জঠর
পর্বঃ১৬,১৭
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ১৬
কয়েকদিন ধরেই হৃতির অস্বাভাবিক আচরণ খেয়াল করছে অর্হিতা। মেয়েটা কলেজ থেকে বেশ সময় করে বাড়ি ফিরে। কারো সাথে তেমন একটা কথাও বলে না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকে। আগে নায়েলের সাথে ভালো একটি বন্ডিং ছিল। ক্রমশ তা ফিকে হতে লাগল। অর্হিতা ভেবেছে হয়তো তার জন্য হৃতি নিজেকে নায়েলের কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু অর্হিতার ভুল ভাঙল যখন সে হৃতির ব্যবহারের প্রতি অভিনিবেশ করে।
তিমির আচ্ছন্ন নভোলোকে চন্দ্রিকার উদ্ভাসিত চন্দ্রাতপে মুখর মেদিনী। মৃদুশীতল বহ্নিসখে গুঞ্জন উঠেছে শান্ত তিমির পরিবেশে। ছাদের বাউন্ডারি দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে নায়েল। তার বুকের বা’পাশে হৃদপিন্ডের উপর মাথা রেখে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে অর্হিতা।
চাঁদের মিহি আলো চুকচুক করে ছুঁইছে অর্হিতার সুশ্রী আনন। নায়েলের ঘ্রাণেন্দ্রিয় তখন মত্ত অর্হিতার ঘন কেশে। সৌরভের ছড়াছড়ি রেশম কালো অরন্যে। নায়েল প্রাণভরে শ্বাস নেয়। অর্হিতা ধীর গলায় বলল—
“হৃতির সাথে কথা বলেছেন আপনি?”
নায়েলের অস্পষ্ট উত্তর—
“উঁহু।”
“আপনি কালই ওর সাথে কথা বলবেন। আজকাল অদ্ভুত আচরণ করছে। কথা বলছে নি ঠিক মতো, খাচ্ছে না ঠিক মতো। সারাদিন ধুম ধরে ঘরে বসে থাকে। আর কলেজ থেকে ফেরেও দেরি করে।”
নায়েলের শ্রুতিগোচর হলো না কিছুই। সে ব্যস্ত অর্হিতার ঘাড়ে। ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের ঘর্ষণের সাথে উষ্ণ অধরের ছোঁয়া। নায়েলের দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে অসহনীয় গলায় বলে উঠে অর্হিতা—
“নায়েল! কী বলেছি শুনতে পেরেছেন আপনি?”
“হু।”
মেজাজ তিরিক্ষি হলো অর্হিতার। নায়েলের বুকের পাটাতন থেকে পিঠ সরিয়ে সরব কণ্ঠে বলল—
“ধুর! কিছু বলছেন না কেন?”
নায়েল নিরীহ গলায় বলল—
“কী বলব?”
“আপনি কি কিছুই শুনতে পাননি।”
“না তো। শুধু দেখতে পেয়েছি। আপনার ওই চন্দ্রানন! চাঁদের জোছনা ঠিকরে পড়ছে আপনার অঙ্গে। প্রভঞ্জনে উঠেছে ঝড়, উত্তাল করেছে আমার মন।”
অর্হিতা বিষিয়ে উঠা গলায় বলল—
“আপনার এই আবর্জনা মার্কা কবিতাগিরি বন্ধ করবেন? মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার।”
“কুল, কুল মিসেস অর্হিতা। বলুন, আমি শুনছি।”
অর্হিতা সচেতন গলায় ফের বলল—
“হৃতির সাথে কালই কথা বলবেন আপনি।”
নায়েল ফিচেল হাসে। বক্রোক্তি করে বলল—
“যেন আপনি আমার চুল ছিঁড়ে বাতাসে ফুঁ দিয়ে ওড়াতে পারেন। নো চান্স!”
অর্হিতা চোয়াল শক্ত করে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল—
“আপনি কী আমার কথা শুনবেন, না আমি চলে যাব?”
