“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৪৯
(নূর নাফিসা)
.
.
আরাফ চলে যাওয়ার পরপরই নাহিদা রুমে এসে বললো,
– এটা কি করলে আপু! ভাইয়া যে রাগ করে চলে গেলো!
নাজিয়া তার চোখ মুছতে মুছতে বললো,
– যাক। ডাকবি না আর তাকে। বাবা মা ও যেন আর না ডাকে। নিজের ভালোটা নিয়ে ভাবতে দে তাকে। নিজেকে নতুন ভাবে গড়ে তুলুক।
– আর তুমি?
– আমি আর কি! আমাকে দেখতে পাচ্ছিস না! এমনই থাকবো। আমার জন্য কেউ খেটে মরুক, আমি তা চাই না। আমি অপয়া, আর অপয়াদের কারো সাথে মিশতে নেই। তোরাও থাকিস না আমার পাশে।
নাজিয়ার কান্নাজড়িত কণ্ঠ শুনে রুমানা বেগম রান্নাঘর থেকে চলে এলেন। নাজিয়ার পাশে বসে বললেন,
– কাদছিস কেন, মা। ভেবে নে কিছু হয়নি। সব ঠিক আছে। আল্লাহ যা করে সবটা আমাদের ভালোর জন্য।
নাজিয়া তার মায়ের কাধে মাথা রেখে হু হু করে কেদে উঠলো। নাহিদার একদমই ভালো লাগছে না এসব কান্নাকাটি দেখতে! ক’দিনের জন্যে দুনিয়াতে এসেছে। এই ক্ষুদ্র জীবনের ক্ষুদ্র সময়টুকুতে মানুষের জীবনে কেন এতো দুঃখ এসে হানা দেয়! দেয় তো শুধু দুঃখ দিয়েই যায় না। একটার সাথে আরও দু-চারটা দিক ধ্বংস করে তারপর দুঃখের অবসান ঘটে তা-ও আবার সেটা ক্ষণিকের জন্য! সুখ সুখ করে পাগল মানব আর প্রকৃত সুখী হয়ে উঠতে পারে না!
নাফিসা রুমে এসে দেখলো মা মেয়ে উভয়েই কাদছে। নাহিদা নাফিসার দিকে তাকিয়ে দেখলো নাফিসার চোখও অশ্রুতে টলমল করছে! নাফিসা আবার বেরিয়ে যেতেই নাহিদা রান্নাঘরে চলে গেলো। নাফিসাকে পড়ার জন্য পাঠিয়ে সে রান্নার কাজ সেড়ে নিলো।
নিয়াজ উদ্দিন বাড়ি ফিরে নাজিয়াকে কাদতে দেখে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তিনি মেয়েকে সান্ত্বনা দিলেন। এতে কি আর মন মানছে তার! এক বাচ্চার জন্য আরেক আরাফকে কষ্ট দেওয়ার জন্য উভয় দিকের যন্ত্রণা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে! নাজিয়াকে যথাসম্ভব শান্ত করে নিয়াজ উদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন,
– আরাফ কোথায়?
– চলে গেছে।
– বাসায় চলে গেছে?
– হুম।
– কখন গেলো! আমাকে বললো না তো কিছু! খেয়ে গেছে?
নাহিদা জবাব দিলো,
– খেয়ে যাবে কি করে! আপু তাড়িয়ে দিয়েছে ভাইয়াকে।
নিয়াজ উদ্দিন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন নাহিদার দিকে। নাহিদা আবার বললো,
– আপু নিজেকে অলক্ষুণে ভাবছে আর ভাইয়াকে বলে দিয়েছে যেন আবার বিয়ে করে নেয়।
ওদিকে রুমানার উক্তি,
– ভালো করছে। আর পাঠাবো নাকি আমার মেয়েকে ওই জল্লাদ মহিলার বাড়িতে! কোনো দরকার নাই এমন সংসারের। প্রয়োজনে সারাজীবন আমার বাড়িতে রাখবো। তবুও ওই বাড়ি পাঠাবো না।
নাহিদা বললো,
– মা, এখানে ভাইয়ার দোষ কোথায়! ভাইয়া তো তার ঠিক জায়গাতেই আছে।
– উল্টাইছে ঠিক জায়গায় থেকে! ঠিক জায়গায় থাকলে তার মা তার সামনে ওসব বলে যায় কি করে আমার মেয়েকে! পরের মেয়েতো, তাই মুখে যা আসে তাই ছুড়ে মারে! নিজের মেয়ের ক্ষেত্রে এমনটা হলে দেখতাম ওই মুখটা কেমন হয়! বার বার বলছিলাম খোঁজ খবর নিয়ে বিয়ে দাও। ছেলে ভালো পাইছে আর বিয়ে দিয়ে দিছে। ছেলে এখন তার বাবা-মা ছেড়ে সংসার করে! সবদিক দেখে নিতে হয়। শ্বশুর শ্বাশুড়িই যদি শত্রু হয় তবে সেই সংসারে সুখ কেমনে আসে!
