কৈশোরে প্রেম
অংশ: ০৩,০৪(১৮+সতর্কীকরণ)
লিখা: বর্ণালি সোহানা
অংশ: ০৩
ভয়ে বুক ধুকপুক করছে প্রহেলির। কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এক হাতে অন্য হাত মলে যাচ্ছে।
মোবাইল কানে লাগাতেই টুট টুট শব্দ করে লাইনটা কেটে যায়। ওপর পাশে কে ছিল তা আর বোঝা হয় না।
“কতক্ষণ ধরে মোবাইল খুঁজে পাই না। তোর খালাকে কল দিব। আর তুই এখানে কার সাথে কথা বলিস?”, প্রহেলির মা আরফা খাতুন ঝাঁজালো কণ্ঠে বললেন।
প্রহেলি ইতস্তত করে বলল, “ইলমার সাথে কথা বলছিলাম। ও আজকে আমার খাতা নিয়ে গেছে। কাল যেন নিয়ে আসে সেটাই বলে দিলাম।”
আরফা খাতুন ক্ষুদ্র চোখে একবার তাকিয়ে চলে যান। প্রহেলি যেন যমেরবাড়ির দরজা থেকে ফিরে এলো। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এবারে বেঁচে গেল তাই। এই প্রথম মায়ের সাথে মিথ্যে কথা বলল। প্রথম প্রেম তাকে মিথ্যে বলতে শিখিয়ে দিল। না জানি এরপর আর কি বাকি আছে।
সারারাত প্রহেলি ঘুমাতে পারে না। কেবল সকাল হওয়ার অপেক্ষা করছে কখন রাত শেষ হবে আর কখন তার প্রিয় মানুষটাকে দেখতে পারবে। কিন্তু রাত যেন লম্বা হতে থাকে অপেক্ষার প্রহর আর ফুরোয় না সারারাত জাগার কারণে ভোরবেলা চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে। মায়ের ডাকে চোখ খুলে তাকায়। ঘড়িতে তখন ন’টা বেজে চল্লিশ মিনিট। কোনোরকমে তৈরি হয়ে স্কুলের জন্য বেরিয়ে পড়ে। সকালের নাস্তাটাও করে যায় না। স্কুলে এসে দেখে জাতীয় সংগীত শুরু হয়ে গেছে। লুকিয়ে গেটের ভেতর দিয়ে ঢুকে ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে ঘাসের উপর রেখে সারির একদম পেছনে দাঁড়ায়। তার চোখজোড়া কেবল নাহিয়ানকে খুঁজছে। নাহিয়ান সবার সামনে দাঁড়িয়ে।
প্রহেলি কমন রুমে যেতেই ইলমা আর পূজা টেনে কোণায় নিয়ে যায়। অপি স্কুলে এসেই তাদেরকে গতকালের ঘটনা বর্ণনা করে দিয়েছে।
ইলমা তার একটা হাত ধরে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, “তুই তো হারামি রে! প্রেমের মিষ্টি খেয়ে হজমও করে নিলি আর কিছুই বললি না!”
