“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৪৫

0
2728

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪৫
(নূর নাফিসা)
.
.
ঘুম ভাঙলে আরাফকে পাশে পায়নি নাজিয়া। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলো সন্ধ্যা হয়ে আসছে! আসরের নামাজ পড়তেও ডাকলো না তাকে! এতো পাজি লোকটা, অসময়ে কি সুন্দর ঘুম পাড়িয়ে রেখে চলে গেছে সে! হাই তুলতে তুলতে নাজিয়া কম্বল সরিয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো। চুল খোপা করে ঘর থেকে বের হতেই কিচেনে আরাফ ও আশিকের হাসাহাসি শুনতে পেলো। তারা কিচেনে কি করছে! নাজিয়া সেদিকে না গিয়ে ফরজ নামাজটা আদায় করার জন্য বাথরুমে চলে গেলো। ওযু করে নামাজ আদায় করে কিচেনে যাওয়ার সময় দেখলো আয়েশা বেগম কিচেন থেকে বেরিয়ে আসছে। নাজিয়াকে দেখে নিজ ঘরের দিকে হনহনিয়ে যেতে যেতে তিনি বিড়বিড় করে বললেন, “আরও কত কিছু না জানি দেখতে হয়! মাইয়া মানুষ নাকে তেল দিয়া ঘুমাইবো আর ছেলেরা আইসা রান্নাঘর সামলাইবো! এমন সুখই পাইলাম না জীবনে!”
শুনতে খারাপ লাগলেও সেটা মনে ধরলো না, নাজিয়া। সে চুপচাপ কিচেনে অগ্রসর হলো। দেখলো আরাফ আশিক দুইভাই মিলে রান্না করছে! একএকজনের নাজেহাল অবস্থা আর হাসিঠাট্টা! বিস্মিত হয়ে নাজিয়া বললো,
– এসব কি অবস্থা!
আরাফ বললো,
– এতো তারাতাড়ি ঘুম ভেঙে গেছে।
– তারাতাড়ি ঘুম ভেঙেছে! নামাজটাও তো ঠিকমতো পড়তে পারলাম না। ডাকলে কি হতো!
– ইচ্ছে করছিলো না ঘুমটা ভাঙাতে।
আশিক জবাব দিলো,
– ভাবি, দেখো একটু আমার অবস্থা কি করেছে ভাইয়া। তোমার ঘুম ভাঙতে পারেনি বলে আমার মাথায় ডিম ভেঙেছে। ডিম ভেঙে নাকি পরীক্ষা করে আমার মাথা শক্ত কি-না! ছি! কি বাজে গন্ধ! ওয়াক!
আশিককে থামিয়ে আরাফ বললো,
– নাজিয়া, আশিকের আগে আমার অবস্থাটাও দেখো একবার! ভাজি করার জন্য মাত্র তিনটা ডিম তার মাথায় ঠুসে ভেঙেছি বলে আমাকে আটা দিয়ে গোসল করিয়েছে! এখনো আমার যৌবন পাড় হয়নি বলে দেখতে এসেছে চুল পেকে বুড়ো হলে কেমন দেখাবে আমাকে!
– বাচ্চাদের চেয়েও খারাপ তোমরা। বের হও এখান থেকে। অনেক হয়েছে রান্না। বের হও।
– উহুম, আমাদের আনন্দে ব্যাঘাত সৃষ্টি করো না। রান্না প্রায় শেষের দিকে। আমরা যখন বেশি খুশি হই, তখন দুই ভাই মিলে রান্না করি। লাস্ট রান্না করেছিলাম আশিকের রেজাল্টের পর, যখন সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলো৷ এরপর আজ আবারও সুযোগ এলো। আজ তোমার ছুটি।
আশিক বললো,
– ভাবি, আমাদের রান্না খেয়ে দেখবেন। একবার খেলে বারবার খেতে মন চাইবে। আয়াত জানতে পারলে শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে আসবে।
– আচ্ছা! তাহলে তো আরও মুশকিল! এখন থেকে প্রতিদিনই তোমাদেরকে রান্না করতে হবে!
