নিভৃতে_যতনে Part_31,32

0
1673

নিভৃতে_যতনে
Part_31,32
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_31

জৈষ্ঠ্যমাসের তপ্ত গরমে তিক্ত হয়ে উঠেছে পরিবেশ। ভ্যাপসা গরম আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠা রৌদ আড়াআড়ি ভাবে বিরাজমান। রৌদ্রতপ্ত দুপুরে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে রোয়েন ছুটেছে আমায় নিয়ে। গন্তব্য আমার জানা নেই। তাজ্জবের বিষয় হলো, যে নাকি অসুস্থ শরীর নিয়ে অফিসে ছুটতে প্রস্তুত সেই আজ বিনা কারণেই অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন। সেই সাথে আমাকেও ক্লাস বাঙ্ক দিতে বলেছেন। আদৌ ভাবা যায়? এ তো ভূতের মুখে রাম রাম। আমি সন্দিহান কন্ঠে তাঁকে এই নিয়ে প্রশ্ন করেছি বহুবার। কিন্তু প্রতিবারই তাঁর দিক থেকে স্পষ্ট কোন উত্তর মিলে নেই। ব্যাট যে আস্ত ঘাড়ত্যাড়া তা যেম প্রতি পদে পদে প্রমাণ করা চাই তাঁর। হুহ!
বাইক ফ্লাইওভারে উঠতেই আমি শেষবারের মত উদ্যোগ নেই জানার আসলে আমরা যাচ্ছিটা কোথায়। আমি রোয়েনের কাধ থেকে হাত সরিয়ে সপ্তপর্ণে রোয়েনের কোমড় জড়িয়ে ধরে মিষ্টি সুরে জিজ্ঞেস করি,

— কোথায় যাচ্ছি আমরা?

রোয়েন গম্ভীর কন্ঠে বলেন,

— তোমার সতীনের কাছে।

আমি রোয়েনের কথায় ফুঁসে উঠি। মনে মনে কয়েকটা সুশীল বকা দিয়ে বলি, “এত সুন্দর করে জিজ্ঞেস করলাম তাও পাত্তা দিল না। এমন হার্টলেস মানুষের সাথে কেন সংসার করছি আমি? হুয়াই?” রাগে দুঃখে উনার কোমর ছেড়ে দিয়ে বাইকের পিছন দিকটা ভালো ধরে তাঁর থেকে দূরত্ব নিয়ে বসি৷ মুখ ঘুরিয়ে রাখি আকাশের পানে। হঠাৎ আমার ষষ্ঠইন্দ্রীয় জানান দেয় কারো শীতল দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার মুখ পানে। ক্ষণেই লুকিং গ্লাসে নজর যেতেই দেখি রোয়েনের নির্মল চাহনি। দর্পণের মধ্য দিয়ে দুইজনের দৃষ্টি এক প্রান্তের মিলিত হতেই রোয়েন বাঁকা হাসে। তাঁর হাসির অর্থ বুঝার আগেই বাইকের স্পীড বেড়ে যায় শতভাগ। মুহূর্তেই আমি ভড়কে যাই আর নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখতে আমি আঁকড়ে ধরি রোয়েনের কোমড়। আমি কিছু বলতে যাব তাঁর আগেই রোয়েন বলে উঠেন,

— নীড়হারা যেমন পাখি হয় না, আমার তীর ব্যতীত তার কোন নীড় হয় না।

_______________________

দুইপাশে সারি সারি গাছের মেলা। নীলাভ আকাশে ছড়িয়ে আছে সোনালী রৌদ্দুরের আলতো ছোঁয়া। হাইওয়ের মত সরু বিস্তৃত রাস্তায় চলছে বাইক। চারপাশে চোখ বুলাতেই নজরে পড়ে এক সাইনবোর্ড। তাতে গোটা অক্ষরে লিখা ‘পূর্বাচল’। আমার আর বুঝতে নেই আসলে আমরা কোথায়। কিন্তু রোয়েন আজ হঠাৎ আমায় এইখানে নেওয়ার আসার কারণটা বুঝে উঠতে পারলাম না৷ বেশ কিছুক্ষণ পর নীলা বাজারের রাস্তায় বাইক উঠে পড়ে। কিছু দূর যেতেই রোয়েন বাইক থামায়৷ আমায় নামতে বলে নিজেও নেমে পড়ে। আমায় এক ছাউনিতে দাঁড় করিয়ে দুইটা ডাব কিনে আনেন তিনি। একটা আমার দিকে এগিয়ে দেন। আমিও বিনাবাক্যে সেটা গ্রহণ করলাম।

