স্বপ্নছায়া পর্ব-২৫,২৬

0
1785

স্বপ্নছায়া
পর্ব-২৫,২৬
মুশফিকা রহমান মৈথি
২৫তম_পর্ব

অভ্র থেমে গেলো। সূর্য অস্ত যাবে যাবে করছে। নদীর তীরে লাল রেখা জড়ো হয়েছে। পাখিরা বাড়ি ফেরার প্রচেষ্টায় রয়েছে। ঐন্দ্রিলা অভ্রের চোখে চোখ রাখলো। অভ্রের চোখে কোনে পানি চিকচিক করছে। ঐন্দ্রিলা এখন তার সিদ্ধান্ত জানাতে প্রস্তুত। কিন্তু আরেকটা প্রশ্নের উত্তর যে পাওয়া বাকি। সেটা জানতে তার মন ছটপট করছে। শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– ভালোবাসেন আমাকে? আমি আজ এই প্রশ্নের উত্তর চাই। স্পষ্ট উত্তর।
– যদি বলি হ্যা, বিশ্বাস করবে? যদি বলি আমার হৃদয়ের গহীনে যে জায়গাটা শুধু জ্যানিফারের জন্য বরাদ্ধ ছিলো, সেই ঘরের বদ্ধ দরজা ভেদ করে তুমি নিজের রাজত্ব জমিয়েছো বিশ্বাস করবে? যদি বলি দ্বিতীয়বার ভালোবাসা নামক যন্ত্রণাকে আপন করে নিয়েছে শুধু তোমার জন্য বিশ্বাস করবে? যদি বলি আমার অনুভূতিতে, চিন্তাধারায় তুমি মিলেমিশে একাকার হয়ে আছো, বিশ্বাস করবে?
– করবো। আমি কখনো চাইবো না আপনি জ্যানিফারকে ভুলে যান। প্রথম ভালোবাসা ভুলে যাওয়া যদি এতোই সহজ হতো, তাহলে ভালোবাসা শব্দে এতো আবেগ থাকতো না। সে আপনার প্রথম ভালোবাসা, আপনার স্ত্রী, আপনার সন্তানের মা। জ্যানিফার থাকুক আপনার মনে, মস্তিষ্কে, স্মৃতির ছেড়াপাতায়। আমি না হয় বর্তমানটা জুড়ে থাকলাম। প্রতিটা মানুষের অতীত থাকে, অতীত না থাকলে মানুষের বর্তমান হতো না। সে মানুষটাকে ভালোবেসেছি, সেই মানুষটার অতীতকে ভালোবাসতে আমার আপত্তি নেই।

ঐন্দ্রিলা শান্ত কন্ঠে কথাগুলো বললো। তার মাঝে কোনো জড়তা নেই, নেই কোনো ইতস্তততা। অভ্র নদীর সরল গতির দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,
– তাহলে দ্বিতীয় সুযোগটা কি পাচ্ছি?
– সুযোগ পাচ্ছেন ঠিক ই, কিন্তু ওই যে শুকনো কথায় চিড়ে ভিজে না। কষ্ট না করলে কেষ্ট মিলে না। আমি ও বাড়ি ফিরছি না। এই এক ঘেয়েমি ডিল আমার ভালো লাগছে না। আজ ডিল থেকে আমি রিজাইন দিবো। এসব ডিল ফিলের মধ্যে আমি নেই। এসব শর্ত, কন্ডিশন আমি আর নিতে পারছি না। এবার বুঝে দেখুন কি করবেন?
– তাহলে বলছো, এবার সত্যিকারের স্বামী স্ত্রী হবার পালা?
– বটেই, অভ্র মশাই এই পরীক্ষা যে খুব কঠিন। এখনো সময় আছে, পিছিয়ে যান। এই বাঘিনীর পাল্লায় পড়েছেন

ঐন্দ্রিলা মিটিমিটি হাসছে। অভ্র তার হাতের ভাজে ঐন্দ্রিলার কোমল হাতটা ন্যায়। উষ্ণ ঠোঁট ছুইয়ে বলে,
– বারবার এই বাঘিনীর পাল্লায় ই পড়তে চাই, যে বাঘিনীর গভীর নয়তে আমি বারবার আহত হই। ব্যাপার না, পালিয়ে যাবার ইচ্ছে নেই। দেখি বাঘিনীর হৃদয়জয় হয় কি না!
– কবি কবি ভাব, শুধু কবিতার অভাব।
– সেটাও পূরণ করে দিচ্ছি,
“আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে
তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে”

