স্বপ্নছায়া পর্ব-১৭,১৮

0
1569

স্বপ্নছায়া
পর্ব-১৭,১৮
মুশফিকা রহমান মৈথি
১৭তম_পর্ব

নীলাদ্রির সামনে পিউ দাঁড়িয়ে আছে। তার পরণে আসমানী রঙ্গের শাড়ি। খোঁপা করেছে সে, তাতে বেলীফুলের মালাও গুজেছে। চোখে মোটা করে কাজলের বাহার, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক, আর দু হাত ভর্তি রেশমি চুড়ি। তার সাজের বাহারের কারণটা নীলাদ্রির জানা নেই। তবে পিউ এর সাজসজ্জা নীলাদ্রির হৃদস্পন্দন তীব্র করে দিয়েছে। শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার মনের অবস্থা প্রকাশের উপায় নেই। কারণ তার সামনে বদরুল সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। সে পিউকে নিয়ে সকাল সকাল তাদের বাড়ি এসেছেন। নীলাদ্রি অফিসের জন্য বের ই হচ্ছিলো তখনই তাদের আগমণ। তার নাকি নীলাদ্রির সাথে কাজ, কিন্তু কখন থেকে শরীফ সাহেবের সাথে খাজুরে আলাপে লেগেছে সে। নীলাদ্রি ঘড়ির দিকে এক নজর দেখে বিনয়ী কন্ঠে বললো,
– খালু, আমার উঠতে হবে। অফিসে নয়তো দেরি হয়ে যাবে।
– অফিসে যাবার পথে পিউমা কে একটু হাসপাতালে ড্রপ করে দিবে। ইবনে সীনা হাসপাতালের সামনে ড্রপ করে দিলেই হবে। ওর পাশেই ওর বান্ধবীর বাসা। আজ তারা বাহিরে ঘুরতে যাবে।

ইবনে সীনা হাসপাতাল শুনতেই নীলাদ্রি চোখ কুচকে তাকায় পিউ এর দিকে। পিউ এর মুখোভাব তাতে বদলালো না। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে মামুর সামনে নীলাদ্রি তাকে কিছুই বলতে পারবে না। নীলাদ্রির অগ্নিদৃষ্টিকে তাই অগ্রাহ্য করা যেতেই পারে৷ নীলাদ্রির বুকে ত্রাশ তৈরি হয়। পিউ সেজেগুজে শিহাবের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে যাচ্ছে না তো৷ কারণ এই ইবনে সীনা হাসপাতালেই শিহাব ভর্তি রয়েছে। আজ হয়তো ডিসচার্জ করিয়ে দিবে। নীলাদ্রির মুখটা ভার হয়ে গেলো। হঠাৎ করেই সেদিনের আচারণটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। পিউ সেদিনের পর থেকে আজ ই তার সামনে এসেছে, তাও বদরুল সাহেবের সাথে। একা হলে হয়তো কখনোই তার সামনে আসতো না। যতই সে উচ্চগলায় দাবি করুক সে পিউকে ভালোবাসে, পিউ তার প্রেমনিবেদন গ্রহন না করলে সে সব বৃথা। তখন নীলাদ্রির পরিচয় হবে কেবল একজন ব্যার্থ প্রেমিক। তাকে সমাজ ব্যর্থ প্রেমিকের নজরেই দেখবে। থাকবে না পিউ এর উপর কোনো জোর, থাকবে না কোনো অধিকার। পিউ তখন মুক্ত। যতই হোক, ভদ্র ঘরের ছেলে যে, প্রেমিকা তাকে ফিরিয়ে দিলে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করার মতো নিম্মমানসিকতা না নেই। নীলাদ্রির ভার মুখটা দেখে শরীফ সাহেব জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
– কি হলো নীল, তোর মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেনো? শরীর ভালো নেই?
– বাবা, শরীরের কি দোষ। মনটাই আজকাল নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। আমি আসছি। আমার দেরি হচ্ছে।
– পিউকে নিবি না?
– ওকে না নেবার কোনো কারণ তো নেই। খালু আদেশ করেছেন।

