নিভৃতে_যতনে Part_29,30

0
1639

নিভৃতে_যতনে
Part_29,30
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_29

গোধূলির লগ্ন। পশ্চিমাকাশে ছেঁয়ে আছে হলদেটে ভাব। পাখিরা ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটে চলেছে আপন নীড়ে। আমি বারান্দায় রাখা বেতের মোড়ার উপর বসে আছি। হাতেই ধোঁয়া উঠানো এক কাপ কফি। দৃষ্টি নিবদ্ধ কমলা রাঙ্গা ডুবন্ত সূর্যটির দিকে। কফির কাপে একটু চুমুক দিতেই কোথ থেকে এক জোড়া চড়ুই পাখি এসে বসে বারান্দার কার্নিশে। ক্ষণেই বাতাসে কিচিরমিচির শব্দ তুলে মেতে উঠে খুনসুটিতে। তাদের দেখা মাত্র আমি নিরব হয়ে যাই। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকি তাদের। অতঃপর আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই চোখ আটকে যায় বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখা রোয়েনের একটি টি-শার্টের দিকে। টি-শার্টটি দেখা মাত্র চোখে ভেসে উঠে রোয়েনের চেহেরা। সেইসাথে মনে পড়ে যায় চৈত্র মাসের অনাকাঙ্ক্ষিত সেই বর্ষণের রাতের কথা। মুহূর্তেই আমার চর্বিযুক্ত গাল দুইটি হয়ে উঠে রক্তিম লাল। লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলি আমি। চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস নেই।

সেদিন রোয়েনের এহেন প্রস্তাবে আমি ক্ষনিকের জন্য ভড়কে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরমুহূর্তেই লজ্জায় মিইয়ে গিয়েছিলাম। গা মৃদু পরিমাণে কাঁপছিল আমার। যেখানে আমার বিভ্রান্তিতে পড়ার কথা সেখানে সপ্তপর্ণে মুখ লুকিয়ে ছিলাম তাঁর বুকে। তাঁর বুকে মাথা রাখতেই যেন এক আলাদা প্রশান্তি অনুভব করি। সেই সময় আমার মধ্যে না ছিল কোন সংশয়, না ছিল কোন আড়ষ্টতা। ছিল এক অদ্ভুত ভালোলাগা। কোন এক অদৃশ্য কারণে তাঁকে আমি কখনো ‘না’ করতে পারি না, সেইদিনও পারিনি৷ নীরবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলাম তাঁর মাঝে। সাঁই জানিয়েছিলাম তাঁর প্রস্তাবে। অতঃপর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত বর্ষণের অনাকাঙ্ক্ষিত সেই প্রহরে পূর্ণতা পেয়েছিল আমাদের সম্পর্ক। রচিত হয়েছিল নতুন এক জীবনের সূচনা।

হঠাৎ চারদিকে মাগরিবের আযান প্রতিধ্বনিত হতেই আমি উঠে রুমে চলে আসি। ওযু করে মাগরিবের নামাজ আদায় করে রোয়েনের জন্য এক সেট কাপড় বিছানায় রেখে চলে যাই রান্নাঘরে। এক কাপ কফি চুলোয় চড়িয়ে দেই রোয়েনের জন্য। কফি যখন প্রায় হয়ে এসেছে ঠিক তখনই ডোরবেল বেজে উঠে। পলি আন্টি গিয়ে দরজা খুলে দেয়। অতঃপর রোয়েন রুমে চলে যেতেই পলি আন্টি নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে আমায় বলে চলে যায়। আমি দরজাটা আটকে এসে কফিটা কাপে ঢেলে নেই। অতঃপর অগ্রসর হই রুমের দিকে। রুমে আসতেই দেখি রোয়েন মাত্র ফ্রেশ হয়ে বের হচ্ছেন। আমি তাঁর দিকে এক পলক তাকাতেই দৃষ্টি নত করে ফেলি। সেদিনের পর থেকে তাঁর দৃষ্টির সামনে আসতেই লজ্জা আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। তাঁর দিকে দৃষ্টি স্থির রাখাটাই দুষ্কর হয়ে পড়ে আমার জন্য। এই যে যেমন এখন হচ্ছে। আমি কফির কাপটা সাইড টেবিলের উপর রেখে চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পা চালাতে শুরু করি। এর মাঝেই ডান বাহুতের গভীর টান অনুভব করতে সামনে দিকে এগোনোর বদলে কয়েক কদম পিছিয়ে আসি। আমি কিছু বলতে যাবো তাঁর আগে রোয়েন গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠেন,

— দুইদিন ধরে খেয়াল করছি তুমি আমায় এড়িয়ে চলছো, সমস্যা কি?

আমি কম্পিত কন্ঠে বলি,

— কোথায় এড়িয়ে চলছি?

— তা না হলে এখন কি করছো?

আমি তাঁর দিকে কিছুটা ঘুরে হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে বলি,

— আরেহ ধুর! ছাড়েন তো, পড়া আছে আমার।

রোয়েন ভ্রু কুঁচকে বলেন,

— এই কয়েকমাসে একবারও তো ঠিক মত বই ধরতে দেখলাম না আর আজ বলছো পড়া আছে?

আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলি,

— আজ আছেই বলেই বলছি।

— অজুহাত দিয়ে কাটিয়ে দিতে চাইছো বিষয়টা?

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলি,

— তেমন না বিষয়টা?

রোয়েন আমার হাতের কব্জি ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে দাঁড় করালেন। মুখোমুখি হয়ে বললেন,

— তাহলে কেমন? এড়িয়ে কেন চলছো আমায়?

আমি কিছু না চুপচাপ দৃষ্টি নত করে দাঁড়িয়ে থাকি। আনমনে তাঁর ছুটে পালানোর রাস্তা খুঁজতে থাকি। রোয়েন কিছুক্ষণ উত্তরের আশায় আমার মুখ পানে তাকিয়ে থাকেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন আমার আকার-ভঙ্গি। অতঃপর স্বাভাবিক সুরেই বলেন,

— তুমি আমার সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছো?

আমি মাথা নুইয়ে বলি,

— হুম।

রোয়েন এইবার নিঃশব্দে হেসে উঠে। হাসির দুই ধারে বেরিয়ে আসে গজদাঁত দুইটি। বরাবরের মতই অমায়িক সেই হাসিটি৷ আমি একপলক সেই হাসির দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেলি। সে কি জানে? তাঁর এই হাসিতে আমি বারংবার খুন হই? হঠাৎ রোয়েন নিজের হাতের তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকের মাঝ দিয়ে আমার থুতনি চেপে ধরে মুখটা উঁচিয়ে রসিকতা সুরে বলেন,

— আমি তো তাঁর লজ্জা ভেঙ্গেই দিয়েছি তাহলে সে এত লজ্জায় পায় কিভাবে?

কথাটা শোনা মাত্র আমি রোয়েনের বুকে মুখ লুকিয়ে বলি,

— জানি না।

রোয়েন হেসে ফিসফিসিয়ে বলেন,

— লজ্জা পেলে কিন্তু তাকে চ্যারির মত লাগে। ইচ্ছে করে…

আমি তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই ছিটকে সরে দাঁড়াই। স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠি,

— দিন দিন নির্লজ্জ হচ্ছেন আপনি।

রোয়েন পুনঃরায় নিঃশব্দে হেসে উঠেন। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসতে বসতে বলেন,

— যার বউ এত লজ্জা পায় তার বরকে তো না চাইতেও নির্লজ্জ হতেই হয়।

__________________

কালকে পহেলা বৈশাখ। সেই উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়াম খুব সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে। সকলের মধ্যে কাজ ভাগ করে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন টিচাররা। কমনরুমে চলছে গান ও নাচের রিহার্সাল। চেয়ার সাজানোর দায়িত্ব পড়েছে ইফতি,নূরের উপর আর আলপনা করার দায়িত্ব পড়েছে আমার উপর। স্নেহা আর আদিবকে ম্যাম বাহিরে পাঠিয়েছে কি যেন এক কাজে। এইদিকে কাজ করতে হবে বলে সুরাইয়া আগে ভাগেই অসুস্থতার বাহানা দিয়ে ভেগেছে। আস্ত কামচর একটা। আমি আনমনে আলপনা করছি তখন দূর থেকে ইফতি চেঁচিয়ে বলে,

— ওই সিয়া! তোর ফোন বাজতাসে।

আমি চকিত দৃষ্টি ইফতির দিকে তাকিয়ে বলি,

— আমার ফোন কি তোর কাছে?

ইফতি আমার ব্যাগ উঁচিয়ে বলে,

— হো। আলপনা করার আগে না তুই আমাকে দিয়ে গেসিলি৷

আমি আলপনা ঠিক করতে করতে বলি,

— তাইলে মোবাইলটা এইদিকে নিয়ে আয়। এখন উঠতে পারবো না।

ইফতি ফোন বের আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,

— ওই মাইয়া! এই ‘খারুশ’ কেডা? দশবারের উপরে ফোন দিসে তোরে।

কথাটা কর্ণধার পর্যন্ত পৌঁছাতে দেরি কিন্তু আমার লাফ মারতে না। মূহুর্তেই আমি ভড়কে গিয়ে বলি,

— কয়বার ফোন দিসে?

ইফতি আমার দিকে ফোনটা এগিয়ে বলে,

— কানে কি কম শুনোস? বলসি না একবার?

আমি ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকি। অতঃপর উঠে রঙ লাগানো হাতেই ইফতির পিঠে ধুপধাপ দুইটা কিল মেরে বলি,

— এতবার ফোন আসার পর তুই এখন এসে বলছিস আমার ফোন এসেছে? তোকে রাখতে দিসিলাম কেন ফোন তাইলে আমি? কানে আমি কম শুনি না তুই?

ইফতি নিজের পিছনের শার্টের অংশটুকু টেনে সামনে এনে ধরে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,

— এইটা কি করলি তুই? দুইদিন আগেই শার্টটা নামাইসিলাম। ঘামের গন্ধও লাগে নাই ঠিক মত শার্টে তার আগেই তুই এইটা নষ্ট করে দিলি? আল্লাহ গজব ফালাইবো তোর উপরে দেখে নিস।

আমি বিরবির করে বলি,

— আমার উপরে যে এখন কোন গজব পড়বো আল্লাহই জানে।

এর মাঝে নূর এসে বলে,

— কি বিরবির করছিস?

