জঠর পর্বঃ১৮,১৯

0
896

জঠর
পর্বঃ১৮,১৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ১৮

সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে পিউলী। কাউচে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে আছে সুহাস। অর্হিতা নিচে নেমে আসতেই তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল পিউলী। নরম গলায় বলল—

“মামুনি ওই আঙ্কল হৃতির আনটির ঘরে কেন থাকে?”

অর্হিতা চকচকে চোখে চেয়ে বলল—

“কারণ ওই আঙ্কলের সাথে তোমার হৃতি আনটির বিয়ে হয়েছে তাই।”

পিউলী উৎফুল্ল গলায় বলল—

“সত্যি?”

“হুম।”

“বিয়ে হলে বুঝি একসাথে থাকতে হয়?”

অর্হিতা ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। হতভম্ব গলায় বলল—

“হ্যাঁ।”

“তাহলে তুমি কেন পাপার ঘরে থাকো না?”

অর্হিতা চাপা হাসে। মেয়ের গালে চুমু বসিয়ে বলল—

“কারণ আমাদের তো ছোট্ট পিউ সোনা আছে তাই। চলো, চলো স্কুলের জন্য দেরি হচ্ছে।”

অর্হিতার হাত ধরে হাঁটতে থাকে পিউলী। কিন্তু তার কৌতূহলী চাহনি সুহাসের দিকে। পিউলীর মনে হচ্ছে সে সুহাসকে এর আগে কোথাও দেখেছে। গাড়িতে বসায় পিউলীকে। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসল অর্হিতা। খানিক সময় পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে নায়েল। তার চোখে-মুখে রাগের আবছায়া। অর্হিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে কপালে ভাঁজ তুলল। নায়েল ঠাস শব্দ করে গাড়ির দরজা বন্ধ করে ভেতরে বসল।

গাড়ি চলছে স্বাভাবিক গতিতে। নায়েলের গম্ভীর, স্থির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে অর্হিতা—

“কিছু হয়েছে নায়েল?”

নায়েল বিক্ষিপ্ত গলায় বলল—

“কাল থেকে আপনার আর শাড়ি পড়ার দরকার নেই।”

অর্হিতা মুচকি হাসল। তার স্বামী জেলাসও হয়! অর্হিতা ঘাড় ঘুরিয়ে সুদূর আকাশে তাকাল। জীবন কত অদ্ভুত সুন্দর! কে জানত তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে, বিছিয়ে থাকা জীবন এত সুন্দর করে গুছানো হবে! কে জানত, মুছড়ে যাওয়া ফুলকেও কেউ তার দামি ফুলদানিতে এনে সাজাবে? অর্হিতা মনে মনে বলে, “জীবন সুন্দর! আসলেই সুন্দর। প্রয়োজন শুধু সঠিক সময় আর মানুষের। যার আগমনে জীবন তার আসল মানে খুঁজে পায়।”
,
,
,
ঘুটঘুটে আঁধারে ছেয়ে আছে নীলাভ্র। থালার মতো উঠেছে চাঁদ। তার উদ্ভাসিত আলোয় ধরণীতে নেমেছে জ্যোৎস্না। ছাদের বাউন্ডারি দেয়ালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুহাস। আকাশ পানে চেয়ে মুখভর্তি ধোঁয়ার কুন্ডলি নির্গত করল মুখ থেকে। ঠোঁটের ভাঁজের সিগারেট তখন শোভা পাচ্ছে হাতের আঙুলের ভাঁজে। রঞ্জিত চোখ জোড়ায় তীব্র আক্রোশ। জ্বলন্ত সিগারেটের শেষাংশ নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে ধরে সুহাস। তার পেছনে এসে দাঁড়ায় সায়েরা। আবেগমাখা অসহায় গলায় বলল—

“এসব কেন করছিস সুহাস? কেন জীবনটাকে এভাবে শেষ করে ফেলছিস?”

সুহাস উপহাসমিশ্রিত হাসল। দুই হাত প্যান্টের পকেটে পুরে দৃঢ় গলায় বলল—

“কেন এসেছ? যাও এখান থেকে। কারো কোনো উপদেশের প্রয়োজন নেই আমার।”

“কেন এমন পাগলামি করছিস?