নায়েল হুট করে অর্হিতাকে নিজের বুকে টেনে নেয়। টপটপ করে কয়েকটা চুমু খেয়ে বলল—
“আই এম সিরিয়াস নাউ, বলুন।”
অর্হিতা ফোঁস করে দম ফেলে। সোজা হয়ে বসে। মৃদু বাতাসে তার চুলে উড়াভাব এসেছে। নায়েল সেই চুল নিয়ে উঁচু করে ধরে। তারপর একটু একটু করে হাত থেকে ছাড়ে। চুলগুলো কচ্ছপ গতিতে খসে পড়ে বাতাসে দোল খায়। নায়েল সেই চুলের ফাঁক গলিয়ে চাঁদ দেখে। অর্হিতা নাক, মুখ কুঁচকে নায়েলের আচরণ দেখছে। ইচ্ছে করছে এখন নিজের চুলগুলোই টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। নায়েলের হাত থেকে চুল সরিয়ে দগদগে চোখে তাকাতেই নায়েল কপট ভয়ের ভঙ্গি ধরে। বুকে থু থু ছিটিয়ে বলল—
“এভাবে তাকান কেন? ভয় লাগে আমার।আচ্ছা বলুন। কী বলছিলেন যেন!”
অর্হিতা রাগ সংবরণ করে। সে বেশ বুঝতে পারছে নায়েল তাকে রাগানোর জন্য এমন করছে। অর্হিতা একটু শান্ত হয়ে বলল—
“আপনি কাল সকালেই হৃতির সাথে কথা বলবেন। হৃতি আপনার সাথে অনেক ফ্রি। আই থিংক ও আপনাকে নিজের সমস্যাটা খুলে বলবে।”
“আপনি শুধু শুধু ভাবছেন। ওর পরীক্ষা সামনে। তাই হয়তো ব্যস্ত।”
“তা নয়। হৃতি ঠিক সময়ে বাসায় ফেরে না। রাতে প্রায়ই না খেয়ে ঘুমিয়ে থাকে। সেদিন দেখলাম মেঝেতে শুইয়ে আছে। মেয়েটার চোখ গুলো কেমন প্রাণহীন! শরীরেও জোর নেই।”
নায়েলের মসৃণ কপাল কুঞ্চিত হয়। গাঢ় শ্বাস ফেলে। চোয়ালে আসে দৃঢ়তা। স্থির গলায় বলল—
” ওকে। আমি দেখছি।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অর্হিতা। মেয়েটার জন্য বড্ড মন পোড়ে তার। নিজেকে কল্পনা করে ওর জায়গায়। তার কেউ নেই, কিন্তু মেয়েটির বাবা থেকেও নেই। অর্হিতার ধ্যান কাটে নায়েলের কণ্ঠে—
“এখন বলুন তার বিনিময়ে আমি কী পাবো?”
অর্হিতা চোখের আয়তণ সংকুচন করে বলল—
“আপনি কী পাবেন মানে? আপনাকে আমি কী দেবো?”
“যা আমার চাই।”
অর্হিতা বিরক্তি নিয়ে উঠে বলল—
“ধুর! বসে থাকুন এখানে। আমার ঘুম পাচ্ছে।”
“আরে, এই, মিসেস অর্হিতা শুনুন।”
খলখল করে হাসে নায়েল। মেয়েটা অদ্ভুত ! দূরে গেলে বাড়ায় জ্বালা, কাছে এলে দিশেহারা!
,
,
,
সকালে জরুরি কাজ থাকায় হৃতির সাথে দেখা হয়নি নায়েলের। বিকেলে বাসায় ফিরে সে অপেক্ষমাণ হৃতির জন্য। হৃতি এলো। কিন্তু সায়াহ্নের শেষ লগ্নে। নায়েল তখনও বসার ঘরে বসে আছে। নায়েলকে দেখে একরকম লুকোচুরি করে নিজের কক্ষে পা বাড়ায় হৃতি। বাসায় এসেই যে নায়েলের সম্মুখিন হবে তা সে ভাবতে পারেনি। প্রায় আধঘণ্টা পরও যখন হৃতি এলো না তখন নায়েল নিজেই তার কক্ষে গেল। বাইরে থেকে নক করতেই থিতিয়ে থাকা হৃতি সরব হলো। নায়েলকে দেখেই অপ্রস্তুত ভঙিতে নিজেকে গোটাতে থাকল। নায়েল চোখের সাহায্যে হৃতিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে। হৃতি অস্বাভাবিক আচরণ করছে। নায়েল কাঠ গলায় বলল—
“এতক্ষণ কোথায় ছিলে?”