“কেন আমি বললে কী তুইও খেতে পারতি?”, প্রহেলির কণ্ঠে বিরক্তি।
“তুই চুপ থাক তো ইলমা। দেখ প্রহেলি আমি আগেই বলেছিলাম এসব প্রেম টেমে যাইস না। দেখলি তো কেমন লুচ্চা ওই নাহিয়ান। সুযোগে কাল তোকে চুমু দিয়েছে আজ শরীরের অন্য কোথাও হাত দেবে। বোঝার চেষ্টা কর এসব করার বয়স না এটা। আমার মা বলে…”
ইলমা পূজার সামনে দু’হাত জোড় করে বলল, “ওহে, সরস্বতী মাতা, থামেন আপনি।”
অপি পূজার একটা বেণি টেনে দেয়। আঘাত পেয়ে মাথায় হাত দেয় সে। অপি প্রহেলির কাঁধে হাত রেখে বলল, “পূজার কথায় কান দিস না তুই। ও তো তার মায়ের খুকি এখনো। মায়ের কথা ছাড়া পা ফেলে না। নাহিয়ানের চেহারাটা দেখেছিস? মুখটা কেমন কালো করে রেখেছে। আজকে তার রাগ ভাঙা গিয়ে নাহলে পরে সমস্যা বেড়ে যাবে।”
প্রহেলি কেবল নীরবে শুনে যায়। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল কিছুই বুঝতে পারছে না। পূজা আরো একবার ইশারায় সাবধান করে দিচ্ছে তাকে। প্রথম ক্লাস গণিত। বোর্ডে অংক করিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন স্যার। সেদিকে মনোযোগ নেই প্রহেলির। খাতায় কিসব আঁকিবুঁকি করছে। স্যারের নজর পড়ে সেদিকে। অংক বুঝিয়ে দিতে দিতে তার পাশে এসে থেমে যান।
“প্রহেলিকা দাঁড়াও।”
হতচকিত হয়ে দাঁড়ায় প্রহেলি। একমাত্র গণিত স্যার তার পূরো নাম ধরে ডাকেন। এ ছাড়া তাকে আর কেউ প্রহেলিকা বলে ডাকেন না।
“আমি কোন অনুশীলনের কত নম্বর অংক করাচ্ছি বলো দেখি।”
গলার পানি শুকিয়ে এসেছে। একটুও মনোযোগ দিয়ে শুনেনি। এখন কী বলবে সে! তার সামনের বেঞ্চেই বসেছিল পূজা। হাতের ইশারায় বারবার দেখাচ্ছে তাকে। প্রহেলির বুঝতে সময় লাগে না।
অপ্রস্তুত গলায় বলল, “স্যার ৯.২ এর অংক করছি।”
কথায় আটকাতে না পেরে মনোযোগী হতে বলে স্যার নিজের জায়গায় ফিরে যান।
পূজা মাথাটা তার দিকে হেলিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তুই এই প্রেমে জড়িয়ে পড়ালেখার ক্ষতি করছিস তা নিশ্চয়ই তোকে বুঝাতে হবে না। এমন চলতে থাকলে তুই নিশ্চিত ফেল করবি পরীক্ষায়। হাতে বেশি সময় নেই।”
অপি প্রহেলিকে টেনে নিয়ে বলে, “নিজে প্রেম করে না বলে হিংসে করছে তোর উপর। তুই ওর কথায় কান দিস না।”
প্রহেলি আসলেই তার কথায় কান দেয় না। একটা চিরকুটে স্যরি লিখে অপির মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয় নাহিয়ানের কাছে। টিফিন পিরিয়ডের আগে কলপাড়ের পেছনে দেখা করতে বলে। শুভ্রত নাহিয়ানকে বলল, “দোস্ত আজকে প্রহেলিকে এত ভাও দিবি না। দূরে থাকবি। দেখিস কেমনে ময়না খাঁচায় ধরা দেয়।”
প্রহেলি যাওয়ার আগে অপি তাকে আটকে বলল, “দেখ, যদি দেখিস নাহিয়ান বেশি রেগে আছে তাহলে তার ঠোঁটে চুমু দিয়ে দিস। দেখবি সব রাগ পানি হয়ে যাবে।”
ক্ষীণ গলায় বলল, “এটা কী বেশি হয়ে যাবে না?”