সুহাস চেঁচিয়ে ওঠে। গরগর করে বলল—

“এত চিন্তা কেন তোমার এখন? কোথায় ছিল এই চিন্তা যখন মা-বাবা জীবিত থাকতেও আমাকে এতিমখানায় কাটাতে হয়েছে? কোথায় ছিল তখন, যখন তিন বেলার জায়গায় আমাকে একবেলা খেয়ে থাকতে হয়েছে? শীতের রাতে মায়ের উষ্ণতার জন্য কাতরাতে হয়েছে। শুধু নিজের সুখের কথা ভেবেছ তোমরা। আমার কথা ভাবনি? জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না। সুখের সাগরে ভাসতে টাকাওয়ালা লোককে বিয়ে করে বসলে। তোমার স্বামীও তোমার জায়গায় অন্য কাউকে নিয়ে আসলো। আর আমার জায়গা কোথায় হলো? এতিমখানায়!”

সায়েরা ডুকরে উঠলেন। স্বামীর সাথে ডিবোর্স হলে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছেন তিনি। ভাবতে পারেননি তার প্রথম স্বামী তাদের একমাত্র সন্তানকে এতিমখানায় রেখে আসবেন।

সায়েরা শ্রান্ত গলায় বললেন—

“এখানে হৃতির কী দোষ? মেয়েটাকে কেন কষ্ট দিচ্ছিস?”

সুহাস বাঁকা হাসল। ক্রুর গলায় বলল—

“ওর সাথে প্রেম করতে বলেছ করেছি, বিয়ে করতে বলেছ করেছি। এখন আমার বউয়ের সাথে আমি কী করব তা আমার ব্যাপার। তা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আর চিন্তা করো না, কেউ জানবে না তুমিই আমার মা। যাও এখান থেকে, যাও।”

সায়েরা আর দাঁড়ালেন না। নিজের প্রতি ক্ষুব্ধ তিনি। তার ভুলে তার ছেলের আজ এই অবস্থা।
,
,
,
পড়ার টেবিলে মাথা দিয়ে বসে আছে হৃতি। তার মাথায় হাত রাখে অর্হিতা। চট করেই মাথা তোলে হৃতি। অর্হিতা সরস গলায় বলল—

“ঘুম পাচ্ছে?”

হৃতি ক্লান্ত হাসে। মিহি গলায় বলল—

“উঁহু। ভালো লাগছে না। সামনে পরীক্ষা। চিন্তা হচ্ছে খুব।”

অর্হিতা সাহস যুগিয়ে বলল—

“এত ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। একটা কথা বলব?”

“বলো।”

“নায়েলের সাথে কথা বলো। তিনি আসলে তোমাকে নিয়ে অনেক চিন্তিত। ”

হৃতি মাথা নিচু করে। চোখে টলটল করে তার জলকণা। অপরাধি গলায় বলল—

“নায়েল আমাকে ক্ষমা করবে? ”

অর্হিতা সহাস্য অধরে বলল—

“কেন করবে না। কাউকে ভালোবাসা অপরাধ নয় হৃতি। কিন্তু বিয়ে! বিয়ে শুধু দুটো মানুষের একসাথে থাকা নয়। তাদের বিশ্বাস, ভরসা, একে অন্যের উপর আস্থার প্রয়োজন। আর দুটো পরিবারের মিলবন্ধন বিয়ে। মানলাম সুহাসের কেউ নেই। কিন্তু তোমার তো আছে। আর বিয়ে নিয়ে প্রতিটি মেয়ের একটা স্বপ্ন থাকে, অভিলাষ থাকে। তুমি ইচ্ছে করলেই তোমার সেই ইচ্ছে পূরণ করতে পারতে। নায়েল তোমাকে নিহিতার মতোই ভালোবাসে। ভাবোতো, যে মানুষটা নেই তাকেও প্রতি মুহূর্তে মনে করে নায়েল, সেখানে তোমাকে কতটা ভালোবাসে সে।”

“আই এম সরি অর্হিতা।”

“থাক, আর দুঃখ পেতে হবে না। নায়েলের সাথে কথা বলো। তারও ভালো লাগবে।”

“হুম।”

অর্হিতা পরিবেশে চটপটে ভাব আনতে বলল—

“চা না কফি?”

হৃতির সমস্ত কষ্ট এক নিমিষে কর্পূরের মতো উবে গেল। হাসি হাসি মুখে বলল—

“তুমি বসো আমি নিয়ে আসি।”

অর্হিতা জোরালো গলায় আপত্তি করে বলল—

“নো ওয়ে। তুমি বসো আমি নিয়ে আসছি।”

অর্হিতা মনে সন্দেহ রেখে ফের বলল—

“তোমার হাজবেন্ড কোথায়?”