ঢোক গিলল হৃতি। মৃদু গলায় বলল—
“কলেজে।”
নায়েল হাত ঘড়িতে তাকায়। বলল—
“সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। বিকেল চারটায় ছুটি। এত সময় কোথায় ছিলে?”
হৃতি থতমত খেয়ে বলল—
“বান্ধবীদের সাথে গেছিলাম। তাই…।”
“মিথ্যে বলছ। কোথায় ছিলে হৃতি? এনি থিংক রং?”
“না, না। আমি ঠিক আছি। তুমি যাও।”
নায়েলের চোখ পড়ে হৃতির হাতে। খপ করে তা ধরে তীক্ষ্ম স্বরে বলল—
“তোমার হাতে কী হয়েছে? পুড়লো কী করে?”
হৃতি নিজের হাতের দিকে তাকায়। জলন্ত সিগারেটের পোড়া দাগ। হৃতির মোমের মতো শরীরে কৃষ্ণ গহ্বর তৈরি করেছে। সিক্ত হয় তার আঁখিজোড়া। নায়েলকে জোর করে কক্ষ থেকে বের করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—
“তুমি যাও, যাও এখান থেকে। কিছু হয়নি আমার। যাও এখান থেকে।”
নায়েল ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। ঠিক পিউলী যেন অভিমান করে কাঁদছে। নায়েল দরজায় চাপড় বসাতে থাকে।
“হৃতি দরজা খোলো। কী হয়েছে তোমার?হৃতি!”
অর্হিতা এসে দাঁড়িয়েছে পাশেই। সন্দিহান গলায় বলল—
“কী হয়েছে?”
নায়েল নাকের ডগা ফুলিয়ে বলল—
“হয়েছে তো কিছু একটা।”
গজগজ করতে থাকে নায়েল। বিছানায় শুয়ে ঝমঝমিয়ে কাঁদছে হৃতি। এত বড়ো ভুল সে কী করে করল? এর মাসুল তাকেই দিতে হবে।
,
,
,
নওশাদ সাহেবের কোলে বসে কার্টুন দেখছে পিউলী। ডিভানের কোণে বসে আছেন সায়েরা। নায়েল কোনো সাড়া না দিয়েই ভেতরে ঢুকে পড়ে। বিব্রত চোখে তাকাল সায়েরা। নায়েল কখনো এমন করে না। তার বাদামী রঙটায় আগুন ধরেছে যেন! গটগট করে বলল—
“হৃতির কী হয়েছে বলোতো? ও কী কারো সাথে রিলেশনে জড়িয়েছে?”
সায়েরা ফাঁকা ঢোক গিললেন। ঊষর গলায় বিস্ময় নিয়ে বললেন—
“এসব কী বলছ তুমি?”
“ঠিক ই বলছি। ওর হাত দেখেছ? যেন কেউ জ্বলন্ত সিগারেটের ফিল্টার লাগিয়ে দিয়েছে। আই সয়ের, যদি কোনো এড়েগেড়ে ছেলের পাল্লায় ও পড়েছে তাহলে কিন্তু ভালো হবে না। সাবধান করে দিয়ো ওকে।”
পিউলীর কৌতূহল দমাতে নওশাদ সাহেব তাকে টিভিতে ব্যস্ত করলেন। বিভিন্ন কথা বলে ভোলাতে চেষ্টা করছেন। সায়েরা দ্বিধান্বিত ! ভয়ে জবুথবু সায়েরা নিজের প্রশান্তিময়ী জায়গা খুঁজে নিয়ে কাউকে কল করে। ওপাশের ব্যক্তি যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। কল রিসিভ করেই বিশ্রি রকম হাসল। সায়েরা খনখনে গলায় বললেন—
” এসব কী শুরু করেছিস তুই? কী করেছিস মেয়েটার সাথে?”