ডাবক খাওয়া শেষে আবার বাইক চলতে শুরু করে। শহীদ মায়েজ উদ্দিন চত্তরের থেকে পুব দিকে মোড় নিতেই নজরে পড়ে বাবুইপাখি ও কুড়েঘরের মত খুটিগুলো। ভালো করে খেয়াল করতে বুঝা গেল এইগুলো রেস্টুরেন্ট। মূলত রেস্টুরেন্টের ভিতরটা আকর্ষণীয় করতেই এমন পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে৷ রোদের তীক্ষ্ণতা কমে এসেছে। শীতল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের। আরও বেশ কিছুক্ষণ পথ অতিক্রম করার পর ‘পূর্বাচল ইকো পার্কের’ সামনে এসে বাইকটা স্থির হয়৷ আমি নেমে পড়তেই রোয়েন বাইক পার্ক করে আসতেই ভিতরে চলে যাই আমরা। ভিতরের পরিবেশ সুন্দর। রাস্তার দুই ধারে সারি সারি রঙিন লাইন,আশেপাশে কিছু ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট,সামনে মস্ত বড় লেক,চারদিকে সুবজ রাঙ্গা গাছগাছালির মেলা। বেশ মনোরম আর নির্মল পরিবেশ। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় চারদিকে মানুষ তেমন নাই বললেই চলে। আমি রোয়েনের দিকে কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি আমার হাতের মাঝে নিজের হাত গলিয়ে দিয়ে অগ্রসর হন সামনে। লেকের তীরেই আসতেই দেখতে পাই তীরেই বাঁধা আছে কিছু নৌকা। রোয়েন কোন দরদাম না করেই একটা নৌকায় উঠে পড়েন। অতঃপর আমার হাত শক্ত করে ধরে বলেন,

— উঠে পড়ো।

আমি কিছুক্ষণ শীতল দৃষ্টিতে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে থাকিয়ে উঠে পড়ি নৌকায়। নৌকার মাঝে এসে বসতেই নৌকা চলতে শুরু করে। পানির থৈ থৈ আওয়াজ কানে আসতেই মন জুড়ে যায় আমার। রোদ্দুরে তীক্ষ্ণতা এখন আদুরে হয়ে উঠেছে। বেশ ভালো লাগছে পরিবেশটা। নৌকা লেকের মধ্যভাগে আসতে আমি রোয়েনের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। বুঝার চেষ্টা করি রোয়েন আসলে আমরা এইখানে কেন এসেছি। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলি,

— হঠাৎ আজ আমরা এইখানে কেন এসেছি?

রোয়েন কিছুটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায়। নৌকা চালকের কাছে চলে যান। কি নিয়ে যেন কথা বলতে থাকেন। আমি কিছুটা সময় তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে স্বচ্ছ পানির দিকে নিবদ্ধ করি। বেশ কিছুক্ষণ পর উনি ফিরে এসে আমার পাশে বসেন। আমি তাঁর দিকে তাকাতেই উনি হালকা হেসে আমার দিকে একটা ছোট রক্তিম লাল গোলাপের তোড়া এগিয়ে দিয়ে কানের কাছে এসে নমনীয় কন্ঠে বলেন,

— শুভ বিবাহবার্ষিকী!

কর্ণধারে কথাটা বারি খেতেই আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি রোয়েনের মুখপানে। মুহূর্তেই আমার নিকট সব পরিস্কার হয়ে আসে রোয়েনের আজকের কর্মকাণ্ডের অর্থ। হঠাৎ টনক নাড়ে, আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী অথচ আমারই মনে নেই? বিয়ের প্রথম বার্ষিকীটা সকল মেয়েরই জন্য অন্যরকম অনুভূতি বয়ে আনে। এইদিনটা নিয়ে সকলের কত প্ল্যান থাকে, কত আশা থাকে। অথচ আমি বেমালুম ভুলে বসে আছি। এতটা বেখেয়ালি কবে হলাম আমি? হঠাৎ বুকের বাপাশে তীব্র ব্যথা অনুভব করি। গলা ধরে আসছে বার বার। দৃষ্টি নরম হয়ে আসতেই আমি মাথা নিচু করে ফেলি৷ ক্ষণেই নয়ন দুইটির কার্নিশ বেয়ে নীরবে গড়িয়ে পড়ে দুইফোটা নোনাজল। নীরবে কেঁদতে থাকি আমি। আমার কান্না দেখে হয়তো রোয়েন কিছুটা ভড়কে যায়। কেমন বিচলিত দেখাল তাকে। পরমুহূর্তে নিজেকে স্থির করে আমায় পিছন দিয়ে এক বাহু জড়িয়ে ধরে সিক্ত কন্ঠে বলেন,

— কি হয়েছে? কাঁদছো কেন তুমি?

আমি কিছু না বলে নীরবে কান্না কর‍তে থাকি। তা দেখে রোয়েন আর কয়েকবার একই কথা জিজ্ঞেস করেন। অবশেষে আমি ধরা গলায় বলি,

— কিভাবে পারলাম আমি ভুলতে আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী?

রোয়েন আমায় আগলে নিয়ে বলেন,

— এইটা ব্যাপার না।

আমি করুন কন্ঠে বলি,

— আমার জন্য যে অনেক কিছু।

রোয়েন মিষ্টি হেসে বলেন,

— প্রকৃতির নিয়মই হচ্ছে, দুইজনের মধ্যে একজনের বিশেষ দিনের কথা মনে থাকবে আরেকজনের থাকবে না। এইবার না-হয় তুমি ভুলে গিয়েছ পরেরবার না-হয় আমি ভুলে যাব।

শেষের কথাটা শুনে আমার ঠোঁটের কোনে শ্লেষের হাসি ফুটে উঠে। আমি বিষাদময় কন্ঠে বলি,

— কিছু তো করতেও পারলাম না আপনার জন্য অথচ আপনি কত কি প্ল্যান করে বসে আছেন।

রোয়েন নির্লিপ্ত কন্ঠে বলেন,

— কোথায় কত কি প্ল্যান করেছি?