নীলাদ্রির কথার মর্মার্থ বদরুল সাহেব কিংবা শরীফ সাহেব বুঝলেন না। তারা হা করে শুধু তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পিউ তাদের ভ্যাবাচেকা খাওয়া মুখগুলোকে স্বাভাবিক করতে বলে উঠলো,
– মামু আসলাম। খালু আসি। তোমরা দুজন মনে করে ঔষধ খেয়ে নিবে। আমি দিশাকে বলে দিয়েছি যদিও। তাও তোমাদের ও বলে গেলাম৷ আসি

পিউ কথাটা বলে নীলাদ্রির পিছু পিছু ছটলো। পিউ যাবার পর বদরুল সাহেব হো হো করে হয়ে সে উঠলেন। আবেগপ্রবণ কন্ঠে বললেন,
– দেখেছেন দুলাভাই, মনে হয় মা শাসন করছে।
– একদম ঠিক বলেছো, ঐন্দ্রি মাও এভাবেই আমাকে শাসন করতো। যখন ওকে প্রথম কোলে নিয়ে ছিলাম আমার মনে হয়েছিলো আমার মা ছোট্ট রুপে আমার কোলে এসেছে। মেয়েটাকে দেখি না কতোদিন হয়ে গেছে। আসলে মেয়েরা হয় ই এমন। মায়ায় জড়িয়ে অন্য কারোর ঘরে চলে চায়। দেখবে পিউ আর দিশার বিয়ের পর ঘরটা একেবারেই ফাঁকা হয়ে যাবে। খা খা করবে ওদের খিলখিল হাসির জন্য। ওদের দুটো বুলির জন্য। ওদের নুপুরের গুঞ্জনের জন্য, ওদের গলার স্বরের জন্য।

শরীফ সাহেবের কন্ঠ কাঁপছে। বদরুল সাহেবের মনটা ও বসে গেলো। পিউ এবং দিশাকে যদি নিজের কাছে রেখে দিতে পারতেন কি ভালোটাই না হতো___________

ইবনে সীনা হাসপাতালের করিডোরে হাটছে পিউ এবং নীলাদ্রি৷ পুরোটা রাস্তা লোকটা একটা টু শব্দ করে নি পিউ এর সাথে। শুধু মন মরা হয়ে এক দিকে চেয়ে ছিলো। নীলের এই রুপ পিউকে ভাবাচ্ছিলো। কিন্তু সাহস করে প্রশ্ন করে উঠতে পারে নি। বলা তো যায় না, শান্ত বাঘকে জাগালে না তার ই শিকার বনে যেতে হয়। নীলাদ্রি সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পিউ এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। শান্ত ভাবে তার কার্যক্রম দেখছে। সে রিসিপশনে শিহাবের রুমের নাম্বার যোগাড় করেছে। এখন ভিজিটিং আওয়ার হবার দরুন তাকে ভেতরে যাবার অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। নীলাদ্রির হৃদয় ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে কিন্তু সে চুপটি করে দেখে যাচ্ছে মেয়েটির কাজ। বাসা থেকে মিথ্যে বলে, এতো সাজের বাহার দিয়ে শিহাবের সাথে দেখা করার যুক্তি খুজে বেড়াচ্ছে নীলাদ্রি৷ পিউ যখন শিহাবের রুমের বাহিরে দাঁড়ালো তখন ঘাড় ফিরিয়ে নীলাদ্রিকে জিজ্ঞেস করলো,
– আমাকে কেমন লাগছে?
– কিহ?
– বলছি আমাকে কেমন লাগছে? দেখে প্রেম প্রেম জাগছে না?

