স্বপ্নছায়া পর্ব-৬,৭

0
2076

স্বপ্নছায়া
পর্ব-৬,৭
মুশফিকা রহমান মৈথি
৬ষ্ঠ_পর্ব

নীলাদ্রির সাথে চোখাচোখি হতেই সে হাসি দিয়ে পাশ কাটিয়ে টেবিলের কাছে হাটা দেয়। তখন নীলাদ্রি ঝাঝাঁলো কন্ঠে বলে,
– কথা আছে, ছাঁদে যাওয়া যাক?

অভ্র নীলাদ্রির কথাটা অগ্রাহ্য করতে পারলো না। তাই পানিটা খেয়ে ধীর কন্ঠে বললো,
– চলো

ছাঁদের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে অভ্র এবং নীলাদ্রি। ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। তিন ঘন্টার একটানা ঝুম বৃষ্টি উত্তপ্ত ঢাকা শহরকে শীতল নগরীতে পরিণত করেছে। নীলাদ্রি সিগারেটটা অভ্রের এগিয়ে দিয়ে বললো,
– চলবে?
– হু, থ্যাংক্স।
– তোমার কৌতুহল হচ্ছে না? আমি কেনো তোমকে এখানে নিয়ে এসেছি?
– হচ্ছে না বললে ভুল হবে, তবে একটা অনুমান করতে পারছি। বোন তো আমার ও আছে।
– ঐন্দ্রি আমার শুধু বোন নয়, ও আমার কলিজার অংশ৷ আমার আয়ত্তে থাকলে আমি কখনোই এই বিয়েটা হতে দিতাম না। কারণ তুমি ওর যোগ্য নও। যার ছোট ভাই বিয়ের আসরে আমার বোনকে তার রুপের জন্য ছেড়ে যেতে পারে, সে কতোটা ভালো হতে পারে আমার জানা আছে। কিন্তু তখন আমি অপারগ ছিলাম বলে বিয়েটা আটকাতে পারি নি। তবে এটা ভাবার মোটেই ভুল করবে না যে, আমি একজন অকর্মণ্য ভাই। কখনো যদি তোমার জন্য আমার বোনের চোখ থেকে পানি পড়ে, সেদিন ওইবাড়িতে আমার বোনের শেষ দিন হবে। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখো।

বেশ শান্ত কন্ঠে হুমকি দিচ্ছে সে অভ্রকে। নীলাদ্রির চোয়াল স্থির, তার কন্ঠে কোনো জড়তা নেই। ভাই বোন দুটো একই ধাঁচের। এক জন তাকে প্রতিনিয়ত নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে, আরেকজন সিগারেট দিয়ে শান্ত কন্ঠে ওয়ার্নিং দিচ্ছে। অভ্র মনে মনে হাসলো। ধীর কন্ঠে বললো,
– বিয়েটা আমার বা ঐন্দ্রিলার ইচ্ছেতে হয় নি। তবে এটাকে এগিয়ে নেবার ইচ্ছেটুকু উভয়ের ই আছে। দুটো আলাদা মানুষ হুট করেই তো একই রঙ্গে রাঙ্গতে পারে না, সময় লাগে। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই প্রযোজ্য। তবে আশাকরি, আমি জেনে কখনোই ঐন্দ্রিলাকে কষ্ট দিবো না। আফটার অল সি ইজ মাই ওয়াইফ। যদি কোনোদিন কথা না রাখতে পারি দেন দ্যা ডিসিশন উইল বি ইউরস।

নীলাদ্রি উত্তর দিলো না। সে নিঃশব্দে সিগারেটে সুখটান দিলো। তার দৃষ্টি বাহিরের দিকে। অভ্রের অন্তরে সে উঁকি দিতে পারছে না, তাই তার মুখের কথাকেই আপাতত বিশ্বাস করতে হচ্ছে। তবুও মনে কোনে আশংকার প্রদীপ মিটিমিটি করে জ্বলছে। ঐন্দ্রিলা কি আদৌ সুখের হাতছানি পাবে!!

