স্বপ্নছায়া পর্ব-১৫,১৬

0
1864

স্বপ্নছায়া
পর্ব-১৫,১৬
মুশফিকা রহমান মৈথি
১৫তম_পর্ব

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো পিউ৷ সন্ধ্যে হতে চলেছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না পিউ এর। তাই সে পা বাড়ালো দরজার দিকে। ঠিক তখনই হ্যাচকা টানে দেওয়ালের সাথে তাকে চেঁপে ধরলো নীলাদ্রি। নীলের এমন ধারা আচারণে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছে পিউ। নীল তখন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– দরদ দেখছি উথলে উঠছে শিহাবের জন্য। দরদের কারণটা কি শুনি?

নীলাদ্রির চোখ লাল হয়ে রয়েছে। তার চোয়ালজোড়া শক্ত। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে পিউকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে রয়েছে। সে পিউ এর দিকে খানিকটা ঝুকে দাঁড়িয়েছে। তার তপ্ত নিঃশ্বাস যেনো পুড়িয়ে দিচ্ছে পিউ কে। পিউ তার চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এতোটা অদ্ভুত আচারণ নীলাদ্রি কখনোই করে নি। তার চোখে মুখে ক্ষুদ্ধতা স্পষ্ট। লোকটা এতোটা অদ্ভুত কেনো! ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে পিউ। চাপা স্বরে বলে,
– ছাড়ুন, মানুষ দেখলে ভুল বুঝবে।
– যা বোঝার বুঝতে দে! তুই আমার কথার উত্তর দে? এতো ছটফট করছিস কেনো তুই ওই ছোকরাটার জন্য?
– আপনি এমন পাগলের মতো আচারণ কেনো করছেন? হাতটা ছাড়ুন নীল ভাই।

কথাটা শুনে যেনো নীলের মেজাজ আরোও খারাপ হয়ে গেলো। রাগের কারণে তার শরীর যেনো কাঁপছে। হিনহিনে গলায় বলে উঠলো,
– সবসময় আমাকেই তোর পাগল মনে হয় তাই না? কথা থেকে উড়ে আসা শিহাবের জন্য মন পুড়ছে তোর, আর আমি কিছু করলেই পাগলামি? কেনো? কেনো ওই দুদিনের ছেলের জন্য তুই এতোটা ব্যাস্ত হয়ে আছিস। কেনো ঐ ছেলেকে নিয়ে এতোটা চিন্তা করছিস?
– অদ্ভুত তো! সে আমার হবু হাসবেন্ড ছিলো।
– গো টু হেল উইদ ইউর হবু হাসবেন্ড। কথা বার্তা শুরু হওয়া মানেই বিয়ে হয়ে যাওয়া না। একটা লিকলিকে শরীরের ছোকরা। তার জন্য এতো মন পোড়ানোর কি আছে? হ্যা? খবরদার যদি ওখানে যাস, খুন করে রেখে দিবো তোকে।
– আজব, এমন ব্যাবহার করছেন কেনো? মানবতা বলেও একটা জিনিস আছে। মানুষটা অসুস্থ। আর সবথেকে বড় কথা, বেচারা আমার জন্য মার খেয়েছে। ওকে দেখতে যাওয়া কোনো অপরাধ নয়। উনি মার না খেলে হয়তো বিয়েটা কেঁচতো না। এটা বাস্তবতা। এতে এভাবে ব্যাবহার কেনো করছেন আমার সাথে? আমি আপনাকে আজ, এখন প্রশ্ন করছি।আপনি আমার উপর কিসের জোরে এতোটা অধিকার দেখান বলুন তো!

নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না পিউ৷ ক্ষুদ্ধ কন্ঠে কথাগুলো বলে সে৷ নীলাদ্রির চোখে চোখ রেখে স্পষ্টকন্ঠে প্রশ্নটি করে সে। নীলাদ্রির মাত্রা ছাড়া আচারণ তার সহ্য হচ্ছে না। নীলাদ্রি খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় পিউ এর আকস্মিক প্রশ্নে। সে খানিকটা চুপ হয়ে যায়। রাগের মাথায় নিজেকে আর সংযত রাখতে পারে নি সে। নীলাদ্রিকে চুপ করে থাকতে থেকে পিউ তাকে আবারো প্রশ্ন করে উঠে,
– কি হলো বলছেন না কেনো? কিসের এতো জোর আপনার? আমাকে কিসের অধিকারে ওখানে যাওয়া থেকে আটকাচ্ছেন? উত্তর নেই বুঝি! কি হলো উত্তর দিন।
– ভালোবাসি
– জ্বী?
– আমি তোকে ভালোবাসি। কোনো ছেলে তোর দিকে চোখ তুলে তাকাক আমার সহ্য হয় না। হ্যা, পাগলামি করি আমি, রাগ করি আমি কিন্তু সেটা শুধু তোর উপর। আর অধিকারের কথা বলছিস। ভালোবাসি তাই অধিকার দেখাই। আমি না ওই লুতুপুতু মার্কা পোলাদের মতো না। ন্যাকামি ভালোবাসা আমার দ্বারা হয় না। তবে যাকে ভালোবাসি তাকে আগলাতে পারি। তুই কি সত্যি বুঝিস না? মেয়েরা তো বিশ মিটার দূর থেকে বুঝে যায় কোন ছেলে তাকে পছন্দ করে। এতোদিনে তুই বুঝিস না! এতোদিন ছোট ছিলি বলে আমি প্রকাশ করি নি, আজ করছি। ভালোবাসি তোকে। প্রচুর ভালোবাসি। কেনো? জানি না। কবে থেকে? জানি না। তবে ভালোবাসি। উত্তর পেয়েছিস? আরেকবার শিহাবের নাম উচ্চারণ করে দেখিস আমি কি করি!

বলেই পিউ কে ছেড়ে দেয় নীলাদ্রি। হনহন করে ছাদ থেকে নেমে যায়। পিউ এর উত্তর পাবার অপেক্ষা তার করতে ইচ্ছে করছে না। তার মাথায় আগুন জ্বলছে। সেটা থামানো জরুরি। দেখা যাবে রাগের মাথায় উল্টোপাল্টা কিছু করে বসলো সে পিউ এর সাথে। এতে তাদের মাঝে দূরুত্ব ছাড়া কিছুই তৈরি হবে না। পিউ সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। কথাগুলো যেনো প্রজেকটাইলের মতো মাথার উপর থেকে গিয়েছে। নীলাদ্রি তাকে ভালোবাসে! এটা কি কোনো তামাশা ছিলো! নাকি লোকটা সত্যি ই তাকে ভালোবাসে! এর আগেও প্রেম নিবেদন পেয়েছে সে, কিন্তু এমন রুদ্র প্রেমনিবেদনটা এই প্রথম পেলো সে। নীলাদ্রির এরুপ প্রেম নিবেদনে তার খুশি হওয়া উচিত নাকি রাগ হওয়া উচিত ভেবে পাচ্ছে না সে। লোকটাকে ছোট বেলা থেকেই একজন অভিভাবকের রুপে দেখেছে সে, এমন একজন পুরুষ যাকে চোখ বুজে ভরসা করা যায়, যে বিপদে ঠায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার কখনো একজন জ্বালাতনকারী বিরক্তিকর লোক, যে কি না অহেতুক কারণে তার তাকে টিটকারি দেওয়া কথা বলে, বাজে ভাবে অপমান করে। এমন একজন পুরুষ তাকে প্রেম নিবেদন করেছে, তার কি সত্যি খুশি হওয়া উচিত নাকি কষ্ট পাওয়া উচিত। আর এই প্রেম নিবেদনের উত্তরটা কিভাবে দিবে সে!

রুমে এসেই ধরাম করে দরজা দিয়ে দিলো নীলাদ্রি। তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। অত্যধিক মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। মেজাজটা নিজের উপর হচ্ছে। তার এই রাগটাই আজ তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পিউ এর শিহাবের জন্য চিন্তাটা যেনো একেবারেই সহ্য হয় নি তার। মূহুর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো তার বুকে কেউ চুরিঘাত করছে। মাথায় যেনো আগুন জ্বলছিলো। কতো পরিকল্পনা ছিলো তার পিউ কে নানা ভাবে প্রেমনিবেদন করবে সে। কিন্তু তার সকল পরিকল্পনায় পানি পড়ে গেলো। রাগ কন্ট্রোল না করতে পারায় তার এতোটা আহম্মকের ন্যায় কাজ করে ফেলেছে সে। মাথাটা দু হাতে চেপে ধরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো নীলাদ্রি। পিউ এর সামনে কোন মুখে দাঁড়াবে সে! পিউ কি আদৌ তার অনুভূতি গুলো বুঝতে পারবে! উফফ এতো কষ্ট কেনো ভালোবাসায়_____________