খিলখিল করে হেসে উঠে ঐন্দ্রিলা। নদীর স্বচ্ছ প্রবাহের ন্যায় সে হাসি। অভ্র মুগ্ধ নয় তার বাঘিনীকে দেখছে। হাসলে মেয়েটির বা পাশে ছোট্ট করে টোল পড়ে, এই টোলেই হৃদয় হারিয়েছিলো সে। আজ বুঝতে পারছে, এ নারীতে কেনো বারে বারে মত্ত হয় তার হৃদয়। কেনো বারে বারে চিৎকার করে বলে উঠে,
” ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি”

নীলাদ্রির সামনে চোখ মুখ কুচকে বসে রয়েছে দিশা। দিশা বদরুল সাহেবের এক মাত্র মেয়ে। স্বভাবে বাবার কপি বলা চলে। এবার কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ, কিছুদিন পর উচ্চ মাধ্যমিক দিবে। চোখে চশমা, দু পাশে দুই বেনুনী। দেখলে মনে হয় ভাজা মাছ উলটানোর ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু নীলাদ্রি জানে, কতটা ধূর্ত সে। তাই নিজের দলে তাকে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলেই তার ধারণা। দিশাকে জরুরি তলবে নিজের রুমে এনেছে সে। নিজের এবং পিউ এর অবস্থা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছে। দিশা সব শুনে চোখ মুখ কুচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বিজ্ঞভাব নিয়ে বললো,
– বুঝলাম, কিন্তু আমাকে এসব কেনো বলছো? এতোদিন তো ভুলেই গিয়েছিলে তোমার একটা বোন আছে। এখন আমাকে তলব করলে কারণ কি?
– ক্ষেমা দে, মা। ভুল হয়ে গেছে। মহাবিপদে পড়েছি। তোর বাপ কেমন, তার বিবরণ তুই আমার থেকে ভালো জানিস। আমাদের উপর একটু কৃপাদৃষ্টি দে, আমাদের একটু সাহায্য কর। প্লিজ বুনডি।

অসহায় মুখ করে নীলাদ্রি কথাগুলো বলে। কথাগুলো শুনে দিশা পৈশাচিক হাসি একে বলে,
– তা না হয় করলাম। কিন্তু এটা বাংলাদেশ ভাই। ঘুষ ছাড়া পাতাও নড়ে না। তুমি যেহেতু আমার বড় ভাই, আমি বেশি কিছু চাবো না। ওই কল্পকিছু চা পানির ব্যাবস্থা আর কি!
– কেনো মেরে তোর তালের বড়ার মতো নাকটা ভেঙ্গে দিতে ইচ্ছে করছে।

দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলে নীলাদ্রি। দিশা তখন একটু জোরে হেসে বলে,
– কিন্তু তুমি তা করবে না, আমি জানি। কারণ আমি আহত হলে পিউ আপু আর তোমার কাহিনী বাবার কানে চলে যাবে। হাহাহা
– তুই এতো খারাপ কেনো রে? জানি না। এবার দেওয়া নেওয়াটা সেরে ফেলি?

নীলাদ্রি কিছু না বলে অগ্নি দৃষ্টি প্রয়োগ করে দিশার উপর। দৃষ্টিতে তাকে ভষ্ম করার ব্যর্থ চেষ্টা করে নীলাদ্রি। দিশা তাকে পাত্তা না দিয়ে বলে,
– মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। তো লিষ্ট বলি, প্রথমত, তুমি৷ আমাকে “সুলতানস ডাইন” এ নিয়ে৷ যাবে। আমার যা ইচ্ছে আমি খাবো। তুমি বাঁধা দিতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, আমাকে শপিং এ নিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার মন ভরে আমি শপিং করবো। আর তৃতীয়ত এবং শেষ, আমি যদি কখনো প্রেম করি তবে তুমি আমাকে এভাবে সাপোর্ট করবে। বাবাকে রাজী করানোর দায়িত্ব তোমার।
– একেবারে বাপের মতো হয়েছিস। জুনিয়র বদরুল আহমেদ। বেচারিই আমার খালা। কি বুঝে যে নানা এই সিংহের গুহোতে বিয়ে দিয়েছে কে জানে!

