায় আমি মানতে পারছি না। কিছুতেই পারচ্ছি না।

হসপিটালে আসা মাত্র জানা গেল, রোয়েনকে রাস্তার কিছু পথিকরাই এই হসপিটালে নিয়ে এসেছেন।কিন্তু রোয়েনের মোবাইল লক থাকায় তারা কাউকে ইনফর্ম করতে পারেনি৷ এক্সিডেন্টের সময় রোয়েন রাস্তায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল যার জন্য তাঁকেও জিজ্ঞেস করা যায়নি। এরপর যখন হসপিটালে তার জ্ঞান ফিরে তখন সে বাবার নাম্বারটা হসপিটাল কর্তৃপক্ষকে দেন যোগাযোগ করার জন্য৷ রোয়েন গুরুতর এক্সিডেন্ট করেন নি কিন্তু চোট পেয়েছেন বেশ। একটু আগেই ডাক্তার এসে জানিয়ে গেলেন, তার ডান হাতটা না ভাঙলেও বেশখানিক কেটে দিয়েছে। সেই সাথে রগে টান পড়েছে বিধায় হাতে প্লাস্টার পড়েছে। সপ্তাহখানেক তা রাখতে হবে। ডান পা-টা মচকে গিয়েছে এবং ছিলে গিয়েছে। কিছুদিনের জন্য তার চলাফেরা সম্পূর্ণ নিষেধ। বাকি আরও অনেক জায়গায় ছিলে ও কেটে গিয়েছে সেখানে ডেসিং করে মেডিসিন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। মোটামুটি তাকে পনেরো-বিশ দিনের মত বেডরেস্টে থাকতে বলেছেন ডাক্তার। যত্ন নিতে বলেছেন আমাদের।

বেশ কিছুক্ষণ পর রোয়েনের ঘুম ভাঙ্গতেই মা তাঁর এক হাত চেপে ধরে দ্বিগুণ কান্না কর শুরু করে দেন। বকতে থাকেন তাকে। বাবা কিছুক্ষণ ধমকালেন বেপরোয়াভাবে বাইক চালানোর জন্য। চুপ শুধু আমি থাকলাম। কোন কথাই বললাম না। নীরব দৃষ্টিতে দেখতে থাকলাম মানুষটিকে। উনি বাবা-মার সবকিছুই নীরবে হজম করে বাবা-মাকে বুঝ দিলেন। চলতি রাস্তায় সামনে থাকা গাড়িটি হঠাৎ ব্রেক করায় তাঁর ব্যালেন্স হারিয়ে যায় এবং সে এক্সিডেন্ট করে বসে। ঘটনাক্রমে শোনামাত্র বাবা-মা চুপ হয়ে যান। তাঁর মাথায় আদরমাখা হাত বুলিয়ে দেন মা। ক্ষণিকের মাঝে উনি চারদিকে চোখ বুলাতেই আমার নয়ন দুইটির দৃষ্টির সাথে তার দুইটি নয়নের দৃষ্টির সাক্ষাৎ হয়। চারটি নয়ন একত্রিত একই সুতোর মালায় এসে স্থির হয়। এরপর নিভৃতে চলতে থাকে দৃষ্টির আদান-প্রদান।

_____________________

রাত বারোটায় স্যালাইন শেষ হতেই হসপিটালের সকল টাকা পরিশোধ করে আমরা রোয়েনকে নিয়ে আসি। মা রোয়েনকে ফ্রেশ করিয়ে দিতে বাবা আর আমি ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে দেই। এরপর আমরা সকলেই ফ্রেশ হয়ে আসি। ফ্রেশ হয়ে এসে আমি জোর করে বাবা-মাকে খাওয়ার জন্য বসিয়ে দেই আর নিজে প্ল্যাটে খাবার তুলে নিয়ে যাই রোয়েনের জন্য। সেই সাথে তাদের কড়া নির্দেশ দিয়ে দিলাম, তারা যাতে রাত না জাগে৷ রোয়েনের পাশে আমি আছি তাই তারা যাতে নিশ্চিন্তে থাকে আর খেয়ে ঘুমাতে চলে যান।তারাও আর দ্বিমত প্রকাশ করলেন না। বাবা-মায়ের চেহেরা দেখেই বুঝ যাচ্ছে তারা বেশ ক্লান্ত। হবেই বা না কেন? যে দখল গিয়েছে আজ তাদের উপর দিয়ে৷ তাই তাদের এখন বিশ্রাম করাটা জরুরি বৈকি। খাবারের প্ল্যাট নিয়ে রুমে এসে বিছানায় বসতেই রোয়েন ভ্রু কুঁচকে তাকালেন কিন্তু কিছু বললেন না৷ আমি ভাত মেখে তাঁর মুখের সামনে ধরতেই সে চুপচাপ তা খেয়ে নিলেন। শুধু চেয়ে থাকলেন নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে। খাওয়া শেষে আমি হাত ধুয়ে এসে তাকে পানি আর মেডিসিন খাইয়ে দিলাম। এরপর যখন উঠে যেতে নেই উনি বা হাত দিয়ে আমার ডান হাত চেপে ধরে বলেন,

— কি হয়েছে? কথা বলছো না কেন?