৯.
দুপুর বারোটা,
অভ্র এবং ঐন্দ্রিলা বাসায় ফিরেছে দশ মিনিট হয়েছে। আজ সকাল সকাল ই তারা রওনা দিয়েছিলো চট্টগ্রাম থেকে। রাস্তায় জ্যাম না থাকায় দুপুরের আগেই বাসায় পৌছে গিয়েছে। দিশানের খুশী দেখে কে! দৌড়ে এসে ঐন্দ্রিলাকে জড়িয়ে ধরলো সে। ঐন্দ্রিলাও পরম আদরে ছেলেটাকে কোলে তুলে নিলো। আদরে আদরে দিশানকে ভরিয়ে দিচ্ছিলো সে। দিশান ও চুপটি করে মায়ের আদর খাচ্ছিলো। শারমিন বেগম গর্বিত স্বরে বলে,
– আমার সোনা নাতিটা সেই কখন থেকে তোমাদের অপেক্ষা করছিলো৷ জানো তোমরা কালকে কতটা শান্ত বাচ্চা হয়ে ছিলো দিশান! একদম জ্বালায় নি আমাকে। ঠিক সময়ে খেয়েছে। ঠিক সময়ে গোসল করেছে।
– তাই বুঝি আব্বু? আমার সোনা আব্বু। আজকেই বাবা আর মাম্মাম মিলে আমার আব্বুটার জন্য একটা এত্ত বড় গাড়ি কিনে আনবো।

বলেই দিশানের গালে একটা চুমু একে দিলো ঐন্দ্রিলা। দিশান তার মায়ের গলা জড়িয়ে চুপ করে মায়ের আদর খাচ্ছে। অভ্র আবেগপ্রবণ দৃষ্টিতে ছেলে এবং মায়ের মিলন দেখছে। ঐন্দ্রিলাকে দিশানের সাথে এতো মিশে যেতে দেখে খুব ভালো লাগছে তার। গত দুদিন থেকে মেয়েটির সাথে যুদ্ধ চলছে তার, নিরব যুদ্ধ। কোনো কথা না বলে নিশ্চুপ ভাবে এই যুদ্ধ পালন করছে তারা। জরুরি ব্যাতীত কোনো কথা বলে নি তারা দুজন। অভ্র ও ঐন্দ্রিলাকে বেশি ঘাটায় নি। দুদিন পর আজ ঐন্দ্রিলাকে হাসতে দেখে বেশ ভালো লাগছে তার। ঐন্দ্রিলা দিশানেএ পেটে কাতুকুতু দিচ্ছে আর দিশান খিলখিল করে হাসছে। কতটা মনোরম দৃশ্য! এর মাঝেই কলিংবেলটা বেজে উঠলো। আহানা ছুটে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই আহানা যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো। আহানাকে অনেকক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অভ্র তার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
– কি রে জমে গেলি নাকি? কে এসেছে?
– আহাশ ভাইয়া……………..

চলবে

#স্বপ্নছায়া
#১৬তম_পর্ব

এর মাঝেই কলিংবেলটা বেজে উঠলো। আহানা ছুটে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই আহানা যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো। আহানাকে অনেকক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অভ্র তার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
– কি রে জমে গেলি নাকি? কে এসেছে?
– আহাশ ভাইয়া

আহানার মুখে নামটি শোনা মাত্র জমে গেলো ঐন্দ্রিলা। নামটি তার পরিচিত। ব্রেইনের নিউরণ গুলো কাজে জুটে যায়। আঠাশ দিন পূর্বের নির্মমতা চোখের সামনে ভাসতে থাকে। হৃদয়ের এক পাশে ছাইছাপা আগুনটা যেনো দপ করে জ্বলে উঠে। ঠিক আঠাশ দিন পূর্বে, এই ছেলেটার জন্যই ভরা মজলিশে তাকে নিজের দূর্ভাগ্যের পরিণতি দেখছে হয়েছিলো। সেদিনের বিদ্রুপের স্বরে লেপ্টে থাকা সান্ত্বনাগুলো আজ ও মস্তিষ্ক ভুলে নি।

