স্বপ্নছায়া পর্ব-২৩,২৪

0
1730

স্বপ্নছায়া
পর্ব-২৩,২৪
মুশফিকা রহমান মৈথি
২৩তম_পর্ব

ডাইরির পরের পাতাগুলো ফাঁকা৷ শেষ লেখাটা পড়তে খুব কষ্ট হয়েছে ঐন্দ্রির। লেখাগুলো অস্পষ্ট ছিলো। বোঝাই যাচ্ছে জ্যানিফারের কতোটা কষ্ট হয়েছে। তবুও সে লিখেছে। ঐন্দ্রি খেয়াল করলো তার গাল ভিজে আছে। ডাইরিটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ হু হু করে কাঁদলো সে। এখন ভোর চারটা। দিশান গভীর ঘুম। ওর পাশে বসে ওর কপালে হামি দিলো সে। এরপর মোবাইলটা হাতে নিলো। ফোন করলো একটা নাম্বারে। তিনবার বাজার পর ফোনটা রিসিভ হলো। কাঁপা স্বরে ঐন্দ্রি বললো,
– অভ্র?
– এতো রাতে ফোন করলে? সব ঠিক আছে তো?
-……..
– হ্যালো ঐন্দ্রি, কথা বলছো না কেনো? সব ঠিক আছে? দিশান? ও ভালো আছে? কথা বলছো না যে? আমার দম আটকে আসছে ঐন্দ্রি, কিছু তো বলো?

অভ্রের ঘুম ঘুম কন্ঠ হুট করে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। তার কন্ঠে উদ্বিগ্নতার পরিচয় পাচ্ছে ঐন্দ্রিলা। ব্যাপারটা একটু উপভোগ ও করলো সে। রাত চারটার সময় কাউকে ঘুম থেকে তুলে চুপ করে বসে থাকলে অপর ব্যাক্তির মনে কি চলে তা আন্দাজ করাটা খুব একটা কঠিন নয় তার পক্ষে। তবুও এই ভয়ংকর কাজটা সে করছে। সে জানে একটু পর অভ্র প্রচন্ড রেগে যাবে। তার কন্ঠে রোশের উদ্ভব হবে। ফোনের এপাশ থেকে ও তার রাগের ছিটা বুঝতে পারবে ঐন্দ্রি। ঐন্দ্রি কন্ঠ যথাযথ শান্ত রেখে বললো,
– পরশুদিন দেখা করতে পারবেন?
– খুব সিরিয়াস কিছু? আমি চলে আসবো এখন?
– আহা! কিছু হয় নি। কি হবে? আমি তো আপনার সময় জিজ্ঞেস করতে ফোন করছে! বলুন না পরশু সময় আছে? দেখা করতাম
– তুমি এই জন্য ফোন দিয়েছো?
– হু
– রাত চারটায়?
– হ্যা
– তুমি কি পাগল?

বেশ রুদ্র কন্ঠেই কথাটা বললো অভ্র।৷ তার মাথায় যেনো আগুন জ্বলছে। একটা মেয়ে ভোর চারটায় ফোন করে তাকে জিজ্ঞেস করছে পরশু দেখা করা যাবে কি না! সেটার জন্য পুরো দিন পড়েছিলো। কিন্তু মেয়েটি তা করে নি। বরং ভোর চারটায় অভ্রের সদ্য কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করছে। এটাকে পাগলামী ব্যাতীত অন্য কি বলা হয়৷ সেটা অভ্রের জানা নেই। ঐন্দ্রিলা বেশ ভাবলেশহীন ভাবেই বললো,
– আমার অনেক প্রশ্ন জমেছে। উত্তর গুলো আপনাকেই দিতে হবে। আমার ঘুম হারাম করে আপনাকে শান্তির ঘুম তো আমি ঘুমাতে দিতে পারি না। তাই এখন ফোন করলাম।

