নিভৃতে_যতনে Part_46 last part

1
5600

নিভৃতে_যতনে
Part_46 last part
Writer_Asfiya_Islam_Jannat

হৃদিপুর রুমে সামনে তাকে ডাকতে গিয়েও থমকে গেলাম, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম দরজার ধারেই। মুহূর্তেই মনের দুয়ারে উঁকি দিলো কিছু তিক্ত স্মৃতি। স্মৃতিগুলো মাথা চাড়া দিতেই চোয়েল দু’টি শক্ত হয়ে দৃষ্টি কঠোর হয়ে উঠলো আমার। আমি চোয়াল দুটো শক্ত করে কটমট দৃষ্টিতে সামনে তাকালাম। আমার থেকে ঠিক পাঁচ-ছয় হাত দূরেই হৃদিপু পাশে কিয়ারা দাঁড়িয়ে আছি। আশেপাশে আরও অনেকজনই আছে। তাদের সাথেই হেসে-খেলে কথা বলছে সে। আমি কিছু না বলে দরজার সামনে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। খানিকের মাঝেই আমি হৃদিপুর দৃষ্টিতে পড়তেই সে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে আসতে উৎফুল্ল সুরে বলে উঠে,

— সিয়া তুই এসেছিস!

আমি কিয়ারার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে হৃদিপুর দিকে দৃষ্টি স্থির করি। নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে ঠোঁটের কোনে সরু হাসির রেখা টেনে বলি,

— বাহ রে! আমার একমাত্র বোন প্লাস হবু ভাবীর বিয়ে আর আমি আসবো না? তা কি হয়?

হৃদিপু কিছু না বলে আমার সামনে এসে নিবিড়ে জড়িয়ে ধরে। অস্ফুটস্বরে বলে,

— ভেবেছিলাম আসবি নারে তুই।

আমি আপুকে জড়িয়ে ধরে বলি,

— রাগ তো তোমার উপর না যে আসবো না। আমার কাছে সবার উর্ধ্বে তুমি ছিলে,আছো আর সবসময় থাকবে৷

হৃদিপু আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার কপালে ছোট একটা চুমু খেয়ে বলে,

— অনেক বড় হয়ে গিয়েছিস তাই না?

আমি স্মিত হাসি দিতেই হৃদিপু একপলক আমার দিকে তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়৷ অতঃপর আমার দিকে ঘুরে ইতস্ততসুরে বলে,

— তুই গিয়ে নাহয় ড্রয়িংরুমে বস। এইখানে তো অনেক মানুষের ভীড়।

হৃদিপু যে কিয়ারার অস্তিত্ব কথা জেনে আমাকে এই রুমে রাখতে চাইছেন না তা বেশ বুঝতে পারছি। হয়তো আপু ভাবছে এইখানে থাকলে আমাকে অতীতের পুরোনো স্মৃতিগুলো ধাওয়া করবে, পিড়া দিবে আমায় বেশ। তাই কৌশলে সরিয়ে ফেলতে চাইছে আমায়। এই মেয়েটা নিজের খুশির মাঝেও আমায় আগলে রাখতে ভুলবে না। এই ভালোবাসা কি আদৌ মাপ-তোল করা সম্ভব? আমি ঠোঁটের কোনে মিষ্টি এক হাসি ঝুলে শীতল কন্ঠে বলি আমি,

— আমি ঠিক আছি। চিন্তা করো না। কোন তুচ্ছ মানুষের উপস্থিতি এখন আমার মাঝে ভাবান্তর সৃষ্টি করে না বুঝলে।

কথাটা বলেই আড়চোখে কিয়ারার দিকে তাকালাম। তার মুখটা কেমন চুপসে আছে। মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার পানে। আমি সেই দৃষ্টি তোয়াক্কা না করে হৃদিপু হাত টেনে নিয়ে গেলাম আয়নার সামনে। এখনো কিছু গহনা পড়া বাকি বলে নিজ হাতে সেগুলো আপুকে পড়িয়ে দিতে থাকলাম। মাঝে মধ্যে খুনসুটি করতে থাকলাম বেশ। অবশেষে আপুর সাজ শেষ হতেই মা আর বড়চাচী এসে হৃদিপুকে ছাদে নিয়ে যায়। ছাদে যাওয়ার আগে হৃদিপু আমার হাতটা ধরে বিনয়ী সুরে বলে,

— আমাকে হলুদটা প্লিজ লাগিয়ে যাস। এইভাবে চলে কিন্তু আমি রাগ করবো।

আপুর এই ভালোবাসা মাখা আবদার আমি ফেলতে পারিনি। তাই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম তার কথায়। হৃদিপু রুম থেকে বেরুতেই এক এক করে সকলে বেরিয়ে পরে। আমিও বেরিয়ে আসতে নিলে পিছন থেকে কিয়ারা বলে উঠে,

— কেমন আছিস সিয়াশা?

আমি এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেও ক্ষণেই নিজেকে সামলে নেই। পিছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে এক প্রশস্ত হাসি দিয়ে বলি,

— দেখেই বুঝতে পারছো বেশ ভালো। তা তুমি ভালো আছো তো?

কিয়ারা স্মিত হেসে বলে,

— এইতো। শুনলাম বিয়ে করেছিস?

— সে তো বেশ আগেই। তা আমার খোঁজ-খবর রাখা হচ্ছে নাকি? ভালো আছি নাকি খারাপ জানতে চাইছো বুঝি?

কিয়ারা ইতস্তত সুরে বলে,

— না মানে..

আমি একটু আয়েশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— আমার সম্পর্ক জেনে কি করবে শুনি? নতুন করে কোন আগুন লাগাইতে চাইছো আমার জীবনে?

কিয়ারা মলিন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— যার জীবনই আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে সে কি আর অন্যের জীবনে আগুন লাগাবে?

— মানে?