সেদিন বিয়ের আসরে না এসে আহাশ চলে যায় অজানা কোনো ঠিকানাতে। এ বাড়ির লোকেদের ও জানায় নি কোথায় আছে। শওকত সাহেব খানিকটা রেগেই ছিলেন। তাই খোঁজ নেবার প্রয়োজন বোধ করেন নি। কিন্তু শারমিন বেগম ছেলের খোঁজ রেখেছেন। ব্যাপারটা ঐন্দ্রিলা আন্দাজ করেছিলো। কিন্তু কখনো কিছু প্রকাশ করে নি। মা তার ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করবে, তাকে ফোন করবে এটা নিরন্তন সত্য। সেটাকে বদলানোর সাহস বা ইচ্ছে ঐন্দ্রিলার নেই। কারণ এই কষ্ট তার একান্তের, অন্যকে টেনে সমোবেদনা পাবার আশা তাই নেই। ঐন্দ্রিলা বিয়ের রাত থেকেই মনকে শক্ত করে রেখেছিলো। আহাশের সাথে না চাইতেও একটা পারিবারিক সম্পর্ক বাঁধা পড়েছে সে। ভাবী রুপে হয়তো আমরণ আহাশের সাথে এই সম্পর্কটা থেকে যাবে তার। শওকত সাহেব যতই হোক পরের মেয়ের জন্য নিজের রক্ত, মাংসকে আজীবন পরিত্যক্ত করবেন না। অভ্র তার অনুজকে কখনোই নিজের জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলবে না। এটা করলে ঐন্দ্রিলা সর্বদা একটি পরিবার ভাঙ্গার দায়ে দায়ী থেকে যাবে। তাই নিজের মনকে সর্বদা প্রস্তুত রেখেছিলো সে, যেদিন আহাশের মুখোমুখি হবে সেদিন ভেঙ্গে পড়বে না। ভুলে যাবে সেদিনের ঘটনা, ভুলে যাবে এই মানুষটা তার চামড়া রঙ্গের কারণে তাকে ভরা মজলিশে একা রেখে চলে গিয়েছিলো। কিন্তু আজ যখন তার সামনে লোকটা বসে রয়েছে তখন সেলুলয়েডের রিলের মতো একের পর এক দৃশ্য গুলো তার চোখের সামনে ভাসছে। চোখের জমা স্রোত যেনো নিজেকে মুক্ত করতে ব্যাস্ত। হঠাৎ অনুভব করলো একটা উষ্ণ হাত তার হাত চেপে রেখেছে। পাশে ফিরতেই দেখলো, অভ্র চোয়াল শক্ত করে তার হাত চেপে বসে রয়েছে। দিশান এখনো তার গলা জড়িয়ে কাধে মাথা রেখে চুপটি করে বসে রয়েছে। এটাই তো তার পরিবার, তার নতুন পরিবার। তার বর্তমান, তার ভবিষ্যৎ। হৃদয়ের অতীতের কন্টকময় স্মৃতি গুলোর কালো মেঘ সরে যেতে লাগলো। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো ঐন্দ্রিলা। নিজের মনকে শক্ত করতে হবে তার। ভেঙ্গে পড়লে সে তার পরিবারের জোরটাকে মিথ্যে প্রমাণিত করে দিবে। এমনটা যে কখনোই হতে দিবে না ঐন্দ্রিলা। দিশানকে কোলে নিয়েই ভেতরের দিকে চলে যায় সে। অভ্র ও তার পেছন পেছন নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।