ঐন্দ্রির জড়তাহীন ভাষ্যতে অভ্রের বুঝতে বাকি রইলো না এই ভোররাতে মেয়েটি কেনো তাকে ফোন করেছে। নিজেকে শান্ত করে জিজ্ঞেস করলো,
– তোমার ডাইরি পড়া শেষ?
– হু, শেষ। এবার নাহয় উচ্ছিষ্ট প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাক!
– বেশ তবে তাই হোক। পরশু বিকেলে তৈরি থেকো।
– কোনো শান্ত নিরিবিলি জায়গা বাঁছবেন। লোক লোকালয়ের ভিড় যেনো কম থাকে।
– তাই হবে।
– রাখছি
– ঐন্দ্রিলা
– কিছু বলবেন?
– কেমন আছো? বললে না যে?
– আছি, যেমনটা ছিলাম। যেমনটা রেখে গেছেন। আছি। রাখছি।

ঐন্দ্রিলা ফোন রেখে দিলো। অভ্র ফোন কাঁটার পর দীর্ঘসময় ফোনের দিকে চেয়ে রইলো। হয়তো আর কিছুসময় ঐন্দ্রিলার কন্ঠ শুনতে পাবার ক্ষীণ আশা মনে জন্ম নিয়েছে। তিন বাদে মেয়েটির কন্ঠ শুনতে পেয়েছে সে। মনের ভেতর নীল ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। আরো ও কিছুক্ষণ তার কন্ঠ শুনতে পেলে খুব মন্দ হতো কি!

বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকালো ঐন্দ্রিলা। কিছুক্ষণ বাদে আধারের বিষন্নতা ভেদ করে পূবের আকাশে লাল রেখা দেখা যাবে। শান্ত আকাশ কালো মেঘের দল হয়তো ঘুমিয়ে আছে। শীতল ঝিরঝিরি বাতাসে ঐন্দ্রিলার খোলা চুল গুলো দোল খাচ্ছে। গ্রিলে ঝোলানো নীলকন্ঠ ফুলটায় হাত বুলিয়ে নিচু গলায় বললো,
” সখী আমি কি ভুল করছি?
সমাজ তাকে অপবাদ দিচ্ছে
ভালোবাসা কি সত্যি অপরাধ?
আমি কেনো তাকে ঘৃণা করতে পারি না
পারি না তাকে হেও করতে!
পারছি না তাকে শাস্তি দিতে
যার শাস্তি স্রষ্টা ঠিক করেছেন
যেখানে কি মানবীর শাস্তি মানায়!
হ্যা সখী, আমি কি ভুল করছি?”________