আমি চোখ মুখ বিরক্তি ঘুচে বলি,

— আন্ডা বলছি। বলবি তুই আমার সাথে?

নূর এইবার স্মিত হেসে বলে,

— ওইদিকে শোরগোল বেশি ছিল তাই হয়তো শুনে নাই ওই। এত প্যারা কেন নিচ্ছিস?

আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই আমার ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে ভেসে উঠে ‘খারুশ’ নামটি। আমি কিছু না বলে ওদের থেকে সরে এসে ফোনটা রিসিভ করতেই উনি গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,

— ফোন কই থাকে তোমার? কয়বার কল দিয়েছি দেখেছো?

আমি আমতা আমতা করে বলি,

— খেয়াল করি নি।

— বাইরে এসো।

আমি অকপটে জিজ্ঞেস করে উঠি,

— কেন?

— আসতে বলেছি আসবে। কোন কথা না আর সন্ধ্যা কয়টা বাজে সেই খেয়াল আছে কি তোমার?

আমি একবার ফোনে সময় দেখে নিলাম। সাড়ে ছয়টার মত বাজে। তা দেখামাত্র আমি বিনয়ী সুরে বলি,

— কাজ করছিলাম তাই খেয়াল ছিল না। হাতের কাজটা সেরেই আমি দ্রুত আসছি৷

— হারি আপ!

কথাটা বলেই তিনি ফোন কেটে দেন আর আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি। ভেবেছিলাম মহাপ্রলয় শুরু হবে কিন্তু তা হয়নি। আমি দ্রুত নিজের কাজটা শেষ করে হাত না ধুয়েই ইফতি আর নূরকে বলে চলে আসি বাইরে। গেটের বাইরেই আসতে দেখি রোয়েন বাইকের সাথে হেলান দিয়ে পা দুইটি আড়া-আড়িভাবে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি তার নিবদ্ধ মুঠোফোনের উজ্জ্বল স্ক্রিনের দিকে। আমি নিঃশব্দে তাঁর দিকে এগিয়ে যাই। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে হালকা কেশে উঠতেই তিনি আমার দিকে চোখ তুলে তাকান। আমি স্মিত হেসে বলি,

— হঠাৎ এইদিকে আসলেন যে?

রোয়েন নিজের মুঠোফোন বন্ধ করে পকেটে ভরতে ভরতে বলেন,

— একটা মেয়েকে লিফট দিয়েছিলাম এইদিকটায়। তো তাকে নামিয়ে যাওয়ার পথে ভাবলাম তোমায়ও লিফট দেই।

কথাটা শোনামাত্র আমার ঠোঁটের কোনে ঝুলে থাকা হাসিটি উধাও হয়ে গেল। চোখে-মুখে নেমে এলো অন্ধকার। আমি চোখ মুখ শক্ত করে বলি,

— বাজে বকা বন্ধ করুন।

রোয়েন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলেন,

— কি বাজে বকলাম?

আমি মুখ ঘুরিয়ে অভিমানী সুরে বলি,

— কিছু না। আর আপনি চলে যান চাই না আপনার লিফট আমি। একাই চলে যেতে পারবো আমি।

— তা তো হচ্ছে না। আমি যেহেতু এসেছি সেহেতু যেতে তো তোমায় আমার সাথেই হবে।

আমি নাকছ করে বলি,

— যাব না আমি।

— তোমার থেকে কেউ তোমার মতামত চায়নি।

কথাটা বলে তিনি আমার হাতের কব্জি ধরে টান দিতেই তাঁর নজরে পড়ে বিভিন্ন রঙে মাখা আমার হাতটি। তা দেখে তিনি বলেন,

— হাত ধুয়ো নি কেন?

আমি স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠি,

— ইচ্ছা।

রোয়েন কিছু না বলে বাইকের সিট উঠিয়ে ভিতর থেকে পানির বোতল বের করে আমায় টেনে নিয়ে যায় রাস্তার ধারে। নিজেই খুব সপ্তপর্ণে ধুয়ে দেন আমার হাত। আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি। কেন যেন সবকিছুই আমার অসহ্য লাগছে। আমার হাত ধুয়ে দিয়ে তিনি আমায় টেনে নিয়ে নিজের বাইকের কাছে নিয়ে যান। আগে নিজে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দিয়ে আমায় উঠে বসতে বলেন। আমি বিনাবাক্যে উঠে পড়ি তার বাইকে। টু শব্দ পর্যন্ত করিনা। কারণ জানি সে যে পরিমাণে ঘাড়ত্যাড়া আমাকে না নিয়ে সে যাবেই না। কিন্তু তাই বলে নিজের অভিমান ফেলে দেইনি আমি। তাঁর থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে চুপটি মেরে বসি যাতে তাঁর শরীরের সাথে আমার স্পর্শ না লাগে। রোয়েন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যখন দেখলেন আমি তাঁকে ধরছি না তখন তিনি নিজেই তাঁর হাত পিছিয়ে নিয়ে আমার হাত দুইটি টেনে নিজের পেটের দুই পাশে রাখলেন। আমি হাত সরিয়ে নিতে গেলে তিনি আমার হাত দুটি চেপে ধরে বলেন,