পিউ এর প্রশ্ন শুনে মাথায় যেনো আগুন জ্বলে উঠলো নীলাদ্রির। আবার বুকের বা পাশটা হু হু করে উঠলো। পিউ কি বুঝে না, সে এমন একজনকে প্রশ্নটি করেছে যার মনে তার জন্য বাসার জামা পড়া অবস্থাতেও প্রেম প্রেম জাগে। পরীক্ষার প্রেসারে যখন তার চোখের নিচে কালি পড়ে যায়, তার চুল গুলো কাকের আর বাবুই পাখির বাসার ন্যায় দেখায় তখন ও নীলাদ্রির প্রেম প্রেম জাগে। আর আজ তো সে নীলাদ্রির মতো করে সেজে রয়েছে। সুতরাং প্রেম প্রেম জাগবে এটা চিরন্তন সত্য। নীলাদ্রি ব্যাথিত কন্ঠে বললো,
– এতো সাজের বাহার কি তবে শিহাবের জন্য?
– আপনাকে বলবো কেনো? আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দেন, আমাকে দেখে কি প্রেম প্রেম জাগছে?

নীলাদ্রি মাথাটা নামিয়ে ফেললো। তার চোখ ছলছল করছে। সে পুরুষ মানুষ তাই পিউকে এই অশ্রু দেখতে দিবে না। নীলাদ্রি আহত কন্ঠে বললো,
– তুই ভেতরে যা, আমি বাহিরে আছি
– উত্তরটা দিলেন না তো!
– তুই ও তো দিলি না।
– বেশ তবে শুনুন, আমার এই সাজের ঘটা আমার প্রেমিকের জন্য।

পিউ কথাটা বলেই সোজা শিহাবের রুমের ভেতরে চলে গেলো৷ পিউ এর কথাটা শুনে নীলাদ্রির চোখ থেকে টপ করে অশ্রুর মুক্তোদানাটা গড়িয়ে পড়লো। সে অশ্রুসিক্ত চোখে তার হৃদয়ের মহারানীর যাবার পানে চেয়ে রইলো_________

ঐন্দ্রিলার দম বন্ধ লাগছে। মন অশান্ত হয়ে রয়েছে। কোনো কিছুতে মন বসতে চাইছে না। রান্নাটা কাজের মেয়ের রাতে দিয়েই নিজ রুমে চলে আসে সে। দিশান বিছানায় ঘুমোচ্ছে। ঐন্দ্রি তাই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। দক্ষিণের বাতাস ছুটেছে, আজ আকাশে মেঘ করছে। হয়তো কিছুক্ষণ পর ই বৃষ্টি নামবে। কিন্তু গরমের উম্মাদনা কমে নি। চুলের গোড়া থেকে ঘামের রেখে গড়িয়ে যাচ্ছে ঐন্দ্রির ঘাড়ে৷ কিন্তু সেদিকে তার মোটেই খেয়াল নেই। সে চোখ বুঝে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছে করছে তার।
“তুমি আমার নওতো সুখ
তুমি সুখের বেদনা
সব স্বপ্নের রং হয় না তো
বেদনার মতো নয় রঙা ।
জীবনের সব কথা নয়
আমি জীবনটাকে বলতে চাই
হয়তো দুর্ভাগ্য নয়
সে তো ভালোবাসার কাব্য কয় ।।
আমি কবি নই
তবু কাব্যের ভাষায় বলবো আজ
তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে স্বপ্ন নিয়ে ভাসতে চাই ।
তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে স্বপ্ন নিয়ে ভাসতে চাই ।”

কিন্তু সেটা মনেই চেপে রেখে দিলো। কারণ দিশানের ঘুম ভেঙ্গে যাবে। ভাববে মাম্মাম বুঝি পাগল হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ অনুভব করলো তার ঘাড়ের উপর কারোর উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ছে। ঐন্দ্রি খানিকটা কেঁপে উঠলো। তবে আন্দাজ করতে কষ্ট হলো না মানুষটি কে! সে তার স্বামী। তাই ঐন্দ্রি পেছনে ফেরলো না। অভ্র ঐন্দ্রির সাঁড়া না পেয়ে তার কাঁধে থুতনিটা ঠেকিয়ে বললো,
– অতীত অতীত ই হয়। অতীতের মুখোমুখি হয়েছো বলে বর্তমান এলোমেলো হয়ে যাবে কথাটা ভুল…………