— তেমন কিছু না। শুধু বুঝে নে নিজের করা পাপের এই শাস্তি পাচ্ছি।

কথাটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্র আমি শীতল দৃষ্টিতে কিয়ারার দিকে তাকাই। বুঝার চেষ্টা করি কথার অর্থ। সেই সাথে পর্যবেক্ষণ করি তাকেও। মলিনতায় পরিপূর্ণ চেহেরা। চোখের নিজের গভীর গর্ত পড়েছে। আগের চেয়ে সৌন্দর্য হ্রাস পেয়েছে বেশ। বলতে আগের মত অপারময় সৌন্দর্য তার মধ্যে এখন বিদ্যমান নেই। স্বাস্থ্য যেন তিন ভাগের এক ভাগ রয়ে গিয়েছে। হঠাৎ দৃষ্টি গিয়ে স্থির হয় কিয়ারার কাঁধের দিকে। ব্লাউজের সাইড দিয়ে স্পষ্ট কালচে এক দাগ ভেসে উঠেছে। ভালো মত পর্যবেক্ষণ করার পর বুঝতে পারলাম এইটা মারের দাগ। বেল্ট জাতীয় কিছু দিয়ে মারলে যেমন দাগ হয় ঠিক তেমনই। আমি চটজলদি জিজ্ঞেস করে উঠি,

— কাধের পাশে ওটা কিসের দাগ?

ক্ষণেই কিয়ারা ভরকে যায়। নিজের শাড়ির আঁচল দ্রুত উপরের দিকে টেনে নিয়ে বলে,

— কোথায়? কোন দাগ নেই তো।

কথাটা কর্ণপাত হতেই ভ্রু কুটি একত্রিত হয়ে আসে আমার। কিন্তু ক্ষণেই আমি বিষয়টা নিয়ে বেশি না ঘেটে জিজ্ঞেস করি,

— তা আর কিছু বলবে নাকি? আমার আবার যার-তার সাথে কথা বলতে রুচিতে বাজে।

কিয়ারা আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— আসলেই আমার মত নিকৃষ্ট মনের মানুষের সাথে কথা বলতে সকলের রুচিতে বাঁধা উচিৎ।

আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই কেউ হুরহুর করে রুমের মাঝে ঢুকে পড়ে। কিয়ারাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে গিয়েও আমাকে দেখে চুপ বনে গেল সে৷ হঠাৎ কঠোর কন্ঠে বলে উঠে,

— তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে কিয়ারা।

আমি একপলক লোকটার দিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। বয়সে ঢের বড়। বলতে আঙ্কেলদের টাইপ। ভুড়িওয়ালা পেট,সাথে গায়ে ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি। চোখে তেজ ভরা। দেখে যতটুকু বুঝলাম এই লোকটাই কিয়ারা স্বামী৷ কিয়ারার বিয়ের সময় আমি ছিলাম না, সেই সাথে বিয়ের দুইমাসের মাঝেই কিয়ারা দেশ ছাড়ায় তার স্বামীকে দেখার সুযোগ আর হয়ে উঠেনি আমার। কিন্তু হৃদিপুর ফোনে তার ছবি একবার দেখেছিলাম। হঠাৎ কিয়ারা কম্পিত কন্ঠে বলে,

— জ্বী! আপনি রুমে যান আমি আসছি।

লোকটি রুম ত্যাগ করার আগেই আমি বলি,

— আপনারা কথা বলুন আমি আসছি।

কথাটা বলেই দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসলাম আমি। দরজার পেরিয়ে একটু সামনে যেতেই কারো তেজী কন্ঠে আওয়াজ শুনে থমকে যাই আমি।

— এই তোকে না আমি বলেছিলাম আমার জন্য কফি দিতে? এখনো দিস নি কেন? এইখানে এসে পাখা গজিয়ে গেছে নাকি?

মুহূর্তেই কিয়ারা ভড়কে যায়। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে ভয়ে। কম্পিত সুরেই বলে উঠে,

— মাকে বলেছিলাম তো। হয়তো এত ব্যস্ততায় ভুলে গিয়েছে।

— হারাম**, দুই মিনিটের মধ্যে কফি না পেলে খবর আছে তার৷ পিঠের ছাল একটাও থাকবে না মনে রাখিস।

আমি আর সেখানে দাঁড়ালাম না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম ড্রয়িংরুমে। স্বামী-স্ত্রী ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাকগলানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই৷ আর সেটা যদি হয় কিয়ারা তাহলে তো আরও নয়।

____________________

ছাদে হট্টগোল হচ্ছে বেশ। গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠেছে সকলে। সকলেই একেক করে হৃদিপুকে হলুদ ছোঁয়াচ্ছে। আমিও গিয়ে হৃদিকে হলুদ ছুঁয়ে দিলাম। অতঃপর ছাদের এক কিনারে দাঁড়িয়ে থাকলাম। অন্যপাশে পাত্রপক্ষ থেকে আসা সকলকেই আপ্যায়ন করা হচ্ছে বেশ। জোর করে তাদের খেতে বসিয়ে দিয়েছে এই বাড়ির অভিভাবকরা। আমাকে জোর করলেও খিদে নেই বলে চলে আসি৷ এই বাড়ির কিছু খাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। আমি শীতল দৃষ্টিতে নাচ-গান দেখছি। সেই সাথে ভাবছি আগের কথা। আড়াই বছর আগে, এমনই একদিনে আমি মুখভার করে স্টেজে বসেছিলাম, মনে বিয়ের ভাঙ্গার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। কিন্তু তখন আকাঙ্ক্ষাটা পূরণ হয়নি। উলটো রাগের বসে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। করে ফেলেছিলাম বিয়ে। কিন্তু সেটাই যে আমার জীবনের বেস্ট ডিসিশন হবে তা কি তখন জানতাম? উঁহু! জানতাম না। আর জানতাম না বলেই হয়তো এমন অমূল্য রত্ন পেয়েছি আমি। আজ ভাবি, তখন যদি বিয়েটা না হতো তাহলে নিভৃতে গড়া মানুষটিকে আপন করে পেতাম না। জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিটাই হয়তো হারাতাম।
কথাটা ভাবতেই বুক চিরে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে আমার। আমি নিস্তেজ চোখে সামনে তাকাতেই হঠাৎ রোয়েন আমার পাশে এসে দাঁড়ান। আমি সচকিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাই। অন্যপাশে খাবারের টেবিলে বসা সকলের দিকে নজর বুলিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— না খেয়ে চলে আসলেন যে, খাবেন না?

