স্বপ্নছায়া পর্ব-২১,২২

0
1973

স্বপ্নছায়া
পর্ব-২১,২২
মুশফিকা রহমান মৈথি
২১তম_পর্ব

অভ্রের মুখে “হ্যা” শুনেই ঐন্দ্রিলা চুপ হয়ে গিয়েছিলো। এই সত্যটা অনেক আগ থেকে আন্দাজ করেছিলো সে। দিশানের চোখের সাথে অভ্রের চোখের অসম্ভব মিল। সে ভেবেছিলো অভ্রের মুখে সত্যটা জানলে এতোও কষ্ট লাগবে না। কিন্তু সে ভুল ছিলো। তার মনে হচ্ছে অসংখ্য সুচ তার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করছে। এটাকেই হয়তো বিষাক্ত ভালোবাসা বলে। ঐন্দ্রিকে চুপ করে থাকতে দেখে অভ্র প্রশ্ন করে,
– কি হলো? রাগ করলে? ঘৃণা হচ্ছে আমার প্রতি? সত্যিটা কি দিশানের প্রতি তোমার ভালোবাসাটাকে ম্লান করে দিলো?

ঐন্দ্রিলা অভ্রের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়। সে এখনো অভ্রের বাহুর বেষ্টনীতে আবদ্ধ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– আমি মানুষটা ছোটবেলা থেকে খুব লিবারেল। মানুষের কাছে এতোটা জাজ হয়েছি যে, মানুষকে জাজ করার ফিচারটাই আমার মাঝে ইন্সটল হয় নি। সেকারণে আমি মানুষের ঠিক ভুল কখনো বিচার করতে যাই না। যে কোনো পরিস্থিতিটাকে সহজভাবে নেবার ট্রাই করি। ভাগ্যের নির্মমতার প্রহার বলে মেনে নেই। আজ কেনো যেনো পারছি না। আমার রাগ হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে। দিশানের ব্যাপারটা জানার পর কষ্টটার মাত্র যেনো দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আপনার প্রতি আমার প্রেমটা বিষাক্ত ভালোবাসায় পরিণত৷ হয়েছে। তাই তো স্বার্থপরের মতো আপনার উপর অন্য কারোর অধিকারটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। তবে আমি আপনাকে বা দিশানকে ঘৃণা করবো না। ওই যে বললাম আমার স্বভাবে নেই।
– মানুষ যে তোমাকে আত্নসম্মানহীন বলবে! নিজের স্বামীর পাপকে ভালোবাসবে?

অভ্রের কথায় শব্দ করে হাসলো ঐন্দ্রিলা। তারপর বললো,
– আপনার পাপ,পূন্যের হিসাব করার মতো ক্ষমতা বা অধিকার আমার নেই। তাই আমি সেটা করবোও না। আমি তো সামান্য মানুষ, সৃষ্টিকর্তা তো নই। সেজন্য আপনার আর জ্যানিফারের সম্পর্ক নিয়ে অহেতুক মন্তব্য করবো না। তবে আমার সময় লাগবে। আমার না অস্বস্তি হচ্ছে এখানে থাকতে। একটু হাওয়া বদল হলে খুব মন্দ হবে কি?
– পালাতে চাচ্ছো?
– না, নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করতে চাচ্ছি। যে কন্টকময় পথ বেঁছে নিয়েছি সেটায় হাটতে হলে মনকে স্থির রাখতে হবে। আমি এতোটাও দূর্বল নই যে পালিয়ে যাবো। আর আপনিই তো বলেছেন আপনার বাঘিনী ঈর্ষাকেও হার মানাবে। আমি সেটাই চাচ্ছি। আমাদের সম্পর্কের জন্য নয়। ওই নিস্পাপ বাচ্চাটার জন্য। তবে আপনি ওর সত্যটা বাসায় কেনো লুকিয়েছেন?

ঐন্দ্রিলার কন্ঠ কাঁপছে। তার নোনা জলের স্রোত চোখ থেকে গড়িয়ে গাল ভিজিয়ে দিচ্ছে। অভ্র আলতো হাতে তার চোখ মুছে বলে,
– আজ না, কিছু কথা তোলা থাক। যেদিন আবার দেখা হবে আমাদের, সেদিন তোমাকে সব বলবো। নিজেকেও না হয় সেদিন ই উজার করে দিবো। আজ থাক।

ঐন্দ্রিলার হৃদয় হু হু করে উঠলো। বিষাদের বিশ্রি স্ফুলিঙ্গে তার চোখ জ্বলছে। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বুকটা ভার হয়ে আসছে। মনের কোনে জমা বিষাধসিন্ধু মুক্তির অপেক্ষা করছে। বিষাধের এই ঢেউ হয়তো এলোমেলো করে দিবে, তিন জনের এই পরিবার!!!