— আমার ব্যক্তিগত বাইক ছোঁয়ার উঠার অধিকার শুধুমাত্র আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটার আছে। এর বাইরে কল্পনাতেও আমার বাইকে উঠার সাধ্য কারো নেই।

কথা বলেই তিনি একটানে বাইক চালাতে শুরু করেন। রোয়েনের কথা শুনা মাত্র আমার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে মিষ্টি হাসি। আমি জানি মানুষটা কেমন। যে নাকি কখনোই কোন মেয়েকে নিজের কাছেও ঘেষতে দেয় না সে আবার লিফট দিবে অন্য কোন মেয়েকে? প্রশ্নই আসে না। কিন্তু ওই যে বাঙালি নারীর মন। আপন মানুষটার মুখে অন্য কোন মেয়ের কথা উচ্চারিত হতে না হতেই নিখিল জাহানের সকল ঈর্ষা এসে ভর করে তখন। বড্ড অভিমান জাগ্রত হয় তখন মনের মাঝে৷ অতঃপর যতক্ষণ না আপন মানুষটি অভিমানটি ভাঙ্গাচ্ছে ততোক্ষণ পর্যন্ত অভিমান প্রগাঢ় হতেই থাকে। রোয়েন জানতো আজ আমার বাসায় যেতে রাত হবে তাই তো সে নিজে এসেছেন আমায় নিতে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে মানুষটা প্রচন্ড ক্লান্ত। অথচ তিনি বিনা বিরক্তি প্রকাশ করে ক্লান্ত শরীরটাই টেনে নিয়েই এসে হাজির হয়েছেন আমার সামনে। আসলেই মানুষটা আমার নির্মল প্রেমিক। আমি নিঃশব্দে খানিক্ষন হেসে তাঁর পেট জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা এলিয়ে দেই৷ এইটাই আমার নির্ভরতার সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান। আমি নয়ন দুইটি বন্ধ করে নিতেই রোয়েন বলে উঠেন,

— অভিমানিনী কে অভিমানেই ভালো মানায়।

চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_30
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

প্রকৃতি আজ বৈশাখের রঙে মাতোয়ারা।বৈশাখ মানেই প্রকৃতিতে বিরাজমান সুন্দর সুবাসে ভারী হওয়া।নতুন রঙে মেতে উঠা হাজারো প্রেমিযুগলের ভীড়ে ঠাসা। আনন্দে উচ্ছ্বাসিত প্রাণবন্ত ঢাকার আনাচেকানাচে।কৃষ্ণচূড়ায় বিলীন হওয়া রাস্তা-ঘাটের নতুন রুপ। আমি তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে বৈশাখের আগমণ বিভোর চোখে উপলব্ধি কর‍তে ব্যস্ত আর রোয়েন দূর থেকে আমাকে দেখতে ব্যস্ত যা আমার ষষ্ঠইন্দ্রীয় জানান দেওয়ার সাথে সাথেই লজ্জায় লালাভ হয়ে উঠি। দ্রুত তোয়ালেটা বারান্দায় মেলে তৈরি হওয়ার জন্য তোড়জোড় লাগিয়ে দেই। এমন ভাণ ধরি যেন রোয়েন নামক কোন ব্যক্তিকে আমি উপলব্ধিই করতে পারছি না। তাঁর অস্তিত্ব রুম জুড়ে কোথাও নেই। অনেকটা সময় চলে যাওয়ার পরও যখন আমার ষষ্ঠইন্দ্রীয় জানান দেয় রোয়েন এখনো আমার পানে তাকিয়ে আছে তখন আমি স্বগতোক্তি কন্ঠে বলি,

— আপনার পাঞ্জাবী বিছানায় রাখা আছে। রেডি হয়ে নিন।

কথাটা বলে আমি রোয়েনের উত্তরের অপেক্ষা না করে মেকাপ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ক্ষণেই ওয়াশরুমের দরজা লাগানোর আওয়াজ শ্রবণ হতেই হাফ ছেড়ে বাঁচি আমি। অতঃপর মনোযোগ দেই নিজের কাজে। আমি শাড়ির আঁচলটা টেনে নিতেই রোয়েন রেডি হয়ে বেরিয়ে আসেন। রোয়েনের দিকে তাকাতেই দুইজনের দৃষ্টি একে অপরের দিকে নিবদ্ধ হয়ে যায়। ক্ষণেই আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে কুঁচি করার দিকে মনোযোগ দেই। কিছু প্রথর অতিক্রম হতেই রোয়েন ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসেন। কিছু না বলে চুপচাপ আমার সামনে এসে হাটু ভাঁজ করে বসেন আর আলতো হাতে আমার কুঁচিগুলোর দায়িত্ব নিয়ে নেন। তা দেখা মাত্র আমার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে তৃপ্তির হাসি। মুখে প্রকাশ না করলেও আমি মন থেকে এইটাই চাইছিলাম আমি। শাড়ি পড়ার পিছনের মূল কারণ যে রোয়েনই।

