স্বপ্নছায়া পর্ব-১৪,১৫

0
1801

স্বপ্নছায়া
পর্ব-১৪,১৫
মুশফিকা রহমান মৈথি
১৪তম_পর্ব

ঐন্দ্রিলা হা করে অভ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। লোকটার মধ্যে একজন আদর্শ বাবার সকল ধরণের গুন রয়েছে। সে দিশানকে আদর করে আবার শাসন ও করে। কিন্তু তার শাসনটা বেতাঘাতের মতো নয়। যত দিন যাচ্ছে ততই যেনো অভ্রকে নতুন করে আবিষ্কার করছে ঐন্দ্রিলা। লোকটার কত আবরণ! একটার পর একটা আবরণ খুলছে আর মুগ্ধ নয়নে দেখছে সে তার হৃদয়হীন বরকে। অভ্রের মাথায় খানিকটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে। সে ঐন্দ্রিলার কাছে এসে ফু দিয়ে তার কপালের চুল গুলো সরিয়ে দেয়। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে,
– কি দেখছেন দিশানের মাম্মাম? আমি কি সুন্দর হয়ে উঠেছি? এভাবে দেখতে থাকলে তো প্রেমে পড়ে যাবেন।
– পড়ার তো কিছু নেই, অলরেডি প্রেমে পড়ে সাঁতার কাটছি। ডুবেও যেতে পারি। হয়তো দেখা যাবে কোনো এক সময় তলিয়ে যাবো।

ঐন্দ্রিলা অকপটে কথাটা বলে দিলো৷ ঐন্দ্রিলার স্বতঃস্ফূর্ত উত্তরে খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো অভ্র। সে ভেবেছিলো ঐন্দ্রিলা হয়তো পুনরায় লজ্জায় লাল হয়ে যাবে আর সেই সুযোগে ঐন্দ্রিলার লাজুক চেহারাটা দেখতে পাবে। ঐন্দ্রিলার লাজুক মুখশ্রী যে অভ্রের প্রচন্ড প্রিয়। কিন্তু সেটা হলো না। আজ সে ঐন্দ্রিলার অন্য একটি মুখশ্রী দেখছে। ঐন্দ্রিলা এক রাশ আবেগ দিকে অভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির প্রতিটা রুপ তাকে ঘোরে ফেলে দেয়। সেটা হোক তার মাতৃ রুপ, তার বাঘিনী রুপ অথবা লজ্জাবতী রুপ। কিন্তু আজ তার এই প্রেমময় রুপটি ঠিক মেনে নিতে পারছে না অভ্র। অভ্র ভেবেছিলো তাকে দূরে সরিয়ে দেবার পর ঐন্দ্রিলা তার কাছে আসবে না। কিন্তু সে ভুল ছিলো। ঐন্দ্রিলা এখনো একরাশ প্রেমের ডেউ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার প্রেম নিবেদন করেছে। অভ্র খানিকটা সরে যেতে নিলে ঐন্দ্রিলা তার দিকে এগিয়ে আসে। তার চোখে চোখ রেখে আবেগপ্রবণ কন্ঠে বলে,
– ভয় পাবেন না। আপনাকে আমি প্রেমনিবেদন করছি ঠিক ই কিন্তু সেই প্রেমনিবেদনকে গ্রহণ করতে বলছি না। সত্যি বলতে আমি প্রতিনিয়ত নতুন করে আপনার প্রেমে পড়ি। কখনো আপনার ব্যাথিত হৃদয়ের, কখনো আপনার শান্তচিত্তের তো কখনো আপনার খচ্চরপনার। আমি প্রতিনিয়ত নতুন করে আপনাকে আবিষ্কার করি এবং তার প্রেমে পড়ি। সব প্রেমের পূর্ণতা পেতে হবে এই কথাটা ঠিক নয়। কিছু প্রেম অপূর্ণই ভালো। প্রেম, ভালোবাসায় রুপান্তর না হওয়া পর্যন্ত কষ্ট লাগে না। কারণ কাউকে পাবার, তার মনে রাজত্ব করার ইচ্ছে তখন মনে জন্মায় না। কিন্তু সেই প্রেম যখন আপনার হৃদয়ে ভালোবাসার মোহ তৈরি করে তখন না পাওয়ার যন্ত্রণা অসহনীয় হয়ে উঠে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমার প্রেম প্রেম ই থাকবে, ভালোবাসার মোহ-মায়াতে রুপান্তরিত হবে না।