১১.
দিনটা শনিবার, কানের কাছে শো শো করে বাতাস বইছে। বদরুল সাহেব বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে আছেন, হাতে পেপার। বাতাসের গতিতে বোঝা যাচ্ছে হয়তো আবারো ঝড়ের আগমণ ঘটবে। আজকাল বলা নেই কওয়া নেই ঝড় হচ্ছে, বৃষ্টি হচ্ছে। যদিও ঢাকা কোনো সমুদ্রের আশেপাশের জায়গা নয়। বদরুল সাহেবের মতে সমুদ্রের আশেপাশের অঞ্চল হলে এই ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি মানা যায়। ব্যাপারটা প্রকৃতির সাথে যায়। কিন্তু এই ইট পাথরের শহরে যেখানে মানুষের এক এক মিনিট টাকার থেকেও মূল্যবান; সেখানে এই প্রাকৃতিক মায়াজালটা ঠিক মানায় না। শহরের মানুষের কাছে পরিবারকে সময় দেবার মতো সময় নেই, সেখানে বৃষ্টিবিলাসের মতো বিলাসী ব্যাপারটা বেশ বেমানান। আর এই ঝড় বৃষ্টিতে লাভের লাভ তেমন হয় না, শুধু তা হতদরিদ্র মানুষের উপর প্রকৃতির বৈরী অত্যাচারের মাধ্যম, বলা যেতেই পারে। আকাশ জুড়ে নেমে এসেছে ঘোর বিষন্নতার আধার। টিপ টিপ বৃষ্টি নামলো। দালানের বানানোর ত্রুটির কারণে তার গায়েও বৃষ্টির পানি ছিটে আসছে। পেপারের পাতলা পৃষ্ঠা ভিজে যাচ্ছে। তবে বদরুল সাহেব উঠছেন না। তিনি সরু দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেঁচি গেটটা বারান্দা থেকে বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। আর তিনিও সেকারণেই আজ বারান্দায় বসেছেন। আজকাল তিনি নিজেকে বমকেশ বক্সী এর কাতারে ফেললেন। সত্যান্বেষণ করবেন তিনি। ব্যাপারটা একটু জটিল, সহজ ভাষায় বললে তিনি পিউ এর উপর নজর রাখছেন। মেয়েটা আজকাল অন্যমনস্ক থাকছে। সারাক্ষণ মিটিমিটি হাসে, গুনগুন করে গান গায়, আবার একটু কিছুতে মন খারাপ করে। ব্যাপারটা আরোও খারাপ হলো যখন তিনি জানতে পারলেন আজকাল পিউ রাত্রীযাপন ও করছে। এই সব সিম্পটম একটা রোগের ই হয়ে থাকে সেটা হলো “প্রেম”। তিনি নিজেও প্রেম করেছেন, তাই ব্যাপারগুলো ধরতে খুব একটা কষ্ট হয় নি তার। কেঁচি গেট থেকে পিউ কে ছাতা হাতে ঢুকতে দেখে খানিকটা নড়ে চড়ে বসেন তিনি। আশেপাশে চোখ ঘুরাতে লাগলেন। কোনো ছেলের চিহ্ন খোঁজার চেষ্টা করছেন। নাহ কোনো ছেলে নেই। এর মিনিট পাঁচেক বাদের মাথায় হাত দিয়ে ছুটতে ছুটতে কেঁচিগেট দিয়ে নীলাদ্রি প্রবেশ করলো। নীলাদ্রিকে দেখেই বদরুল সাহেব চেঁচিয়ে বললেন,
– নীল, একটু উপরে আসো তো!

হঠাৎ বদরুল সাহেবকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই নীলাদ্রীর কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো। বুক দুরুদুরু করছে, একই রিক্সা থেকে নামাটা কি তবে বদরুল সাহেব দেখে ফেললেন। বিগত এক সপ্তাহ যাবৎ লুকিয়ে প্রেম করছে এই কপোত কপোতী। বদরুল সাহেবের চোখ এড়িয়ে একটা সপ্তাহ বেশ ভালোভাবেই কাটিয়ে দিয়েছে তারা৷ কিন্তু শেষ রক্ষা বোধ হয় হলো না। বদরুল সাহেবের কন্ঠ কানে আসতেই পিউ এর হাতপা ঠান্ডা হতে লাগলো। সিড়িঘরে দাঁড়িয়ে নীলাদ্রির দিকে আশংকা মুখে তাকালো। নীলাদ্রির উত্তর না পেয়ে বদরুল সাহেব আবারো বললেন,
– কি হলো? আসো!
– আসছি খালু।