বিরবির করে কথাগুলো বলে নীলাদ্রি। দিশা মুখে বিরক্তিকর হাসি টেনে বলে,
– হয়ে গেছে গাইল্লানো? এবার প্লান বলি?
– যথাআজ্ঞা, আপনার ই মুখ, আপনার ই মাথা। আমরা তো কেবল আপনার কৃপার দাবিদার।

দিশার চুল টেনে টিটকারির স্বরে কথাগুলো বলে নীলাদ্রি। দিশা ভেঙচি কেটে বলে,
– তোমার মতো হুদুমকে পিউ আপু কেনো পছন্দ করেছে আল্লাহ জানে!
– তোর ই তো ভাই রে, হুদুমের ভাই তো গাদুম হবে না। তাই না?
– তোমার মনে হয় বিয়ে করার ইচ্ছে নেই! আমি গেলাম, থাকো তুমি
– এ না, বয় বোন আমার। বল, কি প্লান?

এর পর দিশা বিজ্ঞভাবে একটা মহাপ্রলয়কারী প্লান বললো। নীলাদ্রি তার দিকে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে বললো,
– কাজ হবে?
– দৌড়াবে। আমার ই তো বাবা। শতভাগ নিশ্চিত কাজ হবেই।

বহুদিন বাদে নীলাদ্রির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এবার মনে হচ্ছে তাদের প্রেমের একটা সুখময় পরিনতি হবে! এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা!

চটপটির ঠেলার সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাড়িরসিটে বসে চটপটি খাচ্ছে ঐন্দ্রিলা। অভ্র যথারীতি নাক শিটকাচ্ছে। তার ড্রেইনের পাশের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে চটপতি খেতে ভালো লাগে না। তার মতে হাইজিন ব্যাপারটা না কি এসব খাবারে মোটেই মেইনটেইন করা হয় না। কিন্তু ঐন্দ্রিলার সাথে তর্কে পেরে উঠলো না। মেয়েটা একবার বলেছে সে চটপটি খাবে মানে খাবেই। তাই বাধ্য হয়ে চটপটির ঠেলার সামনে গাড়ি থামাতে হলো তাকে। অভ্রের দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে তুমুল ঝাল চটপটি অনায়াসে খাচ্ছে ঐন্দ্রিলা। তার চটপটি জিনিসটা অধিক ডিম, অধিক মরিচ এবং অধিক টক দেওয়া পছন্দ। পেট জ্বলবে, মুখ, ঠোঁট লাল হয়ে যাবে কিন্তু খাওয়া থামবে না। অভ্র সিটটা পেছনে এলিয়ে দিয়েছে। গভীর নয়নে ঐন্দ্রির মুখ দেখে যাচ্ছে সে। ঝালে মেয়েটার অবস্থা খারাপ, চোখ থেকে পানি পড়ছে, একটু পর পর নাক টানছে। এতো ঝাল কখনোই খেঁতে পারে না অভ্র। খাওয়ার মাঝেই অভ্র বলে উঠলো,
– মা, তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলো। কবে আসবে এই সেই, দিশানকেও মিস করছে। না আমার পরীক্ষা কতোদিন চলবে?
– আমাদের ও বাড়ি রঙ্গমঞ্চ হচ্ছে। সেটা শেষ হওয়া অবধি তো চলবেই।

ঝালে হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা বললো ঐন্দ্রিলা। মেয়েটার ঠোঁট লাল হয়ে এসেছে তবুও খাওয়া কমছে না। এর মধ্যে অভ্র প্রশ্ন করে উঠলো,
– রঙ্গমঞ্চ মানে?
– “পিউ এবং নীলাদ্রির শুভবিবাহ”____ এই রঙ্গ ন্না শেষ হওয়া অবধি, আমি কোথাও যেতে পারবো না। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের ভূমিকায় আছি আমি। আগুন লাগলে নেভাতে হবে তো।
– পিউ মানে তোমার ওই কাজিন?
– হুম, ভাইয়া ওকে ভালোবাসে। খালু আত্নীয়ের মাঝে বিয়ে পছন্দ করেন না। তাই একটু নাটকের সাহায্য নিতে হবে।
– শালাসাহেব প্রেম ও করতে পারেন?
– শুধু প্রেম, চুটিয়ে প্রেম। প্রেমিক পুরুষদের কমপিটিশন হলে আমার ভাই এক নম্বর থাকতো।