১২.
বিকেল চারটা,
ছাঁদ জুড়ে নিগূঢ় নিস্তব্ধতা। প্রকৃতি শান্ত, থমথমে বাতাস বইছে। পথঘাটে হাটু অবধি পানি, ময়লা পানি। ড্রেইন খোঁদাই এর কাজ হবার পর ও লাভ হয় নি। পানি পানির জায়গায় আছে। গলির মুখের চায়ের দোকানে কাক ও ভিড়ছে না। প্রতিটা দোকানে শাটার দেওয়া। যে গলিতে বৃষ্টি হলেই বাচ্চাগুলো হুরহুর করে হাতে ব্যাট আর বল নিয়ে নেমে পড়ে সেই গলি আজ শান্ত। কফির মগ হাতে গাঢ় নজরে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে পিউ। ময়লা পানির স্রোত দেখতে বেশ লাগছে। ছোট বেলায় এই স্রোতে কাগজের নৌকো ভাসাতো। যদিও তার এবং ঐন্দ্রিলার নৌকা সর্বদা ঢুবে যেতো। নীলাদ্রি বেশ সুন্দর করে নৌকা ভাসাতো। কিন্তু শহরের তুমুল ব্যাস্ততায় আজ সেই শৈশবটা কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে। এখনের বাচ্চাদের শৈশব ইট পাথরের ধুলোর নিচে চাপা পড়ে আছে। ছোট বাচ্চাগুলো এখন আর কিতকিত খেলে না, তারা মাংস চুরি বা টোকাটুকি খেলাগুলোর নাম ও হয়তো শুনে নি। তাদেরকে খেলার নাম জিজ্ঞেস করলে তারা পাব-জি, ফ্রি ফায়ার কিংবা কল অফ ডিউটির কথাই বলবে। সময়ের সাথে সাথে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের দুনিয়াকে হাত খুলে বরণ করছে। আর হারিয়ে যাচ্ছে শৈশবের নিস্পাপ মূহুর্তগুলো। পিউ অনুভব করলো তার ঘাড়ে কেউ উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। চমকে উঠে পেছনে তাকাতেই দেখলো, মুখে হাসি টেনে নীলাদ্রি দাঁড়িয়ে আছে। মামুর সাথে কথা বলে লোকটা যেনো বেমালুম হয়ে গিয়েছিলো। না ফোন, না ম্যাসেজ, না চিঠি, না সাক্ষাত। লোকটা যেনো ঘাপটি মেরে কোথাও পালিয়ে গিয়েছিলো। তাই পিউ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অভিমানী কন্ঠে বললো,
– তা মহারাজ কোন রাজকার্যে ব্যাস্ত ছিলেন শুনি! একেবারে তো আমাবস্যার চাঁদ বনে গিয়েছিলেন৷
– মহারানীর বুঝি গোসা হয়েছে?

আদুরে গলায় প্রশ্ন করলো নীলাদ্রি। পিউ মুখটা ভেংচি কেটে বললো,
– নাহ! আমি ফাউ লোকের উপর গোসা টোসা করি না।
– আহা! রাগ করো না প্রিয়। তোমার কার্যেই ব্যাস্ত ছিলাম। তোমার ভুড়িয়াল মামু আমাকে যাহা কার্য দিয়েছিলো….
– খবরদার আমার মামুকে নিয়ে উলটাপালটা কথা বলবেন না। রেগে যাবো কিন্তু।

চোখ রাঙ্গিয়ে কথাটা বললো পিউ। নীলাদ্রি হাসতে হাসতে বললো,
– তা কি করবো বলতো? তোর মামু আমাকে যে মহান কাজ দিয়েছে তা শুনলে তোর মাথা ঘুরাবে।
– কি এমন কাজ দিয়েছে শুনি!
– তোর প্রেমিক খোঁজার কাজ
– কিহ!
– আজ্ঞে জ্বী। তার ধারণা তুই প্রেম করছিস, তাই আমাকে তোর স্পাই হতে বলেছে। একারণে আমি একটু আন্ডারগ্রাউন্ড ছিলাম এই কদিন। তোর মামু পারে ও
– আচ্ছা আমরা মামুকে সত্যটা বলে দেই। তাহলেই তো ঝামেলা মিটে যাবে।
– জ্বী না, তখন ঝামেলা মিটবে না৷ আরো বাড়বে। আমি বাবাকে আমাদের সম্পর্কের কথা বলেছিলাম। এও বলেছিলাম আমার আর তোর বিয়ের কথাটা যেনো খালুকে বলা হয়। বাবা সাফ মানা করে দিলেন। খালু আত্নীয়ের মাঝে সম্পর্ক পছন্দ করেন না। তিনি কখনোই তোর আর আমার সম্পর্ক মেনে নিবেন না। উলটো বাবার সাথেই সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলবেন। একারণে
– আমরা কি তবে আলাদা হয়ে যাবো?