শাড়ি পড়া শেষে আমি চটজলদি লিপস্টিকের প্রলেপ ওষ্ঠদ্বয়ের উপর ছড়িয়ে দিয়ে আয়নাতে একবার নিজেকে দেখে নেই। হলদেটে ফর্সা গায়ে লাল পাড়ের অফহোয়াইট জামদানী শাড়ি জড়ানো। মুখে কৃত্রিম সাজ আর চুলগুলো খোপা করা। দুই হাত ভর্তি রক্তিম লাল রেশমি চুড়ি। খারাপ লাগছে না। ভালোই লাগছে দেখতে। আমি পিছন দিয়ে শাড়ির আঁচলটা টেনে সামনে এনে রোয়েনের দিকে ঘুরে দাঁড়াই। পড়নে তাঁর সাদা আর লাল মিশ্রণের একটি পাঞ্জাবী আর সাদা পায়জামা। চুলগুলো ব্রাশ করে সাইড করা। উনি বিছানার উপর বসে নিজের হাতে সিলভার কালারের চেইন ঘড়িটা পড়ছেন। তাকে ঘড়ি পড়তে দেখে হঠাৎ টনক নাড়ে। আমি দ্রুত পায়ে নিজের কাবার্ডের দিকে এগিয়ে যাই। কাবার্ড খুলে ভিতর থেকে সেই কালো রঙের ঘড়ির বক্সটা বের করি৷ বক্সটা নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যাই রোয়েনের দিকে। উনার সামনে এসে দাঁড়াতেই রোয়েন চোখ তুলে আমার দিকে তাকায়। আমি ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বক্সটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলি,

— দেখেন তো, আপনার ভালো লাগে কি-না?

রোয়েন বক্সের দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বক্সটা হাতে নেন। অতঃপর জিজ্ঞেস করেন,

— এইটা তুমি কবে কিনলে?

আমি ইতস্তত সুরে বলি,

— অনেক আগেই কিনেছিলাম।

রোয়েন আর কিছু না বলে মুহূর্তেই নিজের হাতের ঘড়িটা খুলে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলেন,

— দিয়েছ তুমি, পড়িও দিবে তুমি।

আমি তৃপ্তির হাসির হেসে বক্স থেকে ঘড়িটা বের করে সপ্তপর্ণে তাঁর বা হাতে ঘড়িটা পড়িয়ে দিলাম। সোজা নরম সুরেই বললাম,

— এইবার চলুন, আমি রেডি।

রোয়েন আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন,

— কাজল পড়ো না তুমি?

আমি মাথা হেলিয়ে বলি,

— না। কখনো পড়া হয়নি আরকি।

রোয়েন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেন,

— মায়াবী চোখে কাজলের স্পর্শ হলে কাজল সার্থক হতো।

কথাটা বলে তিনি বেরিয়ে যান রুম থেকে। আমি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যাই ডেসিং টেবিলের সামনে। কাজলের কোটা বের করে সপ্তপর্ণে তা চোখে লাগিয়ে নেই। তাঁর কথা ফেলার সাধ্য আমার নেই৷ একদমই নেই।

_______________________

“এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।”

ভার্সিটির প্রাঙ্গনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে গানটি। চারদিকে আজ শুভ্র আর লাল রঙের ছড়াছড়ি। উচ্ছাসে পরিপূর্ণ পরিবেশ৷ রোয়েন আমায় ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। তাঁর নাকি কিছু কাজ আছে সেটা শেষ করে তিনি পড়ে আসবেন। আমি তাতে সম্মতি জানিয়ে চলে আসি ভিতরে। ভিতরে এসেই ফোন দেই স্নেহাকে জানার জন্য ওরা কোথায়। স্নেহা জানায় তারা হাকিম চত্তরের পাশেই আছে আমিও যাতে সেখানেই এসে পড়ি। ক্ষণিকেরই মাঝেই হাকিম চত্তরে এসে হাজির হই আর বন্ধুমহলের মাঝে ঢুকে পড়ি। সবাই আজ আগে ভাগেই এসে পড়েছে। শুধু আমারই দেরি হয়ে গিয়েছে। যার ফলে সকলে মিলে আমার গায়ে ‘লেটলতিফ’ তকমা লাগিয়ে দেয়। আমি মুখ ভোতা করে বসে আছি তা দেখে ইফতি রসিকতা সুরে বলে উঠে,

— নাকের সাথে কি এখন চেহেরাও ভোতা বানানোর উদ্যোগ নিয়েছিস নাকি?

পাশ দিয়ে স্নেহা বলে উঠে,

— উদ্যোগ নিলেই কি আর উদ্যোক্তা হওয়া যায়? এর জন্য বুকের পাটা লাগে বুঝছিস।

আদিব স্নেহাকে খোঁচা মেরে বলে,

— চাইলেই কি আর মেকাপ ছাড়া বিশ্ব সুন্দরী হওয়া যায়? এর জন্যও বুকের পাটা লাগে বুঝেছিস?