নাক টেনে কথাটা বলে ঐন্দ্রিলা। কথাটা শুনে অভ্রের দৃষ্টি সরু হয়ে গেলো। আজ চটপটি মামা একটু ঝাল টা বেশি ই দিয়ে৷ ফেলেছেন। ঠোঁট জোড়া একেবারে লাল হয়ে রয়েছে ঐন্দ্রিলার। হুট করেই অভ্রের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি জেকে বসলো। ঐন্দ্রিলা কিছু বোঝার আগেই অনুভব করলো……………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#স্বপ্নছায়া
#২৬তম_পর্ব

নাক টেনে কথাটা বলে ঐন্দ্রিলা। কথাটা শুনে অভ্রের দৃষ্টি সরু হয়ে গেলো। আজ চটপটি মামা একটু ঝাল টা বেশি ই দিয়ে৷ ফেলেছেন। ঠোঁট জোড়া একেবারে লাল হয়ে রয়েছে ঐন্দ্রিলার। হুট করেই অভ্রের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি জেকে বসলো। ঐন্দ্রিলা কিছু বোঝার আগেই অনুভব করলো এক জোড়া উষ্ণ ঠোঁট তার ঠোঁট আকড়ে ধরেছে। অভ্রের এরুপ আচারণে ঐন্দ্রিলা যেনো জমে গেলো। তার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। হৃদস্পন্দন তীব্র হয়ে উঠলো। আবেশে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো সে। ব্যাপারটা খানিকটা সিনেমেটিক, অভ্র এরুপ কিছুও করতে পারে কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করে নি ঐন্দ্রি। কয়েক মূহুর্ত বাদে ঐন্দ্রির পাতলা ঠোঁট জোড়া ছেড়ে দিলো অভ্র। নির্বিকার ভাব নিয়ে গাড়িটা স্টার্ট দিলো সে। গাড়ির শব্দে স্বম্বিত ফুরলো ঐন্দ্রিলার। এতোক্ষন তারা চটপটি৷ ওয়ালার ঠেলার পাশেই ছিলো। লজ্জায় ঐন্দ্রিলার গাল দুটো লাল-বেগুনী হচ্ছিলো। আর অভ্রের ভাবটা এমন যেনো কিছুই হয় নি। অভ্রের এমন স্বাভাবিকতায় ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে গেলো ঐন্দ্রিলার। চটে গিয়ে বললো,
– এটা কি হলো?
– কি হবে?

স্বাভাবিক ভঙিতে প্রশ্নের উপর প্রশ্ন ছুড়ে দিলো অভ্র। এতে ঐন্দ্রির মেজাজ তুঙ্গে উঠলো। হিনহিনে স্বরে বললো,
– ন্যাকা, বুঝছেন না বুঝি? ফ্রি তে মামাকে শো দেখালেন সেটার কথা বলছি
– অদ্ভুত নিজের বিয়ে করা বউকে চুমু খেয়েছি। কি মহাভারত অশুদ্ধ করলাম আমি?
– আপনি একটা অসহ্য, অসভ্য, অভদ্র সেটা জানেন?
– এতোদিন জানতাম না, আজ জানলাম। ধন্যবাদ এতোসুন্দর চারিত্রিক কমপ্লিমেন্টের জন্য।
– ধুর! ভালো লাগে না।