“প্রেমে সব বেশি বেশিই হয় আমার জান। যা যা দেরি করিস না। আমি কিন্তু সব শুনবো।”
অপি তাকে ঠেলে পাঠিয়ে দেয়। নাহিয়ান যথারীতি সেখানে পৌঁছে যায়। শুভ্রতের কথামতো আজ দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে। প্রহেলি তার চিবুকে হাত রেখে মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল, “স্যরি, প্লিজ এভাবে রেগে থেক না। আমি আসলে তখন কিছুই বুঝিনি। জীবনে প্রথম তো। আমাকে অপি সব বুঝিয়ে দিয়েছে। প্রেমে এসব মানে চুমু খাওয়া স্বাভাবিক। তুমি আমার সাথে যা করার করতে পারো আমি তোমাকে বাঁধা দিব না। কিন্তু…”
“আমি তোমার সাথে কিছুই করতে চাই না। আমাকে ক্ষমা করে দিও, আমারই ভুল ছিল। তোমাকে স্পর্শ করার আগে অনুমতি নেওয়া প্রয়ো…”
কথা সম্পূর্ণ করার আগেই প্রহেলি দু’হাতে তার গাল ধরে ঠোঁট জোড়া দখল করে নেয়। নিজের আধিপত্য বিস্তার করে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু সে নাহিয়ানকে হারাতে চায় না। নাহিয়ানের পিঠ গিয়ে দেয়ালে ঠেকে। এক হাতে তার কোমর চেপে ধরে। শিউরে উঠে প্রহেলির শরীর। হৃৎপিণ্ডের চলন বেড়ে গেছে। নিশ্বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ঠোঁটের পাতা ছুঁয়ে দিচ্ছে আরেক জোড়া ঠোঁট। নাহিয়ান তার হাত কোমর থেকে উপরের দিকে তুলছে। প্রহেলির কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। ঠোঁট ছেড়ে চোখ মেলে তাকায়। চোখ চোখ পড়তেই লজ্জা পেয়ে যায়। সোজা হয়ে বসে। সামনে চোখ যেতেই আৎকে উঠে সে। দিব্য দাঁড়িয়ে আছে। খালি গলায় ঢোক গিলে প্রহেলি।
জামা আর চুল ঠিক করে দিব্যের দু’হাত ধরে বলল, “তুই কী কিছু দেখেছিস?”
সে নিশ্চুপ মাথা নাড়ে। গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
“কাঁদছিস কেন তুই?”
দিব্য কোনো উত্তর দেয় না। তার হাত কাঁধ থেকে সরিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। নাহিয়ান উঠে বলল, “তুমি ক্লাসে যাও, ছুটির পর দেখা হবে। আর চিন্তা করো না আমি তাকে সামলে নেব।”
প্রহেলি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হৃৎস্পন্দনের শব্দ সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। রাগে কান্না পাচ্ছে। ভয়ে কাঁপছে শরীর। দিব্য বাচ্চা মানুষ। কাউকে বলে দিলে কী হবে তার! স্কুলে মুখ দেখাতে পারবে না। হাঁটতে পারছে না ঠিকমতো। কল চেপে চোখেমুখে পানির ছিঁটা মেরে লম্বা করে নিশ্বাস ফেলে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে। নাহিয়ান সব সামলে নেবে তার বিশ্বাস। কারণ একা তার নাম নয় এখানে তাদের দু’জনের নামই সামনে আসবে।
কমনরুমে বসে আছে একা একা। এখন আর ক্লাসে যেতে পারবে না সে। ভেবেছিল একটু ভালো সময় কাটাবে তা আর হয়ে উঠলো না। এমনিতেও ভয়ে ভয়ে দেখা করতে যায়। যা ভয় করছিল আজ তাই সত্যি হয়ে গেল। টিফিনের ঘন্টা পড়তেই সব ছাত্রীরা হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসে কমনরুমে। অপি, ইলমা আর পূজা এসে চারদিকে ঘিরে ধরে তাকে। কীভাবে বলবে এসব ভাবতেই লজ্জায় মুখ কিছুটা আরক্ত হয় তার। অনুভূতিগুলো ঠিকমতো অনুভব করারও সময় পায়নি। সবকিছু শোনার পর ইলমা আর অপি তাকে খোঁচা মেরে কথা বলে। অন্যদিকে পূজা চুপচাপ বসে থাকে। তার চেহারাটা মলিন। চোখের সামনে বান্ধবীটা ভুল পথে চলে যাচ্ছে সে কিছু করতেও পারছে না।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা
[বিঃদ্রঃ গল্পের স্বার্থে এবং বাস্তবতার সাথে মিল রেখে কিছু ১৮+ কথাবার্তা উঠে আসছে এবং সামনে আরো আসবে। কোনোরকম অশ্লীলতাকে প্রচারের উদ্দেশ্যে কিছু লিখা হচ্ছে না। যাদের পড়তে সমস্যা অবশ্যই এড়িয়ে চলবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।]
কৈশোরে প্রেম
অংশ: ০৪ [১৮+সতর্কতা]
নাহিয়ান প্রহেলিকে চুমু খেয়েছে ভাবতেই দিব্যের দু’চোখে অশ্রুর ফোয়ারা তৈরি হয়েছে। অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে। সোজা হেঁটে ক্লাস রুমে এসে বসে আছে। শার্টের হাতা দিয়ে চোখের জল মুছতেই আবার জল এসে ভরিয়ে দেয়। এই অল্প বয়সে সে এর থেকে বড় আঘাত কখনোই পায়নি৷ তাদের অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে তার কেন খারাপ লাগছে সে জানে না। শুধু এটুকু জানে প্রহেলিকে কেউ ছুঁলে তার কষ্ট হয়। সেদিন যখন প্রহেলি তার গাল ধরে আদর করে দিয়েছিল তখন থেকেই সে তাকে নিয়ে মনের জগতে ভাবতে শুরু করেছে। পড়তে বসলে, খেতে বসলে, গোসলে গেলে, ঘুমাতে গেলে সব জায়গায় প্রহেলিকে নিয়ে ভাবতে তার ভালো লাগে। প্রহেলির হাসি তার ভালো লাগে৷
নাহিয়ান পেছনে এসে তার পাশে বসে। সম্পূর্ণ ক্লাস খালি। সবাই মাঠে যে যার মতো খেলা করছে তো কেউ টিফিন খাচ্ছে। ভয়ে বুকে তিনবার ফুঁ দিয়ে বলল, “দিব্য, কী হয়েছে তোর? ওখান থেকে এভাবে পালিয়ে আসলি কেন?”
কোনো উত্তর দেয় না দিব্য। কপট অভিমানে খানিকটা সরে যায় সেখান থেকে। নাহিয়ান আবার বলে, “দেখ তুই যা দেখেছিস ওটা আসলে একটা খেলা ছিল। আমি খেলায় জিতে গেছিলাম তো তাই তোর প্রহেলি আপু আমাকে মারছিল। বিশ্বাস না হলে তাকে জিজ্ঞেস করে দেখিস৷”
চোখ তুলে তাকায় সে। দু’হাতে চোখের জল মুছে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি খেলা ছিল?”
নাহিয়ান হ্যাঁ সূচক সায় দিয়ে বলল, “আচ্ছা শোন, এই কথা যেন আর কেউ না জানে। আমাদের মাঝেই সিক্রেট থাকুক, কেমন? আমি তোকে কাল চকলেট খাওয়াবো।”
দিব্য ক্লাস থেকে বেরিয়ে যায়। তার চোখ প্রহেলিকে খুঁজছে। কমন রুমের বাইরে আসতেই দেখল প্রহেলি বসে আইসক্রিম খাচ্ছে। দিব্য বাইরে থেকে আওয়াজ দেয়, “প্রহু আপু,”
প্রহেলি আইসক্রিম হাতে দ্রুত বেরিয়ে আসে। দিব্যের হাত ধরে এক কোণায় নিয়ে যায়। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “তখন তুই এভাবে পালিয়ে গেলি কেন? আপুর কথাটা শুনে যেতি। কত করে ডাকলাম। আচ্ছা শোন, তোর নাহিয়ান ভাইয়া কিছু বলেছে তোকে?”
দিব্য দুলিয়ে নেড়ে বলল, “হু, বলেছে। আমিও ওই খেলা খেলতে চাই।”
“খেলা!”
“হ্যাঁ খেলা, যেই খেলায় জিতলে তুমি আমাকে ওইভাবে আদর দিবা।”
চোখের মণিজোড়া বড় তীক্ষ্ণ হয়ে আসে তার। কী খেলার কথা বলে এই ছেলেকে এভাবে এখানে পাঠিয়ে দিল! প্রহেলি দিব্যের দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলল, “তুই এতটুকুন একটা বাচ্চা ছেলে। আমার কোমরে এসে পড়িস। তুই কী পারবি আমার সাথে খেলায়?”