বিষন্ন মন নিয়ে নিয়াজ উদ্দিন উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন। বিষন্নতা এই জন্যে, মেয়ের সংসার বুঝি ভাঙতে চলেছে! না ওদিকে রক্ষা আর না এদিকে! কার বিরুদ্ধে লড়বে আর কাকেই বা চুপ থাকতে বলবে! সবাই যৌক্তিকতা নিয়ে নিজের অবস্থানে স্থির হয়ে বসে আছে! শেষ পর্যন্ত মেয়েটা নিজেও ছেলেটাকে উপেক্ষা করেছে! সেখানে তিনি একা আর কি প্রচেষ্টা করবে! সংসার জোড়া লাগাতে বহুদিক বিবেচনা করে দীর্ঘ সময় নিয়ে ভাবতে হয়। দোষ গুন খুজে খুজে তারপর বন্ধন সৃষ্টি করতে হয়। পরক্ষণে বন্ধনকে অটুট করতে হাজারো রঙের বাহারে সংসার সাজিয়ে তুলতে হয়। অথচ, তিলে তিলে গড়া সেই সাজানো সংসার ভাঙার জন্য একটা কারণই যথেষ্ট! যদিও সময়ের সাথে সাথে এক কারণ থেকে সৃষ্টি হয়ে যায় শত শত কারণ!
রাতে নিয়াজ উদ্দিন অল্প খাবার খেয়ে উঠে পড়লেন। মন ভালো না থাকলে খাবারে রুচি আসবে কোথা থেকে! কারোই তেমন খাওয়া হলো না। নাজিয়াকে জোর করে কিছু খাওয়াতে পেরেছে। কেননা খালি পেটে ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। রুমানা বেগম নাজিয়ার কাছে শুয়েছে। চারিদিকে ঘনিয়ে এসেছে গাঢ় অন্ধকার! প্রকৃতি নিরব হয়ে গেছে। বাইরে শুধু ঝিঝি পোকার ডাক শুনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে একটু আধটু কুকুরের হাকও ভেসে আসছে। নিস্তব্ধ পরিবেশে ঘুমন্ত সকলের মাঝেও কিছু মানুষ আজ নির্ঘুম! কারো দৃষ্টি সজাগ! কারো দৃষ্টি ঘুমন্ত কিন্তু মস্তিষ্ক সজাগ! আবার কারো নিরবে ফেলা অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে বালিশ! আবার কেউ অন্ধকার ঘরে জানালা খুলে আনমনে তাকিয়ে আছে মেঘে ঢাকা ঘোলাটে চাঁদের দিকে! চাঁদটাও যেন আজ আলো ছড়াতে ভুলে গেছে! মনের ঘুম হারিয়ে গেলে চোখে ঘুম আসবে কিভাবে! অশান্ত মন যে সারাক্ষণ শুধু ছটফট করছে! শব্দহীন আর্তনাদ করছে একটু শান্তির খোঁজে! সেদিকে একজন ব্যথিত অভিমানে বসে আছে আনমনে আর এদিকে একজন বালিশ ভেজাতে ভেজাতে চিন্তা করছে,
“সে তো খেয়ে নিয়েছে কিন্তু সমস্ত ক্লান্তি বহনকারী লোকটা কি কিছু তুলেছে মুখে! নিস্তেজ দেহের সেই মানুষটা কি একটু বিশ্রামের জন্য দেহ এলিয়েছে বিছানায়! কাল রাতে তো একটুও ঘুমাতে পারলো না, সে ঘুমাতে পারছে তো আজ! নিশ্চয়ই ঘুম আসছে না আজ তার! আসবে কিভাবে, এদিকে সে নিজেই তো তার ঘুমটা হারাম করে দিলো!”