ওপাশের ব্যক্তিটি বাঁকা হাসল। তার ঠোঁটের ভাজে জ্বলন্ত সিগারেট। দুই আঙুলের ভাঁজে নিয়ে মুখ ভর্তি ধোঁয়ার কুন্ডলি বিক্ষিপ্ত করল। প্রকীর্ণ হলো ছোট্ট খুপড়ি কক্ষে। চেয়ারে হেলান দিয়ে আরেক চেয়ারে অদ্ভুত ভঙিতে পা তুলে রেখেছে। রঞ্জিত চোখে দীর্ঘ পল্লব। মেঘবর্ণ মুখে সিগারেট পোড়া ওষ্ঠাধর। কণ্ঠে জীর্ণতা।
“টাকা কোথায় আমার?”
সায়েরা চেঁচিয়ে উঠলেন। বললেন—
“পনেরো দিন আগেই তোকে টাকা দিয়েছি। শেষ করে ফেললি! এত টাকা দিয়ে করিস কী তুই? এই মাসে তুই দুই বার টাকা নিয়েছিস।”
ব্যক্তিটি আঙুলের ভাঁজের সিগারেটটি মুখে পুড়ল। একটা দীর্ঘ টান মেরে মুখ থেকে সরিয়ে নিল। আয়েশি ভঙ্গিতে ধোঁয়া ছেড়ে বলল—
“কী করেছি জানি না। টাকা লাগবে আমার। ব্যবস্থা কোরো। না হলে তোমার ওই নায়েল আনসারীর মান সম্মান নিলামে ওঠাব আমি। জাস্ট এক মিনিট লাগবে আমার। ওই হৃতির অ্যাডাল্ট ভিডিয়ো ভাইরাল করতে। তখন তোমার নায়েল মুখ লুকাতে পারবে না।”
সায়েরা তেঁতে উঠলেন। গরগর করে বললেন—
“আমি তোকে হৃতিকে ভালোবাসতে বলেছি। আর তুই মেয়েটার সাথে এই জঘন্য কাজ করলি!”
বিশ্রি রকম চাপা হাসে ব্যক্তিটি। ভরাট গলায় বলল—
“ভালো বিয়ের পর বাসব। এখন এনজয়! টাকার ব্যবস্থা কোরো আমার আর না হলে ওই বাড়িতে আমার এন্ট্রির। নাহলে ওই হৃতিকে আমি বাজারে উঠিয়ে ছাড়ব।”
“সুহাস!”
ব্যক্তিটি খিঁচতি মেরে হাসে। কল কেটে অ্যাশ ট্রেতে সিগারেটের ফিল্টার ফেলে একটা সিরিঞ্জ নেয়। নিজের হাতে পুশ করে তৃপ্তিকর হাসে। শরীরটা এলিয়ে দেয় পুরোদস্তুর চেয়ারে।
চলবে,,,
#জঠর
#পর্বঃ১৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
রাগে মস্তিষ্কের দু’পাশের রগরগ দপদপ করছে নায়েলের। এত বড়ো একটা অঘটন ঘটিয়ে নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে বসে আছে হৃতি। টিমেটিমে চোখে তাকিয়ে মেঝেতে পায়ের আঙুল ঘষে যাচ্ছে। নওশাদ সাহেব গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সহজ-সরল মেয়েটা এমন একটা চিন্তাতীত কাজ করে ফেলবে তা তিনি ভাবতেই পারেন নি। সায়েরাও নির্লিপ্ত। নায়েল বিক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠে—
“বিয়ে কী ছেলে খেলা! বললেই হয়ে গেল? এইটা কী ধরনের বিয়ে?”
