“তৃ-তনয়া” পর্ব- ৫০

0
2563

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫০
(নূর নাফিসা)
.
.
নিয়াজ উদ্দিন ইশার নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরেছেন। দুপুর থেকেই অস্থির লাগছে শরীরটা। আর এখন যেন সেই অস্থিরতা প্রচুর বেড়ে গেছে! তিনি নাজিয়ার পাশে এসে বসলেন। মেয়েটা সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে! মেয়ের মন ভালো করার জন্য দু একটা কথা বললেন তিনি। অত:পর নিজ রুমে চলে গেলেন। খাবার প্লেটে বেড়ে নাফিসা ডাকতে এলো বাবাকে। দেখলো তার বাবা শুয়ে আছে কপালের উপর হাত রেখে।
– বাবা, ভাত খাবে না?
– তোমরা খাও। আমি পরে খাবো।
– কেন? এখন এসো।
– ফ্যানের সুইচটা অন কর তো, মা। আর অল্প একটু পানি দাও গ্লাসে।
নাফিসা ফ্যানের সুইচ অন করতে করতে বললো,
– এই ঠান্ডার মাঝে গরম লাগছে তোমার!
– হ্যাঁ, লাগছে একটু।
– ভাতের প্লেট এখানে আনবো?
– না, আমি পরে খাবো। আপাতত পানি এনো।
নাফিসা পানি আনার জন্য বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। রুমানা বেগম তাকে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই নাফিসা বললো, “বাবার শরীরটা মনে হয় খারাপ লাগছে। এখন খাবে না বলছে। তুমি দেখে এসো তো মা।”
নাফিসা পানি নিয়ে এসেছে সাথে রুমানাও এসেছে। নিয়াজ উদ্দিন শার্ট খুলে শুয়ে আছে। ফ্যান চালু থাকা সত্ত্বেও তার দেহের পাতলা গেঞ্জিটা ঘেমে ভিজে আছে! নাফিসা পানির গ্লাস এগিয়ে দিলে তিনি শোয়া থেকে উঠতে গিয়েও যেন পড়ে গেলেন। রুমানা আর নাফিসা দুজনেই ভয় পেয়ে গেছে! দুজন ধরে নিয়াজ উদ্দিনকে বসতে সাহায্য করলো। নিয়াজ উদ্দিন বসে পানি পান করলো। মাথাসহ মুখমণ্ডল প্রচুর ঘামছে। উনার যেন শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে! কিছু জিজ্ঞাসা করলেও জবাব দিতে পারছে না! শুরু হয়ে গেছে মা মেয়ের কান্নাকাটি! নাহিদা দৌড়ে এসেছে বাবার ঘরে! বাবার অবস্থা দেখে তার ভেতরটায়ও ভয় চেপে গেছে! ওদিকে নাজিয়া চলাফেরা করতে পারে না বলে সেখান থেকেই ডাকছে আর জানতে চাইছে কি হয়েছে! নাহিদা দৌড়ে এসে বললো, “আপু, বাবা যেন কেমন করছে! কি করবো এখন!”
নাজিয়া নাহিদাকে বললো তাকে বাবার কাছে নিয়ে যেতে। বাবার ছটফট দেখে নাজিয়ারও প্রচুর ভয় লাগছে। ঘরে চারজন মেয়ে। তারমধ্যে একজন অসুস্থ! এমন হুলস্থুল এর মাঝে কি রেখে কি করবে কারোই মাথায় ধরছে না! নাজিয়া তার বাবার ফোনটা হাতে নিয়েই আরাফকে কল করলো। আরাফ রিসিভ করতেই নাজিয়ার কান্নাজড়িত কণ্ঠ শুনতে পেলো,
– আরাফ, বাবা কেমন যেন করছে! তুমি এসো একটু।
– কি হয়েছে, বাবার? কাদছো কেন তুমি!
– কি হয়েছে, বুঝতে পারছিনা কিছু! বাবার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে!