আহাশকে নিয়ে খুব একটা আদিক্ষেতা দেখা গেল না। শওকত সাহেব কিংবা অভ্র ব্যাপারটায় নিজের খুশি প্রকাশ করলেন না। তবে শারমিন বেগম নিজের ছেলেকে পেয়ে অশ্রু ছেড়ে দিলেন। আহাশ আগের থেকে খানিকটা শুকিয়ে গেছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি হয়েছে। চোখ গুলো গর্তে চলে গেছে। এতোদিন সিলেটে বন্ধুর বাড়িতে ছিলো সে। সেদিন নিজের দায়িত্ব থেকে ভবিষ্যতের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো সে। চাইলে ভালো কোনো হোটেলে থাকতো পারতো। কিন্তু আহাশ সেটা সে করেনি। তার টাকার প্রচুর প্রয়োজন ছিলো। জার্মানীর প্রায় হয়ে যাওয়া ভিসাটা নিয়েই জার্মানী চলে যাবার ইচ্ছে ছিলো তার। কিন্তু একটা রাত সব কিছু পালটে দিলো। জার্মানীর ভিসাটা আটকে গেলো। তার কাছে টাকা না থাকায় বন্ধু নিজের কাছে আর রাখতে চাইলো না তাকে। এদিকে বাবার কাছেও টাকা চাইতে পারছিলো না। সে, দিনের পর দিন সিলেটের রাস্তায় ঘুরতে হয়েছে। মা আশ্বাস না দিলে হয়তো ফেরা হতো না। আহাশের নিজের কাছেই নিজেকে খুব ছোট লাগছে, তার জন্য তার বাবা-মা, ভাইকে এতো অবমাননার ভেতর থেকে যেতে হয়েছে। একটা মেয়ের সবথেকে সুখময় সময়কে সবথেকে বিষাক্ত সময়ে পরিণত করেছিলো সে। তাকে সমাজের কাছে অপমানের জন্য একা ফেলে চলে গিয়েছিলো সে। অপরাধবোধের জন্য মার কাছে কখনো ঐন্দ্রিলার সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় নি৷ লজ্জাবোধ হতো। সেদিন এমন একটা কাজ না করলে বোধহয় সে পরিবারের চোখে এতোটা নিচে নামতো না। এই যেমন বিগত দেড় ঘণ্টা যাবৎ সোফাতে একা বসে আসে আহাশ। মা ব্যাতীত কেউ তার সাথে ভালো ভাবে কথা বলে নি। নিজের রুমে যেতে পারছে না, কারণ শওকত সাহেব কটমট দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রয়েছেন। তিনি কিছুই বলছেন না শুধু প্রখর দৃষ্টিপাতে ছেলে গিলে খাচ্ছেন। এদিকে অভ্রের দেখা এখনো মেলে নি। আহানা সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কথা বলছে না। শারমিন বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,
– তুমি এতোদিন কেনো আসিস নি বাবা? কোনো শুকিয়ে গেছিস।
– মা আমি ফিরতাম না, কিন্তু বাঁচার ইচ্ছেটা ফিরতে বাধ্য করেছে। আমি ওখানে থাকলে হয়তো মরেই যেতাম।

শারমিন বেগম ছেলের কথা শুনে হু হু করে কেঁদে দিলেন। তার শ্বাসকষ্টের সমস্যা রয়েছে। তাই অল্প কাঁদলেই হাঁপানির টান উঠে। আহাশ তাই মাকে সান্ত্বনা দিলো,
– মা, কেঁদো না প্লিজ। আমি যা করেছি, তাতে এমনটা আমার প্রাপ্য ছিলো।
– ঠিক বলেছো তুমি।

এতোক্ষণ পর মুখ খুললেন শওকত সাহেব। বেশ কঠোর স্বরেই বললেন,
– তুমি না ফিরলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। আজ তোমার দায়িত্বজ্ঞানহীনতার শাস্তি আমাদের পেতে হয়েছে।
– বাবা, আমি ওকে ভালোবাসি না। হ্যা মানছি আমি বিয়েতে রাজী হয়েছিলাম কিন্তু আমি যাকে ঐন্দ্রিলা ভেবেছি, সে তো ঐন্দ্রিলা নয়। এই বিয়েতে কেউ সুখী হতাম না বাবা। তুমি চাইলে ঐন্দ্রিলার কাছে আমি নিজে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিবো। ওর বিয়ে যেনো ভালো একটি জায়গায় হয় সেই ব্যাবস্তা ও আমি করবো।
– তার প্রয়োজন নেই আহাশ।

কন্ঠটা কানে আসতেই দরজার দিকে তাকায়। একটা কালো টি-শার্ট এবং ট্রাউজার পরিহিত কফি হাতে অভ্র বসার ঘরে প্রবেশ করে। আহাশের ঠিক সামনে তার মুখোমুখি বসে সে। আহাশ তার কথাটা শুনে খানিকটা থমকে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
– কেনো ভাই?
– কারণ ঐন্দ্রিলার বিয়ে হয়ে গেছে। ঐন্দ্রিলার হাসবেন্ড কখনোই চাইবে না তার স্ত্রীর দ্বিতীয় বিয়ে হোক।
– বিয়ে হয়ে গেছে?
– মা তোকে বলে নি?