হৃতির মুখে রা এলো না। ওড়নার দুইপাশ কোলের মধ্যে নিয়ে শুধু চেপে যাচ্ছে। তার হা,পা কাঁপছে অনবরত। ভয়, শঙ্কায় আর লজ্জার বলয়ে আবিষ্ট হৃতি চোখ তুলেও তাকাচ্ছে না। নায়েল প্রশস্ত গলায় ঘোষণা করল—
“এই বিয়ে আমি মানি না।”
পাশে থাকা সুঠাম দেহের পুরুষটি অধরের কোণ প্রশস্ত করল। হেয়ালি চোখে তাকাল। কালো শার্ট-প্যান্টে তার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ধূসর আকাশে একফালি রোদ হয়ে ধরা দিচ্ছে চোখে। বাদামী বর্ণের চোখে ঘন পক্ষ্মচ্ছায়ায় নিবিড় মোহ। প্রশস্ত ললাটে পুরু ভ্রু জোড়া সুদীর্ঘ। ভরাট চোয়াল। পুরুষটি ওঠে দাঁড়াল। তার এক হাত হৃতির হাতে। হৃতিকে নিয়ে দু’কদম সামনে এগোতেই নায়েল প্রতিবাদ করে বলল—
“ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?”
পুরুষটি তার পুরু অধরে স্নিগ্ধ হাসির ফোয়ারা ঝরালো। তেজবিহীন স্বরে বলল—
“আমার বউ, আমি যেখানে খুশি নিয়ে যাব। যদিও রাজপ্রাসাদ নেই। গাছতলা, ব্রীজতলা কিছু তো একটা উপায় হবেই।”
নায়েল কটমটিয়ে বলল—
“ও কোথাও যাবে না।”
পুরুষটি মিষ্টি করে হাসল। প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করে নাকের ডগায় ঘষা মারল। স্নিগ্ধস্বরে বলল—
” বউকে ছেড়ে তো আমি কোথাও যাচ্ছি না বড়ো ভাই। আসি।”
“দাঁড়ান।”
মেয়েলি মিহি কণ্ঠে থমকে যায় পুরুষটি। অর্হিতা এসেছে। পিউলীকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসেছে সে। পিউলীর সামনে এমন ঘটনা ঘটুক তা কেউ চায় না। সেই সকালে বেরেয়েছিল হৃতি। ফিরেছে রাত আটটার পর। একা ফেরেনি। কাজী অফিস থেকে এক আগন্তুককে নিয়ে ফিরেছে। হৃতি তাকে চিনলেও বাড়ির আর কেউ তাকে এ জীবনে দেখেনি। অর্হিতা শান্তকণ্ঠে বলল—
“কোথাও যেতে হবে না আপনাকে। হৃতি, তোমার হাজবেন্ডকে নিয়ে ঘরে যাও।”
হৃতি চোরা চোখে নায়েলের দিকে তাকায়। ক্ষিপ্ত নায়েলের দুই চোখ দিয়ে অগ্নিনালা নির্গত হচ্ছে। হৃতি কুণ্ঠিত হয়। চলে যায় নিজের কক্ষে। বিতৃষ্ণ নওশাদ সাহেব ওঠে চলে গেলেন। সায়েরাও দাঁড়ালেন না। রণলীলা সাঙ্গ হলো। নায়েলের মেজাজ বিগড়ে গিয়েছে। অর্হিতা সান্ত্বনার সুরে বলল—
“প্লিজ, শান্ত হোন। ছোটো মানুষ ভুল করে ফেলেছে। কোথায় যাবে ও আমাদের ছেড়ে? আর ছেলেটারও তো কেউ নেই।”
নায়েল দগ্ধ গলায় বলল—
“এটাই তো। ও এত বড়ো ভুল করল কী করে? ছেলেটার কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, তার ওপর বেকার। এমন ছেলেকে ও বিয়ে করল কী করে? নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু চিন্তা হলো না ওর?”