রোয়েন নির্লিপ্ত কন্ঠে বলেন,

— ইচ্ছে করছে না।

— ইচ্ছে করছে না মানে কি? আপনি কিন্তু দুপুরের পর থেকে একদম না খাওয়া। যান খেয়ে আসুন নাহলে শরীর খারাপ করবে।

রোয়েন আমার দিকে শীতল চাহনি নিক্ষেপ করে বলে,

— সেও তো না খাওয়া। আগে তাকে বলো খেতে তারপর না-হয় আমি খাব।

আমি কিছু না বলে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকে দেখতে থাকি৷ খানিক বাদে স্মিত হেসে বলি,

— বাসায় গিয়ে খাব।

রোয়েন পকেট থেকে একটা চকলেট এগিয়ে দিয়ে বলেন,

— আপাতত এইটা খাও।

চকলেটটা দেখে আনমনে হেসে উঠি আমি। তাঁর এই ছোট ছোট কেয়ারগুলোই তো মোহিত করে আমায় তাঁর প্রতি। আমি নীরবে চকলেটটা নিয়ে খেতে থাকি। মাঝে মধ্যে রোয়েনকেও খায়িয়ে দেই। তিনি না খেতে চাইলেও জোড় করে খাওয়াই। খাওয়া শেষ হতেই রোয়েন বলে উঠেন,

— স্বাদে কি বাচ্চা বলি?

আমি কৌতূহল দৃষ্টিতে রোয়েনের দিকে তাকাতেই তিনি টিস্যু বের করে আমার ঠোঁটের পাশের ময়লাটুকু ঝেড়ে দিয়ে বলেন,

— বাচ্চা একটা।

আমি নাক ফুলিয়ে কিছু বলতে যাব তার আগেই তিনি বলেন,

— ওদের খাওয়া হোক এরপরই রওনা হবো আমরা।

আমি সম্মতি জানিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে নেই। খানিক বাদেই এক পিচ্চি এসে আমায় জানায় মা আমায় খুঁজছে। আমি যাতে একটু নিচে যাই। আমি রোয়েনকে বলে নিচে যাব বলে চলে আসি। কিছু দূর যেতেই কিয়ারার দিকে নজর যায় আমার। সে নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমার পানে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি তাঁর মলিন। হঠাৎ খেয়াল করলাম বা গালটা কেমন অদ্ভুত রকম লাল হয়ে আছে। কিছু একটা আন্দাজ করেও মুখ ঘুরিয়ে নিলাম আমি। কারো বিষয় নিয়ে ঘাটার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। যে যেমন আছে থাকুক আমার কি?
আমি নীরবে সিড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। সিড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতেই ওসমান সাহেবের সাথে আমার মুখোমুখি হয়ে যায়। আমি তার প্রতি তেমন একটা আগ্রহ না দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে তিনি বলে উঠেন,

— ভালো আছো, মা?

ক্ষণেই বুকটা মোচড়ে উঠে আমার। নিঃশ্বাস কেমন ঘন হয়ে আসে। অজানা কারণে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় হাজার গুণ। নয়ন দুটো ভার হয়ে আসতে শুরু করে। কোন মতে নয়ন দুটির পাতা বুজে নিজেকে সামলে নেই। অতঃপর পিছনে ঘুরে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলি,

— জ্বী আমাকে বলছেন?

— তুমি ছাড়া আশেপাশে আছেই বা আর কে?

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলি,

— এই বাসায় এত স্নেহময় কন্ঠে কেউ আমার সাথে কথা বলতে পারে বলে আমি আশা করি না। তাই সিউর হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম৷

ওসমান সাহেব ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,

— অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি না তোমায়?

— কষ্ট কম বেশিও হয় বুঝি? জানতাম না তো। আর কিসের কষ্টের কথা বলছেন আপনি?

— মজা করছো?

ঠোঁটের কোনে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বলি,

— সেই সম্পর্ক আমাদের নেই। বলতে কোন সম্পর্কই নেই আপনার আমার মাঝে৷

— এতদিন চক্ষুলজ্জার জন্য চুপ ছিলাম। সাহস হয়নি তোমার সাথে কথা বলার। এমনকি বাড়ির কারোই। কিন্তু আজ যেহেতু সামনে এসেছ তাই সামনাসামনি বলছি, ক্ষমা করে দাও আমাদের। বড্ড অন্যায় করে ফেলেছি।

আমি নির্লিপ্ত কন্ঠে বলি,

— অহ আচ্ছা।

ওসমান সাহেব বিনয়ী সুরে বলেন,

— সব ভুলে গিয়ে কি ক্ষমা করা যায় না? নতুন করে সব শুরু করা যায় না?

— এতই সহজ ভুলা? বললেই কি সব হয়ে যায়? আপনাকে ক্ষমা করে দিলে আমার জীবন থেকে সেই তিক্ত শৈশবটি মুছে যাবে? শৈশব ফিরে আসবে আমার? বলুন! বছরের পর বছর পাওয়া ওই কষ্টগুলো এখন ক্ষত হয়ে গিয়েছে যা আর নিরাময় হওয়ার নয়। সব এত সহজে ভুলা যায় না। কিছু জিনিস চিরন্তন কাল অন্তরের মাঝে দাগ বসিয়ে যায়।

ওসমান সাহেব আমার একহাত চেপে ধরে বলেন,

— একটা শেষ সুযোগ কি দেওয়া যায় না?

