কৈশোরে প্রেম
অংশ:০২ (১৮ সতর্কীকরন)
নাহিয়ানের হাতে প্রথম প্রেমের প্রথম চিরকুট। তার চোখেমুখে প্রাপ্তির আনন্দ। এই খুশি সে কোথায় লুকাবে! সম্পূর্ণ স্কুল খুঁজে বেড়ায় প্রহেলিকে, কিন্তু কোথাও পায় না। সে ওয়াশরুমে লুকিয়ে ছিল তখন। নাহিয়ানের চোখের আড়ালে থেকেছে সর্বক্ষণ। লজ্জা আর ভয়ের অপূর্ব এক মিশ্রণ ভেতরে বয়ে যাচ্ছে। ছুটির পর আর নিজেকে লুকাতে পারে না। মাঝ রাস্তায় আসতেই ধরে ফেলে তাকে। নাহিয়ান সাইকেলে প্রহেলির পাশাপাশি চলছে। সেদিন থেকে শুরু হয় তাদের প্রেম কাহিনী৷ প্রতিদিন নাহিয়ান তাকে এভাবেই বাড়ির সামনে এনে পৌঁছে দেয়। নাহিয়ানের নিজের একটা নকিয়া মুঠোফোন ছিল। কিন্তু প্রহেলির বাবা তাকে তখনও মোবাইল দেননি। তার মতে, অল্প বয়সে মোবাইল হাতে দিলে বাচ্চাকাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। পড়লেখারও ক্ষতি হয়। কিন্তু প্রহেলি তাদের নাকের নিচে লুকিয়ে মায়ের ফোন থেকে প্রতিদিন নাহিয়ানকে এসএমএস করে। সুযোগ পেলেই মিসডকল দেয় নাহিয়ান তখন কল দেয়। ফিসফিস করে কথা বলে।
স্কুলের ভেতর চিরকুট আদান-প্রদান চলতে থাকে। এই চিরকুট আদান প্রদান মাধ্যম প্রহেলির দিক থেকে অপি আর নাহিয়ানের দিক থেকে দিব্য।
আজ নাহিয়ান প্রহেলিকে দেখা করতে ডেকেছে। স্কুলের পেছনে কলপাড়ের ওপর পাশে নিস্তব্ধ জায়গাটায়। নাহিয়ান এসে অপেক্ষা করছে। সামনে পুকুরের মতো একটা ডোবা। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে প্রহেলি দেখা করতে চলে যায়। এই প্রথম তারা এতটা কাছাকাছি বসেছে। একটুখানি কথা শুরু করতেই ক্লাস শেষের ঘন্টা শোনা যায়৷ দ্রুত উঠে চলে যায় দুজন। ক্লাস থেকে হুড়মুড়িয়ে ছাত্র-ছাত্রী বেরুতে থাকে। কোনোরকমে বেঁচে যায় দুজন। সেদিন থেকে শুরু হয় তাদের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দেখা করা। গল্প, খুনসুটিতে ভালোই সময় কেটে যায়। ওখানে তাদের কতশত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রেমের যত সুখ ছিল সব অনুভব করেছে সেই জায়গায়। গা ঘেঁষে বসে হাত ধরা ছিল তাদের ভালোবাসার প্রথম ছোঁয়া। সামান্য হাত ধরতেই থরথর কাঁপছিল নাহিয়ান। প্রহেলি তো চোখ তুলেই তাকায়নি। তবু পেছনে উৎসাহ দিয়েছে বন্ধুরা৷
ইংলিশ স্যার আসেননি আজ। ক্লাস হচ্ছে না। বেঞ্চের উপর মেহরাব, শুভ্রত আর নাহিয়ান বসে আছে।
শুভ্রত নাহিয়ানকে জিজ্ঞেস করলো, “কতদূর এগুলো রে মামা? চুমু-টুমু খাইছিস নাকি?”