চলবে

#স্বপ্নছায়া
#১৮তম_পর্ব

হঠাৎ অনুভব করলো তার ঘাড়ের উপর কারোর উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ছে। ঐন্দ্রি খানিকটা কেঁপে উঠলো। তবে আন্দাজ করতে কষ্ট হলো না মানুষটি কে! সে তার স্বামী। তাই ঐন্দ্রি পেছনে ফেরলো না। অভ্র ঐন্দ্রির সাঁড়া না পেয়ে তার কাঁধে থুতনিটা ঠেকিয়ে বললো,
– অতীত অতীত ই হয়। অতীতের মুখোমুখি হয়েছো বলে বর্তমান এলোমেলো হয়ে যাবে কথাটা ভুল। অতীত থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। কিন্তু অতীতকে আকড়ে বসলে বর্তমানের সময়টা শুধু শুধু নষ্ট হবে। নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে হবে। আমি চাই না আমার বাঘিনী নিজেকে গুটিয়ে ফেলুক।

অভ্রের কথাগুলো চুপ করে শুনে ঐন্দ্রিলা। অভ্র তার হাতের বেষ্টনীতে তাকে আবেষ্টিত করে৷ ঐন্দ্রিলাও গা এলিয়ে দেয় অভ্রের সুঠাম বুকে। চোখ বুঝে মূহুর্তটাকে অনুভব করছিলো সে। অভ্র তখন ও তাকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রেখেছে। ঐন্দ্রিলা কয়েক মূহুর্ত বাদে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অভ্র তখন মুচকি হেসে বলে,
– এতো সুন্দর মোটিভেশনাল লাইন বললাম, তবুও তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলবে?
– মোটিভেশনাল লাইন তার মুখেই মানায় যে সেই লাইনের প্রতিটা অক্ষর মেনে চলে। কিন্তু আপনি নিজেই তো অতীত আকড়ে রেখেছেন। পেরেছেন কি নিজেকে মুক্ত করতে? পেরেছেন নিজেকে বর্তমানে মিশিয়ে ফেলতে? পেরেছেন কি নিজের জীবনকে এগিয়ে নিতে? শুধু একটা খোলস তৈরি করে ফেলেছেন নিজের চার পাশে।
– তোমার সাথে আমাকে মিশিয়ে ফেলছো?
– আমি মেশাচ্ছি না, ফ্যাক্ট বলছি। আমার অতীত যেমন আমাকে অস্বস্তিতে ফেলছে। আপনার অতীত ও আপনাকে কুড়ে খাচ্ছে। অবশ্য সেখানে আমার প্রবেশ নিষেধ৷ তাই আমি ঘাটাই ও না। যাক গে, ছাড়ুন রান্নাটা চুলোয় আছে। আর ধন্যবাদ, কিছু মূহুর্তের জন্য হলেও আমার মনে হয়েছে আমাকে নিয়েও কেউ ভাবে৷