ঐন্দ্রিলা মুখ সরিয়ে গ্লাসের দিকে তাকায়। রাগ এবং লজ্জা মিলেমিশে যেনো আরো ও মোহনীয় করে তুলেছে তাকে। অভ্র আড়চোখে তার বাঘিনীকে দেখে নিলো। তারপর ঠোঁটের কোনে তৃপ্তির হাসি একে গাড়ি ছোটালো। আধারের নগরীর হলুদেটে রাস্তায় কাঁটানো মূহুর্তগুলো ব্যস্ত জীবনটাকে যেনো আরোও জীবন্ত৷ করে৷ তোলে। এই গোটা কয়েক মূহুর্তগুলোই মাঝে মাঝে “চেরী অন দ্যা কেক” এর ন্যায় নীল ভালোবাসাকে আরোও আবেগঘন করে তোলে। ঐন্দ্রিলা গাড়ির গ্লাসে মাথা ঠেকিয়ে আধার কালো আকাশের পানে তাকিয়ে রয়েছে। ভালোবাসার স্বপ্নছায়াগুলো যেনো বাস্তব মনে হচ্ছে। নিজেকে আবারো কিশোরী ভাবতে ইচ্ছে করছে। হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের নায়ক নায়িকার মতো প্রেম করতে ইচ্ছে করছে তার। আচ্ছা অভ্র কি পারবে তার পছন্দের সেই প্রেমিক পুরুষটি হতে! খুব জানতে ইচ্ছে করছে তার।

১৩.
ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহ, কুকুর মরা গরম পরেছে বললে ভুল হবে না। মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে, তবুও বদরুল সাহেব তরতর করে ঘামছেন। তার সাদা পাঞ্জাবি গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। আসমা বেগম একটা গ্লাস এগিয়ে দিলেন তার দিকে। তিনি অবাক চোখে জিজ্ঞেস করলেন,
– এটা কি?
– লেবু পানি। বিটলবণ আর হালকা চিনি ও দিয়েছি। খাও ভালো লাগবে।

তিনি নিঃশব্দে গ্লাসটা হাতে নিলেন। তার এখন লেবুর শরবত খাওয়া জরুরী। মস্তিষ্কের প্রতিটি শিরা তার উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। শরবত খেলে মাথাটা একটু শান্ত হবে বলে তার ধারণা। নীলাদ্রি বদরুল সাহেবের ঠিক বিপরীতে বসে রয়েছে। মনে মনে সূরা পাঠ করছে সে। আজ নাটকের প্রথম দিন। তার উপর নাটকের ফল নির্ভর করছে। নীলাদ্রি কখনো ভয় পায় না। তবে আজ তার ভয় হচ্ছে। ভয় হচ্ছে এই ভেবে যে প্লান ব্যাকফায়ার করলে কি করবে সে? ফিফটি ফিফটি চান্স, একটা ভুল স্টেপ আর প্লান এর চৌদ্দটা বেজে যেতে পারে।

বদরুল সাহেব শরবতটা শেষ করে নীলাদ্রির মুখের দিকে তাকালেন। শান্ত কন্ঠে বললেন,
– কেসের কি অবস্থা?
– খালু কেস কিন্তু জন্ডিস। আপনি যা ধারণা করেছেন সেটাই ঠিক। পিউ প্রেমে পড়েছে। এখন সেই গাড়ি কতদূর গিয়েছে তা সঠিক না জানলেও গতি সুবিধার না।
– ছেলে কি করে?
– আস্তো একটা রাম ছাগল। ম্যা ম্যা করে না, তবে পিউ পিউ করে। পিউ এর কলেজের ই। পিউ কে বহু আগ থেকে সে পছন্দ করে। কলেজে বেশ নাম ডাক আছে শুনেছি। পলিটিক্স ও করে, মারপিট, দাঙ্গা। বুঝলেন খালু, আমাদের নিস্পাপ মেয়েটা একটা রামছাগলের পাল্লায় পড়েছে। শুধু তাই নয়, শিহাবকে ও এই রামছাগল ই মেরেছিলো। সে নাকি বলেই দিয়েছে, পিউ কে যে বিয়ে করতে আসবে তার হাড় ভেঙ্গে দিবে।