রাত কেটে কখন সকাল হয়ে গেছে বুঝতেই পারলো না কেউ। ফজরের আযান শুনে সবারই ধ্যান ভাঙলো। কেউ ছুটে চললো মসজিদে আবার কেউ বা ঘরে জায়নামাজ পেতে আদায় করে নিলো জান্নাতের চাবি।
আজ এলার্ম বাজেনি কারো ফোনে। নাফিসার ফোন ড্রয়ারের ভেতর ছিলো আর নাহিদার ফোনে এলার্ম দেয় না। কারণ ওবাড়িতে মেহেদীর ফোনে এলার্ম দেওয়া থাকে। রুমানা বেগম নামাজ পড়ে নাহিদা ও নাফিসাকে ডেকে দিলেন। অত:পর রাতের বেচে যাওয়া খাবারই গরম করে দিলেন। নাজিয়াকে খায়িয়ে ওষুধ খাওয়াতে হবে আবার নিয়াজ উদ্দিন অফিস যাবেন। গতকালের মতো আজ সকাল সকালই লোকজন আসছে নাজিয়াকে দেখতে। একদমই ভালো লাগছে না নাজিয়ার! কোনো কিছু ঘটলে সাথে সাথেই যেন রটে যায় এপাড়ায় ওপাড়ায়! আর শুরু হয় মানুষের সমাগম আর নানান কথাবার্তা! যন্ত্রণার উপর যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিতে যেন তারা ওস্তাদ! সমবেদনা জানাতে তারা যে অঘটন মনে করিয়ে বারবার বুকে ছুড়ি মারছে সেটা কি তাদের খেয়াল আছে! খেয়াল থাকবে কি করে! খেয়াল থাকলে কি আর এতো আলোচনা সমালোচনা করতো! এক একজনের মুখে এক এক কারণ শুনা যাচ্ছে বাচ্চা নষ্ট হওয়ার! যা পরিবারের কারোই শুনতে ভালো লাগছে না! কি ই বা করবে! লোকমুখে তো আর তালা দেওয়া যায় না। মানবতার খাতিরে বেদনার বিষয়বস্তুতে সমবেদনা তো জানাবেই! হোক সেটা গুণ অথবা দোষ উল্লেখ করে!
মেহেদী নাহিদার কাছে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করেছে নাজিয়ার কথা। গতদিন থেকে তাদের মাঝেও তেমন কথা হয় না। তাদের মনমেজাজ ভালো না তাই মেহেদীও তেমন কল করে না। রাতে একবার আর অফিস যাওয়ার আগে সকালে একবার কল করেছিলো বড়জোর দুতিন মিনিটের জানি! “খেয়েছো, সবাই খেয়েছে, কি করছো, ভালো থেকো, নিজের সাথে বাকিদের যত্ন নিও” কথাগুলো এটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। মেহেরুন ইসলামও রুমানা বেগমের সাথে কথা বলেছেন আর নাজিয়ার যত্নাদির ব্যাপারে কিছুটা সতর্কতা প্রদান করেছেন।
দুপুরে আশিক এসেছিলো নাজিয়ার সাথে দেখা করতে। নিজে অসুস্থতা সত্ত্বেও নাজিয়া ওবাড়ির সকলের কথা জিজ্ঞেস করেছে তারা কেমন আছে। আরাফের কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো আরাফ স্কুলে গেছে। আশিক বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেনি এখানে। সে ফ্যাক্টরি থেকে এসেছে লাঞ্চ টাইমে। খাবারের জন্য বললে জানালো খেয়ে এসেছে। দেখা করার পরপরই সে আবার চলে গেছে।
দুদিন দুরাত পেরিয়ে আজ তিন রাত এসেছে, সেই সময়ের পর থেকে আরাফের সাথে একটুও কথা হয়নি! আজ সন্ধ্যায় মাগরিবের পর নাজিয়া ই নিজ থেকে কল করলো আরাফকে। কল রিসিভ হয়েছে কিন্তু অপর পাশ থেকে কোনো শব্দ আসছে না। প্রায় একমিনিটের মতো অপেক্ষা করে নাজিয়া সালাম দিলো। আরাফ সালামের জবাব দিয়ে আবারও চুপ করে রইলো। নাজিয়া জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছো?