আমি কিছুনা বলে রোয়েনের বুকে মাথা চেপে বসে থাকি। রোয়েন স্বাভাবিক কন্ঠেই বলেন,

— ফুলগুলো কি পছন্দ হয়নি? নদীতে ফেলে দিব?

আমি কিছু না বলে আলতো হাতে ফুলগুলো নিয়ে নিলাম। এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকলাম ফুলগুলোর দিকে। কিভাবে যে মানুষটির সাথে একটি বছর পার করে ফেললাম বুঝতেই পারলাম না। যে মানুষটাকে প্রথমে দুই চোখে দেখতে পারতাম না আজ তাঁর জন্য মাতোয়ারা আমি। যাকে ঘিরে আমার চরম বিরক্তি, তাঁকেই ঘিরে এখন আমার সকল অনুভূতি। জৈষ্ঠ্যমাসের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দিনে আমাদের সাক্ষাৎ যে চিরকালের জন্য আমাদের একই বন্ধনে বেঁধে দিবে তা কে জানতো? হঠাৎই রোয়েন আমার বা হাত টেনে ধরতে আমি আমার ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসি। রোয়েন আমার অনামিকা আঙ্গুলে ছোট একটা সাদা আর নীল পাথরে কারুকাজ করা আংটি পড়িয়ে দিতেই বিস্মিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাই। আংটিটা পড়ানো শেষে রোয়েন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কোমল কন্ঠে বলে উঠেন,

— আমার জীবনের সকল জৈষ্ঠ্যমাস যেন তাকে নিয়েই শেষ হয়।

___________________

সময় যে কত দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে তা পিছনের দিনগুলো গুনলে বুঝা যায়। এই যে সময় কাটা যে কখন বৈশাখ,জৈষ্ঠ্য পেরিয়ে শ্রাবণে গিয়ে ঠেকলো বুঝাই গেল না। রমজান মাসও যে এসে এখন শেষ হতো চললো৷ এইতো মাত্র আর একদিন বাকি। ইদের ছুটি কাটাতে মা-বাবা ঢাকাই চলে এসেছেন। কালকে ইদ বলে আজ বাসায় ঢেড় আয়োজন। পলি আন্টি সন্ধ্যা পর্যন্ত মায়ের কাজে সাহায্য করলেও তার যাওয়ার পর আমিই মাকে সাহায্য করতে থাকি। রাত যখন প্রায় এগারোটা ছুঁই ছুঁই তখন মা আর আমার কাজ শেষ হয়। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে রুমে আসতেই রোয়েন গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,

— এইদিকে আসো!

কথাটা শুনে আমি তাঁর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাই। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— কেন?

— প্রশ্ন করতে বলিনি। এইদিকে আসে বলেছি।

আমি আর কিছু না বলে তাঁর দিকে এগিয়ে যাই। তাঁর মুখ বরাবর গিয়ে বসতেই উনি আমার এক হাত টেনে বলেন,

— মেহেদী পড়োনি কেন?

আমি স্মিত হেসে বলি,

— আমার মেহেদী দেওয়ার তেমন অভ্যাস নেই। তার উপর দিতেও জানি না।

রোয়েন আর কিছু না বলে পিছন থেকে একটা কাভেরি মেহেদী বের করেন। মেহেদীটা দেখা মাত্র বিষ্ময়ে আমার ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আসে। রোয়েন পাশে মোবাইলের ডিসপ্লেতে মেহেদীর একটা ডিজাইন রেখে আমারটা তাঁর উরুর উপর নিয়ে চুপচাপ ডিজাইনটা দেখে মেহেদী দিতে শুরু করেন। আমি কিছু বলতে যাব তাঁর আগেই তিনি গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,

— হুসসস!! ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।

কথাটা শুনে আমার হাসি পেলেও হাসলাম না আমি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে রইলাম আর রোয়েন একধ্যানে মেহেদী দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ঘন্টাখানিক পর মেহেদী দেওয়া শেষ হতেই তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলেন,

— ডান!

আমি কথাটা শুনে নিজের হাতের দিকে তাকাতেই মিষ্টি হাসি দেই। রোয়েন বেশ সুন্দর করেই মেহেদীটা পড়িয়ে দিয়েছেন। মেহেদীর এক কোনে লুকিয়ে থাকা ‘আর’ শব্দটি নজর বুলাচ্ছি বার বার। রোয়েন কৌশলে নিজের নামের প্রথম শব্দটি লিখলেও আমার নজরে তা ঠিকই ধরা পড়ে যায়। মাঝেমধ্যে মানুষটি এমন অপ্রকাশিত পাগলামো,অনুভূতি দেখলে সত্যি অভিভূত হই আমি। কিছু না বলেও অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ খুব ভালো করতে জানেন তিনি। আমি মিষ্টি হেসে বলি,