অর্হিতা মৃদু গলায় বলল—
“সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাবা- মাকে ভাবতে হয়। না কি তারা নিজেরা চিন্তা করে তাদের কৈশোর নষ্ট করবে। সন্তান ভুল করলে বাবা-মা শুধরে দেবে, বিপদে পড়লে আশ্রয় দেবে। এই জন্যই তো পরিবার। হৃতি অজ্ঞতাবশত হোক আর প্রেমের টানেই হোক ভুল করে ফেলেছে। আমরা তো আছি। ওর পরিবার। আপনি আর এ নিয়ে চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করবেন না। বাবা, খালামনি তারাও উদ্বিগ্ন এ নিয়ে। আপনি হাল ছাড়লে তাদের কী হবে?”
নায়েল শান্ত হয়। তবুও সে ক্ষুব্ধ।
বিছানার কোণে বসে আছে হৃতি। তার উরুর উপর পা তুলে সটান হয়ে শুয়ে আছে পুরুষটি। হৃতি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—
“তুমি নায়েলের সাথে এভাবে কথা বললে কেন?”
পুরুষটি পা নামায়। ওঠে বসে। হৃতির কাছে এসে শ্বাস ফেলতেই তার নিঃসৃত উষ্ণতায় কেঁপে ওঠে হৃতি। দাঁতের সাথে দাঁত লাগিয়ে বলল—
“তোর আশিকের সাথে কথা বলেছি বলে তোর রাগ হচ্ছে?”
হৃতি তাপিত গলায় বলে উঠে—
“সুহাস! এসব কী বলছ?”
সুহাস একটানে নিজের বুকে নিয়ে নেয়ে হৃতিকে।
,
,
,
ডিভানে শরীরে এলিয়ে বসে আছে নায়েল। তার গম্ভীর, চিন্তিত, নিমগ্ন চিত্ত। স্বামীর এহেন দশায় অর্হিতার মন ক্ষুণ্ণ হয়। নায়েলের পাশে বসে তার বুকে মাথা রাখে অর্হিতা। আদুরে গলায় বলল—
“আপনি কেন এত ভাবছেন?”
অর্হিতার মাথার উপর চিবুক রাখে নায়েল। এক হাতে তাকে বুকের সাথে আলতো করে চেপে ধরে। অবিন্যস্ত চুলে হাত গলিয়ে বলল—
“ভয় হয় আমার। আর কাউকে হারাতে ইচ্ছে হয় না। হৃতি আর নিহিতার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই আমার কাছে। ও তো আমার পিউর মতো। পুতুলের মতো কোমল। মেয়েটা কী করে এত বড়ো ভুল করল?”
“আপনি শুধু শুধু ভাবছেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“নিহিতাও এই ভুল করেছে। ইন্টারমিডিয়েট অব্দি দুই ভাইবোন এক ঘরে থাকতাম আমরা। অনার্সে ভর্তি হতেই আমাদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা হয়ে গেল, সাথে আমাদের ঘরও। একই কলেজে পড়া সত্ত্বেও আমার নাকের নিচেই মাহিমের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেল। আমি টেরও পেলাম না। তারপর বিয়ে, ডিবোর্স, পিউ! সবকিছু এত দ্রুত হলো আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। হৃতির সাথে যেন এমন কিছু না হয়। আই হোপ!”