বলেই নীলাদ্রি সিড়িঘরের দিকে হাটলো৷ পিউ ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,
– মামু ধরে ফেলেছে, বলছিলাম আলাদা রিক্সা নিতে। এবার শান্তি হলো তো?
– অফ যা গাধা, একেই আমার বুক ধরফর করছে। কোথায় সাহস দিবি। না মহারানী আরো ভয় দিচ্ছে।
– ভয় দিচ্ছি না, ফ্যাক্ট বলছি। মামু আমাকে মেরেই ফেলবে। আমি বাসায় যাবো না।
– কিচ্ছু হবে না, প্যানিক নিস না। চল আমার সাথে। এমন হতেই পারে খালু কোনো কাজে আমাকে ডেকেছে। শুধু শুধু এতো চিন্তা করার মানেই হয় না।
– বলছো!
– হু, চল

বুকে তিনবার আয়াতুল কুরসি পড়ে ফু দিলো পিউ। মামুর রাগ সম্পর্কে তার ধারণা রয়েছে। আজ না জানি কোনো ভুমিকম্প তার জন্য অপেক্ষা করছে।

নীলাদ্রি আর পিউ একই সাথে বাসায় প্রবেশ করলো। বদরুল সাহেব বসার ঘরে পায়চারি করছেন। পিউকে দেখে থমথম কন্ঠে বললেন,
– পিউ মা, তুমি ফ্রেস হয়ে নাও। আমার নীলাদ্রি সাথে জরুরি কথা আছে।

পিউ কথা বাড়ালো না। সোজা ভেতরে হাটা দিলো। নীলাদ্রিকে একটা গামছা এগিয়ে দিলো। নীলাদ্রি হাসিমুখে গামছাটা হাতে নিলো। মাথা মুছতে মুছতে সোফায় বসলো সে। তখন বদরুল সাহেব বললেন,
– অফিস তো আজ বন্ধ, তা কোথায় গিয়েছিলে?
– জ…জ্বী খালু?
– বললাম আজ তো বন্ধের দিন। আজ ও বাহিরে গেলে, বাইরে বৃষ্টি তো। কিছুদিন আগেও জ্বর হলো। সেকারণেই বলছি।
– কাজ ছিলো আর কি!
– অহ

নীলাদ্রির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। গামছাটা দিয়ে ঘাম মুছে নিলো সে৷ তার মনে হচ্ছে সে থানায় বসে আছে। আর বদরুল সাহেব সেই থানার ইন্সপেক্টর। তাকে চুরি করার দায়ে ইন্টারোগেশন করছেন। এবার বদরুল সাহেব ভনিতা ছাড়াই বলে উঠলেন,
– তোমার সাহায্যের প্রয়োজন। আমার মনে হয় পিউ প্রেম করছে। প্রেম করাটা খারাপ কিছু নয়। তবে ছেলেটা কেমন সেটা জানা জরুরি। তুমি আমার বিশ্বস্ত সেপাই। আমি চাই তুমি ছেলেটার পুরো খোঁজ নিবে এবং আমাকে জানাবে। পারবে?

বদরুল সাহেবের আবদারে বেকুব বনে গেলো নীলাদ্রি। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকলো সে৷ মনে মনে হাসি পাচ্ছে খুব, যে চুরি সেই করেছে সেই চুরির চোর খোঁজার দায়িত্ব ও তার ঘাড়েই পড়লো। ব্যাপারটা কি হাস্যকর নয়!

টেবিলে বসে রয়েছে ঐন্দ্রিলা। তার সামনে জ্যানিফারের ডাইরি। আজ তিনদিন হতে চললো সে তার বাবার বাড়ি এসেছে। প্রথমে ভেবেছিলো একাই আসবে। কিন্তু দিশানটা হাত ছাড়লো না। জিদ করে বসলো, “মাম্মামের সাতে দাবো”

আর কি বাধ্য হয়ে নিয়ে আসতে হলো। তবে ঐন্দ্রিলা অবাক হচ্ছে তার মনে দিশানের প্রতি কোনো কঠোরতা নেই, বরং ছেলেটা মাম্মাম বলে জড়িয়ে ধরলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ঐন্দ্রিলা আবারোও ডাইরির পাতা পাল্টাতে লাগলো। তার মনের কৌতুহল তাকে শান্তি দিচ্ছে না।

৭ অক্টোবরের পর থেকে বেশ কিছু পাতা খালি। ঐন্দ্রিলার নজর গিয়ে ঠেকলো ১৯ নভেম্বর, ২০১৭ তে।

১৯ নভেম্বর, ২০১৭
যা সন্দেহ করেছিলাম সেটাই হয়েছে, আমি মা হতে চলেছি। আমার মাঝে অভ্রের অস্তিত্ব বাড়ছে। সে রাতে অভ্রকে না বলেই আমি বাংলাদেশ ছাড়ি। যখন অভ্র ঘুমে বিভর আমি তখন কানাডার পথে যাত্রারত। জানি না পাগল ছেলেটা কি করছে! হয়তো পাগলামি করছে, রাগ ঝাড়ছে। ছেলেটা হয়তো সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজের অভিমানের অন্ত করছে। জানি না! কানাডায় আসার পর থেকে আমি তার সাথে যোগাযোগের কোনো সুযোগ রাখি নি। নিজ থেকে করিও নি। দরকার কি! মায়া বাড়িয়ে শুধু কষ্ট ই পেতে হবে। তবে আমি কান্ড করেছি তাতে ঈশ্বর হয়তো আমায় ক্ষমা করবেন না। কারণ এটা একটা পাপ। আমি নিজেও জানি। তবুও পাপটা করেছি, ভালোবাসায় দায়ে। আমি জানি না যে আসছে তার পরিণতি কি হবে। আমার ভয় হয়, প্রচুর ভয় হয়।