— আপনি তো দেখছি ভালোই মেহেদী দিতে জানেন।

রোয়েন নিজের চুলে হাত গলিয়ে বলেন,

— কষ্টের ফল মিষ্টি হলেই হয়।

কথাটা শুনে আমি মিটমিটিয়ে হাসি। রোয়েন যে মিষ্টি ফল বলতে মেহেদীর রঙ গাঢ় হওয়ার কথা বলছে তা ঢেড় বুঝতে পারছি। আমি আর কিছু না বলে উঠতে যাব তখনই আমার ফোন বেজে উঠে। আমি বা হাতে ফোনটা তুলে নিতেই দেখি হৃদিপু কল করেছেন। আমি ঘড়ি একবার দেখে নিলাম। রাত বারোটার বেশি বাজে। এইসময় হৃদিপু কেন ফোন করলো? কোন বিপদ হলো না তো? আমি চটজলদি ফোনটা রিসিভ করে হৃদিপুর কান্নামিশ্রিত কন্ঠ শুনতে পেলাম। ক্ষণেই বিচলিত হয়ে পড়ি আমি। অস্থির কন্ঠে কয়েকবার কি হয়েছে জানার চেষ্টা করি৷ অতঃপর হৃদিপুর উত্তর শুনে আমি একদম স্তব্ধ হয়ে যাই। মাথা ভনভন করে ঘুরতে শুরু করে। নিস্তেজ হতে বসে পড়ি বিছানায়।

চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_32
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

সকালে উঠে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করে রুমে এসে বসে আছি। দরজা ভিতর থেকে লাগানো। ভালো লাগছে না কিছুই। রোয়েন আর বাবা গিয়েছেন মসজিদে ইদের নামাজ পড়তে। মা হয়তো রান্নাঘরে কাজ করছে। আপাতত আমার খোঁজ করার মত কেউ নেই। তাই একাকিত্ব এই সময়ে নিজেকে নিয়ে ভাবার মোক্ষম সময়। বিছানার এক কোনে চোখের পাতা দু’টি বন্ধ করে আধশোয়া হয়ে বসে আছি৷ মস্তিষ্ক জুড়ে পদচারণ করছে ছোট বেলার তিক্ত স্মৃতি। মনে পড়ছে আমার প্রতি করা সকলের ব্যবহার। সেই সাথে ভারি হচ্ছে হিসাবের পাল্লা। হিসাববিজ্ঞানে তো অনেক হিসাব মিলালাম এইবার না হয় জীবনের হিসাব মিলাবো। যখন আমি জীবনের ছক কষছি তখনই দরজায় কড়া আঘাত পড়ে। মা ডাকছে। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি তিনি যা বলছেন। প্রথমকে তার কথাগুলো শুনে কিছুটা ভড়কে গেলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নেই। না শোনার ভাণ ধরে বসে থাকি। কেন না তার কথা রাখার সাধ্য যে আমার নেই। খানিকটা সময় অতিক্রম হওয়ার পরও যখন মা গেলেন না তখন আমি গলার স্বর উঁচিয়ে কোমল কন্ঠে বলি,

— মা আপনি চলে যান। আমি পরে তাদের ফোন দিয়ে কথা বলে নিব নে।

কথাটা মা শুনলো কি-না জানি না কিন্তু দরজার ওপাশ থেকে আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। আমিও এইসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকি। ভাবতে থাকি, আমার পরিবারটা আসলে কতটা স্বার্থপর। যেখানে তারা মাসে একবারও ফোন দিয়ে আমার খবর নেয় কি-না সন্দেহ সেখানে আজ তাদের দরকারের জন্য ফোনের উপর ফোন করেই চলেছে। হৃদিপুকে দিয়ে আমাকে রাজি করাতে পারেনি বলে এখন নিজেরাই মায়ের ফোনে ফোন দিচ্ছে। বাহ,চমৎকার!
ঘন্টাখানিক বাদে রোয়েনের গম্ভীর কণ্ঠ কর্ণধারে বারি খেতেই চকিত দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকাই।

— সিয়াশা! দরজা খোলো।

রোয়েন কন্ঠ শ্রবণ হতেই আমি বিনাবাক্যে উঠে দাঁড়াই। ধীর পায়ে এগিয়ে যাই দরজার দিকে। দরজা খুলতেই নজরে পরে রোয়েনের গম্ভীর চেহেরা। আমি একপলক তাঁর দিকে তাকিয়ে চলে যাই বারান্দায়। বারান্দার এককোনে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি দূর আকাশের পানে। রোয়েন তৎক্ষনাৎ আমার কাছে এসে বলেন,

— এইসব কি হচ্ছে সিয়াশা?

আমি ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দেই,

— কোনসব?

— তোমার বাসা থেকে বার বার ফোন আসছে, সবাই তোমাকে খোঁজ করছে আর তুমি কি-না হাত গুটিয়ে বসে আছো?

আমি রোয়েনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— কেন ফোন দিচ্ছে জানেন?

— হ্যাঁ! তুমি না বললে কি হবে? তারা নিজেরাই ঘন্টাখানিক আগে ফোন করে সব জানিয়েছে।

আমি নির্লিপ্ত কন্ঠে উত্তর দেই,

— অহ আচ্ছা।

রোয়েন কাঠ কাঠ গলায় বলেন,

— একজন শয্যাশায়ী মানুষ অনবরত তোমাকে খোঁজ করছেন, কাছে চাইছেন তোমায় আর তুমি কি-না তার সাথে দেখা করতেও ইচ্ছুক না?