কাঁপা স্বরে কথাটা বললো পিউ। তার মনে বিষাদের কালো ঢেউ সব উথাল পাথাল করে দিচ্ছে। ঝাঝালো যন্ত্রণাতে বুক জ্বলছে। নীলাদ্রি মেয়েটার চুপসে যাওয়া উদাস মুখটা আলতো হাতে তুলে ধরলো। ম্লান গলায় বললো,
– দরকার হলে পালিয়ে যাবো। কিন্তু বিয়ে তো তোকেই করবো। তুই চিন্তা করিস না৷ একটু আঙ্গুল বাঁকাতে হবে। তবে ঘি বের হবেই।

নীলাদ্রির আশ্বস্ত কন্ঠে পিউ এর মনটা খানিকটা হলেও শান্ত হলো। অজান্তেই লোকটাকে ভালোবেসে ফেলেছে সে। আবার মামার সম্মানের কথাটাও তাকে ভাবাচ্ছে। নীলাদ্রি কি করবে পিউ এর জানা নেই। তবে অজানা কারণে তাকে খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে পিউ এর। মনে মনে আশ্বস্ত হচ্ছে তাদের কাহিনীর সমাপ্তিটা সুখময় হবে_________

পরদিন
সূর্য পশ্চিমে ঢেলে পড়ছে। স্নিগ্ধ কমলা আলো ঐন্দ্রিলার গায়ে আছড়ে পড়ছে। গাড়ি আপন গতিতে চলছে। গাড়ির গ্লাসটা নামানো। ঐন্দ্রিলা নামানো অংশটার উপর হাত রেখে মাথা এলিয়ে দিয়েছে। ফলে তার চুল উড়ছে। তার দৃষ্টি বাহিরের সবুজ শ্যামলতায় ঘেরা প্রকৃতিতে আটকে রয়েছে। পাশে তার বর বসে রয়েছে অভ্র ঠিক কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ঐন্দ্রিলার জানা নেই। তবে মনে সামান্য আশংকাটুকু নেই। সে জানে অভ্র কখনোই তার ক্ষতি করবে না। তার উত্তরের সন্ধ্যানে আসা। উত্তরগুলো তাদের সম্পর্কটাকে ভেঙ্গে দিতে পারে আবার চিরকালের জন্য জুড়ে৷ দিতে পারে। ঐন্দ্রিলা কোনো বাড়তি আশা নিয়ে আসে নি। আশা বাড়িয়ে হতাশ হতে চায় না সে। গাড়িটা থামলো। অভ্র গাড়ি থেকে নেমে ঐন্দ্রিলার পাশের দরজা খুলে দিলো। ঐন্দ্রিলা ও গাড়ি থেকে নামলো। জায়গাটা কোনো নদীর পাড়। নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ। ঐন্দ্রিলা খেয়াল করলো সেখানে একটা চায়ের টং আর ডাবের ঠেলা ব্যাতীত কিছু নেই। অভ্র ঐন্দ্রিলাকে ঘাসের দিকে ইশারা করে বসতে বললো। তার মিনিট বিশেক বাদে দুটো ডাব কিনে আনলো সে। ঐন্দ্রিলার হাতে ধরিয়ে বললো,
– এই ডাবগুলো বেশ মিষ্টি হয়। পানিটা খাও ভালো লাগবে।

ঐন্দ্রিলা স্ট্র তে ঠোঁট লাগালো। সত্যি দারুণ পানিটা। একেবারে ঠান্ডা, মিষ্টি৷ নদীর পাড়ে বসে ডাব খাবার আনন্দ সে অনুভব করতে পারছে। শীতল বাতাসে, কোনো দূষিত কনা নেই। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে কোনো বাঁধা নেই। ঐন্দ্রিলা যখন প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো অভ্র তখন সুগাঢ় দৃষ্টিতে ঐন্দ্রিলাকেই দেখে যাচ্ছিলো। তার পিপাসু নজর পাঁচদিনের পিপাসা মিটাচ্ছে। ধীর কন্ঠে বললো,
– কোনো প্রশ্ন করবে না?
– করবো তো! কতো প্রশ্ন জমেছে জানেন?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাটা বলে ঐন্দ্রিলা। তখন ঠোঁটের কোনে হাসি একে অভ্র বলে,
– আন্দাজ করতে পারছি। জানো এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। কিন্তু জায়গাটার খোঁজ আমি লাগাই নি। এই জায়গায় আমাকে জ্যানি প্রথম নিয়ে এসেছিলো……..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#স্বপ্নছায়া
#২৪তম_পর্ব