– আমি আসছি।
আরাফ আশিক দুজন একসাথেই ছিলো। ইশার নামাজ পড়ে বাড়ি যাচ্ছিলো দুজন। তারা আর বাড়ি না ফিরে রাস্তা থেকেই চলে এলো নাজিয়াদের বাড়ি। আরাফ তার বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা নাজিয়াদের বাড়িতে যাচ্ছে। নিয়াজ উদ্দিনের অবস্থা ভালো না দেখে আরাফ গাড়ি ঠিক করে উনাকে হসপিটাল নিয়ে গেছে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় নাফিসা তার বাবার ডেবিট কার্ড আরাফের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। কার্ডটি নিতেও যেন আরাফের সম্মানে লেগেছে! কিন্তু কি আর করার! এদিকে নিজের হাত যে শুন্য! এমনিতেই সংসারে টানাপোড়েন তার উপর নাজিয়ার অসুস্থতায় আবার তার হাতটান পড়ে গেছে! বাধ্য হয়ে নিতে হলো তাকে। হসপিটালে নিয়াজ উদ্দিনের সাথে এসেছে রুমানা, নাহিদা, আরাফ ও আশিক। রুমানাও কাদছে, নাফিসাও খুব কাদছে। অসুস্থ একজন মানুষের সাথে দুজনকে সামলানো দায় তাই নাজিয়ার কাছে নাফিসাকে রেখে এসেছে বাসায়। আর নাহিদা একটু বুঝদার হওয়ায় তাকে নিয়ে এসেছে সাথে। অফিসের প্রয়োজনে জহিরুল ইসলাম ও মেহেদী গতকাল থেকে ঢাকার বাইরে আছে। আগামীকাল ফেরার কথা তাদের। নাহিদা তার শ্বাশুড়িকে কল করে জানিয়েছে তার বাবার অবস্থা। রাতেই তিনি আসিফের সাথে হসপিটাল গিয়েছে।
.
নিয়াজ উদ্দিন এখন বিপদমুক্ত। ডাক্তারের সাথে কথা বলে আরাফ জানিয়েছে দুশ্চিন্তার কারণে প্রেশার বেড়ে গেছে। তাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। বিপদমুক্ত হলেও শরীর এখন অনেক দুর্বল। নিয়াজ উদ্দিনকে আশঙ্কামুক্ত দেখে মেহেরুন ইসলাম আবার বাড়ি ফিরে গেছে। কেননা মেয়ে ও নাতি নাতনিদের বাড়িতে রেখে এসেছে। এদিকে নাজিয়া আর নাফিসা দুজন মেয়ে লোক একা বাড়িতে। আরাফ কি করবে মাথায় ধরছে না! সে আশিককে হসপিটালে থাকতে বললো আর সবকিছু গুছিয়ে রেখে রাত বারোটার পর নিজে চলে এলো বাড়িতে। যা ভেবেছে তা-ই হয়েছে! দুইবোনই এখনো কাদছে! আরাফ যথাসম্ভব সান্তনা দিয়ে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দুজনকে খেতে বাধ্য করলো। সে-ও খেয়েছে। নাফিসা ঘুমানোর পূর্বে ওযু করে কুরআন পাঠ করেছে। আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে মোনাজাত করেছে মধ্যরাতে। নিরবে কাদতে কাদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই।
নাজিয়া আজ আরাফকে পেয়ে ঘুমাতে পারলেও শান্তির ঘুম হয়নি তার! একের পর এক অশান্তি যেন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে! এই অশান্তির কি কোনোই অন্ত নেই!
.
সকাল হতেই নাফিসা ঘুম থেকে জেগে নামাজ পড়ে রান্না বসিয়েছে। পরপর আবার খামারে চলে গেছে। এমন এক পরিস্থিতিতে পড়েছে, সবদিকে কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে! খামারে মুরগির খাদ্য পানি দেয়ার কাজে আরাফ সাহায্য করলো তাকে। পরপর সে রান্না শেষ করলো। আরাফ ভোরেই চলে যেতে চেয়েছিলো হসপিটালে কিন্তু নাফিসা যেতে দেয়নি, কেননা সে যাবে সাথে। রান্না শেষ করে নাজিয়াকে খায়িয়ে রেখে তারা দুজন খাবার নিয়ে চলে গেলো। সেখানে এসে দেখলো মাত্রই জহিরুল ইসলাম ও মেহেদী এসেছে। চারজনই একসাথে লিফটে উঠে কেবিনে এলো।
নাহিদা, রুমানা ও আশিক সবাই আছে কেবিনে। সকলের চোখেমুখে ভেসে আছে রাত জেগে থাকার ছাপ! নাহিদা জহিরুল ইসলামকে সালাম দিলো। নিয়াজ উদ্দিনের সাথে তাদের সাক্ষাতের পর মেহেদীর পাশে এসে দাড়িয়ে নাহিদা জিজ্ঞেস করলো,
– কখন ফিরেছো?