দিব্যের মুখটা মলিন হয়ে আসে। একবার প্রহেলির দিকে তাকায় আরেকবার নিজের দিকে। আসলেই সে তো পারবে না৷ গোমড়া মুখে চলে যাচ্ছিল। প্রহেলি মুখ টিপে হাসছে। পেছন থেকে ডাক দেয়, “এইযে শিল্পী সাহেব শুনে যাও।”
দিব্য কয়েক কদম এগিয়ে মাথা তুলে তাকায় প্রহেলির দিকে। প্রহেলি ঝুঁকে এসে একহাতে তার দুই গাল চেপে ধরে।
“যা পিচ্চি, কোনো খেলা ছাড়াই আজকে তুই জয়ী।”, বলেই তার একটা গালে আলতো করে চুমু খায়।
মুহূর্তেই দিব্যের মুখে হাসি ছড়িয়ে যায়। গালে আইসক্রিম লেগে আছে তার৷ সবগুলো এলোমেলো দাঁত বের করে বলল, “প্রহু আপু আমাকে বিয়ে করবা?”
স্বাভাবিকের চেয়ে চোখ বড় বড় করে তাকায় প্রহেলি। এই পিচ্চি ছেলে তাকে কী বলে! বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে! প্রেমের প্রস্তাব দিলেও না হয় মেনে নেওয়া যেত৷ সোজা বিয়ের প্রস্তাব!
তার একটা গাল টেনে ধরে বলল, “ওরে বুড়ো ছেলেরে! আমায় বিয়ে করবি! তা বিয়ে করে খাওয়াবি কী?”
“কেন! আমি যা খাই তা খাবে।”
“আচ্ছা! তোর মা তো তোকে বসাই বসাই খাওয়ায়। আমাকেও কী নিয়ে বসাই বসাই খেতে দিবে?”
এবার বেশ চিন্তিত দেখায় তাকে। সহসা বলল, “আচ্ছা আমি তোমাকে নিজের টাকায় খাওয়াবো। আমার ব্যাংকে অনেকগুলো টাকা আছে।”
“আর ওগুলো শেষ হয়ে গেলে কীভাবে খাওয়াবে? আমাকে শপিং করানোর টাকা কই পাবে? আমাকে ঘুরতে কীভাবে নিয়ে যাবে?”
কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে দিব্য বলল, “আমি যদি বাবার মতো চাকরি করি তবে বিয়ে করবে? তখন তো আমার মানিব্যাগে অনেক অনেক টাকা থাকবে। সব তোমায় দিয়ে দিব।”
প্রহেলির মিহি হাসির শব্দে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দিব্য। একগুচ্ছ এলোমেলো চুল দিব্যের কপালে এসে চোখ ঢেকে দিচ্ছে। প্রহেলি তার চুলে ফুঁ দিতেই ঢেউ খেলে গেল। ক্ষণকাল চোখ বন্ধ করে আবার তাকায়। প্রহেলি ক্ষীণ গলায় বলল, “তার জন্যে তো ক্ষুদে শিল্পীকে অনেক বড় হতে হতে হবে। অনেক পড়ালেখা করতে হবে। তারপর আমার বাবার কাছে বিয়ের কথা বলতে হবে। আমি ততদিন পর্যন্ত তোর মানিব্যাগ নেওয়ার অপেক্ষায় থাকব। ঠিকাছে তো? এবার খুশি?”
দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে তার খুশির বহিঃপ্রকাশ করলো। চুলগুলো আবার এলোমেলো হয়ে গেল তার। এক দৌড়ে কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে এসে বলল, “প্রহু আপু, সত্যি অপেক্ষা করবা তো? এই যে আমায় ছুঁয়ে কথা দাও।”
“পাগল ছেলে! এই যে আমার শিল্পীকে ছুঁয়ে কথা দিলাম।”, একগাল হেসে বলল।
দিব্য ছুটে চলে যায় মাঠে খেলতে। ক্রিকেট খেলায় বেশ আকর্ষণ তার। মাঝেমধ্যে মনে হয় বড় হয়ে পাক্কা ক্রিকেটার হবে। প্রহেলি হাসিমুখে কমন রুমের দিকে পা বাড়ায়। দিব্যের কথা সবার কাছে বলে হাসাহাসি করে। কিন্তু পরদিন থেকে স্কুলে দিব্যকে আর দেখতে পায় না। তার এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে দিব্যের বাবা তাকে বয়েজ স্কুলে ভর্তি করে ওখানেই হোস্টেলে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কেন জানি কিছুটা ব্যথিত হয় প্রহেলি। খুব আদর করতো দিব্যকে হয়তো তাই। কিন্তু কিছুদিন পর তা আবার ঠিকও হয়ে যায়৷ দিব্যের কথা আর মনে হয় না তার। মানুষ এমনই স্বার্থপর ধরনের! একজন মানুষ জীবনে যতদিন আছে ততদিন আমরা তাকে মনে রাখি, গুরুত্ব দিই, ভালোবাসি, তার ভালো থাকার চিন্তা করি। আর জীবন থেকে হারিয়ে গেলে খেয়াল থেকেও হারিয়ে যায়। মনে রাখি না আর তাকে। তবে হ্যাঁ, ক্ষণকালের জন্য স্মৃতির পাতায় কখনোসখনো উঁকি দিয়ে যায় তাদের কথা।
প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় কোনোরকমে পাস করে গেলেও টেস্ট পরীক্ষায় প্রহেলির রেজাল্ট যথেষ্ট খারাপ আসে। গণিতে টেনেটুনে চল্লিশ মার্ক পেয়েছে। তার বাবা শামসুল গাজী প্রাইভেট শিক্ষকের সাথে কথা বলে জানতে পারেন প্রহেলিকা নিয়মিত টিউশন পড়তে যাচ্ছে না। ফাঁকি দিচ্ছে। মায়ের উত্তম-মধ্যম খাওয়ার পর তার বাবা তাকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার থেকে তো এমন রেজাল্ট আশা করিনি। এমন হওয়ার কারণ কী?”
সে কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে জানায়, “এই স্যারের কাছে আমার পড়া হচ্ছে না। আমি বুঝি না উনার কাছে। অন্য স্যার হলে হয়তো পারব।”
তার কথামতো শিক্ষক বদলে দেয়া হয়। কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা থাকে। টিউশন ফাঁকি দিয়ে স্কুলের বাইরে নাহিয়ানের সাথে দেখা করতে লাগে। কত না আবেগী মুহূর্ত কাটায় দু’জনে। পার্কের কোণায় বসে দুজন দুজনাতে মত্ত হয়ে রয়৷ ঠোঁটে ঠোঁটে কথা যেন রোজকার খাদ্য হয়ে দাঁড়ায়। একবার না খেলে মাথা ঠিক থাকে না। নাহিয়ানের অবাধ্য হাতে ছুঁয়ে দেয় প্রহেলির প্রতিটা অঙ্গ। শরীর দুলে উঠে তার স্পর্শে। বেহিসেবী মেলামেশা প্রেমের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। শরীর শরীরকে ছুঁয়েছে অগণিতবার। নাহিয়ানের কাছে দেখা করে একান্ত সময় কাটানো মানেই প্রহেলির শরীরের ঘ্রাণ নেওয়া। এটা যেন নিত্যকার অধ্যায় হয়ে যায়। কোনো বাধ্যবাধকতা নেই তাদের মধ্যে।
স্কুলে ঢুকতেই অপি প্রহেলির পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকায়। এপাশ ওপাশ ঘুরে কাঁধে হাত রেখে বলল, “কী রে তোর বুকটাকে কী নাহিয়ান তার যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে ফেলল নাকি? সাইজ দেখছি দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে! খুব হাত চলে না?”