রুমে যেতেই অভ্র থমকে গেলো৷ বিছানায় ঐন্দ্রিলা দিশানকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে রয়েছে। দিশান ও ঐন্দ্রিলার বুকে মিশে রয়েছে। ছোট বেলা থেকে দিশান খুব ইন্ট্রোভার্ট। অপরিচিত মানুষ দেখলেই সে ভয়ে চুপসে যায়। অভ্র যখন তাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলো তখন কেবল অভ্রের কাছেই সে থাকতো। অভ্র ব্যাতীত প্রতিটি মানুষকে সে ভয় পেতো। দিশানের এই মানসিক রোগটা যাকে সাইকিয়াট্রিস্টরা “xenophobia” বলে, সেটা সম্পর্কে বেশ আগ থেকেই অভ্র জ্ঞাত ছিলো। বিভিন্ন চাইন্ড সাইকিয়াট্রিস্টের সাথেও সে কথা বলে। দিশানের প্রচুর সময় লাগে অভ্রের পুরো পরিবারের সাথে মিশতে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার ছেলে ঐন্দ্রিলার সাথে কোনো কষ্ট ব্যাতীত ই মিশে গিয়েছে। নিজ থেকে তাকে “মাম্মাম” বলে, যেখানে অভ্রকে বাবা বলতে তার বছর খানিক সময় লেগেছে। অভ্রের ঠোঁটের কোনায় অজান্তেই হাসি ফুঁটে ওঠে। আজ বত্রিশ বছরের জীবনের সবথেকে সুন্দর এবং লাভবান ডিলটা সে করেছে। রোডের ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোটা ক্ষীন ভাবে রুমে প্রবেশ করছে। এই ক্ষীণ আলো আধারে ঐন্দ্রিলার ঘুমন্ত শান্ত মুখখানা চমৎকার লাগছে অভ্রের। মেয়েটি কৃষ্ণ বর্ণের, কিন্তু মুখখানা দেখলে মনে হয় কোনো ভাস্করের নিপুন হাতের শিল্পকর্ম, মোমের দলাতে আলতো হাতের ভাস্কর্য। এক বছর পর এতোটা খুতিয়ে কোনো নারীকে দেখছে অভ্র, হ্যা সে গভীর নয়নে ঐন্দ্রিকে দেখছে___________

৫.
বারান্দার এক কোনায় গোঁমড়া মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিউ। আকাশের কোনে মেঘ জমেছে, বৃষ্টি হবে হবে করছে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। দমকা গরম হাওয়া পিউ এর ঢেউ খেলানো চুলগুলোকে দোল দিচ্ছে। ঐন্দ্রিলা ও বাড়ি চলে গিয়েছে। মন দিয়ে হয়তো সংসার করছে। আর এদিকে পিউ এর নিজেকে বড্ড একা লাগছে। ঐন্দ্রি থাকলে ওকে নিয়ে দিব্বি বাহিরে ঘুরতে যাওয়া যেতো। কিন্তু সে নেই। দিশাটা ও বাসায় নেই। কলেজে তার হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা চলে। পিউ এর একা একা একঘেঁয়েমি লাগছে। মাত্র ই সে তার ব্যাচেলর অর্থাৎ অনার্সটা কমপ্লিট করেছে। মাস্টার্সের ক্লাসটা ও শুরু হয় নি। নয়তো একটা না একটা কাজে মন টা লেগে থাকতো। আজ কিছুই কেনো যেনো ভালো লাগছে না। মাঝে মাঝে আমাদের সকলের ভালো না লাগা রোগে ধরে। পিউ ও এই রোগে আক্রান্ত৷ হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠে তার। ফোনের স্ক্রিনে সাবার নামটা বড় বড় হরফে দেখা যাচ্ছে। সাবা মেয়েটি পিউ এর খুব ভালো বান্ধবী। তারা একই সাথে ভার্সিটিতে পড়তো। ফোন রিসিভ করতেই উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে সাবা বলে উঠে,
– শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে নে, আমরা দিয়াবাড়ি যাবো।
– কিহ?
– রেডি হো ছেরি, সময় নেই। আমরা ৪টায় বের হবো।
– সে বুঝলাম। হুট করে এই প্লানের কি কোনো কারণ আছে?
– নাহ নেই। আরিফা ফোন দিয়ে বললো সে বোর হচ্ছে, তাই এই প্লান। শাড়ি পড়ার প্লান আমার।
– তুই কি জানিস তুই কতো ভালো!
– না জানি না, তুই রেডি হ। ওখানে যেয়ে ফুচকা খেতে খেতে শুনবো।
– যা আজকে তুই যত ফুচকা খাবি, আমি তোকে খাওয়াতে রাজী। আমার যে কি মন খারাপ লাগছিলো বলে বোঝাতে পারবো না। আমি রেডি হয়ে ফোন করছি। বাই