নীলাদ্রির কথা শুনে বদরুল সাহেবের মাথা ঘুরে যাবার জোগাড়। রীতিমতো আরোও বেগে ঘামছেন তিনি। নীলাদ্রি টিস্যুর বক্স টা এগিয়ে দিলো তার দিকে। খালুর সামনে নিজেকে পিউ এর যোগ্য প্রমাণ করার তালে নিজের নামেই দূর্নাম রটাচ্ছে নীলাদ্রি। দিশার প্লান অনুযায়ী, সে খালুর উপর রিভার্স সাইকোলজি প্রয়োগ করছে। খালুর সামনে পিউ এর প্রেমিকের বদনাম করে খালুর বিশ্বাসী হয়ে উঠার প্রথম ধাপ এটা। মাথার ঘাম মুছে চিন্তিত কন্ঠে বদরুল সাহেব বললেন,
– এটা কি মামদোবাজি নাকি? আমার ভাগ্নী যেখানে ইচ্ছে সেখানে বিয়ে দিবো। ও গুন্ডামি করবে আর আমরা মেনে নিবো নাকি? আমি থানায় যাবো
– এ ভুল করবেন না খালু। হিতে বিপরীত হতে পারে। পিউ এখন নতুন নতুন প্রেমের হাওয়া খাচ্ছে। কিশোরী মন, উলটা পালটা করে বসলে? আর ওই ছেলের উপর তিনটা কেস আছে অলরেডি৷ ওকে জেলে দিলে কিচ্ছু হবে না। ওর চেলা দিয়ে বর পেটাবে। ও তো নিজে পেটায় না। চেলা দিয়ে পেটায়। মাঝখানে আমাদের মেয়ের নাম খারাপ হবে। একটু ভেবে দেখুন খালু।
– তাহলে কি করবো?
– অতি শীঘ্রই ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিবো পিউ এর। যে ছেলে এই রামছাগলকে ভয় পাবে না। আমরা বলে নিবো এই ব্যাপারটা। যে ছেলে রাজী হবে সেই ছেলের সাথেই বিয়ে দিবো। “ধরো তক্তা, মারো পেরেক”
– এতো তাড়াতাড়ি ভালো ছেলে পাবো কোথায়?
– সেটা আমি কিভাবে বলি খালু? আপনারা দেখুন না। পাবেন ইনশাআল্লাহ। আজ উঠি৷

বলেই উঠে দাঁড়ালো নীলাদ্রি। খালার দিকে তাকিয়ে বাকি নাটক চালিয়ে যাবার ইশারা করলো সে। আসমা বেগম ও তাকে চোখের ইশারা আশ্বস্ত করলেন। নীলাদ্রি পিউদের বাসা থেকে বেরিয়ে৷ আসলো। তার বুক এখনো কাঁপছে। শ খানেক মিথ্যে সাজানো লেগেছে শুধু একটা বিয়ের জন্য। বদরুল সাহেবকে মিথ্যে বলায় তার খানিকটা খারাপ ও লাগছে। কিন্তু কিছুই করার নেই৷ পিউ কে বিয়ে করার জন্য মিথ্যে বলতেও রাজী সে। বাসা থেকে বের হতেই পিউ এর দেখা হয় নীলাদ্রির। নীলাদ্রির চুপসে যাওয়া চেহারা দেখে পিউ ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে আপনার? মুখটা পাংশুটে হয়ে আছে যে?
– নিজের মুখে নিজের বদনাম করে এসেছি, মুখ পাংশু হবে না তো কি উজ্জ্বল হবে? জানিস, রামছাগল অবধি বলেছি নিজেকে।

নীলাদ্রির অসহায় কন্ঠের বক্তব্যে হেসে উঠে পিউ। বিরবির করে বলে,
– ভালো তো মাঝে মাঝে নিজের সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা ভালো।
– খুব হাসি পাচ্ছে না, যা ভেতরে। দেখ তোমার মামু কি করে তোর!
– নীলাদ্রি ভাই, কাজ হবে তো?
– জানি না। তবে টেনশন করিস না। কাজ না হলে পালিয়ে যাবো। চিটাগাং পালাবো। পাহারের মধ্যে একটা ঘর নিবো। ব্যাস আর লাগে।

নীলাদ্রির কথায় ম্লান হাসি হাসলো পিউ। এই হাসির মাঝে নিজের দোটানার চিত্র ফুটে উঠছে। মামুকে কষ্ট দিতে চায় না পিউ। লোকটা তার জীবনে তার পাবার ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু নীলাদ্রিকেও পাগলের মতো ভালোবাসে সে। তাদের প্রণয়ের ঠিক কি পরিণতি হবে তা একমাত্র বিধাতাই বলতে পারেন!!