৩০ নভেম্বর, ২০১৭
বাবাকে আজ সত্যটা খুলে বলেছি। বাবা প্রথমে হেসেছেন। তারপর আমাকে চড় মারলেন। উনার দোষ নেই, যেকোনো পিতাই এই কাজটি করবেন। মেয়ে অপরাধ করেছে। শুধু অন্যধর্মী ছেলেকে ভালোই বাসে নি, তার বাচ্চার মা হতে চলেছে সে। আমার ভয় হচ্ছে। উনি হয়তো আমার বেবিকে বাঁচতে দিবেন না। আমার খুব হচ্ছে। তিনি বলেছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে আমার এবোর্শন করাবেন তারপর বিয়ে দিবেন………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#স্বপ্নছায়া
#২২তম_পর্ব

৩০ নভেম্বর, ২০১৭
বাবাকে আজ সত্যটা খুলে বলেছি। বাবা প্রথমে হেসেছেন। তারপর আমাকে চড় মারলেন। উনার দোষ নেই, যেকোনো পিতাই এই কাজটি করবেন। মেয়ে অপরাধ করেছে। শুধু অন্যধর্মী ছেলেকে ভালোই বাসে নি, তার বাচ্চার মা হতে চলেছে সে। আমার ভয় হচ্ছে। উনি হয়তো আমার বেবিকে বাঁচতে দিবেন না। আমার খুব ভয় হচ্ছে। তিনি বলেছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে আমার এবোর্শন করাবেন তারপর বিয়ে দিবেন, কথাটা শোনার পর থেকেই আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে। সে রাতে আমি অভ্রকে না বলেই বাংলাদেশ ত্যাগ করি। অনেকে বলবে, আমি কেনো তার সাথে থাকি নি। সত্যি বলতে, ইচ্ছে তো ছিলো। ছেলেটাও আমাকে হয়তো নিজের কাছে আটকে রাখতো। কিন্তু আমি ই চাই নি। কারণ আমি ওর দূর্বলতা হতে চাই নি। যে মানুষটাকে ভালোবেসেছি সেই মানুষটাকে প্রতি নিয়ত লড়তে দেখতে চাই নি। এলকোহল জিনিসটা একবার সেবন করলে সেটা এক অন্য অনুভূতির জন্ম দেয়। ভালো এবং খারাপের মিশ্রণে মানুষের হৃদয় পুলকিত হয়ে ওঠে। কিন্তু একটা মানুষ যখন প্রতিনিয়ত সেই এলকোহলে নিজেকে ডুবিয়ে দেয় তখন সেই এলকোহল তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। আমি অভ্রের জীবনের কাল হতে চাই নি। কয়েক মাসের আন্তরিকতাটা বা মোহ তার সারা জীবনটাকে এলোমেলো করে দেবে। ওর একটা ভবিষ্যৎ আছে। সেও সুখী হবার দাবীদার। আমি চাই, ও আমাকে ভুলে যাক। বিষাধের সুধা নাহয় আমি ই পান করি।

৭ ডিসেম্বর, ২০১৭,
আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। আগামীকাল যখন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে তখন আমি সেখান থেকে পালিয়ে যাবো। হ্যান্ড ব্যাগে একটা জামা আর এই ডাইরিটা নিয়েছি। এই ডাইরিতে অভ্রের স্মৃতি। ওর সাথে কাটানো মূহুর্তের প্রমাণ রয়েছে। আমি চাই না সেটাকে হারাতে। যখন দূরের কোনো গৃহে একাকীত্বে জীবনের নির্বাহ করবো তখন এই ডাইরিটাই আমার জমাপুঞ্জি হবে, আমার চেতনা হবে। আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একজন মা হিসেবে এটা যে আমার কর্তব্য। আমি কখনো বিয়ে করবো না। একা হাতে আমার সন্তানকে মানুষ করবো। আমি জানি আমার কষ্ট হবে, আমি হারবো, পড়বো, ব্যাথা পাবো, ছিন্নভিন্ন হবো কিন্তু থামবো না। ঈশ্বর আমাকে আমার পাপের শাস্তি দিবেন, আমি তা পেতে নিবো। কিন্তু আমার সন্তানকে আমি ছাড়বো না। পাপি আমি, আমার সন্তান নয়।