– ভোরে।
– নাস্তা করেছো?
– হুম।
– বাবা?
– হ্যাঁ, করেছে।
আরাফ নাহিদাকে বললো,
– নাহিদা তুমি মাকে সাথে নিয়ে বাসায় চলে যাও। সারারাত জেগেছো, বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। আশিক, তুইও বাসায় ফিরে যা। দেখ আজ অফিস থেকে ছুটি নিতে পারিস কি-না। রাতে ঘুমাস নি, অসুস্থ হয়ে পড়বি।
– আচ্ছা, যাচ্ছি।
আশিক বেরিয়ে যেতে নিলে নাহিদা বললো,
– ভাইয়া, বাসায় চলেন। রাতেও খাননি কিছু, নাস্তা করে তারপর যাবেন।
– না, ঠিক আছে। যাও তোমরা।
আশিক চলে গেলো। নাহিদা মেহেদীকে বললো,
– বাসায় যাবে, এখন?
– অফিস যাবো।
জহিরুল ইসলাম বললেন,
– মেহেদী চলো, নাহিদাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে অফিস যাই। দুপুরে মিটিং শেষ করে তুমি আবার চলে এসো।
– চলো।
নাহিদা লক্ষ্য করছে সবার সাথে প্রয়োজনীয় টুকটাক কথাবার্তা বললেও মেহেদীর মুখটা কেমন গম্ভীর! নাহিদা ও রুমানাকে তাদের গাড়িতে করে বাড়ি নামিয়ে দিয়ে তারা বাবা ছেলে অফিস চলে গেছে। গোসল সেড়ে বিশ্রামের কোনো প্রয়োজন মনে করেনি রুমানা বেগম। আবার রান্না বসিয়ে নিজে কিছু খেয়ে তাদের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে গেছে হসপিটাল। এবার তিনি একাই গেছেন। নাহিদা তার বোনের ও খামারের দেখাশোনার জন্য বাড়িতে রয়ে গেছে।
নাফিসা তার বাবার কাছে ঘেঁষে বসে আছে। প্রথমত কাদছিলো, পরক্ষণে শান্ত হয়ে গোমড়ামুখো হয়ে বসে আছে। আরাফ একবার রোগীর কেবিন তো আরেকবার ডাক্তারের কেবিনে আসা যাওয়া করছে! কখনো রিসিপশনের ঝামেলা নিয়ে ছুটাছুটি করছে কখনো বা ওষুধ কিনতে হসপিটালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
আজ প্রথম নিয়াজ উদ্দিন ছেলে সন্তানের অভাব হারে হারে উপলব্ধি করতে পারছেন। এতোদিন রুমানা বেগম ছেলে সন্তানের জন্য আফসোস করলে তিনি বারবার সামাল দিতেন এই বলে, পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ভাগ্যবান তিনি। কেননা তার কাছে তৃ-তনয়া আছে। যখনই আল্লাহ তায়ালা খুশি হোন, তখনই পৃথিবীতে কন্যা সন্তান পাঠান! নবী করিম (সা.) ও কন্যার জনক ছিলেন। সেই সুত্রে তিনিও পরপর তিন কন্যার জনক! তার মতো ভাগ্যবান পৃথিবীতে খুব কমই আছে।
কিন্তু আজ! আজ যে একটা পুত্রের খুব প্রয়োজন ছিলো! যতই আপন হোক না কেন, মেয়ের জামাইকে ছোটাছুটি, দৌড়াদৌড়ির কষ্ট করতে দেখতে একটুও ভালো লাগছে না! তিনি মন থেকে নিজ সন্তান ভাবে কেবল খুশির সময়ে উপস্থিত করতে। কিন্তু আজ দুখের দিনে এভাবে খাটাতে একদম ভালো লাগছে না। নিজের পুত্র সন্তান থাকলে তো মেয়ের জামাইকে এভাবে কষ্ট করতে হতো না! নিজ দায়িত্বে সকল ভার বহন করে নিতো তার ছেলে। ছেলেকে বাবার জন্য কষ্ট করতে দেখতে তখন গর্ববোধ করতেন তিনি। যেটা আজ পারছেন না। বরং নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে আজ!