“তোর মুখে কখনো ভালো কথা আসবে না তাই না? আমাদের মধ্যে অতোটাও গভীর সম্পর্ক নয় যে যেখানে সেখানে হাত চালাবে সে।”, প্রহেলির কণ্ঠ বজ্রপাতের ন্যায় আঘাত করে।
“এভাবে চ্যাতে গেলি কেন! সত্য কথা হজম হয় না তাই না? শোন আমার এসবের অভিজ্ঞতা আছে বুঝলি। এই অবধি তিন তিনটা প্রেম করেছি। কোন ছেলে কেমন তা দেখলেই বুঝতে পারি। সব ছেলেরা এত সাধু নয়। নাহিয়ান তো অবশ্যই নয়।”
প্রহেলি আর কোনো উত্তর দেয় না। হনহনিয়ে তার সামনে দিয়ে চলে যায়। অপি তার যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অপি যখন প্রথম প্রেম করে তখন সে এইটে ছিল। একই ক্লাসের একটা ছেলের সাথে প্রেম করেছিল। ছেলেটা কিছুই বুঝতো না, হাবাগোবা ছিল বলে প্রেম আর বেশিদিন আগায় না। তারপর যখন নবম শ্রেণিতে উঠে তখন দশম শ্রেণির একটা ছেলের সাথে প্রেম করে। ওই ছেলেটাই তাকে একদম পাকিয়ে দিয়ে গেছে। গেছে বলার কারণ এসএসসি এর পর আর ছেলেটার সাথে তার কোনো যোগাযোগ হয় না। এখন সে ইন্টারের একটা ছেলের সাথে প্রেম করছে।
অফিস রুমের বাইরে চোখ যেতেই প্রহেলি দেখলো মেহরাব বসে বসে কাঁদছে। প্রহেলি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কী রে ট্যাবলেট! কী হয়েছে তোর?”
“কিছু না, যা তুই এখান থেকে। আমাকে একা থাকতে দে।”
“আরে না বললে বুঝবো কীভাবে! বল কী হয়েছে!”
“বললেই কী সব ঠিক করে দিতে পারবি?”
“আগে বলেই দেখ না!”
“ইলমা আমাকে ঠকিয়েছে।”
অবাক দৃষ্টিতে তাকায় প্রহেলি। ইলমা তাকে ঠকিয়েছে কথাটা তার কাছে বোধগম্য হয় না। ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “ইলমা তোকে কীভাবে ঠকালো?”
“সেই এক বছর ধরে আমাদের প্রেম। এখন নাকি তার আমাকে দিয়ে চলবে না। কিন্তু সত্যি তো আমি জানি।”, মেহরাবের চোখে স্পষ্ট জল।
প্রহেলি কখনো ছেলেদের কাঁদতে দেখেনি। তার বড় ভাইকে মা মারলেও কাঁদতো না। গাল ফুলিয়ে কেবল বসে থাকতো। কৌতুহল ধরে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে খুলে বল।”
“ইলমা, শফি স্যারের সাথে প্রেম করছে। আমার সাথে সে কীভাবে এমন কাজ করতে পারলো! আমাদের এতদিনের সম্পর্ক সে নিমিষেই ভেঙে দিল!”
মেহরাবের ইলমার প্রেম ছিল অথচ কেউ টের পায়নি বিষয়টা ভেবে বেশ অবাক হয় প্রহেলি। সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পায় না সে।
তাদের প্রেমটা কেবল চিরকুটেই সীমাবদ্ধ ছিল। যাওয়া আসার পথে একে অন্যকে চিরকুট দিয়ে যেত। কখনো সরাসরি কথা হতো না, সব কথা চোখে চোখেই হতো। না ছিল শরীর ছুঁয়ে দেওয়া কোনো চাহিদা আর না ছিল মুখ ফুটে ভালোবাসি শব্দ শোনার আকাঙ্খা। কিছু তৃষ্ণা মিটাতে কাছে আসার প্রয়োজন হয় না দূর থেকেই মিটিয়ে নেওয়া যায়।
এসএসসি পরীক্ষাতে কোনোরকমে এ গ্রেড পেয়ে পাস করে প্রহেলিকা। ওদিকে নাহিয়ান, পূজা, ইলমা, এ+ পায়। অপি আর শুভ্রত এ- পেয়ে পাস করে যায়। অন্যদিকে দুই রোল নম্বর থাকা সত্ত্বেও মেহরাব একটা বিষয়ে ফেল করে ফেলে। তার পেপার রি-চেক করানো হয়। কিন্তু ফলাফল একই থাকে।
চলবে…