এর পরের পাতাগুলো খালি৷ ২০১৭ সালের ডাইরিটা বন্ধ করলো ঐন্দ্রিলা। জ্যানিফারের জীবনের বাকি দুটো বছর পড়ার কৌতুহল তাকে দম নিতে দিচ্ছে না৷ সে কোনো গল্প পড়ছে না৷ একটি নারীর জীবন পড়ছে। যে নারী তার সর্বস্ব হারিয়ে নিজের সন্তানকে নিয়ে বাঁচার কথা ভাবছে৷ আচ্ছা অভ্র কেনো এই কয় মাসে জ্যানিকে খুজলো না? কেনো মেয়েটিকে সকল বাঞ্চনা একাই সহ্য করতে দিলো? মনে মনে অভ্রের উপর প্রচন্ড রাগ হলো ঐন্দ্রির। একটা পুরুষ এতোটা কাপুরুষ হয়? কামনার জন্যই কি সে ভালোবেসেছিলো জ্যানিকে? ঐন্দ্রিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ব্যাতীত কিছুই করার নেই। কারণ জ্যানিফার এই দুনিয়াতে নেই।

ঐন্দ্রিলা ২০১৮ সালের ডাইরিটার তালা ভাঙ্গলো। ডাইরিটা খুলতেই একটা ছবি তার সামনে আসলো। তিনজনের পারিবারিক ছবি, দুজন মানব মানবী তার সদ্য জন্মানো বাচ্চাটিকে আগলে ছবি তুলেছে। তাদের মুখে কি চমৎকার হাসি। অদ্ভুত ব্যাপার এই তিনজনের দুজন জ্যানিফার এবং অভ্র। ঐন্দ্রিলা আন্দাজ করলো বাচ্চাটি হয়তো দিশান। কিন্তু তাকে ভাবাচ্ছে একটাই প্রশ্ন! দিশানের জন্মের সময় অভ্র কি সেখানে উপস্থিত ছিলো? উত্তর খুজতে পাতা উল্টালো ঐন্দ্রিলা। চোখ আটকালো ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে।

৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮,
আজ নতুন চাকরিতে জয়েন করলাম। এই তিনটা মাস খুব কষ্ট গিয়েছে। সেদিন হাসপাতালে নেবার পথ থেকেই পালিয়ে গিয়েছিলাম আমি। বাবার নজরের আড়াল হতে কম ঝুঁকি নিতে হয় নি। পালানোর সময় বাবার অসহায় মুখখানা খুব মনে পড়ছিলো। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারি নি। কারণ আমি এখন একজন মা, মায়েরা তাদের সন্তানের জন্য সকল বাধাকে হার মানায়, নিজের সর্বস্ব কে ত্যাগ করে। আমিও তাই করেছি, আমার পরিবারের মায়া ছেড়েছি, বাবার অঢেল ঐশ্বর্যকে ত্যাগ করেছি। চাইলে আমি এবোর্শন করে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারতাম, কিন্তু সেটা আমাকে ভেতর থেকে হারিয়ে দিতো৷ হয়তো আমি বিলাসীতা পেতাম, স্বচ্ছল জীবন পেতাম কিন্তু আমার ভেতরের মা, নারী হেরে যেতো। আমি তা হতে দিতে পারি না। এই তিনমাস ঠিক মতো তিনবেলা খাবার জুটাতে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। বান্ধবীর সাহায্যে এই চাকরিটা পেয়েছি। এখন হয়তো আমার সন্তানের গ্রোথটা ঠিক মতো হবে। তিনমাসে তার গ্রোথ নেই বললেই চলে৷ খুব চিন্তায় থাকি, বাঁচাতে পারবো তো বাবুকে?

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮,
প্রতিদিন লিখতে ভালো লাগে না আমার। তাই আজকাল লেখা হয়ে উঠে না। আমার জীবনে স্মরণীয় মূহুর্ত ও চলছে না যে আমার না ডাইরিতে টুকতে হবে। তবে আজ লেখার কারণটা হলো বাবু। আমার বাবুটা তার উপস্থিতি আমাকে জানাচ্ছে। প্রতি নিয়ত মর্নিং সিক, মাথা ঘুরানো আমাকে অনুভব করায় সে আছে। তবে অভ্রকে খুব মিস করি। ক্যানাডাতে সিঙ্গেল মম এর কমতি নেই। তাই ব্যাপার গুলো ততোটা ম্যাটার করে না। তবুও এই মূহুর্তে ভালোবাসার মানুষের পাশে থাকাটা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা একমাত্র গর্ভবতী নারী ই বলতে পারে। আমি ক্ষণে ক্ষণে কাঁদি, আমার খুব ইচ্ছে করে টক জাতীয় সব খাবার খেতে, খুব ইচ্ছে হয় ক্যারেমেল ডোনাট খেতে, আমার রাগ হয়, হাসি পায়, অভিমান হয়। কিন্তু আফসোস সেগুলোকে দেখার কেউ নেই। নিজের পিঠে নিজেই চাপড়িয়ে মন কে শান্ত করি।অভ্র, তুমি যদি পাশে থাকতে! এই চাওয়াটা কি খুব বেশি কিছু?