আরাফ খুব শান্ত গলায় বললো,
– কল করেছো কেন? বিয়ে করেছি কি-না, বউ কেমন সেই খোঁজ নিতে?
সাথে সাথেই নাজিয়ার গাল গড়িয়ে পানি পড়ছে। কম্পিত কণ্ঠে নাজিয়া বললো,
– সরি। আর বলবো না কখনো।
কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে আরাফের শান্ত গলা শোনা গেলো,
– আগের চেয়ে সুস্থ হয়েছো একটু?
– থাকতে পারছি না তোমাকে ছাড়া! পারবোও না কখনো। একটুও ঘুমাতে পারি না আমি! এসো না একবার। নিয়ে যাও তোমার কাছে।
– মা, তোমাকে আসতে দিবে না।
– তুমি বলে নিয়ে যাও।
– কি বলবো আমি! আর কি ই বা ভরসা দিবো! পারবো কি সব ফেলে রেখে তোমার খেয়াল রাখতে! কিসের ভরসায় মা তোমাকে পাঠাবে আমার সাথে, বলো?
– তাহলে থাকবো কিভাবে আমি!
আরাফের কোনো জবাব এলো না। এর মাঝে রুমে এসে নাফিসা ঘুরে গেছে। নাজিয়া আরাফের সাথে কথা বলছে তাই সে এখানে অপেক্ষা করেনি। নাজিয়া চোখ নাক মুছে বললো,
– কোথায় আছো তুমি?
– রাস্তায়।
– দিনরাত কি এখন শুধু রাস্তায়ই থাকো?
– না, নামাজ পড়ে হাটছি আবছা অন্ধকারে।
– আমাকে ভাবছো না?
– ভাবনার বাইরে কখনো রাখতেই পারলাম না!
– আমার ভালো লাগছে না একটুও। সারাক্ষণ কান্না আসে। কেদেও শান্তি পাই না আমি। তুমি আমাকে নিতে আসবে না আর?
– আমার কি করা উচিত বলতে পারো? আমি আমার বাবা-মাকে বুঝাতে পারি না, তোমার বাবা-মা কে বুঝাতে পারি না, কখনো কখনো তোমাকে বুঝানোরও ক্ষমতা রাখি না! নিজেকে এখন মানুষই মনে হয় না। কাপুরষ হয়ে উঠেছি আমি।
সাথে সাথেই কল কেটে নাজিয়া ঠোঁট কামড়ে ধরে কাদতে লাগলো। আরাফের শান্ত গলায়ও প্রচুর ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে! অনেকটা আঘাত করে ফেলেছে সেদিন উপেক্ষা করে! তারই বা করণীয় কি ছিলো! সংসারের সাধ যে তার মিটে গেছে! দিনরাত এমন কটু কথা শুনতে কার ভালো লাগে! এখন বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে, এখন তো আরও বেশি কথা শুনতে হবে এ নিয়ে! কিন্তু সে কি এখানে থাকতে পারবে! ওদিকে আরাফও যে বিষন্নতায় দিন কাটাচ্ছে! আরাফ যদি ভালো থাকতে পারতো তাহলে না হয় সে নিজেকে এখানে মানিয়ে নিতে পারতো! কিন্তু একজনকে কষ্ট দিয়ে সে শান্তিতে থাকবে কিভাবে! না, সে যাবে আরাফের কাছে। মাকে বুঝিয়ে বলবে সে। মেয়ের সুখে মা নিশ্চয়ই বাধা দিবে না। মা তো পরিস্থিতি দেখে রেগে এমন কিছু বলেছেন। মাকে বললে অবশ্যই যেতে দিবে।