ঐন্দ্রিলা স্ট্র তে ঠোঁট লাগালো। সত্যি দারুণ পানিটা। একেবারে ঠান্ডা, মিষ্টি৷ নদীর পাড়ে বসে ডাব খাবার আনন্দ সে অনুভব করতে পারছে। শীতল বাতাসে, কোনো দূষিত কনা নেই। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে কোনো বাঁধা নেই। ঐন্দ্রিলা যখন প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো অভ্র তখন সুগাঢ় দৃষ্টিতে ঐন্দ্রিলাকেই দেখে যাচ্ছিলো। তার পিপাসু নজর পাঁচদিনের পিপাসা মিটাচ্ছে। ধীর কন্ঠে বললো,
– কোনো প্রশ্ন করবে না?
– করবো তো! কতো প্রশ্ন জমেছে জানেন?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাটা বলে ঐন্দ্রিলা। তখন ঠোঁটের কোনে হাসি একে অভ্র বলে,
– আন্দাজ করতে পারছি। জানো এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। কিন্তু জায়গাটার খোঁজ আমি লাগাই নি। এই জায়গায় আমাকে জ্যানি প্রথম নিয়ে এসেছিলো। ও বড্ড ভ্রমণপ্রেমিক ছিলো। জানি না কিভাবে এই সুন্দর জায়গাটা খুঁজে পেয়েছিলো! ওর হাজারো রহস্যের ভেতর সেটাও একটি রহস্য ছিলো। আমাদের প্রেমের পরিস্ফুটন এই জায়গাতেই হয়েছিলো। ও চলে যাবার পর আর এই জায়গাতে আমার ফেরা হয় নি। ফিরতে ইচ্ছে হয় নি। আজ এতো বছর পর তোমাকে নিয়ে এখানে এসেছি, কারণ এই স্থান থেকেই জ্যানি এবং আমার উপন্যাসটা লেখা হয়েছিলো। আর জানো তো, যেখানে উৎপত্তি সেখানেই সমাপ্তি। তাই এখানে আসা। বিরক্ত হচ্ছো?

অভ্র জিজ্ঞাসু চাহনীতে ঐন্দ্রিলার দিকে তাকায়। ঐন্দ্রিলা মলিন হাসি এঁকে বলে,
– বিরক্তি আসছে না। জোর করে কিভাবে আনতে হয় জানা নেই। কিন্তু একটু খটকা লাগলো, উপন্যাসটার কি সত্যি ইতি টানবেন?

অভ্র ম্লান হাসি টেনে বলে,
– আমি যে অনেক পূর্বেই ইতি টেনে দিয়েছি ঐন্দ্রি। এই নিজ হাতে আমার জ্যানিকে আমি মেরে ফেলেছি। এই নিজ হাতে। জ্যানি কতো বলেছে,
“জিদ করো না অভ্র, আমি ক্যামো দিবো না। ক্যামো না দিলেও আমি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকবো, দেখো তুমি?”

আমি শুনি নি। ওকে সুস্থ করার জিদ মাথায় উঠেছিলো। আমাদের উপন্যাসের হ্যাপি এন্ডিং দিতে চেয়েছিলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম, আমাদের উপন্যাসের স্রষ্টা আমি নই। উপরে যিনি বসে আছেন, যার রঙ্গমঞ্চের চরিত্র আমরা, তিনি ই তো আমাদের সমাপ্তির ধরণ ঠিক করে দিবেন। তাই হলো, উনি আমার হাতেই আমার গল্পের ইতি টেনে দিলেন। আমি একজন খুনি ঐন্দ্রিলা। একজন খুনি। সেদিন যদি ঠিক সিদ্ধান্তটা নিতাম, হয়তো আর ক’টা দিন জ্যানিকে কাছে পেতাম। আমি আমার কথা রাখতে পারি নি। জ্যানি হয়তো আমাকে ক্ষমা করবে না কখনোই। দায়ী থেকে যাবো ওর কাছে।