১৯ এপ্রিল, ২০১৮,
আমি স্তব্ধ। আমি পুলকিত। আমি আশংকিত। যে অতীতকে সাত মাস পূর্বে বাংলাদেশে ছেড়ে এসেছি সে আমার সামনে। ঈশ্বর আমাকে এতোটা পরীক্ষার মুখোমুখি কেনো করছেন! হ্যা, অভ্র ক্যানাডাতে। আমি হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এটা অনেকটাই সিনেমেটিক, গভীর বিচ্ছেদ বাদে নায়ক নায়িকা মুখোমুখি। কিন্তু বাস্তবটা সিনেমা নয়। আমি পারি নি, পারি নি “প্রাইড এন্ড প্রিজুডিস” এর এলিজাবেথের মতো অভ্রকে জড়িয়ে ধরতে। বরং কাপুরুষের মতো পালিয়ে এসেছি। আমার বাড়তি পেটটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো অভ্র। তার চুপসে থাকা অসহায় মুখখানা আমার ভেতরে লাভার জন্ম৷ দিচ্ছিলো। আমি ভেতরটা পুড়ছিলো। আমি সত্যি জানি না ও কি ভাবছে। তবে আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি নি।

৩০ এপ্রিল, ২০১৮,
আর পালাতে পারলাম না। ভালোবাসার মায়াজালে আমাকে জড়াতেই হলো। অভ্রকে ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। ছেলেটা সত্যি পাগল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাস পরেছিলাম, “দেবদাস”। আজ যেন তাকে সচোখে দেখলাম। এই সাতমাসে কতোটা পালটে গেছে সে। তার যৌবনের এই ঝলকানি আর নেই। এখন সে কোনো একজন যুবক থেকে পুরুষে রুপান্তরিত হয়েছে। তার মাঝে যেনো কোনো শান্ত নদী ভর করেছে। একটা পুরুষ কোনো নারীকে কতোটা ভালোবাসতে পারে যে সেই নারীর অস্তিত্ব মুছে গেলেও সে তাকে হৃদয়ে আগলে রেখেছে। সে আমাকে জড়িয়ে হু হু করে উঠেছিলো। তার তপ্ত অশ্রু আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিচ্ছিলো। অবাক হলাম এটা জেনে অভ্র মানসিকভাবে এতোটা আসক্ত হয়ে গিয়েছে যে চিকিৎসা করাতে কানাডা এসেছে। এই পাগল ছেলেটাকে নিয়ে সত্যি আর পারলাম না। তাই শত চেষ্টার পর ও আমি তাকে ফিরালাম না। একটু স্বার্থপর হওয়া কি অন্যায় হবে!

৭ মে, ২০১৮,
আমার বাবু আজ প্রথম লাথি মেরেছে। বাবার স্নেহ অনুভব করে সেও বাড়ছে। সে কতোটা খুশি তার বেড়ে ওঠাই তার প্রমাণ। অভ্র অনেকটা স্টেবল, এখন আর পাগলামি করে না বললে ভুল হবে৷ কারণ তার সকল পাগলামি আমাকে নিয়ে। সে ঠিক করেছে আমাকে বিয়ে করে বাংলাদেশে নিয়ে যাবে। আমাদের বাবু হবার পর আমরা বিয়েটা করবো। তবে আমাকে না বললেও আমি জানি সেটা হবে না। কারণ অভ্রের মা-বাবা সন্তানকে মেনে নিলেও আমাকে মানতে পারবেন না। সমাজ নামক গন্ডির কাছে নতুন চিন্তাধারা রাখলে সেটা জুতোর তলে দাবিয়ে দেওয়া হয়। তারা তো সমাজেই থাকেন। তাই এই গন্ডি তারা পার হবেন না। অভ্র আমাকে আশ্বাস দিচ্ছে, আমাদের ও একটা পরিবার হবে। কিন্তু আমার হৃদয় যে সায় দেয় না। জানি না পরিনাম কি হবে!