আমি ক্ষণেই দ্রুত গতিতে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে বলি,

— সেই সুযোগ আপনারা ডিজার্ভ করেন না। আর এইভাবেও যদি সেদিন সত্যটা প্রকাশ না হতো তাহলে তো এখনো আপনারা অনুতপ্ত না হয়ে সেই রুক্ষ আচরণেই করতেন। তাই ভেবে নিন, না, আপনারা সত্যিটা জানেনই না। ভুলে যান সেসব কথা। তিক্ত সম্পর্কটাই না-হয় থাকুক আমাদের মাঝে।

— আমার কথা তো..

আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলি,

— আর আমার কথা বাদ দিন। আপনার এখন একটা মেয়েই আছে আর সে কিয়ারা। তাই তাঁর দিকে ফোকাস করুন। ভালো আছে কি-না দেখুন৷ একজনকে তো খোয়েছেনই এখন আরেকজনকে খোয়েন না। ভালো হোক মন্দ হোক মা-বাবার কাছে সন্তান সন্তানই হয়। সেই সময় কথাটা না বুঝলেও এখন বুঝে নিন। হয়তো কারো জীবন নষ্ট হতে হতে বেঁচে যাবে।

কথাটা বলেই চলে আসতে নিলেও থমকে দাঁড়ালাম। ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম,

— ক্ষমা আপনার প্রাপ্য কি-না জানি না কিন্তু একটা ধন্যবাদ ঠিকই আপনার প্রাপ্য। আপনার জন্যই আজ আমি এমন এক পরিবার ও জীবনসঙ্গী পেয়েছি যাদের নিকট থেকে বাঁচতে শিখেছি। ভালোবাসার আসল মানে জেনেছি। তাদের জন্য যদি জীবন দিতে হয়না? আমি ঠিক দিয়ে দিব। তাই ধন্যবাদ আপনায় এই পরিবারের সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে দেওয়ার জন্য।

অতঃপর আর একটা মিনিটও অপেক্ষা না করে আমি দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে আসি। হয়তো অনেকের কাছে আমি এখন পাষান। ক্ষমা করে দেওয়াটাই হয়তো আমার উচিৎ বলে অনেকের মনে হতে পারে৷ কিন্তু সব আদৌ সহজ? সব অন্যায়ের কি ক্ষমা হয়? জীবনের দশটা বছর হোস্টেলেই কাটিয়েছি। একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতায় মাঝের। ভালোবাসা কি বুঝিই নি। সেই ছোট শৈশব হতেই পরিবার ও বাবা আদরের জায়গায় পেয়েছি তাচ্ছিল্য আর অবহেলা। পদে পদে অপদস্ত হয়েছি আমি। কত কি না শুনেছি? কত তিক্তই না ছিল সেই শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলো৷ জ্বরে,রোগে কাউকে পাইনি পাশে। বিছানায় পড়ে কাতরিয়েছি শতবার। কিন্তু দেখার মত ছিল বা কে? কষ্ট কি সামান্য ছিল? ভুলার ছিল এইগুলো? ছোট মনে পাওয়া সেই আঘাত গুলো দাগ কেটে গিয়ে এখন ক্ষত হতে গিয়েছে। গভীর ক্ষত। যা হয়তো কখনো কোনকিছু ভুলতে দিবেও না, ক্ষমাও করতে দিবে না। কিন্তু নীরবে ঠিকই একবার চেষ্টা করব ক্ষমা করার। তাদের শান্তির জন্য না, হাশরের ময়দানে নিজেকে ভারমুক্ত রাখার জন্য।

_______________________

আজ আরহান ভাইয়া আর হৃদিপুর বিয়ে। একটু আগেই বর ও কনে-কে একত্রে স্টেজে বসানো হয়েছে। একটু পরই হয়তো বিয়ে পড়ানোর কার্যক্রম শুরু হবে। কিছু কাজের সুবাদে আমি মা আর তানিয়া ফুপুর সাথেই থাকছি বেশির ভাগ। খানিকবাদে মা আর ফুপু বড়দের সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথায় জড়িয়ে পড়লে আমি সরে আসি। কোলাহল থেকে একটু দূরে নীরব একস্থান দেখে বসে পড়ি। বিগত রাতে ঠিক মত ঘুম না আসায় ক্লান্ত লাগছে বেশ শরীর। ক্লান্ত দৃষ্টিতে সামনে দিকের তাকাতেই নজরে পরে কিয়ারাকে। ফুল নেক ও ফুল হাতা দিয়ে বানানো একটা লেহেঙ্গা পড়েছে। মুখে ছেঁয়ে থাকা চাপা কষ্ট ভারী মেকাপের আড়ালে পড়ে গেলেও চেহেরায় মলিনতা এখনো বিরাজমান। আর মলিনতা কিসের তা পুরোপুরিভাবে না জানলেও কিছুটা জানি।

