স্বপ্নছায়া পর্ব-১০,১১

0
1812

স্বপ্নছায়া
পর্ব-১০,১১
মুশফিকা রহমান মৈথি
১০ম_পর্ব

ঐন্দ্রির কথা শুনে বাঁকা হাসি হাসে অভ্র। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হুট করেই ঐন্দ্রিলার কোমড় আকড়ে নিজের কাছে টেনে নেয়। অভ্রের এমন কাজে চোখগুলো বড় হয়ে যায় ঐন্দ্রিলায়। নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে টিটকারির স্বরে বলে,
– কেনো ভয় পাচ্ছো? একা আমার সাথে, তিন দিন৷ কেউ থাকবে না আমাদের মাঝে। শুধু তুমি আর আমি। বলা তো যায় না যদি কিছু হয়ে যায়, ভুল ত্রুটি।

অভ্র খানিকটা ঝুকে গেলো ঐন্দ্রিলার দিকে। তার গরম নিঃশ্বাস ঐন্দ্রিলার মুখে পড়ছে। অজানা কারণে তার বুকের স্পন্দন বেড়ে যায়। হাত পা খানিকটা ঠান্ডা হয়ে যায়। অভ্র খানিকটা নেশাকাতর স্বরে বলে,
– আজকাল বাতাসেও প্রেম প্রেম গন্ধ বইছে। সেই সুযোগে তুমি আমাতে ডুবে গেলে আর আমি তোমাতে। কেউ থাকবে না আমাদের মাঝে।

বলেই ঐন্দ্রিলার কপালের চুল গুলো আলতো স্পর্শে কানের কাছে গুজে দেয়। অভ্রের স্পর্শে ঐন্দ্রিলার মনে অজানা শিহরণ জাগে। তার গালদুটো লাল হতে লাগলো। অভ্রের চোখ চোখ রাখতেও তার লজ্জা করছে। এতোটা লাজুক এর আগে কখনো ঐন্দ্রিলা হয়েছিলো কি না তার মনে নেই। ঐন্দ্রিলা চোখটা নামিয়ে নিলো। অভ্র আরেকটু ঝুকে এলো৷ তার কানের কাছে মুখটা নিয়ে ধীর কন্ঠে বললো,
– লজ্জা পেলে বাঘিনীকেও রমনী লাগে।

বলেই ঐন্দ্রিলাকে ছেড়ে দেয় সে। আর হো হো করে হাসতে লাগে। ঐন্দ্রিলা এখনো সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। অবাক নজরে অভ্রকে দেখছে সে। তার হৃদস্পন্দন এখনো তীব্র হয়ে আছে। তার কান যেনো অভ্রের উত্তাপিত নিঃশ্বাসে পুড়ে যাচ্ছিলো। অভ্র কোনো মতে হাসি থামিয়ে বলে,
– যাক তোমাকেও কিস্তিমাত করা যায়। আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি কেবল
– ডোন্ট ওয়ারি, আমি তোমার সাথে প্রেম করতে সেখানে যাচ্ছি না। কাজে যাচ্ছি, সেটা নিয়েই ব্যাস্ত থাকবো। আমি থেকেও থাকবো না।
-…….
– বাবাকে মানা করলে উনি আরোও জোর করতো। বুড়ো মানুষটাকে অহেতুক উত্তেজিত করতে চাই নি। প্যাকিং করে নাও, আমরা সন্ধ্যায় বের হবো।

কথাগুলো বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো অভ্র। তারপর নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেলো। ঐন্দ্রিলা এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনের মাঝে যেনো কালো মেঘ ছেয়ে গেলো। অজানা কারণে আজ কষ্ট হচ্ছে তার। এক মূহুর্তের জন্য আবেশে জড়িয়ে গিয়েছিলো সে। ভেবেছিলো তাদের মাঝেও হয়তো আর পাঁচটা সম্পর্কের মতো একটা মায়ার মোহনজাল তৈরি হবে। কিন্তু সে ভুল ছিলো। নিজের বোকামির উপর নিজের ই রাগ হচ্ছে তার। যে মানুষটা বিয়ের রাতে কিনা নবুবধুর সাথে ডিল ক্রাক করে তার কাছ থেকে এমন একটি ব্যাবহার খুব একটা আশ্চর্যজনক নয়। ঐন্দ্রিলা কোনো কথা বললো না। তার মনে বিষাধের কালো মেঘ ভর করেছে। বর্ষণ হবার পূর্বাভাস। ঐন্দ্রিলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বৃষ্টির ক্রন্দন থেমেছে কেবল। আকাশটা এখনো পরিষ্কার হয় নি। কালো মেঘেরা এখনো ঘুরছে দল বেঁধে। গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছে করছে ঐন্দ্রিলার। নিজের ভেতরের ছাই চাঁপা লিকলিকে আগুনটা জ্বলছে। তাকে নেভানোর উপায় হয়তো এটাই। অনেক দিন যাবৎ তার কন্ঠে সুর তুলে না। তাই চোখ বুঝে গুনগুনিয়ে উঠলো,
“আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।
আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।
শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যা টুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম।
আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।
তোমার হাতেই হোক রাত্রি রচনা
এ আমার স্বপ্ন সুখের ভাবনা।
তোমার হাতেই হোক রাত্রি রচনা
এ আমার স্বপ্ন সুখের ভাবনা।
চেয়েছি পেতে যাকে চাইনা হারাতে তাকে
বৃষ্টি তোমাকে তাই ফিরে চাইনা।
আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।
শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যা টুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম।
আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম”___________________

অজান্তেই চোখজোড়া ভিজে এলো ঐন্দ্রিলার। কঠোর খোলসের ভেতরের কিশোরীটি আজ কাঁদছে, অনেক দিন বাদে সে আজ কাঁদছে।।

৬.
টেবিলের ল্যাম্প জ্বলছে। হাতে কলম হাতে বসে রয়েছে নীলাদ্রি। কিছু লিখছে আর কাঁটছে। নিচে গোল করে করে নষ্ট করা কাগজ গুলো পড়ে রয়েছে। বিকেল থেকে একটা চিঠি লেখার অদম্য প্রচেষ্টায় সে লিপ্ত। কিন্তু কিছুতেই লেখাটা মন মতো হচ্ছে না। সেদিনের পর থেকে পিউকে একদ্বন্দ ও একা পায় নি সে৷ হয় কাবাবে হাড্ডি দিশাটা আঠার মতো পিউ এর সাথে লেগেছিলো, নয় বদরুল সাহেব বা আসমা বেগমের কারণে কোনো না কোনো ভাবে বাঁধ সেধেছেই। তাই ব্যার্থ প্রেমিকের মতো চিঠিতেই প্রেমনিবেদন করাটাই শ্রেয় মনে হচ্ছে নীলাদ্রির। আজকাল মেয়েটা যেনো একটু বেশি এড়িয়ে চলছে তাকে। নীলাদ্রির ব্যাপারটায় মেজাজ খারাপ হচ্ছে কিন্তু কিছু করার নেই তার। মাঝে মাঝে তার খুব ইচ্ছে হয় মেয়েটাকে নিজের পাঞ্জাবির পকেটে লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু এসব কেবলই দিবাস্বপ্ন। এমন টা কি হতে পারে না, মেয়েটাও আড়ালে আবডালে তাকেই ভালোবাসবে। হতেই পারে! আশায় মানুষ বাঁচে। নীলাদ্রির ব্যাপারটাও সেইরকম। দরজার কড়া নাড়ার শব্দে তড়িৎ গতিতে কাগজ গুলো ডেস্কের ভেতর লুকিয়ে ফেললো নীলাদ্রি। আজকাল দিশাটা বড্ড পাজি হয়ে গেছে। বাচ্চাদের হাতে এই চিঠি নামক ভয়ানক অস্ত্রটি পড়লে সেটা এট্যোম বোম্বের মতো কাজ করতে সময় লাগবে না। ফলাফলস্বরূপ দুই বাড়ি হিরোশিমা এবং নাগাসাকির মতো ক্ষিপ্ত বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। তার সকল চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করে শরীফ সাহেব ঘরে প্রবেশ করলেন। নিজের বাবাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো নীলাদ্রি। ঠোঁটের কোনে হাসি একে বললো,
– কিছু লাগবে বাবা?

শরীফ সাহেব কফির মগটা নীলের দিকে এগিয়ে দিলেন। তারপর মুচকি হেসে বললেন,
– দেখ তো বাপ, খাওয়া যাচ্ছে কি না? আমি নিজে বানিয়েছি।

শরীফ সাহেব নীলাদ্রির মুখ থেকে উত্তর জানার অপেক্ষায় আগ্রহী হয়ে আছেন। তার চোখ চকচক করছে। অনেকটা বাচ্চাদের মতো, যখন কোনো বাচ্চা প্রথম কোনো অংকের উত্তর নিজে নিজে মিলায় তখন যেভাবে তার প্রশংসা শুনার জন্য আগ্রহী থাকে; শরীফ সাহেবকেও তেমন লাগছে। নীল কফির কাপে চুমুক দিলো, খারাপ হয় নি। প্রথম এটেম্প এ দশে আট নিঃসন্দেহে দেওয়া যায়। নীলাদ্রি উৎসাহী কন্ঠে বললো,
– বাহ! বাবা এক কথায় দারুণ। তুমি অবসর নেবার পর আমরা বাপ ব্যাটা চাইলে কফি শপ খুলতে পারবো, “ক্যাফে গুনগুন”। একপাশে বই এর তাক থাকবে। মানুষ ধোঁয়া উড়ানো কফির সাথে বই পড়বে। আমি গিটারটা নিয়ে সেখানে গান গাইবো। শ্রীকান্তের গান, অনুপমের গান। আহা! দিনে দশটা কাপ বিক্রি করলে নিমিষেই চারশত টাকা ইনকাম হয়ে যাবে। মাসে বারো হাজার। আর কি লাগে?

শরীফ সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। ছেলের সাথে অনেক দিন পর তার এভাবে আড্ডা হচ্ছে। ঐন্দ্রিলার বিয়ের পর থেকে তাদের মাঝে এক অঘোষিত যুদ্ধ হচ্ছিলো। যাকে ইংলিশে বলা হয় “Cold war”. কোন কামান দাগা ব্যাতীত মানুষকে আহত করা। আজ নিজ হাতে কফি বানানোর প্রচেষ্টা এই যুদ্ধে শান্তির সাদা পতাকা উড়ানোর জন্যই৷ এবং তিনি খুব নিপুনহস্তে এই কার্যসাধন করেছেন। কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে শরীফ সাহেব বললেন,
– তোর খালু তোকে খুজছিলেন।
– কেনো বলোতো?
– একটা ছেলের ব্যাপারে সকল ধরণের খোঁজ লাগানোর জন্য। অনেকটা স্পাই এর কাজ যাকে বলে।
– আর মানুষ পেলো না খালু, শেষ পর্যন্ত কিনা আমি?
– হ্যা, অবশ্যই। তুমি হলে তার বিশিষ্ট কমরেড। ছেলেটার নাম শিহাব আহমেদ। ছেলেটা তোমার অফিসেই কাজ করে। তাই তোমার থেকে ভালো খোঁজ কেউ নিতে পারবে না।
– হয়তো অন্য ডিপার্টমেন্টে। কিন্তু কথা হলো, ছেলেটার খোঁজ নিয়ে খালুর কি কাজ?
– পিউ এর সাথে ছেলেটার বিয়ের কথা চলছে। ছেলের বাবা-মার আমাদের পিউরানীকে খুব পছন্দ৷ তাই এই খোঁজ নেওয়া। ছেলেটার সম্পর্কে সব জেনে বদরুল বিয়ে দিতে চায়। সবাই তো আমার মতো ব্যর্থ পিতা নয়।

শরীফ সাহেবের কন্ঠে আক্ষেপের ছাপ স্পষ্ট। এদিকে পিউ এর বিয়ের কথাটা শুনেই বুকে মোচর লাগে নীলাদ্রির। খুব দেরি করে ফেললো কি সে! পিউ কি তবে অন্যের মনের গৃহে পদার্পণ করবে! তাহলে তার কি হবে!

চট্রগ্রাম পৌছাতে পৌছাতে রাত বারোটা বেজে গেলো অভ্র এবং ঐন্দ্রিলার। ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে। অক্লান্ত বৃষ্টির জন্য ড্রাইভ করতে এতোটা দেরি হয়েছে অভ্রের। অভ্রদের ফার্ম হাউজের সামনে গাড়ি থামে। রাতের অন্ধকারে ফার্মহাউজটি যেনো ভূতুড়ে বাড়ি ছাড়া আর কিছুই লাগছে না। বাগানে ঘেরা ছোট্ট একটা কাঠের দোতালা বাড়ি। বাড়ির সামনে বিরাট ফুলের বাগান। বেলি ফুলের গন্ধ নাকে আসছে ঐন্দ্রিলার। অভ্র বাড়ির কেয়ারটেকার কে খুঁজলো, হাঁক দিলো কিন্তু তার সারা পেলো না। হয়তো ঘুমোচ্ছে। কাছে কোনো ছাতাও নেই। গাড়ি থেকেই নামতেই খানিকটা ভিজে গেলও সে। খুব কষ্টে ব্যাগটা নামিয়েই ছুটলো বাড়ির ভেতরে৷ বাড়ির বাহিরের লাইটে আলো আধারের এক অনন্য পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। পেছনে ফিরতেই দেখলো ঐন্দ্রিলা দু হাত উজার করে বৃষ্টিতে ভিজছে। তার সাদা শাড়িটা ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। তার ঢেউ খেলানো চুল গুলো ভিজে মুখের সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। অভ্র অবাক নয়নে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীকে দেখছে। তার মনে হচ্ছে তার সামনে যেনো কোনো বর্ষায়৷ ভেজা শ্বেত কদম ফুল দুহাত ফেলে বর্ষাকে আলিঙ্গন করছে। অজান্তেই এই ফুলকে ছোয়ার আশায় এগিয়ে গেলো সে। বৃষ্টির শীতল পানিতে ভিজতে বেশ ভালো লাগছে ঐন্দ্রিলার। তার খেয়াল ও নেই একটি মানুষ তাকে গভীর নয়নে দেখছে। হঠাৎ সে অনুভব করলো…………..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#স্বপ্নছায়া
#১১ম_পর্ব

অভ্র অবাক নয়নে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীকে দেখছে। তার মনে হচ্ছে তার সামনে যেনো কোনো বর্ষায়৷ ভেজা শ্বেত কদম ফুল দুহাত ফেলে বর্ষাকে আলিঙ্গন করছে। অজান্তেই এই ফুলকে ছোয়ার আশায় এগিয়ে গেলো সে। বৃষ্টির শীতল পানিতে ভিজতে বেশ ভালো লাগছে ঐন্দ্রিলার। তার খেয়াল ও নেই একটি মানুষ তাকে গভীর নয়নে দেখছে। হঠাৎ সে অনুভব করলো তার ঘাড়ে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস পড়ছে। একজোড়া শীত হাত তার কোমড় আকড়ে ধরেছে। একজোড়া উষ্ণ ঠোঁট তার ঘাড় স্পর্শ করছে। এক মূহুর্তের জন্য ঐন্দ্রিলা স্থির হয়ে গেলো। শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বয়ে গেলো। ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠলো সে। এই স্পর্শটা মন্দ লাগছে না তো! সে কি তবে প্রতীক্ষায় ছিলো। তার হৃদয় কি তবে স্পর্শ কাতর হয়ে ছিলো। অভ্র তার ঘাড়ে মুখ গুঁজে রয়েছে। প্রকৃতির উম্মাদনায় আজ তারও উম্মাদ হতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে এই রমনীতে বিলীন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। ঐন্দ্রিলা নিজেকে ছাঁড়ানোর চেষ্টা করে। সকালের অপমানটা এখনো ভুলে নি সে। আবারো কারোর হাসির খোরাক হতে চায় না সে। অহেতুক মায়ায় জড়িয়ে কি লাভ! যেখানে দুটিই মনের মাঝে কোনো হাজারো ক্রোশের দূরত্ব সেখানে শুধু শারীরিক মিলনটা অহেতুক। ঐন্দ্রিলাকে ছটপট করতে দেখে খানিকটা বিরক্ত হলো অভ্র। মৃদু ধমকের স্বরে বললো,
– নড়ছো কেনো এতো?
– ছাড়ুন আমাকে।

কাঁপা কন্ঠে ঐন্দ্রিলা বলে উঠলো। অভ্র আরোও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো এবং ধীর স্বরে বললো,
– একটু শান্ত থাক না। শুধু এই মূহুর্ত টা আমাকে তোমাতে বিলীন হতে দাও।
– তারপর? মূহুর্তটা কেটে গেলে আমাকে আবারো দূরে সরিয়ে দিবেন তাই না?

ঐন্দ্রিলার শান্ত গলার প্রশ্নে অভ্র থমকে যায়। অভ্রকে স্তব্ধ থাকতে দেখে ঐন্দ্রিলা আবারো বলতে থাকে,
– আমি কারোর কয়েক মূহুর্তের মোহ হতে চাই না, সারাটা জীবনের অভ্যাস হতে চাই। আপনার বিলাসিতা নয় প্রয়োজন হতে চাই। শুধু শারিরীক নয়, মানসিক সঙ্গী হতে চাই; যার বিস্তার আপনার হৃদয়ে হবে। অবশ্য যে হৃদয়ে জ্যানিফারের রাজত্ব সে হৃদয়ে আমার মতো হতদরিদ্রেরর ঠায় হবে না। আমি কেবল ই একজন বহিরাগত, যার প্রবেশ আপনার ঘরে থাকলেও হৃদয়ে নেই। আমি বরাবর ই নাকউঁচু ধাঁচের। হৃদয়ের যন্ত্রণা নিবারণের জন্য নিজের আত্নসম্মানের জ্বলাঞ্জলি দেবার পক্ষপাতী আমি নই। আমি বলবো না, আমাকে ব্যাতীত কাউকে ভালোবাসা যাবে না; আমি বলবো না জ্যানিফারকে ভুলে যেতে হবে। তবে আমি শুধু শরীরের খোরাক হতে চাই না। যদি কখনো আপনার মনের খোরাক হতে পারি তবে একবার বলবেন; নিজেকে উজার করে দিবো। বলুন, আমি কি আপনার মনের কুঠিরে নিজের জন্য একটু হলেও জায়গা করতে পেরেছি?

অভ্র চুপ করে আছে। তার কাছে উত্তর নেই। তার হাত জোড়া আলগা করে দিলো সে৷ ধীর পায়ে সরে আসলো সে। ঐন্দ্রিলার বুকে যেনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অভ্র সেখান থেকে সরে যেতে নিলে ঐন্দ্রিলা ঘুরে কলারটা টেনে ধরে। অভ্রের চোখে চোখ রেখে এক রাশ অভিমান নিয়ে বলে,
– এতোটা কাপুরুষ কেনো আপনি? আপনার ভাই আমাকে বিয়ের আগে ভরা মশলিশে অপমান করে চলে গিয়েছিলো। আর আপনি প্রতিটাক্ষণ আমাকে অপমাণ করছেন। যদি ভালোবাসতেই না পারেন তবে কেনো মিথ্যে আশার হাতছানি দেন? যদি দূরে ঠেলেই দেবার থাকে তবে কেনো কাছে আসেন? কেনো আমার মনে আশার আলো জাগান? কেনো? যে মারা গিয়েছে তাকে আকড়ে আর কতদিন থাকবেন? কতোদিন নিজের মনের দরজায় তালা লাগিয়ে রাখবেন? বলুন

অভ্র চুপ করে আছে। উত্তরটা হয়তো তার কাছে আছে কিন্তু উত্তরটা শোনার মতো সাহস ঐন্দ্রিলা কেনো কোনো মেয়ের ই নেই। সম্পর্কের ভিত্তি কখনোই মিথ্যে হয় না। যেকোনো সম্পর্কের সূচনা তিক্ত হলেও সত্য দিয়ে করতে হয়। নয়তো একটা সময় সেটায় ফাটল ধরবেই। অভ্র শীতল কন্ঠে বললো,
– তুমি সত্যটা মেনে নিতে পারবে না ঐন্দ্রিলা। সত্য যে খুব তিক্ত। উত্তর গুলো সহ্য করতে পারবে তো? আমার সত্যগুলো মেনে আমাকে ভালোবাসতে পারবে? পারবে না। এর চেয়ে এই ভালোবাসার চ্যাপ্টারটা না হয় আমাদের সম্পর্কে নাই বা থাকলো। ভালোবাসা আমাকে নিঃস্ব করেছে। আমি দ্বিতীয়বার নিঃস্ব হতে চাই না ঐন্দ্রি। আমি ধ্বংস হতে চাই না। আমি তো বলেই দিয়েছিলাম, আমার কাছে ভালোবাসার দাবি করবে না। আমি এই অহেতুক অনুভূতিতে জড়াতে চাই না।
– আমাকে এতোটা দূর্বল ভেবেছেন আপনি? সব জেনেও আমি যদি দিশানকে মেনে নিতে পারি; তবে আমি আপনার বিক্ষিত ধ্বংসাবশেষগুলো কেনো কুড়িয়ে নিতে পারবো না! আফসোস আপনি আমাকে এতোটা দূর্বল ভাবেন!

ঐন্দ্রিলা অভ্রের কলার দিলো। দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলো সে। বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু অভ্র সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার ভেজা শার্ট থেকে পানি পড়ছে, ঠান্ডা বাতাসে শরীর কাঁপছে। কিন্তু অভ্র নড়ছে না। সে কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কাঁপা কন্ঠে বলে উঠে,
– একজন খুনীকে কি ভালোবাসা যায় ঐন্দ্রি

পরিবেশ শান্ত, ঠান্ডা বাতাস বইছে। বাগানের ভেজা ঘাসের উপর ভেজা শরীরে অভ্র দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চাহনীতে শূন্যতা___________

দুপুর ১.৩০টা,
ক্যান্টিনে মুখোমুখি বসে রয়েছে শিহাব এবং নীলাদ্রি। শিহাব এইচ.আর ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। লম্বা, ফর্সা, লিকলিকে শরীরের ছাব্বিশ বয়সের ছোকড়া সে। চুল গুলো বেশ কায়দা করে জেল দেওয়া, চোখে চশমা। ছেলেটার মধ্যে কোনো ক্ষুদ নেই। ছয় মাস হয়েছে ছেলেটা জয়েন করেছে। তাই নীলাদ্রির সাথে তার পরিচিতি পর্বের সুযোগ হয়ে উঠে নি। নীলাদ্রি সবার থেকে শুনেছে, ছেলেটা নাকি অতিরিক্ত ভদ্র। কারোর সাথে মন্দ ব্যাবহারের এই অবধি কোনো রেকর্ড নেই। সিগারেট খায় না, মদ নেশায় সে একেবারেই নেই। মারপিট থেকে চারশ গজ দূরে থাকে। ছেলেটাকে এক দেখাতেই খালুর পছন্দ হয়ে যাবে। তাই এখন অন্য পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। অনেকটা রিভার্স সাইকোলজি যাকে বলে। বদরুল সাহেব না করুক বা শিহাব কথাটা তো একই। পিউ এর বিয়ে টা ভাঙ্গাই মূল উদ্দেশ্য। শিহাব খানিকটা অস্বস্তিবোধ করছে। অপরিচিত সিনিয়র কলিগের সাথে বসে খেতে তার খানিকটা ইতস্ততবোধ ও হচ্ছে। নীলাদ্রি খানিকটা উৎসাহের সাথে বললো,
– তা গার্লফ্রেন্ড টার্লফ্রেন্ড আছে নাকি?

একে বেঁচারা ঘেমে নেয়ে একসার হয়ে যাচ্ছে, উপরে এমন অদ্ভুত প্রশ্নে তার বিষম খাবার জোগাড়। খুব কষ্টে নিজেকে সামলে বললো,
– না ভাই, ছিলো গার্লফ্রেন্ড কিন্তু ব্রেকাপ হয়ে গেছে।
– কেনো?

নীলাদ্রির প্রশ্নে শিহাব আরোও অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। অচেনা একজনকে নিজের ব্যাক্তিগত ব্যাপার বলাটা ভালো হবে কিনা সে বুঝতে পারছে না। তবুও সিনিয়র কলিগ তাই কিছু বলতেও পারছে না। আমতা আমতা করে বললো,
– ছিলো কিছু ইস্যু। আসলে আমার বাবা-মা আমার বিয়ের কথা চালাচ্ছে। তাই এখন আর প্রেম করবো না ঠিক করেছি।
– ওহ! তা মেয়ে দেখেছো?
– না ভাই! দেখি নি। তবে মা বলেছে অনেক সুন্দরী। সামনের সপ্তাহে দেখতে যাবো।

একটু লাজুক স্বরেই কথাটা বললো শিহাব। নীলাদ্রির ইচ্ছে করছিলো শিহাবকে তুলে আছাড় মারতে। কিন্তু অফিসে শুধু শুধু সিন ক্রিয়েট হবে। তাই সে কিছু করলো না। কিন্তু শিহাবের স্বপ্নে ব্যাঘাত তো ঘটাতেই হবে। তাই উদাস কন্ঠে বললো,
– আসলে কি জানো তো! আমার ও বিয়েটা এরেঞ্জ ই ঠিক হয়েছিলো। মেয়েও দারুণ সুন্দরী ছিলো। বাবা-মা এর কথায় মেয়ের সাথে দেখা করতে রাজী হয়ে গেলাম। আমি তো সুন্দরী বউ এর স্বপ্নে বিভোড় ছিলাম। আমি মেয়ের বাড়িতেই যাচ্ছিলাম তখন একদল গুন্ডা এসে ওরে মার, ওরে মার মারলো। পড়ে জানতে পারলাম ওটা নাকি মেয়ের বয়ফ্রেন্ড ছিলো। এখনো সেই মারের কথা মনে আছে। তুমিও খোঁজ নিও, সুন্দরী মেয়েদের বয়ফ্রেন্ড বা প্রেমিকরা খুব ডেঞ্জারাস হয়। যখন ক্যালায় না হাড় ভেঙ্গে দেয়। ক্যারাটে পারো তো?
– আজ্ঞে না?
– তাহলে আর কি! আল্লাহ ভরসা। সাবধানে থেকো। আমার খাওয়া শেষ

বলেই নীলাদ্রি উঠে দাঁড়ালো। মুখে শয়তানি হাসি এঁকে হাটা দিলো নিজের রুমের দিকে। পেছনে তাকালে শিহাবের চিন্তিত মুখখানা দেখতে পেতো। বেঁচারা এখনো কপাল কুঁচকে বসে রয়েছে। সুন্দরী বউ স্বপ্নটা খানিকটা দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে তার কাছে। এদিকে নীলাদ্রি তার আগামী পরিকল্পনার ছক কষতে কষতে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেলো।

৭.
ভিলার পেছনের পুকুরে পা ঢুবিয়ে বসে রয়েছে ঐন্দ্রিলা। ঠান্ডা পানিতে পা ঢুবিয়ে থাকার মজাই আলাদা৷ পুকুরটি সাদা শাপলায় ঘেরা। সাদা শাপলা খুব একটা দেখা যায় না এখন। ঢাকার মতো ইট পাথরের শহরে এই ফুলটি বেশ বিরল। এখানে না আসলে প্রকৃতির এতোটা কাছে আসা যেতো না। দিনের বেলায় ভিলার সৌন্দর্য যেনো দ্বিগুন বেড়ে যায়। এক পাশে কদম, বেলীর উম্মাদনা তো অন্য পাশে কৃষ্ণচূড়ার মেলা। ঐন্দ্রিলা আজ অনেক কদম ফুল ছিড়েছে। তার কদম ফুল খুব ভালো লাগে। ফুলটি দেখলেই বর্ষাকালের অনুভূতি পাওয়া যায়। এখানে থাকতে খুব ভালো লাগছে ঐন্দ্রিলার। কিন্তু আগামীকাল ঢাকায় ফিরতে হবে তাকে। সেই রাতের পর থেকে অভ্র তার সামনে আসে নি। নিজেকে যেনো আড়াল করে ফেলেছে সে। ঐন্দ্রিও তাকে খুঁজতে যায় নি। যে নিজেই হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এর মাঝেই বাড়ির কেয়ারটেকার লতিফ ছুটে আসে ঐন্দ্রিলার কাছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
– ভাবীজান, একটু ভেতরে আসেন।
– কি হয়েছে লতিফ ভাই?
– ভাইজানের শরীরটা ভালা নাই………

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here