আদিবের কাকে মিন করে কথাটা বলেছে তা বুঝতে পেরে মুহুর্তেই সকলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে আমিও হেসে উঠি। স্নেহা মাত্রাতিরিক্ত মেকাপ করেই বলে আদিব কথাটা স্নেহাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে। এইদিকে স্নেহা আদিবের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ধুপধাপ ওর পিঠে কিল বসিয়ে দিয়ে বলে,

— কুত্তা তুই কি বুঝবি মেকাপের মর্ম? মেকাপ একটা আর্ট বুঝেছিস, একে সম্মান করতে শিখ। নাইলে কপালে বউ জুটবো না।

আদিব নিজের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

— এমন ডাইনি মার্কা বউ আমি চাইও না। হুহ!

সুরাইয়া রসিকতা করে বলে,

— তো কেমন বউ চাস তুই? পেত্নীর মত?

আদিব কিছুক্ষণ চুপ থেকে নূরের দিকে তাকিয়ে বলে,

— নূরের মতো।

নূর তখন কোক খাচ্ছিল। আদিবের এহেন কথা শুনে ও মুখ থেকে ফিক করে কোকটা মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। অবাকে সে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। এইদিকে নূরের নাম শুনে সকলেই হই হই করে উঠি। নূর আর আদিবের লেগ পুল করতে শুরু করলে আদিব ভড়কে উঠে বলে,

— আরেহ আমি হূর বলেছি। হূর! নূর না। কানে বেশি শুনোস নাকি তোরা?

আদিবের এমন পল্টি খাওয়া দেখে সবাই হেসে ফেলি। এই বিষয় নিয়ে কেউ আর কথা বাড়াই না। অন্য এক টপিক নিয়েই আড্ডা আবার জমজমাট হয়ে উঠে৷ অডিটোরিয়ামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চললেও বেশিরভাগ সকলেই এইদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করছে আর আড্ডা দিচ্ছে।

________________________

ঘন্টা খানিক পর আমার মুঠোফোনটা বেজে উঠে। রোয়েন ফোন করেছেন। আমি সকলকে চুপ থাকতে বলে ফোনটা রিসিভ করি। নরম সুরে বলি,

— এসেছেন?

রোয়েন স্বাভাবিক কন্ঠেই বলেন,

— হুম। তুমি কোথায় আছো এখন?

— হাকিম চত্তরের পাশেই আছি। আপনি এইদিকটায় এসে পড়েন।

উনি ছোট করে “আচ্ছা” বলে ফোন কেটে দেন। আমি কান থেকে ফোন রাখতেই বুঝতে পারলাম কয়েক জোড়া উৎসুক চোখের দৃষ্টি আমার দিকেই নিবদ্ধ হয়ে আছে। আমি সকলের দিকে তাকাতেই ইফতি ক্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে বলে,

— কি ব্যাপার মামা? এই আপনিটা কে?

সুরাইয়া পাশ থেকে বলে উঠে,

— কাকে আসতে বলসোস তুই?

আমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে বলি,

— আসলেই দেখতে পাবি।

নূর ফট করে জিজ্ঞেস করে উঠে,

— বিএফ তোর?

আমি কিছু বলার আগেই স্নেহা ফোড়ন দিয়ে বলে,

— এখনকার দিনে বিএফকে কেউ আপনি বলে? সিনিয়র কোন আত্মীয় হবে হয়তো।

ওদের কথা শুনে আমি ঠোঁট টিপে হাসতে থাকি। এরা সকলেই যে আজ চারশো বিশ ভোল্টের শখ খাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেন না তাদের যে আমার বলা হয়নি আমি বিবাহিত। আমাকে এইভাবে মিটিমিটি হাসতে দেখে আদিব সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলে,

— তোর কি কোন টিচারের সাথে সেটিং মেটিং চলতাসে দোস্ত? হইলে বল আমি তোরে সাপোর্ট করুম।

আমি আমার হাতে থাকা খালি পানির বোতল আদিবের দিকে মেরে বলি,

— ওই ইফতি আমার পক্ষ থেকে ওকে চার-পাঁচটা থাপ্পড় মার তো। নাইলে আজ ওই আমার হাতে খুন হইবো।

আদিব বোতল ক্যাচ করে বলে,

— হাইপার হোস কেন? মজা করতাসি শুধু।

আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই আমার মুঠোফোন বেজে উঠে। রোয়েন আবার ফোন করেছেন। ফোন রিসিভ করতেই তিনি বলে উঠেন,

— কোথায় তুমি?

আমি বসা দাঁড়িয়ে যাই। চারপাশে চোখ বুলিয়ে রোয়েনকে খুঁজতে থাকি। বেশ কিছুক্ষণ পর তাঁকে পেয়েও যাই। তাঁকে দেখা মাত্র আমার রাগ উবে যায়। ঘামের কারণে সাদা পাঞ্জাবী কিছুটা লেপ্টে আছে শরীরের সাথে। চোখে মুখে কিছুটা বিরক্তি। আমি শীতল দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলি,

— আপনার বাম দিকটায় তাকান।

কথাটা বলেই হাত উঁচিয়ে জানান দেই আমি এইখানে। রোয়েন আমাকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেন। অতঃপর ফোন কেটে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকেন। আমাকে এইভাবে হাত উঁচিয়ে থাকতে দেখে সকলেই পিছনে তাকায়। শ্যাম বর্ণের এক যুবককে তাদের দিকে আসতে দেখে সকলের ভ্রু কুঁচকে আসে। সুরাইয়া আমার হাতের কব্জি টেনে বলে,