– তা আর হবে নাকি! মাসে একবার হলে খাওয়ানো যায়। তা না হলে তো আবার তোমার হাতের রান্নার স্বাদ ভুলে যেতে হবে।
– দেখি, কি কি রান্না করেছো।
নাজিয়া ঢাকনা খুলে একে একে সব দেখে তারপর বেরিয়ে গেলো বাইরে থেকে কাপড়চোপড় নেওয়ার জন্য। মাগরিবের আযান পড়ে গেছে। দুইভাই রান্না শেষ করে আবার গোসল সেড়ে নামাজ পড়তে মসজিদে গেলো। নামাজ আদায় করে নাজিয়া তার মায়ের সাথে ফোনে কথা বললো। আরাফের পর সে মাকে জানালো তার প্রেগন্যান্সির কথা। নাফিসা শুনে তো বাবুদের নাম রাখতেও শুরু করে দিয়েছে! তবে নাজিয়া সাবধান করে দিয়েছে, মেয়ে বাবুর নাম নিয়ে না ভাবতে। কারণ, মেয়ে বাবুর নামটা যে আরাফ রেডি করে রেখেছে! তবুও নাফিসা ভাববে। কেননা আরাফ যেটা রেখেছে সেটা ডাক নাম থাকবে আর একাধিক নাম রাখবে নাফিসা। সেই অধিকারও আরাফের সাথে কথা বলে আদায় করে নিয়েছে নাফিসা। এই প্রথম আরাফের হাতের রান্না খেলো নাজিয়া। মজা লেগেছে বেশ। বলা যায় তারা দুই ভাই পাক্কা রাধুনি! কিন্তু সেটা খাবার না খেলে বুঝা যাবে না। কেননা, প্রথমে কিচেনে গিয়ে এক একজনের যেই অবস্থা দেখেছিলো! মনে তো হয়েছিলো রান্নার র’ও জানে না! বারোটা বুঝি বাজিয়ে ছেড়েছে তারা! কিন্তু ফলস্বরূপ ভিন্ন স্বাদ পেয়েছে।
.
মেহতাজের বাড়ি যাবে নাহিদাকে নিয়ে। তাই আজ তারাতাড়িই বাড়ি ফিরেছে মেহেদী। নাহিদাকে বলে গিয়েছিলো রেডি হয়ে থাকতে। কিন্তু নাহিদা এখনো রেডি হয়নি! মাত্র গোসল সেড়ে এসেছে! মেহেদী বললো,
– এখনো রেডি হওনি! কি করছিলে এতোক্ষণ!
– মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছিলো, তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে দেখি দুপুর হয়ে গেছে!
– মাথা রিমঝিম করে কেন! মাথার ভেতর তেলাপোকা নৃত্য করে নাকি!
– তোমার মতো তো, আমি তেলাপোকা পুষি না যে মাথায় গিয়ে নৃত্য করার সাহস পাবে!
মেহেদী হাহাহা করে হেসে উঠে বললো,
– দ্রুত রেডি হও।
– নামাজটা পড়ে নেই। রেডি হতে বেশিক্ষণ লাগবে না। বোরকা আর হিজাব পড়বো।
– শাড়ি আর হিজাব পড়ো।
মেহেদী বাথরুমে চলে গেলো। পোশাক নির্ধারণ করে দেওয়ায় নাহিদা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। দুজনেই রেডি হয়ে মেহেরুনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো। রিকশা ভাড়া করলো রেস্টুরেন্টের ঠিকানায়! নাহিদা তার সাথে রিকশায় উঠে বললো,
– আমরা কি আপুর বাসায় যাচ্ছি না?
– না, আপুর শ্বশুরের বাসায় যাচ্ছি।
– একই তো হলো না! তো রেস্টুরেন্টের কথা বলে রিকশা নিলে কেন!
– একচুয়ালি, আমি আপুকে বলেছি রাতে আসবো। তার মানে আপু রাতের জন্য রান্না করবে। এখন যদি আপুর বাসায় যাই, তাহলে তো আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে! আপুও খাবার না দিতে পেরে লজ্জায় পড়ে যাবে। তার চেয়ে ভালো আমরা রেস্টুরেন্টে খেয়ে তারপর যাই। কি বলো!
– ছি! কি আজব চিন্তাভাবনা! এমনটা হলে বাসা থেকে খেয়ে এলে না কেন!
– রেস্টুরেন্ট খাবো বলে।
– রাতের কথা বলেছো যেহেতু, অফিস টাইম শেষে এলে কি হতো!
– একটু ছুটি পেতাম না!
– ফাকিবাজ হয়ে যাচ্ছো আবার!
– তোমার মুখে লিপস্টিকের বদলে সুপারগ্লোভ লাগানোর প্রয়োজন ছিলো! রেস্টুরেন্টে ডেটে যাচ্ছি, ভালো লাগছে না! একের পর এক শুধু উল্টাপাল্টা প্রশ্ন!
মেহতাজের বাড়ির সামনে রিকশা থামালে নাহিদা নেমে যেতে নিলো। মেহেদী তার হাত ধরে বললো,
– এই, কোথায় যাও!
– আপুর বাড়ির সামনেই তো রিকশা থামালে! নামবো না!
– রেস্টুরেন্ট এসেছি? চুপচাপ বসো।
মেহেদী গলা বাড়িয়ে দাড়োয়ানকে ডেকে তাদের কাপড়ের ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে বললো আসিফ ভাইয়ার ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দিতে। নাহিদার মাথায় গোলমাল লাগছে! কি চাইছে মেহেদী, বুঝতে পারছে না। কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারছে না মেহেদীর নিষেধে। মেহেদী একহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– ব্যাগটা ঝামেলা করছিলো তাই ঝামেলা কমিয়ে দিলাম। ভালো হয়েছে না?