“আমাকেই খুঁজছেন, ভাবীজান?”

সুহাসের অকস্মাৎ পুরুষালী কণ্ঠে অপ্রতিভ হয় অর্হিতা। দ্রুত বেরিয়ে আসে সেখান থেকে। কফি নিয়ে যখন পূণরায় হৃতির কক্ষের সামনে এসেছে তখন দরজা বন্ধ। কয়েকবার নক করেও কোনো সাড়া পেল না অর্হিতা। সায়েরা এসে দাঁড়ালেন। প্রশ্নাত্মক গলায় বললেন—

“সুহাস ভেতরে আছে?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে ওদের আর তোমাকে ডিস্টার্ব করতে হবে না।”

অর্হিতা ভ্রূ কুঞ্চন করে। সে ডিস্টার্ব করতে যাবে কেন?
কফির ট্রে টা সায়েরা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল—

“তাহলে এই কফি আপনি আর বাবা খেয়ে নিন।”

সায়েরা অপ্রস্তুত চোখে তাকাল।

স্থির হয়ে শুয়ে আছে হৃতি। তার চোখের কোণে জল। আঁধারের খেল চলছে। ঘুমন্ত সুহাস হৃতির কোমল শরীরটা কাছে টেনে নেয়। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ের তার গলায় মুখ গুঁজে। সুহাসের মোলায়েম স্পর্শে একটু আগের দেওয়া সব কষ্টই যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল হৃতির। সুহাসের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আশার আলো দেখল সে। সুহাস একদিন ঠিক বুঝতে পারবে, সে হৃতিকে সত্যিই ভালোবাসে। শুধু শরীর দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়েও।
,
,
,
জরুরি ফাইল খুঁজছে নায়েল। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অর্হিতা। অর্হিতার সতেজ দৃষ্টি। রহস্য করে বলল—

“আজ আমি আপনার ঘরে থাকতে পারি?”

নায়েল ফাইলের দিকে চোখ রেখে মৃদু গলায় বলল—

“মেয়ের মার আজ এত মেহেরবান?”

অর্হিতা কণ্ঠে মিষ্টতা রেখে ফিচেল হেসে বলল—

“কেন? মেয়ের বাবা কী আজ অনেক বেশি ব্যস্ত?”

“না। তবে আমিষ খাওয়ার মুড নেই আজ।”

অর্হিতা গাল ফোলায়। কপট অভিমান দেখিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই নায়েল হাত টেনে ধরে বলল—

“এই, কোথায় যাচ্ছেন?”

“নিরামিষ আনতে, ছাড়ুন।”

নায়েল পেছন থেকে অর্হিতার কোমর জড়িয়ে ধরে। তার কাঁধে চিবুক রেখে মোলায়েম গলায় বলল—

“আজ হঠাৎ মেঘ না চাইতেই আকাশ ফুঁড়ে বৃষ্টি! অকস্মাৎ বর্ষণে ডুবে যাব আমি। সয়লাব হৃৎপ্রকোষ্ঠে উত্তাল ঢেউ। ক্লান্ত নাবিকের ঠাঁয় কোথায়?”

অর্হিতা লাজুক হাসে। তার চুলে ঘ্রাণেন্দ্রিয় ডোবায় নায়েল। কাঁধে নাক ঘষে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল—

“পিউ ঘুমিয়েছে?”

“ও বাবার ঘরে।”

অর্হিতাকে চট করে নিজের দিকে ফেরায় নায়েল। তার অবিন্যস্ত চুল কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল—

“তাই বুঝি এত মেহেরবানি?”

অর্হিতা চোখের কোণ ক্ষীণ করে বলল—

“এত ঢঙ করতে হবে না। যেতে দিন।”

চকিতে অর্হিতাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয় নায়েল। হট করেই বলল—

“ধন্যবাদ।”

অর্হিতা নায়েলে বুকে মাথা গুঁজে রেখেছে। ছোট্ট শ্বাসের সাথে আলতো গলায় বলল—

“কেন?”

“আমার পিউর মা হয়ে ওঠার জন্য।”

অর্হিতা এবার নিজের হাত কাজে লাগায়। সম্মোহিনীর মতো আঁকড়ে ধরে নায়েলকে। নায়েল ধীর গলায় ফের বলল—

“ধন্যবাদ।”

“কেন?”