— এই ছেলেটা কে? আমি এর আগে বেশ কয়েকবার তাকে দেখেছি তোকে কচিং এ ড্রপ করে যেতে। জিজ্ঞেস করবো করবো আর করা হয়নি।

স্নেহা রোয়েনের দিকে তাকিয়ে বলে,

— এই ছেলে কি তোর কোন কাজিন ব্রাদার? মানে দূরসম্পর্কের কোন ভাই টাই? হলে একটু রাস্তা ক্লিয়ার করে দেয়। এর উপর বড়সড় মাপের ক্রাশ খাইসি আমি।

আদিব খোঁচা মেরে বলে,

— ক্রাশ ইকুয়াল টু লম্বা বাঁশ। সো বি কেয়ারফুল।

স্নেহা অগ্নি দৃষ্টিতে আদিবের দিকে তাকাতেই আদিব অন্য দিকে তাকিয়ে এইটা সেটা দেখতে থাকে। যেন সে কিছুই বলে নি। এইদিকে স্নেহার কথা শুনে আমি ফুঁসে উঠে। রাগে গা জ্বলছে আমার। আমার জামাইকে পটানোর জন্য আমার কাছেই সাহায্য চায়। মনটা তো চাচ্ছে ধরে বুড়িগঙ্গায় চুবিয়ে মারি। নিজেকে কোনমতে সংযত করতেই স্নেহা আবার বলে উঠে,।

— ওই বল না ছেলেটা তোর কি হয়?

আমি কটমট দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলি,

— জামাই ভাই হয় আমার।

আমার উত্তর শুনে স্নেহার সাথে সবার মুখ হা হয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সকলেই। বিস্ময় কাটিয়ে নূর বলে উঠে,

— চাচাতো,মামাতো,কাকাতো,পাতানো ভাইয়ের নাম শুনসি কিন্তু এই জামাই ভাই আবার কেমন ভাই?

আমি গম্ভীর কন্ঠে বলি,

— উনি আসুক বুঝতে পারবি।

কথাটা বল মাত্র রোয়েন আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমি তাঁর দিকে একবার তাকিয়ে সপ্তপর্ণে তাঁর হাত জড়িয়ে ধরি। অতঃপর সকলের দিকে তাকিয়ে বলি,

— মিট মাই হাসবেন্ড আদনাফ জুহায়র রোয়েন।

কথাটা শোনা মাত্র সকলে চোখ গোলগোল হয়ে আসে। বিস্ময়ে তাদের ঠোঁট যুগলের মাঝে সৃষ্টি হয় কিঞ্চিৎ ফাঁক। স্নেহার চেহেরা তো দেখার মত। বেচারি আসলেই ক্রাশের সাথে বাঁশ খেল। সকলের এমন প্রতিক্রিয়া দেখে আমি ফিক করে হেসে দেই। এইদিকে রোয়েন এত জোড়া চোখের কেন্দ্রবিন্দু হতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। আমি কিছুক্ষণ হেসে সকলকের বিভ্রান্তি দূর করি। সব শুনে ওরা কিছুক্ষণ আমায় বকে টকে রোয়েনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

____________________

আমি বিছানায় বসে ফিন্যান্সের থিওরেটিকাল চ্যাপ্টার গুলো পড়ছি। পাশেই রোয়েন ল্যাপটপে অফিসের কিছু কাজ করছে। হঠাৎ পড়তে পড়তে আমি আনমনা হয়ে যাই। আজ বৈশাখ মাসের সাত তারিখ হলেও মন গিয়ে স্থির হয় পহেলা বৈশাখের দিনটিতে। সারাদিন রোয়েনের বাইকের পিছে বসে ঘুরে বেড়ানো, তাঁর সাথে মাটির কাপে চা খাওয়া, রবীন্দ্রসরোবরে ভীড়ের মাঝে আমায় আগলে রাখা, সবকিছু যেন আবার উপলব্ধি করতে পারি আমি। অনুভব করতে পারি সেই সময়গুলো। আমি যখন আপন ভাবনায় বিভোর তখন রোয়েন বলে উঠেন,

— তোমায় একটা প্রশ্ন করার ছিল।

রোয়েনের কন্ঠে আমি নিজ ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসি। শীতল দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলি,

— কি প্রশ্ন?

রোয়েন আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,

— সেদিন তুমি হঠাৎ আমার প্রাক্তনের সাথে নিজের তুলনা করলে কেন? ওই প্রশ্নগুলো তোমার মনে আসলো কিভাবে? এইভাবে এইভাবেই তো সেই প্রশ্নগুলো মনের মাঝে আসার কথা না। তাহলে?

প্রশ্নগুলো শুনে আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। আমতা আমতা করে বলি,

— না মানে…

রোয়েন আমার কথার মাঝে ফোড়ন দিয়ে বলেন,

— আমি সত্যিটা জানতে চাই। বানোয়াট কোন কাহিনী না।

আমি এইবার বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইতস্তত সুরে বলি,

— আপনার ডায়েরি পড়ে৷

রোয়েন ভ্রু কুঁচকে বলেন,

— কোন ডায়েরি?