রিকশায় এভাবে জড়িয়ে ধরে বসায় নাহিদার লজ্জা ও অসস্তি লাগছে খুব! তবুও কিছু বললো না, কেননা মেহেদীকে উপেক্ষা করতে পারবে না সে। তাকে উপেক্ষা করার কোনো ইচ্ছেও নেই তার মাঝে! রেস্টুরেন্টের সামনে এসে নেমেছে এমনি মেহেদীর ফোন বেজে উঠলো। ভাড়া প্রদান করে কল ব্যাক করতেই মেহতাজের কন্ঠ শুনতে পেলো,
– ওই, তুই কোথায়?
– এইতো, বউকে নিয়ে তোমাদের ঢাকা শহর ঘুরতে এলাম।
– আমাদের ঢাকা শহর! তুই কি নোয়াখালী থাকিস নাকি!
– মনে হয়!
– ব্যাগ পাঠিয়ে তুই চলে গেলি কেন! আমি রান্নাবান্না করে বসে আছি। তোরা এলে একসাথে খাবো!
– এখনো খাওনি! ক্ষুধা তো মনে হয় বেশিই লেগেছে! সুতরাং বেশি বেশি খেয়ে নাও। আমরা সন্ধ্যায় আসছি।
– আমি বেশি বেশি খেয়ে নিবো! তুই আয় বাড়িতে! তোর খবর আছে!
– এমন হুমকি দিলে আসবো নাকি!
– তোর আসতে হবে না। নাহিদাকে দিয়ে যা।
– আমি যাবো না, আমার বউ যাবে! তা কি করে হয়!
– রাগিয়ে দিচ্ছিস কিন্তু!
– আচ্ছা, মাথা গরম করে আবার আয়াশ আরিশাকে মেরো না। আসার সময় আইস্ক্রীম নিয়ে আসবো তোমার জন্য। কিন্তু শর্ত একটাই, আইস্ক্রীম খাবে আয়াশ আরিশা।
মেহতাজ হেসে উঠেও ধমকে বললো,
– ফোন রাখ, আর তারাতাড়ি ফিরবি।
নাহিদা দাড়িয়ে দাড়িয়ে হাসছিলো তাদের ভাইবোনের কথা শুনে। মেহেদীকে বললো,
– মিথ্যে বললে কেন?
– কখন?
– তুমি না বললে সন্ধ্যার কথা বলেছো!
– আমি তো সন্ধ্যার কথাই বলেছি। আপু বলেছে দুপুরে এসে যেন লাঞ্চ করি। তাতে আমি রাজি হয়েছি নাকি, যে মিথ্যে হয়ে গেছে আমার কথা!
খুব প্যাচাতে পারে কথা! তাই নাহিদার আর কথা বাড়ালো না। দুজন এসে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে নিলো। অত:পর টুকটাক কথা বলতে বলতে রমনার দিকে একটু হাটলো। খোলামেলা ও তুলনামূলক শান্ত পরিবেশ। ভালোই লাগছে মেহেদীর সাথে হাটতে। হিমেলের সাথে দেখা হয়েছিলো তাদের। হিমেল দু চার মিনিটের মতো সময় কাটিয়ে চলে গেছে। রমনা থেকে রাস্তায় বের হয়ে দেখা পেলো টনিকের! দুজনের জন্য দুইটা কিনে নিলো মেহেদী। অত:পর আইস্ক্রীম কিনে রিকশা নিলো মেহতাজের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। মেহেদীর টনিক শেষ হতেই দেখলো নাহিদারটা অর্ধেক বাকি। তাই জিজ্ঞেস করলো,
– ঝাল লাগছে?
– ঝাল খাবার তো ঝাল লাগবেই।
– দাও আর খেতে হবে না। ঝাল খেলে মাথা ব্যাথা করবে আবার।
কথাটা বলার পরপরই নাহিদার হাত থেকে নিয়ে বাকিটা মেহেদী খেতে লাগলো। নাহিদা তার দিকে অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে! চোখদুটো ছলছল করছে! এই মেহেদী একদিন বিরিয়ানিকে বলেছিলো তার এটো খাবার! অথচ আজ তার মুখে ছোয়া এটো খাবারই অনায়াসে খেয়ে নিচ্ছে! কোথায় গেল সেই মনোভাব, আর কোথায় গেলো সেই ঘৃণা! কিভাবে পারলো আজ এটো খাবার খেয়ে নিতে! টিস্যু দ্বারা চোখ মুছে নিতে দেখে মেহেদী বললো,
– ধুলাবালি লাগছে?
– উহুম।
– তাহলে?
– এমনি।
– পানি এসে গেছে তবুও বলছো এমনি! একটা সানগ্লাস পড়ে বের হলে না!
কথাটা বলে নিজেরটাই খুলে পড়িয়ে দিলো নাহিদাকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here