“আমার পরিবারকে ভালোবাসার জন্য।”

“তারপর?”

“ধন্যবাদ।”

“কেন?”

“এই গিরগিটিকে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য।”

অর্হিতা লজ্জায় মিশে যায় নায়েলের বক্ষস্থলে। দুর্বল হাতে এক চাপড় বসায় নায়েলের বুকে। নায়েল তার দুই বাহু দিয়ে নিচ্ছিদ্রভাবে আড়ষ্ট করে জড়িয়ে নেয় অর্হিতাকে।

চলবে,,,

#জঠর
#পর্বঃ১৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

“মামুনি জানো ওই আঙ্কল না পঁচা জিনিস খায়। ছিঃ গন্ধ! ধোঁয়া, ধোঁয়া।”

অর্হিতা ভাবুক নয়নে তাকায়। তার বুঝতে বাকি নেই পিউলী কীসের কথা বলছে। আজকাল হৃতির ঘরে গেলে সিগারেটের উৎকট গন্ধ লাগে! পিউলী নিশ্চয়ই সুহাসকে সিগারেট খেতে দেখেছে।

“জানো মামুনি, তমাল ভাইয়াও খায়। কী পঁচা!”

“এসব বলে না। থাক, আর তুমি পাপাকে বলিয়ো না আঙ্কলের কথা। ঠিক আছে?”

“ওকে মামুনি।”

পিউলীকে কোলে তুলে নেয় অর্হিতা। নিচে এসে ডাইনিং চেয়ারে বসায়।

“তুমি বসো, মামুনি দুধ নিয়ে আসি।”

“হুম, হুম।”

অর্হিতা রান্নাঘরে গেলে পিউলী ডাইনিং চেয়ারে চিবুক লাগিয়ে বসে থাকে। সুহাসকে দেখে সরব হয় পিউলী। চিবুক উঠিয়ে গোল গোল চোখে চেয়ে থাকে। সুহাস একটা চেয়ার টান দিয়ে পিউলীর পাশেই বসে। সকালে খাওয়া হয়নি তার। নায়েলকে দেখলেই মাথার শিরা কম্পিত হয় সুহাসের। তাই তাকে এড়িয়ে চলার যথাসাধ্য চেষ্টা করে সুহাস।

পিউলী আধো আধো গলায় বলল—

“তুমি হৃতি আনটিকে বিয়ে করেছ?”

ছোট্ট করে হাসে সুহাস। মাথাটা ঝাঁকিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজ করে বলল—

“হু।”

“তোমার নাম কী?”

“সুহাস। আর তোমার?”

“আমি পিউলী। তুমি দুধ খাবে?”

সুহাস গালভর্তি হেসে বলল—

“না।”

পিউলীর মুখটা চুপসে যায়। দুঃখী দুঃখী গলায় বলল—

“কেন?”

সুহাস হেসে হেসে বলল—

“আমি তো আর তোমার মতো বাবু নই।”

“দুধ খেলে শত্তি হয়। মামুনি বলেছে।”

পিউলীর কথায় প্রসন্ন হাসে সুহাস। মেয়েটা কী মিষ্টি!

“তুমি কিকেট খেলতে পারো?”

“হুম।”

“ইয়েহ! তুমি দাঁড়াও, আমি আসছি।”

পিউলী চেয়ার থেকে নেমে তার ছোট্ট ছোট্ট পায়ে এলোমেলো দৌড়াতে থাকে। টেবিলে রাখা বাদামের বাটি থেকে দুটো বাদাম মুখে পুরে নেয় সুহাস। অর্হিতা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে সন্ধানী গলায় বলল—

“পিউ কোথায়?”

মুহূর্তেই সিঁড়ির দিক থেকে ঠকঠক আওয়াজ আসছে। ছোট্ট পিউলীর ক্রিকেট ব্যাট দ্বন্ধ লাগিয়েছে সিঁড়ির সাথে। সুহাসের কাছে এসে দাঁড়ায় পিউলী। চোখভরা আশা নিয়ে বলল—

“বল নাও।”

সুহাস টেনিস বলটা হাতে নেয়। পিউলী সুহাসের আঙুল আঁকড়ে ধরে। টুকটুক করে বলল—

“চলো, চলো আঙ্কল। আমরা খেলব।”

অর্হিতা বাঁধা দিয়ে বলল—

“পিউ দুধটা খেয়ে যাও সোনা।”