বলেই ফোনটা কেটে দিলো পিউ। মনটা মূহুর্তের মধ্যেই ভালো হয়ে গেলো। যাক এই বদ্ধ ঘর থেকে বের তো হওয়া হবে।

আজ অফিসে যাওয়া হয় নি নীলাদ্রির। শরীরটা মেজমেজে লাগছে। দুদিন আগের বৃষ্টিতে ভেজার ফল, এটা তার বুঝতে বাকি নেই। মাথাটা এতো বেশি ধরেছে যে বিছানা থেকেও উঠতে ইচ্ছে করছিলো না তার। ঔষধের ডিব্বাতে টাফনিলের পাতাটাও খুঁজে পাচ্ছে না সে। খালার বাসায় খোঁজ নিলে হয়তো পাওয়া যাবে। মোটেই এই অসুস্থ শরীরটা নিয়ে বাহিরে যেতে ইচ্ছে করছে বা নীলের। খুব কষ্টে নিচে গেলো সে। আসমা বেগম দরজা খুলতেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলেন,
– নীল, তোর কি শরীর খারাপ?
– জ্বর জ্বর লাগছে, টাফনিল হবে খালা?
– বয়, আমি দেখছি।

ছোট্ট করে “হু” বলে ড্রয়িং রুমের সোফাতে গা এলিয়ে বসে নীলাদ্রি। ঠিক তখন পিউ এর কন্ঠ টি কানে আসে তার,
– মামী মা, আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি। আসতে আসতে সন্ধ্যা হবে।

নজর তুলে নীলাদ্রি কিছুক্ষণ থ মেরে বসেছিলো। সাদা-গোলাপি মিশ্র শাড়িতে পিউকে কোনো অপ্সরার চেয়ে কম লাগছে না। হলদেটে ফর্সা দেহে শাড়িটা যেনো মিশে আছে। ঠোঁটে কড়া করে লাল লিপ্সটিক, চোখে গাড় কাজল। ঢেউ খেলানো চুল গুলো কোমড় অবধি নেমে এসেছে। নীলাদ্রির মনে হল কয়েক মূহুর্তের জন্য তার হৃদস্পন্দন থেকে গেছে। তড়িৎ গতিতে চোখ সরিয়ে নিলো সে। এই মেয়েটা একদিন তাকে সত্যি সত্যি মেরে ফেলবে। ভালোবাসা পূর্ণতা পাবার আগেই তাদের কাহিনীর সমাপ্ত হবে। কে বলেছে মেয়েটা এতো সুন্দর করে সাজতে? খানিকটা রাগ হলো নীলাদ্রির। একেই বয়সের তফাতের জন্য মনের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে চৌদ্দ বার ভাবতে হয় তার। এখন যদি কোনো চ্যাংড়া ছেলে তাকে পটিয়ে ফেলে তবে শুরু হবার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে। আসমা বেগম পিউ এর কাছে এসে বলেন,
– এখন এতো সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস রে তুই?
– দিয়াবাড়ি। সাবা আর আরিফাও যাচ্ছে।
– আচ্ছা শোন মা যাবার আগে একটু টাফনীলটা খুজে দে না। আমি পাচ্ছি না।
– তোমার মাথা ব্যথা করছে?
– আরে না, নীলের করছে। বেঁচারার মুখটা শুকিয়ে গেছে। খুঁজে ওর হাতে দিয়ে তারপর যা। আমার চুলার তরকারীটা পুড়ে যাবে।