হৃদিপু থেকে জেনেছিলাম যে, কিয়ারার নাকি এই পর্যন্ত তিনবার বাচ্চা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেই সাথে পেটের একস্থানে বড় আকৃতির টিউমার ধরা পড়েছে। সেটা অপারেশন নাকি খুবই আশঙ্কাজনক৷ মৃত্যু হলেও হতে পারে। তাই আপাতত কেউ কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। কিয়ারাও নাকি ঘটনার ধার ধরে মানুষিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। উপরন্ত, শেষবার যখন তার বাচ্চা নষ্ট হয় তখন কিয়ারা প্রায় পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তাকে সাইকেটট্রিস দেখিয়ে দীর্ঘসময় চিকিৎসা করিয়ে স্বাভাবিক অবস্থান নিয়ে আসা হয়। কিন্তু তাও পুরোপুরিভাবে না। বাচ্চা জন্যই কিয়ারার সাথে নাকি তার শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক এতটা ভালো না। শ্বশুরবাড়ির লোকজনই এখন তাকে অপয়া,বন্ধ্যা বলে উপাধি দিয়েছে। স্বামীর সাথে কিয়ারার সম্পর্ক আদৌ ভালো কি-না তা হৃদিপু জানে না। কিন্তু দেখে ভালোই মনে হয়েছিল তার। সকলের সাথে সে যেহেতু ভালো কিয়ারা সাথেও সে ভালো হবেই বলে মনে সবার। অবশ্য কিয়ারাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছে সকলেই কিন্তু সে তেমন একটা উত্তর দেয়নি। ভালোই বলেছে। বাড়ির সকলেই কিয়ারার উপর কিছুটা হলেও রুষ্ট তাই এই বিষয় নিয়েও তারা এতটা ঘাটে নি। বাদ বাকি, বিয়েতে বাবা দাওয়াত দিয়েছিল এবং তারাও দেশে এসেছিল বিধায় এই বিয়ে এটেন্ড করছে। নয়তো বা দেশে না থাকার দরুন এই বিয়েতেও তারা হয়তো আসতো না।

এইসব জেনে আমি তখন চুপ ছিলাম। বুঝতে তখন আমার দেরি ছিল না, কিয়ারার স্বামী একজন মুখোশধারী। সকলের সামনে ভালোমানুষির মুখোশ পরে থাকলেও আসলে সে একটা জা***। যে নিজের স্ত্রীকে পিটাতে পারে সে নিশ্চয়ই কোন ভালো মনের মানুষ হতে পারে না। কিন্তু আমি তো শুধু উপরের খবরটুকুই জানি। ভিতরের খবর কি আদৌ আমার জানা? হয়তো এর চেয়েও নিকৃষ্ট কোন পরিস্থিতিতে কিয়ারা আছে কিন্তু তা প্রকাশ করছে। আসলেই পাপ কখনো কাউকে ছাড় দেয় না। ইহকালে হোক আর পরকালেই হোক পাপের শাস্তি তো তোমায় পেতেই হবে। হঠাৎ বুক চিরে দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে আমার। কিয়ারার জন্য একটু মন বিষিয়ে গেলেও তা প্রকাশ করিনা। হয়তো এইটাই তার নিয়তি। আর এই নিয়তিকেই মেনে নিয়েছে সে।

________________________

দেখতেই দেখতে হৃদিপু আর আরহান ভাইয়ার বিয়ে সম্পন্ন হলো। চারদিকে খুশির আমেজ ছড়িয়ে গেলেও বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসতেই বিষাদ ছেঁয়ে যায় আপন মানুষগুলোর মাঝে। হৃদিপু কেঁদে একাকার৷ আমি হৃদিপুকে দেখছি আর নিজের বিয়ের কথা মনে করছি। কতটা পার্থক্য ছিল আমার আর হৃদিপুর বিদায়ের মাঝে। বিয়ে নিয়ে কতটাই না তিক্ত ধারণা ছিল আমার। আশঙ্কা ছিল পরবর্তী জীবন নিয়ে। নিজের স্বপ্ন আগেই মাটির নিচে পুঁতে ফেলেছিলাম। নির্জীব হয়ে মেনে নিয়েছিলাম সব। কিন্তু তখন তো আর জানতাম না, তিক্ত সময়ও একসময় মধুর হয়। আমার স্বপ্ন থেকে শুরু করে অপ্রকাশিত সবই আমি পেয়েছি শুধুমাত্র আমার একান্ত মানুষটার কাছ থেকে। এখন এই মানুষটাকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করা তো দূরের কথা ভাবতে পারি না আমি।
হঠাৎ রোয়েনকে নজরে পড়তে একগাল হেসে দেই আমি। তিনি আমাদের দিকে তাকাতেই দুইজনের দৃষ্টি গিয়ে বাঁধা পড়ে এক সুতোয়। আমাকে হাসতে দেখে তিনি ভ্রু কুঁচকে ইশারায় জিজ্ঞেস করেন, “কি?”
আমি মাথা দুলিয়া, “কিছু না।” বুঝিয়ে আরেক গাল হাসি। কে বলবে এই মানুষটিকে আমি একসময় দুই চোখে দেখতে পারতাম না? সহ্য হতো তাকে? যে কেউ এখন আমায় দেখলে বলবে এই মানুষটাকে আমি চোখে হারাই। এক মিনিটও হয়তো স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারি না তাকে ছাড়া। আর সত্যি কিন্তু তাই।

হৃদিপুর বিদায়ে এখনো বেশ খানিকটা সময় অবিশিষ্ট থাকলে আমি, রোয়েন আর আরহান ভাইয়ার কাজিনরা আগে রওনা দিব বলে বেরিয়ে আসি। রোয়েন চলে যান গাড়ি আনতে আর আমি বাকিদের সাথে দাঁড়াই। মিনিট দুই-একের মাঝে আদিবের কল আসতে আমি তা রিসিভ করি। পড়ালেখা বিষয়ক কিছু তথ্য দিবে বলে আমি সকলের থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকি। কথা বলা শেষে পিছনে ঘুরে দাঁড়াতেই কিয়ারাকে দেখে কিছুটা ভড়কে যাই আমি। কিন্তু সেটা মুখভঙ্গিতে প্রকাশিত হতে দেই না। বরং স্বাভাবিক থেকেই কিয়ারার পাশ কাটিয়ে আসতে নিলে সে বলে উঠে,

— শুন!

আমি থমকে দাঁড়ালেও পিছনে ঘুরে তাকাই না। সামনের দিকের তাকিয়েই জিজ্ঞেস করি,

— কি?