রাত আটটা,
বারান্দার এক কোনায় কফি হাতের শরতের আকাশ দেখতে ব্যাস্ত ঐন্দ্রিলা। বাসায় প্রচন্ড উত্তেজনা চলছে। ঐন্দ্রিলাও এই উত্তেজনার অংশ। অভ্রের বাড়িতে সেই রাতে ফেরা হয় নি তার। সেদিনের পর থেকে এক সপ্তাহ কেটে গেছে। অভ্র সেই দিনের পর দিন ই অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে গেছে। যোগাযোগ হয় নি মোটেই। যাওয়ার দিন সকালে দু-তিনটা ফোন এসেছিলো। ঐন্দ্রিলা ঘুমিয়ে থাকার কারণে ফোন ধরতে পারে নি সে। ঘুম যখন ভেঙ্গেছিলো, তখন অভ্রকে ফোন করে কিন্তু ফোনটা বন্ধ পায় ঐন্দ্রিলা। মোবাইল চেক করে একটা ম্যাসেজ পায়, সেটা হলো,
” সকাল সকাল ফোন করে ঘুম ভাঙ্গানোর ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু বান্দা অপারগ। একটা কাজে ঢাকার বাহিরে যাচ্ছি। দশ দিন সেখানেই থাকা হবে। যদি ফোনে না পাও রাগ করো না। এখানে নেটওয়ার্কের অবস্থা ভালো না। ইনশাআল্লাহ দশদিন পর ই কথা হবে। ভালো থেকো।”

ম্যাসেজটা পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো ঐন্দ্রিলার। মনের ভেতর অসংখ্য বিষাদেরা ভর করেছিলো। রাগ হয়েছিলো ঘুমের উপর। এতোটা গাঢ় না হলে হয়তো লোকটার কন্ঠ শোনা যেতো। তারপর একটা সপ্তাহ কেটে গেছে। অভ্রের ফোনে ফোন একেবারেই যে ঢুকে না তা নয়। মাঝে মাঝে নেটে কল যায় কিন্তু অভ্র কেটে দেয়। দু -তিনবার এমন হবার কারণে ঐন্দ্রিও অভিমানে ফোন দেয় নি। মানছে ব্যাস্ততা আছে, তাই বলে এতোটা ব্যাস্ততা! অভ্রের না ফোন, না ম্যাসেজ। একটা সপ্তাহ এভাবেই কেটেছে তার। মুখে মুখে বললেই প্রেমিকপুরুষ হওয়া যায় না। কাজেও করতে হয়। হঠাৎ ডোরবেলটা বেজে উঠে। নীলাদ্রি এবং দিশান বাসায় নেই। মামা, ভাগ্নে কোথায় গেছে সে জানে না। আর শরীফ সাহেব নামাজে। তাই ঐন্দ্রিলাই গেটটা খুলে। গেটে একটা ছেলে দাঁড়ানো। ছেলেটাকে দেখে ডেলিভারি বয় মনে হলো ঐন্দ্রিলার। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– জ্বী বলুন, কাকে চাই?

ছেলেটা বিনয়ের সাথে বলে,
– এখানে কি মিসেসঐন্দ্রিলা অভ্র চৌধুরী থাকেন?
– জ্বী, আমি ই ঐন্দ্রিলা অভ্র চৌধুরী। কেনো বলুন তো?
– আপনার জন্য একটা পার্সেল আছে ম্যাডাম। এখানে একটু সাইন করে দিবেন

ঐন্দ্রিলা খানিকটা অবাক হলো। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো,
– কে পাঠিয়েছে?
– জানি না ম্যাডাম। আমি তো ডেলিভারি বয়। উনার নাম দেওয়া নেই।
– আচ্ছা দিন কাগজটা।

কাগজে সাইন করার পর একটা বেগুনী বাক্স ঐন্দ্রিলার হাতে ধরিয়ে দেয় ছেলেটা। বাক্সটা মিডিয়াম সাইজের। ঐন্দ্রিলা দরজাটা দিয়ে নিজের রুমে চলে আসে। বাক্সটা খুব যত্নের সাথে খুলে ঐন্দ্রিলা। বাক্স খুলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় তার। হরেক রঙ্গের রেসমি চুড়ির দুটো থোকা, এক জোড়া রুপোর নুপুর এবং একটি বেগুনী খাম। বেগুনী খামের উপর লেখা,
“প্রিয় বাঘিনী”

ঐন্দ্রিলা খামটা যত্নের সাথে খুলে। খামের ভেতরে সাদা কাগজে লেখা একটি চিঠি। চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে ঐন্দ্রিলা। চিঠির লেখা গুলো ঠিক এরুপ..………..

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here