নীলাদ্রি নামক ব্যাক্তিটির কথা শোনামাত্র পিউ বড় সড় ঢোক গিললো। এখন তাকে দেখলেই লোকটা কোনো না কোনো টিপ্পনী ঠিক কাঁটবে৷ কিন্তু মামী মার কথাও অগ্রাহ্য করতে পারছে না সে। তাই বাধ্য হয়ে ঔষধটা খুঁজে নিজেই নীলাদ্রির সামনে গেলো সে। লোকটাকে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে যখন ই পিউ খুব সুন্দর করে সাজে কিছু না কিছু টিপ্পনী কাটেই। নীলের সামনে এসে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
– নিন।
– কোনো কুকুর বেড়াল কে দিচ্ছিস নাকি! একটু ভালো ভাবে কি দেওয়া যায় না?
– যা বাবা আমি কি করলাম?
– থাক, থাক আর বুঝে কাজ নেই তোমার। তা এমন সং সেজে কোনো নাট্য কোম্পানিতে যাচ্ছিস শুনি? কুকুরের পাছার মতো লাল করে রেখেছিস কেনো ঠোঁটটা? নাগর জুটিয়েছিস বুঝি?

নীলাদ্রির কথায় প্রচন্ড রাগ হলো পিউ এর। অজান্তেই চোখে পানি জমতে লাগলো৷ এতোটা খারাপ কেনো লোকটা! সে মোটেই সং সাজে নি। সে সাধারণ বাঙ্গালী মেয়েদের মতোই সেজেছে। কিন্তু তার কোনো কাজ ই লোকটার পছন্দ নয়। আর এক মূহুর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো চোখের নোনা জল ছেঁড়েই দিবে সে৷ অভিমানী কন্ঠে বললো,
– আমি মোটেই নাগর জুটাই নি নীলাদ্রি ভাই। কথা না বলতে পারলে বলবেন না। তবে এভাবে অপমান করবেন না।

বলেই হনহনিয়ে বেড়িয়ে পড়লো সে। পিউ এর অভিমানী কন্ঠের বলা কথাগুলো তীরের ন্যায় নীলের হৃদয়ে লাগলো। আজ একটু বেশিই বলে ফেলেছে সে। কিন্তু সে ভয় পায়, ভয় পায় মেয়েটাকে হয়তো হারিয়ে ফেলবে সে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মেয়েটাকে শুধু তার কাছেই রেখে দিবে। যেখানে কেউ তাকে দেখতে পারবে না। কিন্তু মেয়েটা সামনে আসলেই সব যেনো গুলিয়ে যায়। নিজেকে আটকে রাখার প্রচেষ্টায় সারাক্ষণ খিটখিটে মেজাজে কথা বলে মেয়েটার সাথে। মাথা ব্যাথাটা তীব্র হয়ে উঠেছে। নীলাদ্রি দু হাত দিয়ে মাথাটা চেপে বসে রইলো।

সন্ধ্যা ৭টা,
দিনের আলোর সমাপ্তি ঘটেছে। পাখিরা যে যার গৃহে ফেরার তাড়ায় রয়েছে। নীল ঘরে পায়চারি করছে। ক্ষণে ক্ষণে বারান্দায় উঁকি দিচ্ছে। না এখনো পিউ আসে নি। মেয়েটা বেরিয়েছে তিন ঘন্টা হয়ে গেছে। হঠাৎ করে একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে নীলের মোবাইলে। ফোন রিসিভ করতেই কানে আসে,
– নীল ভাই………