আমি এতটা সময় নতজানু হয়ে ছিলাম। রোয়েনের নয়নের সাথে নয়ন না মিলে যায় সেই ভয়ে৷ কিন্তু এইবার আমি মুখ তুলে তাকাই। দৃশ্যমান হয় আমার রক্তিম লাল নয়ন দুইটি। আমি কিছু প্রহর রোয়েনের মুখ পানে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেই। মুখে নেই কোন শব্দ৷ রোয়েন এইবার নরম সুরে বলে,

— কথা বলবে না?

আমি সাথে সাথে না সূচক মাথা দুলাই। রোয়েন তা দেখে স্মিত হেসে বলেন,

— কিন্তু কেন?

আমি তাও নির্বিকার বসে থাকি। কোন কথা বলি না। কেন জানি তাঁকে এই অবস্থায় দেখে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে। ভিতরটা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। গলা ধরে আসছে বার বার। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে আমার। রোয়েন যাতে আমার ভিতরের অবস্থা বুঝতে না পারে তাই চুপ হয়ে আছি। রোয়েন আবার বলে উঠেন,

— চুপ থাকার স্বভাব কিন্তু আমার তোমার না।

আমি তাও কিছু না বলে চুপচাপ উঠে যাই, ঔষধের ঝুলি থেকে একটা ক্রিম নিয়ে পুনরায় ফিরে আসি আর রোয়েনকে সোজা করে বসিয়ে দেই। উনি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,

— কি হয়েছে?

আমি কিছু না বলে তাঁর পিছনে গিয়ে টি-শার্টটা উপরের দিকে গুটিয়ে নেই। সেই সাথে দৃশ্যমান হয় ক্ষত-বিক্ষত পিঠ। জায়গায় জায়গায় ছিলে ও কেটে যাওয়ার লালাভ দাগ। এই দৃশ্য দেখা মাত্র আমার বুক মুচড়ে উঠে। নরম হয়ে আসে নয়ন জোড়া। আমি হাতের তর্জনীর গোড়ায় কিছুটা মলম নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে তাঁর সপ্তপর্ণে ক্ষতস্থানে ছুঁয়ে দেই। সাথে সাথে রোয়েন একটু কুঁকড়ে উঠে। জ্বালায় উহু শব্দ করে উঠে। কেন জানি না আমি এইবার নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। নাক টানতে শুরু করলাম। আমার কান্নার আওয়াজ রোয়েনের কর্ণধার পর্যন্ত পৌছাতেই সে ভড়কে যায়। দ্রুত পিছে ঘুরতে নিলেই সারা শরীরে ক্ষত গুলো কামড়ে ধরে তাঁকে। সে ধীরে সুস্থে পিছে ঘুরে আমায় জিজ্ঞেস করে,

— আরেহ কাঁদছো কেন? এতক্ষণ তো ঠিকই ছিলে।

আমি কিছু না বলে তাঁর বুকে মাথা রেখে সশব্দে কেঁদে দেই। এতে রোয়েন যেন দ্বিতীয় বারের মত ভড়কে যায়। অতঃপর নিজেকে সামলে আমায় তাঁর বা হাত দিয়ে আগলে নিয়ে বলেন,

— কি হলো? কাঁদছো কেন?

আমি ফুঁপিয়ে উঠে বলি,

— জানি না।

— খারাপ লাগছে?

আমি নাক টানতে টানতে বলি,

— জানি না।

— কি হয়েছে বলো তো?

— জানি না।

রোয়েন এইবার কিঞ্চিৎ হেসে বলে,

— তাহলে জানোটা কি?

আমি অকপটে উত্তর দেই,

— জানি না। কিছু জানি না আমি।

রোয়েন উত্তর শুনে কিছু না বলে স্মিত হাসে। কিন্তু কিছু বলে না। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আমি বলি,

— বাইক ঠিক মত চালাতে পারেন না? দেখেছেন সারা শরীরে কত ক্ষত?

রোয়েন অকপটে জিজ্ঞেস করে বসে,

— আমাকে এইভাবে দেখে তোমার কষ্ট হচ্ছে?