— ব্যক্তিটা যদি নাসরিন বেগম না হতো তাহলে বিষয়টা ভিন্ন হতো।

— সবকিছুর উর্ধ্বে মানুষকে মানুষ বলে সম্মানের স্থানে বসাতে হয়। বিবেকহীন হলেও তাকে সর্বপ্রথম মানুষ হিসেবে গণ্য কর‍তে হবে কারণ সে মানুষ।

আমি রোয়েনের দিকে কোমল চাহনি নিক্ষেপ করে বলি,

— আমি যে পারছি না। তার কথা যতবার মনে পড়ছে ততবার আমার প্রতি করা তার অন্যায়গুলোই মনে পড়ছে।

— অতীত থেকে বেরিয়ে এসে বর্তমানকে নিয়ে চিন্তা করো। তাহলে দেখবে সব সহজ লাগছে।

— আমার অতীত থেকে বেরিয়ে আসা এত সহজ না। আমার অতীতই যে আমার পরিচয়।

রোয়েন আমার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন,

— অতীত কখনো পরিচয় হতে পারে না। অতীত শুধুমাত্র আমাদের কষ্টের এক বৃহত্তর অংশ, যা শুধু পীড়া দিতে জানে। তুমি যত তোমার অতীত চাপা রাখবে তত তুমি কষ্ট পাবে।

আমি রোয়েনের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— হতো তাই৷ তা একটা গল্প শুনবেন?

রোয়েন ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে বলেন,

— কিসের গল্প?

— শোনার পর না-হয় বুঝতে পারবেন। শুনবেন কি? বেশি সময় অপচয় হবে না আপনার।

রোয়েন কাঠ কাঠ গলায় বলেন,

— বড্ড বেশি কথা বলো তুমি।

আমি শ্লেষের হাসি হেসে বলি,

— সে আর নতুন কি?

রোয়েন কিছুক্ষণ আমার মুখপানে তাকিয়ে থেকে বলেন,

— শুরু করো।

আমি একপলক রোয়েনের দিকে তাকিয়ে নীলাভ আকাশের পানে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাই। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করি,