চলবে

#স্বপ্নছায়া
#৭ম_পর্ব

সন্ধ্যা ৭টা,
দিনের আলোর সমাপ্তি ঘটেছে। পাখিরা যে যার গৃহে ফেরার তাড়ায় রয়েছে। নীল ঘরে পায়চারি করছে। ক্ষণে ক্ষণে বারান্দায় উঁকি দিচ্ছে। না এখনো পিউ আসে নি। মেয়েটা বেরিয়েছে তিন ঘন্টা হয়ে গেছে। হঠাৎ করে একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে নীলের মোবাইলে। ফোন রিসিভ করতেই কানে আসে,
– নীল ভাই, আমি পিউ। আপনি কি একটু আসতে পারবেন?

কাঁপা স্বরে কথাটা বলে পিউ। তার কন্ঠে ভয়, উৎকন্ঠা স্পষ্ট। হয়তো এখনো কেঁদে দিবে। পিউ এর কন্ঠ শুনে নীলাদ্রির কলিজায় মোচড় দেয়৷ চিন্তিত কন্ঠে ব্যাস্ত হয়ে সে জিজ্ঞেস করে?
– তোর ফোন কোথায়? এটা কার ফোন? কি হয়েছে তোর কন্ঠ এমন কেনো শোনা যাচ্ছে?
– আপনি একটু তাড়াতাড়ি আসেন প্লিজ। আমার খুব ভয় করছে।
– কোথায় আছিস? এড্রেস বল। আমি আসছি।
– আমি দিয়াবাড়ির মেইন রোডে আছি। একটু তাড়াতাড়ি আসেন প্লিজ৷
– তুই শান্ত হো, আমি আসছি। আর ফোন কাটিস না। আমার সাথে কথা বলতে থাক।

নীলাদ্রি ফোনটা কাটলো না। পিউ এর ভীত কন্ঠ তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে যে কিছুক্ষণ পূর্বেও তার মাথা ব্যাথা ছিলো। ফোনটা না কেটে এয়ার ফোনের সাথে কানেক্ট করেই বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়ে সে। রাস্তায় সিএনজি পেতেই কোনো দরদাম না করেই উঠে পড়ে সে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
– মামা, একটু দ্রুত চালান।

নীলাদ্রি বারংবার সিএনজি ওয়ালাকে তাড়া দিতে লাগলো৷ হৃদস্পন্দন ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে তার। ফোনে কানেক্ট থাকা পিউ কে ব্যাস্তস্বরে বলে,
– আমি আসছি। তুই মোটেই ভয় পাস না। আমার বেশি সময় লাগবে না৷

পিউ উত্তরে ছোট করে “হু” বলে৷ চৌদ্দ কিলোমিটারের পথখানা যেনো সহস্র ক্রোশের মনে হচ্ছে নীলাদ্রির কাছে। তার অন্তরখানা ছটফট করছে, কখনো পিউ এর কাছে পিউ এর কাছে পৌছাবে সেই প্রতীক্ষায়_________

বৃহস্পতিবার বলে আজ কাজের চাপ অনেকটাই কম অভ্রের। তাই শুধু শুধু অফিসে না থেকে বাসায় চলে এসেছে সে। অনেকদিন দিশানের সাথে সময় কাটানো হয়ে উঠছে না তার। বিয়ে, অফিসের কাজের প্রেসারে বাচ্চাটাকে একটু ও সময় দেওয়া হয় নি। আসার সময় দিশানের পছন্দের কেক নিয়ে আসে সে। বাসায় আসতেই দেখে শারমিন বেগম ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে চা খেতে খেতে “জ্বী বাংলা” চ্যানেলে “কৃষ্ণকলি” নামক সিরিয়াল দেখছেন। তার মনোযোগ সিরিয়ালের অবাস্তব কাহিনীতে আটকে আছে। অভ্র তার কাছে দাঁড়িয়ে বললো,
– মা
-….
– মা?
– কি হয়েছে?