কিয়ারা ইতস্তত সুরে বলে,

— জানি, ক্ষমা চাওয়ার মত মুখ নেই আমার তাই চাইছিও না। শুধু তোকে এতটুকু বলতে চাই, আর বদদোয়া দিস না আমায়। এইভাবেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছি আমি। জীবন্ত থেকেও আজ মৃত আমি৷ সকলের ভালোবাসা পেয়েও যেন বঞ্চিত।

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে তিক্ত সুরে বলি,

— তোমাকে আমি কখনোই বদদোয়া বা অভিশাপ দেইনি আর দিবোও না। কেন না, সেটার যোগ্যও তুমি না।

কিয়ারা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

— আসলেই হয়তো তাই।

আমি সামনের দিকে তাকাতেই কিয়ারা বলে উঠে,

— ভালো থাকিস!

আমি পুনরায় ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকি। অতঃপর শীতল কণ্ঠেই বলি,

— তুমি ভালো বা খারাপ যাই থাকো তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আজ কথাটা বলা উচিৎ বলে বলছি, অন্যায়কে সাঁই না দিয়ে প্রতিবাদ করতে শিখো। নিজের ভালোটা বুঝে নাও সেই সাথে নিজের পথটাও।

কথাটা বলেই দ্রুত গতিতে সেখান থেকে চলে আসি।

_______________________

নিকষকালো আঁধারকে পেরিয়ে এক ফালি চাঁদের স্নিগ্ধ আলো গলিয়ে পড়ছে ধরনীর বুকে। দূর থেকে ভেসে আসছে নিশাচর পাখিদের মৃদু মৃদু ডাক। হিম শীতল বাতাস গায়ে পরশ বুলাতেই কাঁটা দিয়ে উঠছে শরীর। আমি গায়ের ওড়নাটা গায়ের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিয়ে আনমনে খোলা আকাশের দিকে তাকালাম। হৃদিপুকে বাসর বসিয়ে দিয়ে আমি আর রোয়েন চলে আসি। বাসায় এসে দুইজনে ফ্রেশ হয়ে বেরুতেই রোয়েনের আর্জেন্ট কল আসে বলে তিনি বারান্দায় চলে যান আর আমি মা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে আসি৷ দম বন্ধ হয়ে আসছিল ঘরে সেই সাথে অতীতের তিক্ততা ক্ষণেই আমায় হ্রাস করে দিচ্ছিলো বলে নিজেকে স্পেশ দিতেই ছাদে চলে আসা আমার। আমি একমনে আকাশের পানে তাকিয়ে আছি আর জীবনের হিসাব মিলাচ্ছি। আর সেই হিসাবের পাতায় রোয়েনের হিসাবখাতটাই ছিল প্রধান। হঠাৎ ঘাড়ে কারো তপ্ত নিঃশ্বাস পড়তেই আঁতকে উঠি আমি। তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার আগেই কেউ আমার গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে দেয়। ক্ষণেই মানুষটির উপস্তিতি অনুভব করতে পেরে শান্ত হয়ে যাই আমি। চাদরের দুইপাশ মুঠোতে বন্দী করে আগের ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে থাকি। রোয়েন বলে উঠেন,

— শীতে কাঁপবে কিন্তু তাও নিচে গিয়ে চাদর আনবে না। ষ্টুপিড!

আমি হালকা হেসে বলি,

— আপনি আছেন কি করতে? আমাকে দেখা রাখার দায়িত্ব না আপনার?

— কথার জালে ফাঁসাচ্ছো?

— যদি আপনার তাই মনে হয় তাহলে তাই।

রোয়েন কিছু না বলে পাশেই রেলিং-এর উপর দুই হাত রেখে নিজের শরীরের ভর ছেড়ে দেন। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আকাশের পানে। বেশ খানিকটা সময় এইভাবেই নীরবে কেটে যায়। রোয়েনের পড়নের পাতলা একটা গেঞ্জি দেখে বলি,

— আমার জন্য চাদর আনলেন ঠিকই কিন্তু নিজের জন্য কিছু আনতে পারলেন না? আমার চাদর বড় আছে, শেয়ার করা যাবে।

কথাটা বলেই চাদরের একপাশ এগিয়ে দিলাম তাঁর দিকে। তিনি নীরবেই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমার পিছন দিয়ে হাত গলিয়ে কোমড় পেঁচিয়ে ধরলেন৷ অতঃপর দুইপাশ দিয়ে চাদরটা টেনে আবদ্ধ করে নিলেন আমায় তাঁর উষ্ণ আলিঙ্গনের মাঝে। প্রথমে আমি হকচকিয়ে গেলেও পরবর্তীতে নিজেকে সামলে নেই। আমি সপ্তপর্ণে তাঁকে আঁকড়ে মাথা এলিয়ে দেই তাঁর বুকের মাঝে। ক্ষণেই জিজ্ঞেস করে বসি,

— আপনাকে আমার কিছু প্রশ্ন করার ছিল। করবো কি?

— বলো!

আমি জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট দু’টি ভিজিয়ে নিয়ে বলি,

— আপনি আমায় চেনেন কবে থেকে? ছোট বেলা থেকেই নাকি আমাদের বিয়ের সময় থেকে।

রোয়েন নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দেয়,

— ছোট বেলার স্মৃতিতে তুমি আবছা ছিলে স্পষ্ট না। তাই বলতে পারো, বিয়ের কথা যখন উঠে তখন থেকেই চিনি বা জানি।

— আমার না বলা সত্ত্বেও আপনি আমার সম্পর্কে সবই জানতেন। ভালো-মন্দ,পছন্দ,স্বপ্ন এমনকি আমার বলা মিথ্যা সম্পর্কেও অবগত ছিলেন আপনি। যেখানে আমার আপনাকে জানতে বুঝতে এতটা সময় লেগে গেল সেখানে আপনি আমায় শুরু থেকেই বুঝেন, জানেন। কিন্তু কিভাবে? কার মাধ্যমে জেনেছিলেন আমার সম্পর্কে?