“নারে, হাত ধরলেই ভয় লাগে।”
শুভ্রত হাসতে হাসতে মেহরাবের গায়ে ঢলে পড়ে। যেন কোনো কৌতুক শুনিয়েছে তাকে। মেহরাব আবার এসব কিছুতে নেই। শান্তশিষ্ট ছেলে। মেয়েদের মতো লজ্জা পায়। তাদের দুজনের থেকে বেশ খাটো সে। যার কারণে সবাই তাকে ট্যাবলেট বলে ডাকে।
“কি রে ট্যাবলেট, তুই লজ্জা পাচ্ছিস কেন? তোর আর ইহকালে প্রেম হবে না।”, বলেই শুভ্রত মেহরাবের মাথার চুল এলোমেলো করে দেয়।
কিছুই বলে না মেহরাব। আপন মনে চুল ঠিক করতে লেগে যায়। এদিকে নাহিয়ান শুভ্রতের কথামতো প্রহেলিকে চুমু খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রথম ধাপে হাত ধরে কিছুটা এগিয়েছে। সাহস খানিকটা বেড়েছে। যেহেতু সে তাকে বাঁধা দেয়নি। চুমু খেলেও আপত্তি করবে না। এই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে।
ছুটির আর এক পিরিয়ড বাকি। শেষের ক্লাসটা বাংলা দ্বিতীয়। প্রহেলির বাবা নেন। নাহিয়ান পানি খাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে যায়। প্রহেলির ক্লাসের বাইরে এসে জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। অপির এমনিতেও ক্লাসে মন বসে না। সারাক্ষণ এদিক সেদিক তাকায়। বাইরে নজর যেতেই নাহিয়ানকে দেখে। প্রহেলি বেঞ্চের ওপর প্রান্তে বসে আছে। মাঝখানে পূজা আর ইলমা। অপি ইলমাকে ইশারা করে দেখালো।
ইলমা প্রহেলিকে গুতা দিয়ে বাইরে দেখিয়ে বলল, “দেখ তোর আশিক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।”
বাইরে দৃষ্টি যেতেই দেখল নাহিয়ান এক গাল হাসি মুখে জানালার আড়ালে দাঁড়িয়ে। ইশারায় তাকে কলপাড়ে যেতে বলে। এদিকে ক্লাস শেষ হওয়ার আর বেশিক্ষণ বাকি নেই। এই সময় কেন দেখা করতে ডাকছে কে জানে। তবুও সে ওয়াশরুম যাওয়ার কথা বলে ক্লাস ছেড়ে বেরিহয়ে যায়।
কলপাড়ে যেতেই নাহিয়ান তার একটা হাত ধরে টান দিয়ে সামনে দাঁড় করে। এক হাতে কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নেয়। প্রহেলির চোখজোড়া ক্ষুদ্র হয়ে আসে। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি বেড়ে যায়। কপালের ছোট ছোট চুলগুলো গুঁজে কানের পেছনে। ধীরে ধীরে মুখটা এগিয়ে নেয়। উষ্ণ নিশ্বাস এসে গালের উপর পড়ছে। আলতো করে চুমু খায় গালে। কোনোকিছু বুঝে উঠতে পারে না প্রহেলি। জায়গাতেই যেন জমে গেছে। আচমকা চড় বসিয়ে দেয় তার গালে। নিজেকে ছাড়িয়ে দ্রুত চলে আসে সেখান থেকে। শরীর কাঁপছে তার। কপালে ঘাম জমেছে। নাহিয়ান সেখানেই গালে হাত দিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়। চোখে জল টলমল করছে। ছুটির ঘন্টা পড়ে যায়। অপি নিজের ব্যাগের সাথে প্রহেলির ব্যাগ নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসে। পূজা আর ইলমাকে অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে হয় বলে বিদায় নেয়। বাড়ি যাওয়ার পথে কেবল অপিকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া যায়।
তার চোখে-মুখে ভয় দেখে অপি জিজ্ঞেস করলো, “তোর চেহারার এমন বারোটা বেজে আছে কেন? কী হইছে?”