আহাশ তার মার দিকে তাকায়। শারমিন বেগম মাথা নিচু করে ফেলে। তিনি ঐন্দ্রিলার ব্যাপারে কোনো কথাই আহাশকে জানাতে চান নি। জানালে ছেলেটা কখনোই ফিরতো না। হয়তো এভাবেই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হতো তার ছেলেকে। আহাশের মুখ দেখে অভ্র কিছুক্ষণ ঠোঁট বিস্তারিত করে হাসে। তারপর শক্ত কন্ঠে বলে,
– ঐন্দ্রিলা এখন শুধু ঐন্দ্রিলা নয়। সে এখন ঐন্দ্রিলা অভ্র চৌধুরী। আমি নিশ্চয়ই চাইবো না আমার স্ত্রীর দ্বিতীয় লবার বিয়ে হোক। তোর কাছে আমি সত্যি কৃতজ্ঞ। সেদিন তোর দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার জন্য আমার বিয়েটা এতোটা মোহনীয় নারীর সাথে হয়েছে। তোকে ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি আছি ওর জন্য। তুই তোর কথা বল! জার্মানির ভিসা তো কেঁচে গেলো এখন কি ভাবছিস?

অভ্রের কথাটা হজম হতে একটু সময় লাগলো আহাশের। সে এখনো অবাক দৃষ্টিতে তার ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। ঐন্দ্রিলা তার ভাবী। কথাটা কেনো যেনো কাঁটার মতো গলায় বিধছে আহাশের। যে নারীকে ভরা মজলিশে একে ফেলে কাপুরুষের মতো পালিয়ে গিয়েছিলো, সেই নারী এখন তার ই বাড়িতে তার সামনে ঘুরে বেড়াবে। কোন মুখে দাঁড়াবে সে মেয়েটির সামনে! কি বলবে! তার বদলে তার খালাতো বোনকে মনে ধরেছিলো তার। তাই বাবা যখন বিয়ের কথা বলেছে না ভেবে “হ্যা” করে দিয়েছিলো। তারপর যখন প্রথম মেয়েটির সাথে দেখা করতে যায় সে, কাঁচের মতো তার সব আশা, স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। বাবাকে বলতে চেয়েও সাহস করতে পারে নি তখন। কিন্তু বিয়ের দিন, ভয়ে যখন তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো, যখন শত ভেবেও ঐন্দ্রিলাকে ভালোবাসার একটা কারণ ও খুজে পায় নি তখন কাপুরুষের ন্যায় পালিয়ে গিয়েছিলো সে। এই সত্যটা কিভাবে বলবে মেয়েটাকে! আহাশের চিন্তায় আচ্ছন্ন মুখটা দেখে অভ্র আবার জিজ্ঞেস করে,
– কি হলো বল, তোর নেক্সট প্লান কি?
– আমি একটু রুমে যাই ভাই? আমার মাথাটা ধরে আছে। মা এককাপ চা পাঠিয়ে দিবে?
– তুই রুমে যা আমি চা পাঠাচ্ছি।

আহাশ উঠে নিজের রুমের দিকে হাটা দিলো। অভ্র তাকে আটকালো না। শওকত সাহেব চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
– সিদ্ধান্তটা কি ঠিক হচ্ছে অভ্র?

অভ্র উত্তর দিলো না। চিন্তা তার মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। চিন্তার কারণটা খুব অদ্ভুত! চিন্তার সাথে ক্ষীণ ভয় ও মাথা চারা দিচ্ছে! আহাশ নতুন কোনো বিপদের সূত্রপাত ঘটাবে না তো!

নীলাদ্রির সামনে পিউ দাঁড়িয়ে আছে। তার পরণে আসমানী রঙ্গের শাড়ি। খোঁপা করেছে সে, তাতে বেলীফুলের মালাও গুজেছে। চোখে মোটা করে কাজলের বাহার, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক, আর দু হাত ভর্তি রেশমি চুড়ি। তার সাজের বাহারের কারণটা নীলাদ্রির জানা নেই। তবে পিউ এর সাজসজ্জা নীলাদ্রির হৃদস্পন্দন তীব্র করে দিয়েছে। শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার মনের অবস্থা প্রকাশের উপায় নেই। কারণ তার সামনে বদরুল সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। সে পিউকে নিয়ে সকাল সকাল তাদের বাড়ি এসেছেন। নীলাদ্রি অফিসের জন্য বের ই হচ্ছিলো তখনই তাদের আগমণ। তার নাকি নীলাদ্রির সাথে কাজ, কিন্তু কখন থেকে শরীফ সাহেবের সাথে খাজুরে আলাপে লেগেছে সে। নীলাদ্রি ঘড়ির দিকে এক নজর দেখে বিনয়ী কন্ঠে বললো,
– খালু, আমার উঠতে হবে। অফিসে নয়তো দেরি হয়ে যাবে।
– অফিসে যাবার পথে পিউমা কে একটু হাসপাতালে ড্রপ করে দিবে…….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here