— আজ থেকে কয়েকবছর আগে সম্মানিত এক পরিবারে জন্ম নেয় একটি মেয়ে। মেয়েটির জন্ম যে সকলের মাঝে খুশি বয়ে আনে তা কিন্তু না। তখন সকলের মুখে বিষাদের ছায়া। দেয়াল জুড়ে ছিল মরাকান্নার প্রতিধ্বনি। শোকের আমেজ ছিল চারদিকে। কেন না মেয়েটি জন্ম হওয়ার কিছু প্রহর পূর্বেই তার শ্রদ্ধেয় দাদাজান মারা গিয়েছিল। মেয়েটির দাদাজানের মৃত্যু আকস্মিক হওয়ায় কেউ সেটা সহজভাবে মেনে নিতে পারে নি। বিশেষ করে মেয়েটির দাদিমা। নিজের স্বামীর মৃত্যু তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। পাগলের মত বিলাপ শুরু করে দিয়েছিলেন। ক্ষণে ক্ষণেই দোষ দিয়ে যাচ্ছিলেন নবজাতক সেই মেয়েটিকে। যে কি-না মাত্র ভূ-পৃষ্ঠে জন্ম নিয়েছিল। বার বার বলেই চলেছিলেন, ‘ওই মেয়েটাই নাকি তার স্বামীকে খেয়েছে। তার সংসারে নাকি সে নজর দিয়েছে। ধ্বংস বয়ে এনেছে সেই মেয়েটা। অলক্ষুণে, অপয়া সে।’ এমন আজেবাজে আরও অনেক কিছু বলতে থাকেন আর দাদাজানের মৃত্যুর পুরো দোষ সেই নবজাতক মেয়েটিকেই দিচ্ছিলেন। মেয়েটির পরিবারের সকলেই তখন তার দাদিমাকে শান্ত করতে ব্যস্ত ছিল। ধীরে ধীরে পরিবেশ শান্ত হয়৷ কিছু দিন যায়, বাসায় তখনো শোকের আমেজ যখন মেয়েটিকে হসপিটাল থেকে বাসায় আনা হয়। বাসায় আনার পর দাদিমা যখন মেয়েটি দেখে তখন তার দিকে অহেতুক কিছু কটুকথা ছুড়ে মারেন। নিজের নাতনিকে আগলে নেওয়ার বদলে ‘অপয়া’ বলে দূর দূর করে সরিয়ে দেন। পারলে তিনি মেয়েটা এবং তার মাকে সহ বাসা থেকে বের করে দেন কিন্তু তার ছেলের জন্য পারেন না। কেন না তাদের দুইজনকে বের করলে যে তার ছেলেও ঘর ছেড়ে চলে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে তিনি জায়গা দেন মেয়েটিকে।
মেয়েটির যখন এক মাস পূর্ণ হবে তখন তার বাবা ও বড়বাবা ব্যবসায় অনেক বড় লস খায়। মুহূর্তেই সংসারে নেমে আসে বিপর্যয়। সংসারটা অভাবে পরিনত হয়। এইসব দেখে মেয়েটির দাদী দ্বিতীয়বারের মত মেয়েটিকেই দোষারোপ করেন। মেয়েটির জন্যই নাকি তাদের এমন দুর্দশা। মেয়েটি অপয়া। দাদিমার সেই বিলাপ তখনও কেউ মেনে নেই। ভাগ্যের লিখন বলে সকলে তার কথা অগ্রাহ্য করে।
ধীরে ধীরে তাদের আগের অবস্থান ফিরে আসে। মেয়েটিও তার দাদিমার অনাদরে বড় হতে থাকে। দাদিমার সামনে গেলেই মেয়েটিকে গাল-মন্দ শুনতে হতো। দূর দূর করে সরিয়ে দেওয়া হতো তাকে। মেয়েটি যেন ছিল তার দুই চোখের বিষ। মেয়েটি যখন দেখতো তার সকল ফুপাতো,চাচাতো ভাই-বোনদের দাদি আদর করছে কিন্তু ওকে না তখন মেয়েটা খুব কাঁদতো। তখন তার মা-বাবাই তাকে সান্ত্বনা দিত।
মেয়েটার বয়স যখন চার কি পাঁচ তখন ওর বড় ফুপু বিদেশ থেকে দেশে ঘুরতে আসেন। মেয়েটির ফুপু যখন বাসায় আসে তখন মেয়েটি জানতে পারে তার একটি বড় ফুপাতো বোনও আছে। নাম তার কিয়ারা। কিয়ারার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার কিছু সময়ের ব্যবধানেই মেয়েটির সাথে কিয়ারার বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। বন্ধু হয়ে যায় তারা। মেয়েটির বড় ফুপু ও ফুপা মেয়েটিকে নিজের সন্তানের মতই ভালোবাসতেন। কোথাও গেলে সর্বদা মেয়েটিকে নিয়ে যেতেন।
একদিন মেয়েটির ফুপু মেয়েটিকে তাদের সাথে ঘুরতে নিয়ে যান। সারাদিন ঘুরে এদিক সেদিক ঘুরে বিকেলের দিকে তারা সকলের জন্য কেনাকাটার জন্য বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স চলে যান। যখন তারা কেনাকাটা করছি তখন শপিংমলের উপরের তালায় আগুন লেগে যায়। মুহূর্তেই সেটা চারদিকে ছড়িয়ে যায় আর নিচের দিকে নেমে আসে। আগুন লাগার ফলে চারদিকে হট্টগোল লেগে যায়। ছোটাছুটি শুরু হয় সকলের। শপিংমলের লিফট আর এক্সেলেটরও বন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে শর্টসার্কিট না হয়। মেয়েটির ফুপু আর ফুপা ভিতরের কিয়ারা আর মেয়েটিকে নিয়ে দিকে ছিল বলে শোরগোলের কারণ আয়ত্ত করতে পারেনি। যতক্ষণে তারা সামনে এগিয়ে আসে ততক্ষণে চারদিকে আগুন ছড়িয়ে গিয়েছিল। তারা আটকে পড়ে গিয়েছিল সেই ফ্লোরটি। তাদের সাথে আরও অনেকেই ছিল যারা আটকা পড়ে যায় সেই ফ্লোরে। আগুনের উত্তাপ বাড়তে থাকে। দাউ দাউ করে জ্বলছে থাকে সকল দোকানপাট। কান্নার কলধ্বনি ভেসে উঠে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে। বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ফায়ারসার্ভিস