মাথাটা কিঞ্চিৎ আলগা করে অর্হিতা। নায়েলের হৃৎকম্পন বাড়ছে। অর্হিতা বিচলিত গলায় বলল—
“শান্ত হোন নায়েল। আপনার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে।”
নায়েল নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে। অর্হিতা দুই হাতে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে।
,
,
,
খাবার টেবিলে অনুপস্থিত হৃতি। তার দরজার দিকে বারংবার তাকাচ্ছে নায়েল। হৃতি আসছে না। অর্হিতা নায়েলের উদ্বেলতা বুঝতে পেরে নিজেই এগিয়ে যায় হৃতির কক্ষের দিকে। দরজায় কড়া নেড়ে বলল—
“হৃতি, সবাই বসে আছে। খাবে এসো।”
সমাহিত হৃতির কোমল দেহের উপর থেকে সরে আসে ক্লান্ত সুহাস। তার ঘর্মাক্ত শরীর এলিয়ে দেয় বিছানার অপর পাশে। হৃতি চটপট ওঠে বসে। পড়ে থাকা জামাটা গায়ে পরে নেয় চটজলদি। এলোথেলো চুলগুলো হাত দিয়ে কোনোমতে ঠিক করে দরজা খুলে দাঁড়ায়। হৃতির ছোট্ট মুখটাই শুধু দেখতে পাচ্ছে অর্হিতা। ছোট্ট শ্বাসে বলল—
“খেতে এসো হৃতি।”
“তুমি যাও অামি আসছি।”
“হু। দেরি করো না।”
অর্হিতার টানটান ললাটে ভাঁজ পড়ে। মেয়েটাকে কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে! প্রায় মিনিট পনেরো পরেও হৃতি এলো না। রাগে টনটন করছে নায়েলের শিড়দাঁড়া। অর্হিতা রয়ে সয়ে বলল—
“হয়তো ওর হাজবেন্ড আসতে চাচ্ছে না। আপনারা খেয়ে নিন। আমি ওদের খাবারটা ঘরেই দিয়ে আসি।”
নায়েল খেঁকিয়ে ওঠে।
“ঘরে কেন খাবার দিয়ে আসবেন?”
“নায়েল, সব বিষয় নিয়ে এত ঝামেলা করলে চলে? আপনি খেয়ে নিন তো।”
নায়েল আর বসল না। খাবার ছেড়ে ওঠে চলে যায়। অর্হিতা নীরাস হয়।
কলরবকে দিয়ে হৃতির কক্ষে খাবার পাঠানো হয়। বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে আছে সুহাস।
“সুহাস উঠো। খেয়ে নাও।”
“তোকে লাইট অফ করতে বলেছি আমি।”
“খেয়ে নাও আগে। সারারাত না খেয়ে থাকবে না কি?”
খিচতি মেরে ওঠে বসে সুহাস। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হৃতির হাতের খাবারগুলো ধাক্কা মেরে ফেলে বলল—
“শালি, তোকে খেয়েছি না তাতেই পেট ভরেছে আমার! লাইট বন্ধ কর।”
হৃতি দ্রুত হাতে লাইট অফ করে দেয়। বুক ভেঙে কান্না আসে তার। এই মানুষটাকে চিনতে সে অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছে। সম্পর্কের শুরুতে এত কেয়ার, এত লাভিং আর পারফেক্ট মানুষটা হঠাৎ করেই কেমন অচেনা আগন্তুক হয়ে গেল। হৃতির কোমল মন বিষিয়ে তুলেছে তাদের প্রথম ঘনিষ্ঠতার পরেই। বান্ধবীদের প্ররোচনায় পড়ে সুহাসের সাথে তার বাসায় গিয়েছিল। আর সেদিনই অঘটন ঘটে। হৃতি বুঝতেই পারেনি সুহাস একজন চেইন স্মোকার আর সাথে ড্রাগ অ্যাডিক্টেড। শারীরিক নির্যাতনের সাথে মানসিক নির্যাতন। তাই কাউকে কিছু না বলে সে বিয়ে করে নিল। এতকিছুর পরেও সে সুহাসকে ভালোবাসে। নায়েলের প্রতি তার আবেগ এতটা ছিল না। তবে তার আদর্শ ছিল নায়েল আর সেই সাথে ভালোলাগা। কিন্তু সুহাসকে সে ভালোবেসেছে। তার সবকিছু দিয়েই ভালোবেসেছে। বিনিময়ে পেয়েছে ধোঁকা।
কার্পেট থাকার কারণে নিক্ষিপ্ত খাবারের বাটি, প্লেটের কোনো শব্দ সৃষ্টি হলো না। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে সেই খাবার কুড়াতে থাকে হৃতি। অনবরত তার চোখের কোণ হতে ঝরছে অথৈ জল।
চলবে,,,