৭ জুন,২০১৮,
আমার কোলে ঈশ্বর একটা ফেরেস্তা পাঠিয়েছেন। হ্যা, আমার কাছে ফেরেস্তা। কারণ কোনো মা ই তার সন্তানকে অবৈধ বলতে পারে না। এটা সমাজের একটা শব্দ। আমার কাছে আমার সন্তান অবৈধ নয়, সে কেবল ই আমার সন্তান। আমার সন্তান দেখতে একেবারে আমার মতো হয়েছে। শুধু চুল আর চোখ গুলো অভ্রের। তিনদিন আগে দুপুরে আমার লেবার উঠে, অভ্র পাগল হয়ে যায়। পাগলামী করতে দেখে ভালো লাগছিলো। সিজারে প্রিম্যাচ্যুর বেবি হয়েছে আমাদের। আমার যতক্ষণ জ্ঞান ছিলো আমি অবাক নয়নে তাকে দেখছিলাম। বাবুকে কোলে নিয়ে পাগলের মতো কাঁদছিলো। এই নিয়ে দু দফা আমার পাগল লোকটা কাঁদলো। তবে আমি জানি সে কতোটা খুশি। আমাকে নিয়েও যে সে চিন্তায় ছিলো না তা কিন্তু নয়। কিন্তু অশ্রুমুক্তি সন্তানকে কোলে নিতেই হয়েছে। আজ লেখার আরেকটা কারণ আছে। আমরা৷ আজ বিয়ে করেছি। আমি আমার ধর্ম বদলে ইসলাম অনুযায়ী বিয়ে করেছি। কারণ যে মানুষটাকে ভালোবাসি তার ধর্মকে ভালোবাসবো না তা কি হয়! যে মানুষটা কখনো আমার ধর্মের অসম্মান করে নি, সেই মানুষটার জন্য কি তার ধর্মকে আপন করতে পারবো না। আর ঈশ্বর তো এক জন ই! যে আমাকে সৃষ্টি করেছেন তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। সুতরাং তাকে জিজাস ক্রাইস্ট বলি বা আল্লাহ একই তো হবে। আমি জানি আমি ভুল করি নি। আমার মনে কোনো আফসোস নেই।

৪ অক্টোবর, ২০১৮,
সুখ জিনিসটা একটা নেশার মতো। যত পাই আরোও চাই। এই কয় মাস এতোটা সুখ কুড়িয়েছি যে এখন সেটায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। তাই ভাগ্যের নির্মমতাকে মেনে নিতে পারছি না। পারছি না আল্লাহ এর শাস্তিকে মাথা পেতে নিতে। আমি পাপি, শাস্তি যে আমাকে পেতে হবে আমি জানতাম। কিন্তু ইহজীবনে পেতে হবে মানতে পারি নি। জীবনে অভ্রের পুনরায় আগমনের পর আমার জীবনের মানেটাই যেনো বদলে গিয়েছিলো। জীবন যে কতোটা সুখময় হতে পারে সেটার অনুভূতি অভ্রের সাথে কাটানো মূহুর্তে পেয়েছি। তিনজনের ছোট পরিবার টরেন্টো তে একটা ছোট দুনিয়া বানিয়ে ফেলেছিলাম। অভ্রের মা-বাবার অমতে বাংলাদেশে ফেরাটা আমাদের হয় নি। তাই আমরা আমাদের অতীতকে ছেড়ে ভবিষ্যতের দিকে পা রেখেছিলাম। এই খানে ছিলাম মাত্র তিনজন। আমি, দিশান এবং অভ্র। কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে গেলো। পাপ কখনোই ব্যাক্তিকে ছাড়ে না। তাই তো আমার শাস্তিটাও আমাকে পেতে হচ্ছে। আমার লাঙ ক্যান্সার ধরা পরেছে। আমি তো সিগারেট খাই নি, এলকোহল ছুই নি। তবে কেনো এমন টা হলো। আমার দিশানকে দুধ খাওয়াতে পারছি না। ছেলেটা দুধের শিশু। আমার কিছু হয়ে গেলে কিভাবে বাঁচবে সে? আর অভ্র! ও পাগল হয়ে যাবে। যেমনটা আগে হয়েছিলো। এই দুজন তো অন্ধকারে ঢুবে যাবে। ঈশ্বর, আল্লাহ আমার পাপের শাস্তি এদের দিও না। দিও না।

৯ নভেম্বর, ২০১৮,
আমি লিখছি, হ্যা আমি লিখছি। কারণ এ ব্যাতীত কাজ নেই। টরেন্টোর ভালো ভালো ডাক্তার আমাকে হয়তো বাঁচাতে পারবে না। কারণ আমার শরীরে যে উইপোকা ধরেছে তা আমাকে ধীরে ধীরে শেষ করে দিবে। অভ্র তার সর্বস্ব দিয়ে দিচ্ছে আমাকে বাঁচাতে। সে একা হাতে বাবুকে সামলাচ্ছে, আমাকে সামলাচ্ছে। পানির মতো অর্থ ঢালছে। কিন্তু আমি জানি তাতে লাভ নেই। ছেলেটা বুঝতে পারছে না। কিন্তু একটা সময় ঠিক বুঝতে পারবে যখন আমি আর থাকবো না। আমার শ্বাসকষ্ট হয় খুব। তাই আজ আর লিখবো না।

২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮,
বাইরে স্নো পড়ছে। চেরি গাছটাতে প্রচুর স্নো জমেছে। আমি হাসপাতালের জানালার ধারে বসে আছি। নিজেকে কবি কবি মনে হচ্ছে। নাকে নোজাল ক্যানোলা, পাশে অক্সিজেনের সিলিন্ডার। হাতে কলম আর ডাইরি। বছরটা শেষ হতে যাচ্ছে। আমার জীবনের দিনগুলোও শেষ হতে যাচ্ছে। ডাক্তার জানিয়েছে আমি নাকি আর কিছুদিনের মেহমান। অভ্র বিশ্বাস করে নি। তার ধারণা ডাক্তার জানে না কিছু। খুব কষ্ট লাগে। বাবুকে কোলে নিতে পারছি না তাই। ছোট্ট দিশানটা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। ভাবে তার মা কতোটা স্বার্থপর। আমি কি সত্যি স্বার্থপর!