শান্ত গলায় কথাটা বললো ঐন্দ্রিলা। তারপর আস্তে করে অভ্রের হাতের বাধন ছাঁড়িয়ে নিলো। ধীর পায়ে ভেতরের দিকে পা বাঁড়ালো সে। অভ্র কোনো উত্তর দিলো না। ক্ষণিকের অনুভূতিটা তার হৃদয়ের এক কোনায় লুকিয়ে রাখলো সে৷ ঐন্দ্রিলা ঠিক বলেছে, তার কথায় কোনো ভুল নেই। সত্যি ই তো অভ্র এখনো অতীতের মায়াজালে নিজেকে আটকে রেখেছে। অতীত কতোটা বিষাক্তকর অনভূতি তার প্রমাণ সে নিজেই। তবুও ঐন্দ্রিলাকে সে জ্ঞান দিয়েছে। এটাই আমাদের নিয়ম।মানুষের চিরন্তন স্বভাব। মানুষ উপদেশ দিতে খুব ভালোবাসে। এই ভালোবাসাটা মাঝে মাঝে বাজে অভ্যেসে পরিণত হয়৷ সাধারণত দেখা যায় যে ব্যাক্তি সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে না সে অন্য ব্যক্তিকে সকালে উঠার উপদেশ দিবে। যে ব্যাক্তির শেখার প্রতি মোটেই আগ্রহ নেই সেই ব্যাক্তি অন্যকে বলবে “শিক্ষাই জ্ঞান”। যে ব্যক্তি নিজের রাগ দমন করতে পারে না, অন্যকে উপদেশ দিবে রাগ দমন করার জন্য। এই উপদেশ দেবার রোগটা মানুষের হয়তো কখনোই হয়তো নিরময় হবে না। আজ অভ্র ও সেই রোগের রোগীর লিষ্টে নাম লেখালো। ঐন্দ্রিলা রুম থেকে বেরিয়ে গেলে বাহিরের দিকে নজর দিলো সে। ঠোঁটের কোনের হাসিটা ক্রমশ বিস্তৃত হলো তার। তার বাঘিনী এখনো বাঘিনী ই রয়েছে। হতে পারে সে আহত, কিন্তু এখনো সে বাঘিনী ই রয়েছে_________

শিহাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পিউ। শিহাব বেশ আয়েস করে আপেল চাবাচ্ছে। পিউ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অথচ তার আপেল খাওয়া থামলো না। পিউ এর বিরক্ত লাগছে। ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে পারলে বেশ ভালো হতো। কিন্তু শিহাবের হাত এখনো সারে নি। ডাক্তার বলেছে এক মাস লাগবে তার হাত সারতে। তাই সে এই কাজ টি করে নি। শিহাব প্রথমে পিউকে দেখে চিনতে পারে নি। পিউ নিজের পরিচয় দেবার পর সে বেশ চটে যায়। হিনহিনে কন্ঠে বলে,
– কি দেখতে এসেছেন? আপনার প্রেমিক আমার কি হাল করেছে দেখুন। আমাকে ভালো লাগে বললেই তো পারবেন। আমার হাত ভাঙ্গার কি দরকার ছিলো?

পিউ নিজের বিরক্তিকে চাপিয়ে রেখে নমনীয় স্বরে বলে,
– আমি এখানে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আসলেই এমন একটা ঘটনা ঘটে যাবে বুঝতে পারি নি।
– এখন ন্যাকামি করবেন না তো? সব জানতেন। আমার তো মনে হয় আপনি ই এই কাজ করিয়েছেন।
– আপনার হাত ভাঙ্গিয়ে আমার কি লাভ বলুন?
– আমি যাতে আপনাকে বিয়ে না করি। এটাই তো আপনার প্লান ছিলো। বুঝি না, মনে করেছেন। আপনাদের মতো মেয়েদের ভালো করেই জানা আছে আমার। প্রথমে প্রেম করে, তারপর সেটা যদি বকাটে ছেলে হয় তখন পরিবার সম্মান বাঁচাতে একজন ভালো ছেলের গলায় ঝুলায়ে দেয়। আপনি জানতেন বাসায় মানবে না তাই এই কাজ করিয়েছেন। আমি ক্ষমা করবো না। আমার পা ধরে ক্ষমা চাইলেও আমি করবো না।

পিউ এতোক্ষণ নিজেকে খুব সংযত রেখেছিলো। কিন্তু শিহাবের বেয়াদবি মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে পিউ আর নিজেকে আটকাতে পারলো না। শিহাবের হাত থেকে আপেলটা কেড়ে নিয়ে হিনহিনে কন্ঠে বললো,
– শুনুন, বিয়েটা আমার পরিবার আপনার বাড়ি বয়ে নিয়ে যায় নি। আপনার মামা বিয়েটা এনেছিলেন। আমার যদি আপনাকে এক বিন্দু অপছন্দ হতো আমার মামু এই বিয়েটা ঝেটিয়ে বিদেয় করতো। সুতরাং আমার যদি বিয়েটা না করার ইচ্ছে হতো তাহলে আমি খুব ইজিলি ই করতে পারতাম। আমি এখানে আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি সেটার যোগ্য না। যতসব।
– তার মানে আপনার প্রেমিক নেই?