কথা শ্রবণ হওয়া মাত্র আমি কিছুটা মিইয়ে যাই। মিনমিনে গলায় বলি,

— জানি না।

আমি উত্তর শুনে রোয়েন তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে। উদাসীন গলায় বলে,

— আমি তোমার কে হই যে তুমি আমায় এইভাবে দেখে কষ্ট পাচ্ছো?

কথাটা কর্ণধার পর্যন্ত পৌঁছাতেই আমি স্থির হয়ে যাই। গুটিকয়েক বার একটানা চোখের পাপড়ি ফেলে নির্লিপ্ত গলায় উত্তর দেই,

— জানি না।

রোয়েন কিঞ্চিৎ হেসে স্বাভাবিক কন্ঠে বলেন,

— বাইক চালাতে গেলে এমন টুকিটাকি এক্সিডেন্ট হয়ই। এর আগেও দুই-একবার এমন এক্সিডেন্ট করেছি। ব্যাপার না।

আমি কিছু না বলে কাঁদতে থাকি। উনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন,

— সে কি জানে? তার চোখের জল যে আমার কাম্য নয়। তার চোখের জল ব্যথিত করে আমায়। মুহূর্তেই ছন্দছাড়া করে ফেলে?

কথাটা শুনে আমি নিরব হয়ে যাই। আমি নিরবতা দেখে উনি পুনরায় বলেন,

— সকলের জন্য কিন্তু চোখের পানি ঝরে না আর যার জন্য ঝরে সে হয় অতি ভাগ্যবান। তাহলে কি আমি ধরে নিব আমি ভাগ্যবান?

আমি এইবার রোয়েন কাছ থেকে সরে এসে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলি,

— পিছে ঘুরুন, মলম লাগানো বাকি আছে আমার।

রোয়েন তাঁর বা হাতের তর্জনী উঁচু করে সপ্তপর্ণে আমার ফোলা চর্বিযুক্ত গালের উপর গড়িয়ে পড়া তপ্ত পানির কণাগুলো মুছে দিয়ে বলেন,

— কান্নায় নয়,হাসিতে মানায় তাকে।

মুহূর্তেই ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে কিঞ্চিৎ হাসি।

__________________

রাত তখন কয়টা বাজে জানি না। আমি বিছানায় বসে দেয়ালে মাথা রেখে ঝিমুচ্ছি। রোয়েনের কিছু লাগতে পারে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জেগেই থাকবো আজ। কিন্তু কখন যে চোখ লেগে আসে বুঝতেই পারিনি। ঘুম যখন একটু গাঢ় হয়ে আসতে নিলো তখনই কেউ আমায় টানছে। প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও ক্ষণেই রোয়েনের কথা টনক নাড়তে ঘুম ছুটে যায় আমার। আমি তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে তাকাই। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় বুঝতে পারি রোয়েন আমার একবাহু ধরে রেখেছে। আমি চট জলদি জিজ্ঞেস করি,

— কিছু লাগবে আপনার? ওয়াশরুমে যাবেন? ব্যথা করছে কোথাও? ঘুমাতে অসুবিধা হচ্ছে?

রোয়েন ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন,

— না।

— তাহলে?

— তুমি এভাবে বসে ঝিমাচ্ছো কেন? শুয়ে পড়ো।

কথাটা শ্রবণ হওয়ার পর আমি কিছুক্ষণ তাঁর পানে চেয়ে থাকলাম। অতঃপর ঘটনাক্রমে বুঝতে পারলাম উনি তাঁর এক হাত দিয়ে ঘুমন্ত আমিটাকে শুয়ে দেওয়ার বৃথা করছিলেন। কথা বুঝার পর ঠোঁটের কোনে সরু হাসির রেখা ফুটে উঠে৷ আমি নরম সুরে বলি,

— নিজেই আমাকে শুয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তাই তো?

কথাটা বলা মাত্র রোয়েন থমথম খেয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বলে,

— এইভাবে থাকলে সকালে পিঠ ব্যথা তো আমার না তোমার করবে। তখন সেবা কিভাবে করবে আমার?।

আমি কিঞ্চিৎ হেসে বলি,

— নিজে অসুস্থ হয়েও আমায় আগলে রাখার চেষ্টা করছেন? কিন্তু কেন?

রোয়েন আমার দিকে সরল চাহনিতে চেয়ে বলে,

— কে বলেছে আমি তোমায় আগলে রাখছি?

— তো কাকে রাখছেন?

— শুনেছি, স্বামীর বা পাজারের হাড় দিয়ে নাকি স্ত্রী তৈরি। তো সেই হিসাবে, আমি তো আমার আমিটাকেই আগলে রাখছি। তোমাকে না।

কথাটা শোনামাত্র ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে মিষ্টি হাসি। মনে এসে ভীড় করে এক রাশ মুগ্ধতা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here