১ জানুয়ারি, ২০১৯,
অভ্রের সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে। তুমুল ঝগড়া। ছেলেটা পানির মতো টাকা খরচ করছে। পাগলের মতো আচারণ করছে। বারবার বুঝালাম, আমি মৃত্যুর দিকে আগাচ্ছি। অযথা এসব করো না। যতদিন আছি থাকি না, স্বাভাবিক মানুষের মতো। কেনো ক্যামো দিতে হবে। ক্যামো দিলে সুস্থ হবো না আমি। বরং আরো তাড়াতাড়ি মারা যাবো। আমার ছেলেটাকে বড় হতে দেখা হলো না। আচ্ছা আমার অবৈধ ছেলেকে কি কেউ ভালোবাসবে? তাতে নাক সিটকাবে? কেউ কি আমার মতো ওকে বুকে জড়িয়ে নিবে?

৮ মে, ২০১৯,
লিখাটা এলোমেলো হচ্ছে। কলম ধরতে পারছি না। তবুও আমি লিখবো। আমি জানি এর পরের পাতা গুলো ফাঁকা থাকবে। আমাকে ক্যামো দেওয়া হচ্ছে, অহেতুক পার্থিব শরীরটাকে অত্যাচার করা হচ্ছে। অভ্রকে দোষ দিবো না, সে তো তার কথা রাখার চেষ্টা করছে। আমাদের কাহিনীর পূর্নতার দেবার চেষ্টা। ছেলেটা রোজ আমার পাশে বসে থাকে, ক্লান্ত শরীর, ভেজা চোখ, হাতে “নোটবুক” উপন্যাস। আমার কষ্ট হয় ওকে এভাবে দেখতে। আমি শেষ পর্যন্ত ওর কাল হয়ে গেলাম। আমাকে ভালোবাসাটা ওর জীবনের অভিশাপ হয়ে গেলো। ঈশ্বর আমাদের এই অবৈধ ভালোবাসার শাস্তি দিচ্ছেন। আমার শাস্তি তো কিছুদিনে অন্ত হবে কিন্তু অভ্র ও সারাটা জীবন এই গ্লানি বয়ে নিবে। আমাকে জরিয়ে ধরে কাঁধে। আমি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দেই। কিন্তু কিছু বলতে পারি না। আমার অসুন্দর মুখে ঠোঁট ছুয়ে বলে,
“জ্যানি, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। আমার খুব কষ্ট হবে। সাত মাস তোমাকে ছাড়া আমি পাগল হয়ে ছিলাম। তুমি ব্যতীত আমি যে অসহায়।”

কিন্তু আমি উত্তর দিতে পারি না। কারণ আমি কথা বলা শক্তি আমার নেই। ঈশ্বর আমার অভ্রকে তুমি আর কষ্ট দিও না। ও যে একটা সামান্য মানু্ষ। প্রিয়জন হারানোর বেদনা যে ওকে নিঃস্ব করে দিবে। কাউকে ভালোবাসতে গেলে ভয় পাবে। ও যে ওর কথা রেখেছে। আমি ই শুধু স্বার্থপরতা দেখিয়েছি। আমাকে আরেকটু বাঁচতে দাও এই পুরুষের জন্য, আমার সন্তানের জন্য। আর যদি আমাকে নিয়েও যাও তবে কাউকে পাঠিও যে ওদেরকে বুঝবে। ওদেরকে আগলাবে।

ডাইরির পরের পাতাগুলো ফাঁকা৷ শেষ লেখাটা পড়তে খুব কষ্ট হয়েছে ঐন্দ্রির। লেখাগুলো অস্পষ্ট ছিলো। বোঝাই যাচ্ছে জ্যানিফারের কতোটা কষ্ট হয়েছে। তবুও সে লিখেছে। ঐন্দ্রি খেয়াল করলো তার গাল ভিজে আছে। ডাইরিটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ হু হু করে কাঁদলো সে। এখন ভোর চারটা। দিশান গভীর ঘুম। ওর পাশে বসে ওর কপালে হামি দিলো সে। এরপর মোবাইলটা হাতে নিলো। ফোন করলো একটা নাম্বারে। তিনবার বাজার পর ফোনটা রিসিভ হলো। কাঁপা স্বরে ঐন্দ্রি বললো,
– অভ্র………

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here