অভ্রের কন্ঠ কাঁপছে। হয়তো বিষাধসিন্ধুর কালো ঢেউ উঠছে। ঐন্দ্রিলার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো৷ শান্ত কন্ঠে বললো,
– সাতটা মাস নষ্ট না করলে এই আফসোসটা হয়তো থাকতো না। মেয়েটা সাতটা মাস একা একা যুদ্ধ করেছে। সমাজ, পরিবার সবকিছুকে ত্যাগ করেছে। আমিও তো একজন মেয়ে। বুঝতে পারছি, ওর উপর কতোটা ঝড় গেছে। মেয়েটার তো আশ্রয় ও ছিলো না।
– সেদিন সকালে আমার ঘুমটা ভেঙ্গেছিলো তৃপ্তির হাসি নিয়ে। ভেবেছিলাম, জ্যানিকে বুকে আগলে ঘুমোচ্ছি। স্বপ্ন দেখছি, সকালে উঠে বিয়ের ব্যবস্থা করার। হাজারো চিন্তা, সুখের স্বপ্নছায়ায় আমার ঘুম ভাঙ্গে৷ কিন্তু চোখ খুলতেই দেখি আমার বাপাশটা ফাঁকা। বিছানার অংশটা ঠান্ডা। যখন এয়ারপোর্টে খোঁজ নেই, জানতে পারি ভোরে ফ্লাইট ছেড়েছে। অফিসে ওর ঠিকানা ছিলো। কিন্তু স্পেসিফিক কোনো ঠিকানা নয়। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি জ্যানি জব ছেড়ে দিয়েছে, ওর এপার্টমেন্ট ফাঁকা। এদিকে বাবা-মার প্রেসার বাড়তে থাকে। বড় ছেলের পাগলামি তারা মানতে পারছিলেন না। বাংলাদেশে বসে কানাডাতে খোঁজ লাগানো ব্যাপারটা সিনেমাতে বেশ চমৎকার লাগে, কিন্তু বাস্তবে অনেক কঠিন। আমি পাগলের মতো যোগাযোগের চেষ্টায় লিপ্ত। একটা সময় নিজেকে নিকোটিনের প্রবল নেশা আর এলকোহলে ডুবিয়ে দিলাম। সময় যেতে লাগলো, জ্যানিকে পাবার ক্ষীণ আশাটুকুর প্রদীপটা নিভে যেতে লাগলো। আমার মানসিক বিকারগ্রস্ততা দেখা দিতে লাগলো। এদিকে মায়ের শরীর খারাপ হতে লাগলো। ছেলের ভবিষ্যতের জাহাজ ডুবন্ত দেখে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাবা ঠিক করলেন আমার হাওয়া বদল করবেন। তাই আমার এক আংকেলের কাছে কানাডা পাঠিয়ে দিলেন আমাকে। আমি অমত করি নি। হুট করে জ্যানিকে পাবার একটা সুপ্ত আসা মনে হানা দিলো। বাবা কখনো আমাকে আর জ্যানিকে মেনে না নিলেও তার উছিলায় আমি জ্যানিকে আবার পেয়েছিলাম। আবার কাছে আমি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকবো।