আমতা আমতা করে কথাটা বললো শিহাব। পিউ ঠোঁটের কোনায় হাসি টেনে বললো,
– আমার প্রেমিক আছে বা নেই সেটা কথা নয়, কথাটা হলো আপনাকে আমার পছন্দ নয়। আমি আমার ক্ষমা ফেরত নিলাম। চাই না আপনার ক্ষমা। কাল অবধি আমার মনে হচ্ছিলো আপনি একটা বেঁচারা। তাই ক্ষমা চাইতে এসেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যিস এসেছি৷ নয়তো জানতেই পারতাম না আপনি কতোটা মুখোশ ধারী! আপনার বিয়ের জন্য শুভকামনা রইলো। তবে সাবধান, সুপ্ত প্রেমিকেরা অতর্কিতে হামলা করে। সবাই তো আমার প্রেমিকের মতো ভালো না শুধু হাত ভেঙ্গে ছেড়ে দিবে। বলা তো যায় না এই মুখটাই না কেউ ভেঙ্গে দেয়।

পিউ এর হুংকারে শিহাব চুপসে গেলো। পিউ এই প্রথম কারোর উপর সাথে উচ্চস্বরে কথা বললো। শিহাব অসুস্থ না হলে হয়তো তার মাথাটাই ভেঙ্গে ফেলতো। লোকটা বিরক্তিকর শুধু নয়, পিউ এর মতো শান্ত মেয়েকেও রাগিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। পিউ আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না। হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পেতো শিহাবের কাঁচুমাচু হয়ে থাকা মুখখানা। বেঁচারা হয়তো কখনোই কোনো মেয়েকে আর দেখতে যাবে না। পিউ বের হতেই দেখলো করিডোরের এক কোনায় নীলাদ্রি বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। পিউ দ্রুত পায়ে তার সামনে যায়। বিরক্তিভরা কন্ঠে বলে,
– আপনি অফিসে যান নি?
– না, ভালো লাগছে না। তোর প্রেমিকের সাথে দেখা করা শেষ?
– আমার প্রেমিক? ওই মাথা মোটা টা? হাহ! আমার কি মনে হয় জানেন? খালা ছোটবেলায় আপনাকে হাত থেকে ফেলে দিয়েছিলো। তাই তো আপনার মাথার দু তিনটা স্ক্রু খোলা। যাক গে! অফিস যেহেতু যাচ্ছেন না। চলুন ঘুরতে যাবো৷
– ঘুরতে যাবি মানে?
– ঘুরতে যাবো মানে ঘুরতে যাবো। এখন এই মানেটাও কি আপনি বুঝেন না? ঘুরবো বলেই তো এভাবে সেজেছি। চলুন
– তা যার সাথে ঘুরবি বলে সেজেছিস, তাকে বললেই হয়! আমি পারবো না!
– হ্যা, আমি তাকেই বলছি। এখন যার জন্য এতো সাজের ঘটা, যার সাথে ঘুরতে যাবো, আমি তো তাকেই বলবো। এখন সে যদি ব্যাস্ত থাকে তাহলে আর কি করার, আমার ভাগ্য!

বলেই সামনে হাটা শুরু করলো পিউ। পিউ কিছুটা এগিয়ে গেলো। কিন্তু নীলাদ্রি তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। পিউ এর কথাগুলো কানে বাজছে। হৃদয়ে শিহরণ জেগে উঠলো। সে এখন আর ব্যর্থ প্রেমিক নয়। তার প্রেম অবশেষে সফল হলো। নীলাদ্রি ছুটে গিয়ে পিউ এর পাশাপাশি হাটতে লাগলো। পিউ এর কোমল হাতটা নিজের হাতের মুঠোতে নিলো। পিউ ও মুচকি হাসি দিয়ে হাটতে লাগলো। অবশেষে তার সুপ্ত প্রেমিককে খুঁজে পেলো সে, তার জীবনেও প্রেমের স্বপ্নছায়া হাতছানি দিলো____________