“না। খাবো না এখন। আমি খেলব। চলো আঙ্কল।”

সুহাস মৃদুহাস্য অধরে বলল—

“চলো।”

সুহাসকে টেনে টেনে ব্যাক ইয়ার্ডে নিয়ে যায় পিউলী। গাছগাছালির মায়ার ঘেরা শান্ত পরিবেশ। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া। পত্র-পল্লবে নিবিড় ছায়ায় রোদ্দুর ঝলসানো তাপ নেই বললেই চলে। পিউলীর খুশি তার চোখে -মুখে উপচে পড়ছে। অতি সাবধানে বল ছুড়ে দেয় সুহাস। পাছে পিউলীর লেগে না যায়!
অকস্মাৎ ব্যাট হাতে দৌড়াতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে পিউলী। মাখনের শরীরে আঘাত লেগেছে। থামায় কার সাধ্যি! একটুখানি ব্যাথাতেই পুরো বাড়ির আঙিনা কাঁপিয়ে ফেলল পিউলী। অর্হিতা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসে। তার কান মিথ্যে শুনেনি। অস্পষ্ট আওয়াজ শুনে দৌড়ে আসে সে। পিউলী তখন সুহাসের ক্রোড়ে।

“কী হয়েছে?”

“তেমন কিছু নয়। খেলতে গিয়ে পড়ে গেছে।”

“এই জন্যই আমি বারণ করেছি।”

“বাচ্চা মানুষ! খেলতে গিয়ে একটু পড়বেই। এত চিন্তার কিছু নেই ভাবীজান।”

“দিন ওকে আমার কাছে।”

“একটা বাচ্চাকে সামলানোর ক্ষমতা আছে আমার। চলুন।”

পিউলী সমানতালে কেঁদেই যাচ্ছে। ক্রন্দনরত গলায় তার একটাই আবদার,” পাপাকে ডাকো, পাপাকে ডাকো।” প্রথমে বাঁধ সাধলেও পরে নায়েলকে কল করে অর্হিতা। কারো কথায় কান্না থামছে না পিউলীর। যতক্ষন না নায়েল এসে পিউলীকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে।

বাবার কোলে শান্ত হয়ে লেপ্টে আছে পিউলী। কাঁদতে কাঁদতে ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে। চোখ ফুলে টমেটো! ঘুমিয়ে পড়েছে কিছুক্ষণ আগেই। নায়েল নম্র স্বরে বলল—

“আপনার খেয়াল রাখা উচিত ছিল অর্হিতা।”

অর্হিতা ফ্যাকাশে গলায় বলল—

“আসলে আমি….।”

“ভাবীজানের কোনো দোষ নেই বড়ো ভাই। আর বাচ্চা মানুষ, একটু আকটু পড়বেই। নাহলে বুঝবে কী করে ব্যাথায় যন্ত্রণা কত হয়!”

শেষের লাইটা কেমন অদ্ভুত শোনালো অর্হিতার কাছে। তাতে রোষ ছিল।
নায়েল তীর্যক গলায় বলল—

“কী বলতে চাও তুমি?”

“তেমন কিছু না। খেলতে গিয়ে পড়েছে। মলম লাগিয়ে দিন ঠিক হয়ে যাবে। এইটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার প্রয়োজন নেই।”

“জাস্ট শাট আপ। দায়িত্ব নিলে তা পালন করতে হয়। ও তোমার সাথে খেলতে গেছে, সেক্ষেত্রে তোমার ওর খেয়াল রাখা উচিত ছিল।”

নায়েলের জোর গলায় নড়ে ওঠে পিউলী। সুহাস ঝরা হাসে। রসালো গলায় বলল—

“বড়ো ভাই, ব্যাটসম্যান ব্যাট নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেছে, সেখানে বোলার কী করতে পারে বলুন? সেইটা তো বোলারের জন্য সুযোগ!”