দুপুরের দিকে আলফাজ সাহেবও দেখা করে কথা বলে গেছেন। সন্ধ্যার দিকে আবার জহিরুল ইসলাম এসেছেন কিন্তু মেহেদী আর আসেনি। একদিনেই এক একজনের চেহারার অবস্থা নাজেহাল হয়ে গেছে! তাই আজ রাতে সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে আরাফ একা থেকেছে হসপিটালে।
.
রাতে ডাক্তার এসে চেকাপ করে গেলে নিয়াজ উদ্দিন আরাফকে ডেকে পাশে বসতে বললো। আরাফ পাশে বসলে নিয়াজ উদ্দিন তার মনে জমা দুশ্চিন্তার কথা শেয়ার করলেন ছেলেসমতুল্য জামাইয়ের সাথে। নাজিয়ার হাত তো বহু আগেই তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। নাহিদাকেও কোনো এক সুশৃঙ্খল পরিবারের কাছে তুলে দিতে পেরেছেন। মনে হচ্ছে জীবনের শেষ দিকে চলে এসেছেন। স্বপ্ন থাকে বহুদূর, কিন্তু সময় যে সীমিত! সেকেন্ডেরও ভরসা নেই, মুহুর্তেই সুস্থ মানুষ শূন্যে হারিয়ে যায়। আর সেখানে তিনি দুরারোগ্য! তার সকল চিন্তা এখন নাফিসাকে নিয়ে। আজ যদি সে দুনিয়া ত্যাগ করে চলে যায় তাহলে দুই মেয়ের ভার বহন করার মতো আলাদা পরিবার আছে, কিন্তু তার ছোট মেয়েটার ভার কে বহন করবে! তার ভার কারো উপর তুলে দিতে পারলে তিনি দায়িত্বমুক্ত হতে পারতেন। সম্ভব হলে তার উপস্তিতি বা অনুপস্থিতিতে আরাফ যেন বড় ভাই হয়ে একটা সুশৃঙ্খল পরিবারে তাকে পাঠিয়ে দিতে পারে। এমন একটা আবদার রাখলেন তিনি আরাফের কাছে এবং বড় ভাইয়ের অধিকারটাও দিয়ে দিলেন। মেয়েদের নিয়ে চিন্তামুক্ত হতে পারলে বাকি জীবনটা অনু প্রচেষ্টায় কাটিয়ে দিতে পারবেন তিনি এবং তার স্ত্রী।
নিয়াজ উদ্দিনের কথার সুবাদে আরাফ আজ তুলে ধরলো তার খালাতো ভাই ইমরানের কথা! কিছুদিন যাবত তার বিয়ের জন্য পাত্রী খুজছে। সেদিন আশিকের সাথে ভার্সিটিতে দেখার পর এবং আশিকের কাছে তার পরিচয় জানার পর ইমরান আরাফকে বলেছিলো নাফিসার কথা। কিন্তু আরাফ নিষেধ করে দিয়েছে, কেননা সে জানে পড়াশোনা শেষ না করিয়ে নাফিসাকে এখন বিয়ে দিবে না। তাই সেই প্রসঙ্গে কাউকেই কিছু বলেনি। নিজ থেকেই নিষেধ করে দিয়েছে। আজ আরাফের কাছে শুনে নিয়াজ উদ্দিন ইমরানের ডিটেইলস জানলেন। জামাই শ্বশুর গল্প করেই রাতের অর্ধেকটা সময় পাড় করে দিলো।
.
.
? সারপ্রাইজড?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here