বেশ বিরক্তিভরা কন্ঠে শারমিন বেগম উত্তর দেন। অভ্র স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– দিশান কোথায়?
– আহানার কাছে।
– আহানা কোথায়?
– ধুর বাবা দেখ না, ছাঁদে হয়তো। আমি জানি না।
– এ বাবা, এতোটা খিটখিট করছো কেনো
– সিরিয়াল দেখছি তো বাবু, জ্বালাস না তো!

শারমিন বেগমের বয়স এবছর ছাপ্পান্নতে পদার্পন করেছে। সন্ধ্যা সাতটা থেকে তার সিরিয়ালের কার্যক্রম শুরু হয়। রাত দশটার সময় সেই কার্যক্রম শেষ হয়৷ যেহেতু বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে, তাই করার মতো তেমন একটা কাজ থাকে না। এখন ঐন্দ্রিলা ঘরের দায়িত্ব নেবার পর থেকে আরোও অবসর সময় তার। তাই অবসব একঘেয়েমি সময়টা কাটাতে তিনি টিভি এর অহেতুক সিরিয়াল দেখেন। শুধু তাই নয়, বেশ মনোযোগ দিয়ে তিনি অনুষ্ঠানগুলো দেখেন। কেউ এসময়টায় তার সাথে কথা বললে তিনি রীতিমতো রেগে যান। এই সময়টা তার ব্যাক্তিগত সময়। অভ্র অবাক চোখে শওকত সাহেবের দিকে তাকায়। তিনি নিঃশব্দে একটা বইয়ে মুখ গুজে আছেন। টিভির এতো ভলিউম যেনো তার কানেও যাচ্ছে না। একটু অদ্ভুত কিন্তু ইনারাই অভ্রের বাবা-মা। অভ্র মুচকি হাসি হেসে নিজের রুমে রওনা দিলো৷ হয়তো বয়স হলে সেও এই কাজগুলোই করবে। সারাটা জীবন তাদের তিন ভাইবোনকে বড় করতেই অতিব্যাহিত করেছেন এই মানুষ দুজন। তাদের নিজের জন্য কখনোই সময় বের করা হয়ে উঠে নি তাদের। আজ যখন সকল দায়িত্ব থেকে ছাড়া পেয়েছেন তাহলে নিজেকে সময় দেওয়াটা অন্যায় কিছু না! বরং এটা তাদের প্রাপ্য।

দিশানের খেলাররুম থেকে হাসির শব্দ কানে আসছে অভ্রের কানে। হয়তো দিশান সেখানে দেখছে৷ তাই সে রুমে প্রবেশ করে। ঐন্দ্রিলা তখন চোখে কাপড় বেঁধে দিশানের সাথে কানামাছি খেলতে ব্যাস্ত। ঐন্দ্রিলা দিশান ভেবে প্রতিবার অন্যকিছু ধরে, আর দিশান তা দেখে খিলখিল করে হাসছে আর বলছে,
– মাম্মাম পালে না। মাম্মান পালে না