রোয়েন কিছুটা সময় চুপ থেকে বলেন,

— সত্যিটা বলবো?

আমি মাথা তুলে জিজ্ঞেস করি,

— আমি নিশ্চয়ই মিথ্যে শোনার আশায় প্রশ্নটা করিনি?

রোয়েন চাপা হেসে বলেন,

— তোমার হৃদিপুর কাছ থেকেই আমি তোমার সম্পর্কে সকল কিছু জানতে পেরেছিলাম। তোমার পছন্দ-অপছন্দ সবই।

আমি বিস্মিত কন্ঠে বলি,

— হৃদিপু মানে? ওয়েট আ মিনিট, তার মানে আপুকে কি আপনি আগে থেকেই চিনেন? হলুদের দিন বলা আমার মিথ্যাগুলো কি তাহলে আপনি এই জন্যই ধরতে পেরেছিলেন? আপনি আগে থেকেই জানতেন আমার বিএফ নেই?

— হৃদিকে আমি আগে চিনতাম না। তোমার সাথে হলুদের দিন কথা বলার পরই চিনেছিলাম তাকে আমি। অতঃপর আমাদের বিয়ের পর থেকেই তথ্য আদান-প্রদান শুরু।

— তাহলে কিভাবে কি?

— তোমার সম্পর্কে আমি আগেই তোমার স্কুল,কলেজে খোঁজ নিয়েছিলাম। তখনই জানতে পেরেছিলাম তোমার বিএফ নেই। আর এইভাবেও তুমি যে মিথ্যা বলছিলে তা তখনই ধরা পড়েছিল যখন তুমি তোমার প্রেমিকের নাম বলতে এত সময় নিচ্ছে। তাই তোমার বলা কথাগুলো তখন আমার গায়ে লাগেনি।

আমি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— যদি জানতে পারতেন আমার বিএফ আছে তখন?

রোয়েন আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেন,

— তাহলে করতাম না তোমায় বিয়ে।

ক্ষণেই আমি মুখ ঘুচে বিরবির করে বলে উঠি,

— ভাগ্যিস! বিএফ ছিল না আমার। নাহলে নিজের ভাগ্যে নিজেই কুড়াল মারতাম।

হঠাৎ রোয়েন বলে উঠেন,

— কেন আমাকে পেয়ে বুঝি তুমি ভাগ্যবতী?

মুহুর্তেই গাল দুটোতে ছেঁয়ে যায় রক্তিম আভা। আমি মাথা নুইয়ে মিইয়ে যাওয়া সুরে বলি,

— প্রশ্ন আমি করবো আপনি না।

রোয়েন নিঃশব্দে হেসে বলে,

— আচ্ছা। তা করো তোমার পরবর্তী প্রশ্ন।

আমি কিছুটা সময় নীরব থেকে নিজেকে গুছিয়ে নেই৷ অতঃপর মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করি,

— আমার অতীত সম্পর্কে কি আপনি আগে থেকেই জানতেন?

— তেমন না। শুধু জানতাম তোমার সাথে তোমার পরিবারের সম্পর্ক ভালো না। কিন্তু এর পিছনে কারণটা তোমার মুখ থেকেই শুনেছিলা।

আমি আলতো হাতে নিজের কানের পিঠে একগাছি চুল গুঁজে দিয়ে জিজ্ঞেস করি,

— আপনার একান্ত মানুষটার জন্য আপনার অনুভূতিগুলো ঠিক কবে জন্ম নিয়েছিল?

— ঠিক জানি না। কিন্তু হ্যাঁ, তার চোখের মায়ায় যখন গভীরভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলাম তখনই বুঝেছিলাম আমার সর্বনাশের পথ এইখান থেকেই। হয়তো অনুভূতির শুরুটা সেখান থেকেই।

কথাটা শুনে আমি লজ্জায় আরও মিইয়ে যাই। রোয়েনের সাথে আরেকটু লেপ্টে গিয়ে মুখ লুকাই। অতঃপর একটা ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করি,

— অতীতকে কি মনে পড়ে?

ক্ষণেই রোয়েন আমার কোমড় শক্ত করে চেপে ধরেন। আমি কিছুটা ব্যথা পেলেও তা প্রকাশ করিনা। বুঝে যাই মাত্র করা আমার প্রশ্ন তাকে রাগিয়ে দিয়েছে বেশ। আমি ভয়ে দুই-চারটা ঢোক গিলতেই রোয়েন চোয়াল শক্ত করে বলেন,

— বার বার অতীতকে টেনে আনা কি জরুরি? আমি আগেও বলেছি এখনো বলছি, অতীতটা তুচ্ছ ছিল। সেটার মূল্য না বর্তমানে আছে, না ভবিষ্যতে। সব জেনে শুনেও কেন তুমি সেই অতীতকেই নিয়ে পড়ে আছো? হুয়াই?

আমি কিছু না বলে চুপটি মেরে তাঁর বুকের মাঝে মুখ গুঁজে রাখি৷ বুঝতে পারি, বড্ড ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছি আমি। রোয়েন বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে নিজেকে সামলে নেন। অতঃপর শীতল কন্ঠে বলেন,

— তুমি কি ইনসিকিউরড ফিল করছো? ভাবছো কোন একসময় আমার অতীত আমার সামনে এসে দাঁড়ালে আমি দ্বিধায় পড়ে যাব? তোমাকে তুচ্ছ করে দিব?