অভ্র তার ফাঁকা ডাবটা ফেলে দিলো। গল্প শুনতে শুনতে ঐন্দ্রির ডাবটা এখনো তার হাতেই রয়ে গেলো। ঐন্দ্রি খানিকটা হেসে উঠলো। একটু শব্দ করেই হাসলো। স্ট্র টা নাড়তে নাড়তে বলে উঠলো,
– কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই কি তাদের মিথ্যের জালে জড়িয়ে রেখেছেন? নিজের সন্তানকে অন্যের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন?
– মা-বাবা সব জানেন। এই মিথ্যের সূচনা বাবাই করেছিলেন। জ্যানিফার মারা যাবার পর আমি আর দিশান দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। ছেলেটা কাঁদতো আমি দেখতাম। তবুও নির্বিকার থাকতাম। ছেলেটার মনে আমার প্রতি একটা ভয় তৈরি হয়েছিলো। যেখানে অন্য বাচ্চারা বাবা ডাকতো। আমার ছেলেটা চুপ করে বসে থাকতো। আর আমি জ্যানিফারকে কবরে সময় কাটাতাম। প্রতি বিকেলে ওকে “নোটবুক” পড়ে শুনাতাম। আমার মনে হতো। এই বুঝি ও কথা বলবে। কিন্তু সেসব আমার ই বানোয়াট চিন্তা ছিলো। কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম। দিশানের মানসিক সমস্যা হচ্ছে। আমি ছেলেকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখালাম। তারা জানালো, ওর “xenophobia” নামক একটা মানসিক রোগ রয়েছে। আমি যদি এখন থেকে ওর কেয়ার না নেই তবে এটা বাড়তে থাকবে। ও আরোও অসুস্থ হবে। আমার আংকেল বাবাকে সব জানান। যতই হোক নিজের রক্ত। তাই বাবা আমাদের দেশে ফিরতে বললেন। তিনি জ্যানিফারের সাথে বিয়ে, সন্তানের কথাটা সম্পূর্ণ চেপে গেলেন। আমার পরিবার ইনফ্যাক্ট আহাশ, আহানাও এই ব্যাপারটা জানতো না। আফটার অল বড় ছেলে, বড় ভাই আমি। আমি তাদের আদর্শ হবো, আমাকে দেখে যেনো তারা না বিগড়ায়। সেই প্রচেষ্টাই বাবা চালালো। মাও বারণ করলো না। আরেকটা কারণ ও ছিলো। বাবা চান নি, দিশান সমাজের নানা উপহাসের পাত্র হোক। ছেলেটা এমনেই মানসিক ভাবে অসুস্থ। ব্যাপারগুলো ওর মেন্টাল টর্চার হতো। তাই নিজের ছেলে হওয়া স্বত্তেও সমাজের কাছে দিশান আমার এডোপ্টেড ছেলে। আমার এসব দিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। দিশান খুশি তাই আমিও খুশি। আমি জানি তোমার ক্ষোভ হচ্ছে। এটা ভেবে যে বাবা-মা তোমার বাবার কাছে মিথ্যে বলেছে, তোমাকে মিথ্যের ভেতরে রেখেছে। কিন্তু তুমি ই বলো কোনো মেয়ে দিশানের পরিচয় পাবার পর ওকে মেনে নিবে? ওকে ভালোবাসতে পারবে? পারবে না। এটাই সমাজের নিয়ম। এটাই আমাদের সমাজ। যেখানে বাচ্চাদের উপর বৈধ অবৈধতার ট্যাগ দেওয়া হয়।
– সমাজ আপনাকে চরিত্রহীন ট্যাগ দিয়েছিলো, সেটাকে তো অন্তত ঘোচানোর চেষ্টা করতেন!
– আমার এই সমাজের চিন্তাধারায় যে কিছুই যায় আসে না ঐন্দ্রি।
– আর আমার সাথে হওয়া বিশ্বাসঘাতকতা? আমার সাথে হওয়া মিথ্যাচার?