থেকে লোক আসে সকলকে উদ্ধার করতে। কিছু মানুষকে উদ্ধার করতে পারলেও বেশিরভাগ মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আর সেই তালিকায় মেয়েটির ফুপু আর ফুপাকেও ছিল। কেন না তারা কিয়ারা আর সেই মেয়েটিকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেন। কিয়ারা আর সেই মেয়েটিকে হসপিটালে নেওয়া হয়। কেন না তাদের কিছু অংশ আগুনে জলসে গিয়েছিল। মেয়েটির পরিবার যখন এই খবরটি পায় তারা ছুটে আসে হসপিটালে। দুইজনের অবস্থা আর মেয়েটির ফুপু ও ফুপার মৃত্যু সংবাদ শুনে সকলে একদম ভেঙে পড়ে। কিন্তু এর মাঝেও মেয়েটির দাদিমা মেয়েটিকে দোষ দিতে ভুললেন না। শ’খানেক গাল-মন্দ করে অপয়ার তকমা লাগিয়ে মৃত্যুর দোষটা লাগানো হলো মেয়েটির উপর। সেই সাথে একের পর এক ঘটনার প্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে মেয়েটির পরিবারের কম-বেশি সকলে মেনে নেয় মেয়েটা অপয়া। যা হয়েছে সব তার জন্যই হয়েছে।
দিন যায়, কিয়ারার প্রতি সকলের মায়া বেড়ে যায় আর সেই মেয়েটির প্রতি সকলের অনিহা সৃষ্টি হয়। কিয়ারার যাতে অনাথ হিসাবে পরিচয় না পায় তাই দাদিমার কথায় সেই মেয়েটির বাবা-মা কিয়ারাকে দত্তক নেয়। মেয়েটির বড়বোন হিসাবে পরিচয় দেয় সকলকে। এইদিকে দাদিমা সকলের সাথে কিয়ারার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেন মেয়েটি ছিল কিয়ারার বাবা-মার খুনি। মেয়েটির জন্যই কিয়ারার বাবা-মা আজ এই পৃথিবীতে নেই। কিয়ারাও সেটা মেনে নেয় এবং দাদিমার সাথে মিলে মেয়েটির সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করে। কিয়ারা মেয়েটিকে খারাপ কিছু বললেও পরিবারের কেউ কিছু বলতো না। এমনকি মেয়েটির বাবা-মাও কিয়ারাকে কিছু না বলে মেয়েটিকেই বুঝ দিত কিয়ারার মানসিক অবস্থা এখন ভালো না। তাই ওকে যাতে সে কিছু না বলে।
এইদিকে, দিন যত যায় দাদিমা কিয়ারার মনে মেয়েটির নামে বিষ ঢুকিয়ে দিতে থাকেন। মাস খানেকের মধ্যেই কিয়ারার চিরন্ত শত্রু হয়ে উঠে মেয়েটি। দুই চোখে দেখতে পারতো না সে মেয়েটিকে। যার দরুন কিয়ারা সবসময় মেয়েটিকে মারতো আর খারাপ খারাপ কথা বলতো। মেয়েটি যখন এইসব কথা তার বাবা-মাকে জানাতো আর তারা কিয়ারাকে ডেকে এনে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করতো তখন সে অনায়াসে মিথ্যা বলে দিত যে, ‘সে এইসব কিছু করেনি বরং মেয়েটি তাকে মেরেছে আর বকেছে।’ তখন মেয়েটির বাবা কিয়ারার কথা বিশ্বাস করলেও মেয়েটির মা করতো না। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারতো না।
ধীরে ধীরে, কিয়ারাকে সকলে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে। মেয়েটির বাবা-মাও কিয়ারাকে বেশি ভালোবাসতে শুরু করে। কিয়ারার প্রতি সকলের ধ্যান হলেও মেয়েটির প্রতি কারো কোন ধ্যান ছিল না। এতে মেয়েটির খুব রাগ হয়। সে এই বিষয় নিয়ে কিয়ারার সাথে ঝগড়া করে। একসময় দুইজনের হাতাহাতি শুরু হয়। কিয়ারা মেয়েটিকে ধাক্কা দিলে সেও তাকে ধাক্কা দেয়। কিয়ারা পুনরায় মেয়েটিকে ধাক্কা দিতে আসলে মেয়েটি সরে যায় আর কিয়ারা তাল সামলাতে না পেরে খাটের কোনে গিয়ে বারি খায়। সাথে সাথে তার কপাল ফেটে ফিনিকে রক্ত বেরিয়ে আসে। মুহূর্তেই রক্তে লেপ্টে যায় তার মুখশ্রী। মেয়েটি রক্ত দেখে এক চিৎকার দিতে বাড়ির সকলে এসে হাজির হয় সেখানে। কিয়ারার এমন অবস্থা থেকে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যায়। অতঃপর সেখানে চিকিৎসা করার পর যখন সকলে কিয়ারাকে জিজ্ঞেস করে,’ এই দুর্ঘটনা কিভাবে হলো?’ সে অকপটে বলে উঠে, ‘মেয়েটা তাকে ধাক্কা দিয়েছিল। যার ফলে সে খাটের কিনারে গিয়ে বারি খায় আর তার কপাল ফেটে যায়।’ সব শুনে মেয়েটা চেঁচিয়ে বলেছি, ‘সে এমন করেনি। বরং তাকে আঘাত করতে গিয়ে কিয়ারা নিজে ব্যথা পেয়েছে।’ কিন্তু কেউ তার কথা বিশ্বাস করেনি। সকলে তাকে দোষারোপ, এমনকি তার আপন বাবাও। এইদিকে দাদিমা রটিয়ে দেন যে, ‘মেয়েটি কিয়ারাকে মারতে চায়।’ এর সাথে আরও অনেক বানোয়াট কাহিনী রটান। অবশেষে মেয়েটির বাবা সেদিন প্রথমবারের মত মেয়েটির গায়ে হাত তুলেন। তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে রুমের মধ্যে বন্দী করে দেয়। মেয়েটি সেদিন অনেক আকুতি মিনতি করে কিন্তু কেউ তার কথা শুনেনি। মায়াও করে নি। একমাত্র তার মা আর তার বড় চাচাতো বোন ছাড়া। সকলের কাছে যখন মেয়েটা অবহেলার পাত্রী হয়ে উঠে তখন সেই দুটো মানুষই তাকে আগলে নেয়। বাড়ির সেই দুটো মানুষ বাদে সকলের তুচ্ছতাচ্ছিল্য নয় বছর বয়সী মেয়েটির মনে গভীর দাগ টানে। ক্ষিপ্ত হয়ে যায় সবার প্রতি। সব দিক বিবেচনা করে মেয়েটির মা মেয়েটিকে কঠোর হতে বলেন আর এইসবে কান না দিয়ে নিজের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহী হতে বলেন। পড়ালেখা করে নিজের যোগ্যতা অর্জন করে সকলের চোখে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিতে পারে তার নিজের অবস্থান। প্রুভ করতে নিজেকে যা হয়েছে তা তার জন্য নয় বরং ভাগ্যে এমনটা লিখা ছিল বলে হয়েছে। আর যতক্ষণ না সেই দিন আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত সবকিছু চুপচাপ সহ্য করে যেতে। মেয়েটিও তার মায়ের কথা শুনে তাই করে গেল। কিন্তু একটা জিনিস বিপরীত হয়েছি তা ছিল মেয়েটি শান্ত থাকার বদলে ধীরে ধীরে মেয়েটা জিদি আর বেপরোয়া হয়ে উঠে। স্কুলে মারামারি শুরু দেয়। যার দরুন বাসায় তার নামে অভিযোগ আসতে শুরু করে। সম্মানহানি হতে শুরু করে পরিবারটির। তাতে মেয়েটির বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং মেয়েটি অনেক বকা ঝকা করে। মেয়েটি রাগে তার বাবার সাথে তর্ক জড়িয়ে যায়। অতঃপর সেদিন দ্বিতীয় বারের মত তার বাবা মেয়েটির গায়ে হাত তুলেন। দাদিমাও এতে উস্কানি দেয় এবং বলেন মেয়েটিকে যাতে বোর্ডিং স্কুলে দেওয়া হয়৷ পরিবার থেকে দূর গেলেই নাকি মেয়েটা বুঝবে পরিবারের মর্ম। অতঃপর বছরের শেষের দিকে দাদিমার কথায় সকলে মেয়েটিকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। ছিন্ন করে দেয় মেয়েটিকে পরিবার থেকে।
প্রথম প্রথম মেয়েটি খুব কান্না করতো বাসায় যাওয়ার জন্য। পাগলামো করতে। ফোন করে কেঁদে বলতো সে আর কখনো ঝগড়া,মারামারি করবে না। সে শুধু বাসায় যেতে চায়। কিন্তু তাও তাকে কেউ নিতে আসেনি। দিনের পর দিন সে আশায় থাকতো কেউ তাকে নিতে আসবে। কিন্তু দিন শেষে কেউ আসেনি। মাঝে তার অনেক জ্বর হয়। যা সপ্তাহ খানিক থাকে। ছোট সেই মেয়েটি তখন বার বার মা-বাবাকে কাছে চাইতো। কান্নাকাটি করতো। কিন্তু আফসোস! তাকে দেখতে তার মা আর তার চাচাতো বোনটি বাদে কেউ আসেনি। মেয়েটির মায়ের অনুমতি ছিল তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার তাই তার মা সেখানেই বসে মুখে আঁচল চেপে কাঁদতো। ইদের ছুটিতে যখন মেয়েটা বাসায় যেত তখন বাড়ির দুইজন সদস্য বাদে কেউ তার প্রতি আগ্রহ দেখাত না। সে পরে থাকতো বাসার এককোনে। সকলের এমন অনাগ্রহ,অবহেলা আর অপবাদে পরবর্তী সময়ে মেয়েটা হয়ে উঠে কঠোর আর বেপরোয়া। কারো কথাই সে গায়ে মাখতো না। পড়ালেখা ঠিক রেখে নিজের মন-মর্জি মত চলত। নিজের জীবন নিয়ে বুনতে থাকে হাজারো স্বপ্ন। কিন্তু তাও হয়তো তার পরিবারের কারো সহ্য হয়নি। ইন্টারমিডিয়েট দেওয়ার পর যখন সে বাসায় যায় তার তিনদিনের মাথায় তার বিয়ে ঠিক করে দেওয়া হয়। সবকিছু এত দ্রুত হওয়ায় মেয়েটা ভড়কে যায়। সব বুঝে উঠার আগেই তার বিয়ের কথাও পাকা হয়ে যায়। নিজের সব স্বপ্ন ভাসতে যেতে দেখে মেয়েটা বিয়েটায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু কাজ হয়না। অবশেষে যখন মেয়েটি বাবাও তাকে অপয়া আর সন্তান হিসাবে কলঙ্ক ঘষিত করেন মেয়েটি বিনাবাক্যে বিয়ের পীড়িতে বসে যায়। নিজের কঠোরতা বজিয়ে রেখে পা দেয় নতুন জীবনে। কিন্তু তখনও সে জানতো না তার নতুন জীবনটাই হবে তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।

একদমে পুরো গল্পটুকু বলে আমি ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেই। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করি। অতঃপর নিজে সামলে ঠোঁটের কোনে শ্লেষের হাসি ঝুলিয়ে রোয়েনের দিকে তাকিয়ে দেখি উনি আমার দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাঁর চোখের মনি কিছু একটা জানার আকাঙ্খা। আমি সেই অর্থ বুঝতে পেরে নমনীয় কন্ঠে বলি,

— জিজ্ঞেস করবেন না গল্পের মেয়েটা কে? থাক করতে হবে না আমিই বলছি। মেয়েটা হচ্ছি আমি আর বাকি গল্পের সকল চরিত্র হচ্ছে আমার পরিবারের সদস্য।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here