দুপুর ১.৩০টা,
ঐন্দ্রিলা খাবার বেড়ে এনে খানার টেবিলে রাখছে। আহানাও তাকে সাহায্য করছে। শওকত সাহেব, শারমিন বেগম এবং অভ্র খেতে বসেছে। শারমিন বেগম আহাশের চেয়ার ফাঁকা দেখে চাঁপা স্বরে বললেন,
– আহাশ তো এখনো আসে নি। ও আসুক তারপর না হয় খাওয়া শুরু করি?

তার কথায় বাধ সাধলেন শওকত সাহেব। কড়া কন্ঠে বললেন,
– যে আসার সে এমনেই আসবে। তার জন্য আমাদের বসে থাকার কোনো মানে নেই।
– কিন্তু
– খাওয়া শুরু করো। ঐন্দ্রি, আহানা তোমরাও বসে পড়ো।

বলেই খাওয়া শুরু করলেন শওকত সাহেব। শারমিন বেগম এখনো ভাতের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ব্যাপারটা ঐন্দ্রিলা বুঝতে পেরেছে। তাই সে আহানাকে ইশারা করলো যেনো আহাশকে ডেকে আনে। আহানাও তার ভাবীর কথা মতো কাজটা করলো। মিনিট পনেরো বাদে আহাশ খাবার রুমে আসলো। ঐন্দ্রিলার মুখোমুখি হতেই মাথা নামিয়ে নেয় সে। তার চোখের দিকে তাকাতেও লজ্জাবোধ করছে সে। ঐন্দ্রিলা স্বাভাবিকভাবেই আহাশের প্লেটে৷ ভাত বেড়ে দিলো। তারপর অভ্রের পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলো৷ আহাশ মাথাটা তুলে একনজর ঐন্দ্রিলাকে দেখলো। মেয়েটাকে শেষ দেখেছিলো হলুদের রাতে। কতোটা বদলে গেছে সে। মেয়েটির কাছে ক্ষমা চাইবার মতো মুখটুকু তার নেই। পালিয়ে যেতে পারলে হয়তো এই গ্লানি, অপরাধবোধ, লজ্জার থেকে বাঁচতে পারতো আহাশ। ভাতের প্লেটের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সে। কিভাবে এই অস্বস্তিকর পরিবেশের অন্ত করবে সেটাই তার মাথায় পেন্ডুলামের মতো ঘুরছে‌‌!!!

বিকেল ৪টা,
খা খা রোদে ঢাকা শহর ঝাঝরা হয়ে যাচ্ছে। আকাশে একদল কালো মেঘ ভিড় করেছে কিন্তু তাদের মতিগতি আজ ভালো না। তারা শুধু দল বেধে ঘুরে বেড়াবার মতলব ই এটেছে। ক্ষণে ক্ষণে গরম বাতাস বইছে। তাতে গরম কমার বদলে আরোও বেশি গরম লাগছে। এই উত্তপ্ত গরমে রাস্তার ধার দিয়ে হেটে যাচ্ছে নীলাদ্রি এবং পিউ৷ পিউ শাড়ির কুঁচিটা বেশ সুন্দর করে ধরে হাটছে৷ গরম লাগছে কিন্তু হাটতে বিরক্ত লাগছে না পিউ এর। পিউ এর হাতটা এখনো নীলের হাতের মুঠোয় রয়েছে৷ নীলাদ্রি খুব আগলে আগলে হাটছে। হাটতে হাটতে হঠাৎ পিউ হাতটা ছাঁড়িয়ে নিলো নীলাদ্রির হাত থেকে। পিউ এর এরুপ কাজে কিছুটা নীলাদ্রি বেশ অবাক হলো৷ পাশে তাকাতেই দেখলো পিউ পাশে নেই………..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here