ঐন্দ্রিলার কন্ঠ কাঁপছে। তার চোখ ছলছল করছে। হৃদয় বিষাদময় হয়ে গেছে। তার সুখময় প্রেম, বিষাক্ত ভালোবাসায় পরিণত হবার চেষ্টায় লিপ্ত। এই মোহ অভ্রের বদ্ধ হৃদয়ে কড়া নাড়তে চায়। অভ্রের হৃদয়চিত্তে নিজের রাজত্ব করার মোহের সাথে তাকে প্রতিনিয়ত লড়তে হয়। ঐন্দ্রিলা উঠে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। তার অভ্রের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তার দূর্বলতা কাউকে দেখাতে মোটেই রাজী নয় সে। সে অভ্রের সমবেদনা পেতে চায় না। অভ্র এখনো সেখানেই বসে রয়েছে। পরাজিত সৈনিকের ন্যায় ঐন্দ্রিলার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে রইলো সে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। দু হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো সে। ধীর স্বরে বললো,
– প্রেমে তো আমিও পড়েছি। প্রতিনিয়ত, প্রতি মূহুর্ত৷ তোমার প্রেমে তলিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এই প্রেম যে আমার জীবনের অভিশাপ। আমি তোমার জীবনের অভিশাপ হতে চাই না। আমি যে পাপী, খুনী, অপরাধী। আমার এই রুপকে যে তুমি ঘৃণা করবে। তখন নিজেকে ঘৃণা করবে

অভ্র চোখ বুঝতেই এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার চোখ থেকে। বুকে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। হয়তো এই যন্ত্রণা ঐন্দ্রিলার বুকে সূচের মতো বিধছে। একেই হয়তো বিষাক্ত ভালোবাসা বলে___________

গোধূলী বেলা দিনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। হলুদ আলোয় প্রকৃতি প্রচন্ড সুন্দর রুপ ধারণ করে তখন। অধিকাংশ ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফার এই সময়কে ছবি তোলার আদর্শ সময় রুপে বেঁছে নেয়৷ কিন্তু আজ প্রকৃতি আরোও বেশি মনোরম হয়ে রয়েছে। টানা এক ঘন্টা ঝুম বৃষ্টিতে ইট-পাথরের ঢাকা বেশ তলিয়ে গেছে। দুপুরের ধু ধু গরম নিমিষেই উধাও হয়ে গিয়েছে। আকাশে রঙধনু উঠেছে। রংধনুর জন্য আকাশটিকে অনন্য শিল্পকর্ম লাগছে। বৃষ্টি থেমেছে মিনিট বিশেক হবে। ছাঁদে পানি জমে আছে। বরফের থেকেও শীতল এই পানি। পা দিলে কাটা লাগে গায়ে। এই পানির মধ্যে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে পিউ। তার মন আজ প্রচন্ড ভালো। আর পরিবেশটা এতো মনোরম হয়ে রয়েছে যে তার মন আরো ভালো হয়ে গিয়েছে। আকাশটি হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে, ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। সেই বাতাসে চোখ বুঝে থাকতে বেশ লাগছে পিউ এর। পিউ এর কেনো যেনো গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছে করছে,
“চেনাশোনার কোন বাইরে যেখানে পথ নাই নাই রে
চেনাশোনার কোন বাইরে যেখানে পথ নাই নাই রে
সেখানে অকারণে যায় ছুটে
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে”

পিউ এর গানের লাইন শেষ হতেই পেছন থেকে এক পুরুষালী কন্ঠ ভেসে আসে।
“বৃষ্টি-নেশা-ভরা সন্ধ্যাবেলা কোন বলরামের আমি চেলা,
আমার স্বপ্ন ঘিরে নাচে মাতাল জুটে–
যত মাতাল জুটে।
যা না চাইবার তাই আজি চাই গো,
যা না পাইবার তাই কোথা পাই গো।
পাব না, পাব না,
মরি অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে”