ঐন্দ্রির কন্ঠে রোশের হাতছানি। হাজারো অভিমান তার কন্ঠে ভিড় করেছে। অভ্র ধীর স্বরে বললো,
– আমি জানি তোমার সাথে অনেক অন্যায় হয়েছে। এজন্য ই বিয়ের রাতে আমি তোমাকে শর্ত দিয়েছিলাম। স্পষ্ট বলেছিলাম, দিশান আমার ছেলে। যাতে তোমার যদি এই মায়ার শিকল ভাঙ্গতে ইচ্ছে করে, তুমি যেনো সহজে ভাঙ্গতে পারো। আমি মানি, আমি কম দোষী নই। আমি বলবো না, “আমি সাধু মানুষ, আমি তো তোমায় মিথ্যে বলিনি”। আমি তোমায় মিথ্যে বলি নি ঠিক ই কিন্তু তোমার মিথ্যে ধারণা ভাঙ্গার চেষ্টাও করিনি। ইচ্ছে করে করিনি। কারণ আমার দিশানটা তোমাকে পেয়ে স্বাভাবিক হচ্ছিলো। আমার ছেলেটাকে সুস্থ, স্বাভাবিক হতে দেখে আমার লোভ লাগছিলো। ভয় হচ্ছিলো, সত্যি বললে তুমি আমার ছেলেটাকে আর ভালোবাসবে না। বাবা তো, সন্তানের কথাই আগে ভাববো। তাই তো তোমার অপরাধী হয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম তোমাকে নিজের থেকে আড়াল করে রাখবো। এই ভালোবাসা নামক চোরাবালিতে তোমাকে শেষ হতে দিবো না আমি। কিন্তু বিধির বিধান। নিজেই সেই চোরাবালিতে নেমে পড়লাম। যখন অনুভব করলাম, তোমার প্রেমে ক্রমশ নিজেকে জড়াচ্ছি তখন ঠিক করলাম তোমাকে সব খুলে বলবো। সব খুলে বলার পূর্বে জ্যানিকে জানাটা তোমার জন্য দরকার ছিলো। আর ভাগ্যবশত তোমার হাতেও জ্যানির ডাইরিগুলোও পড়েছিলো। আমি ডাইরি গুলো বাংলাদেশে আসার পর বুক শেলফেই রেখে দিয়েছিলাম। কখনো খোলা হয় নি, আমিও জানি ও না জ্যানি কোথায় রেখেছে চাবি গুলো। ডাইরির ভেতরে কি আছে। তবে এটুকু জানি ওর আবেগ, অভিমান, কান্না, বিষাধ ডাইরিতে লুকিয়ে রেখেছিলো। সেই রাতে নিজের সাফাই দিতে পারতাম, তোমাকে সব খুলে বলতে পারতাম। কেনো যেনো ইচ্ছে হলো না। আমি জানি না আমাকে তোমার ঘৃণা হচ্ছে কি না! জানি না আমি তোমার ভালোবাসার যোগ্য কি না! জানি না তুমি আমাকে দ্বিতীয় বার সুযোগ দিবে কি না! জানি না আমাদের সম্পর্কের পরিণতি কি হবে! তবে একটা ছোট আবদার, আমার ছেলেটাকে ঘৃণা করো না। ছেলেটা তোমার মাঝে নিজের মা কে খুজে পায়। আমরা আলাদা হয়ে গেলেও তোমার জীবনের এক কোনায় ওকে ঠায় দিও।

অভ্র থেমে গেলো। সূর্য অস্ত যাবে যাবে করছে। নদীর তীরে লাল রেখা জড়ো হয়েছে। পাখিরা বাড়ি ফেরার প্রচেষ্টায় রয়েছে। ঐন্দ্রিলা অভ্রের চোখে চোখ রাখলো। অভ্রের চোখে কোনে পানি চিকচিক করছে। ঐন্দ্রিলা এখন তার সিদ্ধান্ত জানাতে প্রস্তুত। কিন্তু আরেকটা প্রশ্নের উত্তর যে পাওয়া বাকি। সেটা জানতে তার মন ছটপট করছে। শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– ভালোবাসেন আমাকে?………….

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here