আমি দৃষ্টি নত করে দুই হাত কচলাতে কচলাতে বলি,

— যেটাতে আপনার অনুভূতি ও আপনার প্রাক্তনকে নিয়ে লিখা৷ সেদিন আপনার কাবার্ড ঠিক করতে গিয়ে একটা ডায়েরি পেয়েছিলাম। কৌতূহলবসত সেটা পুরোটা পড়েছিলাম আমি। তখন প্রচন্ড কষ্ট হয়েছিল আমার আর সেই সাথেই ওই প্রশ্নগুলো মনে জেগেছিল। সরি, আপনার ডায়েরি আপনার অনুমতি ছাড়া পড়ার জন্য।

রোয়েন কিছুটা সময় চুপ থেকে জিজ্ঞেস করেন,

— ডায়েরিটা কোথায়?

— আপনার কাবার্ডেই।

— বের করে আনো।

আমি বিনাবাক্যে বিছানা থেকে নেমে কাবার্ডের ভিতর থেকে ডায়েরিটা বের করে রোয়েনের দিকে এগিয়ে দিলাম। রোয়েন ডায়েরিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখেন। অতঃপর তিনি কিছু না বলে বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বেরিয়ে যান৷ ক্ষানিকটা সময় পর তিনি হাতে একটা বোতল নিয়ে রুমে ফেরত আসেন। কিছু বুঝে উঠার আগেই উনি আমার হাতের কব্জি নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বেরিয়ে আসেন বাসা থেকে। আমায় নিয়ে চলে আসেন ছাদে। আমি তাঁর দিকে কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি আমার হাত ছেড়ে দেন। ছাদের মধ্যভাগে ডায়েরিটা রেখে তাঁর হাতে থাকা বোতলটির মুখ খুলে ধরতেই তরল পদার্থ জাতীয় কিছু গড়িয়ে পড়ে ডায়েরিটার উপর। বাতাসে তরল পদার্থটির উদ্ভট গন্ধ মিশে নাকে এসে বারি খেতেই বুঝতে পারলাম এইটা কেরোসিন। সাথে সাথে বিস্ময়ে আমার চোখ দুইটি বড় হয়ে আসে। আমি অস্ফুটস্বরে বলে উঠি,

— এইসব কি করছেন?

উনি আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে,

— অতীতের অস্তিত্ব চিরতরের জন্য মিটিয়ে দিচ্ছি। যাতে বর্তমানে এর ছাপ দ্বিতীয়বার না পড়ে।

— দেখুন এর কোন দরকার নেই।

— সেটা আমি বুঝবো।

আমি বিনয়ী সুরে বলি,

— এমনটা করবেন না প্লিজ। আমি আপনার অনুভূতিগুলোকে অসম্মান করি নি। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্য আমার ছিল না।

— অতীত যে আবার বর্তমানে আসবে না তার কি গ্যারান্টি আছে?

— তখন অন্যকে নিয়ে লিখা আপনার অনুভূতিগুলো দেখে ক্ষাণিকের জন্য হিংসে হয়েছিল। নিজের অবস্থান জানতে চেয়েছিলাম শুধু আপনার জীবনে। যেটা আপনি সেদিনই আমায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর তো আর সেই বিষয় কোন কথা উঠার প্রশ্ন আসে না।

রোয়েন নির্লিপ্ত গলায় বলেন,

— আমি তোমাকে ভুল বলছি না। তোমার মনোভাব গুলো তোমার জায়গায় থেকে ঠিক। কিন্তু যে জিনিসটার এখন আমার জীবনের সাথে কোন সম্পর্ক নেই তা আগলে রেখে লাভ কি?

— কিন্তু..

— যার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এত সুন্দর তার কি দরকার অতীতের পাতাগুলো জমিয়ে রাখার?

কথাটার পিঠে আমি কিছু বলতে পারলাম না। রোয়েন আমার সামনেই পকেট থেকে দিয়াশলাই বের করে তা জ্বালিয়ে ডায়েরির উপর ফেলে দেন আর কয়েক কদম পিছিয়ে আসেন। মুহূর্তেই পুরো ডায়েরির উপর ছেয়ে যায় অগ্নিকন্যার দাপট। চোখের সামনেই দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে ডায়েরিটি। সেই সাথে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে আছে রোয়েনের সুপ্ত অনুভূতিগুলো,যতনে লিখা প্রত্যেকটা চরণ, তাঁর না বলা কথাগুলো, জীবনের নির্মলতা, পৃথিবীর তিক্ত সত্যগুলো। আমার থেকে এক হাত দূরেই রোয়েন ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন আর আমি ছন্নছাড়া হয়ে। ডায়েরিটার দিকে যতবারই তাকাচ্ছি ততোবারই চোখ জ্বালা করে উঠছে আমার। বুকের বা পাশটাই তীব্র ব্যথা অনুভব করছি। সেই সাথে উপলব্ধি হচ্ছে কারো সুপ্ত অভিমান। সহ্য হচ্ছে না এইসব। বার বার মনে হচ্ছে, প্রহরটা এইখানে থেমে যাক,ধ্বংস না হোক অতীতটা। থাকুক না দুই-একটা ভাসমান স্মৃতির কুন্ডলী।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here