পিউ অবাক নয়নে মানুষটিকে দেখছে। চোখ বুজে আবেগপ্রবণ কন্ঠে সে গান গাইছে। মানুষটি আর কেউ নয় বরং নীলাদ্রি। নীলাদ্রির কন্ঠে গান অনেকটা গঞ্জিকার ন্যায়। নেশায় ফেলে দেয় পিউ কে বরাবর ই। ছোটবেলায় যখনই গিটার হাতে নীলাদ্রি সুর তুলতো পিউ দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনতো। এজন্য অবশ্য কম লজ্জা পেতে হয় নি তাকে। নীলাদ্রি তাকে দু কথা, চারকথা শুনিয়ে দিতো। তবুও সে বেহায়ার মতো দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতো। ঐন্দ্রি তো শুধু ফাযলামি করে বলতো,
“গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে,
বিসরি ত্রাস-লোকলাজে
সজনি, আও লো
অঙ্গে চারু নীল বাস,
হৃদয়ে প্রণয়কুসুমরাশ,
হরিণনেত্রে বিমল হাস,
কুঞ্জবনমে আও লো”

এখন অবশ্য পিউ বড় হয়েছে। তাই এখন এই বেহায়াপনাটা তার করতে ভালো লাগে না। আজ বহুদিন বাদে আবারো নীলের কন্ঠে গান সে শুনলো। নীল তার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে। তার দৃষ্টি বাহিরের দিকে। গান শেষে বিদ্রুপের স্বরে বললো,
– শুনলাম, তোর নাকি প্রেমিকের উদ্ভব হয়েছে! তোর বিয়েটা কেলিয়েই ভেঙ্গে দিয়েছে! পাত্রকে ঠেঙ্গিয়ে ইবনে সিনাতে পাঠিয়ে দিয়েছে।
– আপনি কি টিটকারি দেবার জন্যই এসেছেন?
– না তোর সাথে দুঃখবিলাস করতে এসেছি। ভেবেছিলাম তোর মন টন খারাও থাকবে, কিন্তু তুই তো সুখের ঠেলায় গান গাচ্ছিস! তা এতো সুখ কিসের শুনি?

নীলাদ্রির টিটকারি মূলক কথা শুনতে একেবারেই ভালো লাগছে না। অহেতুক খোঁচা দেওয়া কথা বলে লোকটা। পিউ খানিকটা বিরক্ত নিয়ে বললো,
– আমার সুখ নিয়ে আপনি এতোটা চিন্তা না করলেও চলবে। তা বলি, শিহাব ইবনে সিনাতে আছে আপনি কিভাবে জানলেন?

পিউ এর প্রশ্নে বিষম খেয়ে উঠে নীলাদ্রি৷ হুট করে কাঁশতে লাগে সে। তখন বিদ্রুপের স্বরে বলে,
– প্রশ্ন শুনে যক্ষা হয়ে গেলো নাকি? যাক গে, আগামীকাল আমাকে নিয়ে একটু বের হবেন?

কোনোমতে কাশি থামিয়ে নীলাদ্রি বলে,
– কোথায় যাবি?
– শিহাবকে দেখতে। শুনেছি কালকে তাকে ডিসচার্জ দেওয়া হবে। বেচারা হাত ভেঙ্গে পড়ে রয়েছে।
– তো তুই সেখানে কেনো যাবি? ওর সাথে তো তোর বিয়েটা কেঁচে গেছে। সুতরাং ওখানে যাবার তো কোনো মানেই হয় না।
– উনার সাথে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না। বিয়ে হোক বা না হোক, লোকটাকে দেখতে যাওয়া আমার কর্তব্য। যতই হোক তাকে আমার জন্য মার খেতে হয়েছে। আর এই প্রেমিক সংক্রান্ত ব্যাপারটা তো সম্পূর্ণ যুক্তিহীন। এই “প্রেমিক” ব্যাক্তিটির জন্য ইকবাল আংকেল মামুকে ভুল বুঝছেন। সুতরাং এই ভুলবোঝাবুঝির অন্ত হওয়াটাও তো দরকার। যাই হোক, আমাকে একটু নিয়ে যাবেন প্লিজ৷ আর আপনার যেহেতু কলিগ, আপনার ও উচিত একবার তাকে দেখে আসা।

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো পিউ৷ সন্ধ্যে হতে চলেছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না পিউ এর। তাই সে পা বাড়ালো দরজার দিকে। ঠিক তখনই হ্যাচকা টানে দেওয়ালের সাথে তাকে চেঁপে ধরলো নীলাদ্রি। নীলের এমন ধারা আচারণে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছে পিউ। নীল তখন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
………..

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here