আমি কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার মুখের কোন ভাষা নেই। কেন না, তিনি যেটা ধারণা করেছেন সেটাই সঠিক। কিন্তু কথাটা আদৌ আমি মুখ ফুটে বলতে পারবো না তাই চুপ থাকাটাই বেছে নিয়েছি আমি। রোয়েন আমার নীরবতার মানে বুঝতে পেরে আমায় আরও নিবিড়ভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নেন। আশ্বস্ত কন্ঠে বলেন,

— অতীত তুচ্ছ হলেও বর্তমান না। আর না কখনো হবে। আমি আমার আপন মানুষটার ছিলাম,আছি আর সবসময় থাকবো৷ আর এইটা নিয়ে কোন দ্বিধাদ্বন্দ নেই৷ তার পাশে আমি মৃত্যুর আগপর্যন্ত আছি

কথাটা শুনে আমি মুচকি হাসি। একপলক রোয়েনের দিকে তাকিয়ে মিইয়ে যাওয়া সুরে বলি,

— সরি!

রোয়েন কঠোর গলায়ই বলে উঠেন,

— এই নিয়ে প্রশ্ন যাতে আর দ্বিতীয় বার না উঠে। নাহলে আমার চেয়ে খারাপ তখন কেউ হবে না মনে রেখ।

আমি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাতেই রোয়েন বলে উঠেন,

— প্রশ্ন করা শেষ?

— শেষ একটা প্রশ্ন আছে, আপনার কি আমাদের বিয়েতে মত ছিল? আমার বিয়েতে মত নেই তা জানা সত্ত্বেও কেন বিয়ে করেছিলেন আপনি আমায়?

রোয়েন আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। অতঃপর স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠেন,

— কিছু প্রশ্নের উত্তর অজানা থাকাই ভালো। এই প্রশ্নের উত্তরও না-হয় অজানাই থাক।

হঠাৎ বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস৷ তিনি যেহেতু বলতে চাইছেন না তখন আমি আর জোড় করলাম না। সকল মানুষেরই আলাদা একটা স্পেশ আছে, প্রাইভেসি আছে৷ আর সেখানে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারোই নেই। থাকুক না কিছু প্রশ্ন তোলা। সব প্রশ্নের উত্তর যে জানতে হবে তেমন তো কোন কথা নেই। হঠাৎ রোয়ান আমার নাম ধরে ডেকে উঠেন,

— সিয়া!

পিলেই চমকে উঠি আমি। মাথা তুলে বিস্মিত নয়নে তাকাই তাঁর পানে। এই প্রথম তিনি আমায় সিয়াশা বলে সম্মোধন না করে সিয়া বলে সম্মোধন করছেন। আমার এখন ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে তা প্রকাশ করার মত নয়৷ আমি ছোট করে বলি,

— জ্বী বলুন!

রোয়েন কিছুটা সময় নীরব থেকে বলেন,

— ভালোবাসি তোমায়!

কথাটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্র আমি স্থির হয়ে যাই। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি শুধু তাঁর পানে৷ হঠাৎই চোখ দুইটি বুঝে আসে আমার। ক্ষণেই নয়ন দুটি’ হয়ে উঠে অশ্রুসিক্ত। আজ প্রথমবারে মত তিনি স্বীকারোক্তি করলেন আমার নিকট। তাও বিয়ের এত বছর পর। বিষয়টা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও এর গভীরতা বুঝানো অতি দুষ্কর৷ এতদিন না বললেও ঠিকই বুঝেছি মানুষটা আমায় প্রচন্ড রকমের ভালোবাসে। তখন কিন্তু এমন অনুভব হয়নি যতটা আজ তাঁর মুখে ভালোবাসিটা স্বীকার করায় হচ্ছে৷ আমি রোয়েনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলি,

— আমিও আপনাকে ভালোবাসি, রোয়েন৷ খুব বেশি ভালোবাসি।

কথাটা বলেই লজ্জায় মুখ লুকাই তাঁর বুকের মাঝে। তিনি খেয়াল করেছে কি-না জানি কিন্তু এই প্রথম আমি তাঁর নাম ধরে সম্মোধন করেছি৷ মনে মনে হাজার বার তাঁর নাম উচ্চারণ করলেও মুখে কখনো করিনি। হঠাৎ কপালে তাঁর শুষ্ক ঠোঁটের উষ্ণ পরশ অনুভব করতেই লজ্জায় শতগুণ মিইয়ে যাই আমি। ক্ষণেই তিনি ফিসফিসিয়ে বলে উঠেন,

— ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতির সপ্তপর্ণে
কাব্যিক অক্ষরে গাঁথা মুক্ত মালায়
খানিকটা নিভৃতে, খানিকটা যতনে
তোমার আমার নামটি লিখা।

কথাটা কর্ণপাত হওয়া মাত্র শীতল এক বায়ু বয়ে যায় সর্বাঙ্গ জুড়ে। প্রচন্ড শান্তি অনুভব হয় মনের মাঝে। আমি কিছু না বলে লেপ্টে থাকি তাঁর সাথে৷ শুনতে থাকি তাঁর হৃদস্পন্দনের ধুকপুক শব্দ। হয়তো এইভাবেই আজীবন শুনতে থাকবো তাঁর হৃদস্পন্দনের শব্দটি৷ সেই সাথে, একসময় নিভৃতে যতনেই ইতি টেনে যাবে আমাদের সম্পর্কের মেয়াদরেখা।

?সমাপ্ত?

বিঃদ্রঃ কিছু জিনিস অসমাপ্ত রেখেছি কারণ সেগুলো লিখায় প্রকাশ সম্ভব না৷ উপন্যাসটা শুরু থেকেই ফাস্ট পার্সন হিসাবে লিখা। মানে সিয়াশার প্রেক্ষিতে লিখা৷ তাই এইখানে সিয়াশা নিজে যা জানবে তাই আপনারাও জানতে পারবেন। ও না জানলে কেউই জানবে না। আর পরবর্তীতে সিয়াশা এইভাবেও জানবেনা কারো পরিনতির কথা। তাই সমাপ্তিটা এইখানেই টানা।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here