প্রহেলি প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে সব বলে দেয়। অপি যেন এসব কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ে। সব দোষ উলটা তাকেই দেয়৷
নিজের যুক্তি দিয়ে বুঝাতে বলল, “তুই অল্পতেই হাইপার হয়ে গেলি। আরে ওসব প্রেম-ভালোবাসায় হওয়াটা স্বাভাবিক। সোনা, তুমি প্রেম করবা আর একটু চুমু খাবা না এমন হয় নাকি? প্রেমে তো আরো কতকিছুই হয়।”
প্রহেলির এটা প্রথম প্রেম। সে এসবের কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। অপি অল্প বয়সেই অনেক কিছু বুঝে গেছে। অনেকটা আগ্রহ নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো, “আর কী কী হয় রে?”
সে বেশ খোলামেলাভাবে তাকে বোঝাতে লাগে। নির্দ্বিধায় সবকথা বলে দিতে পারে। এমনিতেও অপির মুখটা একটু অশ্লীল। কোনো কথা আটকায় না। তবে আজ তার কথায় বোঝা গেল সে কেন এই বয়সে এত অশ্লীল হয়েছে। তার প্রেমিক আশহাব নাকি কতদিন তার বুকে হাত দিয়েছে। প্রহেলির চোখ ডিমের মতো বড় হয়ে যায়! এই মেয়ে এসব কী বলছে! মাথা ঠিকাছে তো! পা থমকে যায় তার।
প্রহেলি কিঞ্চিৎ ভ্রু বাঁকিয়ে বলল, “ছিঃ এসব কী বলছিস তুই? লজ্জা করে না তোর? মানে কীভাবে এসব করিস! এগুলো তো ঠিক না।”
“আরে এতে লজ্জার কী আছে! এতে কী সুখ তুই কীভাবে জানবি! আশহাব যদি কখনো চুমু খেতে খেতে বুকে হাত দেয় না তখন আমি নিজেই তার হাত টেনে নেই। আহ! কী সুখ! কখনো ট্রাই করে দেখিস তুই।”
হাতে থাকা অপির ছাতাটা দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় প্রহেলি৷ মেজাজটা আরো তিরিক্ষি করে দিল এই মেয়ে। আর কোনো কথা না বলেই বাড়িতে ঢুকে গেল। অপি পেছন থেকে বেশ কয়েকবার ডাকলো কিন্তু সে কোনো সাড়া দিল না।
বাড়িতে আসার পর অপি দুইবার কল দিয়েছে মায়ের ফোনে। প্রহেলি কথা বলেনি। তবে বারবার অপির বলা কথাগুলো মনে হচ্ছিলো। নাহিয়ান চুমু খাওয়াতে তো তার খারাপ অনুভব হয়নি। তাহলে কেন ওমন প্রতিক্রিয়া দেখালো! সে তো চাইলে তাকে বাধা দিতে পারতো। কিন্তু তাকে তো বাধা দেয়নি। তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই তার হুঁশ আসে। এটা সে কী করলো! নাহিয়ান তো অন্যায় কিছু করেনি। যেকোনো প্রেমিক হলে এমন করতো, সেও তাই করেছে। না জানি কতটা কষ্ট পেয়েছে মনে! এখন তার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে।
চুপিসারে মায়ের রুমে গিয়ে মোবাইলটা লুকিয়ে নিয়ে আসে৷ বাবা বলেছে এসএসসি পরীক্ষার পর তাকেও মোবাইল কিনে দেবে৷ সামনের মাসে তাদের প্রি-টেস্ট পরীক্ষা। এসএসসিতে তাকে জিপিএ -৫ পেতে হবে। নয়তো মোবাইল পাওয়ার স্বপ্ন ভুলে গেলেই উত্তম। বেশ কয়েকটি মেসেজ করে কল দেয় নাহিয়ানকে৷ রিসিভ করে হ্যালো বলতেই প্রহেলির মা ফোনটা টান দিয়ে নিয়ে নেন। গলা শুকিয়ে পানিশূন্য হয়ে আসে। ভয়ে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়৷ আজকের দিনটা তার এতটা খারাপ না গেলেও পারতো৷
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা