“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৫১
(নূর নাফিসা)
.
.
পরদিন সকালে রুমানা বেগম ও নাফিসাকে হসপিটালে রেখে আরাফ বাড়ি ফিরে গেছে। গতকাল স্কুল মিস হয়েছে ,কিন্তু আজ যেতে হবে। স্কুল টাইম ওভার হতেই সে কোচিং অফ রেখে চলে এসেছে হসপিটাল। নিয়াজ উদ্দিনকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যার মধ্যে সবটা গুছিয়ে আরাফ তাদের বাড়ি নিয়ে গেছে। বাড়িতে এখন দুই রোগী। নাজিয়া কিছুটা সুস্থ হলেও পুরোপুরি না। আরাফ আজ এখানেই থেকেছে। পরদিন আবার এখান থেকেই স্কুলে গেছে। নাফিসার ভার্সিটি যাওয়া হচ্ছে না বেশ কিছুদিন ধরে। নাহিদা নাফিসা দুজনেই পড়াশোনার বাইরে। নিয়াজ উদ্দিন বাড়ি ফেরার চার পাচ দিন পর ইমরান, তার ভাই ও ভাবি এসেছে নাফিসাকে দেখতে। শুনেছে তার বাবা-ই নাকি আসতে বলেছে তাদের। যদিও মেহমান আসছে শুনতেই নাফিসার খুব বিরক্ত লাগছিলো। কেননা সে এখন বিয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত না! তবুও মায়ের চোখ রাঙানো দেখে সে উপস্থিত হয়েছে আজ মেহমানের সামনে। মেহমানদের মাঝে ইমরানকে দেখে তো সে চরম অবাক! সে তো একে একদিন ভার্সিটিতে দেখেছে আশিকের সাথে! ঝগড়াটে লোক একটা! কিন্তু এখানে দুইজন পুরুষকে দেখে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে কোনটা পাত্র! পরক্ষণে খেয়াল এলো আপুর কাছে শুনেছে ভাই, ভাবি আর ছেলে এসেছে। সেই সুত্রে সে নিশ্চিত তুলনামূলক অল্প বয়সের ছেলেটা অর্থাৎ ইমরানই পাত্র। ইমরানের চোখে চোখ পড়তেই ইমরান জিজ্ঞেস করেছিলো, “কেমন আছো?”
নাফিসা দৃষ্টি সরিয়ে মলিনতার সাথে জবাব দিলো, “আলহামদুলিল্লাহ।”
এতোক্ষণ নিয়াজ উদ্দিন বসে ছিলেন মেহমানদের সাথে। এখন নাফিসাকে নিয়ে আসায় তিনি উঠে চলে গেলেন৷ আরাফ আজ এখানে নেই। আসতে বলা হয়েছিলো তাকে কিন্তু সে ব্যস্ততা দেখিয়ে আর এলো না। যদিও এর মূল কারণ নাজিয়ার জানা। আরাফ এলে নাফিসা নিশ্চিত ভাববে আরাফ তার জন্য এই সমন্ধটি নিয়ে এসেছে। এমনিতেই সে একটুতে রাগ করে ফেলে, আর এখানে সম্পূর্ণ ভাবে দোষারোপ করবে আরাফকে। কেউ তার উপর রেগে থাকুক সেটা চায় না আরাফ। তাই ঝামেলা থেকে দূরেই আছে।
নাজিয়ার পরিচিত হওয়ায় নাফিসার সাথে এ রুমে নাজিয়া এসেছে। মেহমানদের মধ্যে মহিলাটি জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছেন ভাবি?
– আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?
– আছি, আলহামদুলিল্লাহ।
– জিহান, কেমন আছো তুমি?
ইমরানের কোলে থাকা পিচ্চিটা লজ্জায় যেন ইমরানের সাথে মিশে গেছে! তা দেখে নাজিয়া, ইমরান এবং বড় ভাই আরমান হেসে উঠলো। নাফিসা এতোক্ষণে বুঝে গেছে এরা নিশ্চয়ই নাজিয়ার শ্বশুর বাড়ির দিক থেকে পরিচিত! নাজিয়া নাফিসা সমন্ধে বলে পরিচয় করিয়ে দিলে শুরু হলো জিহানের মায়ের জিজ্ঞাসাবাদ!
– নিয়মিত নামাজ পড়ো?
– হুম।
– কুরআন পড়তে জানো?
– হ্যাঁ।
– বলোতো কুরআনের কয়টি সূরা আছে?
– ১১৪টি।
– ১১৪ সূরার নাম বলোতো কি কি?
– মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগের জন্য কি ভাইভা নিচ্ছেন? আমি চাকরি করবো না আপনার মাদরাসায়।
মহিলাটি বাদে বাকিরা মুখ টিপে হাসলো! তিনি আবার বললেন,
– বেশ চতুর তুমি! দেখেই বুঝা যায়! আচ্ছা, যাও। নিলাম না ভাইভা। রান্না করতে জানো?
– মোটামুটি।
– মোটামুটি বলতে, কখনো লবনের সল্পতা আবার কখনো প্রাচুর্যতা ! এইতো?
নাফিসা বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না। স্বভাবতই মেয়ে দেখতে এলে খুটিয়ে খুটিয়ে এতো জিজ্ঞাসাবাদ নাফিসার বিরক্ত লাগে! মহিলাটি আবার বললো,
– ঘর ঝাড়ু দেওয়া, ঘর মোছা, পরিবারের সদস্যদের যত্ন নিতে পারো?
ইমরান তার ভাইকে ইশারা করলো ভাবিকে থামানোর জন্য। আরমান শান্ত স্বরে বললো, “জেরিন!”
কিন্তু এবার নাফিসা আর চুপ থাকতে পারলো না। সে বলেই ফেললো,
– আপনি বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে এসেছেন নাকি বাড়ির জন্য কাজের বুয়া খুজতে এসেছেন!
– কাজের বুয়া কেন খুজতে আসবো! ঘরে বউ থাকলে কাজের বুয়ার কি প্রয়োজন! এসব কাজ তো বউদেরই করতে হয়!
– তো সেটা বউ হলে না করে দেখাবে!
– আচ্ছা! ইংলিশে এড্রেস লিখে দেখাও দেখি।
– আপু কিন্তু বলেছে আমি অনার্সে পড়ি। এড্রেস লেখা বাচ্চাদের কাজ।
নাফিসাকে থামাতে নাজিয়া দাত চেপে নিচু শব্দে বললো,
– নাফিসা! চুপ থাকো। অতিরিক্ত কোনো কথা বলবে না। আমি খাতা নিয়ে আসছি।
আরমান বললো,
– না ভাবি, প্রয়োজন নেই। জেরিন, এসব কি শুরু করেছো তুমি!
– কেন, দেখতে এলে তো এড্রেস চায় ই! এতে কিছু শুরু করার কি আছে! আমার সময়ও চাওয়া হয়েছিলো।
– আমি চাইনি তোমার কাছে।
– তুমি না চাইলেই কি, অন্য যারা দেখতে এসেছে চেয়েছে না! ভাবি, আপনাকে দেখতে এসে এড্রেস চায়নি?
নাজিয়া জবাব দিলো,
– হ্যাঁ।
জেরিন আবার বললো,
– তো! এটা স্বাভাবিক! চাইতেই পারে।
আরমান বললো,
– যারা প্রাথমিক শিক্ষাটাও জানে না, তাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। আর তুমি এতো মাথা ঘামাচ্ছো কেন। এড্রেস যদি না ই বা লিখতে জানে ইমরান শিখিয়ে নিবে। এসব তথ্য নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
– তো আমাকে নিয়ে আসার কি প্রয়োজন ছিলো!
– দেখার জন্য। তাছাড়া অন্যকিছুও তো জিজ্ঞাসা করতে পারো যেগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন, কিছুক্ষণ আগে জিজ্ঞেস করলে নামাজ, কুরআন পড়ে কিনা এমন কিছু। অথবা তার সম্পর্কে জানতে পারো।
– প্রয়োজন নেই আর জানার। তোমরাই জানো বেশি করে।
জেরিন আর কোনো কথা বললো না। নাফিসার একটুও ইচ্ছে করছে না এখানে বসে থাকতে! আরমান বলার পরপরই নাফিসা উঠে চলে গেলো। নাজিয়া আরও কিছুক্ষণ বসে কথা বলেছিলো তাদের সাথে। রুমানা বেগমকেও ডাকা হয়েছে। সাক্ষাৎ শেষে তারা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো। নিয়াজ উদ্দিন বাড়ির সীমানা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলেন। আর এদিকে শুরু হলো নাফিসার স্পেশাল ক্লাস! নাহিদা ও তার মা পাশের রুমে থেকে তাদের কথাবার্তা শুনছিলেন। আর এখন ঝাড়ছেন! অন্যের কথা শোনার একটু ধৈর্য যেন নেই তার! ভালো লাগলে মাথায় নিবে আর ভালো না লাগলে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিবে। মুখের উপর এভাবে জবাব দেওয়ার কি প্রয়োজন সেটা নিয়েই রুমানার রাগ হচ্ছে নাফিসার উপর!
সেখানে মুখের উপর জবাব দিলেও এখন নাফিসা পরিবারের লোকদের উপেক্ষা করে নতুন পোশাক পালটে তার খামারে চলে গেলো।
পরিবেশ শান্ত হলে নাফিসা সন্ধ্যায় নাজিয়ার কাছে জিজ্ঞেস করলো,
– আপু, ওরা তোমাদের কি হয়?
– কারা?
– আজ যে এসেছে।
– তোর ভাইয়ার খালাতো ভাই আর ভাইয়ের বউ।
– আপন?
– হুম।
– ভাইয়া নিয়ে এসেছে না তাদের?
– তোর ভাইয়া এসেছে বুঝি!
– না আসুক, ভাইয়ার পরিচিত যেহেতু ভাইয়াই আসতে বলেছে। তা না হলে এলো কিভাবে!
– শুনিস নি, বাবা বলেছে আসতে! আর ঘরে উপযুক্ত মেয়ে থাকলে দেখতে আসবেই এদিক সেদিক থেকে। তাই বলে মেহমানদের সাথে এভাবে জবাব দিতে হয় না।
– আমি কি উপযুক্ত হয়ে গেছি?
এমন প্রশ্নে নাজিয়া অন্যরকম এক দৃষ্টিতে তাকালো নাফিসার দিকে। হঠাৎই আগমন ঘটলো নাহিদার। সে বললো,
– আপু, একে অতসব বুঝিয়ে লাভ নেই! কিছুদিন আগে ফুপির ঘরে যেই এলাহি কাণ্ড ঘটিয়েছে! মায়ের কাছে শুনে আমি হাসতে হাসতে শেষ!
– কি হয়েছে?
– শুনো নি?
– না তো!
নাহিদা আবার সেদিনের গল্প জুড়ে দিলো। আর দুইবোন আবারও হেসে কুটিকুটি! আর নাফিসা রেগে কিড়মিড়!
পরদিন জানতে পারলো নাফিসাকে নাকি পছন্দ হয়েছে তাদের! কিন্তু নাফিসার যে পছন্দ হয়নি! এমনিতেই বিয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত না তার উপর পাত্র আরাফের খালাতো ভাই! অর্থাৎ ওই বদ মহিলার বদ বোনের সন্তান! উনি যেহেতু এমন তাহলে উনার বোনও একই স্বভাবের হবে সে নিশ্চিত! তাই আরও বেশি অপছন্দনীয়! ওদের আত্মীয়তে সম্পর্ক জুড়তে সে যাবে না!
ভেবে ভেবে মাথা খাটিয়ে কিছু প্ল্যান করলো। আরাফ এ বাড়িতে এলে সে ইমরান নাম খুঁজে খুঁজে ফোনে দুইটা নম্বর পেলো আরাফের ফোন থেকে। পরিকল্পনা মোতাবেক দুদিন পর ভার্সিটি গিয়ে কল করার জন্য নোট বুক বের করলো। আরাফের ডায়াল লিস্টে কোনটা আগে ছিলো সেটা ভুলে গেছে সে। প্রথমে একটাতে দিতেই রিসিভ হলো এবং সালাম দিলো সে। লোকটা সালাম নিয়ে জানতে চাইলো “কে? হ্যালো?”
নাফিসা সাথে সাথে কেটে দিলো। সে নিশ্চিত এটা ইমরান হবে না। লোকটা কেমন যেন টানা ভাষায় কথা বললো, মনে হলো লোকটা বরিশালের হবে! কেননা তার ভার্সিটির বরিশালের স্যারদের কথা এমন টানা টানা!
সে দ্বিতীয় নম্বরে কল দিতেই রিসিভ হলো এবং তার আগেই অপর পাশ থেকে সালাম দিলো। সে সালামের জবাব দিতেই ওপাশ থেকে বললো,
“কেমন আছো?”
গলাটা এতোটাই শান্ত ছিলো, নাফিসার মনে হলো যেন লোকটা তার প্রেমিকার সাথে কথা বলছে! সে ঠিক জায়গায় কল দিয়েছে তো! ভাবছে মনে মনে।
তাকে নিরব দেখে ওপাশ থেকে বললো, ” হ্যালো? হ্যালো? নাফিসা?”
তার নাম শুনতে পেয়ে নাফিসা চমকে উঠলো! সে কি মানুষের কাছে কল করেছে নাকি ভুতের কাছে! লোকটা জানলো কিভাবে নাফিসা কল করেছে! নাফিসা ঢোক গিলে বললো,
– আপনি জানলেন কিভাবে আমি কল করেছি?
– আরও তিনদিন আগে থেকে তোমার দুইটা ফোন নম্বর সেভ করা আছে।
– কোথায় পেলেন!
– সম্পর্কে তুমি আমার বেয়াইন! ফোন নম্বর পাওয়া ব্যাপার নাকি!
– আমি আপনার কিছু না।
– আচ্ছা কিছু না। শুধু মাত্র হবু বউ। ওকে? এবার বলো, কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
– আলহামদুলিল্লাহ।
– আমি আপনাকে একটা বিশেষ প্রয়োজনে কল করেছি।
– আমি ভেবেছিলাম ভুলে কল এসেছে! আচ্ছা বলো, কি প্রয়োজন।
– আমি এখন বিয়েটা করতে পারবো না। আর আপনি কথাবার্তা না এগিয়ে ক্যান্সেল করে দিন। অন্য মেয়ে দেখা শুরু করুন।
– বিয়ে না করার কারণ?
– সামনে আমার এক্সাম। পড়াশোনা শেষ করার আগে এসব নিয়ে ভাবছি না।
– তোমার পরিবার তো তোমাকে বিয়ে দিয়েই দিবে।
– আপনি নিষেধ করলেই তো আর দিতে পারবে না।
– আমি নিষেধ করলেও তো অন্য একজন ঠিকই আসবে।
– অন্য একজনকেও আসতে দিবো না!
ইমরান হেসে বললো,
– জীবনে বিয়ে করবে না, সেই সিদ্ধান্তে অটুট হয়েছো নাকি!
– হ্যাঁ।
– তাহলে সেটা কখনো সম্ভব হতে দিবে না। কোনো পরিবারই না। এমনকি সমাজও না। আর আমিও নিষেধ করছি না।
– কেন?
– তোমার মতো একজনকে প্রয়োজন আমার। অন্যথায় ভালো লেগেছে তোমাকে, তাই।
আপাতত আর কিছু বলার জন্য খুজে পাচ্ছে না নাফিসা। চোখের সামনে ক্যাম্পাসে জোড়া পাখিদের দেখে একটা উপায় এলো মাথায়। তাই সে বলে দিলো,
– আমার বয়ফ্রেন্ড আছে।
– এতোক্ষণ পর বয়ফ্রেন্ডের কথা মনে হলো!
নাফিসা বিরক্তি নিয়ে কপালের এক কোনে স্লাইড করতে করতে বললো,
– বলতে চাইছিলাম না, কিন্তু এখন বলতে বাধ্য হলাম। আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। সুতরাং ক্যান্সেল করে দিন।
– এসব বয়ফ্রেন্ড টয়ফ্রেন্ড রাখা ভালো না। একটু মনোমালিন্য হলেই প্রেমে বিচ্ছেদ! তার চেয়ে ভালো, ব্রেকাপ করে দাও। আর আজ থেকে… না, বিয়ের পর থেকে আমাকে নতুন করে বয়ফ্রেন্ড ভাবতে শুরু করো কেমন?
নাফিসা কল কেটে কপাল চাপড়ালো! তার প্ল্যান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিলো লোকটা! বেহায়া লোক একটা!