দৃশ্যটা গভীর নয়নে দেখছে অভ্র। দিশানকে এতোটা হাসিখুশি সে দেড় বছর আগে দেখেছিলো, যখন জ্যানিফার বেঁচেছিলো। জ্যানিফারের সাথে কাঁটানো শেষ মূহুর্তগুলো খুব স্মরণীয় হয়ে আছে অভ্রের মনে। জ্যানিফার এবং ঐন্দ্রিলার মাঝে কোনো মিল নেই। জ্যানিফার যতটা শান্ত ছিলো, ঐন্দ্রিলা ততটাই ডানপিটে। যেখানে জ্যানিকে দশটা কথা বললেও কোনো উত্তর দিতো না সেখানে ঐন্দ্রিলার সাথে কথায় প্রতিবার হার মানে অভ্র৷ তবুও মেয়েটিকে জ্যানির স্থান দিয়েছে দিশান। অবশ্য অভ্রের ও মেয়েটাকে ততটা মন্দ লাগে না। বরং মেয়েটা আশেপাশে থাকলে অজানা শান্তি লাগে মনে। এর মাঝেই ঐন্দ্রিলা অভ্রের কাছে চলে আছে। হাতড়াতে হাতড়াতে অভ্রের মুখখানা দু হাতের মাঝে ধরে সে। অভ্রের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি হাতে লাগতেই চোখের কাপড়টা সরিয়ে ফেলে সে। হুট করে চোখের সামনে অভ্রকে দেখে তড়িৎ-গতিতে খানিকটা পিছিয়ে যেতে নেয় ঐন্দ্রিলা। কিন্তু শাড়ির কুঁচিতে পা বেঁধে তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নেয়। ঐন্দ্রিলা ভয়ে চোখ বুঝে নেয়। মনে মনে ভাবতে লাগে কোমড়টা বুঝি এই চোটে ভেঙ্গেই গেলো৷ কিন্তু হঠাৎ অনুভব হয় একটা শক্ত হাত তার কোমড় আকড়ে ধরেছে। পিটিপিটি করে চোখ খুলতেই দেখে অভ্র তার দিকে বাঁকা হাসি দিয়ে তাকে অর্ধ ভাসমান অবস্থায় ধরে রেখেছে। এদিকে দিশান হাততালি দিয়ে বলতে থাকে,
– ইয়েস, বাবা মাম্মামকে ধলে ফেলেছে। ইয়েস

অভ্রের গরম নিঃশ্বাস ঐন্দ্রির মুখে আছড়ে পড়ছে। লোকটাকে কাছ থেকে আরোও সুন্দর লাগে। ঐন্দ্রির হৃদস্পন্দন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। অভ্র ফিসফিসিয়ে বললো,
– এভাবেই থাকবে?

কথাটা কানে যেতেই দ্রুত নিজেকে সামলে নেয় ঐন্দ্রিলা। অভ্রের কাছ থেকে পাঁচ মিটার দূরে সরে যায় সে। ঐন্দ্রিলার লাজুক মুখখানা যেনো আরোও বেশি মোহনীয় লাগছে তার কাছে। লজ্জা পেলে নারীকে এতোটা মোহনীয় লাগতে পারে এটা জানা ছিলো অভ্রের। ঐন্দ্রিলা এখনো চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। বুকের ধুকপুকানি টা এখনো কমে নি তার৷ আর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না এখানে। তাই কাঁপা কন্ঠে বলে,
– আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি চা দিচ্ছি।

বলেই ছুটে পালিয়ে যায় ঐন্দ্রি। অভ্র দিশানকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলে,
– তাহলে কি বুঝলা আব্বু? তোমার সিংহী মাম্মাম ও বাবাকে ভয় পায়।
– মোটেই না। আমার মাম্মাম বেস্ট
– তবে রে

বলেই দিশানকে কাতুকুতু দিতে থাকে অভ্র। আর দিশান খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। বাবা এবং ছেলের এই মূহুর্তটা কেউ দূর থেকে দেখে হয়তো মুচকি মুচকি হাসছে_________

নীলাদ্রির পৌছাতে দেড় ঘন্টা লেগে যায়। রাস্তার এই দেড় ঘন্টা সে পিউ এর সাথেই কথা বলে গেছে। পিউ এর বলা ঠিকানায় পৌছাতেই দেখে এক কোনায় পিউ এবং দুটি মেয়ে যবুথবু করে দাঁড়িয়ে আছে। নীলাদ্রি ছুটে যায় পিউ এর কাছে। ব্যাকুল কন্ঠে বলে,
– পিউ, কি হয়েছে?

পিউ ছলছল চোখে নীলাদ্রির দিকে তাকায়। পৃথিবীতে তিনটি মানুষের চোখের পানি নীলাদ্রি একেবারেই সহ্য করতে পারে না। প্রথমত বাবা, দ্বিতীয়ত তার কলিজার টুকরা ঐন্দ্রিলা আর সর্বশেষ এই মেয়েটা। নীলাদ্রি তার মুখটা দুহাতে ধরে উঁচু করে। পিউ ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রেখেছে। এবার হু হু করে মেয়েটা কেঁদে উঠে। নীলাদ্রি এবার শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,
– ফ্যাসফ্যাসানি থামিয়ে বল কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?

মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে হিচকি তুলে ফেলেছে। উপরন্তু নীলের ধমকে আরোও যেনো কান্নার বেগ বেড়ে গেছে। এবার নীল নিজেকে শান্ত করে বলে,
– পিউরানী, এভাবে কাঁদলে আমি কিভাবে বুঝবো কি হয়েছে?

তখন সাবা বলতে শুরু করে,
– ভাইয়া আমি বলছি। আমরা বাসায় যাবার জন্য যখন রওনা দিবো। তখন একটা বাইকে করে দুজন ছেলে পিউ এর পার্স ধরে টান মারে। পিউ শক্তহাতে পার্সটা ধরে রাখতে চায় তখন ওরা পিউ এর আঁচলেও টান দেয়। সিফটিফিন ছিলো বিধায় ভাগ্যিস আঁচলটা ছিড়ে গেছে। নয়তো আরো বাজে কিছু হতে পারতো। তখন থেকে পিউ ভয়ে চুপসে গেছে। আমরা ওকে একা তো ছেঁড়ে দিতে পারি না। তাই আপনাকে ফোন দেওয়াই। যে নাম্বার থেকে ফোন করা হয় সেটা আমার নাম্বার।

কথাটা শোনা মাত্র যেনো রাগে ফেটে পড়ে নীলাদ্রি। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলতে লাগে,
– যখন কেউ তোর পার্স ধরে টান মেরেছে তো ছেড়ে দিবি। ধরে রাখতে কে বলেছিলো? যদি আঁচলটা রাস্তায় খুলে যেতো? একবার চিন্তা করেছিস কি হতে পারতো? এতো বলদ কেনো তুই? নিজেকে কি ওন্ডার ওম্যান ভাবিস নাকি? সে তুই ধরে রাখবি আর ওরা তোর শক্তির কাছে টিকতে পারবে বা? কি হলো উত্তর দে?
– আ..আসলে প..পার্সে ফোনটা ছিলো। ও…খানে মা…..মায়ের সব ছবি ছিলো। আমি বু..বুঝি নি।

হিচকি তুলতে তুলতে কথাটা বলে পিউ। পিউ এর চোখের কাজল লেপ্টে চোখের নিচে কালো হয়ে গেছে। নাকটা বরাবরের মতো লাল হয়ে আছে। নীলাদ্রি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। আলতো হাতে পিউ এর চোখজোড়া মুছেদিলো। তারপর ধীর কন্ঠে বলল,
– আমি ফুপির সব ছবি খুঁজে দিবো৷ আর কাঁদতে হবে না। এভুল যাতে দ্বিতীয়বার না হয়। মনে থাকবে?
– হু
– চল বাসায় চল।

বলেই পিউ এর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। নীলাদ্রি অশান্ত বুকখানা যেনো শান্ত হয়েছে। পিউ গভীর নয়নে নীলাদ্রিকে দেখে যাচ্ছে। লোকটার হাজার বকুনী খেলেও বিপদের সময় সবার আগে এই লোকটার কথাই তার মনে পড়ে। কেনো! উত্তরটি তার অজানা! রাস্তার লোকের পিউ এর ছেঁড়া আঁচলটি ঘুরে ঘুরে দেখছে। তাই সরাসরি বাসার গেট অবধি সিএনজি ঠিক করে নীলাদ্রি৷ সারাটা রাস্তা পাশাপাশি বসে থাকা সত্ত্বেও কোনো কথা হয় নি তাদের কাছে। বাড়ির সামনে সিএনজি থামলে পিউ আগে নামে। ভাড়া মিটিয়ে হঠাৎ পেছন থেকে নীলাদ্রি বলে উঠে,
– পিউ, একটু দাঁড়া।
– হু বলুন
– আমি তোকে কিছু বলতে চাই।
– বলুন
– আসলে আমি তোকে………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here