দাঁত কিড়মিড় করে নায়েল। অগত্যা সে চুপ করে রইল। স্বগতোক্তি( মনে মনে বিড়বিড় করা) করে সুহাস,” নিজের সন্তান না হওয়া সত্ত্বেও একটুখানিতে এত কষ্ট লাগছে তোর! আর তোর কারণে যে আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি তার হিসেব কে দেবে? তোকে যদি আমি পাগলা কুকুরের মতো দৌড় না করিয়েছি, তো আমিও সুহাস নই মনে রাখিস।”
,
,
,
মুখ নিঃসৃত ধোঁয়ায় অবগাহন( গোসল,সিক্ত) করছে সুহাস। বিছানায় আরাম করে বসে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। পড়ার টেবিলে বসে আছে হৃতি। সিগারেটের গন্ধে পড়ায় মন বসাতে পারছে না। গা গুলিয়ে উঠছে তার। তবুও বইয়ের দিকে তাকিয়ে ঠাঁয় বসে আছে। সুহাস কোমল গলায় ডেকে উঠে—

“হৃতি, তোমার পরীক্ষা কবে?”

হৃতি সহজ গলায় প্রত্যুক্তি করে—

“আগামী মাসে।”

“এদিকে এসো।”

সুহাসের সামনে এসে বসে হৃতি। তার মুখভর্তি ধোঁয়ার পাক ছুড়ে দেয় হৃতির স্বচ্ছ মুখে। কেঁশে ওঠে হৃতি। অনুরক্তির সুরে বলল—

“এসব কেন খাও তুমি?”

সুহাস লম্বা টান মারে সিগারেটের ফিল্টারে। শূন্যে ধোঁয়া ছুড়ে বলল—

“পৃথিবী ভুলতে।”

হৃতির করুন দৃষ্টি। সিগারেটের বাকি অংশ অ্যাশ ট্রেতে রেখে হৃতির হাত নিজের হাতে নেয় সুহাস। হাতের উলটো পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল—

“নায়েল পিউলীর বায়োলজিক্যাল ফাদার নয় তাই না?”

হৃতি নির্বিকার গলায় বলল—

“হুম।”

“পিউলীর বাবা কোথায় জানো?”

“না। আমি কখনো তাকে দেখিনি।”

সুহাস রহস্য হাসে। হৃতি সংকীর্ণ গলায় বলল—

“তুমি এমন কেন করছ সুহাস? এসব নেশা কেন ছেড়ে দিচ্ছ না?”

“তোর কথায় ছেড়ে দেবো? কে তুই আমার? যা এখান থেকে।”

টলটল করে ওঠে হৃতির চোখ। হৃতি ভেজা গলায় প্রশ্ন করে—

“কেন এমন করছ তুমি? কী করেছি আমি?”

সুহাস তেড়ে যায়। ক্ষুব্ধ গলায় বলল—

“কী করিস না তোরা? তোরা মেয়েরা সব পারিস। টাকার জন্য নিজের সন্তানকে ফেলে আসতে পারিস, টাকার জন্য নিজের অনাগত সন্তানকে মেরে ফেলতে পারিস, টাকার জন্য ভালোবাসার মানুষকে রাস্তায় ফেলে আসতে পারিস। টাকাই সব তোদের কাছে সব। মানি ইজ লাইফ, মানি ইজ লাভ। এখন আমার কাছেও তা। কেউ যদি আমাকে দশ লাখ টাকা দিয়ে বলে তোকে দিয়ে দিতে, আমি দিয়ে দেবো। টাকা চাই আমার।”

ঝমঝম করে কেঁদে ফেলে হৃতি। সন্তর্পনে সুহাসের হাত তার নিজের বক্ষস্থলে চেপে ধরে বলল—

“তোমার হৃৎপিন্ডে হাত রেখে বলো, তুমি পারবে টাকার জন্য আমাকে অন্য কারো কাছে দিয়ে দিতে? সহ্য করতে পারবে তোমার সামনে অন্য কেউ আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলে? ভাবতে পারবে তোমার জায়গায় অন্য কেউ আমাকে ভালোবেসে আদর করছে?”

সুহাসের মেজাজ চওড়া হয়। খটমটিয়ে উঠে বলল—

“একদম ন্যাকামি করবি না আমার সামনে। যা এখান থেকে। যা আমার চোখের সামনে থেকে।”

হৃতির চোখের শ্রাবণে প্লাবিত হচ্ছে তার কপোল(গাল)। সে জানে, সুহাস তাকে ভালোবাসে। একদিন কলেজের সামনে একটা ছেলে হৃতিকে টিজ করেছিল বলে ছেলেটিকে ইচ্ছেমতো রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে ছিল সুহাস। কলেজের প্রায় ডজনখানেক শিক্ষার্থীর সামনে তাকে প্রপোজ করেছে। কিন্তু সেই মানুষটাই হঠাৎ বদলে গেল। কেন?
তার উত্তর হৃতি জানে না।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here